পান পাতার বৌ পর্ব-০৯

0
137

#পান_পাতার_বৌ
নবম_পর্ব
~মিহি

শর্বরীর ঘুম আসছে না। সীমান্ত ল্যাপটপে কী যেন করছে। একটু পরপর বিরক্তিতে উঠে হেঁটৈ বেড়াচ্ছে সে। বিষয়টা লক্ষ করলো সীমান্ত। হাত ধরে বিছানায় বসালো শর্বরীকে।

-“লাইট অফ করে দিচ্ছি, ঘুমাও তুমি।”

-“আমার ঘুম আসছে না।”

-“কেন? বারোটা পেরিয়েছে তো।”

-“দুপুরে অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছি। মা তো কোনো কাজই করতে দেননি আজ। আমাকে খাওয়ায়ে ফুলবাবুর মতো ঘুমোতে পাঠিয়েছেন।”

-“বাহ! ভালোই, বউমা পেয়ে ছেলের আর খবর নেয় না। আচ্ছা শোনো, তোমার ক্যাম্পাসে যাওয়া ম্যান্ডাটরি নাকি শুধু পরীক্ষা এটেন্ড করবে?”

-“পরীক্ষাই দিব শুধু।”

-“বই যা যা লাগবে আমাকে বলো, আমি কাল এনে দিব। আর নেক্সট উইক সম্ভবত শহরের বাইরে যেতে হবে আমার। এক সপ্তাহের জন্য আউট অফ সিটি থাকবো হয়তো।”

-“ওহ।”

-“তোমাকে সাথে নিয়ে যেতে পারলে ভালো হতো। তোমার যে গোয়েন্দা বুদ্ধি, চট করে কেসটা সলভ হয়ে যেত!”

শর্বরী কিছু বলল না। সীমান্তর কথা আনমনে শুনতে লাগলো। ঘুম না আসায় অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। অবশ্য সে ঘুমাতে ভয় পাচ্ছে কিছুটা। আবার যদি ঘুমের মধ্যে হেঁটে সে উল্টোপাল্টা কিছু করে বসে? তার চেয়ে বরং জেগেই থাক!

-“চুপচাপ বিছানায় শুয়ে থাকো, এমনি ঘুম চলে আসবে।”

শর্বরী সীমান্তর কথা শুনলো না, উল্টো সীমান্তর বুকে পিঠ ঠেকিয়ে তার কোলে জায়গা করে নিল সে। সীমান্তও ল্যাপটপ রেখে শর্বরীর উপর ধ্যান-জ্ঞান অর্পণ করলো।

-“আপনি ঐ কেসটার তদন্তের জন্য যাচ্ছেন?”

-“হুম। একটা ক্যারেক্টার মিসিং, তাকে খুঁজতে যাচ্ছি।”

-“আমি একা থাকবো?”

-“একা কোথায়? মা আছে তো, সবাই আছে। বাবার বাড়িতে যেতে চাচ্ছো?”

-“না। বাবার সাথে একসাথে গিয়ে কথা বলতে হবে। কাল যাই একবার আমরা দুজন? আমি একা গেলে বাবা প্রচুর রাগ করবেন। আপনি থাকলে হয়তো ম্যানেজ হয়ে যাবে।”

সীমান্ত কিছু একটা ভেবে মাথা নাড়লো। অতঃপর শর্বরীর চুলের মাঝে নাক গুঁজলো। শর্বরী চুপচাপ চোখ বন্ধ করে আছে। একটা মানুষকে হঠাৎ ভালোবাসা যেতে পারে এটা সে সীমান্তকে না পেলে কখনো বিশ্বাস করতে পারতো না।

________________________

-“এখানে কেন এসেছো? বিয়ে যখন করেই ফেলছো, বাবার বাড়িতে আসার প্রয়োজন কী?”

-“বাবা…”

-“সম্পত্তির ভাগ নিতে আসছো?”

-“বাবা, এভাবে বলো না। আমি পরিস্থিতির কাছে বাধ্য ছিলাম। তুমি তো সীমান্তকেই বেছে নিয়েছিলে আমার জন্য। এখন তো সবাই রাজি তবে এখন কেন এমন করছো? বাবা আমার খুশির কথা ভাববে না তুমি?”

শফিক সাহেবের মন গললো। সত্যিই তো! তিনি তো মেয়ের খুশিই চেয়েছিলেন। এখন যখন মেয়ে সুখে আছে তখন তিনি কেন অযাচিত দুঃখ হবেন মেয়ের জন্য? আবেগতাড়িত হয়ে পড়লেন তিনি। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে মেয়েজামাইকে ডাকলেন কাছে। আরজু বেগমকেও ডাকলেন সাথে সাথেই। আরজু বাইরের কথাবার্তা শুনতে পায়নি তবে শফিক সাহেবের চেঁচানো শুনে বাইরে এলেন তিনি। শর্বরীকে দেখে তার মুখে অন্ধকারে নেমে এলো। শর্বরী কি জানতে পেরেছে তার ভাগের জমি বিক্রি করার পুরোপুরি বন্দোবস্ত আরজু করে ফেলেছে? ভয়ে কেঁপে উঠলেন তিনি।

-“আরজু, প্রথমবার মেয়ে-জামাই আসছে। ভালো করে রান্নাবান্না করো। বাজার-টাজার কিছু আনতে হবে?”

-“না। মাছ-মাংস আছেই, রাঁধতেছি। আসো বাবা ভেতরে আসো।

সীমান্ত এতক্ষণ অস্বস্তিবোধ করছিল, এখন খানিকটা আশ্বস্ত হলো। শর্বরীর ঠোঁটেও হাসি ফুটলো। সীমান্ত প্রথমবার শর্বরীর ঘরে পা রাখলো। বেশ গোছানো ঘরটা। বইগুলো একপাশে সজ্জিত, টেবিলের ঠিক সামনে দেয়ালে স্টিকি নোটস লাগানো। বেডসাইড টেবিলের পাশে একটা ফ্রেমে শর্বরীর একটা ছবি। সীমান্ত ফ্রেমটা হাতে নিয়ে শর্বরীর ছবিতে চুমু খেল। ঘরে ঢোকার সময় ব্যাপারটা লক্ষ করেও না দেখার ভান করে সীমান্তকে পাশ কাটিয়ে যেতে চাইলো। সীমান্ত পেছন থেকে হাত টেনে ধরলো শর্বরীর।

-“পালানো হচ্ছে? বরকে নারাজ করলে পাপ হবে, পাপ!”

-“আহা, ঢঙ! শ্বশুরবাড়ি আসছেন, ভদ্র বাচ্চার মতো থাকেন। একদম কোনো দুষ্টুমি না।”

-“কবে করলাম দুষ্টুমি হ্যাঁ?”

সীমান্ত ধীরে ধীরে শর্বরীর ঠোঁটের দিকে এগোতে লাগলো। শর্বরী এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। সময়টাও বোধহয় ধীর গতিতে চলতে শুরু করেছে…

“স্যরি স্যরি আমি দেখিনি কিন্তু!” শর্বরী বিরক্ত হয়ে তাকালো মেয়েটির দিকে। পাশের বাড়ির মেয়ে, তুরফা। মেয়েটাকে বলতে গেলে একটু অপছন্দই শর্বরীর। এই যেমন আজ নক না করে ঘরে ঢুকে পড়েছে, এমনই তার কীর্তিকলাপ।

-“নক করে আসতে হয় তুরফা!”

-“স্যরি, আসলে নতুন দুলাভাইকে দেখার এক্সাইটমেন্ট! দুলাভাই তো জোসস। লুকায়ে রাখছো ক্যান আপু? শালীর সাথে পরিচয় করাও!”

-“লুকানোর কী দেখলি তুই? মাত্র আসছি আমরা। ফ্রেশ হয়ে বিকেলে পরিচয় করাবো। এখন যা।”

-“আচ্ছা। ভাইয়া বিকেলে আপনাকে ঘুরতে নিয়ে যাবোনি, রেডি থাকিয়েন।”

সীমান্ত চুপচাপ ঘটনাটা দেখলো। তুরফা চলে যেতেই শর্বরী দরজা লাগিয়ে দিল। মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে তার। এই মেয়েটাকে খবর দিল কে? সারাদিন আরেকজনের বাড়িতে দূরবীন লাগিয়ে বসে থাকা মানুষকে শর্বরীর মোটেও পছন্দ না। সীমান্ত শর্বরীর মন খারাপটা বুঝলো।

-“আরে বাচ্চা মেয়ে ও! তুমি রাগছো কেন? বাদ দাও তো।”

-“ও বাচ্চা না সীমান্ত, আপনি ওর থেকে সোশ্যাল ডিসট্যান্স মেনে চলবেন। ও যেন আপনার ধারে-কাছেও না ঘেঁষে বলে দিচ্ছি।”

-“যথা আজ্ঞা বউ! আপনার হুকুম শিরোধার্য। এখন যে কাজটা বাকি ছিল ঐটা শেষ করি?”

শর্বরী সরে যেতে চাইলেও সীমান্ত আটকালো। শর্বরীর দিকে এগোতে যাবে ঠিক সে সময় দরজায় টোকা পড়লো। সীমান্ত বিরক্ত হয়ে সরে দাঁড়ালো।

-“ধূর! ‘ইতনি সি বাত’ এর ইমরান হাশমি নাকি আমি? কেউ কিস করতেই দিচ্ছে না ধ্যাত! যাও তো যাও, সব কাজ শেষ করে আসো। বরের কথা যখন মনে হয় তখন আসো।”

সীমান্ত চুপচাপ বিছানায় গিয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো।

-“এই গরমে কাঁথা? রাগ করারও তো একটা তরীকা আছে! এ কেমন রাগ?”

সীমান্ত কাঁথা আরো ভালো করে মুড়িয়ে নিল। শর্বরী হাসতে হাসতে রান্নাঘরের দিকে গেল। আরজু বেগম একা রান্না করছেন, হাতে হাতে কিছুটা এগিয়ে দিক বরং।

-“তুই আসলি যে? জামাই একা ঘরে?”

-“হুহ। সাহায্য করি একটু, একা এত কিছু করা লাগবে না তোমার।”

-“তোর শরীর ভালো? রাতে এখনো হাঁটিস? ওষুধ খাচ্ছিস?”

শর্বরী বিব্রতবোধ করলো। একটা রাতেও সে ঘুমোয়নি, এ কথা মাকে কিভাবে বলবে সে? শর্বরী মাথা নাড়িয়ে কেবল বোঝালো যে সে ওষুধ খাচ্ছে ঠিকঠাক। রান্নাঘরে কাজের ফাঁকেই শর্বরী লক্ষ করলো তুরফা বারবার তার ঘরে উঁকি দিচ্ছে। তুরফার ঘরের জানালা আর শর্বরীর ঘরের জানালা পাশাপাশি। তার ঠিক পাশেই রান্নাঘর। রান্নাঘরের জানালা দিয়ে লক্ষ করলো শর্বরী। তুরফা একটু পরপর ঘরে আসছে, মুখে ভালোই পাউডার মেখেছে। শর্বরী বুঝতে পারছে সবটাই সীমান্তকে দেখানোর ধান্দা। এজন্যই তুরফাকে তার পছন্দ না! এই মেয়েটা অপরিচিত ছেলে দেখলেই মোমের মতো গলতে থাকে। তাই বলে একটা বিবাহিত ছেলের সামনেও এসব? রাগে মাথায় দপদপ করে আগুন জ্বলছে শর্বরীর। তুরফা সীমা অতিক্রম করে ফেলল একটু বাদেই। ওড়না ছাড়া দিব্যি জানালার কাছে এসে আনমনে দাঁড়িয়ে আছে। শর্বরী রান্না ফেলে সীমান্তর ঘরে গেল। সীমান্ত তখনো কাঁথা মুড়ি দিয়েই আছে। তুরফার এসব রঙঢঙ নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই তবে শর্বরীর আছে। রাগে কাঁপছে শর্বরী। সীমান্তর গা থেকে কাঁথা সরিয়ে খানিকটা আকস্মিকভাবেই সীমান্তর ওষ্ঠদ্বয় দখলে নিল সে। অকস্মাৎ এমন ঘটনায় সীমান্ত ভড়কালো ঠিকই তবে পরমুহূর্তেই সে শর্বরীর ভালোবাসায় নিজেকে আবৃত করলো। ক্ষণিক সময় বাদে সরে এলো শর্বরী। তুরফা সরে গেছে জানালা থেকে। তবে এ দৃশ্যটা যে সে দেখেছে এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই শর্বরীর। সীমান্ত একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। শর্বরীর এ হঠাৎ আক্রমণ তাকে ঠিক কতটা ঘায়েল করেছে তা দেখাতে পারলে তাকে চরম অসভ্য বলে ফেলবে তার অর্ধাঙ্গিনী!

চলবে…

[নতুন নতুন বিয়ে তো তাই ভালোবাসা একটু বেশি বেশি!]