পান পাতার বৌ পর্ব-২৩ এবং শেষ পর্ব

0
290

#পান_পাতার_বৌ
শেষ_পর্ব
~মিহি

শর্বরীর আগামী পরশু থেকে ফাইনাল সেমিস্টারের পরীক্ষা শুরু। সীমান্ত একটা কেসের কাজে শহরের বাইরে গেছে। সীমান্তর বাবাও একটা দরকারি কাজে কিছুদিনের জন্য শহরে নেই। বলা চলে আগুন এবং পেট্রোল এক বাড়িতে অবস্থান করছে। যদিও শর্বরী বাপের বাড়ি থেকে আসার পর তাদের মধ্যে কোনোরকম বাকবিতণ্ডা হয়নি। শর্বরীর রাতে হাঁটার অভ্যেসটাও অনেকটা দূর হয়েছে তাই নতুন কোনো ঝামেলায় তাকে পড়তে হয়নি। এর মধ্যে একদিন সালমা খানম মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে গিয়ে আলেয়ার সাথে দেখা করে এসেছেন। সে খবর অবশ্য শর্বরী জানেনা। আলেয়া কেবলমাত্র শর্বরীর একটু যত্ন নিতে বলেছে। সে কথা ভালোই মনে লেগেছে সালমা খানমের। আলেয়া একটু পরপর সব ভুলে যাচ্ছে অথচ নিয়ম করে ঠিকই শর্বরীর যত্ন নিতে বলেছে। অবশ্যই শর্বরীর প্রতি তার মায়া-মমতা কম নয় তবুও সে পুলিশি নজরবন্দিতে ঐ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে আছে! তাও কিনা শর্বরীর উপর আক্রমণ করার জন্য। এসব সে নিজেই স্বীকার করেছে। শর্বরী চেয়েছে কেস তুলে নিতে কিন্তু আলেয়া রাজি হয়নি। সে মুক্ত হাওয়ায় বেরোতে চায় না। তার মনে হয় একাকী থাকলেই বুঝি সে নিজেকে শেষ করে ফেলবে। সালমা খানম আনমনে কী যেন ভাবছিলেন। ভাবতে ভাবতে নিচ থেকে তিন সিঁড়ি উপরে পা রাখতেই বেকায়দায় পা পড়লো। তৎক্ষণাৎ গড়িয়ে পড়লেন নিচে। প্রচণ্ড আহাজারি ও আর্তনাদে গলা বসে এলো তার। তড়িৎ গতিতে ছুটে এলো শর্বরী। সালমা খানমকে নিচে পড়ে থাকতে দেখে চটজলদি তার নিকট গেল সে। সালমা খানমকে ধরে তোলার চেষ্টা করলো সে। সালমা খানম মোটেও উঠতে পারছেন না। সম্পূর্ণ ভারটা নিজের কাঁধে নিয়ে সাবধানে সালমা খানমকে সোফায় বসালো শর্বরী। ব্যথায় কাঁতরাচ্ছেন সালমা খানম।

-“আম্মা আপনি একটু বসেন, আমি তিথি আপুকে ডাকছি।”

-“ও কী হাড়ের ডাক্তার? ও কী বুঝবে? আমার হাড়টা বোধহয় গেল।”

-“আচ্ছা মা, একটু শান্ত হন। আমি ব্যবস্থা করছি। আপনার এক্সাক্ট কোথায় লেগেছে একটু বলুন আমায়।”

-“আমি এখন তোমায় বোঝাতে বসবো কোথায় কোথায় লেগেছে? তুমি ডাক্তার?”

যন্ত্রণায় আবার চেঁচামেচি করতে লাগলেন সালমা খানম। শর্বরী বুঝতে পারছে উনি ব্যথায় কিছু বলতে পারছেন না। রাত প্রায় এগারোটা। এখন আশেপাশে ডাক্তার পাওয়া মুশকিল। আম্মাকে নিয়ে এভাবে হাসপাতালেও যেতে পারবে না সে। শর্বরী দ্রুত হট ওয়াটার ব্যাগ এনে সালমা খানমের কোমড়ে চেপে ধরলো। কিছুক্ষণ ইতি-উতি করলেও ব্যথা অনেকটা কমলো। শর্বরী তার এক ডাক্তারি পড়ুয়া বান্ধবীকে কল দিয়ে ঘটনা বললো। তার থেকে পরামর্শ নিয়ে প্রাথমিক উপায়ে সালমা খানমের ব্যথা অনেকটা নিরাময়ের ব্যবস্থা করলো শর্বরী। এখন সমস্যা হচ্ছে হাড় ভেঙেছে কিনা। এটার জন্য এক্সরে করাতে হবে। সকালের আগে সেটা সম্ভব না। পেইন কিলারে সালমা খানমের ব্যথা যতটুকু না কমলো তার চেয়ে বেশি কমলো শর্বরীর কালোজিরে মেশানো গরম সরিষার তেলের মালিশে। খানিকটা স্বস্তি বোধ করলেন তিনি। সোফায় ঘুমালে আরো অসুবিধা হবে ভেবে শর্বরী সালমা খানমকে নিচের ঘরেই শুয়ে দিতে চাইলো। কিন্তু ঘর অবধি যাওয়ার চেষ্টাটুকুও সালমা করে উঠতে পারবেন কিনা সন্দেহ। শর্বরীর কাঁধে হাত রেখেই ধীরে ধীরে ঘরে পৌঁছালেন তিনি। শর্বরী সালমা খানমকে শুয়ে দিয়ে তেল মালিশ অব্যাহত রাখলো। সীমান্তর নম্বরে কল করলো শর্বরী কিন্তু আউট অফ রিচ বলছে। শ্বশুরমশাইকে কল করার সাহস পেল না সে। মানুষটা দূরে আছে, এমন দুঃসংবাদ হঠাৎ কিভাবে ফোনে বলবে? শেষমেশ সাইবাকে কল করলো সে। একমাত্র সাইবাই এ সময় তার কাজে আসতে পারে। সাইবার নম্বরটাও বন্ধ বলছে। শর্বরী এখন খানিকটা দুশ্চিন্তায় পড়েছে। সালমা খানমের পাশেই বসে সে। কেউ নেই তাকে একটু সাহস জোগানোর জন্য। শর্বরী নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলো। সংসারটা তারও, দায়িত্ব পালনে পিছপা সে কোনভাবেই হতে পারে না।

_______

রাত দুটো নাগাদ ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠলেন সালমা খানম। শর্বরী পাশেই বই নিয়ে বসেছিল। সালমা খানমের আর্তনাদে সে দ্রুত তার কাছে গেল।

-“আম্মা, কী হয়েছে আপনার? ব্যথা বেশি করছে?”

সালমা খানম কিছু বলতে পারছেন না। যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে যাচ্ছেন কেবল। শর্বরী আর ভাবার অবকাশ পেল না। এম্বুলেন্সে কল করলো সে। এতক্ষণের প্রাথমিক চিকিৎসাতেও যখন সালমা খানম ব্যথা অনুভব করছেন তখন আর রিস্ক নেওয়া উচিত না। এম্বুলেন্স আসা অবধি হট ওয়াটার ব্যাগ এবং তেলের মালিশ বজায় রাখলো শর্বরী। সালমা খানম একটু পর পর যন্ত্রণায় কাঁতরাচ্ছেন। এম্বুলেন্স এলো আধঘণ্টা পর। স্ট্রেচারে করে সালমা খানমকে নিয়ে যাওয়া হলো। শর্বরীও সাথে সাথেই গেল। এ মুহূর্তে সালমা খানমের সুস্থতা ছাড়া তার মাথায় আর কিছু কাজ করছে না। হাসপাতালে সব ঠিকঠাক করতে করতে রাত তিনটার কাছাকাছি বাজলো। সালমা খানমের বাম পায়ে প্লাস্টার করাতে হবে এবং একমাসের ফুল বেড রেস্টে থাকতে হবে। শর্বরী ইতোমধ্যে সব ফর্মালিটি পূরণ করে সালমা খানমের কেবিনের দিকে এগোলো। সীমান্তও নেই, সাইবাও কল রিসিভ করলো না। সৌমিকেরও পরীক্ষা চলছে। তাকে কল করে অযথা দুশ্চিন্তায় ফেলা উচিত হবে না। শর্বরীর মাথা ব্যথা করছে। সারাদিনের কাজ তারপর থেকে এমন ছোটাছুটি, সব মিলিয়ে সেও অনেকটা ক্লান্ত। হাসপাতালের বেঞ্চেই শেষরাতের সময়টুকু কাটলো তার। সকালবেলা সালমা খানমের চেক আপ করার সময় ডাক্তার ডাকলেন তাকে। সালমা খানম তখন ঘুমিয়ে।

-“আপনার পরিবারে আর কেউ নেই? গতকাল রাত থেকে একা সব করছেন। কোনো পুরুষ সদস্য নেই? আপনার মায়ের এ অবস্থায় আপনার ভাইয়ের থাকা উচিত ছিল।”

-“আসলে…”

-“থাক আপনি অনেক ক্লান্ত, আপনি বরং বাসায় গিয়ে একটু বিশ্রাম করুন এবং অন্য কাউকে হাসপাতালে পাঠিয়ে আপনার মাকে নিয়ে যেতে বলুন।”

-“আম্মাকে এখনি বাসায় নিয়ে যাওয়া যাবে?”

-“জ্বী তবে আপনি একা বোধহয় পারবেন না।”

শর্বরী সালমা খানমের শরীরের খোঁজ খবর নিল। সাইবার নম্বর এখনো বন্ধ। শর্বরী বুঝে উঠতে পারছেনা এ মুহূর্তে কী করবে। সালমা খানমের পাশে বসলো সে। তিনি ঘুমাচ্ছেন। শর্বরী তাকালো। চোখ ছলছল করছে তার। আনমনেই বলতে লাগলো সে,”মায়ের আদরের প্রসঙ্গ বোধহয় আমার জীবন থেকে বাদই দিয়েছে নিয়তি। মায়ের ভালোবাসাও পাইনি কখনো সেখানে শাশুড়ির ভালোবাসা পাওয়ার প্রত্যাশাও বিলাসিতা! আপনি শুধু সুস্থ হয়ে উঠুন আম্মা। আবার আগের মতো আমাকে বকাঝকা শুরু করুন।” চোখ বেয়ে অনবরত জল গড়াচ্ছে শর্বরীর। সবসময় অস্থিরচিত্ত সত্তাটা আজ বড্ড নিস্তেজ। যার কদমের শব্দে বাড়ি মাথায় উঠতো, সেই পা আজ প্লাস্টারে আবদ্ধ। দীর্ঘশ্বাস ফেলল শর্বরী। সালমা খানম সবই শুনলেন তবে চোখ খুললেন না। অনুতাপে তার চোখও খানিকটা আর্দ্র হয়ে আসলো বোধহয়। নার্সের সহায়তায় সালমা খানমকে গাড়ি অবধি নিয়ে গেল শর্বরী। বাড়িতে নিয়ে এসে তাকে নিচতলাতেই শুয়ে দিল। পাড়া-প্রতিবেশীরা এ অবস্থা দেখে এগিয়ে এলেন, খোঁজ খবর নিলেন। রাতে তাদের না জানানোতে খানিকটা রাগও দেখালেন। শর্বরী কিছু বললো না। রাতে এম্বুলেন্স এলো, কেউ একটাবার বেরিয়ে দেখলোও না কী হয়েছে অথচ এখন এমন মুখোশধারী সেজে বসে আছে!

সাইবা এলো বিকেলবেলা। তার ফোন পানিতে পড়ে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। খোঁজ পেয়েই সে ছুটে এসেছে। শর্বরীকে একা হাতে সব করতে হচ্ছে দেখে সাইবারও খানিকটা খারাপ লাগলো। মেয়েটার পরীক্ষা অথচ সে সব ধ্যান-জ্ঞান নিজের শাশুড়ির সেবায় দিয়ে রেখেছে। সাইবাও সঠিক সময়ে একটু সহায়তা করতে আসতে পারেনি।
শর্বরী রান্না করছে। সাইবা তার মায়ের পাশে বসে আছে।

-“সাইবা!”

-“হ্যাঁ মা বলো। কিছু লাগবে?”

-“তোর ভাবী কোথায়? কাজ রেখে পড়তে বসতে বল। ফেল করা বৌমাকে আমি মেনে নিব না কিন্তু!”

সাইবা অবাক চোখে নিজের মায়ের দিকে তাকালো। তার মা শর্বরীকে মেনে নিয়েছে ভাবতেই তার মন আনন্দে নেচে ওঠে। ঠোঁটের কোণা প্রসারিত হয়ে আসে তার।

শর্বরী রান্নায় ব্যস্ত। সংসারের দায়িত্বটা এখন পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারছে সে। রান্নাবান্না সে ইদানিং নিজেই করছিল তবে এখন সমস্ত সংসারের দায়িত্বটাই তার ঘাড়ে এসে পড়েছে। সবটা সামলাতে হচ্ছে তাকে। এসবের শিক্ষা সে যথেষ্ট পেয়েছে আরজু বেগমের থেকে। কাজ করার বেলায় আরজু বেগম তাকে কখনো ছাড় দেননি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে শর্বরী। বাবা তার মাকে মাফ করেছেন। অনুতপ্ত দোষীর জন্য ক্ষমাপ্রাপ্তিটাও কাঁটার ন্যায় ঠেকে। শর্বরী সেই কাঁটাটাও দিতে পারবেনা তার মাকে। বাবার মতো অত বড় হৃদয় তার না। মাকে ক্ষমা করতে পারেনি সে। আনমনে এসব ভাবতে ভাবতেই প্রেশার কুকারের শিস বাজলো। গ্যাসের চুলা বন্ধ করতেই সাইবা এসে পাশে দাঁড়ালো তার।

-“এই যে ভাবী!”

-“জ্বী আপু।”

-“তোমার শাশুড়িমা বলেছে সে ফেল করা বৌমাকে মেনে নিবে না। তাই যাও পড়তে বসো। এদিকটা আমি সামলে নিব। অনেক তো মায়ের রাগ দেখেছো, এখন ভালোবাসার স্বাদটাও পাবে!”

শর্বরী উদভ্রান্তের ন্যায় তাকালো সাইবার দিকে। আসলেই? সালমা খানম তাকে মেনে নিয়েছেন? শর্বরীর একবার ইচ্ছে হলো সাইবাকে চিমটি কাটতে বলতে। পরক্ষণেই নিজের পাগলামিতে নিজেই হেসে ফেললো সে। ঘর থেকে সালমা খানম তখন চেঁচিয়ে বলছেন,” রান্নাঘরে খিঁ খিঁ না করে পড়তে বসুক! ফেল করলে তো আমার ছেলের মান ডুবাবে।” শর্বরী হাসতে হাসতে বই নিয়ে বসে।

পরিশিষ্ট- ছাদের কার্নিশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সীমান্ত। শর্বরী তার বুকের সমস্তটুকু দখল করে দাঁড়িয়ে। দূর আকাশে চাঁদ আর মেঘের লুকোচুরি চলছে। সেদিকেই তাকিয়ে একজোড়া দৃষ্টি।

-“তুমি আমার পান পাতার বউ।”

-“সেটা আবার কী?”

-“দেখতে নাজুক কিন্তু মুখে পুরতে চাইলে জ্বালিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখো।”

-“আপনি জ্বলতে প্রস্তুত?”

-“বরাবরই!”

শর্বরী সীমান্তর চোখের দিকে তাকায়, অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে খানিকক্ষণ। সে তাকানোর চাহনি কিংবা দৃষ্টির গভীরতা ভেদ করার সাধ্য কি সীমান্তর আছে? সে তো পরাস্ত! বশবর্তী সে এই চোখের মায়ায়!

সমাপ্ত