#পুনর্মিলন
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_১১
“আমি ফাল্গুনীকে চাই মা। আমি ওকে ছাড়া থাকতে পারবো না। আমি ওকেই চাই। আপনি ওকে দিন আমায়। আমি কথা দিচ্ছি, ওর চোখে আমায় নিয়ে আর নতুন কোন আক্ষেপ এর অশ্রু বইতে দেবো না। এমনকি পুরোনো যত আক্ষেপ আর অভিযোগ আছে সব মুছে দেবো আমি, সব।”
জাগ্রত হাত জোড় করে আকুতিভরা কথাগুলো বলে উঠলো দৃঢ়তার সঙ্গে। আচমকা জাগ্রতর মুখ থেকে এমন কথা শুনে চমকে গেছে ঘরে উপস্থিত সবগুলো মানুষ। সবথেকে খুশি হয়েছে নিশান আর আঁখি। দুজনের মুখেই উপচে পড়া হাসি ঝুলে আছে স্বমহিমায়। বিলাসি দেবী নিরব। তার মুখভঙ্গিতে কোন কিছুর রেষ মাত্র নেই। বোঝা যাচ্ছে না তার মনের অবস্থা। ফাল্গুনীও ভাবলেশহীন। মনের কোন আবেগ অনূভুতির ঠায় দেয় নি মুখের আদোলে। আড়াল করে নিয়েছে সমস্ত হৃদয়াবেগ। তবে তা মুখটাকে বন্ধ করে নয়। সে মুখ খুললো আবার। কঠিন অভিব্যক্তিতে স্পষ্ট গলায় বললো,
“আপনার একার চাওয়াতে কিচ্ছু যায় আসে না। কোর্ট আপনার একার চাওয়ার উপর ভিত্তি করে আমাদের সম্পর্কের চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বলে নি। আমাদের দুজনকেই একে অপরকে চাইতে হবে। আমি তো আপনাকে চাই না। না আপনাকে চাই আর না আপনার পরিচয়।”
“তুমি না চাইলেও তোমার পরিচয় এখনো কিন্তু সেই চার বছর আগের পরিচয়ই আছে। তুমি এখনও আমার স্ত্রী। জুডিশিয়াল সেপারেশন অনুযায়ী তোমার আমার স্বামী স্ত্রী হিসেবে আলাদা থাকার বিধান আছে, পরিচয় বিহীন নয়।”
“কি বলুন তো, এতোগুলো বছর আপনার থেকে দূরে থেকে ভুলেই বসেছিলাম যে আমাদের এক বছরের সেপারেশন হয়েছিলো সারাজীবন এর জন্য নয়। পারমানেন্ট ডিভোর্স যে এখনো হয় নি তা প্রায় ভুলতে বসেছিলাম। সবসময় শুধু এটাই মনে হতো আমি আপনার থেকে ছাড়া পেয়ে গেছি। তবে কোর্টের বিধান কিন্তু আমি একেবারে ভুলিনি। আর এটাও ভুলিনি জুডিশিয়াল সেপারেশন এর এক বছর পরেও যদি দুজনের মতের অমিল হয় বা দুজনের মধ্যে কোন একজন এক না হতে চায় তাহলে সে ডিভোর্সের জন্য আবেদন করতে পারে।”
“আমি তোমাকে ডিভোর্স দেবো না ফাল্গুনী। কোনদিন দেবো না। ঝামেলা এতো দুর কোনভাবেই গড়াতো না যদি তোমাকে আমি পেয়ে যেতাম। তুমি নিরুদ্দেশ না হলে তোমায় আমি ঠিক মানিয়ে নিতাম। কার ভুল কম আর কার ভুল বেশি তার হিসেব না কষে সব দোষ মাথা পেতে নিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিতাম তোমার কাছে। আপন মানুষের কাছে নত হওয়া দোষের কিছু নয়। আমি নত হতাম তোমার সামনে। কিন্তু তুমি তো সেই সুযোগ….”
“সুযোগ আপনি পেয়েছিলেন। দিয়েছিলাম আপনাকে দ্বিতীয় সুযোগ। সবাই পায় না জাগ্রত, আপনি পেয়েছিলেন। কিন্তু তার সদ্ব্যবহার আপনি করতে পারেন নি। আমার বাবা-মা আমাকে আপনার ভরসায় দ্বিতীয় বার ওই বাড়িতে পাঠিয়েছিলেন কিন্তু আপনি আমাকে আগলে রাখেন নি কখনো। অবিশ্বাস করে গেছেন সবসময়। বিশ্বাস করেছেন শুধু আপনার মা কে। আর আপনার মা! সে তো কোনদিন আমাকে মেনেই নিতে পারে নি। কোনদিনও না। সে সবসময় আমাকে অন্যদের সাথে তুলনা করে গেছে শুধু। ঝিমলি দি’র নাম তার মন থেকে তো দূর মুখ থেকেও কখনো সরতো না। ঝিমলি দি এই, ঝিমলি দি সেই, ঝিমলি দি’র দুধে আলতা গায়ের রং, মাথার চুল কোমর ছোঁয়া ছিলো, সংসারের সব কাজ জানতো, ঝিমলি দি’র বাবার নাম ডাক ছিলো! এসব উঠতে বসতে শুনতে হতো আমাকে। সে যখনই আমার দিকে এক নজর চেয়ে দেখতো তখনই নাকি তার চোখে কাটার মতো বাজতো আমার গায়ের শ্যমলা রঙ। সবসময় শুধু আমার কি নেই আর ঝিমলি দি’র কি ছিলো সেসব শুনতে হতো আমাকে। আপনি তো সকালে চলে যেতেন ফিরতেন সেই সন্ধ্যে হলে। সারাদিনে একবার ফোন করে খবর নেওয়াই ছিলো আমার প্রতি আপনার দায়িত্ব আর খেয়াল রাখা। আর আপনি বাড়ি ফেরার পর আপনার সাথে একান্তে দেখা মিলতো একমাত্র শোবার আগে। হয় ছুট খাট কথা বলে দুজনে ঘুমিয়ে পরতাম অথবা টুকিটাকি নিয়ে ঝগড়া লেগে যেতো দুজনের মধ্যে…”
“দুজনে এবার চুপ করো। ঢের তো হলো এবার শান্ত হও দুজনেই।”
বিলাসি দেবীর এক ধমকে মুহুর্তের মধ্যেই পুরো ঘর নিস্তব্ধ হয়ে গেলো। পিনপতন নীরবতায় ছেয়ে গেলো বন্ধ ঘরের ভেতরটা। নিরবতা ছাপিয়ে বিলাসি দেবী বলে উঠলেন,
“এভাবে আর যাই হোক সংসার হয় না। তোমরা দুজনে আগে নিজেদের সিদ্ধান্তঃ স্থির করো তারপর একটা পর্যায়ে আসা যাবে। আপাততঃ এখন এখানেই শেষ করো সব। এটা অন্যের বাড়ি নিজেদের বাড়ি নয়। আর আজকে এতো ঝড় ঝাপটার পর আঁখি একটা নতুন জীবন পেতে চলেছে ওকে হাসি মুখে বিদায় করো। এভাবে তোমাদের জন্য ওদের নতুন জীবনের শুরুটা কেনো কালো মুখে হবে…”
“পিসি… এমন করে বলো না তুমি। আমাকে পর করে দিচ্ছো এভাবে!”
বিলাসি দেবীর মুখের কথা কেঁড়ে নিয়ে অভিযোগ করে উঠলো আঁখি। কাঁদো কাঁদো চেহারা নিয়ে দু হাতে জাপটে জরিয়ে ধরলো মায়ের মতো পিসিকে। বিলাসি দেবী এক হাত দিয়ে আঁখির হাতে হাত রেখে কথা ঘুরিয়ে বললো,
“জামাইয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলি না এখনো। পরিচয় কি আমি নিজে নিজেই হয়ে নেবো?”
পরিস্থিতির খোলসটা এবার ঠান্ডা হয়ে এলো। ভেতরটা কে দেখতে যাচ্ছে? কেউ না। উপরের খোলসটাই আসল। ফাল্গুনীর হৃদয়ে জমানো শত সহস্র অভিযোগ আর আক্ষেপ এর বহর যেমন কেউ দেখবে না তেমন জাগ্রতর বলতে চেয়েও না বলতে পারা কথা আর নিজের হৃদয়াবেগ-ও কেউ দেখতে পাবে না।
পরিচয়ের কথা শুনে নিসান এগিয়ে এলো বিলাসি দেবীর সামনে। প্রণাম করলো সরস ভঙ্গিতে। আঁখি-ও একই সাথে প্রণাম করলো নিসানকে সঙ্গ দিয়ে। বিলাসি দেবী আশীর্বাদ করলেন দুজনকে একসাথে। নিসান এর সাথে সহজ আলাপচারিতায় বন্ধ ঘরের আবহাওয়া বদলানোর আরও একটু চেষ্টায় রত হলেন বিলাসি দেবী।
ফাল্গুনী একপাশ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঘরের এক কোণায়। আর তার থেকে এক হাত দূরেই দাঁড়িয়ে আছে জাগ্রত। ফাল্গুনী একটু পরপর আঁড়চোখে দেখছে জাগ্রতকে আর জাগ্রত চেয়ে আছে তার সামন বরাবর। সামনে টিনের দেয়ালে ঝুলানো আছে ছোট একটি চার ইঞ্চি সমান আয়না। সেই আয়নায় ফুটন্ত ফুলের মতো ফুটে আছে ফাল্গুনীর মায়ামুখ। একবার দেখা যাচ্ছে আবার আড়াল হয়ে যাচ্ছে। আবার দেখা যাচ্ছে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। এভাবেই লুকোচুরি চলছে দুজনের মধ্যে। জাগ্রত এই লুকোচুরি দেখতে দেখতে এবার একটা বিস্ফোরণ ঘটানোর সিদ্ধান্তঃ নিলো মনে মনে। নিজের মনে জোরদার প্রস্তুতি নিয়ে শুরু করলো বিস্ফোরণ এর প্রথম ধাপ। হুট করেই উঁচু গলায় বলে উঠলো,
“এমন করে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে কি লাভ ফাল্গুনী, আমি তো সবই দেখতে পাচ্ছি।”
আচমকা জাগ্রতর উঁচু গলার আওয়াজে ফাল্গুনী চকিতে ফিরে দাঁড়ালো জাগ্রতের দিকে। কথার মানে বুঝতে পেরে আবারও পাশ ফিরে দাঁড়িয়ে গেলো। লজ্জার থেকে রাগ এর উদয় বেশি হলো মনের আঙিনায়। ঘরের বাকি সদস্যরা পুরো বিষয়টা ধরতে পারলো না। তবে নিসান খানিকটা আন্দাজ করে নিলো কথার মানে টা।
“কি হয়েছে?”
বিলাসি দেবীর কথার জবাবে জাগ্রত অতি নমনীয় স্বরে বললো,
“তেমন কিছুই না মা, আপনার মেয়ে একটু পরপর আঁড়চোখে ঝাঁকছিলো আমায়, তাই জানিয়ে দিলাম আমি তার চোরাচাহনি সবটাই দেখতে পাচ্ছি। সামনে একটা ছোট আয়না ঝুলানো আছে ওইযে, ওটাতে আপনার মেয়ের উঁকিঝুঁকি দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। এই আরকি।”
বিলাসি দেবী নিরুত্তর চেয়ে রইলেন শুধু। কি বলবেন বুঝে উঠতে পারলেন না। জাগ্রত এর মধ্যে আবারও বলে উঠলো,
“আপনার মেয়ে মুহুর্তে মুহুর্তে আমার সাথে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করে, যখন তখন যেকোন কথায় আমায় দোষারোপ করে, ফিরিয়ে নিতে চাইলে মুখের উপর ঝাড়ি মেরে না করে দেয় অথচ আড়ালে গেলে অভিযোগ করে বলে সে নাকি আমায় ভালোবাসে। বলি এটা কোনধরনের… ”
“একদম বাজে কথা বলবেন না, আমি কথাটা অন্যভাবে বলেছিলাম। ওভাবে বলি নি যেভাবে আপনি….”
“যাক কথাটা যে তুমিই বলেছো সেটা স্বীকার গেছো এই অনেক। এখন এভাবে বলেছো না সেভাবে বলেছো সেটা মা কে বুঝতে দাও।”
“আপনি একটা জঘন্য মনের মানুষ। আপনার ভেতরটা পুরো নর্দমায় ভরপুর। একটা….”
“ফাল্গুনী তুমি বাইরে যাও। সবার খাওয়া শেষ হয়ে গেছে এতোক্ষণে। বাইরে কথাবার্তার আওয়াজ বেড়ে গেছে। তুমি ওদিকটায় গিয়ে সামাল দাও। শুভ একা একা আছে ওখানে। সবাই হয়তো চলে যাবে এক্ষুনি।”
ফাল্গুনীর চোখ ভর্তি জল। রাগে-কষ্টে ঢল নেমেছে চোখের কোনে। রাগে তার মনে হচ্ছে জাগ্রতকে মেরে ফেলতে। তাতেও যেনো ষোলকলা পূর্ণ হবে না। লোকটাকে কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে ফেললেও কম হয়ে যাবে। ফাল্গুনীর চোখের দৃষ্টিও যেনো চিৎকার করে বলছে, ‘লোকটা খুব খারাপ’। এমনি বিলাসি দেবী তার সাথে ঠিকমতো কথা বলেন না। তাই তার কথা অমান্য করাও তার পক্ষে সম্ভব নয়। বার পাঁচেক চোখ মুছলো হাতের সাদা কালো ওড়না টেনে। মুছতে না মুছতেই ভিজে জবজবে হয়ে উঠছে চোখ, গাল, থুতনি। সময় নিয়ে নিজেকে শান্ত করে বেড়িয়ে গেলো ফাল্গুনী। তবে মন পড়ে রইলো ঘরের ভেতরে। মনে মনে ভাবতে লাগলো ঘরের ভেতরে হয়তো এখন শুধু তাকে নিয়েই কথা হবে। মা হয়তো খারাপ বলবে তাকে। বাকিরা হয়তো হাসাহাসিও করবে। আর জাগ্রত! সে আর কি কি বলবে সবাইকে কে জানে!
ফাল্গুনী চলে গেলে ধুপধাপ দরজা আটকে দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো জাগ্রত। সে বুঝতে পেরেছে বিলাসি দেবী গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলবে বলেই ফাল্গুনীকে বাইরে পাঠিয়েছেন। জাগ্রতর আশার আলো এখন বিলাসি দেবী। একমাত্র ভরসা এখন তাকেই করা যায়। এরমধ্যেই নিসান এগিয়ে গেলো বিলাসি দেবীর সামনে। তাকে বসতে বলে সে নিজেও বসে পড়লো বিছানার এক কোনায়। গুছানো শব্দে নরম কন্ঠে বলে উঠলো,
“আমার কিছু বলার ছিলো পিসিমনি। আপনি কিছু মনে না করলে আমি একটু আপনাদের ব্যক্তিগত জীবনে কথা বলতে চাই। আপনি অনুমতি দিলে…”
“আমাদের জীবনটাই তো ছন্নছাড়া বাবা, ব্যক্তিগত আর কি আছে। তুমি বলো আমি শুনছি।”
~চলবে