পুনর্মিলন পর্ব-২৮+২৯

0
102

#পুনর্মিলন
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_২৮

“আমি আপনাকে বলেছিলাম সোহাগ আমাকে ফোন দিয়ে বিরক্ত করবেন না। গতকাল একদিনের ব্যাবধানে চারটে নম্বর ব্লক করেছি আপনার। আজ সকাল থেকে আবার নতুন নম্বর দিয়ে ফোনের ওপর ফোন দিয়ে যাচ্ছেন। আপনি এতোটা নির্লজ্জ কি আগে থেকেই ছিলেন? নাকি রিসেন্টলি এতোটা উন্নতি করেছেন নিজের স্বভাব চরিত্রের?”

কঠিন গলায় শাষণ সুরে কথাগুলো বললো ফাল্গুনী। তাতে কোন হেলদোল বোঝা গেলো না সোহাগের মাঝে। সে নিজ ছন্দে বেহায়া গলায় বলে উঠলো,

“যা বলার জন্য এতোটা নির্লজ্জ হচ্ছি রোজ, তা শুনে নিলেই পারো। তাহলে তো আর এভাবে আমাকে নম্বর বদলে বদলে তোমার নাগাল পেতে হয়না।”

“অকারণে পঁচা ডাস্টবিনের ঢাকনা খোলা রাখতে নেই। তাতে দুর্গন্ধ ছড়ায়; সাথে অসুখ। আপনি সেই ডাস্টবিনের থেকে কোন অংশে কম নন। মুখ খুললেই অস্বাস্থ্যকর কথাবার্তা। তাই খোলার সুযোগ দিচ্ছি না। আগে বুঝলে আর আপনাকে চিনলে আমার আঙিনায় পা রাখবারও সুযোগ দিতাম না।”

ফোনের ওপাশে সোহাগের মুখটা একটুখানি হয়ে গেলো। তবুও দাঁত চেপে মেকি হাসি হেসে বলল,

“চারবছর আগে তোমার স্বামী কাউকে পছন্দ করতো ফাল্গুনী? জানো কিছু? করতো, করতো। তুমি ছাড়াও অন্য এক নারী মোহ ছিলো তোমার স্বামীর। আজও তার সাথে যোগাযোগ রেখে যাচ্ছে সে। দুই নৌকায় পা দিয়ে চলছে তোমার……”

ফাল্গুনী পুরো কথা শুনলো না। কেটে দিলো কল। সোহাগ আবারও কল করতে লাগলে ফোন অফ করে রেখে দিলো তৎক্ষনাৎ।

এতোক্ষণ ওয়াশরুমে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলো ফাল্গুনী। রুমে কথা বললে জিনিয়া অনায়াসে শুনে নেবে তাই চলে গেছিলো ওয়াশরুমে। ফিরে এসে ফোনটা বিছানায় রেখে একভাবে বসে রইলো বেশ কিছুক্ষণ। অঢেল চিন্তা ভাবনায় মশগুল হয়ে রইলো কতক্ষণ তার হিসেব নেই। মনের খাতায় কাটাকুটি করে হিসেব নিকেশ চালালো অতীতের কিছু খন্ড স্মৃতি অন্বেষণ করে। হিসেব মিলে গেলে আচমকা ভাবনার অন্ত ঘটিয়ে ফোন তুলে নিলো হাতে। ফোন চালু করে নিজেই কল লাগালো ফের সোহাগের নম্বরে। ওপাশ থেকে রিসিভ হতে সময় লাগলো না খুব বেশি।

ফাল্গুনীর কল পেয়ে সোহাগের উল্লাসের ছলকানি যেনো চোখেমুখে উথলে পড়ছে। ফোন রিসিভ করে প্রথমেই ফাল্গুনীকে কিছু বলতে না দিয়ে নিজে ফাল্গুনীর আবেগী মনোযোগ কেঁড়ে নিতে বলল,

“তোমাকে আমি ভালোবাসি ফাল্গুনী। তোমাকে নিজের করে পাই বা না পাই, তোমার খারাপ আমি চাইবো না। প্রথমে হয়তো তোমাকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে নিজেকে হারিয়ে বসেছিলাম, হারিয়েছিলাম চিন্তা-চেতনার বোধশক্তি। তাই পাগলামি করে কি না কি বলেছি তোমায়। কিন্তু বিশ্বাস কর আমি চাই তুমি ভালো থাকো; তা সে আমার সাথে হোক বা অন্যকারও সাথে। কিন্তু জাগ্রত তোমার যোগ্য নয়। ও তোমাকে ভালোবাসে না। তোমার সেফটি আর ভালো থাকার চিন্তায় আমি অনেক খোঁজ খবর নিয়েছি জাগ্রতর সম্পর্কে। কারণ আমি জানি অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আজ তুমি এখানে এসে পৌঁছেছো। নতুন করে আবার ঠোকর খেলে উঠে দাঁড়ানোর শক্তি পাবে না তুমি। যতই হোক তুমিও তো একটা মানুষ, একটা মেয়ে! তোমাদের সেপারেশন এর আগে থেকেই একজনের সঙ্গে সম্পর্ক চালিয়ে যাচ্ছিল জাগ্রত। এখনও তার সাথে আগের মতই যোগাযোগ রেখে যাচ্ছে সে। আমার কাছে যথেষ্ট প্রমাণ-ও আছে তার। আর আমার মনে হয় জাগ্রতর অন্য মেয়ের সাথে সম্পর্কের কথা তুমি চার বছর আগে থেকেই জানতে। মানে যখন তোমরা একসাথে থাকতে তখন থেকেই। এম আই রাইট ফাল্গুনী?”

আশানুরূপ প্রতিক্রিয়া বা প্রশ্নের জবাব কোনটাই পেলো না সোহাগ। ফাল্গুনী ফোন কানে নিয়ে চুপচাপ বসে আছে। সোহাগ কল্পনা করে তৃপ্তি নেওয়ার চেষ্টা করলো কিভাবে ফাল্গুনী এখন ফোনের ওপাশে নিঃশব্দে কাঁদছে। হয়তো নিজের চুল খামছে ধরে কাঁদছে অথবা নিজের কপাল, বুক চাপরাচ্ছে আফসোস আর কষ্টে। তার সামনে লজ্জিত হবে বলে হয়তো প্রকাশ করছে না তার অনুশোচনার কান্না। সোহাগ আকাশ-পাতাল কল্পনা আঁকতে লাগলো নিজের মনগড়া ইতিহাস এর পাতায়। আচমকাই ফাল্গুনী কথা বলে উঠলো। কন্ঠ একদম শীতল।

“শেষ? নাকি আরও কিছু বাকি আছে বলার?”

সোহাগ যেনো ঝটকা খেলো ফাল্গুনীর সহজ, স্বাভাবিক কন্ঠ শুনে। এতো কথার পরেও ফাল্গুনীর এমন নির্মল-তরল কন্ঠ আশা করেনি সে। নিজেকে শান্তনা দিল এই বলে যে ফাল্গুনী হয়তো নিজেকে আড়াল করতে চাইছে। তাই নিজেকে এমন ভাবে উপস্থাপন করছে যেনো সে কিছুই বিশ্বাস করেনি। সোহাগ হাল ছাড়ল না। নব উদ্যমে মেকি মন খারাপের সুবাস মাখা কন্ঠে বলল,

“বলার তো অনেক কিছুই আছে ফাল্গুনী। আপাততঃ আঁশের খোলস টা তো চেনো! তাহলেই হবে। তুমি…..।”

“পারিপার্শ্বিক প্রসঙ্গ নয়, জাগ্রত কে নিয়ে আর কিছু বলার আছে?”

“বললামই তো ফাল্গুনী। আর কি বলবো বল? তুমি আবারও ঠকে গেলে….।”

“বলা হলে হয়ে গেলে এবার চুপ করে একটু শুনতে থাকুন আমি কি বলি।”

“বল ফাল্গুনী, তবে নিজের অনুভূতিগুলো আড়াল করে নিজের…।”

“শাট… আপ। এখন সামনে থাকলে চড়িয়ে দাঁত খুলে ফেলতাম আপনার। তারপর জায়গামতো কেলিয়ে বিয়ের শখ ঘুচাতাম সারা জীবনের মতো।”

“ফাল্গুনী স্বামী শোকে কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার? কি বলছো বুঝতে পারছো তুমি?”

“মাথা খারাপ হলে তুই তুকারি করতাম। আর কিছু না হোক অন্তত গালি তো দিতাম গুটিকয়েক। দিয়েছি কি?”

“এবার কিন্তু বেশি হয়ে যাচ্ছে ফাল্গুনী। তুমি আমাকে ইনসাল্ট করছো এখন!”

“সেতো আগেও করতাম। গতকাল সকালে-ও করলাম, তাও আবার আমরা দু’জনে মিলে। কি লাভ হয়েছে তাতে? গায়ে বিঁধেছে আপনার? বিঁধেনি। বিঁধবে কি করে; গায়ে তো গন্ডারের চামড়া বসানো। তাই যেই লাউ সেই কদু। লজ্জার ছিটেফোঁটা মাত্র নেই। অন্যের পেছনে খোঁচানো ছাড়া আর কোন কর্ম-সাধনা নেই, জীবনের লক্ষ্য নেই, বাসনা-ও নেই! এজন্যই তো বউ পালিয়েছে। এমন বেহায়া ছেঁচড়পনা স্বভাব থাকলে বউ টিকবে নাকি? সেই…. হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো!”

ফাল্গুনী ফোন সামনে নিয়ে দেখলো লাইন ডিসকানেক্ট হয়ে গেছে। সোহাগ নিজে ইচ্ছে করে কাটলো নাকি কোনভাবে কেটে গেলো তা বুঝতে পারল না। রাগের দমকে মাথার ব্রহ্মতালু দপদপ করছে। এ যেনো কোন ধোঁয়া উঠা জ্বলন্ত উনুন এক। ফাল্গুনী দাঁত কিড়মিড়িয়ে আবার কল লাগালো সোহাগের নম্বরে। কিন্তু কল ঢুকলো না। ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে বারবার। তাতে যেনো আরও বেশি ক্রোধ জেঁকে বসলো মাথায়। দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে বিড়বিড় করে নিজে নিজেই বলতে লাগলো,

“আসল কথাই বলা হলো না তার আগেই গেলো কলটা কেটে। আবার সুযোগ পাই একবার, ওর চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করে ছাড়বো। এতোকিছুর পরও পিছু ছাড়ার নাম নেই বজ্জাত কোথাকার!”

______________________

সুভাষ চন্দ্র তার সাথে নিয়ে আসা লোকজন নিয়ে বসে আছে খুশির ঘরের দুয়ারে। খুশির স্বামী প্রবীর চন্দ্র তাদের সামনে বসে আছে একা। যেনো একদল হায়েনার সামনে এক দুর্বল খরগোশ বসে আছে নিজেকে উৎসর্গ করে। তর্কাতর্কি করে শেষমেশ হার মেনে নিতে হয়েছে প্রবীরকে। না নিয়ে উপায় কি? লাকি কে তো তারা আইনি প্রক্রিয়ায় দত্তক নিয়ে লালন-পালন করেনি। সুভাষ চন্দ্র নিজে সেধে তুলে দিয়েছিলো সদ্য জন্ম নেওয়া বিশালাক্ষীকে। তার মুখের কথায় উচ্ছাসিত হয়ে বিশালাক্ষীকে সাদরে কোলে তুলে নিয়েছিলো সন্তানহীন প্রবীর আর খুশি। হাসির দেওয়া নামটা উচ্চারণ করতে দাঁতে ঠোঁটে যুদ্ধ বেঁধে যেতো বলে ছোট করে নাম দিয়েছিলো ‘লাকি’। সেই লাকিকে তারা দুজন স্বামী স্ত্রী মিলে বড় করলেও আইনত কোন অধিকার নেই সুভাষ চন্দ্রকে আটকানোর মতো। এ দুনিয়ায় প্রচলিত কোন স্নেহ ভালোবাসার আইন নেই, আছে শুধু স্বার্থের আইন। সেই আইনের প্রয়োগ কোন না কোন স্বার্থ হাসিলেই করা হয়। সেখানে স্নেহ, মায়া, মমতা বা আবেগ-ভালোবাসার জায়গা নেই। যদি থাকতো তবে ভিন্ন হতো চারপাশের দৃশ্যপট। কোন না কোন অপরাধীকে জিজ্ঞেস করলে হয়তো এও বলতে পারে, “আইন অন্ধ বলেই অপরাধ-ও অন্ধ আর অপরাধী-ও।”

শেষমেশ খুশিকে ডেকে লাকিকে নিয়ে আসতে বলল প্রবীর। রতন এবার একটু আরাম করে বসলো রাজকীয় ভঙ্গিমায়। লাকির রুপের প্রশংসা সে অনেক শুনেছে। কয়েক বছর আগে নিজের প্রথম বিয়ের দিন দেখেও ছিলো এক ঝলক। যদিও সেভাবে মনে নেই মুখশ্রী। তবে সৌন্দর্যের ধারণা এখনো মনে গেঁথে রয়ে গেছে আবছায়ার মতো।

বাকিরা বসে আছে বেজার মুখে। মেয়ে দেখতে এসেছে একটু খাওয়া দাওয়া হবে তা না একদম শুকনো মুখে বসিয়ে রেখেছে সবাইকে। তারা সবাই আসার সময় রতন যে চার কেজি পরিমাণ মিষ্টি কিনে এনেছে তাও তো পরে আছে টেবিলের এক কোনায়। ওগুলো অন্তত প্লেটে তুলে দিলে গোগ্রাসে গিলতে পারতো সব হায়েনাগুলো। যতই স্বার্থপর আর নির্লজ্জ হোক না কেনো নিজেরা নিয়ে আসা মিষ্টি তো আর নিজেরা বের করে খেতে পারে না। এতোটাও বেহায়া নয়। হলেও দেখানো তো যায় না সবসময়। এই খুশি আসলে মেহমান আপ্যায়ন করাই জানে না!

এমন মনোভাব নিয়েই একেকজন চেয়ার দখল করে রুক্ষ মুখে বসে আছে।

লাকিকে লাল টুকটুকে প্রায় নতুন এক তাঁতের শাড়ী পড়া অবস্থায় নিয়ে এলো খুশি। এনে বসালো উঠোনে বসা সব হায়েনা তুল্য মানুষগুলোর সামনে। রতন তো হা হয়ে গেছে লাকিকে দেখে। যেনো এক্ষুনি বুকে হাত দিয়ে হার্ট অ্যাটাক করে নেবে অনায়াসে। কি চোখ ধাঁধানো রূপ! সৌন্দর্য যেনো ঠিকরে পড়ছে। চোখে গাঢ় করে টানা কাজল রাঙা চোখটাই যেনো আগে চোখে পড়লো। রতন হাজারবার শুকরিয়া জানালো ইশ্বরকে আঁখির সাথে বিয়ে ভেঙে গেছে বলে। নয়তো এমন পরি সে পেতো কোথায়!

সুভাষ চন্দ্র সবার আগে ঘাড় ফিরিয়ে চেয়ে দেখলো রতনের মুখমন্ডল। বুঝলো সে আগেই গলে গেছে। এবার এক প্রশান্তি নিয়ে এলিয়ে দিলো শরীরটাকে চেয়ারের উপর। এতোক্ষণ কেমন দারা ধরে বসেছিলো।

আর পাঁচটা মেয়েদেখা-র মতো দেখাশোনা হলো না। শুধু লাকিকে তার দর্শন করিয়েই ভেতরে পাঠানো হলো। পাঠানো হলো রতন এর কথায়। তার আচমকাই কেমন মনে হতে লাগলো বউ তো হবে তার, তাহলে সবার সামনে এভাবে সেজেগুজে বসে থাকার মানে হয়না। দেখবে শুধু সে একলা। অন্যকেউ কেনো নজর দিয়ে গিলে খাবে?

সুভাষ চন্দ্র রতনকে জিজ্ঞেস করে বিয়ের কথা তুললো। আজকেই মন্দিরে নিয়ে মালাবদল করে বিয়ের ছোট পরিসরে আয়োজন করবে বলে জানালো। প্রবীর চন্দ্র শুধু শুনে যাচ্ছেন। তার মতামত নেওয়ার জন্য কেউ আর বসে নেই। সবার কথার মাঝে হস্তক্ষেপ করে খুশি আকস্মিক বলে উঠলো,

“মেয়া দেহার সবই তো হইলো। একটা কাম বাদ যাইবো কেন? পুলা আর মেয়া দুইডারে আলাদা কইরা কথা কইতে দিলে ভালা হইতো না? সংসারডা তো দুইজন মিলা করবো। তাইলে দুইজনের বোঝাপড়ার একটা বেপার আছে তো।”

সুভাষ চন্দ্র না করতে নিলে রতন খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে নিজেই বলে উঠল,

“হ্যাঁ মা অবশ্যই। আপনি ব্যাবস্থা করুন। আমি রাজি। আপনি গুরুজন মানুষ, আপনার কথা ফেলবো কেনো?”

খুশির গা রাগে কষ্টে রিরি করে উঠলো রতন এর মুখে মা ডাক শুনে। মা ডাকেও বুঝি এতো বিষ থাকে!

খুশির ঘরটা পুরোনো টিনের বেড়ায় ঘেরা ছোট একটি ছাপড়া হলেও ভেতরে টিন দিয়ে মাঝামাঝি ভাগ করা আছে। দুপাশে দুই চৌকি বসানো আছে। একপাশে থাকে খুশি আর প্রবীর আরেক পাশে থাকে লাকি। রতনকে লাকির রুম দেখিয়ে দিল খুশি। বুকের ভেতরটা মোচড়ানো শুরু হলো এরপর। মনে হলো যেনো নিজ হাতে নরকে তুলে দিল মেয়েটাকে। মেয়েটার কি গতি হবে এবার!

_____________________

আঁখিকে নিসান এর মাথায় তেল মালিশ করতে বলে সেই কখন চলে এসেছে চন্দনা রান্নাঘরে। আসার পর থেকে মনটা নিসপিস করছে একবার গিয়ে দেখতে যে ছেলেটার মাথা ব্যাথা কমলো কিনা। না কমলে তো এতোক্ষণে বমি করছে হয়তো। কিন্তু যেতে অস্বস্তি হচ্ছে মনে। মতে হোক বা অমতে, ছেলের তো বিয়ে হয়েছে। ঘরে এখন নতুন বউ আছে তার খেয়াল রাখার জন্য। সে বারবার খোঁজ নিতে গেলে যদি বিরক্ত হয় নতুন বউ! এমন অগণিত চিন্তা ভাবনায় মশগুল হয়ে রান্না করছে চন্দনা। মনটা পড়ে আছে নিসান এর ঘরে। এমন সময় আঁখি এলো রান্নাঘরের সামনে। চন্দনাকে ডেকে উঠলো মা বলে। চন্দনা চকিতে পিছু ফিরে তাকাতেই আঁখি কাচুমাচু করে বলল,

“আপনার ছেলের মাথা ব্যাথা কমেছে মা। আপনি হয়তো কাজে ব্যাস্ত আছেন বলে খবর নিতে যেতে পারেন নি, তাই আমি এলাম আপনাকে বলতে।”

চন্দনা রাণীর অশান্ত মন শান্ত হলো। বুকভরে শ্বাস টেনে নিলো তৃপ্তি জরিয়ে। কিন্তু আঁখিকে ভাল-মন্দ কিছুই বলল না। আঁখি শ্বাশুড়ী মায়ের কাছ থেকে কোন প্রতিত্তোর না পেয়ে নিজেই বলতে লাগল,

“আপনার ছেলে এখন একটু ঘুম পড়েছে। ঘুমানোর আগে বলছিল, অন্যসময় হলে আপনি রান্নাবান্না ফেলে রেখে তার মাথার কাছে বসে থাকতেন। আজ রাগ করে আছেন বলে যাননি একবারও খোঁজ নিতে। তাতে নাকি তার থেকে বেশি আপনার কষ্ট হচ্ছে। বড্ড ভালোবাসেন যে তাকে।”

কথাগুলোতে কেমন একটা সহজ হতে লাগলো চন্দনার মন। ভাবলো ছেলে তার ছিল, আজও তার-ই আছে। বউটার মনেও হিংসা নেই বোধহয়। থাকলে স্বামীর মুখে মায়ের গুনগান শুনে তা আবার সেই মায়ের কাছেই বলতে এসেছে। বা হতে পারে হিংসা আছে ঠিকই কিন্তু দেখাচ্ছে না। উলটপালট চিন্তা করতে করতে আবার মশগুল হলো চন্দনা।

আঁখি নিরাশ হলো না শ্বাশুড়ী মায়ের নিরবতায়। হাসিমুখে বলে উঠলো,

“জানেন, আমার মা আর কাকিদের মাঝে মাঝে বলতে শুনতাম,
তাদের ছেলের যখন বিয়ে হবে তখন তারা তাদের ছেলের উপর থেকে সমস্ত অধিকার ছেড়ে দেবে। ছেলে ছেলের বউয়ের মাঝে কখনো হস্তক্ষেপ করবে না, চাইলেও নাকি পারবে না তাই চেষ্টা না করাই ভাল। বিয়ের পর ছেলেরা নাকি পর হয়ে যায়। এক কথায় তাদের বউয়ের হয়ে যায়। যদিও তাদের আর আপনার পরিস্থিতি আলাদা তবুও কথাটা বললাম। তারা কেনো বলেছিলো কথাটা তা আমি জানি না। আপনিও কি তেমনই ভাবছেন মা? ভাববেন না দয়া করে। আপনার ছেলে আপনার কথায় আমাকে ছাড়তে রাজি কিন্তু আমার কথায় কখনো আপনাদের ছাড়তে রাজি হবে না। ইশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন কখনো আমায় এমন চিন্তাও না করতে দেন। মা, আমার হয়তো আপনার মনে কখনো জায়গা মিলবে না, কিন্তু দয়া করে আমাকে নিয়ে কোন ভুল ধারণাকে জায়গা দেবেন না মনে। আমি আমার এক মাকে ফেলে এসেছি, ইশ্বর আমাকে আরেকটা মা উপহার দিয়েছেন। আমি তাকে আমার মা বলে মেনে নিয়েছি। তার মেয়ের মতো না হতে পারি, সজ্ঞানে তার কষ্টের কারণ হবো না কখনো।”

আঁখি কথাগুলো বলে চলে যেতে নিলে চন্দনা পিছু না ফিরেই বলল,

“আমার ছেলে কারও কথায় কাউকেই ছেড়ে দেবার মতো ছেলে নয়। তাকে আমি তেমন শিক্ষা দিই নি। সে যখন তোমার হাত একবার ধরেছে সারাজীবন সে হাত আমার ছেলে ছাড়বে না। আমি তোমাকে আমার মনে জায়গা দিয়ে ছেলের বউ বলে মানি আর না মানি তুমি এ বাড়ির বউ। রঞ্জিত কুমারের একমাত্র পুত্রবধু। এ কথা মনে রেখো। আর আরেকটা কথা, আমাকে খুশি করতে নিজের মনগড়া কথা বলবে না কখনো। আমার পছন্দ নয়। অন্তত নিসানকে নিয়ে তো নয়ই। ওকে ভালোবাসো হয়তো কিন্তু চেনো না। চিনলে এ কথা বলতে না। যাও রুমে যাও। নিসান ঘুমিয়েছে ওর যেনো কোনো ডিস্টার্ব না হয়। শুয়ে থাকো গিয়ে তাহলে আর ওর ডিস্টার্ব হবে না। তুমিও জার্নি করে এসেছো তোমারও বিশ্রাম হয়ে যাবে।”

আঁখিকে মুখে এসব কথা বলতে মানা করলেও মনে মনে ঠিকই খুশি হলো চন্দনা। এবার মন থেকেই কেউ যেন বলে উঠলো, “নাহ, মেয়েটা মন্দ না”। এদিকে চন্দনার মুখে আঁখি বিশ্রাম নেওয়ার কথা শুনে খুব খুশি হলো। হালকা মন নিয়ে পা বাড়ালো নিজের রুমের দিকে। এখানে আসার আগে যে কতোটা ভয় জেঁকে বসেছিল মনে তার হিসেব নেই। অনেক কষ্ট করে মনে সাহস যুগিয়েছে নিসান ঘুমিয়ে পড়ার পর শ্বাশুড়ী মায়ের মুখোমুখি হওয়ার। আঁখি রান্না ঘর পেরোতেই হটাৎ নিসান এর মুখোমুখি হয়ে গেলো। ভয়ে ছোটখাটো এক চিৎকারও করে দিয়েছে আচমকা নিসানকে সামনে পেয়ে। আঁখির চিৎকার শুনে ওদিক থেকে চন্দনা খুন্তি হাতে নিয়ে ‘কি হলো’ বলে এগিয়ে এলো তৎক্ষনাৎ।

~চলবে

#পুনর্মিলন
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_২৯

আঁখি রান্না ঘর পেরোতেই হটাৎ নিসান এর মুখোমুখি হয়ে গেলো। ভয়ে ‘ও মা’ বলে ছোটখাটো এক চিৎকারও করে দিলো আচমকা নিসানকে সামনে দেখতে পেয়ে। আঁখির চিৎকার শুনে ওদিক থেকে চন্দনা খুন্তি হাতে নিয়ে ‘কি হলো’ বলে এগিয়ে এলো তৎক্ষনাৎ। আঁখি পিছু ফিরে শ্বাশুড়ী মাকে আসতে দেখে আবার সামনে চেয়ে দেখে সামনে টা পুরো ফাঁকা। কেউ নেই আশেপাশে। বুকে থুতু ছিটিয়ে আবার পিছন ঘুরলো শ্বাশুড়ীকে সামলাতে। চন্দনা এসে জিজ্ঞেস করল,

“কি হয়েছে চিল্লিয়ে উঠলে যে?”

আঁখি শুকনো গলায় ফাঁকা ঢোক গিললো। এদিক সেদিক চেয়ে বলল, “হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলাম। তাই মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। সরি আর হবে না।”

চন্দনা ভ্রু কুচকে বলে উঠলো, “কি আর হবে না? হোঁচট? নাকি চিৎকার?”

আঁখি পরিমরি করে বলল, “কোনটাই হবে না মা।”

চন্দনা মেজাজি চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে ফিরে গেলো রান্না ঘরে। যেতে যেতে হাসলোও খানিক। আঁখি আবারও থুতু ছিটালো বুকে। আশেপাশে ভাল করে নজর বুলিয়ে পা বাড়ালো নিজের রুমের দিকে। ড্রয়িংরুমের পর করিডোর পেরিয়ে দুই রুম বাদে এগিয়ে ঢুকলো নিজের রুমে। বিছানায় নিসানকে দেখতে না পেয়ে রুমের চারদিকে নজর ঘোরাতেই আচমকা শুন্যে ভেসে উঠলো সে। কোমর জড়ানো হাতের মালিক স্বয়ং নিসান। পেছন থেকে এসে দরজা আটকে দিয়ে কোলে তুলে নিয়েছে আঁখিকে। আঁখি ভয় আর লজ্জায় মাথা ঠেকালো নিসান এর বুকে। দু’হাতে জড়িয়ে নিলো মানুষটার কাঁধ আর গলা।

“যেই দেখেছো আমি ঘুমিয়ে পড়েছি ওমনি ছুটেছো মায়ের কাছে তাই না? আর মাকে তো দেখলাম ভালই পটাচ্ছিলে। এতো বুদ্ধি আমার বউয়ের মাথায় আছে ভাবা যায়! তবে একটা কথা কিন্তু ভুল বলেছো তুমি।”

“আঁখি ভয়ভয় দৃষ্টি নিয়ে মাথা উঠিয়ে চাইলো নিসান এর চোখে। নিসান আঁখির চোখে চোখ রেখে বলল,

“আমি যেমন তোমার কথায় বাবা-মাকে কখনো ছাড়বো না ঠিক তেমন বাবা-মায়ের কথায় তোমাকেও কখনো ছাড়বো না। আমি সবাইকে নিয়ে একসাথে বাঁচতে চাই। তোমার সঙ্গে যদি রতনের বিয়ে নিয়ে ঝামেলা না তৈরী হতো তাহলে আমি সময় নিয়ে মাকে মানিয়ে নিতাম। মা-বাবাকে আগেই বলেছিলাম ঠিক কিন্তু বোঝানোর সময় পাইনি। তাই আজ এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আর তোমার কথার জবাবে বলব, বাবা-মা গত আটাশ বছর ছিলো আমার সাথে, বেঁচে থাকলে আগামী আটাশ বছরও থাকবে। তুমি তো গত আটাশ বছর ছিলে না সাথে; তাই আগামীতে আটাশ আটাশ করে ছাপ্পান্ন বছর তোমাকে আমার পাশে চাই। কি থাকবে না আজকের এই নিসান থেকে আগামীর রুগ্ন বুড়ো নিসানের পাশে?”

আঁখি অশ্রুসিক্ত নয়নে গাল ভরে হেসে দিলো। মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে দু’হাতে উষ্ণ আলিঙ্গনে জড়িয়ে নিলো নিসানকে। নিজের একান্ত পুরুষটির গলায় দুই নয়নের অশ্রুতে ভেজা মুখ ডুবিয়ে বলল,

“শুধু এ জীবনে নয় আগামী সাত জন্মেও আমি আপনাকেই চাই। ইশ্বরের পর শুধু আপনার জন্যই জন্ম হোক আমার। আমি প্রতি জনমে আপনাকে শুধু আপনাকেই চাই।”

আঁখি একটু থেমে গিয়ে আবার বলল, “আপনার মাকেও চাই। উনি খুব ভাল। পরের বার, না না প্রতিবার সেই আপনার মা হোক। কিন্তু কোনবারই যেনো তার মনে কষ্ট দিয়ে আমরা কাছে না আসি।”

নিসান এর ঠোঁটে দখল করা তৃপ্তিপূর্ণ হাসি ঠোঁট ছড়িয়ে গাল ছুঁয়েছে। ছুঁয়েছে চোখ, ছুঁয়েছে হৃদয়। চোখেমুখে যেনো উপচে পড়ছে আঁখির প্রতি সম্মান আর ভরসা। নিসান এর থুঁতনির নিচ বরাবর এলিয়ে আছে আঁখির উজ্জ্বল শ্যামবর্নের কাঁধ। নিসান তার ঠোঁটের হাসি ছুঁয়ে দিলো সেই কাঁধে। আঁখির বাহুবন্ধনী পোক্ত হলো আরও। হাতের সমস্ত জোড় বর্ষন করলো ছুঁয়ে দেওয়া ঠোঁটের মালিকের গলা আর কাঁধে। সবে মাথা উঁচিয়ে উঠা নগন্য পরিমানের নখগুলো সমহিমায় জায়গা করে নিলো এক প্রেমিক এর দেহজুরে। নিসান আর দাঁড়িয়ে রইলো না। আঁখিকে বিছানায় নিয়ে নামিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লো তাকে বুকে জড়িয়ে। ফিসফিসিয়ে আঁখির কানে ঠোঁট ছোঁয়াতে ছোঁয়াতে বলল,

“বাসর রাতকে দুপুর বাসর বললে কি মানায় বল? মানায় না। বাসর যখন হবে তখন তা রাতেই হবে। ভর দুপুর বেলায় না। তাই এখন আপাতত ব্রেক কষে নিলাম। রাতে কোন ব্রেক টেক হবে না। সো ময়ূরাক্ষী মেডাম, এখন একটু ঘুমিয়ে নাও। এমনিতেও জার্নি করেছো, ক্লান্ত লাগছে নিশ্চয়ই?”

আঁখি লজ্জায় টইটম্বুর। নিসানের বুকের মধ্যে রাখা নিজের মাথাটা আরও চেপে ধরলো লজ্জায়। একটু সময় নিয়ে বলল,

“আপনি সবসময় আমায় শুধু লজ্জা দিয়ে দিয়ে কথা কেন বলেন?”
“তুমি কি চাইছো লজ্জা দিয়ে কিছু না বলে সরাসরি লজ্জা দিয়ে কিছু করতে? মানে এখনই? তুমি চাইলে…. আই ওন্ট মাইন্ড। মে আই?”

আঁখি শরীরের সমস্ত জোড় খাটিয়ে উঠে বসলো নিসান এর হাত আলগা করে। মেকি রাগ দেখিয়ে বলল,
“ধ্যাৎ! কি বাজে আপনি! থাকুন তো একলা একলা শুয়ে। আমি যাচ্ছি।”
নিসান চট জলদি ধরে ফেললো আঁখির হাত। দুপাটি দাঁত বের করে একটা হাসি দিয়ে বলল,
“আরে আরে যাচ্ছ কোথায়? আমি তোমাকে লজ্জা দিয়েছি তুমিও আমাকে লজ্জা দিয়ে দাও। শোধবোধ হয়ে যাবে।”

আঁখি আর কি বলবে! কাপাল চাপড়ে বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে পড়লো আবার। নিসান বিশ্বজয়ের হাসি দিয়ে শুয়ে পড়লো আঁখিকে জাপটে জড়িয়ে ধরে। আঁখি বেশ কিছুক্ষণ আর মুখ খুললো না। না নিজে কিছু বললো আর না নিসান কে কিছু বলতে দিলো। একটু পর এক হাতে নিসান এর ঠোঁট চেপে ধরে শুধু বলল, “সারাদিনে যদি আর একটাও এমন লাগাম ছাড়া কথা বলেছেন বা কিছু করেছেন তাহলে আমি মাকে বলে সত্যি সত্যিই আপনার আলাদা থাকার ব্যাবস্থা করে ছাড়বো বলে দিলাম।”

নিসান বিজ্ঞ মনীষীদের মতো ভাবুক চেহারা বানালো। নিজের ঠোঁটে রাখা আঁখির হাতে এক চুমু দিয়ে সরিয়ে নিলো খানিক। বলল, “হুম, তার মানে রাতে বলার আর করার দুটোরই পারমিশন আছে তাই তো?”

আঁখি যেনো পারে না জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে মাটির চাদরে। এ মানুষটা যে এতো ঠোঁটকাটা স্বভাবের তা আগে বিন্দু মাত্রও টের পায়নি।

______________________

লাকির সাথে আলাদা কথা বলতে দেওয়া হয়েছে রতনকে। ঘরে এসেই রতন এর সর্বপ্রথম কথা হলো, “তোমার আমাকে পছন্দ হয়েছে?”

লাকি আগে থেকেই মাথানত করে দাঁড়িয়ে ছিলো। এখনও একইভাবে দাঁড়িয়ে রইলো। জবাব দিলো না চাপা ঠোঁট ছড়িয়ে। রতন আবারও বলল,

“তুমি খুব সুন্দর। একদম ডানাকাটা পরি। তোমার গায়ে এতো এতো স্বর্ণের গয়না তুলে দেবো যে স্বর্গের দেবীদের মতো লাগবে তোমায়। সোনার গয়না পছন্দ না তোমার?”

এবারেও মুখ খুললো না লাকি। অল্পভাষী মেয়েটা সোজা মুখে নির্বাক মাথানত করেই দাঁড়িয়ে রইলো। রতন একটুও বিরক্ত হলো না তাতে। বরং আরও বেশি আগ্রহী কন্ঠে বলে উঠলো,

“আমি শুনেছি তুমি না পারতে কথা বল না। একদম অল্পভাষী। আমার মনের মতো। রূপে গুণে সবদিকেই আমার মনের মতো তুমি। সৃষ্টিকর্তা তোমায় আমার জন্যই তৈরী করেছে বুঝলে?”

লাকি একটুও নড়চড় করলো না। ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। রতন নিজে নিজেই আবার বলতে লাগল,

“আমাদের বিয়ে আজকেই হচ্ছে। বিয়ের সাজগোজ নিয়ে কোন শখ আহ্লাদ আছে? থাকলে শুধু মুখ দিয়ে একবার বল, চোখের পলকে হাজির করে দেবো। কেমন শাড়ী পছন্দ? কেমন গয়না পছন্দ? আর কোন কোন গয়না চাই? সবকিছু মন খুলে নির্দ্বিধায় বলো আমাকে।”

এতোক্ষণে মাথা তুলে তাকালো লাকি। ডাগর ডাগর টানা চোখের অবক্র চাহনিতে দ্বিতীয় বার ঘায়েল হলো রতন। লাকি রতনের পানে চেয়ে প্রাণহীন হাসি হাসলো। রতনের কাছে তা আবিষ্কার হলো পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ হাসি। লাকি বলল,

“দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন, কষ্ট হচ্ছে নিশ্চয়ই? বসুন এখানে। বসে কথা বলুন।”

রতন মুগ্ধ হয়ে শুনলো লাকির কন্ঠ। লাকির কথায় চৌকির এক কোনায় বসে পড়লো চোখ ঝলসানো রূপে মত্ত হয়ে। চেয়ে দেখার প্রয়োজন বোধ করলো না বসার জায়গা টা। সাথে সাথেই চৌকির কোনাসহ হুড়মুড়িয়ে পড়ে গেলো রতন। লাকির মুখশ্রী পাল্টে গেলো চোখের পলকেই। মুখাবয়ব যেনো জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি আর চোখ জোড়া যেনো লাভা। রতন চৌকি ভেঙে পড়ে যাওয়ার সাথে সাথে নিজের চুলগুলো এলোমেলো করে চোখের কাজল আর ঠোঁটের গাঢ় লাল লিপস্টিক লেপ্টে নিলো আঙ্গুলের ডগার ছোঁয়ায়। আগে থেকেই ফুটো করে রাখা ব্লাউজ এর হাতাটাও টেনে ছিঁড়ে নিলো অল্প একটু। টেবিলে রাখা হোমিওপ্যাথিক ঔষধের সাথে দেওয়া ছোট্ট ড্রপার ভরা জল হাতে তুলে নিয়ে এলোমেলো করে দিলো টেবিলটাও। সে জল টুকু দিয়ে বানিয়ে নিলো টইটম্বুর করা অশ্রুসিক্ত দুই নয়ন। এরমধ্যেই সবার আগে রুমে দৌড়ে এলো খু্শি। খুশি “হায় ভগবান” বলে চিৎকার করে উঠল ঘর কাঁপিয়ে। খুশির চিৎকারের পর একে একে সবাই আসতে লাগলো রুমের ভেতর। সবার নজরে এলো লাকি বিধ্বস্ত অবস্থায় বসে আছে টেবিল ঘেঁষে। ফুপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে অনবরত।

___________________

“বৌমনি, দাভাই যে এখনও আসছেনা তোমার চিন্তা হচ্ছে না? এতো শান্ত হয়ে কি করে বসে আছো তুমি? সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে। অফিস টাইম তো শেষ হয়েছে অনেক্ক্ষণ হলো।”

“জিনিয়া, কথাটা ওভাবে না বলে এভাবে বল তোমার দাভাই আসছে না আমি ফোন দিয়ে খোঁজ নিয়েছি কিনা বা সে আসবে কখন।”

“তুমি কি বোঝতে চাইছো আমি ঝগড়া করছি বৌমনি? আবার-ও কথা শোনাচ্ছ আমায়?”

“কথা শোনার মত কাজ কর বলেই কথা শুনতে হয় জিনিয়া। কারও দরজায় আড়ি পেতে বসে থাকবে তার ব্যক্তিগত জীবনের তোয়াক্কা না করে তারপর আবার তা নিয়ে কান ভাঙ্গাবে জায়গা বুঝে, সে কি আর তোমায় ছেড়ে কথা বলবে? তবে এখন আমি কোন খারাপ কিছু বলিনি তোমায়। শুধু বলেছি কথাটা ওভাবে নয় এভাবে বল। আর দুপুরেও বেশি কিছু তো বলিনি। তোমার যে স্বভাব এখনও বদলায় নি আগের মতই আছে তাই দেখে তোমাকে উপদেশ দিয়েছিলাম সময় থাকতে নিজের স্বভাব চরিত্র বদলাতে। নয়তো পস্তাতে হবে। ব্যাস, এটুকুই।”

জিনিয়া চুপ করে গেলো। মুখটা একটুখানি হয়ে গেলো তার। ফাল্গুনী বিরক্তির শ্বাস ফেলে চলে গেলো রুমে। দুপুরে ফাল্গুনী প্রথমবার সোহাগের সাথে কথা ওয়াশরুমে গিয়ে বললেও পরের বার নিজে ফোন দিয়ে কথা বলার সময় বলেছিল রুমে এসে বিছানায় বসে। তখনকার ফোনালাপের সোহাগের কথা না শুনলেও ফাল্গুনীর বলা সব কথা শুনেছে জিনিয়া। সাথে সাথেই জাগ্রতকে ফোন করে জানিয়েছে সবটা মশলা-লবন দিয়ে চটপটে করে। পুরো একশো আশি ডিগ্রিই ঘুরিয়ে দিয়েছে ব্যাপারটাকে। জাগ্রত বিশ্বাস করা তো দূরের কথা জিনিয়াকে ধমকে ফোন কেটে দিয়েছিল। এদিকে জিনিয়া যে জাগ্রতকে ফোন করে সব কথা বলছিল তা আবার ফাল্গুনী রুম থেকে বসে বসে অনায়াসেই শুনতে পেয়েছে। যদিও জিনিয়া চেষ্টার ত্রুটি রাখেনি যাতে যার নামে মিথ্যে অভিযোগ করছে সে যেনো শুনতে না পায়। কিন্তু ড্রয়িংরুম অথবা কিচেন রুমের কথা শুনতে হলে বেডরুমে বসে অনায়াসেই শুনতে পাওয়া যায়। তাই ফাল্গুনীর একটুও অসুবিধা হয়নি জিনিয়ার কথা শুনতে আর তাকে নতুন করে চিনতে। আর বেডরুমের কথা বাইরে থেকে শুনতে গেলে দরজায় কান পেতে শুনতে হয় তাও সুস্পষ্ট শোনা যায় না আস্তে কথা বললে। ফাল্গুনী অবাক না হয়ে পারেনি। কতোটা ছোট মন-মানসিকতা ও নির্বুদ্ধিতা প্রকাশ করলো জিনিয়া নিজেও বুঝলো কিনা ফাল্গুনীর সন্দেহ আছে তাতে।

জাগ্রত বাড়ি ফিরলো আরও বেশ কিছুক্ষণ পর। তবে একা ফেরেনি সে। সাথে নিয়ে এসেছে পার্থকে। দু’জনেই ড্রয়িংরুমে ঢুকলো গম্ভীরমুখে। পার্থকে জাগ্রতর সাথে আসতে দেখে ফাল্গুনী অবাক চোখে চেয়ে রইলো। জিনিয়ার অভিব্যক্তি ছিলো দেখার মতো। জেমি দৌড়ে গিয়ে জায়গা করে নিলো বাবার কোলে।

ফাল্গুনী দুপুর থেকে কতবার ফোন করেছে জাগ্রতকে কিন্তু রিসিভ-ই করে নি সে। শেষমেশ ফোন বন্ধ করে রেখেছিল। ফাল্গুনীর বিশ্বাস ছিল জাগ্রত তার কথা না শুনে শুধুমাত্র জিনিয়ার কথায় তাকে অবিশ্বাস করবে না। তাও মনের মধ্যে ভয় ছিল কোথাও একটা। যদি কিঞ্চিৎ ভুলেরও দানা বাঁধে মনে এবং তা মনের মধ্যেই রেখে দেয় লুকিয়ে তাহলে!

ফাল্গুনী পার্থকে ভাল-মন্দ জিজ্ঞেস করে চলে গেল রান্নাঘরে। চা বসালো চুলায়। কিছু ফল আর চা-বিস্কুট গুছিয়ে নিয়ে গেল ড্রয়িংরুমে। ততক্ষণে জাগ্রত কাপড় বদলে হাত-মুখ ধুয়ে চলে এসেছে। জিনিয়া কাঁচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছে এক কোনায়। চোখেমুখে ভয়ের সাথে রাগও উপচে পড়ছে। জেমি বসে আছে বাবার কোলে। ফাল্গুনী সবার হাতে চা দিয়ে জিনিয়াকে দিতে গেলে জিনিয়া নিল না। ফাল্গুনী একবার ছেড়ে দু’বার সেধে দিতে গেলেই রেগে যায় জিনিয়া। চায়ের কাপ ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় সামনে থেকে। চিৎকার করে বলে উঠে,

“এতো আদিক্ষেতা করতে হবে না তোমাকে। নিজের স্বামীর সাথে যুক্তি-বুদ্ধি করে আমার স্বামীর কান ভাঙিয়ে নিয়ে এসেছো এ পর্যন্ত আবার খাতিরদারি করছো?”

জাগ্রত এগিয়ে এসে ফাল্গুনীর হাত চেক করলো আগে। চায়ে লেগে কোথাও পুরেছে কিনা যত্ন করে দেখে নিল তা। তারপর জিনিয়াকে কিছু বলতে নেবে তার আগেই পার্থ এসে সজোরে চড় বসিয়ে দিলো জিনিয়ার গালে। সাথে সাথেই গালে হাত দিয়ে চিৎকার করে ওঠলো জিনিয়া। বলতে লাগল,

“মারবেই তো, মারো না। নিশ্চয়ই কুমন্ত্রণা পেয়েই এসেছো এই অব্দি। নয়তো এক মাসের আগে তো আসার কথা ছিল না তোমার। শুধু কুমন্ত্রণাই পেয়েছো নাকি আরও কিছু দিয়েছে তোমায়?”

পার্থ হাত তুলে নেয় আবারও চড় মারবে বলে। জাগ্রত থামিয়ে দেয় সঙ্গে সঙ্গে। ফাল্গুনী কান্নারত জেমিকে তুলে দেয় পার্থর কোলে যাতে একটু শান্ত হয় মেয়ের কান্না দেখে হলেও। পার্থ যে মেয়ে বলতে পাগল আর জেমিও যে মায়ের থেকে বাবাকে বেশি পছন্দ করে তা অল্প সময়ে হলেও ভালই বুঝেছে ফাল্গুনী।

আধ ঘন্টা পার হয়েছে পার্থ চলে গেছে জিনিয়াকে নিয়ে। যাওয়ার আগে পার্থ খোলাসা করে গেছে নিজেকে আর নিজেদের সম্পর্কের তিক্ততাকে।

পার্থের পরিবারটা খুব বড় নয়। তার বাবা-মা, ছোট অবিবাহিত এক বোন আর বউ বাচ্চা নিয়ে ছোট্ট সংসার। জিনিয়াকে বিয়ে করেছিল ভালোবেসে পরিবারের অমতে। তার বাবা-মা প্রথম দেখা থেকেই পছন্দ করতো না জিনিয়াকে। বিয়ের পর এক দু’মাস ভাল কাটলেও তারপর থেকে শুরু হয় জিনিয়ার জ্বালাতন। কার বর তার বউকে কত ভরীর সোনার গয়না দিল, কয়টা শাড়ী দিল, কোথায় কোথায় ঘুরতে নিয়ে গেল এসব নিয়ে রোজ ঝামেলা করতে লাগে। ধীরে ধীরে পরিবারের সদস্যদের সাথেও ঝামেলা শুরু করে। কারও সাথে মানিয়ে চলা তো দূর আরও আগ বাড়িয়ে ঝগড়ার সৃষ্টি করে। কথায় কথায় মিথ্যা বলা তো যেনো চার বেলার আহার সমতুল্য জিনিয়ার কাছে। প্রথম প্রথম পার্থ বুঝতে পারতো না জিনিয়ার মুখে মিথ্যা কোনটা আর সত্য কোনটা। পরিবারের ঝামেলা এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতো। এটা বুঝতে পেরে জিনিয়া আরও বেশি মাথায় চড়ে বসে পরিবারের সবার। তারপর একটা সময় পার্থ বুঝতে পারে সে ভুল মানুষকে ভালোবেসে ঘরে তুলে এনেছে। তারপর থেকে কঠিন হতে শুরু করে জিনিয়ার সাথে। জিনিয়াকে শাষণ আর ভালোবাসা দুইয়েতেই ভাল-মন্দ বোঝানোর চেষ্টা করে। কিন্তু জিনিয়া বদলায় না। বোঝালে কান্নাকাটি করে মেনে নেয় সব, রাত পোহালে যেই কি সেই। বছর গড়াতেই জিনিয়ার স্বভাব আরও বেশি খারাপ হতে থাকে। সবসময় পার্থর সাথে শুধু এই চাই সেই চাই করা আর পরিবারের সব কাজ শ্বাশুড়ী ননদকে দিয়ে করিয়ে তাদের ওপরই ঝাল মেটানো হয়ে উঠে ওর নিত্য কর্ম। পার্থ কিছু বলতে গেলেই সুইসাইড করার ভয় দেখানো তো যেন ডেইলি রুটিন। কয়েকবার চেষ্টাও করে দেখিয়েছে। তবে মরেনি। আর তার আগে সুইসাইড নোট লিখতে ভোলেনি একবারও। নোটে নাম থেকেছে পার্থ, শ্বাশুড়ী, ননদ আর শ্বশুর এর। পার্থকে নিরুপায় হয়ে ঝুঁকতেই হয়েছে জিনিয়ার স্বভাব চরিত্রের কাছে। শেষমেশ বাবা-মা আর বোনকে গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছে যাতে অন্তত মানসিক শান্তিতে থাকতে পারে তারা। তাদের জন্য মাসে মাসে দরকারের চাইতে অল্প হলেও বেশি টাকা পাঠানোর চেষ্টা করেছে জিনিয়ার আড়ালে। তার নিজের বাছাই করা ভুলের শাস্তি সে একাই ভোগ করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জিনিয়াকে না ছাড়ার উপায় আছে আর না আছে ওকে নিয়ে ভাল থাকার উপায়। ভেবেছিল একটা বাচ্চা হলে অন্তত একটু শুধরে যাবে। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে আরও বেশি অথৈ নির্জন সাগরে নিমজ্জিত হয় পার্থ। জিনিয়া মেয়েকে এবার ঢাল বানাতে শুরু করে। তার কাজের লোক চাই, তার বড় ফ্ল্যাট চাই, এটা চাই সেটা চাই করে পাগল করে ফেলে পার্থকে। তবে পার্থ কখনোই জিনিয়ার পরিবারে এসব নিয়ে নালিশ করতো না। পালিয়ে বিয়ে করার পর জাগ্রতর মা একটু আধটু যোগাযোগ রাখত তাই বেশি আবার নালিশ করার জায়গা কোথায়? এভাবেই চলে আসছে পার্থর দিন। জিনিয়াকে জাগ্রতর বাসায় আনার কারণ ছিল পার্থর বোন পিহুর বিয়ের কথা চলছে। এক মাস পর বিয়ের তারিখ। তাই গ্রাম থেকে সবাই শহরে এসেছে বিয়ে পর্যন্ত এখানেই থাকবে। বিয়ের শপিং এবং অন্যান্য কাজ মিলিয়ে সময় লাগবে তাই আগেই চলে এসেছে আর বিয়েও হবে শহরেই। এসবে যাতে জিনিয়ার জন্য কোন নতুন ঝামেলার সৃষ্টি না হয় তাই জিনিয়াকে হুট করে নিয়ে এসেছিল জাগ্রতর বাসায়। এমনিতে তো জিনিয়া জাগ্রতর খোঁজও রাখতো না কখনো। কারও জন্যই মায়া ও মেয়ের মনে।

এসব শোনার পর জাগ্রত বলেছিল সে বড় বাসা দেখে এসেছে আগামী দুই একদিন এর মধ্যে উঠে যাবে সে বাসায়, জিনিয়াকে রেখে যায় যেন। কিন্তু রেখে যায়নি পার্থ। জিনিয়াকে নিয়ে চলে গেছে সাথে। জাগ্রত আর ফাল্গুনীর খারাপ লাগছে পার্থর জন্য। জাগ্রতর আফসোস হচ্ছে কেন বলতে গেল পার্থকে আসতে আর এসে নিয়ে যেতে জিনিয়াকে। ফাল্গুনী আর জাগ্রত মন খারাপ করে বসে আছে নিশ্চুপ। ফাল্গুনী ভাবুক চেহারায় জাগ্রতকে বলতে লাগল,

“বেশিরভাগ কেন অযোগ্য মানুষ গুলোই জুড়ে যায় একজন যোগ্য মানুষের সঙ্গে? আমাদের চারপাশে এমন সম্পর্কই বেশি নজরে আসে যে সম্পর্কে কোন একজন হয় আয়নার মতো স্বচ্ছ আর আরেকজন হয় কাঁদা। আয়না তার স্বচ্ছতা হারায় কাঁদার সংস্পর্শ পেয়ে আর কাঁদা পেয়ে যায় কাউকে হারিয়ে দেওয়ার মনোবল আর পৈশাচিক আনন্দ। আর যদি কিছু যৌগ্য মানুষ একে অপরের সঙ্গ পেয়েও যায় সবাই টিকিয়ে রাখতে পারে না সম্পর্কটা কে স্বচ্ছতায়। কিছু অযোগ্য মানুষ গুলোর কাঁদা ছোড়াছুড়ির ছিটেফোঁটায় স্বচ্ছতা হারায় সেই যোগ্য মানুষগুলের স্বচ্ছ সম্পর্ক-ও। কেন হয় এমন?”

~চলবে