#পুনর্মিলন
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_৩১+৩২
ফাল্গুনী রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে আছে কাজের বাহানায়। ছাঁদে লোডশেডিং হওয়ার পর আচমকা ঠোঁটে জাগ্রতর স্পর্শ পেয়ে দিগ্বিদিক হারিয়ে ত্রস্ত পায়ে দৌড়ে চলে এসেছিল ছাঁদ থেকে। চলে এসেও বেঁধেছিল জ্বালা। চাবি তো ছিল জাগ্রতর কাছে। সেই জাগ্রতর মুখোমুখিই হতে হয়েছে শেষমেশ। সে এসে বেসুরো সুরে শিষ বাজিয়েছে আর তালা খুলে দিয়েছে। তারপর বাসায় ঢুকেছে ফাল্গুনী। বাসায় ঢুকে রান্না ঘরে কাজ এর নামে ঠুকঠাকঃ আওয়াজ করছে এই কিছুক্ষণ হলো। রাতের খাবারের পর সব এঁটো থালাবাসন পরে আছে। ধুতে হবে, কিন্তু হাত যেনো চলছেই না। মনে হচ্ছে এখনও ছাঁদের সেই সময়টা পার হয়নি। আটকে আছে সেই সময়য়ের মায়া জালে। জাগ্রত যেন এখনও খুব কাছেই দাঁড়িয়ে আছে আর…. বাকিটা ভাবতে পারলো না। মোচর দিয়ে উঠলো বুকের ভেতর। চিনচিনে ব্যথাটা বেড়ে গেলো শতসহস্র গুন।
এরইমধ্যে জাগ্রত এসে দাঁড়ালো রান্নাঘরের দ্বারপ্রান্তে। এতোক্ষণ নিসান এর সাথে কথা বলছিল রুমে। নিসান বৌভাত এর আমন্ত্রণ জানালো জাগ্রতকে, সাথে জানালো বিয়ে করা বউ ছেড়ে দামড়া গন্ডারদের সাথে ঘুমানোর দুঃখকথা। কিছুসময় রসিকতা চলল একে অপরকে নিয়ে। জাগ্রত একদিন এর ফারাকে এই মুহুর্তে ছুটি পাবে না তাই দুঃখ প্রকাশ করে বলল সামনে যেকোনো ছুটি পেলে অবশ্যই যাবে বরিশাল তাদের বাড়িতে। কিন্তু আগামীকাল সম্ভব নয়।
নানামুখী কথাবার্তা শেষ করে রান্নাঘরে এসে দাঁড়াল জাগ্রত। পর্যবেক্ষণ করে বোধগম্য হলো, কাজে-কর্মে পারদর্শী বউটা তার থতমত খেয়ে থালাবাসন ধুচ্ছে। ধুতেধুতে কখনো এঁটো বাসনেই রেখে ফেলছে ধোয়া বাসন। কেশে উঠল জাগ্রত। ফাল্গুনী সঙ্গে সঙ্গে পিছু ফিরল। ছটফটে গলায় বলল, “আমি থালাবাসন ধুচ্ছি।”
জাগ্রত ভাবুক চেহারায় বলল, “হুম, তা তো দেখতেই পাচ্ছি।”
“তাহলে যান, রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন। আমি কাজ কমপ্লিট করে আসছি।”
কথার শেষে ছোট্ট করে একটা মন ভোলানো হাসির ট্যাগ ঝুলিয়ে দিল। জাগ্রত ভ্রু কুঁচকে এগিয়ে এসে রান্নাঘরের ভেতরে ঢুকে দাঁড়াল। অল্প জায়গা রান্না ঘরে। দু’জন দাঁড়ালে প্রায় ভরে উঠে ভেতরটা। জাগ্রত দাঁড়িয়ে না থেকে উঠে বসল সিংক এর থেকে একটু দূরে সরে।
ফাল্গুনী এবার আরও একটু ভড়কে গেল। এতোক্ষণ যার কথা ভেবে ভেবেই কাজ এগোচ্ছিল না এখন সে স্বয়ং প্রকট হয়েছে একেবারে সম্মুখভাগে। হাত কি আর চলবে!
কোনমতে কাজ শেষ দিল ফাল্গুনী। কাজ শেষ হতে না হতেই জাগ্রত তাড়া দিল ওকে রুমে যাওয়ার জন্য। ফাল্গুনী এটা সেটা টুকটাক জিনিসপত্র নেড়েচেড়ে ঢিলেমি করতে লাগলে জাগ্রত হাত ধরে টেনে নিয়ে হাঁটা দিল বেডরুমের দিকে। ওকে বিছানায় বসিয়ে রেখে রুমের সিটকিনি আটকে এসে সামনাসামনি দাঁড়াল ওর। গম্ভীর স্বরে বলল,
“এতো পালিয়ে বেড়াতে হবে না আমার থেকে। ভয় নেই, তোমার অনিচ্ছায় তোমাকে আর ছুঁয়ে দেখা তো দূর কাছেও ঘেঁষবো না। তবুও এমন পালিয়ে বেড়ানো বন্ধ কর। যাও শুয়ে পড় ওপাশটায়।”
জাগ্রতর গলায় ছিল অভিমান আর খানিকটা মন খারাপ, তবে সবটাই ছিল মেকি। ফাল্গুনীকে সহজ করতে হলে টক, ঝাল, মিষ্টি সব স্বাদ-ই চাই তার আচরণ আর কথায়, এমনটাই তার ভাবনা। তাই একটু মেকি কথায় বাজিয়ে দিল ফাল্গুনীকে। এবার দেখা যাবে নিজেই কাছ ঘেঁষে বসে থাকবে তার। জাগ্রত মনে মনে কল্পনা জল্পনা আঁকতে আঁকতে শুয়ে পড়লো বিছানার একপাশে। এদিকে ফাল্গুনী বসে রইল অসহায়, অবলা মুখাবয়ব নিয়ে। হতবিহ্বল হলো আকাশ পাতাল ভাবনায়। কি বলবে কিভাবে বলবে শব্দই খুঁজে পেল না। শব্দের বড্ড অভাব বোধ করল ফাল্গুনীর অসহায় মন-মস্তিষ্ক।
দুমিনিট বাদে জাগ্রত ঘাড় ফিরিয়ে দেখল ফাল্গুনী এখনও একইভাবে মুর্তিমান হয়ে বসে আছে। দিল এক ধমক।
“এখনও বসে আছো কেন? এখন কি কোলে করে এনে ঘুম পারাতে হবে?”
ফাল্গুনী তৎক্ষনাৎ এক মুহুর্তের মধ্যে উঠে গেল বিছানায়। মাথা ঠেসে শুয়ে পরলো পিছু মুড়ে। জাগ্রত একটু অবাক-ই হলো। ফাল্গুনী কেমন শুড়শুড় করে টুপ করে শুয়ে পরল এক ধমকে। জাগ্রতর এবার অপরাধবোধ হলো। ভাবল, একটু বেশিই হয়ে গেল বোধহয়। আবার একটু অবাক চিন্তাও বাঁধলো মনে। ফাল্গুনীর মত শক্ত একটা মেয়ে কিনা এভাবে এক ধমকে কপোকাত! জাগ্রত মনে মনে আওড়াল,
“তোমাকে এতোটা ভীতু মানায় না ফাগুন। এতোটা বাধ্য খোলসে তোমাকে ভাল লাগে না।”
জাগ্রত সরি বলবে করে ফাল্গুনীর দিকে ফিরতেই আচমকা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো ফাল্গুনী। বুকে মাথা রেখে বড় বড় শ্বাস নিতে লাগলো। নিজেই বলল, “সরি”। জাগ্রত সঙ্গে সঙ্গে ফাল্গুনীর মাথা উঠিয়ে ধরে বলল, “উহুম্, সরি নয়। আমি এমনি একটু দুষ্টুৃমি করছিলাম তোমার সাথে। তুমি তো একেবারে সিরিয়াস হয়ে গেলে। ইশ কি বাধ্য বউ আমার! শোন, তোমাকে না রণচণ্ডী দশাতেই ভালো মানায়। আমি একটা বললে তুমি দুটো উত্তর দেবে তবেই না জমবে বল।”
ফাল্গুনী হেসে দিল খিলখিল করে। যেন পঞ্চাদশী কোন কিশোরী হাসছে ঠোঁট ভরা প্রাণোচ্ছল হাসি। যেকোন বয়সের যেকোন মেয়ে তার প্রেমিক পুরুষ এর নিকট অবুঝ মনা কিশোরী প্রেমিকা হয়েই থাকে, থাকতে চায়। তা জেনে হোক বা না অজান্তে। পরিণত হৃদয় নিয়ে আর যাই হোক প্রেমিকা হওয়া যায় না; প্রেমিক-ও না।
জাগ্রত মুগ্ধ চোখে আঁটকে রইলো ফাল্গুনীর হাসিতে। কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে সামলে নিল নিজেকে। এক হাতে ফাল্গুনীর মাথা বুকে চেপে ধরে বলল,
“ঘুমোও এখন। চিন্তা করো না, তোমার অস্বস্তি হয় এমন কিছু আমি করব না। তোমার যত সময় লাগে তুমি নাও। শুধু পালিয়ে বেড়িয়ো না। এই এভাবে শুধু তোমাকে জরিয়ে ধরে ঘুমোবো। ওকে, এবার পিছু ঘুরে শোও।”
জাগ্রত ঘুরিয়ে শোয়ালো ফাল্গুনীকে। তারপর পিছন থেকে জরিয়ে ধরে শুয়ে পড়লো নিশ্চিন্তে। এদিকে ফাল্গুনী মুখ লটকিয়ে শুয়ে রইলো। মনপুত হলো না কেন জানো জাগ্রতর কথা। সে তো নিজে থেকেই জড়িয়ে ধরল তাকে, সঁপে দিল নিজেকে। তবুও এই কথা বলছে! এখনও কি রাগ রয়ে গেল কিনা মনে! ভাবল, এবার কি লোকটাকে ঘটা করে আনুষ্ঠানিক ভাবে বলতে হবে, “আমি আপনার হতে তৈরী মহাশয়। কৃপা করে গ্রহণ করুন আমাকে জাঁহাপনা।” মনে মনে এলোমেলো শব্দগুচ্ছ বুনলো গুটিকয়েক লাইন। আচমকা জাগ্রতর প্রশ্নে ভাঁটা পরলো চিন্তা সমুদ্রে। জাগ্রত বলল,
“আজ সোহাগ ফোন দিয়েছিল, না?”
ফাল্গুনী সময় নিল না। সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল, “হুম”।
জাগ্রত আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না। চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইল ফাল্গুনীকে জাপটে ধরে। জিজ্ঞেস করতে চাইছে অনেক কিছু কিন্তু সাজিয়ে গুছিয়ে কিভাবে জিজ্ঞেস করবে তা বুঝে উঠতে পারছে না। ভাবছে গুছিয়ে বলতে না পারলে ফাল্গুনী যদি ভুল বোঝে! ফাল্গুনীও আর কিছু বলল না। সেও চুপ করে শুয়ে রইলো একভাবে।
দুপুরে ফাল্গুনীর যতটুকু কথা শুনেছিল জিনিয়া তাতে মশলা-লবন দিয়ে উল্টোভাবে সে বলেছিল জাগ্রতকে। এমন ভাবে কথাগুলো উপস্থাপন করেছিল যার তাৎপর্য ছিলো এই যে, ফাল্গুনীর কারও সাথে সম্পর্কে আছে। যার সাথে সম্পর্ক সে দু’দিন যাবত বিভিন্ন নম্বর থেকে কল করছে আর ব্লক খাচ্ছে। তাকে ব্লক দেওয়ার কারণ হচ্ছে সে ব্ল্যাকমেইল করছে ফাল্গুনীকে কিছু একটা নিয়ে। হয়তো জাগ্রতকে কিছু বলে দেবে বলছে! এমন আরও কিছু ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলেছে জিনিয়া। জাগ্রত পুরো কথা বিশ্বাস করেনি তবে এটুকু বুঝেছে ফাল্গুনীকে হয়তো সোহাগ ফোন করে জ্বালাতন করছে। তাই চিন্তা হচ্ছে মনের মধ্যে। কিন্তু ফাল্গুনী নিজে থেকে কিছু না বললে নিজে জিজ্ঞেস-ও করতে পারছে না। পাছে ফাল্গুনী এমন না ভাবে যে সে সন্দেহ করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে ওকে। ভাবছে ফাল্গুনী হয়তো তাকে বলতে দ্বিধাবোধ করছে অথবা অস্বস্তিতে বলছে না। এদিকে ফাল্গুনী-ও নিজে থেকে বলছে না কারণ সে ভাবছে সোহাগের কথাগুলো জাগ্রত শুনলে মন খারাপ করতে পারে। শুধু শুধু অতীত টেনে কি লাভ! সোহাগ যা বলেছে তা আংশিক হলেও সত্যি। পুরোটা তো মিথ্যে নয়। তবে সোহাগ যে এসব জেনেশুনে বলেনি তা ফাল্গুনী জানে। সে আন্দাজে ঢিল ছুঁড়েছিল ফাল্গুনীর ডায়েরিতে ফাল্গুনীর লেখা চার লাইনের একটা কবিতার উপর ভিত্তি করে।
গতকাল সোহাগের কল আসার খানিক আগে সোহাগের মামি অর্থাৎ যাদের বাসায় ফাল্গুনী চার বছর থেকেছে তার কল এসেছিল। সে বলেছে সোহাগ নাকি বরিশাল ফিরে গিয়ে ফাল্গুনীর জন্য বরাদ্দকৃত রুমটাতে গিয়ে থাকতে শুরু করেছে। ফাল্গুনীর যাবতীয় জামা-কাপড় দরকারী জিনিসপত্র সব বাইরে বের করে দিয়েছে। কিন্তু একটা ডায়েরি রেখে দিয়েছে আড়াল করে। ডায়েরিটা প্রয়োজনীয় বা গোপনীয় কিনা তা জিজ্ঞেস করতেই ফোন করেছিলেন তিনি। কারণ সে জানে তার ভাগ্নে পছন্দ করতো ফাল্গুনীকে। ডায়েরি নিয়ে কোন কান্ড না বাঁধায় সেই ভয়েই ফোন করেছে তৎক্ষনাৎ।
সেই ডায়েরিতে তেমন গোপনীয় কিছু লেখা ছিল না। ছিল কিছু রোজনামচা আর ছিল দু’তিনটে কবিতা। তন্মধ্যে একটি কবিতা ছিল জাগ্রতকে নিয়ে লেখা। বিয়ের প্রথম ছ’মাসের সংসার জীবনে লিখেছিল ফাল্গুনী। বড্ড অভিমানী কিছু এলোমেলো শব্দগুচ্ছ গুছিয়ে লেখা চার লাইনের অবুঝ অনুভূতি। কবিতাটি হলো,
“মন ছুঁয়েছ, ছোঁও নি শরীর, তাতেই এমন হাল!
যদি ছুঁতে, আমার হতে, তবে হতো মোর কাল।
ভাগ্যিস তোমা মোহ ছিলো অন্য কোন নারী,
নচেৎ পঁচে গলে যেতাম মরে যুদ্ধ হতো জারি।”
ঝিমলি আর জাগ্রতকে উদ্দেশ্য করে তখনকার সময়ের লেখা ছিল এটা। বড্ড অভিমান নিয়ে লিখেছিল। জাগ্রতকে ফোনে বলতে শুনেছিল, “ঝিমলি অনেক সুন্দরী। তাকে যেদিন প্রথম দেখতে গিয়েছিলাম সেদিনই খুব পছন্দ করে ফেলেছিলাম। মনে গেঁথে গিয়েছিল অপরুপ এক ডানা কাটা পরি আমার বউ হতে চলেছে। তাই হয়তো ফাল্গুনীকে মনে জায়গা দিতে সময় লাগছে। ঝিমলি মোহ ছিলো আমার। আমি চাই ফাল্গুনী আমার মোহ না হোক, হলে হোক ভালোবাসা অথবা ভরসা। তা না হলে অন্তত সম্মানের জায়গায় থাকুক। তবে এটুকু বলতে পারি ঝিমলি কে আমি কখনো ভালোবাসি নি। সে আমার মনকে স্পর্শ করেনি কখনো। তবে এটাও সত্যি, ফাল্গুনীর সামনে দাঁড়ালেই কেন জানি ঝিমলির কথা মনে পড়ে যায়। কেন মনে পড়ে জানি না। হয়তো মোহ কাটিয়ে উঠতে পারি নি তাই।”
জাগ্রতর এই কথাগুলো ছিল বিয়ের দু’মাস পরের। কোন এক বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছিল সে। জানালার পাশ থেকে শুনে নিয়েছিল তা ফাল্গুনী। কিশোরী মন ছিল তখন ফাল্গুনীর। সবে ষোল বছর বয়স। অতি আবেগে ডায়েরি হাতে বসে পরেছিল অনুভূতির বহর সাজাতে।
রাগ করে সোহাগের ফোন কেটে দেওয়ার পর কিছুসময় নিয়ে ভেবেচিন্তে বুঝতে পেরেছে ফাল্গুনী সোহাগের চালাকি। তার-ই ডায়েরির সাহায্য নিয়ে যে তাকেই বোকা বানানোর চেষ্টা করছে তা বুঝতে বেশি সময় লাগে নি তার। তাই তো নিজেই কল দিয়েছিল আবার। কল করে প্রথমে চুপচাপ শুনেছে সোহাগ কি কি বলে। সম্পূর্ণ কথা শুনে আরও নিশ্চিত হয়েছে যে সোহাগ তার ডায়েরিকে হাতিয়ার করেই মাঠে নামতে চাইছে। তাইতো আত্মবিশ্বাসী গলায় ধুয়ে দিয়েছে সোহাগকে।
________________________
“রতন আর হাসির জামাইরে থানার মধ্যেই রাখছে। ছাড়ে নাই গো লাকির মাও। রতন টেহা পয়সা দিয়া চেষ্টা করছে ছাড়া পাওনের, পায় নাই ছাড়। ইউএনও মেডাম নিজে দেখতাছে হেগোর কেছ। হে আমারে ভরসা দিয়া কইছে দুইডারে জেলের ভাত খাওয়াইয়া ছাড়বো। তা যে কয়দিনের লাইগাই হোইক। হাসি আর লাকির জবানবন্দি লাগবো। সামনে কাম আছে অনেক।”
এটুকু বলে থামল প্রবীর। খুশি কি বলবে বুঝতে পারছে না। হাসি চুপচাপ শুনলো শুধু। এরমাঝে লাকি এলো ঘরে। স্নান করে ভিজে জবজবে হয়ে এসেছে। শাড়ীর উপর গায়ে মোড়ানো রঙ জ্বলে যাওয়া পুরোনো লাল একটা গামছা। সে সরাসরি ঢুকে গেল নিজের জন্য বরাদ্দকৃত রুমটাতে কাপড় ছাড়বে বলে। খুশি ছুট লাগাল চুলোর পাড়ে। পোড়া বেগুনটা ভর্তা মাখাতে হবে। মেয়েটা সারাদিন পর গরম ভাত খেতে চেয়েছে পোড়া মরিচ তেল দিয়ে। সাথে যদি পোড়া বেগুন ভর্তা পায় তবে কি খুশিই না হবে!
প্রবীর চলে গেল কলপাড়ে হাত-মুখ ধুতে। রুমে রয়ে গেল হাসি। কিছুক্ষণ পর লাকি ঘরের দরজা খুলে ভেজা কাপড় হাতে বেরিয়ে এলে হাসি এগিয়ে গিয়ে সামনে দাঁড়াল। লাকির হাত থেকে নিয়ে নিল ভেজা কাপড়। লাকি বাঁধ সেধে বলল,
“আমি ধুয়ে শুকোতে দিয়ে দিচ্ছি, দিন। ওতে কাঁদা লেগে আছে অনেক।”
“আমি দিতাছি। তর শরীর ভাল না। দিদির ভাত রান্ধা হইছে, ভর্তা মাইখা তরে ডাক দিবনি। হেই পর্যন্ত একটু শুইয়া থাক।”
“আমি একদম সুস্থ আছি। দিন ওগুলো।”
“মায়ের সামনেও নাটক করবি? লাভ কি? আমি তো সব বুঝি, সব-ই বুঝি।”
লাকি হাসির চোখে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বলল,
“মায়েরাও তো করে। মা যদি মেয়ের সামনে নাটক করতে পারে মেয়ে কেন পারবে না?”
“নিজের সম্মান ডা কেন খাইলি মা? সম্মান নিয়া নাটক না সাজাইলেও পারতি।”
“আমি আমার অসুখের কথা বলছি।”
“আমি দুপুরের কতা কইতাছি।”
“সরুন সামনে থেকে।”
“রতন সত্যি কতা কইতাছিল তাই না? হে তর সম্মানহানী করার চেষ্টা করে নাই। আর তর বাপ…তর.. আঁখির বাপ, হেও তরে কোন হুমকি ধামকি দেয় নাই। কেন মিথ্যা কথা কইলি?”
“নিজের স্বামীর জন্য বড্ড গায়ে লাগছে?”
“নিজের কইলজা ছিঁড়া ধন আছে আমার, তার নিগে গায়ে লাগে”
“সে মরেছে?”
“সম্মান তো গেছে। মেয়াগোর সম্মান-ই তো সব রে বিশালাক্ষী।”
“আপনার কি আছে? স্বামীর ভালোবাসা আছে? স্ত্রী হিসেবে স্বামীর কাছে সম্মান আছে? সন্তান জন্ম দেওয়ার পর তাকে বুকে আগলে রাখার অধিকার আছে? নাকি একবেলা লাথিগুতো ছাড়া দুমুঠো ভাত হজম করার সুযোগ আছে? এগুলো কি কিছুই না? এগুলো না পেয়েও তো বেঁচে আছেন। আমার তো শুধু একটা গেছে। সম্মান। আমি দিব্যি বেঁচে থাকব।”
“আমার জীবন তরী তো প্রায় শেষ পারে আইসা ঠেকছে। যা শুরুতে পাই নাই তা নিয়া শেষে চিন্তা কইরা কি হইবো?”
“আপনাকে চিন্তা করতে কে বলেছে? আমি বলেছি? বলেছি কি, আমাকে কেন বুকে আগলে রাখতে পারলে না ওই বাবা নামক পশুটার সঙ্গে লড়াই করে। বলেছি কি, কেনো প্রতিবাদ না করে চুপচাপ মুখ বুজে মেনে নাও ওই পশুটার অত্যাচার। এমন আরও অনেক না বলা কথা আছে। বলেছি কি কখনো? বলিনি। থাক সেসব।”
“তুমি কইরা কইলি বিশালাক্ষী? একবার মা ক না!”
“বলব। যদি সুভাষ চন্দ্রের জন্য জেলের ভাতের বন্দবস্ত করেন দীর্ঘমেয়াদি; তাহলে বলব।”
লাকি কিছুক্ষণ চুপ থেকে দীর্ঘশ্বাস টেনে নিয়ে বলল, “আমার আরও একটা বোন ছিল। আপনার স্বামী বাঁচতে দেয়নি তাকে। আমার প্রাণোচ্ছল হাসি খুশি একটা মা ছিল, তাকেও আধমরা করে রেখেছে। কেড়ে নিয়েছে তার মুখের হাসি, শুধু নামটাই রয়ে গেছে হাসি। শারীরিক, মানসিক সবদিকেই পঙ্গু করে দিয়েছে। সেই মায়ের গায়ে এখন আর ফুলের টোকাও সহ্য হয় না। ভেঙে পড়ে তার শরীর। আমাকেও কেড়ে নিয়েছে তার বুক থেকে। তবুও ছাড় নেই তার। আমার বড় বোন আঁখি, ওকেও কম অত্যাচার করেনি ওই পশুটা। ছেলে ছেলে করে গলা শুকিয়ে মরেছে, ছেলে পাওয়ার পর যত্ন কোথায়? গ্যারেজে কাজে লাগিয়ে দিয়েছে টাকার ধান্দায়। আঁখি তবুও নিজের গরজে নিজে টিউশনি করিয়ে পার হয়ে গেছে পড়ালেখা করে কিন্তু শুভ? ওর ভবিষ্যৎ টা গ্যারেজেই খুঁটি গেঁড়ে আঁটকে দিল। আমার মা তো আর প্রতিবাদ করবে না তাই আমি আমার সম্মান এর বিনিময়ে বেছে নিয়েছি লোকটার শাস্তি। যা যা বলেছি তার নামে তাতে খুব একটা সুবিধা করে উঠতে পারবে না। ঘুরিয়ে পেচিয়ে বলেছি, অল্প কিছু মিথ্যেও বলেছি। তবে পুরোপুরি অগ্রহনযোগ্য কিছু তো বলিনি। দোষীকে দোষারোপ করেছি মিথ্যে বলে। তাতে অন্যায় হবে না। এখন যদি আমার মা তার সন্তানকে সাহস জুগিয়ে পাশে দাঁড়ায়, মুখ খুলে ওই পশুটার বিরুদ্ধে তাহলে সার্থক হবে আমার বলিদান। দেখি কি করে সেই মা।”
লাকি হাসির হাত থেকে কাপড় টেনে নিয়ে চলে গেল বাইরে। হাসি দাঁড়িয়ে রইলো রইলো ঠায়।
___________________
তিন ভাই এর সঙ্গে গাদাগাদি করে বিছানায় শুয়ে আছে নিসান। একজন নাক ডাকছে ঘড়ঘড় করে, একজন হাত-পা উঠিয়ে জাপটে ধরে শুয়ে আছে। আরেকজন তো আরও এক কাঠি উপরে আছে। একটু পরপর সে ভাষন দিয়ে উঠছে কিসব বলে চিৎকার করে করে। নিসান শুভর পশ্চাৎদেশে লাথি বসিয়ে দিল একটা। বিরবির করে বলল,
“বেটা রাজনীতি করিস কলেজে কর না। আমার কানের গোড়ায় কেন করছিস? শা**লা এসছিস পর থেকে আমার বউ এর মাথা খেয়েছিস শুভ নামটার ফায়দা লুটে। কান ভাঙিয়েছিস আমার নামে। এখন আবার আমার কানের মাথা খাচ্ছিস, ঘুমোতে দিচ্ছিস না। কোথায় ভেবেছিলাম আজ বউ নিয়ে রাত জাগব! কি কপাল আমার রাত জাগছে হচ্ছে গন্ডারগুলোর সাথে।”
কোনমতে রাত কাটালো নিসান। ভোর হতে না হতেই উঠে গেল বিছানা ছেড়ে। রুম ছেড়ে সরাসরি গিয়ে ঢুকলো মায়ের রুমে। চন্দনা উঠে গেছে আরও অনেক আগেই। সে এখন রান্নাঘরে সকালের খাবার তৈরী করছে। নিসান গিয়ে বাবার পাশে শুয়ে পড়লো। অন্তত ভোরটুকু তো ঘুমানো যাক।
ভোর হতে না হতেই আঁখি উঠে পরেছে। রান্নাঘরের আশেপাশে কিছুক্ষণ ঘুরঘুর করেছে শ্বাশুড়ী মা আর মামীদের হাতে হাতে সাহায্য করবে বলে। কিন্তু চন্দনা এক ধমকে পাঠিয়ে দিয়েছে রুমে। সবগুলো মেয়েকে বলেছে আঁখিকে সঙ্গ দিতে যাতে তার একা না লাগে।
বেলা গড়াতেই বাড়িতে আগমন হলো দোলা, গৌরব আর তার দুই ভাইবোনদের। ওদিকে সাজসজ্জার জন্যও লোক এসে গেছে। কাজ শুরু করে দিয়েছে তারা। গমগমে পরিবেশ এখন পুরো বাড়ির আনাচে-কানাচেতে।
দোতলা বাড়িটার উপরতলা ভাড়া দেওয়া। উপর তলায় থাকে অরিনদের পরিবার। অরিনদের গতকাল সন্ধ্যায় আমন্ত্রণ জানাতে গেছিল চন্দনা। চন্দনার কষ্ট হচ্ছিল। আর কেউ না জানুক সে তো জানতো মেয়েটা কতোটা পছন্দ করতো নিসানকে। মেয়েটাকে বেশ মনে ধরেছিল চন্দনার। তাই তো মনে মনে নিসান এর বউ করবে ভেবে নিসানকে বলেছিল অরিন এর কথা। কিন্তু তা আর হলো কোথায়!
অরিন গতকাল সন্ধ্যায় মামাবাড়ি চলে গেছে কিছুদিন বেড়াতে যাওয়ার বাহানায়। নিসানকে অন্যকারও সাথে দেখতে বড্ড কষ্ট হবে যে।
আঁখি ভেবেছে নিসানকে একটু বলবে বাড়িতে ফোন করে মায়ের খোঁজ নিতে। বুকটা যেন ফেটে পড়ছে মায়ের গলার আওয়াজ শোনার জন্য। ভাবছে, কি জানি সে চলে আসার পর ওই লোকটা কি করছে মায়ের সাথে! কিন্তু নিসানকে বলতেও দ্বিধা হচ্ছে মনে। সে তো বলেছিল ও বাড়ির কারও সাথে কোন সম্পর্ক রাখা যাবে না। মায়ের সাথেও কি না?
দুপুর গড়াতে না গড়াতেই বাড়ি ভর্তি হয়ে গেল আত্মীয়-স্বজনে। যাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে তাদের কেউ-ই বাদ যায় নি। সবাই এসেছে নিসান এর বউ দেখবে বলে। হটাৎ করে এমন বউ নিয়ে উদয় হয়েছে ছেলেটা, কেমন বউ আনলো তা দেখতে হয় না! তাইতো সবাই ছুটে এসেছে নিমন্ত্রণ পেতেই। সবাই আঁখিকে দেখে পছন্দ করলেও আঁখির পরিবার সম্পর্কে কেউ কিছুই জানে না। একেকজন একেক ধরনের কথা বলাবলি করছে নিজেদের মধ্যে। কেউ চন্দনাকে জিজ্ঞেস করছে তো কেউ সরাসরি আঁখিকেই চেপে ধরছে। নিসান আঁখিকে বলে দিয়েছে যা বলার সে নিজে বলবে সবাইকে সময়মতো। তাই সে যেন কারও প্রশ্নের জবাব না দেয়। একজন একটা প্রশ্নের জবাব পেলে দশজনে দশটা প্রশ্নের ঝুলি খুলে বসবে তাই প্রশ্নোত্তর পর্বে না যাওয়াই ভাল। এমন কথা শোনার পর আঁখি শুধু মাথা নেড়ে সায় জানিয়েছে কাঠের পুতুলের মতো। তাতেও এক ধমক খেয়েছে নিসান এর কাছে। নিসান বলেছে,
“ওমন কাঠের পুতুলের মতো মাথা নাড়াচ্ছ কেন? দুই একটা প্রশ্নও তো করতে পার? চুপ থাকা ভুলে কথা বলা শেখো। এটা খুব দরকার। আর যা বলেছি মনে যেনো থাকে। সবার প্রশ্নের জবাবে শুধু আমার নাম বলবে। বলবে আমি সবার উত্তর দেব।”
সকালের খাবার শেষে বোনদের ঘর থেকে বিদায় করেছিল কিছু মুহুর্তের জন্য। তখন উপদেশ দিয়ে গেছে আঁখিকে। সাথে দিয়ে গেছে কপালের মাঝ বরাবর ঠোঁট এর উষ্ণ এক স্পর্শ।
দুপুরের খাবারের পর আঁখিকে সাজাতে বসানো হল। সাজাবে মিতু আর হেল্পার হবে বাকি তিন বোন। ওদিকে নিসানকে ধুতি পড়ানোর দায়িত্ব নিয়েছে শুভ, দ্বীপ আর অয়ন। তিনজনে মিলে হিমশিম খাচ্ছে নিসানকে ধুতি পড়াতে গিয়ে। নিসান নিজেই পারে ধুতি পড়ার কাজ তাও নিজে পড়ছে না। ভাইদের গায়ের গাম ছুটানোর এত ভাল সুযোগ কি আর এতো সহজে ছাড়া যায়?
~চলবে