প্রণয় রেখা পর্ব-২৩+২৪

0
282

#প্রণয়_রেখা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২৩.

দিনগুলো চলে গেল চোখের পলকেই। আর দু’দিন পর থেকে মোহনার ফাইনাল পরীক্ষা। এই কয়দিন সে খুব পড়েছে। ভার্সিটিতে খুব প্রয়োজন ছাড়া যায়নি। এশা আর রাফাতের সাথেও এখন খুব একটা কথা হয় না। তবে এই কয়দিন সে প্রায় রোজ বিকেলেই ছাদে যেত। আর ঠিক রোজ বিকেলেই লরিন বাড়ির ওপাশের রাস্তায় দাঁড়িয়ে মোহনাকে দেখত। মাঝে মধ্যে ইশারা দিয়ে মাহিয়ার সাথে কথা বলত। লরিন এর মাঝে অনেকবার চেয়েছিল, মোহনার বাবার কাছে তাদের বিয়ের কথা বলার জন্য। কিন্তু, মোহনা তাকে বারণ করে বলেছে, সামনে তার পরীক্ষা এখন বিয়ের কথা বললে বাবা তার উপর ক্ষেপে যেতে পারেন। তখন দুশ্চিন্তায় তার পরীক্ষা খারাপ হবে। মোহনার কথা রাখার জন্য আপাতত লরিনও চুপ রয়েছে। ঐদিকে অরূপের তরফ থেকেও কোনো পজিটিভ রিপ্লাই আসেনি, এই নিয়ে মোহনাও এখন অনেকটা নিশ্চিন্ত। সে ভেবেই নিয়েছে, অরূপ হয়তো আর এই বিয়েতে রাজিই হবে না।

আজ বিকেলে হুট করেই এশা মোহনাকে কল করে। প্রথমে মোহনা কল রিসিভ করেনা। কিন্তু এশার লাগাতার কলে মোহনা পরে বাধ্য হয় কল রিসিভ করতে। আর কল রিসিভ করার সঙ্গে সঙ্গেই মেয়েটা হাউমাউ করে কাঁদতে আরম্ভ করে। এমন ভাবে কাঁদছে যেন তাকে কেউ মেরে ফেলছে। তার অমন কান্নার স্বর শোনে মোহনাও হতভম্ব হয়ে পড়ে। ভয়ও পেয়ে যায় খুব। অস্থির গলায় বলতে থাকে,

‘কী হয়েছে, এশা? এভাবে কাঁদছিস কেন?’

এশার কান্না থামছে না। মোহনা আরো বেশি বিচলিত হয়ে উঠছে। প্রায় দুই সপ্তাহ পর এশা তাকে আজ কল করেছে। হঠাৎ এমন কী হলো যে মেয়েটা কল দিয়ে এভাবে কাঁদছে। মোহনা বই বন্ধ করে উঠে দাঁড়ায়। উদ্বিগ্ন সুরে আবারও বলে,

‘কিরে, বলনা কী হয়েছে?’

এশা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল,

‘তুই আমাকে কবে ক্ষমা করবি? আমি যে আর এভাবে থাকতে পারছি না। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, দোস্ত। প্লিজ, আমাকে ক্ষমা করে দে।’

মোহনা কপালে ভাঁজ পড়ে। এর জন্য এশা এভাবে মরা কান্না কাঁদছিল? মোহনার রাগ হলো। সে ক্ষেপে গিয়ে বলল,

‘এর জন্য তুই এভাবে কাঁদছিলি? আর আমার এইদিকে বুকে মোচড় দিয়েছে ভয়ে। এর জন্য তুই এমন মরার মতো কাঁদছিলি কেন, আশ্চর্য?’

‘তুই আমার সাথে আর কত রাগ করে থাকবি? কতদিন তোকে দেখি না। লরিনের কাছ থেকে খবর নিই। ও তো তোকে প্রায়ই ছাদে দেখে, পরে আমাকে কল করে সব বলে। কিন্তু তাও তোর সাথে কথা বলতে না পারার আক্ষেপ টা তো আমার থেকেই যায়। আমি মানছি আমি ভুল করেছি, অনেক বড়ো ভুল করেছি। কিন্তু তুই আর আমাকে এভাবে শাস্তি দিস না প্লিজ। আমার এখন খুব কষ্ট হয়। তুই ছাড়া আমাকে কে বোঝে বল? কত কথা জমে আছে, কিন্তু বলার মানুষ নেই। একটু দয়া কর দোস্ত, প্লিজ আমায় ক্ষমা করে দে।’

মোহনা যেন বাকরুদ্ধ। মন বলছে এক কথা আর মস্তিষ্ক বলছে আরেক কথা। এখন তো আর রাগ নয়, অভিমান হচ্ছে। কিন্তু, মেয়েটার এত আকুতি মিনুতির কাছে সে তো এই অভিমানটাকেও ধরে রাখতে পারছে না। কী করবে এখন? ক্ষমা করে দিবে এশাকে?

মোহনার কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে এশা আবারও কাঁদতে আরম্ভ করল। মোহনা এবার বিরক্ত গলায় বলল,

‘থামবি। তখন থেকে তোর ব্যা ব্যা শুনতে শুনতে এখন আমার মাথা ব্যথা করছে।’

এশা নাক টেনে জবাবে বলল,

‘তাহলে আমাকে ক্ষমা করে দে।’

হ্যাঁ, ক্ষমা করা যায়। ক্ষমা মহৎ গুণ, ক্ষমা করলে কেউ ছোট হয় না। তবে মাঝেমধ্যে অভিমানের পাল্লা এত ভারি হয় যে ক্ষমা করতে গেলেও কয়েকবার ভাবা লাগে।

এশা ফ্যাচফ্যাচ করে বলল,

‘ক্ষমা করবি না, মোহনা?’

এশার এমন সুরে মোহনা আর নিজেকে কঠোর রাখতে পারল না। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,

‘তোর সাথে কথা বলতে না পারলে আমার নিজেরও শান্তি লাগে না। কষ্ট তো আমারও হয়। তবে যখনই ঐ কথাগুলো মনে পড়ে তখন তোর উপর থেকে রাগটা আর ফেলতে পারি না। মনে হয় আর কখনোই কথা না বলি। কিন্তু, একটু পরেই আবার তোর কথা মনে পড়ে। তোদের দেখি না কতদিন। খারাপ তো আমারও খুব লাগছে। কিন্তু, মনের অভিমানের কাছে সেই খারাপ লাগা আর টিকতে পারছে না। তবে আমিও আর পারছি না। অনেক হয়েছে এই মান অভিমান। রাগ পুষে রাখতে রাখতে মন ভার হয়ে উঠেছে। আর পারব না। ক্ষমা করে দিয়েছি তোকে। তবে এরপর যদি কোনোদিন এমন কিছু করেছিস তাহলে আর জীবনেও ক্ষমা পাবি না।’

এশা অস্থির হয়ে বলতে লাগল,

‘না না, আর জীবনেও আমি এই ভুল করব না। এই তওবা কাটালাম। এখন একটু কষ্ট করে দরজাটা এসে খোল।’

মোহনা অবাক হয়ে বলল,

‘দরছা খুলব মানে? তুই কি বাইরে?’

‘হ্যাঁ, তখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি। তাড়াতাড়ি এসে দরজা খোল।’

মোহনা কল কেটে দরজার কাছে ছুটে গেল। দরজা খুলে দেখল সত্যি সত্যিই এশা বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটার ফর্সা মুখ লাল হয়ে আছে। এতক্ষণ সে তাদের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কেঁদেছে? মোহনাকে দেখে এশা ঝাপটে জড়িয়ে ধরে, যেন কত বছর পর দেখা। মোহনাও আর সংশয় না করে এশাকে জড়িয়ে ধরে। ভেতর থেকে তখন মাহিয়াও দরজার সামনে আসে। দুই বান্ধবীর ভালোবাসা দেখে সে খুশিতে হাত তালি দিতে থাকে।

এশা আসার কিছুক্ষণ পর মোহনা রাফাতকেও কল করে আসতে বলে। কতদিন পর ওরা তিন বন্ধু এক হয়েছে, কতদিন পর আবার একটু মন খুলে হেসেছে ওরা। সেই আগের মতো, হাসতে হাসতে একজন অন্যজনের পিঠে দুই চারটা চড় মেরে দেওয়ার প্রকোপটাও এখনো রয়েছে। যেন কয়েকদিনের জমানো কথা শতশত বছরের জমানো কথার সমান হয়েছে। আজ সেগুলো মন খুলে বলে তবেই মন হালকা হলো তাদের।

মোহনার হাতে কফি খেয়ে তবেই এশা আর রাফাত বাড়ি ফিরল। মোহনার আজ আনন্দ লাগছে। মনে হচ্ছে আজ যেন আবার নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছে সে। বন্ধুত্ব সুন্দর জিনিস। তবে যদি সেখানে স্বার্থ চলে আসে তবে সেই সুন্দর জিনিসটাই কুৎসিত হতে বেশি সময় লাগে না।

রাতে বাবার সাথে ফোনে কথা বলে মোহনা আবার গিয়ে পড়তে বসে। মা আর তার ছোটবোন শুয়ে পড়েছে । মোহনা একাই তখন তার রুমে পড়ছিল। তখন আচমকাই তার ফোনে ভো ভো শব্দ হয়। এমন নিস্তব্ধ পরিবেশে এই ভো ভো শব্দেই মোহনা যেন আঁতকে উঠে। সে তাড়াহুড়ো করে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে, “লরিন”। এই ছেলেটা এমন হুটহাট করে কেন কল দেয় কে জানে। মোহনা কল রিসিভ করে। বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে,

‘কী হয়েছে, এত রাতে কল দিয়েছেন কেন?’

‘একটু বেলকনিতে আসবে?’

মোহনার ভ্রু কুঁচকে যায়। তার জানা মতে লরিন তো আজ তার বাড়িতে। এশা তো তাই বলল। তাহলে সে এখন হঠাৎ মোহনাকে বেলকনিতে যেতে বলছে কেন? মোহনা বলল,

‘কেন, বেলকনিতে গিয়ে কী হবে?’

‘আসলে, তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।’

‘আপনি কি এখানে? আপনি না আপনার বাড়িতে ছিলেন?’

‘হ্যাঁ, ছিলাম। তবে কিছুক্ষণ আগেই চলে এসেছি। জানতো, হুট করেই না তোমার কথা খুব মনে পড়ছিল। মানে যেই সেই মনে পড়ে না, মনে হচ্ছিল এক্ষণ যদি তোমাকে একবার না দেখি তাহলে হয়তো মরে যাব। আশ্চর্য, আমি কোনোভাবেই নিজেকে শান্ত রাখতে পারছিলাম না, কেমন যেন করছিল। দাদা দাদু কোনোভাবেই এত রাতে আসার জন্য দিচ্ছিলেন না। তবে আমি তো আমার মনের সাথে পারছিলামই না। এত বুঝিয়েও লাভ হয়নি। মন বলেছে সে মোহনাকে দেখবে, মানে দেখবেই। কী আর করব বলো, মনের এত জোরালো আন্দোলন আমি কীভাবে ফেলব? তাই চলে এলাম। এখন একবার বেলকনিতে দাঁড়িয়ে তোমার মুখদর্শন করার সৌভাগ্য আমাকে পেতে দাও প্লিজ।’

মোহনা মাথা চাপড়ে হতাশ হয়ে পড়ল। না জানি ছেলেটা তার এই কঠিন প্রেমরোগে কবে মারা পড়ে। প্রেমে পড়লে বুঝি মানুষ এত পাগলামী করে? তাহলে তো প্রেম ভয়ানক জিনিস, আর যাই হোক এই প্রেমে পড়া যাবে না।

কিন্তু মোহনা যতই সতর্ক থাকুক না কেন, সে নিজেও জানে লরিন তার প্রেম ভাইরাস দিয়ে ঠিকই তাকে সংক্রমিত করবে। আর তার প্রসেস হয়তো এখনই শুরু হয়ে গিয়েছে।

চলবে…

#প্রণয়_রেখা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২৪.

দুই’টা কোর্সের পরীক্ষা শেষ। আর বাকি তিনটা। তবে আগামীকাল যেই কোর্সের পরীক্ষা, মোহনা সেই কোর্সে খুব কাঁচা। এই সেমিস্টারের সবথেকে বিরক্তিকর আর কঠিন কোর্স বোধ হয় এটাই। প্রথম দুই পরীক্ষা সে ভালোই দিয়েছে। তবে আগামীকালের পরীক্ষার জন্য এখন তার ভয় করছে। সিলেবাস খুব বড়ো, পড়া শেষ হয়নি কিছুই। এখন কীভাবে কী শেষ করবে কিছুই বুঝতে পারছে না।

বইয়ের প্রথম চ্যাপটারটা ভালোভাবে পড়ার পর মোহনার মনে হলো এইটুকুতেই যেন তার মাথায় জ্যাম লেগে গিয়েছে। আগে এই জ্যাম ছুটাতে হবে, নয়তো এই জ্যামের মাঝে আরো যত পড়াই পড়ুক না কেন সব এখন তার জ্যামেই আটকে থাকবে। তাই সে মন ভালো করার জন্য এশাকে কল দিল। এশারও একই অবস্থা। সারাবছর পড়াশোনা না করে পরীক্ষার আগের দিন পড়তে বসলে যা হয় আরকি। এশাও পড়ার টেনশনে অতিষ্ঠ হয়ে মোহনাকে বলল,

‘আমি তোর বাসায় আসব? আমার মাথা একেবারেই কাজ করছে না।’

মোহনা বলল,

‘আয়, তুই এলে দুজনে একসঙ্গে ডিসকাস করে পড়তে পারব।’

এশা আমতা আমতা করে ফের প্রশ্ন করল,

‘লরিনকে নিয়ে আসব?’

মোহনা ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘কেন? ও কেন?’

‘আসলে, লরিন Anthropology নিয়ে পড়াশোনা করেছে; তাই ওর এই ব্যাপারে যথেষ্ট জ্ঞান আছে। ও আমাদের সাহায্য করতে পারবে।’

মোহনা সংশয় না রেখে রাজি হয়ে গেল। এশাও এতে খুশি হলো খুব। চট করে লরিনকে কল করে মোহনাদের বাসায় আসতে বলল। লরিনও যেন খুশিতে আত্মহারা। সে সবকাজ ফেলে দ্রুত মোহনাদের বাসায় চলে এল। আসার আগে আগেই মোহনা দরজা খুলে রেখেছে। তাকে অনেকদিন পর দেখে লায়লা বেগমও খুশি হলেন খুব। মোহনা তার মা’কে লরিনের এখানে আসার কারণ বললে, তিনি খুব স্বচ্ছন্দ মনে মোহনাকে অনুমতি দেন। অনুমতি পেয়ে মোহনা লরিনকে নিয়ে তার রুমে গেল। সেখানে যাওয়ার পর এশা লরিনকে দেখে হেসে হাই বলে। লরিন তাকে দেখে আলতো হাসে। তারপর সে একটা চেয়ারে গিয়ে বসে। অপর পাশ থেকে তখন এশা বলে,

‘তুমি না খুব ভালো Anthropology বোঝাতে পারো? নাও, এখন আমাদের পড়াও।’

লরিন বেশ ভাবসাব নিয়ে বসেছে। চেয়ারে পিঠ ঠেকিয়ে এমন টান টান করে বসে আছে যেন সে একজন বিশ্ববিখ্যাত শিক্ষক। মোহনা তার পাশে চেয়ারে গিয়ে বসল। সবাই ঠিকঠাক মতো বসার পর সে গম্ভীর স্বরে বলল,

‘সবাই ঠিকঠাক মতো বসেছ? এবার তাড়াতাড়ি বই বের করো।’

লরিনের ভাবসাব দেখে মোহনা এশার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট চেপে হাসে। এশাও তার হাসির সাথে তাল মিলিয়ে তাদের পড়ার বইটা বের করে। মোহনা তার বই আর খাতাটা লরিনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,

‘নিন, দেখি কতটুকু ভালো বোঝাতে পারেন।’

লরিন হেসে খাতা আর বইটা নিজের কাছে নিল। বই খুলে একটা চ্যাপ্টার বের করে বলল,

‘যাক, সব ইংরেজি তে লেখা। আমার পড়াতে সুবিধা হবে।’

তারপর সে পড়ানো শুরু করে। মোহনা প্রথমে লরিনকে অতটা বিশ্বাস করতে পারেনি। সে ভেবেছিল ঐ একটু হয়তো কোনোরকমে পড়াবে। কিন্তু, লরিন যখন তাদের পড়ানো শুরু করল তখন মোহনা আশ্চর্য হয়ে লরিনের দিকে চেয়ে রইল। সে অবাক, ছেলেটা পুরো ভার্সিটির লেকচারারদের মতো করে পড়াচ্ছে। প্রত্যেকটা টপিক খুব সুন্দর করে বোঝাচ্ছে। আর কঠিন কঠিন টপিকগুলোও যেন মোহনা আর এশা এখন খুব সহজেই ধরে ফেলতে পারছে। এত দারুণ ব্যাপার।

পড়ার মাঝে লায়লা বেগম সবাইকে নাস্তা দিয়ে যান। মাহিয়াও মাঝে মাঝে একটু করে উঁকি দিয়ে আবার চলে যায়। দুই ঘন্টার ভেতর লরিন পুরো বই পড়িয়ে ফেলে। সাথে তাদের সাজেশন ও দেয়। মোহনা আর এশা তো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। এই তো পুরো লরিনের আরেক রূপ। ও যে পড়াশোনায় এত শার্প সেটা তো কেউ জানতোই না।

সব পড়িয়ে লরিন এবার তাদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘Do you have any problem?’

মোহনা আর এশা একই সঙ্গে মাথা নাড়ায়। লরিনের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠে তখন। সে এতক্ষণে চায়ের কাপে চুমুক দেয়। চা দিয়েছিল অনেক আগেই, কিন্তু পড়াচ্ছিল বলে সেটা আর সে হাতে নেয়নি।
মোহনা বই খাতা গুছিয়ে ছোট্ট নিশ্বাস ছাড়ল। মনের ভয় এখন অনেকটা কমেছে। মনে হচ্ছে সে কালও ভালো পরীক্ষা দিতে পারবে। সে লরিনের দিকে চেয়ে দেখল লরিন চা পান করছে আর এক দৃষ্টিতে কী যেন দেখছে। মোহনা তার সেই দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখল লরিন তার টেবিলের উপর রাখা তার শাড়ি পরা ছোট্ট ফ্রেমের ছবিটাকে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে। মোহনা লরিনের দিকে আবার ফিরে চাইল। লরিনের চোখ জুড়ে প্রশান্তির ছোঁয়া স্পষ্ট। যেন মোহনার সেই প্রতিচ্ছবি তার মনে শান্তি দিচ্ছে। মোহনাও কী ভেবে যেন শান্তি পায়। হালকা গলা ঝেরে লরিনকে বলে,

‘আপনি তো খুব ভালো পড়ান। আপনার কি অনার্স মাস্টার্স সব কমপ্লিট?’

লরিন চায়ের কাপ রেখে সোজা হয়ে বসে। বলে,

‘হ্যাঁ। আমি আমার দেশে একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে কয়েক মাস হয়েছিল একজন লেকচারার হিসেবে জয়েন করেছিলাম। আপাতত এখানে আছি বলে চাকরিটা আর করতে পারছি না আরকি।’

মোহনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

‘আপনি বাধ্য হয়ে এই দেশে থাকছেন তাই না?’

লরিন জবাবে বলল,

‘না। ভাবছি এবার এই দেশেই স্যাটেল হবো। আর ঐ দেশ থেকে জরুরি সব কাগজ পত্র আনার ব্যবস্থা করেছি। কাগজগুলো হাতে পেয়ে গেলেই এখানে যেকোনো একটা চাকরীর জন্য এপ্লাই করব।’

‘আপনি চাইলে আমাদের ভার্সিটিতেও ট্রাই করতে পারেন।’

কথাটা বলে ফেলে মোহনা একটু থামল। নিজেকে নিজে প্রশ্ন করল, “একটু বেশি বলে ফেলেনি তো?”
মোহনার কথা শুনে এশাও তাল মিলিয়ে বলল,

‘হ্যাঁ লরিন, তুমি যা ব্রিলিয়েন্ট। আমাদের ভার্সিটিতে লেকচারার হিসেবে এপ্লাই করে দেখো নিশ্চয়ই তুমি চাকরিটা পেয়ে যাবে।’

লরিন ভেবে বলল,

‘তাহলে তো আমি মোহনার টিচার হয়ে যাব।’

‘হ্যাঁ, কী হয়েছে তাতে?’

মোহনার প্রশ্নে লরিন বলে,

‘না, তেমন কিছু না। ভাবছি, তোমার বাবা যদি আবার বলেন, ভাইয়া থেকে ডিরেক্ট স্যার কী করে হয়ে গেলাম; তখন?’

লরিনের কথা শুনে এশা হেসে ফেলে। মোহনা চোখ গরম করে বলে,

‘সেটা নিয়ে আপনার ভাবতে হবে না। প্রয়োজন পড়লে মানুষ সবকিছুই হয়, সেটা বাবা বুঝবে।’

মোহনার রাগ লরিনকে প্রতিবারই আনন্দ দেয়। এবারও দিয়েছে। তার কঠিন চোখযুগল তাকে বরাবরই কাতর করে। সে তো প্রথম থেকে এই চোখ দেখেই অভ্যস্ত। আর এখন তো তার সেই অভ্যাস যেন ভালোবাসায় পরিণত হয়েছে।

লরিন আর এশা একসঙ্গে বেরিয়ে যায়। তারা চলে যাওয়ার পর মোহনার রুমে তার মা আসেন। তিনি এসে মোহনার বিছানায় বসলেন। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলেন। মোহনা মায়ের দিকে তাকাল। জিজ্ঞেস করল,

‘কিছু বলবে, মা?’

লায়লা বেগম নিরবতা কাটিয়ে গম্ভীর সুরে জিজ্ঞেস করলেন,

‘আচ্ছা, লরিন কি সত্যিই কেবল তোর বন্ধু হয়?’

চলবে…