প্রণয় রেখা পর্ব-২৫+২৬

0
338

#প্রণয়_রেখা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২৫.

মোহনা কেন যেন আর কিছু আড়াল করতে পারে না। মা’র প্রশ্নের জবাবে সে তাকে সব বলে দেয়। মা’কে সব বলতে পেরে যেন আজ তার অন্তস্তল কিছুটা ঠান্ডা হয়েছে। এখন শান্তি পাচ্ছে খুব। কথা জমিয়ে একের পর এক মিথ্যে বলাটা খুব কঠিন। সত্য বলা সহজ, কিন্তু এই সহজ কাজ করতেই মানুষের ঘাম ছুটে যায়। মোহনারও সেই অবস্থাই হয়েছিল। মা’কে সব বলার আগে ভয়ে সে আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছিল কিন্তু, এখন সব বলার পর মনে হচ্ছে যেন সবটা কত সহজ, সাবলীল।

মেয়ের কথার খুব বিরূপ প্রতিক্রিয়ার দেখা মিলল না মায়ের মাঝে। তিনি আশা করছিলেন, মেয়ে তার কিছু একটা তো মিথ্যে বলছে। লরিনকেও তার প্রথম থেকে সন্দেহ হয়েছে যথেষ্ট। সঠিক যুক্তি মেলাতে পারেননি বলে তখন কিছু বলেননি।

সব শুনে অনেকক্ষণ নিরব থেকে তিনি মোহনার দিকে চেয়ে গম্ভীর গলায় বললেন,

‘ভালোবাসিস লরিনকে?’

মায়ের নিরবতা মোহনাকে এতক্ষণ যতটা না চিন্তিত করেছিল তার চেয়ে আরো বেশি মায়ের এই প্রশ্ন এখন তাকে চকিত করেছে। সে নির্বাক, হতভম্ব। অনেক খুঁজেও জবাব মেলাতে পারছে না। সহজ প্রশ্ন, উত্তর “হ্যাঁ” অথবা “না” হবে। অথচ এই “হ্যাঁ” অথবা “না” বলতে গিয়েই মোহনার দ্বিধা দ্বন্দ্বের পাহাড়ের তলায় পড়েছে। পরিষ্কার গলায় বলতে পারছে না, “হ্যাঁ, আমিও লরিনকে ভালোবাসি।” আবার বলতে পারছে না, “না, আমি লরিনকে ভালোবাসি না।” এর থেকে বিরক্তিকর ব্যাপার বোধ হয় আর কিছু হতে পারে না। সে অনেক ভেবেও যখন সঠিক জবাব মেলাতে পারল না, তখন সে কথা কাটাতে বলল,

‘আম্মু, আমার এখন পড়তে হবে। অনেক পড়া বাকি। এসব নিয়ে আমি পড়ে কথা বলব প্লিজ। আর তুমি আপাতত বাবাকে এসব কিছু বলো না। পরে সময় আর সুযোগ মতো আমিই বাবাকে সব বলব।’

লায়লা বেগম ব্যাপারটা আর ঘাটালেন না। তিনি ছোট্ট নিশ্বাস ছেড়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালেন।

_______________________________

আজ মোহনার পরীক্ষা সমাপ্তি ঘটল। আরো এক সেমিস্টারের ইতি টেনে বেশ উৎফুল্ল মনেই বাড়ির দিকে পা বাড়াল সে। হেঁটেই যাচ্ছিল, পাশে এশাও ছিল। অর্ধেক রাস্তায় আসার পরই মোহনার ফোন হঠাৎ বেজে উঠে। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে দেখল, লরিনের নাম্বার। রিসিভ করে সালাম দিল। লরিন তাকে সালামের জবাব দিয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘পরীক্ষা শেষ?’

‘হুম।’

‘বাসায় যাচ্ছো?’

‘হ্যাঁ।’

‘আচ্ছা যাও। বিকেলে আমিও তোমাদের বাসায় যাব।’

মোহনা ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘কেন? আপনি হঠাৎ আমাদের বাসায় কেন যাবেন?’

লরিনের গলার স্বরে তখন খুশির স্রোত নেমে এল। সে বলল,

‘আমি চাকরি পেয়েছি, মোহনা। একটা বেসরকারি কোম্পানিতে ম্যানেজার পদে।’

মোহনার ঠোঁট জোড়া প্রস্ফুটিত হলো। সেও আনন্দে উল্লাসিত। লরিন বলল,

‘আজই আমি তোমার বাবার কাছে গিয়ে আমাদের বিয়ের কথা বলব, আমি আর দেরি করতে পারব না।’

মোহনা আমতা আমতা করে বলল,

‘কিন্তু…’

‘উঁহু, আর দোহাই দিও না। আই কান্ড লিভ জাস্ট অ্যা সেকেন্ড উইথ আউট ইউ। এখন আমাকে যেকোনো মূল্যে বিয়ে করতে হবে। ঐ অরূপ এখনও ঝুলে আছে। যদি একবার তার মত বদলে যায়, তখন আমার কপাল পুড়বে। আমি আর কোনো রিস্ক নিব না। বি প্রিপিয়ার্ড, সন্ধ্যায় দেখা হচ্ছে।’

কল কেটে দেয় লরিন। আজব লোক, মোহনাকে কিছু বলার সুযোগও দেয়নি। মোহনা ফোন রেখে ভয়ে ভয়ে এশার দিকে চেয়ে বলল,

‘লরিন নাকি আজই বাবার কাছে বিয়ের কথা বলবে।’

‘তো, বলুক না। আর কত অপেক্ষা করবে ছেলেটা? এবার তো এর একটা গতির প্রয়োজন।’

‘কিন্তু, বাবা যদি ওর উপর খুব রেগে যান?’

‘সেটা তখন লরিন বুঝে নিবে। চিন্তা করিস না, ঐ বিদেশি বেটা চালু আছে। দেখিস, ঠিক তোর বাবাকে মানিয়ে নিতে পারবে।’

মোহনা নিশ্চিন্ত হতে পারছে না। কী করে পারবে সে তো শুরুতেই লরিনের নামে বাবাকে মিথ্যে বলে রেখেছে। এখন সব সত্যি জানার পর কি তার বাবা এত সহজেই সবকিছু মেনে নিবেন? মোহনার তো মন বলছে, তা কখনোই সম্ভব না।

বাসায় গিয়ে মোহনা মা’কে সব বলে। মোহনার বাবাও কাল চট্টগ্রাম থেকে তাদের বাসায় এসেছেন। আবার কালই চলে যাবেন। আজ উনাকে এসব কথা বলা ঠিক হবে কিনা মোহনা তা নিয়ে খুব চিন্তিত। কারণ বাবা তার খুব করে চাইছেন যেন মোহনার বিয়ে অরূপের সাথেই হয়। কিন্তু অরূপের সাড়া পাচ্ছেন না তিনি। অপরদিকে চাইলেও জোর করতে পারছেন না। ভালো ভদ্র ছেলে হাত ছাড়া হয়ে যাচ্ছে দেখে আজকাল তিনি খুব চিন্তাই থাকেন। এর মধ্যে যদি আবার লরিন এসে উনাকে বিয়ের কথা বলে, তখন উনার কেমন রিয়েকশন হবে কে জানে।

আযান হয়েছে অনেকক্ষণ আগে। বাবা মা’র নামাজ শেষ। সময় যত গড়াচ্ছে মোহনার দুশ্চিন্তা ততই বাড়ছে। বার কয়েকবার সেই দুশ্চিন্তায় সে বেলকনিতে গিয়ে উঁকি ঝুঁকি মেরেছে। বারবার মনে হচ্ছে এই বুঝি লরিন চলে এল। কিন্তু লরিন তাড়াতাড়ি আসে না। তার আসতে আসতে বাজে সন্ধ্যা সাত’টা।

দরজার কলিং বেলের শব্দ পেয়েই কলিজা ধক করে উঠে মোহনার। উঠে যে গিয়ে দরজা খুলবে সেই সাহসটুকুও পায় না সে। সে মাহিয়াকে পাঠায় দরজা খোলার জন্য। মাহিয়া গিয়ে দরজা খুলে। দরজার বাইরে লরিনকে দেখে তার ঠোঁটের কোণে হাসির রেশ ফুটে উঠে। লরিনকে ভেতরে আসতে বলে সে তার মা বাবাকে ডাকে। লায়লা বেগম যেহেতু আগে থেকেই সবকিছু জানেন তাই তিনি খুব সতর্ক রইলেন। মাহবুব সাহেবকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে গিয়ে লরিনকে দেখে খুব খুশি হয়ে তার সাথে কুশল বিনিময় করলেন।

লরিনকে প্রায় অনেকদিন পর দেখে মাহবুব সাহেবও বেশ খুশি হয়েছেন। তিনি সাদরে তাকে নিজের পাশে নিয়ে বসালেন। তারপর লায়লা বেগমকে বললেন, চা নাস্তার ব্যবস্থা করতে। ঐদিকে মোহনা পর্দার আড়াল থেকে দাঁড়িয়ে সব দেখছে আর ভয়ে ভীত হচ্ছে।
কিছু প্রাসঙ্গিক কথা বার্তা শেষ করে লরিন গলা ঝেরে বলে,

‘আংকেল, আমি আপনাকে কিছু বলতে চাই?’

মাহবুব সাহেব স্বাভাবিক গলায়’ই বললেন,

‘বলো না কী বলবে।’

লরিনের নিজেরও এখন কিছুটা চিন্তা হচ্ছে। যদি উনি মুখের উপর না করে দেন, যদি মেনে না নেন, যদি লরিনকে খালি হাতে ফিরতে হয়, তখন? ভয়কে আশকারা দিলে তা আরো পেয়ে বসবে। তাই লরিন ভয়কে সুযোগ না দিয়ে নিজেকে শক্ত করল। চোখ বুজে নিশ্বাস ছেড়ে নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,

‘আমি মোহনাকে বিয়ে করতে চাই, আংকেল।’

মাহবুব সাহেব অবাক হলেন। মাথাটা একটু ঘুরিয়ে আরেকটু মনোযোগ দিয়ে চাইলেন লরিনের দিকে। শান্তশিষ্ট ভদ্র ছেলেটার এত সাহস? সে এত সহজে তার মেয়েকে বিয়ে করার কথা বলে ফেলল? আশ্চর্য, সে একটুও ভয় পেল না?

মাহবুব সাহেবের বিস্ময় যেন কাটছেই না। ঐদিকে মোহনা, মাহিয়া আর তাদের মায়ের বুকের ভেতরটা ধরাৎ ধরাৎ করে লাফাচ্ছে। বড়ো কোনো ঝড় আসার আগে পরিবেশ এমন ঠান্ডাই থাকে। তবে কি মাহবুব সাহেবের এহেন শান্ত রূপ বড়ো কোনো ঝড়ের ইঙ্গিত করছে? মোহনার ভয়ে এবার কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে যায়। সে পর্দার আড়ালে থেকেই মাহিয়ার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে।

অন্যদিকে লরিনও নড়ছে না। গম্ভীর হয়ে বসে উত্তরের অপেক্ষা করছে। অনেকটা সময় গেল সবাই নিরব। এবার মাহবুব সাহেব নিশ্বাস ফেললেন। তার ভারী নিশ্বাসের শব্দও যেন এই গুমোট পরিবেশে টের পাওয়া গেল। তিনি গম্ভীর সুরে বললেন,

‘বলতে হবে, তোমার সাহস আছে। আর সাহসী ছেলেদের আমার বরাবরই পছন্দ। তোমার সাথে আমি আমার মেয়ের বিয়ে দিতে পারতাম যদি না তুমি বিদেশি হতে। কিন্তু, এখন সেটা সম্ভব না। আমি আমার মেয়েকে কোনো বিদেশি ছেলের সাথে বিয়ে দিব না। আমি দুঃখিত।’

লরিন ঢোক গিলল। বলল,

‘আংকেল, আমার বাবা বাংলাদেশি। সেক্ষেত্রে, আমিও বাংলাদেশি। আর আমি এখন এই দেশেই স্যাটেল হয়েছি। একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে জবও পেয়েছি। এখানেই থাকব, দাদা দাদুর সাথে। তাই অন্তত বিদেশি বলে আমায় ফিরিয়ে দিবেন না, প্লিজ।’

মোহনার বাবা ভ্রু কুঁচকালেন। বললেন,

‘মনে হচ্ছে ব্যাপারটা জটিল। কে কয়টা মিথ্যে বলেছ? সবটা ক্লিয়ার করো।’

লরিন বলল,

‘মোহনাকেও ডাকুন তাহলে। ও নিজেই না হয় সবটা বলবে।’

লরিনের কথা শুনে মোহনার আত্মা যেন আর জায়গায় রইল না। তার মনে হচ্ছে, এবার বুঝি জীবনের অন্তিম সময় তার ঘনিয়ে এসেছে।

চলবে…

#প্রণয়_রেখা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২৬.

সবকিছু শুনে মাহবুব সাহেব তিক্ত সুরে মেয়েকে বললেন,

‘তোমার কাছ থেকে আমি এসব আশা করিনি, মোহনা। তোমাকে আমি বিশ্বাস করেছিলাম। কিন্তু, তুমি আমার সেই বিশ্বাসের মর্ম দাওনি।’

বাবার কথায় প্রচন্ড খারাপ লাগে মোহনার। তার শুকনো চোখে সঙ্গে সঙ্গেই জল জমে। নাক লাল হয়ে উঠে। বাবার দিকে যে একবার চোখ তুলে তাকাবে তার সেই সাহসটুকুও নেই।

মাহবুব সাহেব শান্ত হয়ে বসে আছেন। লরিনও এই মুহুর্তে কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না। লায়লা বেগম স্বামীর নিরবতা দেখে প্রথমে অবাক হলেও এখন তিনিও স্বাভাবিক। মানুষটা হয়তো একটু বেশিই কষ্ট পেয়েছেন। তার শিক্ষায় তার মেয়ে আঘাত করেছে, তাই হয়তো এতটা দমে গিয়েছেন। নয়তো ছোট খাটো ব্যাপারেই উনি যে পরিমাণ ক্ষেপে যান এই ব্যাপারটা নিয়ে তো উনার তুলকালাম কান্ড বাঁধানোর কথা ছিল। কিন্তু, উনি এখন নিশ্চুপ…

কেউ কিছু বলছে না দেখে লায়লা বেগম এবার সাহস করলেন। তিনি নরম সুরে মাহবুব সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

‘সন্তান তো ভুল করেই, তাই বলে কি মা বাবা সন্তানের সাথে অভিমান করে বসে থাকে? মা বাবা তো আর সন্তানদের সাথে কথা না বলে থাকতে পারে না, হাজার ভুল করলেও তো সন্তান তো নিজের, তাকে ক্ষমা করে দিতেই হয়। আর তোমার মেয়ে তো তোমার প্রাণ। সে না হয় ছোট্ট একটা ভুল করেই ফেলেছে তার জন্য তুমি কি তার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিবে? তাতে তো তুমিও কষ্ট পাবে তাই না? থাক না, যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। এবার ওদের মাফ করে দাও।’

লায়লা বেগম কথাটা শেষ করতেই মাহবুব সাহেব তার দিকে চোখ ঘুরিয়ে তাকালেন। ভীষণ শান্ত, কঠিন সেই দৃষ্টি। লায়লা বেগম কিঞ্চিত ঘাবড়ালেন। তার কথা শুনে মানুষটা উল্টো আরো বেশি রেগে যাবেন না তো?

তার দুশ্চিন্তা অবসান ঘটল মাহবুব সাহেবের পরবর্তী উক্তি শুনে। মাহবুব সাহেব সাহেব দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। মোহনার দিকে চেয়ে শক্ত হয়ে বললেন,

‘মোহনা, তুমি কি লরিনকে বিয়ে করতে চাও?’

মোহনা ভয়ে ভয়ে বাবার দিকে তাকায়। বাবার চোখ মুখ রুক্ষ। সে চেয়ে থাকতে পারল না। চোখ নামিয়ে ফেলল। জবাব সাজাতে লাগল, কী বলবে। ভয় করছে, অস্বস্তি লাগছে। নিশ্বাস ক্রমে ক্রমে ভারী হয়ে উঠছে। তার জন্য তার বাবা কষ্ট পাচ্ছে, সেটার জন্যও বুকে ব্যথা হচ্ছে তার। কিন্তু, এখন আর চুপ থাকলে চলবে না। এমন একটা দিন যে আসবে সেটা সে আগে থেকেই জানতো। তাই আর আফসোস করে লাভ নেই। এবার এই কঠিন প্রশ্নের জবাব তাকে দিতেই হবে। সে নিজেকে শক্ত করল। লরিনের দিকে এক পলক চাইল। ছেলেটা একরাশ আশা নিয়ে তার মুখপানে চেয়ে আছে উত্তরের অপেক্ষা করছে। এই মানুষটাকেও আর কষ্ট দেওয়া যাচ্ছে না। অতঃপর সে ঠিক করল। বাবার দিকে চেয়ে বলল,

‘জ্বি বাবা, আমি লরিনকে বিয়ে করতে চাই।’

মেয়ের উত্তর মেয়ে মাহবুব সাহেব কিছুক্ষণ থ মেরে বসে রইলেন। বুঝতে পারছেন না কী বলবেন। মাহিয়া এখনো ভীত সন্ত্রস্ত। বলে তো দিয়েছে কিন্তু বাবা ব্যাপারটা কেমন ভাবে নিবে কে জানে।

তবে তার এই কথাটা শুনে যার প্রাণ ফিরে এসেছে সে হলো লরিন। সে তো বিশ্বাসই করতে পারছে না। মোহনা সত্যিই তাকে বিয়ে করতে চায়। আজ যেন জীবন স্বার্থক মনে হচ্ছে। এবার সবশেষে যেন তার শ্বশুরমশাই ও রাজি হয়ে যান এই কামনাই করছে সে।

মাহবুব সাহেব অনেক ভাবলেন। লরিনের সম্পর্কে সবই শুনেছেন, জেনেছেন। ছেলে ভালো, পরিবার ভালো। তার মেয়েও রাজি। ঐদিকে তো অরূপ ও তাকে কম ঘুরাচ্ছে না। সব চিন্তা ভাবনা করে তিনি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। লরিনের দিকে ঘুরে বললেন,

‘কাল তোমার দাদা দাদুকে নিয়ে আমাদের বাসায় আসবে। কালই বিয়ের ডেইট পাকা করব।’

মোহনা আর লরিন দুজনেই হতবিহ্বল। বাবা রাজি হয়ে গেল? এত সহজেই? মোহনা হা করে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। লরিন তো পারছে না নাচতে শুরু করে। সে খুশিতে গদগদ হয়ে বলে,

‘ধন্যবাদ, আংকেল।’

মাহবুব সাহেবের গাম্ভীর্য ভাবে তেমন ফাটল এল না। তিনি গম্ভীর সুরে লায়লা বেগমকে বললেন,

‘চা নিয়ে এসো।’

লায়লা বেগমও খুশি মনে চা বানাতে গেলেন। মোহনাও মা’র পেছন পেছন রান্নাঘরে গেল। সে যেতেই মাহিয়া তাকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরল। লাফাতে লাফাতে বলল,

‘অবশেষে এই বিদেশিই আমার দুলাভাই হতে যাচ্ছে। আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে…’

মোহনা হেসে বলল,

‘হয়েছে ছাড়। এখনই এত নাচানাচি করিস না। বাবার মুড এখনো ঠিক হয়নি। বলা যায় না হুট করে যদি আবার মত পাল্টে ফেলে।’

মাহিয়া তাকে আশ্বাস দিয়ে বলল,

‘আরে আমাদের বাবা হলো এক কথার মানুষ, একবার যেটা বলে দিয়েছে মানে বলে দিয়েছে, আর সেই কথার খেলাপ হবে না। এত চিন্তা করো না তো। জানো, আমি তো শুধু লরিন ভাইয়ার মুখটা দেখছিলাম। বাবা রাজি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কী চমৎকার হাসিই না ফুটে উঠেছিল। উনারও বোধ হয় তখন আমার মতো নাচতে মনে চাচ্ছিল, যা উত্তেজনা উনার চোখে মুখে দেখেছি।’

মোহনা রান্নাঘরের দিকে পা বাড়িয়ে বলল,

‘তোরা দুইটা হয়েছিস একইরকম, বাদর কোথাকার।’

মোহনা রান্নাঘরে গিয়ে দেখে লায়লা বেগম চা বানাচ্ছেন। মোহনা ধীর পায়ে তার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। চুলায় ফুটন্ত পানি, লায়লা বেগম সেই পানিতে চা পাতা ঢালতে ব্যস্ত। মোহনা ঢোক গিলে গলা ভেজায়। মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,

‘আম্মু, বাবা কি কষ্ট পেয়ে এই সিদ্ধান্তটা নিয়েছেন?’

লায়লা বেগম তার কাজের উপর মনোযোগ রেখেই বললেন,

‘মা বাবা সবসময়ই সবকিছু ভেবে চিন্তেই সিদ্ধান্ত নেন। তোর বাবা যা ভালো মনে করেছেন তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এই নিয়ে তুই আর এখন কিছু ভাবিস না।’

‘কিন্তু আম্মু, বাবা যে বললেন কালই বিয়ের ডেইট ফাইনাল করবেন। কিন্তু, আমি তো অনার্সের পর বিয়ে করতে চাই, আমার তো আরো এক সেমিস্টার বাকি।’

‘তাহলে কাবিন হয়ে যাবে। অনুষ্ঠান না হয় পরে হবে। এমনিতেও সামনে রোজা আসছে। এখন অনুষ্ঠান করার মতো সময় হবে না।’

মোহনা খুশি হয়ে বলল,

‘আচ্ছা, তুমি তাহলে বাবাকে এটাই বলো।’

.

চা খেতে খেতে মাহবুব সাহেব লরিনের কাছ থেকে আরো কিছু ইনফরমেশন নেন। লরিনও বসে বসে বাধ্য ছেলের মতো উনার সমস্ত প্রশ্নের জবাব দেয়। লরিনকে ছেলে হিসেবে মাহবুব সাহেবের প্রথম থেকেই পছন্দ ছিল। বিদেশি হলেও বাবার রক্তের ছোঁয়া স্পষ্ট। আজ তার সাথে কথা বলে উনার সেই পছন্দটাই আরো একটু পাকাপোক্ত হয়েছে আরকি।

যাওয়ার সময় মোহনা একবারও লরিনের সামনে আসেনি। লরিনের তৃষ্ণার্ত দুই চোখ মোহনাকে বার কয়েকবার খুঁজেছে। কিন্তু মোহনা তার রুম থেকেই বের হয়নি। বাধ্য হয়ে লরিনকে সেই তৃষ্ণার্ত নয়নে বাইরে বেরুতে হলো। তবে রাস্তার কাছে গিয়ে একবার কী ভেবে সে উপরে তাকায়। সঙ্গে সঙ্গেই চিরচেনা সেই প্রিয় মুখশ্রী দেখে তার ঠোঁটে হাসি ফুটে। বেলকনিতে মোহনা দাঁড়িয়ে আছে। তার ঠোঁটের কোণেও মৃদু এক হাসির রেশ প্রতিয়মান। লরিনের চোখের তৃষ্ণা এবার মিটল। মন ভরে সে মোহনাকে দেখে তবেই সে সেই জায়গা প্রস্থান করল।

চলবে…