প্রণয় হাওয়া লাগলো মনে পর্ব-০৪

0
311

#প্রণয়_হাওয়া_লাগলো_মনে(০৪)
#সুমাইয়া_ইসলাম_জান্নাতি(লেখনীতে)
______________

শাশুড়ি মায়ের স্নেহপূর্ণ আচারণে বহুদিনের মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত অন্বেষা আবেগাপ্লুত। ফলস্বরুপ ডাগর ডাগর চোখ দুটো থেকে অশ্রুর ঢল বইতে লাগলো। সাওদা বেগম আর কিঞ্চিত দুরে দাড়ানো সাইমা, সাইফার চোখ যুগলও ছলছল করে উঠলো। সাওদা বেগম অন্বেষার উদ্দেশ্য নমনীয় স্বরে বললেন, “কেঁদো না মেয়ে। পৃথিবী একটা সমরঙ্গন। এখানে নানা প্রতিকুল পরিবেশে নিজেদের মানিয়ে নিতে হাজারো যুদ্ধ জয় করতে হয়। আমি তোমার কষ্ট, বেদনা বুঝতে পারছি। আমি নিজেও তো মা। আমার নিজেরও তিনটা ছেলেমেয়ে আছে। জানিনা তোমার সৎ মা কেমন মানুষিকতার। কি করে পারে ফুটন্ত গোলাপের ন‍্যায় ফুটফুটে এই মেয়েটার প্রতি নির্যাতন, অবহেলা করতে! যেভাবেই হোক আমার ছেলে তোমাকে বিয়ে করেছে। এখন তুমি এ বাড়ির বউ। আগে যেমন ছিলে যেভাবে ছিলে সেসব ভুলে যাও। এ সংসার বহু কষ্টের গড়া। আমার পরে তুমিই তো এ সংসারের দায়িত্ব নিবে। শুধু আমার মেয়ে দুটোকে দেখে রাখবে। এতটুকুই চাওয়া। কি পারবে না? এ বাড়ির একজন হয়ে আমাদের সবাইকে আপন করে নিতে পারবে না? আপত্তি আছে? আমাকে ‘মা’ বলে ডাকতে আপত্তি হবে কোন?” কথাগুলো বলে নিজ হাতেই অন্বেষার চোখ থেকে চিবুকে গড়িয়ে পড়া পানি সাওদা বেগম মুছিয়ে দিলেন। মুখের দিকে তাকিয়ে আছে অন্বেষার উত্তরের আশায়।

অন্বেষা প্রতিত্তোরে ধরা গলায় বলল, “আমি বহুদিন কাউকে মা বলে ডাকি না। মাতৃস্নেহ তো দুরে থাক। আমি কি আপনাকে আম্মু ডাকতে পারি?”

“কেন নয় সোনা। আজ থেকে তুমিও আমার আরেকটা মেয়ে। দেখি কাছে আসো।”

অন্বেষা একপ্রকার ঝাপিয়ে পড়লো শাশুড়ি মায়ের বুকে। সাওদা বেগমের ঠোঁট কোলে মিষ্টি হাসি বিদ‍্যমান। সেও খুশি। পরম মমতায় অন্বেষার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন তিনি। সাইমা, সাইফাও মায়ের সন্নিকটে এসে দাড়ালো। দুবোন দু পাশ থেকে মাকে জড়িয়ে ধরলো। মাঝে সাওদা বেগমের বুকের সাথে লেপ্টে মিশে আছে অন্বেষা। সাওদা বেগমের চোখ দুটো থেকে আনন্দ অশ্রু প্রবাহিত হলো। এ যেন বহু তৃপ্তির।

রুমের বাহিরে দরজায় দাড়িয়ে এহেন চক্ষু শীতলকারী দৃষ্টি মুগ্ধ করলো সারফারাজকে। সে তাৎক্ষণিক রুমে ঢুকলো না। এমন আবেগপ্রবণ মূহুর্ত সে গিয়ে ভেঙে দিতে পারে না। মন তুষ্ট হলো সারফারাজের। আল্লাহর কাছে লাখো কোটি শুকরিয়া জানালো। মায়ের প্রতি সম্মান ভালোবাসা যেন বেড়েই চলেছে। কমতি নেই। অন‍্যদিকে দ্রুত পা চালিয়ে সাওদা বেগমের রুমে দিকে হেঁটে আসছেন হাসুর মা। সকালের নাস্তা হয়ে গেছে। ঠান্ডা হয়ে গেল যে। খাবে কখন! দরজার কাছে সারফারাজকে দাড়ানো দেখে হাসুর মা তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “কি খবর বাপজান? তুমি রুমে না ঢুইকা এইহানে কি করো? আর সকালের খাওন খাইবা না?”

সারফারাজ হাতের আঙুল দিয়ে নিজের ঠোঁট স্পর্শ করে বোঝালো চুপ করুন। হাসুর মা দমে গেল। সে প্রশ্নবিদ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে সারফারাজের দিকে।
সারফারাজ রুমের দিকে ইশারা করে হাসুর মায়ের উদ্দেশ্য বলল, “খালা চুপ করুন। দেখুন মা আর ওরা মিলে কি করছে! এমন আবেগঘন মুহূর্ত আমরা গিয়ে কি করবো? থাকুক না। মেয়েটা বহুদিন বাদে একটু মাতৃস্নেহের ছায়াতলে এসেছে। কিছুক্ষণ মনে ভরে উপভোগ করুক।”

হাসুর মাও মৃদু হাসলেন এহেন হৃদয় জুড়ানো দৃশ্য দেখে। নিচু আওয়াজে প্রতিত্তোরে বললেন, “হক কথা কইছো বাপজান। তয়, তোমার মা’রে কিছুতে ভুল বুইঝো না। তেনারে আমি অনেককাল থেইকা চিনি। মানুষটা উপরে শক্ত হলেও ভিতরে ভারী নরম। ঠিক নারকেলের মত। আমারও ভালা লাগছে। আল্লাহ্ রহমত দান করুক।”
শাড়ির আচল দিয়ে চোখ মুছলেন হাসুর মা। গ্রামের সহজ সরল মানুষগুলো অন‍্যেকর দুঃখে যেমন দুঃখি হয়ে কাঁদে তেমন অন‍্যের সুখেও তাদের চোখও ভিজে ওঠে। হাসুর মাও তেমনি একজন।
———————
বিকালে সারফারাজ শোরুমের উদ্দেশ্য বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। সঙ্গে বাড়ির গাড়ি। যাওয়ার আগে বোনেদের উদ্দেশ্য বলে গেছে রেডি হয়ে থাকতে। সে সন্ধার পর এসে নিয়ে যাবে শপিংয়ে। আরও বলেছে যদি মা আর অন্বেষা রাজী থাকে তবে সেও যেন রেডি থাকে। সেই থেকে সাইমা, সাইফার খুশি যেন ধরে না। কি করবে কি কিনবে দুবোন লিস্ট করতে বসে পড়েছে।

সাইফা বলল, “সাইমা, বেশি লাফাস না। ভাইয়া এখন বিয়ে করেছেন। মা চাইছেন একটু আয়োজন করে আবার বিয়ে দিতে। খুব সুন্দর সিদ্ধান্ত। এখন মাত্রাতিরিক্ত কিছু কিনিস না। সবকিছুর একটা লিমিট থাকে। লিস্ট থেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ জিনিস বাদে বাকিগুলো কে’টে ফেল। বুঝেছিস?”

সাইমা, সাইফা জমজ দুবোন। প্রায় একই স্বভাবের। তবে চেহারাই হালকা ভিন্নতা। সাইফা বেশ বুঝদার হলেও সাইমার মধ্যে বেশ অবুঝপনা বিদ‍্যমান। সাইফার হাস‍্যজ্জ্বল মুখশ্রী থমথমে হয়ে গেল। পছন্দ হয়নি সাইফার কথা তার। প্রতিত্তোরে ভারী গলাই বলল, “কি বলতে চাইছিস সাফু? এখানে সবই তো গুরুত্বপূর্ণ। কোনটা রেখে কোনটা কাটবো?”

“মেকাপের জিনিসপত্র যেগুলো তোর আছে সেগুলো কেটে ফেল। যা খুব প্রয়োজন সেগুলো রাখ। তাহলেই হয়!”

“না আমার সব লাগবে।”

“বোকার মত কথা বলিস না সাইমা। ভেবে দেখ দ্রব‍্য মূল‍্যের উর্ধগতির জন্য প্রতিটি পণ্যের যে চড়া দাম তোর একার জিনিস কিনতে গেলেই তো ভাইয়ার বিশ হাজারের বেশি নেমে যাবে। বাকিদের জন‍্যও তো কিনতে হবে। নাকি?”

“তাহলে কি করবো?”

“আমার কথায় মন খারাপ করিস না। ভাইয়া আগে আমাদের পিছনে দুহাত ভরে খরচ করেছে। সমস্যা ছিল না। কিন্তু ভাইয়ার এখন বিয়ে হয়েছে। ভবিষ্যতের জন্য কিছু সঞ্চয় করা প্রয়োজন তাছাড়া খরচও বেড়েছে। আবার সবকিছুর দামও দিন দিন আকাশ ছুয়ছে। আমাদের কি উচিত না ভাইয়ার দিকটাও খেয়াল রাখা? নিজেরা যদি একটু শৃঙ্খলা আনি তাহলে দেখবি সংসারে কোন ঝামেলায় হবে না। বুঝলি?”

“ধুর সাফু। তুই কেন সবকিছু এত ভালো বুঝিস বল তো? আমার মাথায় কেন এসব আসে না?”

“সারাদিন ট্রিপ নিয়ে আর ফোন ঘাটলে বুদ্ধি কোথা থেকে আসবে শুনি? বই পড়, বিভিন্ন লেখকদের লেখা পড় দেখবি অনেক কিছু বুঝে ফেলেছিস। তখন আমাকেই জ্ঞান দিতে পারবি।”

সাইমা বুঝলো সাইফার কথা। হাতের লিস্ট সাইফার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে তার উদ্দেশ্যে বলল, “হুম, তাই করতে হবে দেখছি। তাহলে ধর তুই কে’টে কু’টে কমিয়ে দে।”

সাইফা মিষ্টি হেসে বলল, “দিচ্ছি।”

“উফ! সাফু এভাবে হাসবি না। আমি তোর বোন হয়েই ফিদা হয়ে যায়। না জানি ছেলেদের কেমন লাগে! একদম হাসবি না!”

সাইমার বোকা বোকা কথায় শব্দ করে হেসে ওঠে সাইফা। হঠাৎ মনে পড়লো মাস তিনেক আগে এক অদ্ভুত মুহূর্তের কথা। এভাবে একজন তার হাসির প্রশংসা করেছিল। কিন্তু সেদিন নিছক ফ্লাটিং মনে হয়েছিল। বলল, “সত‍্যি বলছিস সাইমা? সুন্দর নাকি?”

সাইমা ভ্রু উচিয়ে বলল, “তুই জানিস না আমি মিথ্যা বলি কম। এটা সত্য। শোন, এবার তৈরি হই। ভাইয়া এলো বলে!”

অন্বেষার মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছেন হাসুর মা। ঢেউ খেলানো চুল। দেখতে সুন্দর লাগে। চুলে মাঝে কাঁটাছেড়া দেখে আতকে উঠেন হাসুর মা। জিজ্ঞাসা করেন, “একি নতুন বউ তোমার চুলের মধ্যে এমনে কাঁটা কেন?”

এহেন প্রশ্নে অপ্রস্তুত বোধ করে অন্বেষা। কি বলা উচিত বুঝে উঠতে পারছে না বেচারি। পাশেই বেতের মোড়ায় মিসেস সাওদা বেগম বসা। আর মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে বসে হাসুর মা আর অন্বেষা। মিসেস সাওদা অন্বেষার মুখভঙ্গি দেখে আন্দাজ করলেন কিছুটা। অন্বেষার উদ্দেশ্যে বললেন, “তোমার ইচ্ছে না হলে বলতে হবে না।”

ইতস্তত বোধ করলো অন্বেষা। কোন দিক দিয়ে শুরু করবে সে? ফেলে আসা জীবনটা এতটা বিভীষিকাময় যে কাউকে বলতেও বাধে। গর্ব করে বলার মতোও কিছু নেই। আছে একরাশ য’ন্ত্রণা। যা কুঁ’ড়ে কুঁ’ড়ে খা’চ্ছে প্রতিনিয়ত। বড় করে শ্বাস নিয়ে বলল, “আমার চুলের গ্রোথ বেশি। দ্রুত লম্বা হয়। আম্মু থাকতে যত্ন নিতেন। আম্মু মারা গেলেন এরপর আসলেন আব্বুর দ্বিতীয় স্ত্রী। চুলে তেল দেওয়া লাগতো সপ্তাহে দুই তিনবার। শ‍্যাম্পুও করা লাগতো। যেহেতু অনেক চুল তাই সবকিছু বেশি পরিমাণে লাগতো। একদিন চুলে শ‍্যাম্পু নিয়েছিলাম, কৌটায় অল্প পরিমাণে ছিল। আমি নেওয়াতে আর একটুও বাকি ছিল না। তিনি গোসলে গিয়ে শ‍্যাম্পু শূন্য কৌটা পেয়ে ক্রোধে ফে’টে পরেন। এসেই আমার চুলের মুঠি ধরে চুল কাটতে উদ‍্যাত হন। কা’চি এনে কেবল এক পোচ দিয়েছিল তারমধ‍্যে আমার চিল্লা’চিল্লির আওয়াজ শুনে পাশের বাড়ির এক চাচি এসে পরেন। তিনি উদ্ধার করেন। সেদিন আর চুলগুলো কাঁ’টা হয়নি। রক্ষা পেয়েছিল। তারজন‍্য চুলগুলো অসমান রয়ে গেছে।” অন্বেষা কথাগুলো বলে ঠোঁট কামড়ে প্রাণপণ চেষ্টা করছে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করার। চোখের পানি যেন গড়িয়ে না পড়ে।

হাসুর মা তো কেঁদেই ফেলেছেন। মনটা বড্ড খারাপ হলো সাওদা বেগমের। কি দরকার ছিল মেয়েটাকে জিজ্ঞাসা করে তার পুরোনো ক্ষ’ত তা’জা করে দেওয়ার। অন্বেষার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। বললেন, “কষ্ট পেও না মা। সবার জীবন সুন্দর হয় না। আগে সুন্দর ছিল না ইনশাআল্লাহ দেখো এখন সুন্দরে মুড়িয়ে রাখবে আমার ছেলে। চোখ মোছ তো!”

অন্বেষা নিজেকে ধাতস্থ করে চোখ মুছলো। ঠোঁটে কোনরকম এক চিলতে হাসি ফোঁটানোর চেষ্টা করলো। কতটা সফল হয়েছে কে জানে!

সন্ধ্যায় সারফারাজ নিতে এসেছে ওদের। সাইমা, সাইফা তৈরি। কিন্তু কোথাও অন্বেষাকে দেখলো না। সাওদা বেগম নিজে এসে জানালেন অন্বেষার খুব জ্বর এসেছে। কোথাও তাকে নিয়ে যাওয়া যাবে না। সারফারাজের মনঃক্ষুন্ন হলো। সময়ের সল্পতার জন্য রুম অবধি যাওয়া হলো না তার। সাইফা, সাইমাকে নিয়ে ভড়ক্রান্ত মন নিয়ে তাকে বেরিয়ে যেতে হলো। চিন্তাও হচ্ছে। মন চাইছে সব ছেড়েছুড়ে মেয়েটার পাশে গিয়ে বসে থাকতে। কিন্তু তাও পারছে না সারফারাজ। কাল গায়ে হলুদ। পরদিন আবারও বিয়ে। কেনাকাটা আজই সারতে হবে। অগ‍্যতা মায়ের ওপর অন্বেষার দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে সে চলে গেল শপিংমলের উদ্দেশ্য বোনেদের নিয়ে।

ইনশাআল্লাহ চলবে…..