প্রণয়ী পর্ব-০৯

0
158

#প্রণয়ী
লেখনীতেঃ #ঈশিতা_ইশা
|০৯.|
(লেখা কপি করা নিষেধ)

…………

‘তুই আশরাফ ভাইকে কি বলেছিস? উনি আমাকে বললেন তাকে যেনো আর বিরক্ত না করি। কেনো এটা বলেছেন?’

‘আমি কীভাবে জানবো?’

‘কীভাবে জানবি মানে? তোর সাথে আজকে দেখা করতে গিয়েছিল না আজকে?’

‘দেখো ভাইয়া যেভাবে বলেছো যা বলেছো করেছি এবার অন্তত আমাকে একটু নিজের মতো থাকতে দাও।’

‘তুই তর্ক করা শিখে গেছিস? এতো সাহস তোর?’

মিসেস মাসুমা আর বেল্লাল হোসেন ছেলের চিল্লাপাল্লা শুনে প্রিয়তার কক্ষে ছুটে আসে।

বেল্লাল হোসেন তুহিনকে প্রশ্ন করে,’কিরে কি হয়েছে চেঁচামেচি করছিস কেনো?’

তুহিন উত্তর দেয়,’তোমার মেয়ে আমার মুখে মুখে তর্ক করা শিখে গেছে।’

মিসেস মাসুমা প্রিয়তাকে ধমকে বলে,’এই শিক্ষা দিয়েছি তোকে? এখন নিজের ভাইয়ের মুখে মুখে তর্ক ও করিস!’

প্রিয়তা বিরক্ত হয় মায়ের আচরণে। সবটা না জেনে তাকে দোষী বানানো হচ্ছে।

প্রিয়তা বলে,’আমি তর্ক ও করিনি আর কোনো অন্যায়ও করিনি। ভাইয়া যা বলেছে তা-ই করেছি তবুও সে আমার সাথে এমন ব্যবহার কেনো করছে?’

এ পর্যায়ে বেল্লাল হোসেন মুখ খোলেন,’এক মিনিট কি হয়েছে বল আমাকে।’

প্রিয়তা কথার জবাব না দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। সে কি ই বা বলবে?

‘ভেবেছিলাম অফিসের ম্যানেজার ওকে বিয়ে করলে ও সুখে থাকবে সেইজন্য আমি ওনাকে কত অনুরোধ করে দেখা করতে পাঠাই। কিন্তু ও লোকটাকে কিছু তো বলেছে যার কারণে সে আমার উপর রাগ। আজকে অফিসে কথাও বলেনি।’

তুহিনের কথা শুনে বেল্লাল হোসেন ক্ষেপে যায়।

‘তুই আমার অনুমতি ছাড়া প্রিয়তার জন্য কোন সাহসে ছেলে আনিস? তোকে না বলেছি ওর পড়াশোনা শেষ হবে এরপর চিন্তা করবো এ বিষয়ে।’

‘দেখো বাবা পড়াশোনা শেষ হলে তো ভালো ছেলে পাওয়া যাবে এমনটা তো না। আগে থেকেই পাত্র খুঁজে না রাখলে কীভাবে মেয়েকে বিয়ে দিবা?’

‘আমার মেয়ের বিয়ে নিয়ে আমি বুঝবো তোর চিন্তা করতে হবে না।’

তুহিন আর বেল্লাল হোসেনের কথার মধ্যে মিসেস মাসুমা বলে,’আচ্ছা ঠিক আছে সামান্য বিষয় নিয়ে নিজেদের মধ্যে ঝামেলা কোরো না। তুহিন তুই তোর ঘরে চল।’

তুহিন গটগট পায়ে প্রিয়তার কক্ষ হতে বেরিয়ে যায়। মিসেস মাসুমা ও তার পিছন পিছন যায়। প্রিয়তা তো জানে না আশরাফ কোথায় বা এরপর তার সাথে কি ঘটেছিলো। সে গতকালকে সেই যে ফুচকার দোকানে আশরাফকে দেখেছিলো এরপর আর তার খবর জানে না কিছুই। গতকালকে কিছু না জিজ্ঞেস করলেও তুহিন আজকে অফিস শেষে বাসায় ফিরে এসব জিজ্ঞেস করছে।

বেল্লাল হোসেন প্রিয়তার মাথায় হাত রাখেন।

‘আমি জানি তুই অন্যায় মুখ বুজে সহ্য করার মতো মেয়ে না। যথেষ্ট শক্ত মেয়ে মানুষ তুই। তবুও কেনো তোর ভাইয়ের কথা মুখ বুজে সহ্য করে নেস সবসময়। ছোট বেলা থেকেই ও তোকে দেখতে পারে না। সবসময় তোর ভাগের জিনিস, খাবার কেঁড়ে নিয়ে গেছে তবুও তুই ওকে সম্মান দিস শ্রদ্ধা করিস।’

প্রিয়তা বাবার বুকে মাথা রেখে বলে,’শত হলেও সে আমার বড় ভাই। হয়তো আমাকে ছোট বোন হিসেবে পেয়ে সে খুশি না। ভাইয়া যাতে খুশি হয় তাই তার কথা মেনে চলার চেষ্টা করি। তুমিই আমায় শিখিয়েছো বড়দের শ্রদ্ধা করতে হয় তারা সবসময় ছোটদের ভালো চায়।’

‘মা’রে সবাই তো শ্রদ্ধার যোগ্য না-ও হতে পারে। চুপচাপ সবটা সহ্য করলে তোকে দুর্বল ভাববে।’

‘ভাবুক তাতে আমার কিছু আসে যায় না। তুমি তো আমার সাথে আছো তাহলে আমি দুর্বল হলাম কীভাবে? যার তোমার মতো বাবা আছে সে দুর্বল হতে পারে না কখনো সে সবসময় মহা শক্তিশালী। আমার শক্তি ভান্ডার তুমি।’

প্রিয়তার কথা শুনে বেল্লাল হোসেন তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। ছোট বেলা থেকেই মেয়েকে দেখে এসেছে কখনো পরিবারের কারো সাথে খারাপ আচরণ করেনি কিংবা মুখেমুখে তর্ক করেনি। অল্প বয়স থেকেই মেয়েটা বেশ বুঝদার।

_____________

গ্রীষ্মের দুপুরে তপ্ত রোদ্র তাপে নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। চারিদিকে একটু হওয়ার ছিটেফোঁটাও নেই। জল তৃষায় জান যায় যায় অবস্থা। ছাতার নিতে আইসক্রিম ওয়ালা নানান ধরণের আইসক্রিম বিক্রি করছে।
রিমি নিলো চকবার,হৈমন্তীর হাতে ভ্যানিলা ফ্রেভারের কাপ আইসক্রিম আর প্রিয়তা খাচ্ছে লেমন ফ্রেভার।

রিমি আইসক্রিমে কামড় বসিয়ে বসলে,’আজকে আর শেষের ক্লাসটা করতে ইচ্ছে করছে না। এখনো এক ঘন্টা বাকি। মন চাচ্ছে গাছ তলায় হাত পা ছড়িয়ে ঘুমাই।’

হৈমন্তী বলে,’এটেনডেন্স সেভেনটি পারসেন্ট না হলে স্যার বলেছে মিড দিতে দিবে না। তুই বিয়ে খেতে গিয়ে অলরেডি অনেকদিন ক্লাস মিস করেছিস। যা করবি বুঝে শুনে কর।’

‘দূর ঐ সব এখন চিন্তা করি না। পরীক্ষার আগে স্যারের সামনে কান্নাকাটি করে ঠিক ম্যানেজ করে নিবো।’

‘লাভ নাই। এই কুদ্দুস স্যার এক নাম্বারের খাটাস। সিনিয়রদের কাছ থেকে জেনেছি উনি এক নাম্বারের জন্য ও ফেল করিয়ে দেন।’

হৈমন্তীর কথা শুনে রিমির মধ্যে কোনো ভাবান্তর হলো না। বরং সে তাকিয়ে আছে প্রিয়তার দিকে। প্রিয়তাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে এসব আলাপে তার মন নেই।

‘কিরে প্রিয়ু তোর মন খারাপ?’

রিমির ডাকে প্রিয়তার ধ্যান ভাঙে।

‘না ঠিক আছি আমি।’

প্রিয়তার কথা রিমির বিশ্বাস হলো না। প্রিয়তা সেটা জানে তবুও চুপ করে রইলো। তারও আজকে আর ক্লাস করতে ইচ্ছে করছে না। নদীর ধারে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকতে ইচ্ছে করছে। নদীর ধারে চুপচাপ চোখ বন্ধ করে বসে থাকলে কেমন লাগে তার জানা নেই। নিশ্চয়ই ভালো লাগে কিংবা অন্য রকম অনুভূতি হয়। নইলে লোকে কেনো যায়?

হৈমন্তী প্রিয়তাকে আলতো ধাক্কা দেয়।
‘ঐ তোর কি সমস্যা? কতক্ষণ ধরে রিমি ডাকে জবাব দেস না কেন?’

প্রিয়তা তাকিয়ে দেখে রিমির মুখ ভার।
‘আসলে আমারো ক্লাস করতে ইচ্ছে করছে না।’

প্রিয়তার কথা শুনে রিমি তার কপালে হাতের উল্টো পিঠ ছুঁইয়ে শরীরের তাপমাত্রা বোঝার চেষ্টা করে।

প্রিয়তা বলে,’আমি ঠিক আছি।’

রিমি জানে প্রিয়তা ঠিক নেই। কারণ ক্লাস মিস দেওয়ার মতো মেয়ে সে না। তাহলে আজকে এই কথা কেনো বলছে? প্রিয়তার কি মন খারাপ নাকি সে কোনো সমস্যায় পড়েছে?

রিমি বলে,’চল বাসায় যাই।’

‘বাসায় যেতেও ইচ্ছে করছে না।’

প্রিয়তার কথা শুনে রিমি আর হৈমন্তী একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে।

হৈমন্তী প্রশ্ন করে,’তাহলে?’

শ্বাস ফেলে প্রিয়তা বলে,’খোলা জায়গায় প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে ইচ্ছে করছে।’

‘বেড়াতে যাবি?’
হৈমন্তী চট করে প্রশ্ন করে।

প্রিয়তা কি বলবে বুঝতে পারে না।

প্রিয়তা উত্তর দেয়,’তুহিন ভাই দিবে না।’

রিমি গলা খেঁকিয়ে বলে,’আরে রাখ তোর তুহিন ভাই। তুই কই যাবি বল খালি।’

‘না রে ভাইয়ার অবাধ্য হই না আমি।’

প্রিয়তার কথা শুনে রিমি হৈমন্তী উভয়ই হতাশ হয় প্রচন্ড।

‘আচ্ছা পরেরটা পরে দেখা যাবে। পাঁচ নম্বর রোডের পার্কটায় গিয়ে বসি কতক্ষণ।’

রিমি প্রিয়তার হাত টেনে বলে।

প্রিয়তা বলে,’কিন্তু ক্লাস।’

‘ক্লাস পরে আগে তোর মন ভালো করা প্রধান কাজ।’
প্রিয়তার কথা পাত্তা দিলো না রিমি। হৈমন্তীও তাকে কিছু বললো না।
রিকশা ডেকে তিনজনে উঠে বসলো।

পার্কে এসে চুপচাপ বেঞ্চে বসে আছে প্রিয়তা আর হৈমন্তী। রিমি এ মাথা থেকে ও মাথা বাচ্চাদের সাথে ছুটছে। মেয়েটা বেশ চঞ্চল। এক স্থানে স্থির থাকে না। প্রিয়তা ওকে বেশ পছন্দ করে।

__________

ছাদে রেলিং থাকায় প্রিয়তার বেশ অসুবিধা হচ্ছে। রেলিং না থাকলে পা ঝুলিয়ে আরাম করে বসতে পারতো। পাশের ছাদে তাকালে তার হিংসে হয়। কয়েকবার মনে হয়েছিলো পাশের গিয়ে একটু বসার কথা পরক্ষণেই চিন্তা বদলেছে। হুট করে কেউ আসলে বিপদ। শহুরে এলাকায় তারা থাকে অথচ এখনো মানুষ কুসংস্কার বিশ্বাস করে। সন্ধ্যার পর কেউ ছাদে আসে না। কোন এক হুজুর নাকি বলেছে সন্ধ্যার পর এই এলাকার ছাদে ছাদে দুষ্টু জ্বি ন ঘুরে। ব্যস এতেই জনগন ভয়ে কাবু। মাগরিবের আজান পড়তেই সবাই নিজেদের ঘরে ঢুকে যায়। অবশ্য এটা শুধু মহিলাদের ক্ষেত্রে। পুরুষরা যারা বাহিরে কাজ করে এদের সময় কই ছাদে আসার? সকালে বের হয় আসে একদম রাতের বেলায়। খেয়েদেয় ঘুম তারপর পরেরদিন একই রুটিন।

প্রিয়তার মা ও তাকে ছাদে আসতে দেয় না। সে-ও এতোদিন আগ্রহ দেখায়নি কিন্তু সেদিন ছাদে আসার পর নিরিবিলি বসে একা একা সময় পাড় করে তার বেশ ভালো লাগে। তাই তো এখন সন্ধ্যার পর ছাদে এসে সে বসে থাকে। তার মা পাশের ফ্ল্যাট থেকে বাসায় ফেরার পূর্বে সে বাসায় গিয়ে উপস্থিত হয়। প্রিয়তা সাথে ঘড়ি আনে না। এসে চুপচাপ ঝিম মেরে বসে থাকে। চল্লিশ মিনিট যেতেই তার অনুমান হয় এখন বাসায় যাওয়া দরকার। কারণ মাঝে মাঝে মিসেস মাসুমা এটা ওটা নিতে নিজেদের ফ্ল্যাটে আসেন তখন যদি উঁকি মেরে তাকে কক্ষে না পায় নানান প্রশ্ন করবে। সচারাচর এমন হয় না, সে এসে প্রিয়তাকে ডাকবে। যেটা প্রয়োজন এসে নিয়ে চলে যায়। তবে মাঝে মাঝে প্রিয়তার কক্ষে উঁকি দিয়ে আবারো পাশের ফ্ল্যাটে চলে যায়। প্রিয়তাকে পড়তে দেখলে বিরক্ত করে না। তার বাবার কড়া আদেশ মেয়েকে পড়ার সময় বিরক্ত করা যাবে না একদমই।

আজকে কোনো কারণে প্রিয়তার একদমই ভালো লাগছে না। ছোট বেলার স্মৃতি চারণ হচ্ছে বারবার। ইচ্ছে করছে দাদুবাড়ি যেতে। দাদির কোলে মাথা রেখে গল্প শুনতে। দাদুবাড়ি গেলেও লাভ নেই দাদি গত হয়েছে বছর চারেক আগে। যেদিন দাদি মারা যায় সেদিন বাহিরে প্রচুর বৃষ্টি ছিলো। প্রিয়তা কাঁদেনি একদমই। দরজায় খিল দিয়ে বসে ছিলো ঝিম মেরে। আজকেও বসে আছে ঠিক সেভাবে। লোকে বলে প্রিয়তার মধ্যে অনুভূতি কাজ করে না সে শক্ত মেয়ে মানুষ।

‘মৃত মানুষদের জন্য আমরা অপেক্ষা করি না। আমাদের সমস্ত অপেক্ষা জীবিতদের জন্যে।’

কথাটা শুনে প্রিয়তা দ্রুত ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকালো। সে অতো বেশি বই পড়ে না কিন্তু তার জানা আছে এই লাইনটা হুমায়ুন আহমেদ স্যারের বিখ্যাত উপন্যাস অপেক্ষা বইয়ের লাইন।

প্রিয়তা তাকাতেই জাইন হাসে। মনোযোগ আকর্ষণ সে ঠিক ভাবেই করতে পেরেছি। নিহারিকাকে জিজ্ঞেস করেছিলো কীভাবে কারো মনোযোগ আকর্ষণ করা যায় না ডেকে। তখন অভিজ্ঞদের মতো ভেবে নিহারিকা বলেছিলো বইয়ের বিখ্যাত লাইন বললে মনোযোগ আকর্ষণ সম্ভব। নিহারিকা প্রচুর বই পড়ে। অনেকগুলো লাইন সে জাইনকে শোনায়। এই লাইন দু’টো তার মনে ধরেছে। এর বদলে কচকচে পাঁচশত টাকার নোট নিহারিকাকে সে দিয়েছিল।

মানুষ যে পরিস্থিতিতে থাকে সেই পরিস্থিতি কেউ আন্দাজ করতে পারলে সে চরম চমকায়। যেমনটা প্রিয়তার চমকালো। সে অপেক্ষায় আছে কিন্তু কীসের অপেক্ষায় তার জানা নেই।

‘তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে কারো অপেক্ষায় আছো।’

জাইনের কথার জবাব দেয় না সে। আবারো সামনে তাকায়। ছাদে সিমেন্ট দিয়ে বেঞ্চ বানানো সেখানেই সে বসে আছে। জাইন এসে তার পাশে বসলো কিন্তু অনেকটা দূরত্ব রেখে। বলা যায় বেঞ্চের দুই মাথায় দু’জন। দীর্ঘ তিনদিন ধরে প্রিয়তা ছাদে আসছে। প্রথমদিন জাইনকে বকা ঝকা করতে আসলেও সেদিন বসে থেকে তার ভালো লাগে তাই পরপর দুইদিন এসেছিলো। আজও আবার আসলো। এর মধ্যে জাইনের বিষয়টা মাথায় ছিলো না। গত তিনদিন জাইনের সাথে তার কোনো রকম সাক্ষাত হয়নি। না রাস্তায়, না কলেজের সামনে,না ছাদে। বলা চলে জাইনের কথা বেমালুম ভুলে গেছিলো। অপরদিকে জাইন নানান ঝামেলায় সময় করতে পারছিলো না। তিনদিনে তিনশন বার চেষ্টা করেছে আসার।

‘আপনি হঠাৎ এতোদিন পর?’

‘পালিয়ে এলাম। হঠাৎ মনে হলো একটু হাওয়া খাওয়া দরকার আর হাওয়া খাওয়ার জন্য এ বাড়ির ছাদ বেস্ট।’

জাইনের কথ প্রিয়তার কাছে বিশ্বাস যোগ্য লাগলো না। সে সহজে মানুষের কথা বিশ্বাস করে না। জাইনের কুঁচকে যাওয়া পাঞ্জাবী অন্য কথা বলছে।

জাইন প্রশ্ন করে,’গত তিন দিন ধরে এসে কার অপেক্ষা করছো?’

প্রিয়তার সরল উত্তর,’নিজের।’

‘কেনো নিজেকে হারিয়ে ফেলেছো?’

‘অমনই কিছু একটা।’

‘মিস করছো কাউকে?’

জাইনের প্রশ্ন শুনে প্রিয়তা এক পলক তার দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে ফেলে। প্রশ্নের উত্তর দেয় না সে। কেনো জানি ইচ্ছে করছে না। আবার জাইনকে বিরক্ত ও লাগছে না।

‘আমি কি তোমাকে কোনো ভাবে সাহায্য করতে পারি?’

‘লাগবে না।’

‘আমাকে বন্ধু ভেবে বলতে পারো।’

প্রিয়তা জবাব দেয় না। জাইন তাকে আরো কিছু বলার পূর্বেই তার ফোন বেজে উঠে। পকেট থেকে ফোন বের করার সময় ব্যথায় গোঙায় সে। কল রিসিভ করে কানে দিতেই অপরপাশে শাকিলের গলা পাওয়া যায়। জাইন খেয়াল করেনি ফোনের ভলিউম বাড়ানো।

শাকিল কাঠকাঠ গলায় বলে,’বাসায় যাইস না আজকে আঙ্কেল দেখলে বকবে। যেখানে আছিস থাক। আমরা এদিকটা দেখতেছি। আর শোন হাতে ব্যান্ডেজ লাগাইছিস?’

জাইন উত্তর দেয়,’হু রাখলাম।’

শাকিলকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সে কল কেটে দেয়।

‘হাতে কি হয়েছে?’
প্রিয়তার প্রশ্ন শুনে জাইন চুপ থাকে। কি হয়েছে বললে নিশ্চয়ই প্রিয়তা জিজ্ঞেস করবে কীভাবে হয়েছে। তারপর তো সে মিথ্যা বলতে পারবে না আর সত্যি বললে প্রিয়তা তার সাথে হয়তো কথাই বলবে না আর। এমনিতেও তাকে প্রিয়তা অপছন্দ করে।
‘সামান্য একটু লেগেছে।’

‘কোন হাতে?’

‘বাম হাতে।’

প্রিয়তা আর কোনো প্রশ্ন না করে চুপ করে বসে থাকে। একটু পর উঠে ছাদের দরজার দিকে হাঁটা দেয়। জাইন অসহায় দৃষ্টি ফেলে সেদিকে। তার হাতে ভীষণ ব্যথা হচ্ছে কিন্তু এই মূহুর্তে ফার্মেসীতে একদমই যেতে ইচ্ছে করছে না। প্রিয়তা চলে গেলে সে কি করবে একা একা?

‘চলে যাচ্ছো?’

প্রিয়তা জবাব দেয় না। জাইনের দৃষ্টির আড়াল হয়ে যায় সে।

শ্বাস ফেলে ছাদে একা বসে থাকে জাইন। বাম হাতটা সামনে এনে দেখতে থাকে। ক্ষতটা সামান্য না বলা যায় ভালোই। ছু রির পো স লেগেছে আরেকজনকে বাঁচাতে গিয়ে। টকটকে লাল র ক্তে তার পাঞ্জাবী ভিজেও গেছে। সেদিকে এতক্ষণ তার খেয়াল ছিলো না। শাকিল একটা রুমাল দিয়ে হাত চেপে বলেছে ফার্মেসীতে যেতে কিন্তু সেখানে না গিয়ে ছাদে চলে এসেছে। তার মন টানছিলো এদিকে।

‘দেখি হাত পাতুন।’
প্রিয়তাকে সামনে দেখে খানিকটা চমকায় জাইন। হাতটা সামনে ধরে। প্রিয়তা ট্রে টা বেঞ্চে রাখে।

‘ফোনের ফ্লাশ জ্বালান।’

জাইন তার কথা মতো তা-ই করে। তুলো দিয়ে ক্ষতের র ক্ত পরিষ্কার করে দিতে শুরু করে প্রিয়তা। জাইনের ব্যথা লাগলেও সয়ে নিচ্ছে। এই মূহুর্তে ব্যথার থেকে গুরুত্বপূর্ণ সামনে থাকা রমনী। এতো সামনে থেকে তার গম্ভীর চেহারা দেখে সে ইতি মধ্যে দিন দুনিয়া ভুলে গেছে। মনে হচ্ছে সময়টা থেমে যাক সামনে না আগাক।

‘কাকে মেরেছেন?’

‘কমিশনারের ছেলেকে।’

জাইনের উত্তর শুনে প্রিয়তা চমকায় না। যেনো এটা তার কাছে স্বাভাবিক।
ক্ষতস্থান ব্যান্ডেজ করে দিয়ে সব কিছু গুছিয়ে ট্রে তে রাখে।

‘নিন।’
এক বোতল পানি জাইনের সামনে ধরে। সাথে একটা পলিতে কিছু খাবার।
জাইন প্রশ্নবোধক চাহনিতে তাকায়।

‘একা একা বোর হবেন। তাই মুড়ি বাতাসা দিলাম বসে বসে চিবাবেন দেখবেন সময় কেটে যাবে।’

‘তুমি এখন চলে যাবে?’

প্রিয়তা সব কিছু গুছিয়ে ট্রেতে নিয়ে নেয়। উত্তর না দিয়ে হাঁটা দেয়। জাইন তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে। ঘাড় ঘুরিয়ে প্রিয়তা বলে,
‘সাহায্য করেছিলেন তার বিনিময়ে সাহায্য করলাম এর বেশি অন্য কিছু ভাববেন না। আর মশার কয়েল আমি জ্বালিয়েছিলাম সেটা এখনো রয়েছে। মশারাও আপনাকে বিরক্ত করবে না।’

প্রিয়তা চলে যায় তবুও জাইন ছাদের দরজার দিকে তাকিয়ে রয়। তার চোখেমুখে অপেক্ষা,তার প্রিয়র অপেক্ষা।
……..
(চলবে..)