প্রণয়ী পর্ব-১৯+২০

0
118

#প্রণয়ী
লেখনীতেঃ #ঈশিতা_ইশা
|১৯.| (১৮+ এ্যালার্ট)
(লেখা কপি করা নিষেধ)

……….

প্রিয়তা ফোন হাতে নিয়ে দেখে জাইনের একত্রিশটা কল এবং বায়ান্নটা মেসেজ। এসব দেখে খানিকটা চমকায় সে। জাইন কেনো এতো কল মেসেজ দিলো সেটাই বুঝতে পারছে না। ফোন হাতে নিয়ে বিষয়টা ভাবতে শুরু করে। এমন সময় ফোন আবারো বেজে ওঠে। স্ক্রিনে ভেসে ওঠে জাইনের নাম্বার। প্রিয়তা ফোনটা টেবিলের উপর রাখে। কল বাজতে বাজতে কটে যায়। এরপর সে এক ভয়ংকর কাজ করে বসে। জাইনের নাম্বার ব্লকে দিয়ে দেয়। এতো জ্বালাতন তার সহ্য হয় না।

বিছানার চাদর বদলাচ্ছিলো তখন কলিংবেল বাজার শব্দ হয়। বাসায় লোক থাকাতে সে আর খুলতে যায় না। মিনিট পাঁচেক পর তার কক্ষের দরজা লাগানোর শব্দ হয়। সে ঘুরে তাকানোর পূর্বেই হাতে হেঁচকা টান অনুভব করে। তাকে হেঁচকা টান দিয়ে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে। শক্ত করে তার বাম হাত চেপে ধরেছে সে। প্রিয়তা চিৎকার দিতে নিলেই তার মুখও চেপে ধরে। চোখ জোড়া বড় বড় করে এইরকম দুঃসাহসিক কাজ করা ব্যক্তিকে দেখার জন্য তাকায় সে।
প্রিয়তা কখনো নিজের দুঃস্বপ্নে ও ভাবেনি নিজ কক্ষে এভাবে সে বন্দী হবে তাও সেই মানুষটার হাতে যাকে সে এড়িয়ে চলে। প্রিয়তা এতোক্ষণ নড়াচড়া করলেও এখন একদম স্তব্ধ হয়ে আছে। তার যেনো বিশ্বাসই হচ্ছে না জাইন তার কক্ষে দাঁড়িয়ে আছে উপরন্তু তাকে এক প্রকার বন্দী করেও রেখেছে।
জাইনের চোখমুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে ভীষণ রেগে আছে সে। চোখের ভেতরের সাদা অংশ কিছুটা লাল বর্ণের হয়ে আছে। গা থেকে সিগারেটের ঝাঁঝালো গন্ধ আসছে। বুঝাই যাচ্ছে মাত্র সিগারেট টেনে এসেছে সে। জাইন কটমট চোখে প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে রাগে ফুঁসছে।

‘আমার কাছে একটা রি ভ ল ভা র আছে। যেটা এখন সাথে আছে একদম ফুল লোডেড। বলো সেটা দিয়ে তোমার কপালে গু লি করবো? এই যে কপাল বরাবর? নাকি মুখের ভেতর?’

জাইন প্রিয়তার কপালে ইশারা করে বলে। প্রিয়তা ভয়ে ঢোক গিলে।

‘তোমাকে না বলছি আমাকে ব্লক করার মতো সাহস দেখাবা না। তুমি জানো তুমি কতগুলো কাজ করে আমার মাথা নষ্ট করে দিছো। আমার গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে সেগুলো ফেলে এখানে আসলাম শুধু তুমি আমার ফোন ধরো নায় সেই সাথে আরেক ছেলের বাইকে ঘুরছো। এখন আবার আমাকে ব্লক করছো। বলো তোমার কই কই গু লি করবো? মন চাচ্ছে এই চোখ,মুখ সব জায়গায় একটা করে বু লে ট গেঁথে দেই।’

জাইনের কথা শুনে প্রিয়তা ছোটার চেষ্টা করে। এতে জাইন তার হাত আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরে।

‘ঐ ছেলে কে? কি হয় তোমার?’

প্রিয়তা প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ছোটার চেষ্টা করে।

‘বলো কি হয়?’

প্রিয়তা উম উম শব্দ করতেই জাইনের হুঁশ হয় সে প্রিয়তার মুখ চেপে ধরে আছে। হুঁশ হতেই মুখ থেকে হাত সরায়।
প্রিয়তা সাথে সাথে বলে,’আপনার সাহস কি করে হয় আমার সাথে অসভ্যতা করার। আমি যার সাথে ইচ্ছে ঘুরবো তাতে আপনার কি? আপনার তাতে কি যায় আসে? আপনি এক্ষুনি বের..’

বাকিটা বলার পূর্বেই জাইন তার মুখ আবারো চেপে ধরে।
রুদ্ধ গলায় বলে,’আমার যায় আসে বহুত কিছু। বিকজ আই লাভ ইউ। আই লাভ ইউ এ লট। তুমি আমার প্রিয়।’

জাইনের কথা শুনে প্রিয়তা বিস্ময় চোখে তাকায়। জাইনের আরো বলে,’আমি পাগলের মতো তোমার পিছনে ঘুরি। আমাকে সবাই মজনু ডাকে তবুও আমি ওসব পাত্তা দেই না। আমি সত্যি তোমার মজনু হতে চাই। সেই তুমি আরেকজনের সাথে ঘুরবা কিভাবে সহ্য করবো বলো? হয় তুমি আমার হবা না হয় একেবারে তোমার জা ন নিয়ে নিবো। আমি থাকতে তুমি অন্য কারো হবা সেটা আমি সহ্য করবো না। গট ইট?’

জাইনের কথাবার্তা শুনে প্রিয়তা বিস্ময়ের উপর বিস্ময় হচ্ছে।

‘তোমাকে পাওয়ার জন্য তোমার সকল আচার-আচরণ মেনে নিয়েছি। তুমি কল না ধরলে একটার জায়গায় দশটা কল দেই। মেসেজের রিপ্লাই দিবা না জেনেও একের পর এক মেসেজ দিয়ে যাই। আর তুমি বলছো আমার কী যায় আসে? জাইন রহমান পা গ ল হয়ে গেছে তোমার জন্য। এবার হয় আপোষে নিজের করে নাও না হয় সবটা সহ্য করো।’

প্রিয়তার ছটফটানি থামে জাইনের কথায়। হঠাৎ শান্ত হয়ে যায় সে।

‘প্রেমিক হলে হতে হয় পাগলাটে। যে ভালোবাসা না পাওয়া পর্যন্ত ছুটে। নিজের পছন্দের মানুষটাকে জোর করে আগলে রাখে। পছন্দের মানুষের প্রত্যাখানের বিপরীতে এক সমুদ্র ভালোবাসা ঢেলে দেয়।’

জাইনের কথা শুনে প্রিয়তা তার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকায়।

‘আমিও তাই করছি। একটু একটু করে তোমায় জয় করতে চাইছি কিন্তু তুমি তা বুঝেও এড়িয়ে চলেছো আমায়। এতোদিন কিছু না বললেও এবার বলবো। আমার সহ্য হয় না তোমার প্রত্যাখান। ভেতরটা বিষিয়ে যায় তোমার এমন আচরণে। এমনটা দ্বিতীয় বার করলে তুমি আস্ত থাকবে না।’

প্রিয়তার মুখ থেকে হাত সরায় জাইন কিন্তু সে এখনো প্রিয়তার হাত চেপে ধরে আছে। তার ফোন বেজে উঠতেই হাত ছেড়ে দেয়।
হুট করে প্রিয়তার খুব কাছে চলে আসে সে। দু’জনের ওষ্ঠের মধ্যে কয়েক ইঞ্চির দূরত্ব। প্রিয়তা নয়ন জোড়া বন্ধ করে ফেলে

এবার জাইনের কন্ঠ বদলে হয়ে যায় ঠান্ডা।
‘ছেলেটা কে ছিলো?’

প্রিয়তা ঐ ভাবেই অস্পষ্ট উত্তর দেয়,’আমার খালাতো ভাই হয় সে। সে বিবাহিত। তার সাথে আমার কোনো রকম সম্পর্ক নেই।’

জাইন ঠান্ডা গলায় বলে,’মনে রেখো এটাই প্রথম আর এটাই শেষ। এরপর উল্টাপাল্টা কিছু দেখলে তোমার নিস্তার নেই।’

জাইনের কথা শেষ হওয়ার কয়েক সেকেন্ডের মাথায় দরজা খোলার শব্দ হয়। প্রিয়তা অনুভব করে জাইন বেরিয়ে গেছে। মূর্তির মতো কয়েক মিনিট চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে প্রিয়তা। হুঁশ আসতেই চক্ষু মেলে কক্ষে তাকায়। কাউকে দেখতে না পেয়ে কক্ষের দরজা ধরে দাঁড়ায়। ভয়ে ঘেমে গেছে সে। বাসার লোকজন এসব জানলে কি হবে! গতকালকে প্রিয়তাকে নিয়ে এসে দুলাল তার পরিবারকে নিয়ে বিদায় নেয়। রাতের দিকে জাইন অনেকগুলো কল দিয়েছিলো ধরেনি সে। আজকে পরীক্ষা না থাকায় বাসার কাজ করছিলো সে। দুলালরা চলে যাওয়ার পর আজকে কক্ষটা গোছাচ্ছিলো তখনই ঘটে গেল সবটা।

মিসেস মাসুমা ফ্ল্যাটে ঢুকতেই তার নজর যায় প্রিয়তার দিকে।
‘কিরে এভাবে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো?’

প্রিয়তা স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করে।
‘কোথায় গিয়েছিলে তুমি?’

‘আরে রুমা টেনে নিয়ে গেলো। বললো আন্টি দেখে যাও সিরিয়াল রিপিট চলছে। ওর টানাটানিতে চুলা বন্ধ করে গেলাম দেখতে। শেষ হতেই জোর করে উঠে এলাম।’

মিসেস মাসুমার উত্তর শুনে প্রিয়তা নিশ্চুপ থাকে।

‘কিরে তোর কি শরীর খারাপ লাগছে?’

প্রিয়তা মাথা নাড়িয়ে নিজের কক্ষে চলে যায়। দরজা বন্ধ করে জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে। মস্তিষ্কে বিচরণ করতে থাকে একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো।

মিসেস মাসুমা মেয়ের কান্ড কিছুই বুঝতে পারেন না। তিনি সোজা চলো যান রান্নাঘরে। অনেক কাজ বাকি তার।

………..

পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে রিমি বেশ খুশি। আজকের পরীক্ষাটা ভালো হয়েছে তার। সে হাবিজাবি বলছে আর হাসছে। তার সাথে তাল মিলিয়ে হৈমন্তী হাসছে। প্রিয়তাকে দেখা গেলো বেশ অমনোযোগী। সে অন্যমনস্ক হয়ে কিছু ভাবছে যা রিমি হৈমন্তীর নজর এড়ায় না।

রিমি প্রিয়তাকে কনুই দিয়ে গুঁতা দিয়ে বলে,’কিরে পরীক্ষা ভালো হয়নি? তোকে এমন লাগছে কেনো?’

প্রিয়তা রিমির কথার জবাব দেয় না।
হৈমন্তী এগিয়ে এসে প্রিয়তার শরীরের তাপমাত্রা চেক করে বলে,’জ্বর তো আসেনি তাহলে কী হয়েছে তোর?’

‘কিছু না।’
বলেই প্রিয়তা হেঁটে যায়। রিমি হৈমন্তী একে অপরের দিকে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করে হলোটা কি!
প্রিয়তা তাদের সাথে কথা না বাড়িয়ে রিকশা ডেকে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। তার হেঁটে যেতেও ইচ্ছে করছে না। গতরাত নিদ্রাহীন কাটিয়েছে। সে বুঝতে পারছে না জাইনের আচরণে কেমন প্রতিক্রিয়া দেওয়া উচিত। সে তো আচঁ করেছিলো জাইন তাকে পছন্দ করে কিন্তু বিষয়টা এতো দূর গড়িয়েছে সেটা বুঝতে পারেনি। যেভাবে তাকে গতকাল ধমকে গেছে তাতে মনে হলো জাইন কিছু পরোয়া করে না। চোখ বন্ধ করে এক হাত দিয়ে মাথা চেপে বসে থাকে প্রিয়তা। রিকশা চলছে আপন গন্তব্যে।

কলিংবেল দিতেই হাসিমুখে দরজা খুলে মিসেস মাসুমা। প্রিয়তা মায়ের দিকে নজর না দিয়ে নিজের কক্ষের দিকে হাঁটা দিলে মিসেস মাসুমা তার হাত ধরে আঁটকায়।

‘হাত ছাড়ো ভালো লাগছে না। কাজ থাকলে পরে করে দিবো।’

‘তাকিয়ে দেখ কে এসেছে।’
প্রিয়তা বিরক্তি নিয়ে তাকাতেই দেখে চেয়ারে পরিচিত মুখ বসা। মিসেস পারুল উঠে এসে প্রিয়তার থুঁতনিতে হাত রেখে হাসি দেয়।

‘কেমন আছো?’

প্রিয়তা জোর পূর্বক হেসে বলে,’জি ভালো,আপনি?’

‘আমি তো আলহামদুলিল্লাহ সব সময়ই ভালো থাকি।’

হঠাৎ মিসেস পারুল তাদের বাসায় কেনো এসেছে বোঝার জন্য মিসেস মাসুমার দিকে তাকায় প্রিয়তা।

মিসেস মাসুমা হেসে বলে,’আপা মেয়েটা মাত্র বাহির থেকে আসলো তো। আপনি চা খান আমি ওকে আনতেছি।’

মিসেস পারুল বাঁধা দিয়ে বলে,’আরে না আপা সে-সবের প্রয়োজন নেই। ওকে আমি প্রথমবার শাড়িতেই দেখেছি।’

প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে বুঝার চেষ্টা করে এখানে চলছেটা কি।
মিসেস পারুল প্রিয়তাকে বলে,’তুমি যাও ফ্রেশ হও।’

প্রিয়তা মাথা নাড়িয়ে নিজের কক্ষে চলে যায়। কক্ষে এসে ফোন হাতে নিতেই দেখে জাইনের মেসেজ।

‘বাসায় ফিরেছো? পরীক্ষা কেমন হলো? আমি সভায় বসে আছি। ভেবেছিলাম আজকে তোমার ভার্সিটিতে যাবো দেখা করতে কিন্তু সভা যে শুরু হলো শেষ হওয়ার নামই নিচ্ছে না। শুনো তোমার সাথে আমার অনেক কথা জমে আছে কখন বলবো বলো তো? আমি তো সময়ই বের করতে পারছি না। আমার বন্ধুরা কী বলে জানো? আমি সময় বের করতে করতে নাকি তুমি আমায় কাচ কলা দেখিয়ে অন্য পুরুষের হাত ধরে চলে যাবা। আসলেই কি তাই?’

মেসেজটা পড়ে প্রিয়তা কতক্ষণ ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকে। অন্য সময় হলে সে ত্যাড়া উত্তর দিয়ে বলতো,’অবশ্যই এমনটা করবো। সম্ভব হলে এখনই করবো।’
এখন সে ত্যাড়া তো দূর সহজ উত্তরও দিচ্ছে না। জাইন গতকালকের ঘটনার পর স্বাভাবিক ভাবেই মেসেজ দিচ্ছে। এখনো কল দেয়নি। সে যেতেই প্রিয়তা ফোন থেকে ব্লক তুলে দিয়েছে। আগ বাড়িয়ে ঝামেলা সে করতে চায় না। বিষয়টা মিটমাট করতে চায়।
মিসেস মাসুমা দরজায় করাঘাত করতেই প্রিয়তা ফোন বালিশের নিচে রেখে দরজা খুলে।

‘আপা চলে যাচ্ছে যা গিয়ে বিদায় দে।’
প্রিয়তা মাথায় ওড়না টেনে যায়। মিসেস পারুল হাসিমুখে প্রিয়তার হাত টেনে দরজার দিকে যায়। টুপ করে প্রিয়তার হাতে কিছু গুঁজে দেয়।
‘আজ আসি কেমন? আবার আসবো শীঘ্রই।’

প্রিয়তা জবাবে বলে,’সাবধানে যাবেন।’

‘ঠিক আছে মা। তুমিও সাবধানে থেকো।’
মিসেস পারুল যেতেই মিসেস মাসুমা পিছন থেকে বলে,’তোর কি আক্কেল জ্ঞান হবে না? মুখটা অমন করে রাখছিস কেন?’

‘ভালো লাগছে না মা। আমি রুমে গেলাম।’

প্রিয়তা মিসেস মাসুমার বাকি কথা না শুনেই কক্ষে ঢুকে দরজা আবারো বন্ধ করে দেয়। হাত খুলতেই দেখে কিছু হাজার টাকার নোট। প্রিয়তার চক্ষু ছানাবড়া। তবে কি মিসেস পারুল এমনি এমনি আসেনি? সে কনে দেখতে এসেছিলো? প্রিয়তা একদম পড়ে যায় সমুদ্রের মাঝে। এবার কী হবে তার?

সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে মিসেস মাসুমার কাছে যায় প্রিয়তা।

‘মা ঐ আন্টি আমাকে দেখতে এসেছিলো?’

‘এটা আবার বলতে হয়? বুঝিস না?’

‘আমাকে একবারো জানানোর প্রয়োজন মনে করলা না?’

‘ওমা আমি কী জানতাম নাকি যে উনি আসবে। ওনাকে তো চিনিই না। এসে বললো তোকে রাস্তায় কয়েকবার দেখে ভালো লেগেছে ছেলের বউ করতে চায়। একটা মানুষ বাড়ি এলে তো আর বের করে দেওয়া যায় না তাই আমি শুধু আপ্যায়ন করলাম।’

‘আমি সোজাসাপটা বলে দিচ্ছি বিয়ে করবো না কিন্তু।’

মিসেস মাসুমা প্রিয়তার কথায় কান দেন না। সে তার কাজে মত্ত্ব থাকে।

প্রিয়তা আবারো বলে,’কি বলেছি শুনেছো?’

‘কী শুনবো আমি? তোর বাবার অবস্থা জানিস? এতো বড় মেয়ে হয়ে এখনো বাপ ভাইয়ের ঘাড়ে চেপে খাচ্ছিস আর কত? এবার মুক্তি দে। রোজ রোজ অশান্তি ভালো লাগে না।’

প্রিয়তা আহাম্মক বনে যায় মায়ের কথা শুনে।

‘আমি বোঝা?’

‘আঠারোর পর সব মেয়েই বোঝা।’
প্রিয়তা হাতে থাকা নোট গুলো ছুঁড়ে দিয়ে প্রস্থান করে। মিসেস মাসুমা গলা উঁচিয়ে বলে,’পারবি তো ঐ একটা কাজই। দরজা বন্ধ করে বসে থাকতে।’

এরপর বিরবির করতে করতে মেঝে থেকে টাকাগুলো কুড়িয়ে গুনতে শুরু করে মিসেস মাসুমা।

………

বালিশের পাশে থাকা ফোনটা ক্রমাগত ভাইব্রেশন হয়ে বেজে চলছে কিন্তু ফোনের মালিকের হদিস নেই। চোখের তন্দ্রা হালকা হতেই ফোনটা তুলে কানে দেয়।

ঘুম ঘুম গলায় বলে,’হ্যালো।’

অপরপাশ থেকে প্রশ্ন করে,’ঘুমাচ্ছো?’

প্রিয়তার মেজাজ খারাপ হয় এতো রাতে কল দিয়ে এমন প্রশ্ন করাতে।
‘না মাছ বিক্রি করি,কিনবেন?’

‘মাছের কেজি কত?’

প্রিয়তা চোখ মুখ খিঁচে বলে,’ফাইজলামি করেন?’

‘শুরুটা তুমি করেছো।’

‘এতো রাতে কল দিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে জিজ্ঞেস করছেন ঘুমাচ্ছি কিনা এটা কেমন ফাইজলামি?’

‘রেগে আছো? কার উপর? আমার উপর?’

প্রিয়তা ঠান্ডা হয়। আসলেই তো কার রাগ কার উপর দেখাচ্ছে সে। মায়ের সাথে ঝগড়া করে দুপুরে দরজা লাগিয়েছে এরপর আর খুলেনি। বেল্লাল হোসেন গেছেন ঢাকায় ডাক্তার দেখাতে তাই বাসার কেউ আর তার খোঁজ করেনি। তিনি থাকলে এসেই প্রিয়তাকে ডাক দিতো। সারাটা দিন না খেয়েই পাড় করেছে প্রিয়তা।

‘একটু ছাদে আসবা?’

জাইনের কথায় প্রিয়তা বাস্তবে ফেরে। কান থেকে ফোন নামিয়ে দেখে সময় রাত দু’টো।
থমথমে গলায় বলে,’সম্ভব না।’

‘আমি তোমার বাসার দরজায়।’
এমন কথা শুনে প্রিয়তা শোয়া থেকে উঠে বসে।
বিস্ময় নিয়ে বলে,’কি!’

‘দশ মিনিটের মধ্যে তুমি না এলে বেল বাজাবো।’

প্রিয়তা কিছু বলার পূর্বেই কল কেটে যায়। প্রিয়তা জাইনের নাম্বার ডায়াল করে কিন্তু নাম্বার বন্ধ দেখায়।আরো দুইবার ডায়াল করার পরও দেখায় বন্ধ। বিছানা থেকে নেমে ওড়না গায়ে জড়িয়ে আস্তে আস্তে দরজা খুলে বের হয় সে।
তুহিন আর মিসেস মাসুমা নিজ কক্ষে ঘুমাচ্ছে। নিজের কক্ষের দরজা টেনে ফ্ল্যাটের সদর দরজার দিকে এগিয়ে যায় সে। দরজা খুলতেই দেখে কেউ নেই। ঘরের দিকে একবার তাকিয়ে সদর দরজা টেনে বের হয়। খালি পায়ে রওনা দেয় ছাদের উদ্দেশ্যে।
পাঁচ তলায় আসতেই দেখে সিঁড়িতে কেউ বসে আছে। প্রিয়তা প্রথমে ভাবে কোনো ভাড়াটিয়া হয়তো। একটু ভয় পায় এটা ভেবে সে হয়তো ধরা পড়ে গেছে।

‘অবশেষে এলে? সুন্দর করে বললে আসো না অথচ হু ম কি দিলে ঠিকই আসো।’

জাইনের গলা পেয়ে প্রিয়তা নিশ্চিন্ত হয়। প্রিয়তা জাইনকে পাশ কাটিয়ে ছাদের দিকে যায়। ছাদের ভেতর এসে আশেপাশে কাউকে দেখতে পায় না। পিছনে ঘুরতে নিলেই দেখে জাইন তার পিছনে দূরত্ব মিটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রিয়তা দুই পা পিছিয়ে যায়।নিজেকে সামলে বলে,’আপনার সমস্যা কী?’

‘তুমি।’
উত্তর শুনে প্রিয়তা ভ্যাবাচ্যাকা খায়।

‘আপনি জানেন যা করছেন তা লোকজন জানাজানি হলে মানসম্মান চলে যাবে।’

‘আই ডোন্ট কেয়ার।’

‘বাট আই কেয়ার। আমার পরিবার আছে আপনার মতো গু ন্ডা না আমরা।’

প্রিয়তার কথা শুনে জাইন নিঃশব্দে হাসে।
‘তোমার কি মনে হয় আমার পরিবার নেই? আমার তো তোমার চেয়েও মস্ত বড় পরিবার আছে।’

প্রিয়তা থেমে গভীর শ্বাস নেয়।
বলে,’কি চান আপনি?’
এখন আর প্রিয়তার গলায় রাগ নেই। গলাটা স্বাভাবিক একদম।

‘বুকের ভেতরটা পু ড় ছে। একটু বুকে আসো কুইক।’

জাইনের কথা শুনে বোকাবনে যায় প্রিয়তা।
জাইন আরো বলে,’গতকালকে তোমাকে ওসব বলার পর থেকেই আমার অশান্তি বেড়ে গেছে। আমি তোমার কাছে ঐভাবে নিজের ভালোবাসা অনূভুতি প্রকাশ করতে চাইনি। তোমার করা কাজ গুলো আমায় বাধ্য করেছে নইলে সবটা সুন্দর হতো।’

প্রিয়তা দূর্বল গলায় বলে,’আমাদের মধ্যে কিছুই সম্ভব না।’

জাইন এগিয়ে জিজ্ঞেস করে,’কেনো সম্ভব না? কোন দিকে কমতি আছে আমার? কী চাও তুমি?টাকা পয়সা কিছুরই কমতি নেই আর ভালোবাসায় মুড়িয়ে রাখবো তোমায়। একটুও কষ্ট পেতে দিবো না।’

প্রিয়তার চোখে অশ্রু এসে হানা দেয়। হঠাৎ কেনো অশ্রুরা এসে হানা দিলো প্রিয়তা জানে না। জাইনের দিকে তাকাতেই সে মায়া ভরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। প্রিয়তা দৃষ্টি সরিয়ে চোখ বুজে ফেলে। এ দৃষ্টির দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে সে নির্ঘাত আহত হবে।

‘প্রিয় তুমি গোলাপ হলে আমি সেই গোলাপের কাঁটা,
প্রিয় তুমি বসন্ত হলে আমি বসন্ত হাওয়া,
প্রিয় তুমি সমুদ্র হলে আমি সেই সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ,
প্রিয় তুমি দূরে সরলে আমি তোমায় আগলে নিবো চিরকাল।’

প্রিয়তা কান্না চেপে পিছিয়ে গিয়ে বেঞ্চে বসে।
জাইন পেছন থেকে বলে,’একটু বুকে আসবা? খুব ইচ্ছে করছে। একবার শুধু।’

প্রিয়তা কোনো উত্তর না দিয়ে ওষ্ঠ চেপে বসে থাকে।

……….
(চলবে..)

#প্রণয়ী
লেখনীতেঃ #ঈশিতা_ইশা
|২০.|
(লেখা কপি করা নিষেধ)
……….

‘তুই কি জানিস তুই না চাইতেও ওনাকে পছন্দ করিস।’
রিমির কথা শুনে প্রিয়তা চোখ তুলে তাকায়।
রুদ্ধ গলায় বলে,’এটা অসম্ভব। ঐ রকম গু ন্ডাকে আমার অপছন্দ।’

‘এটা তোর মুখের কথা প্রিয়ু। মন কিন্তু অন্য কিছু বলছে।’

‘বাজে কথা বলবি না একদম। দুদিন দেখলে কথা বললেই কি ভালোবাসা হয় নাকি?’

‘আমি কখন বললাম ভালোবাসার কথা?’
প্রিয়তা থতমত খায় রিমির প্রশ্ন শুনে।
রিমি আরো বলে,’আমি শুধু বলেছি পছন্দ করিস।’

প্রিয়তা মেকি রাগ দেখিয়ে বলে,’সর তো বাসায় যাবো।’

হৈমন্তী এতক্ষণ পাশে চুপচাপ বসে প্রিয়তা আর রিমির কথা শুনছিলো। অবশেষে সে মুখ খুলে।
‘পছন্দ করিস নাকি করিস না সেটা পরীক্ষা করে নিলেই হয়।’

হৈমন্তীর কথা শুনে প্রিয়তা তার দিকে প্রশ্ন সূচক চাহনি দেয়।

‘দেখ উনি যে তোকে ভালোবাসে এতে সন্দেহ নেই। তুইও যে ওনাকে পছন্দ করিস এটা আমরা সবাই বুঝলেও তুই বুঝতে চাইছিস না।’

প্রিয়তা বসা থেকে উঠে বসে,’আমার আগ্রহ নেই এসব বুঝাবুঝির। তোরাই বুঝতে থাক।’

রিমি প্রিয়তার হাত টেনে ধরে।
‘রাগ করিস কেনো প্রিয়ু? আমাদের কথাগুলো তো শোন আগে।’

প্রিয়তা রিমির দিকে তাকায়। রিমি ইশারা করে তাকে বসার জন্য। প্রিয়তা আবার তার পাশে বসে। হৈমন্তী এগিয়ে এসে প্রিয়তার পাশে বসে।

রিমি বলতে শুরু করে,’তুই ওনাকে অপছন্দ করিস কেনো?’

‘মা রা মা রি করে,মানুষকে হু ম কি দেয়।’

‘আর?’

‘আজব তো অপছন্দ করার আবার কারণ থাকতে হয় নাকি? আমার ভালো লাগে না সোজা কথা।’

‘দেখ তুই নিজেই নির্দিষ্ট করে জানিস না কেনো অপছন্দ করিস।’
রিমির কথায় প্রিয়তা দমে যায়।
হৈমন্তী বলে,’তুই কি রি ভ ল বা রের কথা শুনে ভয় পেয়েছিস?’

‘আমাকে সত্যি যদি গু লি করতো তখন?’

প্রিয়তার কথা শুনে রিমির আর হৈমন্তী হাসে।

হৈমন্তী বলে,’আরে বোকা ওটা তো ভয় দেখিয়েছে। তোর কি মনে হয় তোর বাসায় রি ভ ল বা র নিয়ে যাবে?’

‘নিতেই পারে। গু ন্ডা তো।’

রিমি বলে,’গু ন্ডা তো সকলের জন্য কিন্তু তোর জন্য তো মজনু। তুই না বললি তোর বাসায় তোর রুমে এসেও তোকে বাজে স্পর্শ করেনি। তাহলে কীভাবে লোকটাকে খারাপ বলছিস?

হৈমন্তী প্রিয়তার হাত ধরে বলে,’একটা কথা বলি রাগ করিস না। তুই বোকা না বুদ্ধিমতী মেয়ে। সব কিছু স্পষ্ট বোঝার ক্ষমতা আছে তোর। তুই আমাদেরকে এসব কিছুই বলতি না যদি না গতরাতে জাইন ভাইয়া তোকে ছাদে যেতে বলতো। আসলে ছাদে গিয়ে তুই নিজের ইমোশন ধরে রাখতে পারিসনি। তখন এসব স্বাভাবিক লাগলেও পরে সকালে মনে হয়েছে তুই ভুল করছিস কিন্তু মস্তিষ্ক মনের সাথে পেরে উঠছে না তাই আমাদেরকে বললি। যাতে আমরাও বলি হ্যা উনি খারাপ, বাজে,গু ন্ডা তুই লোকটাকে পাত্তা দিস না। কিন্তু বিশ্বাস কর এতো ভালোবাসে সম্মান করে এমন ছেলেকে তুই কোথাও পাবি না।’

রিমিও বলে,’তোর মস্তিষ্ক চাইছে তার সম্পর্কে নেগেটিভ শুনে পিছাতে। তুই না চাইলে পিছাতে পারিস সেটা একান্ত তোর ব্যাপার তবে স্বর্ণ খুঁজতে গিয়ে হিরা হারিয়ে ফেলিস না। যে তোকে দেখার জন্য চোরের মতো সব কাজ ফেলে ছুটে আসে সে আর যা ই হোক প্রেমিক হিসেবে অসাধারণ।’

প্রিয়তা চুপ হয়ে যায়। গতরাতে সে ছাদে বসে থেকে কান্না আটকে ফেলেছিলো। কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থাকার পর ধীরে ধীরে প্রিয়তা স্বাভাবিক হয়। পুরোটা সময় জাইন বেঞ্চের আরেক মাথায় বসে ছিলো। আর কোনো কথা বলেনি। আধাঘন্টা পর প্রিয়তা স্বাভাবিক হতেই সে উঠে দাঁড়ায়। কোনোদিকে না তাকিয়ে ছাদ থেকে নেমে আসে। জাইনও তাকে আর পিছু ডাকেনি। আজকে পরীক্ষা না থাকা সত্ত্বেও রিমি আর হৈমন্তীকে কল দিয়ে দেখা করতে বলে। দু’জনেই অবাক হয় কারণ প্রিয়তা কখনোই ছুটির দিনে তাদেরকে ডাকেনি। তবুও প্রিয়তার এক ডাকে চলে আসে।

হৈমন্তী বলে,’শোন তুই তো জানিস না কেনো তাকে অপছন্দ করিস। সে তোকে পছন্দ করে কিন্তু কেনো করে এই প্রশ্নটা তাকে করবি।’

রিমিও বলে,’হ্যা আর সেটা এক্ষুনি করবি। কল দিয়ে বলবি তুই দেখা করতে চাস।’

প্রিয়তা বিস্ময় নিয়ে বলে,’এমনটা করলে পা গ লকে ক্ষেপানো হবে। এসব আমি পারবো না।’

রিমি বলে,’ভাইয়া নিশ্চয়ই এখন কাজে অনেক ব্যস্ত। তবুও তুই ডাকার পর যদি ছুটে আসে তাহলেই তোর মনের সন্দেহ গুলো দূর হবে।’

রিমি আর হৈমন্তী প্রিয়তাকে জোর করে। শ্বাস ফেলে প্রিয়তা ফোন বের করে। জাইনের নাম্বার বের করে ডায়াল করে। রিং বেজে কলটা কেটে যায়। এর মিনিট পাঁচেক পর প্রিয়তার ফোন বেজে ওঠে। কল রিসিভ করে ফোনটা স্পিকারে দেয় প্রিয়তা। অপরপ্রান্ত থেকে সোরগোল শোনা যায়।

‘কিছু বলবা? আমি দলের অনুষ্ঠানে আছি।’

প্রিয়তা জবাব না দিয়ে রিমির দিকে তাকায়। রিমি চোখ রাঙাতেই প্রিয়তা মুখ খুলে।

‘আপনার সাথে দেখা করতে চাই এক্ষুনি।’

জাইন গম্ভীর গলায় বলে,’আমি ব্যস্ত আছি।’
এরপর সে কল কেটে দেয়। রিমি আর হৈমন্তী নিরাশ হয়।
প্রিয়তা বলে,’আমি বলেছিলাম তোরা শুনলি না। শুধু শুধু কতগুলো ভাষণ দিলি।’

দু’জনের চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।
মিনিট দুয়েক পর প্রিয়তার ফোনে মেসেজ আসার শব্দ হয়। প্রিয়তা মেসেজ খুলতেই পাশ থেকে দু’জনেই ফোনে চোখ দেয়।
‘রিকশা নিয়ে সোজা পার্কের সামনে আসো। আমি আধা ঘন্টার মধ্যে আসছি।’

মেসেজটা পড়ে রিমি আর হৈমন্তীর ওষ্ঠে হাসি দেখা যায়।
রিমি বলে,’কিরে এখনো সন্দেহ আছে তোর?’

হৈমন্তী বলে,’চুপ কর ওকে নিজে নিজে বুঝতে দে।’

প্রিয়তার মুখ বন্ধ করার জন্য একটা মেসেজই যথেষ্ট ছিলো।

..

পার্কে এসে তিনজন বসে আছে। প্রিয়তা একা না এসে রিমি আর হৈমন্তীকেও বায়না করে সাথে নিয়ে এসেছে। আধাঘন্টা পেরিয়ে গেছে এখনো জাইনের আসার নামগন্ধ নেই। প্রিয়তা ঘড়িতে বারবার সময় দেখছে। ইতিমধ্যে বিকাল তাই সে দ্রুত বাসায় ফিরতে চাইছে।

‘ভেবেছিলাম একাই বসে আছো কিন্তু দেখছি সাথে সখীদেরও এনেছো?’
মারুফের গলা পেয়ে তিনজনই তাকায়। রিমির হাসিমুখ বদলে যায় বিরক্তিতে। প্রিয়তা খেয়াল করে ওরা তিনজন এসেছে কিন্তু জাইন নেই।

শাকিল হেসে জিজ্ঞেস করে,’আপু কাউকে খুঁজছো?’

রিমি উল্টো প্রশ্ন করে,’আপনারা এখানে কেনো?’

মারুফ উত্তর দেয়,’খোলা পার্কে মানুষ কি করতে আসে? হয় প্রেম না হয় হাওয়া খায়। আমাদের তো কেউ নাই তাই হাওয়া খেতে আসলাম। আপনারা কোনটা করতে আসছেন?’

রিমি দাঁতে দাঁত চেপে বলে,’চল তো এখানে আর এক মিনিটও দাঁড়াবো না।’

শাকিল বলে,’আপনি যেতে পারেন কিন্তু প্রিয়তা তো যাবে না। প্রিয়তা এদিকে আসো। এই দেখো আমাকে অলরেডি কলও দিয়ে দিয়েছে।’

শাকিল ফোন বের করে বলে। প্রিয়তা যাবে কিনা সংশয় নিয়ে রিমি আর হৈমন্তীর দিকে তাকায়। দু’জনেই ইশারা করে তারা আছে।

হৈমন্তী বলে,’ওদিকে কেনো যাবে? আপনাদের বন্ধুকে বলুন আসতে।’

শাকিল জবাব দেয়,’ওর আসতে সমস্যা নেই কিন্তু পার্কে লোকে দেখলে প্রিয়তার নিশ্চয়ই সমস্যা আছে? যদি সমস্যা না থাকে ওকে আসতে বলি।’

প্রিয়তা থামিয়ে বলে,’না না চলেন যাচ্ছি।’

শাকিলের পিছন পিছন প্রিয়তা হাঁটা দেয়। রয়ে যায় মারুফ আর রফিক।

মারুফ বলে,’তা আপনার বয়ফ্রেন্ড কেমন আছে?’

রিমি জবাবে বলে,’আরেকজনের বয়ফ্রেন্ডের খবর দিয়ে আপনি কি করবেন?’

‘মুড়ি মাখিয়ে খাবো। হেব্বি টেস্টি। একবার খেলে বারবার খেতে মন চায়।’

‘এই হৈমি এদিকে আয়। এখানে থাকলে মাথা নষ্ট করে দিবে বকবক করে।’

হৈমন্তী রিমির দিকে অবাক চোখে তাকায়। কারণ রিমি তো এক নম্বর বাচাল অথচ সে আরেকজনকে বলছে। বেচারি হৈমন্তী বান্ধবীর সাথে অন্য পাশে গিয়ে বসে। মারুফ বাদাম কিনে খেতে শুরু করে।

প্রিয়তাকে শাকিল পার্কের পিছনের দিকটায় নিয়ে এসেছে। দূর থেকেই জাইনের জিপটা দেখতে পেয়েছে সে। শাকিল বলে,’মহাশয় জিপের ভেতরে আছে।’

এরপর শাকিল আর সেখানে দাঁড়ায়নি উল্টো দিকে হাঁটা দিয়েছে প্রিয়তা কিছু বুঝে ওঠার আগেই।
‘হেঁটে আসতে পারবা নাকি আমিই আসবো,তুলে নিতে?’

জাইনের গলা পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে প্রিয়তা সামনে তাকায়। জিপের চালকের আসনে সে বসা। জানালার কাচ নামিয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। প্রিয়তা ডানে বামে তাকায়। এদিকেটায় তেমন মানুষজন নেই। দু একজন হেঁটে চলে যাচ্ছে।

‘কি আসবো?’

‘আমার পা আছে।’

‘তা তো দেখতেই পাচ্ছি।’

‘আপনি নেমে আসুন এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলে চলে যাই।’

‘তোমাকে লোকে না চিনলেও আমি নামলে আমাকে ঠিকই চিনবে। তখন অবশ্য তোমাকে চিনতে বেগ পেতে হবে না কারো।’

‘তাহলে কলে বলবো।’

‘বুঝেছি এভাবে কাজ হবে না। নেমে তোমাকে তুলে আনতে হবে।’
জাইন জিপের দরজা খুলতেই প্রিয়তা বাঁধা দেয়।

‘আসছি।’

জাইন দুষ্ট হেসে বলে,’গুড গার্ল।’

প্রিয়তা জিপের অপর পাশ এসে দাঁড়াতেই দরজা খুলে দেয় জাইন। প্রিয়তা উঠে চালকের আসনের পাশের সিটে বলে।

জাইন সানগ্লাসটা ঠিক করে জিপের ভেতরের লুকিং গ্লাসটায় তাকিয়ে সেট করা চুল গুলো আবারো সেট করে নেয়।

এরপর জিপ স্টার্ট দিয়ে জিজ্ঞেস করে,’কোথায় যাবা?’

‘কোথাও না। এখানেই কথা বলে চলে যাই।’

‘সবসময় নাকের ডগায় রাগ নিয়ে ঘুরো কেনো? একটু হাসলে কি খুব ক্ষতি হয়?’

‘এখানে হাসির কোনো কারণ হয়নি তাই হাসতে পারছি না।’

‘তাহলে কৌতুক বলবো?’

‘আপনি মুখ বন্ধ রাখেন তাতেই চলবে।’

‘পাশে চাঁদ থাকলে মুখ বন্ধ রাখা অসম্ভব হয়ে যায়।’

‘তাহলে স্কচটেপ মারুন।’

প্রিয়তার কথা শুনে জাইন হাসে। প্রিয়তা একবার আঁড়চোখে জাইনকে পরখ করে। সে বলেছিলে ব্যস্ত তাহলে এলো কীভাবে? চোখমুখ দেখে বোঝার উপায় নেই জাইন আসলেই ব্যস্ত ছিলো কিনা।

হুট করে প্রিয়তা জিজ্ঞেস করে,’আপনি না ব্যস্ত ছিলেন তাহলে এলেন কীভাবে?’

‘সত্যি বলবো নাকি মিথ্যে?’

জাইনের প্রশ্ন শুনে প্রিয়তা তার দিকে ছোট দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।

‘দুটোই।’

‘ওদের বলেছি আমার বাসা থেকে কল এসেছে এখন না গেলে জীবন নিয়ে টানাটানি লাগবে।’

‘এটা কেমন কথা?’

‘এটা না বললে বেরই হতে দিতো না। অবশ্য আমারো বিরক্ত লাগছিলো ভাষণ শুনতে। এসব বাদ দাও তোমার কথা বলো। আজকে তুমি বলবা আমি শুনবো।’

‘কী বলবো?’

‘যেটা বলতে ডেকেছো।’

‘এমনি ডেকেছি অন্য কিছু না।’

‘তার মানে তুমিও আমার সাথে সময় কাটাতে চাইছো।’

‘আপনি যেমনটা ভাবছেন ঐরকম কিছু না।’

‘তাহলে কি রকম?’

প্রিয়তা শ্বাস ফেলে। এতো প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে সে হাঁপিয়ে গেছে।

হঠাৎ জাইন সিরিয়াস গলায় বলে,’আচ্ছা এখন যদি তোমাকে সোজা কাজী অফিসে নিয়ে যাই কেমন হবে?’

প্রিয়তা চোখ জোড়া বড় বড় করে তার দিকে তাকায়। জাইনের কথা শুনে মনে হচ্ছে সে সিরিয়াস।

‘কি হলো উত্তর দিচ্ছো না কেনো?’

‘গাড়ি থামান আমি নামবো ভালো লাগছে না।’

‘ভয় পেয়েছো? তুমি এতো সহজে ভয় পাও জানতাম না।’

প্রিয়তা জাইনের কথায় আশ্বস্ত হয় না। সে দরজা খোলার চেষ্টা করে কিন্তু দরজা লক করা। জাইন বিষয়টা খেয়াল করে হাসে।

‘অল্প বয়সে পিরিতি করিয়া হয়ে গেলো জীবনের শেষ…’

এক লাইন গেয়ে জাইন বলে,’এই যা আমার তো প্রেমের বয়স শেষ। এখন এই গানটা গাইলে লোকে তো খোঁটা দিবে। অল্প বয়সের জায়গায় কি বলা যায় বলো তো।’

প্রিয়তা রাগী গলায় বলে,’গাড়ি থামান আর দরজা খুলুন বের হবো আমি।’

জাইন প্রিয়তার কথায় পাত্তা না দিয়ে গায়,’ধরো বন্ধু আমার কেহো নাই…ধরো বন্ধু আমার কেহো নাই..’

গাড়ি থামে এক নির্জন এলাকায়। প্রিয়তা ওড়না খামচে বসে থাকে। জাইনের সাথে এসে নিজের পায়ে নিজে কু ড়া ল মেরেছে সে। জাইন চালকের আসন থেকে নেমে এসে দরজা খুলে।

‘আসো।’

প্রিয়তা মুখ ফিরিয়ে বলে,’না যাবো না।’

‘দেখে মনে হয় এখানে কাজী অফিস আছে? তাছাড়া এভাবে বিয়ে করে মজা নেই। বিয়ে করবো সবাইকে নিয়ে। নাচ গান হৈ-হুল্লোড় করে।’

প্রিয়তা তবুও বসে থাকে।

‘পরে কিন্তু বলতে পারবা না আমার বাসায় যেতে দেরি হচ্ছে। তুমি দেরি করছো পরে যেতেও দেরি হবে।’

কথাগুলো বলে জাইন হাঁটা দেয়। প্রিয়তা কি করবে বুঝে উঠতে পারে না। গাড়ি থেকে নেমে দেখে জাইন হেঁটে চলেছে ফিরেও তাকাচ্ছে না। উপায়ন্তর না পেয়ে সে-ও জাইনের পিছন পিছন হাঁটা দেয়। সামনে থেকে জাইন গলা উঁচিয়ে বলে,’মেয়ে মানুষ সহজ কথা বোঝে না। তাদের ত্যাড়া কথা পছন্দ।’

পাঁচ মিনিট হাঁটার পর প্রিয়তা খেয়াল করে তারা নদীর পাড়ে এসেছে। জাইন নেমে ঘাসের উপরে শুয়ে পড়ে। প্রিয়তা এসে নদীর কিনারায় পানিতে পা চুবিয়ে বসে। দমকা হাওয়া গায়ে লাগতেই তার রাগ নিমিষেই হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। সে ভুলেই যায় একটু আগে রেগে ছিলো এখানে আনার জন্য। চক্ষু বন্ধ করে প্রকৃতি উপভোগ করতে চায় সে। লম্বা শেষ নিতেই ভেতরটা হালকা লাগে। কতদিন বাদে এভাবে মুক্ত শ্বাস নিচ্ছে সে। হাওয়াতে প্রিয়তার মাথার ওড়না পড়ে যায়। সেই সাথে হাত খোঁপাটাও খুলে যায়। ছোট ছোট চুলগুলো চোখেমুখে এসে পড়ে।

‘আমি যদি এখন তোমার কানের পাশে ছোট্ট চুলগুলো গুঁজে দেই তুমি কি রাগ করবে?’

জাইনের প্রশ্ন শুনে প্রিয়তা চট করে চক্ষু মেলে তাকায়। জাইন তারই বিপরীতে বসে আছে।

‘উহু নড়ে না এভাবেই থাকো। ভালো লাগছে অনেক।’

প্রিয়তা জাইনের চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,’আপনার আমাকে পছন্দ?’

‘অনেক।’

‘এতো পছন্দ কেনো?’

‘তোমাকে পছন্দ করতে কারণ লাগবে?’

‘অবশ্যই।’

‘কারণ তুমিই।’

উত্তর পেয়ে প্রিয়তা আবারো চোখ ছোট করে তাকায়। জাইন ফিসফিস করে বলে,’এভাবে তাকিও না বুকে টেনে নিতে ইচ্ছে করে। কাল তো এতোবার বললাম বুকে এলে না। আজ আসবা? এক মিনিটের জন্য?’

প্রিয়তা দৃষ্টি সরিয়ে ফেলে।

‘আচ্ছা তিরিশ সেকেন্ডের জন্য। তা না হলে দশ সেকেন্ড? অন্তত পাঁচ সেকেন্ডের জন্য আসা যায় না?’

জাইনের কথা শুনে প্রিয়তা হেসে ফেলে। প্রিয়তার হাসি দেখে জাইন ভ্যাবাচ্যাকা খায়।

জাইন সিরিয়াস গলায় বলে,’তুমি আমার ফিলিংস নিয়ে মজা করছো প্রিয়? আমি কিন্তু সিরিয়াসলি বলেছি।’

প্রিয়তা হাসি থামিয়ে বলে,’ঠিক আছে আমিও সিরিয়াস।’

‘না তুমি সিরিয়াস না। থাকো গেলাম আমি।’

জাইন উঠে হাঁটা দেয়। প্রিয়তা জাইনের কান্ড দেখে বুঝে উঠতে পারে না জাইন এমন ছোট বাচ্চাদের মতো কেনো করে। জাইনের আচার-আচরণ বাচ্চাদের থেকে কম না।

জাইন গলা উঁচিয়ে বলে,’আমি কিন্তু অনেক রাগ করেছি। আর এই রাগ সত্যি সত্যি। রাগ ভাঙাতে আসলেও কাজ হবে না। যদি বলো বুকে এসে মাথা রাখবা তাও এই জাইন রহমান গলবে না।’

প্রিয়তা জাইনের যাওয়ার পানে চেয়ে থাকে। এতো সুন্দর পরিবেশ ছেড়ে তার উঠতে ইচ্ছে করছে না। জাইন তার থেকে অনেকটা দূরে চলে গেছে। তবে কি সে সত্যি সত্যি রাগ করেছে? প্রিয়তা ব্যাগটাও গাড়িতে ফেলে এসেছে। জাইন আবার ফিরে আসবে ভেবে সে নদীর দিকে মনোযোগ দেয়। কি মনোরম দৃশ্য সেই সাথে সুন্দর পরিবেশ। একদম প্রাণটা জুড়িয়ে গেলো। প্রিয়তা মাথা ঘুরিয়ে আবারো তাকায়। জাইনকে এখন আর দেখা যাচ্ছে না। তবে কি সে সত্যিই রাগ করে চলে গেলো?

দূর হতে সমস্ত ঘটনা লুকিয়ে কেউ নজরবন্দি করে।

………..
(চলবে..)