#প্রণয়ের_সুর
#পর্ব১৩
#মহুয়া_আমরিন_বিন্দু
বৃষ্টি, জেরিন,সাব্বির গোল করে বসে আছে নেহার চারদিকে।নেহা চুপচাপ বসে আছে খাটের মাঝে।
তারা বুঝে উঠতে পারছে না বড়রা কেনো এতো লুকোচুরি করছে।কি এমন কথা হয়েছে নিখিল আর শহিদুল চৌধুরীর মাঝে যেটা শাহআলম চৌধুরী ও জানে না।সাব্বির গালে হাত দিয়ে ভাবুক সুরে বললো
,,এবার কি করা যেতে পারে?ভাইয়া কে কি সব বলে দিলো আমরা?আমরা তো শুধু মজা করতে চেয়েছিলাম,ভাইয়ার ক্ষ”তি তো করার কোনো মনোভাব ছিলো না আমাদের!সত্যি বলে দিলে হয়তো ভাইয়া চাকরিটা অন্তত ছাড়বে না।
জেরিন সাব্বির কে শাসিয়ে বললো–,,মাথা মোটা।এখন যদি এসব কথা বলে দেই তো আব্বু ছোট হয়ে যাবে না সবার সামনে।কি ভাববে বল তো উনি তো আমাদের কথায় রাজি হয়েছিলো।
বৃষ্টি নাক ফুলিয়ে আছে গতকাল রাতে মিহির তাকে আচ্ছা মতো বকেছে।এখন ওই ছেলের নামও নিতে চায় না।কিন্তু কি করার মিহিরই ওদের কে এখন সাহায্য করতে পারে।
বৃষ্টি হতাশ কন্ঠে বললো–,,মিহিরের থেকে সাহায্য নিতে পারি আমরা।সাব্বির ভাইয়া তুমি কল দিয়ে বলো আসতে বিকালে!
জেরিন বললো–,,তুই কল দিলে আগে আসবে!
বৃষ্টি মন খারাপ করে বললো–,,আসবে না।রাগ করেছে কাল রাতে তো ঝ’গড়া করেছি!
সাব্বির কপাল চাপড়ালো তীব্র বিদ্রুপের সহিত বললো–,,তোদের এই ঘুরাঘুরির চক্করে আর কতো কি যে হবে,,!
জেরিন চেঁচিয়ে উঠলো।সাব্বির কান চেপে ধরে বললো কিরে জেরিন বইন ব্যাঙের মতো লাফানি দিলি কেন!
জেরিন রাগ করলো না মোটেও উল্টো আগ্রহ নিয়ে বললো–,,,আমরা কোথাও থেকে ঘুরে আসতে পারি সবাই মিলে!এতে ভাইয়া নেহা নিজেদের মতো সময় ও পেয়ে যাবে অনেকটা।আমাদের তো ভার্সিটি বন্ধ দিবে পরের সপ্তাহে, রৌফ টাকে ও নিতে পারবো!
বৃষ্টি মিন মিন করে বললো–,,আইডিয়া ভালো কিন্তু বাড়ির সবাই কে কে রাজি করাতে যাবে।বড়দের ছাড়া একা আমরা যাবো এক্ষেত্রে আমাদের কেউ সাহায্য করবে না।
দরজার বাহির থেকে সেতারা বেগমের কন্ঠ শোনা গেলো–,,আমি সাহায্য করবো।আমার কথা অমান্য করার সাহস আছে নাকি কারোর!
পর পর চমকে উঠলো ওরা চার জন,ওদের দাদী ওদের সাথে কথা বলতে এসেছে তাও এসব বিষয়ে!
সেতারা বেগম খাটে বসতে বসতে বললেন–,,বল তোদের কি সমস্যা, বুড়ি কোনো সমাধান দিতে পারি কিনা দেখি।
সাব্বির একে একে সব কিছু বললো সেতারা বেগম কে নেহা ভোঁতা মুখে বসে রইলো।সেতারা নেহাকে আলতো হাতে জড়িয়ে ধরে বলে
,,আহা বইন রাগ করস কেন,ব্যাটা মানুষ হইতাছে বজ্জা’ত জাতের এদের বিয়া করার পর ভাব বাইড়া যায়
আর নিখিল দাদু ভাইরে তো চিনস ওই একটু চাপা স্বভাবের। তোরে মেলা ভালোবাসে শুধু মুখে কইবার পারে না।শোন বইন ভালোবাসা প্রকাশ করার থেকে কাজে বুঝাইয়া দেওয়াটা বেশি জরুরি।সারাদিন ভালোবাসার কথা কইয়া মুখে ফেনা তুইল্যা ফেলা ব্যাটা মানুষ ও দুইদিন পর অন্য বেটির দিক নজর দেয়!যারা সব সময় বউয়ের খেয়াল রাখে,আদর যত্ন করে তাদের ভালোবাসা প্রকাশ করা লাগে না।তগো দাদাজান কোনো দিন মুখে কইছে কিনা সন্দেহ, তয় আদর যত্নে কোনো দিন কমতি রাখে নাই।আমাগো নিখিল হইতাছে তোর দাদাজানের মতো মুখে বলতে পারে না উপরেই কঠিন মন টা একবারে খাঁটি সোনার মতো!
তারা সবাই মনোযোগ দিয়া সেতারা বেগমের কথা শুনলো।নেহা নিজেও জানে নিখিল তাকে কতোটা ভালোবাসে।নেহার নিজেরও ভুল আছে সে মুদ্রার একপিঠ দেখে যাচাই করেছে নিখিলের ভালোবাসার গভীরতা কোনো দিন দেখার চেষ্টাই করেনি।নিজেও তো ভালোবাসা টা প্রকাশ করার চেষ্টা করেনি।নিখিল না হয় অনুভূতি প্রকাশ করতে পারেনি নেহা তো পারতো নিজের ভালোবাসা দিয়ে নিখিল কে জয় করে নিতে সে তো ওটাও করেনি।নেহা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে যত যায় হোক নিখিল কে আর কষ্ট দিবে না নিজেকেও না, দরকার পড়লে নিজ থেকে নিখিলকে বলবে সে নিখিল কে ভালোবাসে তাকে ছেড়ে কোনো দিন যাবে না!সব সময় সকল পরিস্থিতিতে হাত ধরে রাখবে।
——
রাত প্রায় এগারোটার কাটা ছুঁই ছুঁই নিখিল আজ এখনো বাড়ি ফিরেনি।নেহা এখনো দরজার দিকে তাকিয়ে নিখিল বাড়িতে আসলে তার ঘর পেরিয়েই তো নিজের ঘরে যাবে তখন সে দেখতে পাবে। নেহার মন খারাপের পাল্লা ভারী হয়,মানুষ টা সত্যি অনেক কষ্ট পেয়েছে।
নেহা ঘরময় পায়চারি করে,বিছানায় বসে, বারান্দায় ঘুরে আসে তবু আজ যেনো সময়টা পেরোতেই চায় না।বিষন্ন সময় গুলো খুব দীর্ঘ হয় অনেক বেশি প্রতিক্ষায় রাখে।অপেক্ষার মতো সুন্দর মিষ্টি আদুরে কষ্ট হয়তো আর কিছু নেই।
অপেক্ষা আমাদের কে কতো কিছু শেখায়,কতো বিরক্তির রেশ ছড়ায় আমাদের মাঝে তবুও দিন শেষে যখন প্রত্যাশাময় জিনিস টি আমরা চোখের সামনে দেখতে পাই তখন যে তৃপ্তি পাওয়া যায় তার মতো শান্তি অন্য কিছুতে পাওয়া যায় না।নেহা দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায় গ্রিল ধরে।বাড়ির গেইট পেরিয়ে হেডলাইটের আলোটা চোখে পড়তেই চমকালো নেহা,তাদের বাড়িতে বাইকে করে কে আসলো রাতের বেলা!
নেহা চোখ সরায়নি একবারের জন্য ও গ্যরেজ থেকে নিখিল কে বের হয়ে আসতে দেখে নেহা চমকায়, নিখিল ভাইয়ের তো বাইক ছিলো না উনি কি বাইক কিনে এনেছে?কিন্তু কেনো তার এটার কি দরকার পড়লো হঠাৎ!
নিখিল বাড়িতে এসে রুমে গিয়েছে নেহা স্পষ্ট দেখেছে,একবার ইচ্ছে জেগেছিলো এখনই গিয়ে জিজ্ঞেস করতে, কি মনে করে যেনো গেলো না।চুপচাপ বসে রইলো নেহা, কিন্তু তার মন স্থির থাকলো না, নেহা কে ঠেলেঠুলে এনে দাঁড় করিয়েছে নিখিলের রুমের বাহিরে। নেহা দুইবারের মতো উঁকি দিয়েছে রুমের ভিতরে নিখিল কে দেখতে পায়নি।
হঠাৎ গম্ভীর কন্ঠস্বরে নেহা ভয় পেয়ে যায়
,,এই দরজার বাহিরে এভাবে চোরের মতো উঁকি ঝুঁকি মারছিস কেনো?ভিরতে আসতে পারিস না!
নেহা ধরা পড়ে গিয়ে ঢোক গিললো,আমতা আমতা করে বললো–,,ঘুম আসছিলো না তো কেউ জেগে নেই তাই আপনাকে দেখতে এসেছিলাম!
নিখিল ভ্রু বাঁকিয়ে তাকালো,ঠোঁটে তার সুক্ষ্ম হাসি।সদ্য গোসল সেরে এসেছে নিখিল চুল গুলোকে ঝেড়ে পানি ফেললো নেহার দিকে তাকিয়ে থেকেই বললো
,,দেখতে হলে তো রুমে আসতে হবে তোকে, উঁকি ঝুঁকি মেরে দেখতে পারবি নাকি?আয় খাটের উপর বস পরে মন দিয়ে দেখ!
নেহা চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই নিখিল আবার বললো–,,ভিতরে আয়!
নেহার কাছে কথাটা আদেশের মতোই শুনালো, এমনিতেই নেহার মন খারাপ,সে নিজেও চাইছে এখন নিখিলের কাছে থাকতে কিন্তু বলতে পারছে না থাকার কথা!
নেহা রুমে ঢুকে গেলো ফটাফট।নেহা এক হাতের সাথে অন্য হাত নিয়ে নাড়াচাড়া করছে,দৃষ্টি এলোমেলো, যুতসই কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছে না বলার মতো।
নিখিল এক ধ্যানে নেহাকে দেখছে,সে জানে নেহা তার জন্যই অপেক্ষা করছিলো,কিন্তু কেনো মেয়েটা তাকে ছেড়েও যেতে চায় আবার তাকে দেখার জন্য এতোটা অস্থির উতলা হয়ে উঠে কেনো?তবে কি নেহা তার অনুভূতি চিনতে ভুল করছে?নিখিলের মনের মাঝে কোথাও একটা খটকা আছে নেহা সব সময় বলে সে কাউকে ভালোবাসে সেই মানুষ টা কে?যদি সত্যি কেউ থেকে থাকে তবে নিখিল কি পারবে নিজেকে ঠিক রাখতে?পারবে প্রেয়সীর সুখে তাকে অন্যের কাছে সপে দিতে!নিখিল চোখ বন্ধ করে শ্বাস নেয় বুকের বা পাশটায় ভীষণ রকম যন্ত্র’ণা হচ্ছে শুধু কথা টা নিজ মনে ভেবে।
নিখিল কে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে চোখ বন্ধ করে রাখতে দেখে নেহা ডাকে–,,আপনি রাতে খাবেন না নিখিল ভাই!
,,না!
নেহা মুখ ফুলিয়ে রুম থেকে বের হয়ে চলে যায়,নিখিল পেছন থেকে ডাকে কিরে চলে যাচ্ছিস কেনো আমি আবার কি করলাম?তোকে যেতে বলেছি আমি?
নেহা চলে গিয়ে আবার ফিরে আসে খাবারের প্লেট সহ।
নিখিল নেহা কে খাবার সহ আসতে দেখে বলে উঠে
,,তোকে আমি খাওয়ার কথা একবার ও বলেছি?
নেহার স্বাভাবিক জবাব
,,আমি কি আপনার থেকে একবার ও জানতে চেয়েছি আনবো নাকি আনবো না?
,,প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন করবি না নেহা!
নেহা নিখিল কে কপি করে বললো–,,প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন করবি না নেহা!
নেহা নিখিল কে টেনে এনে বিছানায় বসায়,খাবারের প্লেট নিখিলের সামনে ধরে বলে –,,নিন এবার খেয়ে ফেলুন।
,,খাবো না আমি!
নেহা বিরক্তি নিয়ে তাকালো কিছুটা রাগ নিয়ে বললো
,,প্লেট টা ধরুন বলছি।
,,তুই আমাকে রাগ দেখাচ্ছিস নেহা?
,,পাশের বাসার ভাইয়া কে দেখালে বেশি খুশি হবেন বুঝি?
,,মে’রে রেখে দিবো তোকে অন্য ছেলের নাম মুখেও আনলে!
,,তাহলে রাগ নিজে সহ্য করতে শিখুন।খেয়ে নিন!
,,খাইয়ে দে!
নিখিলের সহজসরল আবদার।
,,পারবো না, আমি কেনো খাওয়াতে যাবো আপনাকে,আমাকে দিয়ে কামলা খাটানোর সখ জেগেছে কেনো আপনার?
,,বউকে দিয়ে কাজ করালে সোয়াব হয় তাই।তুই ভেবে দেখ তুই খাইয়ে দিলে খাবো আমি না হয় না!
নেহা বিরবির করে বললো –,,অসহ্য লোক একটা।
নেহা হাত ধুয়ে এসে নিখিলের হাত থেকে প্লেট নিয়ে তার মুখে খাবার তুলে দিলো।
নিখিল খেয়ে নিলো চুপচাপ। মাঝপথে নেহার হাত থামিয়ে দিলো নিখিল কন্ঠে কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলো–,,তুই নাকি রাতে খেতে যাসনি?সাব্বির বললো আমায়।
নেহা প্লেটের দিকে মন দিয়েই বললো
,,কখন বলেছে?
,,এইতো আসার পরে।
,,মিথ্যা বলার আর জায়গা পান না আপনি, আসার পর আপনি আপনার বাইক রেখে এসেছেন পরে সিঁড়ি বেয়ে উঠে সোজা নিজের ঘরে সাব্বির ভাইয়ার সাথে তো দেখাই হয়নি আপনার!
,,তুই কিভাবে জানলি আমি এগুলো করেছি?
,,আমি আপনাকে দেখছিলাম তাই জেনেছি।আর আমাকে কি সহজ সরল স্বামী ভক্ত বউ মনে হয় নাকি স্বামী বাড়ি না আসা পর্যন্ত তার জন্য না খেয়ে বসে থাকবো?এতো মহান আমি না!
নিখিল হাসলো হাসি বজায় রেখেই বললো–,,আমার সামনে এখন তোকে একটু হলেও খেতে হবে।
নেহা নিখিলের দিকে তাকিয়ে বললো–,,আপনি তো জানেন নিখিল ভাই আমি ছোট্ট একটা মানুষ আমার পেটটাও তো ছোট এতো খেতে পারি না আমি।পেটটা যখন বড় হবে তখন থেকে বেশি খাবো এখন খেতে পারবো না বিশ্বাস করেন একটুও জায়গা নেই পেটে!
,,আমাকে দেখা তোর পেট কতো ছোট!
নেহা মৃদু চেঁচিয়ে বললো–,,নিখিল ভাই আপনার মুখে লাগান টানুন বলছি।না হয় আমি কস্টেপ আঁটকে দিবো বলে রাখছি।আপনার মুখ থেকে এখন যা তা কথা বের হয়!
নিখিলের খাওয়া শেষ হতেই নেহা বের হয়ে যেতে নেয় নিখিল আটকে দিয়ে বলে
,,মন খারাপ কেনো তোর?
নেহা নিখিলের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে –,,আপনাকে একটু জড়িয়ে ধরি নিখিল ভাই!
নিখিল চমকে উঠলো নেহার কি কারনে মন খারাপ হলো?নিজ থেকে জড়িয়ে ধরতে চাইছে মেয়েটা।
নিখিলের জবাবের আশায় থাকলো না নেহা শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো নিখিল কে।
নেহার মনের ভিতরে কি যে চলছিলো সকাল থেকে, শুধু ছটফট করছিলো কখন নিখিল কে একটু দেখবে।পৃথিবীর সব সুখ তার কাছে থাকলেও সে অসুখী থাকবে যদি নিখিল তার কাছে না থাকে।
নিখিল নেহার মাথায় হাত রাখে মৃদু স্বরে ডাক–,,কি হয়েছে বলবি তো নাকি।আমাকে বলবি না তুই?
নেহা কিছুক্ষণ চুপ থাকলো নিখিলের বুকে মুখ গুঁজে রেখেই বললো–,,জানি না,শুধু অনেক কষ্ট লাগছে!
নিখল দু হাতে নেহাকে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে–,,আমাকে জড়িয়ে ধরে থাকলে বুঝি কষ্ট কমে যাবে?
,,হুম!
নিখিলের চোখ জোড়া খুশিতে জ্বলজ্বল করে উঠলো,মানুষের কাছে সবচেয়ে প্রশান্তির বিষয় হচ্ছে প্রিয় মানুষটার বিশ্বাস অর্জন করতে পারা।নেহা তাকে বিশ্বাস করে নির্দ্বিধায় তার কাছে এসে তাকে জড়িয়ে ধরেছে।নিখিল নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যমান মানুষ বলে মনে করছে এখন!
নিখিলের হাস্যউজ্জ্বল কন্ঠ–,, আজকে কি কি হলো শুনবি নেহা?তোর তো জানা উচিত, বউদের কে সব জানতে হয়!তারা হচ্ছে স্বামীদের ভরসা,শান্তি, ক্ষমতার উৎস।শুনবি তো নেহা?
নেহা মাথা উঁচিয়ে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে।
নিখিল নেহাকে এক হাতে জড়িয়ে বারান্দায় নিয়ে আসে,নিখিলের বারান্দায় এক পাশে ছোট করে বিছানার মতো পাতা,নিখিল প্রায় সময়ই এখানে সময় কাটাতো আগে,তার মতে এটা তার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা।
নিখিল নেহাকে সেখানে বসার জন্য বললো।নেহা গিয়ে দেয়ালের সাথে মাথা এলিয়ে দিলো।নিখিল পাশে বসে পড়লো,নেহার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো
,,ঘুম পাচ্ছে তোর?
,,না।
নিখিল হাসলো,কারন সে জানে নেহা মিথ্যা বলছে,রাত বারোটা মানে এই মেয়ের কাছে ঘুমের রাজ্য সব ভাই বোনরা রাত জেগে আড্ডা দিলেও সেখানে ঘুমিয়ে পড়ে নেহা।আজ কিনা মিথ্যা বলছে।নিখিল বুঝেও কিছু বললো না কখনো কখনো অভ্যাস কিছুটা পরিবর্তন করা উচিত।ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে যদি ভালো কিছু হয় তো তাতে বাঁধা দিতে নেই।
নিখিল নিজ থেকে নেহাকে টেনে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে ধরলো
,,আজকে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলাম।
নেহা উঠে নিখিলের দিকে তাকাতে চাইলো নিখিল জড়িয়ে ধরে রেখেই বললো উঠছিস কেনো? শুয়ে থাক।
,,আগের টা ছাড়লেন কেনো নিখিল ভাই,আমার উপর রাগ করে ছেড়ে দিয়েছেন?
নিখিল বুঝলো নেহার মন খারাপের কারন।
,,তোর জন্য কেনো হবে বোকা।কিছুসময় নিজের আত্নসম্মান বাঁচিয়ে রাখতেও কিছু জায়গা থেকে সরে যেতে হয়।
এখন শোন গুরুত্বপূর্ণ কথা।চাকরিটা করা যাবে দুই জায়গা থেকে, যদি এখানে থেকে করি তো স্যালারি দিবে চল্লিশ হাজার টাকা।যদি পোস্টিং নিয়ে অন্য শহরে ওদের আরেক ব্রান্চে করি তো স্যালারি দিবে আশি হাজার টাকা।ভাবছি পোস্টিং নিয়ে চলে যাবো তাই বাইক টা কিনে এনেছি!
নেহা ভয়ানক কিছু শোনার মতো করে চমকে উঠলো। নিখিলের টিশার্ট দু হাতে চেপে ধরে বলে
,,আপনি যাবেন না প্লিজ নিখিল ভাই!
,,কেনো তুই তো ছেড়ে চলে যেতে চাস আমাকে,তুই যাওয়া যে কথা আমি যাওয়া একই,একজন না একজন দূরে থাকলেই হয়।
,,যাবেন না মানে যাবেন না।আমি যেতে চেয়েছি দেখে আপনাকে ও যেতে হবে নাকি?
,,কেনো যাবো না আমি তোর কথা শুনতে হবে এখন আমার?
,,হ্যাঁ শুনতে হবে।কোথায় যেতে পারবেন না আপনি আমাকে ছেড়ে!
,,কেনো?
,,জানি না।
,,বউ পালতে হলে বেশি টাকা লাগে তুই জানিস না?
,,আমি আপনার কাছে কোনো দিন টাকা চেয়েছি বলুন?আমি তো বেশি খাই ও না নিখিল ভাই,এতো টাকা দিয়ে কি করবেন আপনি।বেশি টাকা লাগবে না,আপনি বাড়িতেই থাকবেন কোথাও যাবেন না।আমি আপনাকে ছাড়া থাকতে পারবো না।
,,টাকা লাগবে না তোর?তো কি লাগবে বল?
,,আপনি তো দিবেন না তাহলে জিজ্ঞেস করছেন কেনো?
,,তুই চাইলে নিজের জীবনও দিয়ে দিতে পারি আমি বল কি লাগবে তোর?
নেহার ঘুমে নিভু নিভু চোখ,ঘুম জড়ানো কন্ঠে নেহা অস্পষ্ট স্বরে বললো
,,আপনাকে!
নিখিল ঘুমন্ত নেহার দিক তাকিয়ে শান্তির নিশ্বাস ফেললো।মেয়েটা এখনো পৃথিবীর কঠিন নিয়ম গুলো নিজ চোখে দেখিনি,ছোট বেলায় কখনো অভাব বুঝতে হয়নি। বাড়ির কেউ অভাব কি জিনিস বুঝতে পারেনি নিখিল নিজেও জানতো না তবে তাকে বাস্তবতা শিখিয়েছেন শাহআলম চৌধুরী। সে দেখেছে তাদের বাবা চাচারা কতো কষ্ট করে ব্যবসা করেছে সব কিছু টিকিয়ে রেখেছে নিজেরা শত কষ্ট মাথা পেতে নিয়ে পরিবারকে সুখ সাচ্ছন্দ্যে ভরিয়ে রেখেছে।নিখিল জোছনা বিহীন রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে
নিজেকে প্রশ্ন করলো–,,তুই আদো নেহাকে আগের মতো সুখে রাখতে পারবি তো নিখিল?ওকে কোনো দুঃখ এসে ছুঁয়ে দিবে না তো আবার?মেয়েটা যদি সন্তুষ্ট না থাকে তোর প্রতি তুই কি কখনো ওর যোগ্য স্বামী হতে পারবি?
নেহা নিখিল কে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে অতি শান্তিতে।নিখিল এতো চিন্তার মাঝেও কোথাও একটা সুখ অনুভব করছে।এই মেয়েটা ওর পাশে থাকলে সব দুঃখ ভুলে যায় সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায় নিমিষেই। নিখিল নেহার কপালে চুমু দিলো গভীর ভাবে নেহাকে নিজের কোলের উপর শোয়ালো নিখিল, মেয়েটা ঘুমের মাঝেই ওর কোমড় জড়িয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হলো।
——
আর কতো ঘুমাবি নেহা?উঠ আমি কিন্তু এখন চলে যাবো পরে কিন্তু আর দেখতে পাবি না!
নেহা ঘুম থেকে ধরফরিয়ে উঠলো,নিখিল শার্টের বোতাম লাগাতে ব্যস্ত।নেহা নিখিলের শার্টের এক কোনা চেপে ধরে বললো–,,আপনি সত্যি সত্যি চলে যাবেন?আপনি তো বলেছেন যাবেন না!
নেহার চুপসে যাওয়া মুখ দেখে নিখিলের এবার হাসি পেলো কিন্তু হাসলে নেহা নিশ্চিত ওর মাথা ফাটিয়ে দিবে এই মুহুর্তে!
,,অফিস যাচ্ছি! তুই তো দেখছি প্রথম দিনই আমাকে দেরি করাবি নেহা।
মিহির হন্তদন্ত হয়ে দরজা ঠেলে আসতে আসতে বললো
,,কিরে শা’লা নিখিল তুই এমন একটা কাজ করতে পারলি ভাই,আমাকে রেখে তুই দ্বিতীয় ব্রান্চে চলে যাচ্ছিস একবার জানাবি না আমাকে?
নেহা চোখ বড় বড় করে তাকালো নিখিলের দিকে।
নেহা অবিশ্বাস্য কন্ঠে বললো–,, নিখিল ভাই আপনি আমাকে মিথ্যা কথা বলেছেন?আপনি ঠিকই না জানিয়ে চলে যাচ্ছেন।তো যান আমি আর আপনার সাথে কোনো কথা বলবো না।
নেহা দ্রুত পা চালিয়ে চলে গেলো,নিখিল পিছু ডেকে বললো–,,কথা তো শুনে যা নেহা।
মিহির বেচারা কিছু বুঝে উঠলো না।নিখিল মিহিরের দিকে বিরক্ত নিয়ে তাকালো
,,তুই দেখে শুনে কথা বলবি না।ওফ!এখন তো এই মেয়ে ছয় সাত আর কাছেও ঘেঁষবে না,নিজ থেকে এসেছিলো কালকে,এভাবে তুই আমার সংসারে আগু’ন লাগিয়ে দিলি মিহির!
,,আমি কি করলাম আমি কি জানতাম নাকি,তোর রুমে নেহা আছে।
,,নেহা কোথায় থাকবে তো?তোর বউ কে কি তুই আলাদা রুমে রেখে ঘুমাবি?
,,এসব কথা বাদ দে তুই তোর হিট’লার শ্বশুরের সাথে আমাকে রেখে তুই অন্য অফিসে গিয়েছিস কেনো?শ্বশুর জামাই যু’দ্ধ করে আমার মতো অবলা মানুষ টাকে কেনো ফাঁসি’য়ে দিলি ভাই,আমার শ্বশুরের সাথে দিলেও মানতাম সহজ সরল ছিলো!
,,চুপ থাক তো প্রয়োজনেই গিয়েছি তুই দেখ বলে কয়ে আসতে পারিস কিনা,এই অফিস বাড়ি থেকে দূরে বেশি তাই বাইক কিনেছি রাতে!
,,বাহ্!ভালো তো যা, যা খুশি কর।এদিকে তোর বোন আমাকে জ্বালি’য়ে মার’ছে রাতের বেলা ঘুরতে গেলো, নিজে আসলো, ভালো করে শুধু বলেছি একটু, উল্টো ঝাড়ি আমাকে দিলো রাগ দেখালো আমার উপর।ব্লক ও করেছে আমাকে।তোর মতো ভাই আছে দেখেই আমার বউটা এতো নির্দ’য় হয়েছে!
নিখিল ঘড়ি পড়ে রুম থেকে বের হয়ে বললো–,,বসে থাক তুই আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।
নিখিল নেহার রুমে ঢুকে দেখলো বৃষ্টি বসে আছে,নিখিল বৃষ্টি কে বললো –,,রুম থেকে বের হ একটু।
বৃষ্টি রুম থেকে বের হতেই মিহির ওর হাত টেনে সাথে করে নিয়ে গেলো
,,এটা কোনো কাজ করলে তুমি বৃষ্টি। দুইদিন হয়েছে বুঝতে পারছো তুমি?বলে দিলেই পারো তোমাকে আর আমার এখন ভালো লাগে না মিহির তোমার থেকে দূরে যেতে চাই!তোমাকে ছাড়া ভালো থাকবো আমি!
বৃষ্টি মিহিরের দিকে কটমট দৃষ্টি রাখলো।বিরক্তি নিয়ে বললো —,, তুমি কি চুপ করবে মিহির।
মিহির হাঁটা বাড়ালো সামনের দিকে–,, তুমি যেহেতু চাও না আমি আর আসবো না ফোন করে বিরক্ত ও করবো না।ভালো থেকো!
বৃষ্টি মিহিরের হাত টেনে ধরে বললো–,,তোমাকে ছাড়া আমি ভালো থাকবো কি করে?জেনে বুঝে এমন করো আমার সাথে!
মিহির পেছন না ফিরেই বললো
,,তোমার কিছুু হয়ে গেলে আমার কি হবে ভেবেছো একবার,শুধু বাচ্চাদের মতো জে’দ করো সব সময়।রাতে গিয়েছো শুধু ভালো করে বুঝাতে চেয়েছিলাম।তুমি কি করেছো উল্টো রেগে গেছো।তোমাকে কিছু বলার তো অধিকার নেই আমার, তাই চলে যাচ্ছি!
বৃষ্টির কান্না পেয়ে গেলো এবার।মিহিরের হাত শক্ত করে চেপে ধরে বললো–,,স্যরি আর এমন ভুল হবে না।কথা শুনে চলবো এবার থেকে!
,,শুনতে হবে না তোমাকে!
,,রাগ দেখাবা না একদম কামড় দিয়ে দিবো তোমাকে।
মিহির হাসি চেপে রেখেছে নিজের।কঠিন কন্ঠে বললো
,,আমি এখান থেকে যাওয়ার আগেই যেনো আনব্লক করা হয় আমাকে।না হয় এরকম বাচ্চার সাথে আর প্রেম করবো না আমি!
,,তো কার সাথে করবা?তোমার জীবনে আর কাউকে পারলে এনে দেখাও মে’রে চেপ্টা করে দিবো একসাথে দুটোকে।
বৃষ্টি মিহিরের হাত ছেড়ে চলে যেতে নিলো,মিহির পেছন থেকে বলে উঠলো–,,ভালোবাসি মেঘবালিকা!
বৃষ্টি মুখ ভেংচি কেটে চলে গেলো।
—–
,,এভাবে নাক ফুলিয়ে রেখেছিস কেনো?আচ্ছা আসার সময় তোর জন্য কি আনবো বল?
,,কিছু না!
নিখিলের কন্ঠে দুষ্টুমি–,,ঘুমের ঘোরেও তো আমাকে চাস তুই!আমি যদি আমাকে দেই তুই নিজেকে দিতে পারবি তো?কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হয় বুঝতে পেরেছিস কি বলেছি আমি।
নেহা তাকাতেই নিখিল চোখ টিপ মারলো,নেহা ভেবাচেকা খেয়ে গেলো,এই ছেলে দিন দিন কি নির্লজ্জ হচ্ছে ভাবা যায় এসব!
নেহা একটা বালিশ ছুঁড়ে মারলো নিখিলের উপর,রেগে বলে উঠলো –,,আমার সামনে থেকে যান বলছি অসভ্য লোক!
নিখিল চুলে হাত বুলিয়ে বললো–,,বউয়ের কাছে নির্লজ্জ,বেহায়া,বেশরম,অসভ্য হতে হয়, না হলে বউ থাকে না,বউ তখন মনে করবে আমি একটা টিউবলাইট কিছু মিছু পারি না, বুঝেছ জান!
নেহা চিল্লিয়ে বললো–,,বের হন বলছি!
নিখিল নেহার দিকে ফ্লাইং কিস ছুঁড়ে রুম থেকে বের হলো।
——-
সাব্বির, জেরিন হুড়মুড়িয়ে রুমে ঢুকলো নেহা চোখ ছোট করে দেখলে দুজনকে, কিছু সময় পর বৃষ্টি হাতে নুডুলসের প্লেট নিয়ে ঢুকলো।
বিছানার মাঝে রেখে দিলো বড় প্লেট টা চারটা চামচ সাজিয়ে সবাইকে খেতে বললো।
জেরিন সুর তুলে বললো–,,বাবা কতো কি দেখছি মানুষ জন রাতের বেলা স্বামী সেবা করছে,মুখে তুলে খাওয়াচ্ছে!
নেহা চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে বললো–,,জেরিন আপু তুমিও না!তোমার ভাইকে কে ভালোমানুষি দেখানোই আমার ভুল হয়েছে,ব্যটা আস্ত খাটাশ।মুখ না অন্য কিছু যা তা বলে!
সাব্বির মুখে নুডুলস ঠেসে বললো,,, কি কি বলে নেহা বইন?
বৃষ্টি নেহাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে–,,রাগ করিস না বইন তোরে আমি লজেন্স দিমু নে!
নেহা বৃষ্টির পিঠে দিয়েছে একটা জোরে।বৃষ্টি জিজ্ঞেস করলো–,,তোমরা দুজন আজ ভার্সিটি যাবে না?
সাব্বির বললো–,,কি আর বলি বল তো বৃষ্টি শা’লার সব প্রফেসর মিলে গেছে চিল করতে ওদেরই দিন বইন,বুইড়া বয়সে এদের রঙ লাগছে,আর এদিকে আমি সিঙ্গেল!
চার ভাই বোন মিলে হাসি আড্ডাতে মেতে উঠলো।এভাবেও সব বিষন্নতা এক পাশে রেখে মানুষ হাসে,দুঃখ ভুলে সব কিছুর মাঝেও জীবনে সুখে থাকার চেষ্টা করে।হাসি কান্না মিলেই জীবন!
সময় যেনো স্রোতের বেগে চলে,দেখতে দেখতে কেটে যায় সময় দিন, সপ্তাহ কিংবা মাস!
ছুটি পেয়েছে সাব্বির, জেরিন,রৌফ ও ছুটি পেয়েছে।
সবাই মিলে কথা তুললো তারা ঘুরতে যাবে।বাড়ির সবাই বিপক্ষে যথারীতি। সবাই মন খারাপ বসে আছে সোফায়। সেতারা এসে বসলেন সবার সাথে,নেহা কে ওরা বলেছে তুই ভান ধরে বলবি তুই যেতে চাস না।
নেহা মুখ ভেংচি কাটলো পরে যদি ওকে রেখেই চলে যায় তখন!
সাব্বির বুঝিয়েছে, নেহা রাজি হলেও মনে মনে ভয় পাচ্ছে।
নিখিল,মিহির এসেছে সন্ধ্যায়,সবাই মিলে আবার কথা তুললো কিন্তু বড়রা নারাজ যেতে দিবে না।সবাই নিখিলের দিকে তাকিয়ে আছে নিখিল একবার বললেই সবাই রাজি হবে।সবাই ঘিরে ধরেছে নিখিল কে, নিখিল কি বলে সে আশায়!
চলবে?