প্রতাপ গড়ের অভিশাপ পর্ব-০৭

0
4

#প্রতাপ_গড়ের_অভিশাপ
#লেখায়_জান্নাতুন_নাঈম
#পর্ব_৭

আরাফ বলল, “আমাদের জমিদার অনেক ভালো। আমাদের এলাকায় মানুষ অনেক সুখেই ছিল। শুধু মহামারীর জন্য। হঠাৎ করেই কোথা থেকে এক মহামারী চলে এসেছে। অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে।তাই আমাদের জমিদার এর ঔষধ খুঁজতে বেরিয়েছে। সাথে এসেছেন জমিদারের স্ত্রী।”

আলী বলল, “জমিদার অনেক দয়ালু।তা না হলে কি এভাবে মানুষের কথা ভেবে এতদূর আসে। আমাদের জমিদার তো শিশুর মতো আচরণ করে। সামান্য কারণে মানুষ মেরে ফেলতেও দুবার ভাবেন না”

আরাফ তার কথায় সায় দিয়ে নিজেদের কক্ষে চলে গেল।

হৈমু ও বীর প্রতাপের জন্য আলাদা কক্ষ।আরাফ ও রুদ্রকে একটি কক্ষ দেয়া হয়েছে।আরাফ বিছানায় শুয়ে পড়ে। পাশেই একটা চাদর ছিল।চাদরটা টেনে গায়ের উপর দেয়। রুদ্র ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে।আরাফ ও ঘুমিয়ে পড়বে। হঠাৎ কারো শিস বাজানোর শব্দ আসতে থাকে।একে একে শব্দ বাড়তে থাকে।যেন অসংখ্য অগণিত মানুষ শিস বাজাচ্ছে। তারপর চারদিকে নিরব হয়ে যায়।আরাফ ঘুমানোর চেষ্টা করে। ঘুমানোর আগে লক্ষ্য করে ঘরের এক কোণে ছাতা খুলে রাখা হয়েছে ও জানালার পাশে লবণ ছিটিয়ে দেয়া হয়েছে।আরাফ ঘুমিয়ে পড়েছে।

বীর প্রতাপ খাটের উপর বসে রইলো।হৈমু বলল, “ঘুম আসছে না?”

বীর প্রতাপ বলল, “হ্যা।”

হৈমু বলল, “শরীর ব্যথা করছে তাই না। এইগুলো স্বাভাবিক। আপনি জমিদার পরিবারের ছেলে।নরম বিছানায় ঘুমিয়ে অভ্যস্ত। আপনার এই শক্ত বিছানায় ঘুম আসবে না। শরীর ব্যথা করবে। তবে আমি কিন্তু এই রকম শক্ত বিছানায় ঘুমিয়ে এসেছি।”

বীর প্রতাপ বলল, “আমাদের সব পরিবেশেই মানিতে নিতে হবে হৈমু”

হৈমু বলল, “আমি এসেছি বলে একটু হলেও আপনার ভালো লাগছে।এই কথা আমি জানি। নাহলে আপনি আমার চিন্তায় ঘুম হারাম হয়ে যেত”

বীর প্রতাপ হেসে বলল, “কথাটা ভুল বলোনি।এই মহামারীতে তোমাকে রেখে আসলে খুব চিন্তা হতো। তাছাড়া এতগুলো দিনের জন্য আমি বাড়ির বাইরে থাকবো তোমার ও আমার জন্য চিন্তা হতো। এখন আমরা একসাথে আছি সেইসব চিন্তা নেই।”

হৈমু বলল, “আমাদের শহরের কথা ভেবে ভয় লাগে। এতগুলো দিন মানুষের কি যে অবস্থা হয়েছে সেটা ভেবেই তো গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো”

বীর প্রতাপ বলল, “এক মাস হলো আমরা পথে পথে ঘুরছি।আমার প্রাসাদের মানুষের জন্য খুব চিন্তা হচ্ছে।আম্মা বকুল নয়নতারা ওদের জন্য খুব চিন্তা হচ্ছে।”

হৈমু বলল , “অনেক রাত হয়েছে। এবার একটু ঘুমানোর চেষ্টা করুন”

বীর প্রতাপ হৈমুর কোলে মাথা রেখে ঘুমানোর চেষ্টা করলো।সকালে ঘুম ভাঙ্গে আলীর ডাকে।আলী নাস্তা খাওয়ার জন্য ডাকছে।আরাফ বাইরে টিউবওয়েলের হাত মুখ ধুয়ে খাবারের রুমে হাজির হয়। রুদ্র ও আগে থেকেই বসা।আরাফ রুদ্রর পাশে গিয়ে বসলো।হৈমু ও বীর প্রতাপ হাত মুখ ধুয়ে নাস্তা খাওয়ার জন্য বসে পড়লো।আলী তাদের নাস্তা বেড়ে দিতে লাগলো।

আরাফ আলীকে উদ্দেশ্য করে বলল, “রাতে শিস বাজাতে দেখলাম।মনে হলো পুরো গ্রাম শিস বাজিয়েছে”

আলী বলল,” এটা মৃত মানুষের সম্মানে করা হয়। প্রতিদিন কোথাও না কোথাও মানুষ মারা যায় তাদের উদ্দেশ্য এই শিস বাজানো।যাদের অপমৃত্যু ঘটে তাদের আত্মা শান্তি পায় না। তাদের আত্মার শান্তি কামনা করা হয় এই শিস বাজিয়ে।এটাও এই গ্রামের একটা নিয়ম।না মানলে কঠিন শাস্তি পেতে হবে।”

বীর প্রতাপ বলল, “এখানে কবরে কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা দেয়া থাকে কেন? আসার পথে কিছু কবরে এই জিনিস গুলো দেখলাম”

আলী বলল, “এইগুলা এখানে কবর দেয়ার নিয়ম। এখানে মানুষ কবর দেয়ার নিয়ম অনেক আলাদা। এখানে কবর দেয়ার নিজস্ব নিয়ম আছে। এখানে মানুষ মারা গেলে কবর গুলো কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা দেয়া হয়। প্রত্যেক জায়গার কিছু নিজস্ব নিয়ম নীতি থাকে।নিয়ম না মানলে অনেক বিপদ হতে পারে।নিয়ম মেনে কবর না দিলে রাতে লাশ কবর থেকে উঠে চলে আসে।আমাদের পাশের গ্রাম পুরো ধ্বংস হয়ে গেছে এই কারণে। কেবল নিয়ম মেনে কবর দেয়নি বলে। এখন আমরা ওটাকে মৃতদের গ্রাম বলি।প্রত্যেক জায়গায় আলাদা আলাদা নিয়ম আছে।সবার উচিত সেই সব নিয়ম মানতে হয়।”

আরাফ বলল, “ পাশের গ্রামের ঘটনা খুলে বলা যাবে ?”

আলী বলল, “অনেক বছর আগে গ্রামে কলেরা হয়। চারদিকে অনেক মানুষ মরতে শুরু করে দেয়। একদিন গ্রামে কবর খোদাই করা লোক কলেরায় মারা যায়। তখন পাশের গ্রাম থেকে দুইজন কবর খোদাই করার জন্য লোক আসে। গ্রামের বিশেষ নিয়ম তাদের বলে দেয়া হয়। কীভাবে কবর খোদাই করতে হবে কীভাবে লাশ কবর দিতে হবে সবকিছু। কিন্তু গ্রামের বিশেষ নিয়মে কবর না দিয়ে তারা নিজেদের নিয়মে কবর দেয়। তারপর রাতে সবগুলো কবর থেকে লাশ উঠে এসে গ্রামের সব জীবিত মানুষ কে মেরে ফেলে।ওই গ্রামে আর কেউ জীবিত নেই। মানুষ বলে ওখানে এখনো লাশেরা রাতের বেলা ঘুরে বেড়ায়”

রুদ্র বলল, “বিশেষ নিয়ম কি ?”

আলী বলল, “আলাদা কিছু না। লাশের মুখ খোলা যাবে না। একেবারে বন্ধ রেখে কবর দাঁতে হবে।কবরের ধরন টাও ভিন্ন।আর মাথায় খুঁটি না দিয়ে পায়ের মধ্যে খুঁটি দেয়া। সবশেষে কবর কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়া”

আরাফ বলল, “ওই গ্রাম এখন কোথায়?”

আলী বলল, “পাশেই এক চর এলাকা। কয়েক বছর আগে বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছিল।তাই গ্রামের অর্ধেক এখন পানির নিচে।”

রুদ্র বলল, “এই ঘটনা তুমি নিজের চোখে দেখেছি?”

আলী বলল, “না”

রুদ্র বলল, “তাহলে কীভাবে বুঝলে এটা সত্যি ঘটনা। মিথ্যা ও তো হতে পারে”

আলী বলল, “আমরা অধিকাংশ গল্পই বাপ দাদার থেকে শুনেছি। শুধু মাত্র চুলের পিশাচের গল্প আমার চোখে দেখা।কারন আমার বউ এই পিশাচের হাতে মারা গেছে”

রুদ্র বলল, “আর ঘরের কোণে ছাতা মেলে রাখার কারণ কি? শুনেছি ছাতা খোলা রাখা ভালো না।ঘরে অশুভ শক্তির নজর পড়ে”

আলী হেসে বলল, “এখানকার নিয়ম ভিন্ন।ঘরে ছাতা খোলা রাখতে হয়।এতে অশুভ শক্তির নজর পড়ে না”

বীর প্রতাপ বলল, “এখানে সবকিছুই দেখি উল্টো”

আলী বলল, “এই গ্রাম বেশ অদ্ভুত। আপনি যত তাড়াতাড়ি গ্রাম ছেড়ে দিবেন আপনার জন্য ততই ভালো। এখানে মানুষ বেশিদিন মেহমান থাকা পছন্দ করে না”

আরাফ বলল, “আচ্ছা এখানে জানালা পাশে অনেক লবন পড়ে থাকতে দেখলাম। জানলার মধ্যে লবণ দেয়ার কারণ কি?”

আলী বলল, “শয়তান থেকে বাঁচার জন্য। অপশক্তিরা লবণ ভয় পায়।লবণ দিলে ঘরে প্রবেশ করতে পারে না”

তারা আর কোন কথা বলল না। খাবার শেষ করে দ্রুত বেরিয়ে পড়লো। তাদের সামনে অনেক পথ যেতে হবে।বাড়ি থেকে বিদায় নেয়ার সময় বীর প্রতাপ আলীকে অনেক গুলো স্বর্ণ মুদ্রা দিল।আলী বলল, “এইগুলা আমাদের জমিদার দেখলে মেরেই ফেলবে”

বীর প্রতাপ বলল, “তুমি এইগুলো লুকিয়ে খরচ করো কিংবা তোমার মাকে নিয়ে দূরে অন্য কোথাও চলে যাও”

আলী স্বর্ণ মুদ্রা গুলো রাখলো।হৈমু পালকিতে উঠে বসলো।হৈমুর সাথে বীর প্রতাপ ও পালকিতে বসলো।রাতে শক্ত বিছানায় ঘুমিয়ে শরীর ব্যথা করছে।

আলী বলল, “যদি কিছু না মনে করেন আপনারা কোথায় যেতে চান একটু বলবেন?”

রুদ্র বলল, “সমুদ্র বন্দরে”

আলী বলল, “ঠিক আছে। আপনাদের যাত্রা শুভ হোক”

শহরে লোকজন কাজে কর্মে ছড়িয়ে পড়েছে। সেই সময়ে কিছু মানুষ বেরিয়ে পড়েছে অজানার উদ্দেশ্যে। শহরে নতুন মানুষ দেখে আশেপাশের লোকজন তাদের দিকে বেশ অদ্ভুত ভাবেই তাকিয়ে আছে।কেউ কিছু বলতে পারছে না।হয়তো এটাই তাদের নিয়ম। অপরিচিত কারো সাথে কথা বলা যায় না।হয়তো ভয়ে কিংবা কুসংস্কারের জন্য। এইরকম নজরে তাকিয়ে থাকা রুদ্র,আরাফ কারোরই ভালো লাগে না।আরাফ মনে মনে স্থির করে নেয় জলদি শহর বেরোনোর পথ পার করে ফেলতে।যে করেই হোক শহর থেকে বেরিয়ে যেতে হবে।শহর শেষ হলেই পাহাড় ও জংগলের শুরু।পাহাড়ী পথ অতিক্রম করেই সমুদ্র বন্দরে পৌছাতে হবে।

পালকি চলতে লাগল। হঠাৎ কিছু লোকজন তাদের পালকি ঘিরে ফেলল।আরাফ কিছু বলতে যাবে তার আগেই জমিদারের লোকজনের একজন বলল, “আপনারা কে? কোথা থেকে এসেছেন?আপনাদের জমিদারের সাথে দেখা করতে হবে। জমিদার আপনাদের সাথে দেখা করতে চান।”

আরাফ বলল, “অন্য এক সময় দেখা করবো। এখন আমাদের হাতে অনেক জরুরী কাজ আছে”

লোকটি বলল, “এটা জমিদারের আদেশ। জমিদারের আদেশ অমান্য করলে কঠিন শাস্তি পেতে হবে”

আরাফ আবার কিছু বলতে চাইলো কিন্তু তার আগেই বীর প্রতাপ পালকি থেকে নেমে পড়লো। জমিদারের লোকজনদের উদ্দেশ্য করে বলল, আমি হলাম প্রতাপ গড়ের জমিদার বীর প্রতাপ। তোমরা আমাকে শান্তি দিবে।এত বড় সাহস তোমাদের। তোমার তোমাদের জমিদার কে বলে দিও আমার প্রাসাদ তার পুরো রাজ্য থেকে অনেক বড়।যদি আমার সাথে ঝামেলায় জড়াতে চায় তাহলে তার অস্তিত্ব এই পৃথিবীতে থাকবে না। আমরা শুধু আমাদের গন্তব্যে যাওয়ার জন্য এই গ্রামে এসেছি।খুব তাড়াতাড়ি এই গ্রাম ছেড়ে চলে যাব।অযথাই আমার সাথে বেয়াদবি করে নিজেদের বিপদ ডেকে এনো না”

জমিদারের লোকজনের মধ্যে একজন বলল, “আমাদের ক্ষমা করুন। আমরা আপনার পথ আটকাবো না। আপনার যাত্রা শুভ হোক”

বীর প্রতাপ আর কোন কথা বাড়াল না। পালকিতে উঠে বসলো। বেশি দেরি হলে জাহাজ মিস করতে হবে।

গ্রাম শেষ।গ্রাম শেষ হয়ে পাহাড়ী এলাকায় প্রবেশ করলো। পাহাড়ী উঁচু নিচু জায়গায় পালকি নিয়ে যেতে কষ্ট হচ্ছে।বীর প্রতাপ ও হৈমু দুইজনে পালকি থেকে নেমে পড়লো।চাকররা একটা জায়গায় পালকি লুকিয়ে রাখলো।যাতে যাওয়ার সময় কোন অসুবিধায় পড়তে না হয়।

চার জন চাকর সহ মোট আটজন ভ্রমণ সঙ্গী নিয়ে বীর প্রতাপ সমুদ্র বন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা দিল।জায়গাটা একদম পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। অনেক গুলো কাঁচা ঘর ভাঙা অবস্থায় পড়ে আছে।দেখে মনে হচ্ছে কোন বড় ঝড় বা ভূমিকম্পের কারনে এই গ্রামটা থাকার অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে। বাড়িঘর ভাঙাচোরা।দেয়াল ভেদ করে ঘাস লতা পাতা বেরিয়েছে। এমনকি রাস্তায় ও গাছ লতা পাতা গজিয়ে উঠেছে।দেখেই মনে হচ্ছে বহু বছর এই গ্রামে কোন মানুষ জন আসে নি।

রুদ্র বলল, “আজ থেকে অনেক বছর আগে এই জায়গায় মানুষ থাকতো।এক রাতে এক ভূমিকম্প হয়েছিল। এরপর পুরো জনপদ ধ্বংস হয়ে যায়। এই পাহাড়ী এলাকায় থাকা অনেক কঠিন।তার মধ্যে আবার রাতে হিংস্র জানোয়ারের আক্রমণ আছে। এইজন্যই ভুমিকম্পের পর মানুষ পাহাড় ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে যায়”

হৈমু বলল, “এখানে থাকলে এমনিতেই না খেয়ে মরে যাবে। শক্ত পাথরের পাহাড় মনে হয় না ফসল জন্মাবে । তাছাড়া এখান থেকে বাজার ও অনেক দূরে।কোন কিছু কিনে খেয়ে পারবে না”

আরাফ বলল, “এখানকার মানুষ মাছ ধরেই নিজেদের জীবন চালায়। এখানে কেউ কেউ আবার কয়লার খনিতে কাজ করতো। অনেক বছর আগে যখন ভুমিকম্প হয় তখন কয়লার খনিতে আটকে অনেক মানুষের প্রাণ যায়।এরপরেই এই জায়গা একটা ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে”

সবাই সমুদ্র বন্দরে এসে পৌছাল। জাহাজ অনেক আগেই সমুদ্রের উদ্দেশ্য রওনা দিয়েছে।পরের জাহাজে করে যেতে হলে আরো ছয় ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে।পায়ে হেঁটে আসার কারনে সমুদ্র বন্দরে আস্তে দেরি হয়ে গেছে।

আরাফ বলল, “এখন আমাদের ছয় ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে।এত সময় কি করবো ?”

বীর প্রতাপ বলল , এখানে কোথাও বসে অপেক্ষা করতে হবে। এছাড়া আর উপায় নেই।”

হৈমু বলল, “চলুন ওইদিকে গিয়ে বসি। পাহাড়ের ওইদিকে বসার মতো জায়গা আছে।একটু ছায়ায় বিশ্রাম নেই। এখানে অনেক রোদ।”

(চলবে)