প্রাণপ্রিয় পর্ব-১৪

0
5

#প্রাণপ্রিয়❤️ [পর্ব-১৪]
~আফিয়া আফরিন

“দেখতে দেখতে ঈদের সময়টাও গড়িয়ে এলো। ও নিজের বাড়ি ফিরে গেছে, তাই বেশ কিছুদিন আমাদের দেখা হচ্ছে না। আমি ভেবেছিলাম, আমার মনটা খারাপ থাকবে। কিন্তু ঈদের আনন্দ উত্তেজনায় কোনোদিকে খেয়াল নেই। তারমধ্যে মা আবার বলেছে, ঈদের দুই দিন পর মামা বাড়ি বেড়াতে যাবে। তাহলে আর মন খারাপ করব কেন? মামা বাড়ি গেলে তো ওর সাথে দেখাই হবে। ইতোমধ্যে আমাদের সম্পর্কের এক বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু আমার ভালোবাসার রেশ সেই প্রথম দিনের মতোই রয়ে গেছে। ওকে না দেখে আমার দিন কাটে না, থাকতে ইচ্ছে করে না। আবার চারদিকে সব আছে, সকলে আছে; তবুও আমার নিজেকে অপূর্ণ মনে হয়। ফাঁকা ফাঁকা লাগে।”
২৫ মে, ২০০১.

“আজ চাঁদ রাত। আশেপাশে যারা আছে সবাই একত্রিত হয়ে হাতে মেহেদী দিচ্ছি। আজ দুটো বিষয় নিয়ে আনন্দ হচ্ছে। প্রথমত, আগামীকাল ঈদ। দ্বিতীয়ত, তারপর আমরা মামা বাড়ি যাব। রাত বারোটা পার হয়েছে। অন্যদিন সকলে ঘুমিয়ে কাঁদা। আজ পাশের বাড়িঘরগুলো থেকেও হালকা সুরে গান ভেসে আসছে, বাচ্চাদের চেঁচামেচির আওয়াজ ভেসে আসছে। প্রতিবছর এই সময়টার জন্য আমি অপেক্ষা করি। গতবছর এইসময় অসুস্থ থাকায় কিছুই করতে পারি নাই। এইবার সব সুদে আসলে তুলব।”
১২ জুন, ২০০১.

“সকাল সাতটা বাজে। ঈদ মোবারক আমার এই প্রিয় ডায়েরীটাকে এবং ঈদ মোবারক অদূরে থাকা আমার প্রিয় মানুষটাকে। সে নিশ্চয়ই মনে মনে এই মুহূর্তে আমাকে স্মরণ করছে। ভালো থেকো প্রিয় মানুষ।তোমার ভালো থাকার উপর আমার জীবনের অর্ধেক স্বাচ্ছন্দ নির্ভর করে।”
১২ জুন, ২০০১.

“প্রতিবছর ভাইয়ার সাথে আমার সালামী নিয়ে ঝগড়া হয়। গত বছরও হয়েছিল, তবে তুলনামূলক কম। ভাইয়া সবসময় একগাদা টাকা নিয়ে এসে বলবে, ‘তোর থেকে আমি সালামী বেশি পেয়েছি।’ এগুলা আমার সহ্য হয় না। আমি ছোটো, এইজন্য নাকি সবাই আমাকে অল্প টাকা দিয়ে ধোকা দেয়।
তবে এইবার ভাইয়া মোটেও আমার সাথে ঝগড়া করে নাই। উল্টো আমাকে এক হাজার টাকা দিয়েছে। বলেছে, ‘আমার পক্ষ থেকে তোর জন্য সালামী।’ টাকাটা হাতে নিয়ে আমি অবাক হয়ে তাকালাম। আমি ভাইয়া আমাকে জীবনে প্রথম সালামী দিয়েছে। এই টাকা আমি কখনো খরচ করতে পারি? অভাব আসলেও তো যক্ষের ধনের মতো আগলে রাখব। কথা দিচ্ছি ভাইয়া, আমাকে দেওয়া তোমার প্রথম উপহার আমি আমার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আগলে রাখব।”
১২ জুন, ২০০১.

“আজকের বিকালটা ভীষণ সুন্দর ছিল। অন্যান্য সময়ের চাইতে আবহাওয়াও বেশ। মা বাবা আর ভাইয়ার সাথে ঘুরতে বেরিয়েছিলাম। আশেপাশে আমাদের অনেক আত্মীয়-স্বজন, সবার বাসায় ঘুরেছি। মজা করেছি, আনন্দ করেছি। আবার সকালে তো আমার বান্ধবীদের সাথেও দেখা করেছি। এই ঈদের দিনটাই আমার কাছে একটা ফুল প্যাকেজ মনে হয়। ইচ্ছামতো খাওয়া দাওয়া করতে পারি, বান্ধবীদের সাথে ঘুরতে যেতে পারি, সকলের সাথে দেখা হয়, আনলিমিটেড মজা করতে পারি আর সালামীর ব্যাপারটা তো আলাদাভাবে আছেই। তবে সবকিছুর মধ্যেও ওর কথা ভীষণ মনে পড়ছে। আফসোস থেকে গেল, আজকের দিনে ওর সাথে আমার দেখা হলো না।
রাত বারোটা বাজতে চলেছে। কিছুক্ষণ বাদেই আজকের দিনটার ইতি ঘটবে। ২০০১ এর ঈদুল ফিতর দারুন করেছে। এই বছরটা, এই সময়টা আর ফিরে পাওয়া হবে না কিন্তু প্রতিটা মুহূর্ত যুগ যুগ ধরে মনে দাগ কেটে রবে। এইতো বাজল বারোটা। সুন্দর দিনের ইতি খুব শীঘ্রই হয়ে গেল।”
১৩ জুন, ২০০১.

অনিতা পরের পৃষ্ঠা উল্টাতেই ডায়েরীর সাথে স্টার প্লাস করা একটা ১০০০ টাকার নোট দেখতে পেল। সেভাবেই উল্টেপাল্টে দেখল, ছাপার সাল ২০০১। নোটের নিচে লেখা, “ভাইয়ার দেওয়া ঈদ সালামী।”
সেই কতগুলো বছর আগে, অথচ নোটটা এখনও চকচকে! বোঝা গেল, যত্নে রাখলে কখনো সেই জিনিস নষ্ট হয় না। এমনকি গন্ধটাও এখনও অক্ষত। অনিতা মৃদু হাসল। তারপর পরের পাতা উল্টাল,

“মামা বাড়ি আসা উপলক্ষ্যে ভীষণ এক্সাইটেড ছিলাম। কিন্তু হায়! আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম, এখন ছুটির সময়। ভেবেছিলাম, ওর সাথে দেখা হবে। কিন্তু ও তো নিজের বাসায়। এখন? ধুর ছাই, কিছু ভালো লাগে না। আমার আজকে মন খারাপ, ভীষণ মন খারাপ। ইচ্ছে করছে সবকিছু ছেড়েছুড়ে অনেক দূরে চলে যাই, এতটাই দূরে যে কেউ আমাকে খুঁজে পাবে না; আমার খোঁজ পাবে না।
আচ্ছা, এমন কোনো জায়গা আসলেই আছে কি? যেখানে কোনো কোলাহল থাকবে না। আমি ভীষণ নির্জনতা প্রিয়। নিজেকে একলা আবদ্ধ রাখতেই ভালোবাসি। নিজের অনুভূতিগুলো কখনো নিজে ব্যাতীত অন্য কারো সাথে শেয়ার করি না। আমার কোনো সমস্যার কথাও কাউকে বলতে ইচ্ছে করে না। একমাত্র ও ছাড়া নিজেকে আর কাছেই পুরোপুরি প্রকাশ করতে পারি নাই, ইচ্ছেও করে নাই। যাইহোক, রাত এগারোট বাজে। এই সময় আমার হাঁকডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। স্নেহা’ও পাশে ঘুমাচ্ছে। আমার ঘুম ধরছে না। নিজেকে নিজে ঘুম পাড়ানোর কোনো উপায় আছে কি?”
১৭ জুন, ২০০১.

“হেহে! ও এসেছে। ও আশায় প্রতিদিন আমি ছাদে দাঁড়িয়ে থাকি। অবশেষে আজকে দেখা পেলাম। ভুতের ভয় দেখানোর জন্য সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ওমা! ওর সাথে যে আমার মামা চলে আসবে তা তো জানা ছিল না। ওর বদলে মামাকে ভয় দেখায়ে ফেলছি। ছিঃ ছিঃ, কী বাজে অবস্থা। আজ তো আর কথা হলো না, কাল সাহেবের সাথে জোর বোঝাপড়া করব। এত বড় সাহস, এত দেরি করে ফিরেছে? আমি অপেক্ষা করছি তো! বোঝে না? মনের টান নেই? কাল বলব, ‘কী ভালোবাসো তুমি আমাকে? আমি যে অপেক্ষায় বসে আছি, বোঝো না? না বুঝলে ভালোবাসো কেন?’
আমি সিওর ও হাসতে হাসতে বলবে, ‘ওমা! এতকিছু জেনেবুঝে তো আমি ভালোবাসি নাই। ভালোবাসতে ভালো লাগে, তাই ভালোবাসি।’
আমি জানি, ও এটাই বলবে; বলবেই বলবে।”
২২ জুন, ২০০১.

“আমার মায়ের কথার মাথামুণ্ডু আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না। আমি পড়াশোনা করলেও,তার অভিযোগ; পড়তে পড়তে আমি নাকি একদিন পাগল হয়ে যাব। আবার বই না ধরলেও বলে, ‘এই মেয়ে সারাদিনে আজ একবার’ও বই ধরেছে? পড়াশোনা না করলে জীবনে করবে কি? পড়াশোনা ছাড়া আজকাল ভাত আছে? দিনে দিনে টাকা-পয়সা এত খরচ করি, তার কোনো মূল্য আছে? আশ্চর্য হয়ে যাই আমি।’ আমি তখন একদম স্টাচু অব লিবার্টি হয়ে থাকি। মায়ের কথার সাথে তর্ক করলে আগুনে ঘী ঢালার মত ছ্যাৎ ছ্যাৎ করে উঠবে। ভাইয়া এত বড় হয়েছে, ভাইয়াকেও বকাবকি করে। আমি তো চিন্তায় আছি, ভাইয়ার বউকে নিয়ে।”
২৬ জুন, ২০০১.

“গ্রামের বাসায় গিয়েছিলাম, সেখান থেকে ফিরলাম। প্রতিবার বাসে যাই। আজ বাবাকে বললাম, ‘ট্রেনে উঠব।’ ওমা! রাজি হয়ে গেল। জীবনে প্রথম ট্রেন ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। এগুলো শুধু বাংলা পরীক্ষায় রচনা আর অনুচ্ছেদেই লিখে গেছি, তা মুখস্ত করে। আজ নিজের অভিজ্ঞতা হলো। এত বেশি দারুণ, বলার মত নয়। চারপাশে গ্রামীণ পরিবেশ, কোথা থেকে কোথা; দূর থেকে দূরান্তে ছুটে চলছি। ফেলে যাচ্ছি এক একটি স্টেশন, মানুষজন আরও কত কিছু”
২০ জুলাই, ২০০১.

“ওর পরীক্ষা শুরু হয়েছে, তাই শুধুমাত্র শনিবার দেখা করতে পারবে বলে দিয়েছে। আজ শনিবার, সকাল আটটা বাজে। ও দশটায় কলেজ গেটে দাঁড়িয়ে থাকবে। হাতে এখনও অনেকটা সময় আছে, অনুভূতি ব্যক্ত করার জন্য।
ও ভীষণ আড্ডাপ্রিয় মানুষ। সবসময় বন্ধুদের সাথে আনন্দে মেতে থাকতে পছন্দ করে। একমাত্র ওর মায়ের অসুস্থতার ব্যাপার ছাড়া আর কোন ব্যাপারে ওকে আমি চিন্তিত থাকতে দেখি নাই। সবসময় হাসিখুশি, রাগ নেই বললেই চলে। কবে জানিনা, এত ফুর্তিতে থাকার জন্য অস্কার পেয়ে যায়! মাঝে মাঝে রাগতে বলি। ও অবাক হয়ে আমায় জিজ্ঞেস করে, ‘রাগ? সেটা আবার কি? খায় না মাথায় দেয়?’
ওর কথা শুনে উল্টো আমার রাগ লাগে।”
০৩ আগষ্ট, ২০০১.

“নদীর কিনার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছি। ও হঠাৎ আমাকে বলছে, ‘অনু একটা কথা বলি?’
‘বলো।’
‘এই যে নদীটাকে দেখছ তো?’
‘হুম দেখছি।’
‘কীভাবে এক ধারায় বয়ে চলছে, কোথাও আটকে যাচ্ছে না। একদম নিজের মত, নিজের নিয়মে….. যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। আমাদের জীবনটাও ঠিক এইরকম বুঝলে। কোনো বাঁধা বিপত্তি ছাড়াই আমাদেরকেও এইভাবে এগিয়ে যেতে হবে। থাকা যাবে না কোন পিছুটান, মায়া। শুধু যেটা থাকবে সেটা হচ্ছে, তাড়াহুড়ো। নিজেদের বেঁচে থাকার তাগিদ।’
ওর কথাটা আমার কেমন যেন লাগল, খানিকটা বিষন্ন। আমি শক্ত করে ওর হাত চেপে ধরলাম। বললাম, ‘হঠাৎ এসব কথা বলছ কেন?’
‘জানিনা তবে মনে হলো বলা দরকার। মানুষের জীবনে কখন কি হয়, তা তো আগে থেকে আমরা ধারণা করতে পারি না; বুঝতে পারি না।’ ওর কন্ঠে সেই নির্লিপ্ততা।
‘তোমার কি অনেক বেশি মন খারাপ?’
ও আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে উল্টো আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা তুমি আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে?’
আমার বুকের ভেতরটা চিনচিন করে উঠল। নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হলো। চোখের কোণে অশ্রু জমল। কিছু বলতে পারলাম না। ওকে ছেড়ে থাকার কথা তো আমি কল্পনাও করতে পারি না।
ও আমাকে সান্তনা দিয়ে বলল, ‘আরে পাগলী, কান্নাকাটি করো না। আমি তো এমনিই বলছিলাম। কোথায় যাব তোমাকে ছাড়া? তুমি ছাড়া আমার আর কোনো গতি আছে?’
আমি আলতো করে ওর বুকে মাথা রাখলাম, একটু শান্তি পেলাম। আমার বুকের ভেতরটা ব্যাথা করছিল। সেই ব্যাথার চোটে কথা বলতে পারছিলাম না। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বাচ্চাদের মত কাঁদছিলাম।
আমার এমন কেনো লাগছে? মনে হচ্ছে, সারা দুনিয়া আমার মাথার উপর ঘুরছে। ও আমাকে ধরে রেখেছে, তবুও মনে হচ্ছে আমি মাথা ঘুরে পড়ে যাব। যখন একটু ধাতস্থ হয়ে উঠলাম, তখনও ওর সাথেই ছিলাম। বাড়ি যাওয়ার কথা বেমালুম ভুলে গেছি। ও আমাকে অনেকক্ষন পর বলল, ‘অনু! বাড়ি ফিরবে না?’
আমি ওর দিকে ফিরে তাকালাম। কিছু বললাম না। ও পুনরায় বলল, ‘এত দূর থেকে এত কষ্ট করে আমি কি তোমার চোখের পানি দেখার জন্য আসি?’
অবশেষে আমি বললাম, ‘লুকিয়ে চুরিয়ে আমি তোমার সাথে দেখা করতে আসি ক্ষণিকের জন্য? তোমাকে ভালোবাসি বলে, বারবার ফিরে আসি। আর তুমি এসব বলো? ছেড়ে যাওয়ার কথা? ছেড়ে থাকার কথা…?’
ও আমাকে আর অভিমান করতে দিল না। কানে ধরে দশবার উঠবস করল। আচ্ছা ঠিক আছে, এইবারের মতো মাফ করে দিছি ওকে। এরপরে আর কখনোই দিব না, একদম দিব না।”
১২ আগষ্ট, ২০০১.

“ওর মায়ের অসুস্থতা বেড়েছে। আমাকে এসে বলল, ‘ম্যাডাম আমার ছুটি চাই।’
‘ওমা কিসের?’
‘আপনার সাথে কিছুদিন দেখা করতে পারব না হয়ত।’
‘যথাজ্ঞা!’
তাহলে ওর সাথে আমার আবার বেশ কিছুদিন দেখা হচ্ছে না।”
২৮ আগষ্ট, ২০০১.

“আমার সিঁড়ি আগলে থাকে
ব্যাকুলতা।
পেছনে থেকে চুল টানে সে
হঠাৎ বাঁধে আলিঙ্গনে,
আমার সিঁড়ি আগলে থাকে
ব্যাকুলতা।

হাওয়ায় ঘোরায় চাবির গোছা,
যেন আমার ঘরণী সে;
দুপুরবেলা কখন খাটে
দেয় এলিয়ে শরীরটাকে,
ব্যাকুলতা।

বাসের ভিড়ে দোকান-পাটে
পার্কে ধূসর বেঞ্চিটাতে
আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে
ব্যাকুলতা।

যখন লিখি কিংবা খুলি
সদ্য কেনা বইয়ের পাতা
তখন পিঠে নিঃশ্বাস ফ্যালে
ব্যাকুলতা।

রোদ-খেলানো ফসফরাসে
কিংবা বুড়িগঙ্গা তীরে
আচম্বিতে আমার বুকে
দ্যায় তুলে সে ছদ্মবেশী
দুঃখ সুখের শিল্পকলা
ব্যাকুলতা।
-শামসুর রহমান। (ব্যাকুলতা)”
৩০ আগষ্ট, ২০০১.
.
.
.
চলবে…..
[কার্টেসি ছাড়া কপি করা নিষেধ]
শব্দ সংখ্যা— ১৫৩২