#প্রাণপ্রিয়❤️ [পর্ব-১৫]
~আফিয়া আফরিন
“ওর সাথে অনেকদিন পর দেখা হলো। কেমন শুকিয়ে গেছে এই কয়েকদিনে, চেহারায়’ও কেমন যেন উদাস উদাস একটা ভাব। আমার সাথে দেখা করল, কিন্তু কথাবার্তা বলল না। যতক্ষণ ছিল, আমিই বকবক করে গেলাম। ও চুপচাপ শুনল। যাওয়ার আগে ছোট্ট করে বলল, ‘আসছি।’ ওমা! হুট করে এসে হুট করে চলে গেল। আমাকে কিছু বলার সুযোগই দিল না। খানিকটা অবাক হয়েছিলাম ওর আচরণে। এর আগে কখনো এমন করে নাই। কিন্তু কেন যেন কিছু বলতে ইচ্ছে করল না! থাক না। সবসময় জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে এরকম কোন কথা আছে? আর সব কৈফিয়ত আমাকে কেনো দিতে হবে? আমি এখনও ওর সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার মত যোগ্যতা অর্জন করতে পারি নাই। ওর’ও নিজস্ব স্বাধীনতা রয়েছে, নিজের জন্য কিছু সময় রয়েছে, আমি সেসব নষ্ট করতে চাই না। কারণ আমি জানি, পাখিকে উড়তে দিতে হয়; খাঁচায় আটকে রাখলে সে পাখির বিগড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর দশজন প্রেমিকার মত আমি আবার এত খুঁতখুঁতে নই কিন্তু, এটা ও আমাকে নিজের মুখেই বলেছে।”
১৮ সেপ্টেম্বর, ২০০১.
“আমি একটা জিনিস খেয়াল করছি, ও বদলে যাচ্ছে। ওর সাথে আমি আমার সেই সুপারহিরোর মিল খুঁজে পাচ্ছি না। অচেনা লাগছে সব। ও সবসময় খুব আপসেট থাকে। আমার সাথে আগের মত কথা বলে না, ঘুরতেও যায় না। আর যাই করুক, অন্তত কথা বললে তার জবাব তো দিবে! নাহ, সে তাও করে না। আমি শুধু বলে যাই, ও শোনে কিনা জানিনা; তবে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে, আমার দিকে। যেনো আমাকে আগে কখনো দেখেনাই, এখন নতুন দেখছে। ওর কি হলো ভেবে পাচ্ছি না। ও বদলে গেলে আমি কি করব? আল্লাহ সহায় হও। প্রতিটা মুহুর্তে আমি ওকে নিয়ে ভয়ে ভয়ে আছি।”
২৬ সেপ্টেম্বর, ২০০১.
.
অনিতা ভেবেছিল, তার মা আর ফুপি আসার আগেই সে ডায়েরীটা পড়ে শেষ করে ফেলতে পারবে। আর অল্পটুকুই বাকি ছিল। কিন্তু মা আর ফুপি চলে আসাতে ডায়েরীটা রেখে দিতে হলো। তারপর মনের ভিতর বিষন্নতা এবং মুখে হাসি রেখে তাদের আনা শাড়ি-গয়না দেখতে হলো আবার কথায়’ও সায় দিতে হলো।
গতরাতে জেগেই ছিল সারারাত। ফজরের পর ফুপির ঘুম যখন আলগা হয়ে যাচ্ছিল, ঠিক সেইসময় সে ঘুমিয়েছে। আবার উঠেছে আটটায়। সব মিলিয়ে ঘুম হয় নাই একদম, এখন অনিতা ঘুমে ঢুলে পড়ছে। বাড়িভর্তি সকলে তার বিয়ে নিয়ে আলাপ-আলোচনা করছে, আর সে সব বাদ দিয়ে বিছানার এক কোণে পড়ে রয়েছে। চোখটা প্রায় লেগে এসেছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে অনু এসে ডাকাডাকি করতেই ঘুম ছুটে গেল। অনিতা আলস্য ভঙ্গিতে হাই তুলতে তুলতে বলল, ‘কি হয়েছে ফুপি? অসময়ে আমাকে ডাকাডাকি করছ কেন?’
অনু নিজের হাতে থাকা কার্ডটা অনিতার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘এই নে তোর বিয়ের কার্ড। তোকেই আগে দাওয়াত করলাম। আমার একমাত্র ভাইজির বিয়ে, ঠিক সময় মত উপহার নিয়ে চলে আসবি কিন্তু। উপহার ছাড়া একদম বিয়েতে আসতে দিব না।’
অনিতা হেসে হাত বাড়িয়ে কার্ডটা নিল। সাদাত হাসান অনিতাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কী রকম কার্ড তার পছন্দ? অনিতা এই বিষয়টা সম্পুর্ণ বাবার উপর ছেড়ে দিয়েছিল। কার্ডটা দেখে তার মন ফুরফুরে হয়ে গেল। অনেক বেশিই সুন্দর হয়েছে! তৎক্ষণাৎ ছবি তুলে রাখল, আহিরকে পাঠাবে বলে।
অনু অনিতার পাশে বসে জিজ্ঞেস করল, ‘পছন্দ হয়েছে?’
‘খুউউউউব।’ উচ্ছ্বাস ভঙ্গিতে বলল সে।
অনিতা তখনও কার্ডটা উল্টেপাল্টে দেখছিল। অনু হঠাৎ আনমনে বলল, ‘আচ্ছা তোর শশুর বাড়ির মানুষগুলো কেমন রে?’
অনিতা নড়েচড়ে বসল, যেন কথা বলার মত দারুণ একটা বিষয় পেয়েছে। ফুফির কাছাকাছি এগিয়ে এসে বলল, ‘বলার মতো না এত দারুণ মানুষজন। আহিরকে তো তুমি দেখলেই, ওর কথা আর আলাদা করে কি বলব! ওর ছোটো ভাই আহির, সেও দারুণ। বয়সে আমার চেয়ে বেশ ছোটো, এত সুন্দর করে কথা বলে। আমাকে বলেছে, তোমাকে আমি ভাবি ডাকব না আবার আপুও ডাকব না। ডাকব, ভাবিপু বলে। সুন্দর না বলো?’
‘তোর শাশুড়ি? সে কেমন?’
অনিতা একটু ভেবেচিন্তে বলল, ‘ভালই তো মনে হলো। এর আগে তার সাথে আমার আরো একবার দেখা হয়েছিল, আহির ওদের বাসায় নিয়ে গেছিল আমাকে। প্রথম দেখায় ভেবেছিলাম, অনেক বদমেজাজি হয়ত। কারণ, কেমন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমাকে দেখছিলেন। আবার আহিরকে বলছিলেন, সাথের এই মেয়েটা কে রে? আহির তখন বলেছিল, তারপরও তার সাথে সহজ হতে পারি নাই। অনেকটা গম্ভীর মনে হয়েছিল। যখন ওই বাড়ি থেকে চলে আসব তখনও আমাকে গম্ভীর মুখে বললেন, আবার এসো। কিন্তু আমাদের বাড়িতে যখন এলো, তখন অনেকটা সহজ মনে হয়েছে। আমার সাথে অনেক কথাবার্তা বললেন। জানিনা এখন, কেমন হবে আমার শাশুড়ি আম্মা!’ অনিতা উদাস ভঙ্গিতে বলল।
অনু পুনরায় জিজ্ঞেস করল, ‘আর তোর শ্বশুরমশাই? তার কথা বললি না?’
‘উনি এক কথায় অসাধারণ মানুষ। অন্তত আমার শাশুড়ির মত কাঠখোট্টা মনে হয় নাই প্রথম দিনে। যথেষ্ট আন্তরিক। কথাবার্তায় একটা আপন আপন ভাব আছে।’
অনু আর কিছু বলল না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ঠিক’ই দীর্ঘশ্বাস ফেলছিল। দীর্ঘশ্বাসের ওজন গুলো এতটাই দীর্ঘ ছিল যে, বহন করতে কষ্ট হচ্ছিল খুব। সে অনিতার রুম থেকে উঠে নিজের রুমে গিয়ে দরজা লাগাল।
এটাই তার নিজস্ব জায়গা। এই বদ্ধ ঘরেই নিজের অনুভূতিগুলো বিছিয়ে রাখতে পারে নির্বিঘ্নে। আগে ডায়েরী লেখার প্রচুর অভ্যাস ছিল, এখন আর ভালো লাগে না। মাঝেসাঝে খুব ইচ্ছে করলে, দুয়েক পাতা লিখে।
এই একটা মাত্র পৃথিবীতে কতগুলো মানুষ, সেই মানুষদের আবার কয়েক শত দুঃখ! এত দুঃখ বহন করে পৃথিবী কীভাবে এখনও টিকে আছে খুব জানতে ইচ্ছে করে। এই পৃথিবীর থেকে বেঁচে থাকার ছোট্ট একটা আশার উপায় জানতে ইচ্ছে করে। পৃথিবী তো দিব্যি ভালো আছে, বেঁচে আছে, সুখে আছে; আর সে সামান্য একটু দুঃখ নিয়ে বারবার কেনো ভেঙে পড়ছে? কেনো বারবার নিজেকে সর্বহারা মনে হচ্ছে? তার সব আছে! মা-বাবা বেঁচে আছে, ভাই-ভাবি আছে, অনিতা আছে, তবে? ভালোবাসার এত লোভ কেনো তার? এই লোভটাই তো তার জীবনটা ছাড়খাড় করে দিল। একজন মানুষকে ভালোবাসার লোভ আছে বলেই তো, দ্বিতীয় কাউকে ভালোবাসতে পারল না।
মা-বাবা সেই সময় কত করে চেয়েছিলেন, মেয়ের দুঃখ ঘুচাতে। কতবার বলেছিলেন, বিয়ে করার কথা। কত সুযোগ্য পাত্র সে ফিরিয়ে দিয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই।
ওই মানুষটা কেনো বলেছিল, ‘আমার জন্য অপেক্ষা কইরো।’ আর কেনই বা অনু অন্ধের মত বিশ্বাস করেছিল? আজকাল নিজেকে ধিক্কার দেয়, নিজের বিশ্বাসের কাছে বাজে ভাবে হেরে গিয়েছে না?
স্বার্থপর! সবাই স্বার্থপর, যাদের জন্য আমরা নিজেদের সারাজীবন উজাড় করে দিই; তারা আমাদের চেনেও না।
.
অনিতার বিয়ের দায়িত্ব সবাই নিজেদের মধ্যেই ভাগাভাগি করে নিয়েছে। মেহেদী, গায়ে হলুদ এবং কনে সাজানোর জন্য মানুষ ঠিকঠাক করা’সহ এই দায়িত্ব গুলো দেওয়া হয়েছে অনুকে। অনু ঠিক বুঝতে পারছে না, কোথা থেকে কী শুরু করবে! এরইমধ্যে অনিতা বারবার আসছে শাড়ি দেখাতে। আহির কতকগুলো বেনারসী শাড়ির ছবি পাঠিয়েছে, অনিতার নাকি সব’ই পছন্দ। সে বলল, ‘আমার সবগুলোই চাই এবং আমি আমার প্রতি বিয়েতে একটা করে শাড়ি পড়ব।’
আহির শুনে তো থ! তার মাথায় হাত। খাবি খাওয়া মাছের মত চোখ উল্টে বলল, ‘বিয়ে? আবার বিয়ে? কী বলো এসব? আবার বিয়ে করবে কেনো? আয় হায়, আমি কি এতগুলো শাড়ির ছবি পাঠিয়েছি নিজের সর্বনাশ করার জন্য?’
‘আরে পাগল! আমি বলি কি আর সে বোঝে কি? এইটারে বিয়ে করে আমি কি করব? ওহ আল্লাহ! এই গাধাটাকে মানুষ করে দাও।’
‘তুমি সত্যি করে বলো অনি, প্রতি বিয়েতে একটা একটা করে শাড়ি পড়বে মানে কি?’
অনিতা রেগে মেগে বলল, ‘কিচ্ছু না, কিচ্ছু না এবং কিচ্ছু না। আর কিছু শুনতে চাও তুমি? জানো, আমি কতটা এক্সাইটেড হয়ে তোমাকে ফোন করেছি। তুমি কি করলে? মুডটাই নষ্ট করে ফেলছ। তোমার সাথে আমার বিয়ের পর মিলবে কি করে তাই ভাবছি আমি। তুমি যা অসহ্য টাইপের কথা বলো, তাতে তো প্রতিদিন মারামারি আর কাটাকাটি হবে।’
আহির ফের দ্বিধায় ভোগে। এই মেয়েটাকে সে বুঝে উঠতে পারে না। এই ঠিকঠাক, এই রেগে এটম বোম।
আহিরের সাথে কথা বলে অনিতার’ও মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে। সে ফুপিকে গিয়ে বলল, ‘তোমরা বিয়ের এত প্ল্যানিং বাদ দাও তো। আমার কিছু ভালো লাগছে না। আমি বিয়ে করব’ই না।’
‘ওমা! কেনো? আমার খুকিটাকে কে কি বলেছে শুনি।’
‘কেউ আমাকে কিছু বলে নাই। যতদিন এগিয়ে আসছে, তত’ই ভয় করছে। তোমাদের ছেড়ে চলে যেতে হবে, তাই বিয়ে করব না।’
‘সব মেয়েকেই একদিন বাপের বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয় রে মা!’
অনিতা হঠাৎ বলে বসল, ‘তুমি তো যাও নাই ফুপি। আমিও তোমার মত থেকে যাই?’
‘ছিঃ অনি, এসব কথা বলিস না। আমার ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। ভালোবাসার মানুষকে পেয়ে গেলে ওতো আপত্তি সাজে না। বিয়েটা সেরে নে, দেখবি জীবনটা অন্যরকম হয়ে যাবে। একদম আলাদা, ভালোলাগার একটা জীবন, ভালোবাসার একটা জীবন।’
অনিতা ফুপির গা ঘেঁষে বসে বলল, ‘তবে তুমি বিয়ে করলে না কেনো?’
অনু কপালে হাত রেখে বলল, ‘এইখানে লেখা ছিল না।’
.
অনিতা কিছুদিন ধরে ডায়েরীটা পড়ার সুযোগ’ই পাচ্ছে না। রাতে যেই একটু সুযোগ আসে ওমনি আহির ফোন দেয়, তারপর ওর সাথে কথা বলতে বলতেই রাত শেষ হয়ে যায়। আবার কখনও কখনও ঘুমে চোখ খুলে রাখা যায় না। আজকে দুপুরে ঘুমিয়েছিল এবং একটু আগে আহিরের সাথে কথা বলে, শুভ রাত্রি জানিয়ে দিয়েছে। তাই ফুপি ঘুমিয়ে পড়তেই সে ডায়েরীটা নিয়ে বসল। ঠিক এমন সময় ফোনটা ভাইব্রেট করল। অনিতা বিরক্তিতে নাক কোচকাল। হাতে নিয়ে দেখল, আহির ফোন করেছে। একটু আগেই কথা হলো, আবার কেনো ফোন করেছে? ধুর! বিরক্তি নিয়ে অনিতা ফোন রিসিভ করল।
আহির দ্রুত বলল, ‘তুমি এক্ষুনি, এই মুহূর্তে তোমাদের ছাদে উঠো।’
অনিতা ঘড়ির দিকে তাকাল। রাত বাজে বারোটা। এই সময় সে ছাদে গিয়ে কি ভূত পেত্নীর সাথে আড্ডা দিবে? আশ্চর্য! অনিতা বলল, ‘আমি একলা এত রাতে ছাদে যেতে পারব না।’
‘একলা না। তুমি যাও, তারপর বুঝবে।’
‘একলা তো নাই’ই। এই সময় তো ছাদে ভূত, পেত্নী সবাই আছে। তাদের সাথে যোগাযোগ করতে যাব তাইনা?’
‘আমি আছি, আসো।’
অনিতা আরেক দফা অবাক হলো। জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কি করো?’
‘এসো, তারপর বলছি।’ আহির ফোন রেখে দিল। অনিতা কিছুটা বিস্মিত হলেও, সে ছাদের উদ্দেশ্য রওনা দিল। সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ভাবল, যাবে কি যাবে না! আহির যেহেতু ফোন করেছে, তবে সেটা সত্যিই, এই ভেবে দরজার কড়ায় হাত রাখল। দরজা একটুখানি আলগা করতেই হঠাৎ আঁধারে একঝলক আলো এসে চোখে লাগল। চারিপাশ আলোয় আলোকিত, ভরপুর! অনিতা অবাক হলো। কিন্তু আশেপাশে আহিরকে কোথাও দেখতে পেল না। এটা কি ভ্রম? ভূতের কারবার?
.
.
.
চলবে…..
[কার্টেসি ছাড়া কপি করা নিষেধ]
শব্দ সংখ্যা— ১৫০৪