#প্রাণপ্রিয়❤️ [পর্ব-১৬]
~আফিয়া আফরিন
উঁহু, এসব ভূত পেত্নী কিছুই নয়। আহিরকে দেখতে পেল। অনিতা এগিয়ে গেল। অবাক হয়ে আশেপাশে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি? আর এসব কি? এতো লাইটিং কেনো করেছ? আমাদের বিয়ের এখনও এক সপ্তাহ দেরি আছে।’
‘কিন্তু এসব তো আমি বিয়ের জন্য করি নাই।’
‘তবে কেনো করেছ?’ অনিতার পাল্টা প্রশ্ন।
আহির আয়েশ করে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাড়াল। এগিয়ে গেল অনিতার কাছাকাছি। মিষ্টি করে হেসে বলল, ‘ভাবলাম, আমাদের এতদিনের সম্পর্কে কখনোই তোমার জন্য আয়োজন করে কিছু করা হয় নাই। আমাদের সম্পর্কটা এখন বিয়ে অবধি গড়াবে, তো এই সম্পর্কটাকে একটু স্পেশাল করে রাখতে হবে না? তো, যেই ভাবা সেই কাজ। অনেকক্ষণ আগেই এসেছি। আসলাম আংকেল’কে হাত করে তার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সব কাজ করেছি। কেমন হয়েছে বললে না?’
অনিতার কাছে আহির আগাগোড়া পুরোটাই স্পেশাল। এতো যত্ন করে করেছে, ভালোবেসে করেছে, “অনেক সুন্দর” বললেও কম হবে। অনিতা বলে, ‘তুমি যে আমার জন্য কিছু করো নাই, এটা সম্পূর্ণ ভুল।’
‘আমি বলেছি বিশেষ কিছু…….’ আহির অনিতার ভুল শুধরে দেয়।
অনিতা ফের বলে, ‘শোনো শোনো, তুমি যে আমার রাগ-অভিমান সহ্য করে রয়ে গেছ, এর চেয়ে বিশেষ কিচ্ছু হয় না। আর আজকের এইটা তো সেরা! কী বলব? প্রথমে অবাক হলাম, তারপরে সারপ্রাইজড! এত্তো দারুন লাগছে…… তোমাকে, নিজেকে এবং সাথে এই মুহুর্তের প্রকৃতিটাকে।’
আহির বলল, ‘আমার ভালো লাগে। তোমার রাগ, অভিমান আর জেদ। ওসব ছাড়া তোমাকে একদম মানায় না। একটু রাগি রাগি কণ্ঠে যখন বলো, “তুমি দুনিয়ার সবচেয়ে বড় বোকা, হাদারাম” তখন আমার ইচ্ছে হয় আমি আরও বোকা হয়ে যাই। অন্তত তোমার শাসনটুকু তো আমার থাকবে!’
‘তাই? বিয়ের পর যদি এইরকম রাগারাগী করি তবে মেনে নিবে?’
‘সারাজীবন মাথা পেতে নিব। ওই যে বললাম, ভালো লাগে। অভ্যাস হয়ে গেছে, তুমি বায়না না করলে ভালো লাগে না, অভিমান না করলে ভালো লাগে না, অকারণ জেদ না দেখালে ভালো লাগে না, রাগারাগী না করলে তো আমার দিন’ই কাটে না।’
‘আচ্ছা তাই? তবে এখন থেকে বেশি বেশি রাগ দেখাব। আমি শুধু রাগ করব, তুমি উল্টো আমাকে একদম ধমক দিতে পারবে না বলে দিলাম! বেশি বেশি ভালোবাসবে, ঘুরতে নিয়ে যাবে, ওকে!’
আহির দু’পাশে মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বলল, ‘যথাজ্ঞা রাণী সাহেবা।’
অনিতা খিলখিলিয়ে হেসে উঠল, সুখী মানুষের হাসি। সে অলক্ষ্যে বুঝতে পেরেছে, তার জীবনে আর কোনো অপূর্ণতা নেই। নেই কোনো নিঃসঙ্গতা, আজ থেকে সঙ্গতা আঁকড়ে ধরে সে পুনরায় বাঁচতে শিখবে। তার জীবনে একটা বোকা মানব রয়েছে, যে প্রতিমুহূর্তে বোকামি করে শুধু শাসনের জন্য! মুচকি হাসে অনিতা। সময় কেটে যায়….. অনেকক্ষণ….. খেয়াল থাকে না। হাত রাখে একে অপরের হাতে, অঙ্গীকার করে সারাজীবন পাশে থাকার। তারা থাকবে সেভাবে, যেভাবে থেকে দুজনের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির স্থান থাকবে না। তারা ফিরে আসবে সেভাবে, যেভাবে শীতের পর আবার গ্রীষ্ম ফিরে আসে।
.
“ও আজ আবার এলো। আগের মতোই, কোনো উন্নতি নেই। যাওয়ার আগে আমাকে বলে গেল, ‘আবার কবে আসব জানিনা, আমি ভাবি যাচ্ছি।’ আসার দিন তারিখ বলে গেলে ভালো হতো, কিন্তু ও বলল না। আমিও কিছু জিজ্ঞেস করলাম না। বাড়ি যাক, কিছুদিন ঘুরে এলে হয়তো মনটা ফ্রেশ হবে। এই আশায় ওকে বললাম, ‘আচ্ছা যাও। গিয়ে আবার আমাকে ভুলে যেও না।’
‘কখনোই ভুলব না। ভালো থেকো। আসছি।’
অদ্ভুত লাগল কথাটা! ও কখনো এভাবে বলে নাই, ভালো থেকো। আচ্ছা ঠিক আছে, আমি একটু বেশি বেশিই ভাবছি। ওর মন-টন এমনিতেই খারাপ, কী বলতে কী বলেছে—সেটা নিয়ে এত হাইপার হওয়া উচিত না।”
০৮ অক্টোবর, ২০০১.
“ও এখনো ফিরে আসছে না কেন? অনেকদিন হলো তো… এর আগে একবার আমায় টেলিফোনে ফোন করেছিল, এইবার তো তাও করছে না। অনেক চিন্তা হচ্ছে।”
২২ অক্টোবর, ২০০১.
“একটা মাস হয়ে গেছে, আল্লাহ! এইরকম কখনোই হয় নাই। এইবার নিজেকে পাগল পাগল মনে হচ্ছে। ও কবে ফিরবে? এর আগে কখনোই ১০ দিনের বেশি বাড়িতে গিয়ে থাকে নাই, ঈদের ছুটিতেও না। এইবার ওকে যতটা না দেখতে ইচ্ছে করছে, তারচেয়েও বেশি আমার টেনশন হচ্ছে। আর কিছুদিন বরং অপেক্ষা করি। অবশ্যই আমার জীবনে সুন্দর একটা দিন আসবে। ওকে আর কোথাও যেতে দিব না, বেঁধে রেখে দিব নিজের কাছে।”
০৮ নভেম্বর, ২০০১.
“আজ হঠাৎ এক জায়গায় শুনলাম, ‘ভালোবাসায় ধরে রাখা এবং ছেড়ে দেওয়ার মতো দুটো বিষয়ই রয়েছে। যারা ধরে রাখতে চায়, তারা যেকোনো মূল্যে যেকোনো ভাবে নিজের কাছে বেঁধে রাখা। যাদের উদ্দেশ্য থাকে ছেড়ে চলে যাওয়া, তাদের সবটাই অজুহাত; অবহেলা। তারা ভালবাসতে জানে না, প্রেম প্রেম খেলা খেলতে জানে।’
আমার এখন আর কিছু ভালো লাগছে না। ওর কোনো খবর পেলাম না। প্রতিদিন ক্লাস শেষে গেটের কাছে আধাঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকি, যদি ওর দেখা পাই। আশ্চর্য! প্রাইভেটের পড়া বাদ দিয়ে রিকশা করে শহরের অলিতে গলিতে ঘুরি, যেখানে ওর পরিচিত কেউ আছে, সেখানেই ছুটে যাই। তাও পাই না খবর!”
১৫ নভেম্বর, ২০০১.
“ও আমার কাছে নিশ্চয়ই ফিরে আসবে। হ্যাঁ আমি জানি……..”
২০ নভেম্বর, ২০০১.
“সময় কেটেই যাচ্ছে অজান্তে, চোখের পলকে। আশ্চর্য, একটা মানুষ এভাবে নিখোঁজ কি করে হয়ে যায়? আমি বুঝিনা, আমি কিছু জানিনা। আমার পাগল পাগল লাগে নিজেকে। মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এদিকে তোমার খোঁজ পাচ্ছি না, ওইদিকে মা-বাবা বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে। কী করব আমি? অপেক্ষা করা ছাড়া এখন আর কিছুই করার নেই।”
২৫ নভেম্বর, ২০০১.
ডায়েরীর পরের পৃষ্ঠা উল্টাতেই একটা আওয়াজ ভেসে এলো। অনিতা তরান্বিত হয়ে ডায়েরী বন্ধ করল। দরজায় উঁকি দিল। কাউকে আসতে দেখা যাচ্ছে না। তবুও দ্বিতীয়বার ঝুঁকি নিল না। ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। কিন্তু মনের মধ্যে খুঁতখুঁতুনি রয়েই গেল।
তার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না কেনো? তাকে খুঁজে পাওয়ার তীব্র প্রয়াস! তার জন্য নিজেকে ওমন পাগল পাগল অনুভূত হওয়া। কার জন্য অপেক্ষা! সেই অপেক্ষা কি শেষ হয়েছিল?
ফুপি বাসায় নেই—একটুখানি রিস্ক নেওয়াই যায়। অনিতা ঘরে গিয়ে ফের পড়তে শুরু করল,
“ভাগ্য আমার সাথে একি খেলা খেলছে? যাকে ভালোবাস’লাম, সে আমায় ভালোবাস’ল না? এভাবে পালিয়ে যাওয়ার কি দরকার ছিল? ও যদি আমাকে বলত, ‘অনু আমি তোমাকে আর ভালোবাসি না।’ তবে কি জোর করতাম ওকে? আমার আবেগ নিয়ে অযথা খেলল! আজ শুনেছি ওর কথা! আছে নাকি ভালোই! বিয়েও নাকি করেছে। পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যেতে খুব একটা দেরি হলো না। ওখান থেকে কীভাবে যে বাসায় এলাম, তাও জানিনা। হতভম্ব হয়ে গেছি আমি। আমার বিশ্বাসের এই প্রতিদান দিল ও? মাত্র কিছুদিন! কিছুদিনের ব্যবধানে এতটা…….”
২৯ নভেম্বর, ২০০১.
“ভাইয়ার বিয়ে প্রায় ঠিকঠাক। নিজের এমন অবস্থা যে, বাড়ির দিকে খেয়াল নাই একদম। অনেকদিন আগে থেকেই কথাবার্তা চলছে, মেয়েও মায়ের পছন্দ হয়েছে, অথচ আমি বাড়ির মানুষ হয়ে কিছুই জানিনা। আজকে মা জানাল, ভাইয়াও রাজি। এখন শুধুমাত্র তারিখ ঠিক হওয়া বাকি আছে। যাক, আমার ছন্নছাড়া ভাইয়ের একটা গতি হইলো।”
০২ ডিসেম্বর, ২০০১.
“আমাদের এই বাড়ির সাথে আমার অনেক স্মৃতি। ভাবতেই অবাক লাগে, খুব শীঘ্রই আমরা বাড়ি ছাড়ব। আমার মা বিয়ের পর থেকেই এখানে আছে। আমার দাদুও মারা গেছে এই বাড়িতে। আমি যখন বারো/তেরো বছরের, তান শখ করে উঠোনে অনেক গাছপালা লাগিয়েছি। নাম না জানা অসংখ্য ফুল গাছ! সব ছেড়ে যেতে হবে। বিশ্বাস হয় না, দক্ষিণের জানালাটা খুললে আর নদীর জলের গান শুনতে পারব না। অনেককিছুই আমার ইদানিং বিশ্বাস হয় না, কেমন যেনো অনুভূতিশূন্য মনে হয় নিজেকে। দুনিয়ায় যাই হয়ে যাক, আমার কিছু যায় আসে না।”
১০ ডিসেম্বর, ২০০১.
“ভাইয়ার বিয়েটা আজ ধুমধাম করে হয়েই গেল। আমার একটামাত্র ভাই, অথচ তার বিয়েতে আমি কিছুই করতে পারলাম না। মা শেষমেশ আমার উপর রাগ হয়ে গেল, আমার নির্লিপ্ততা দেখে। বাবা মাকে থামাতে এসে নিজেও একচোট বকা খেল। মা বলল, ‘দেখেছ তোমার মেয়েকে? কীরকম ভাব ধরে বসে আছে? কয়েকদিন থেকে দেখছি এইরকম বৈরাগী হয়ে বসে আছে। কী সমস্যা ওর? কীসের বিরহে ভুগছে জিজ্ঞেস করো তোমার মেয়েকে। বাড়িভর্তি সবাই আমাকে বলছে, আপনার মেয়ের কি হয়েছে? শরীর খারাপ নাকি? কথাবার্তা বলে না খুব একটা, অনেক চাপা স্বভাবের।
ও কিন্তু এরকম করে থাকলে আমার কাছে মাইর খাবে।’
বাবা মাকে বলল, ‘চুপ করো, বাড়িভর্তি মানুষজন এর মধ্যে তুমি কি শুরু করেছ? অনুর পরীক্ষা না সামনে, পড়াশোনা নিয়ে হয়তো চাপে আছে। তুমি যাও, তোমার কাজ সামলাও।’
‘আমিও দেখব পড়াশোনা করছ তোমার মেয়ে কোথাকার কোন বিদ্যাসাগর হয়।’
মা চলে গেলে বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। আমি হাসি, আমার সে হাসিতে প্রাণ নেই। শুধুমাত্র দেখানোর জন্য হাসি! সবশেষে আমি ভালো আছি।”
১১ জানুয়ারি, ২০০২.
“নতুন বছরের আমেজ সকলের মধ্যেই বিরাজ করছে। ভাইয়া-ভাবি রোজ আমায় বলে, ঘুরতে যাব কিনা! পড়াশোনার দোহাই দিয়ে এড়িয়ে যাই। আমার কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। ভাবি অনেক ভালো, সারাক্ষণ আমার সাথেই বকবক করে। আগের আমি হলে, উচ্ছ্বাসে শেষ হয়ে যেতাম। কিন্তু এখন…..! যাইহোক, তবুও ভাবির সাথে সময় খারাপ কাটে না।”
৩০ জানুয়ারি, ২০০২.
“আমার সেই সময়টায় খুব ফিরে যেতে ইচ্ছে করে, যখন ও ছিল। ওর হাত ধরে আবার পুনরায় শহরের অলিতে গলিতে ঘুরতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে আবার ক্লাস ফাঁকি দিয়ে, প্রাইভেট বাদ দিয়ে—শূণ্যে হারাই। ইচ্ছে করে খুউউউব। এখন আর লেখালেখি করতে ইচ্ছে করছে না। ও যখন ছিল, রঙীন ছিল দুনিয়া। এখন সব সাদাকালো। মামা বাড়িতেও খোঁজ নিয়েছি। হঠাৎ বিনা নোটিশে বাড়ি ছেড়ে দিয়েছে। থাকুক, ও ভালো থাকুক। সুখী হোক, আমার সবটুকু সুখ আমি ওকে দিয়েছি। ও ভালো থাকলেই আমি ভালো থাকব। ও শুধু আমার জীবন থেকে চলে যায় নাই, আমার জীবনের হাসি আনন্দ সব নিয়ে গেছে। খুউব অভাব ছিল বুঝি যে অভাবী মানুষের কাছ থেকেই সব নিয়ে তাকে অসহায় করে দিল!”
০২ জুন, ২০০২.
“রাজশাহী শহরটা আগের মত, এখনও খুব প্রিয় আছে। যাই, আগের মত নিজেই হারাই। ওকে খুঁজি, উঁহু আমার জন্য না। শুধুমাত্র কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়ার জন্য। প্রশ্নের উত্তরগুলো না খুঁজে পাওয়া পর্যন্ত আমি শান্তি পাব না।”
০৮ জানুয়ারি,২০০৩.
“মা আবার আমার বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। আমি তো কখনোই বিয়ে করব না। ও আমাকে বলেছিল, যেকোনো মুহূর্তে ওর জন্য অপেক্ষা করতে। আমি তো বিশ্বাসঘাতক নই, যে কথা দিয়ে কথা রাখব না। অপেক্ষা করছি…… অপেক্ষা করব……! দেখি কবে কখন এই অপেক্ষার প্রহর শেষ হয়। দুনিয়া তো খুব বড় নয়। জীবনের শেষ লগ্নে হলেও আমি ওর সাথে দেখা করতে চাই।”
১৯ জুলাই, ২০০৩.
.
.
.
চলবে…..
[কার্টেসি ছাড়া কপি করা নিষেধ]
শব্দ সংখ্যা— ১৫০৩