প্রাণসখা পর্ব-০৪

0
3

#প্রাণসখা
#লাবিবা_আল_তাসফি

৪.
‘প্রেমে পড়া বারণ’ নামক উক্তি সেই ছোট্ট থেকে শুনে আসছি। আমার বংশের কেউ আজ অবদি প্রেম নামক শব্দের সাথে পরিচিত হতে পারেনি। প্রেম ধ্বংস বয়ে আনে এমনটাই বলা হয়েছে আমাদের। ঠিক বুঝতে শেখার পর থেকেই আমাদের এ বিষয়ে শিক্ষাপ্রদান করা হয়েছে। আমরা ভাই বোনেরা আজ অব্দি সে কথা মাথায় রেখে চলেছি। ভুল বসত ও কখনো কারো প্রতি আকৃষ্ট হতে দেইনি নিজেদের। এত বছরের সাধনা কি তবে বৃথা হতে গেলো? বাদামী বর্ণের এই অগোছালো মানুষটায় তবে দৃষ্টি কেন থমকালো? কেন বুকের ভেতরটা তাকে দেখতেই আনন্দ জাল বুনতে লাগলো? এর উত্তর নেই আমার কাছে। এই অনুভূতি পুরোটাই নতুন। একটু অদ্ভূত কিন্তু মিষ্টি!
মাথার উপরের আকাশটা ক্রমশ মলিন হতে লাগলো। ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি উড়ে যাচ্ছে। বাড়ি ফেরার তাড়া খুব। তবে আমার মাঝে তেমন কোনো তাড়া নেই। আমি বেশ দাঁড়িয়ে আছি একই স্থানে। এতক্ষণ স্বচ্ছ ছাদের গেটের পাশের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। এখন সে সোজা হয়ে হেঁটে আমার সামনে দাঁড়ালো। মুচকি হেসে বললো,

‘পৃথিবী এতটা ছোট তা আশা করিনি! আবারো দেখা হয়ে গেল!’

আমি আমার বিষ্ময় ভাব ধরে রাখতে পারলাম না। তাকে প্রশ্ন করে বসলাম,

‘আপনি এখানে কিভাবে?’

‘যতদূর জানি এই বাড়িটা আমার বাবার। আমি যেহেতু নিজের বাড়ি এখনো তৈরি করতে পারিনি তাই এখানেই আশ্রয় নিয়েছি। আপনার ব্যাপার কি? এখানে কেন?’

তার জবাবে আমি হাসলাম। তিনি যদি সহজ ভাবে বলতেন এটা তাদের বাড়ি তাহলে বিষয়টা মোটেই এতটা প্রাণোচ্ছল হতো না।

‘আমিও আশ্রয় নিয়েছি। তৃতীয় তলায়। ডান পাশের ফ্লাটে।’

স্বভাবসুলভ স্বচ্ছ হাসলো। সন্ধ্যার মৃদু আলোতেও আমি লক্ষ্য করলাম তার সেই গা কাঁপানো হাসি। আমি অভিভূত হলাম। পলক না ফেলেই অস্ফুট স্বরে বলে উঠলাম,

‘আপনার হাসি সুন্দর। ভিষণ সুন্দর। আপনার নামের মতোই স্বচ্ছ।’

স্বচ্ছ চমকালো না। তার হাসির প্রশংসা করায় খুব একটা খুশি হলো তেমন ও না। স্বল্প কপাল কুঁচকে বললো,

‘তাই নাকি? আমার মনে হতো আমি হয়তো রাক্ষস পুরির রাক্ষসদের মতো হাসি। ভয়ংকর হাসি। ছোট বাচ্চাদের সামনে আমি হেসে ফেললে তারা চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে। আমার এই ভয়ংকর হাসিতে সৌন্দর্য খুঁজে বের করা মেয়েটার চোখ জোড়া নিশ্চই ভিষণ সুন্দর! আপনার চোখ জোড়া একটু কাছ থেকে দেখতে পারি? আপনার সুন্দর চোখ জোড়া দেখার লোভ হচ্ছে খুব!’

স্বচ্ছ হঠাৎ করেই আমার খুব নিকটে এসে দাঁড়ালো। আমি চমকে পিছিয়ে গেলাম এক পা। হাত থেকে দু চারটা কাপড় পড়ে গেলো। লক্ষ্য করলাম চশমার আড়ালে থাকা চোখদুটো কুঁচকে এসেছে। স্বচ্ছ নিভু গলায় বললো,

‘পিছালেন কেন? অন্ধকারে দেখা যায় না।’

সে আবারো এক পা এগোলে আমি পুনরায় পেছাতে গেলে সে বলে ওঠে,

‘নড়বেন না। এক মিনিট সময় নিব।’

আমি সত্যিই নড়লাম না। ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। এক মিনিট পার হলেও নড়বার বিন্দু মাত্র শক্তি পেলাম না আমার মাঝে। স্বচ্ছ নিজেই সরে দাঁড়ালো। নিচ থেকে কাপড় গুলো তুলে আমার হাতে দিয়ে বিনা বাক্যে ছাদ থেকে নেমে গেলো। আমি তখনো ঘোরের মাঝে। শরীরে তীব্র কাঁপুনি অনুভব করলাম। আমার হাত পা কাঁপছে। স্বচ্ছর উইদাউট নোটিশে এভাবে কাছে আসাটা আমার মনে প্রভাব ফেললো খুব। দুদিন ঘুম হলো না। আমার জীবন কেমন করে যেন স্বচ্ছতে তলিয়ে গেল। উঠতে, বসতে, খেতে কেবল স্বচ্ছকে নিয়ে ভাবতে বসে গেলাম। বিষয়টা এখানেই থামলো না। স্বচ্ছর প্রতি আমার অনুভূতি বারাবারি পর্যায়ে পৌঁছে গেল। আজকাল হুটহাট তাকে দেখতে মন চায়। দিনের অধিকাংশ সময়ই আমার কাটতে লাগলো বারান্দায় দাঁড়িয়ে। এই বুঝি স্বচ্ছ গেট থেকে ঢুকলো! কিন্তু তার দেখা নেই। সেদিনের পর থেকে যেন উধাও হয়ে গেছে সে। আমার ভারী দঃখ হলো। আমি যার জন্য এত উতলা হলাম সে কি আমার কথা একবার ও ভাবে না? রোজ বিকেলে নিয়ম করে ছাদে যাওয়া হয় এখন। সেখানেও স্বচ্ছকে পাওয়া গেল না। স্বচ্ছ হীন জীবন এভাবে এক সপ্তাহ কেটে গেলো। একদিন হুট করেই বাবার নম্বর থেকে কল আসলো। মামা এই নম্বরটা অনেক আগেই বাবাকে দিয়েছে। এতদিন বাদে আজ কেন কল করলেন? আমার সন্দিহান মন চাপ অনুভব করলো। নিশ্চয়ই কিছু ঘটেছে। হয়তো খুব খারাস কিছু! আমি কিছুটা আতঙ্ক নিয়েই কল রিসিভ করলাম। হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে বাবা গম্ভীর গলায় বললেন,

‘আর কতদিন বেরাবে? বাড়িতে ফিরছো না কেন? দু একদিনের মাঝেই চলে আসো। শুনেছি কিছুদিন বাদে নাকি পরীক্ষা তোমার? না পড়লে খাতায় কি লিখবে? আমার এ বংশের ওনো ছেলে মেয়ে ফেইল করেনি কখনো। তুমি কি সেই রেকর্ডটাও ব্রেক করতে চাচ্ছ?’

বাবার কথার উত্তর দেওয়ার আগেই মা বাবার থেকে ফোন ছিনিয়ে নিলেন। ফোন ধরে তিনি প্রায় কেঁদেই ফেললেন,

‘এমন কেন করলি মনা? তুই বিয়ে করবিনা এ কথা আমায় একবার বলতি। মা কি মরে গেছি? আমি বেঁচে থাকতে তোকে কেন এভাবে পালিয়ে থাকতে হবে শুনি? এত নিষ্ঠুর ভাবিস তুই আমায়?’

আমার চোখ পানিতে ভরে উঠেছে। অপরাধ বোধে মনটা হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠছে। সত্যিই তো আমি তাদের কাউকেই আমার মতামত জানাইনি। একবার অন্তত জানানো উচিত ছিলো। মা এখনো কাঁদছেন। আমি জবাব দেওয়ার মতো কিছু পাচ্ছি না। নিজেকে পৃথিবীর নিষ্ঠুর তম মানুষ বলে মনে হচ্ছে। তখনি বড় ভাইয়ার গলা শুনলাম। ভাইয়া পশ থেকে চিৎকার করে বলছে,

‘পুঁচকি তোর জন্য চমৎকার একটা ড্রেস কিনেছি। পুরো ছয় হাজার টাকা। তুই বললে আরো দুটো কিনে দিবো। এ মাসের স্যালারি সবটা তোর। তবুও বাড়ি আয় লক্ষিটা।’

আমি এবার ও জবাব দিতে পাড়লাম না। ঢুকড়ে কেঁদে উঠলাম। আমার কান্না হয়তো মা শুনলেন। সে নিজে কাঁদতে কাঁদতে আমায় সান্ত্বনা দেওয়ার সুরে বললেন,

‘কাঁদে না মনা। আমি তোর বিকাশে টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করছি। কালই চলে আয় না? তোর জন্য পাবদা মাছ আনিয়েছি। তোর ছোট চাচ্চু বাজার থেকে টাটকা মাছ খুঁজে এনেছে।’

বাবা মায়ের হাত থেকে ফোন নিয়ে নিলেন। ধমক দিয়ে বললেন,

‘কি শুরু করলে। এমন মরা কান্না শুরু করেছ কেন? আমি এখনো মরিনি। আর হ্যাঁ তুমি, আদ্রিতা! বাড়ি ফেরার জন্য প্রস্তুত হও। এতদিন মানুষের বাসায় থাকাটা ভালো দেখায় না। এখন রাখছি।’

ফোন কেটে গেলো। আমি সেদিন পুরো রাত কাঁদলাম। আন্টি এসে খেতে ডেকে গেলো। আমি গেলাম না। পরক্ষণে আন্টি ভাত নিয়ে রুমে আসলেন। জোর করে আমায় খাইয়ে দিলেন। এতেও আমার দুঃখ হলো খুব। আমি আন্টিকে জরিয়ে ধরে কেঁদে ফেললাম।

‘তোমায় খুব মিস করবো আন্টি। এত কেন ভালোবাসলে তুমি আমায়? এখন তোমায় ছেড়ে যেতেও কষ্ট হবে খুব।’

আন্টি হাসলেন। মত্ন করে তার শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে দিলেন।

‘কাঁদে না পাগল মেয়ে। তোমার লেখাপড়া তো এখানেই। যখন ইচ্ছা তখনি চাইলে চলে আসবে।’

আমার কান্না থামলো। সত্যিই তো তাই!

পরদিন সকালে আমার যাওয়া হলো না। আন্টিই যেতে দিলেন না। সেদিন আন্টির বিবাহ বার্ষিকী ছিলো। আন্টি ভালো মন্দ রান্না করলেন। সব ফ্লাটে খাবার দেওয়া হলো। বাড়ি ওয়ালার বাড়িতে খাবার পাঠাতে দায়িত্ব দেওয়া হলো আমাকে। আমি সাথে সাথেই রাজি হয়ে গেলাম। বাড়িওয়ালার ফ্লাট দ্বিতীয় তলায়। দ্বিতীয় তলায় একটাই ফ্লাট। পুরো ফ্লোরটাই তাদের। কাঠের বিশাল দু পাটের দরজা। আমি বেল দিলাম। আগ্রহ ভরা দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম দরজার দিকে। তখনি দরজা খুলে উঁকিদিলো কাঙ্খিত পুরুষটি। কত দিন বাদে তাকে দেখলাম! হৃৎপিণ্ডটা সেকেন্ডের জন্য হলেও থমকালো। তার মাঝে তেমন কোনো লক্ষণ দেখা গেলো না। সে তার স্বভাব মতোই হাসলো। বললো,

‘আকাশ থেকে নেমে আসা অপ্সরী আমার ফ্লাটের সামনে হাজির হলো কোন উদ্দেশ্যে?’

চলবে……..