প্রাণসখা পর্ব-০৬

0
7

#প্রাণসখা
#লাবিবা_আল_তাসফি

৬.
আমার বাড়ি ফেরা হলো না। বাবা কল দিয়েছিলেন। আন্টি পইপই করে বলে দিয়েছেন আজ অতি বিশেষ দিন। আজ কিছুতেই তিনি আমায় ফিরতে দিবেন না। বাবাও আর জোর দিলো না এ বিষয়ে। আগামীকাল ফিরে যাওয়ার জন্য বলে কল কেটে দিলেন।

রাজশাহীর বুকে বিকেল নেমেছে। মিষ্টি রোদ হেলে পড়েছে পশ্চিম দিকে। রুমের খোলা জানালা থেকে লাল হলদেটে রঙের রোদ এসে মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আমি একমনে চেয়ে চেয়ে তা দেখলাম। উঠে যেয়ে জানালা খুলে দিলাম পুরোটা। মুহূর্তেই সোনালী আলোয় ঘর ঝলমলিয়ে উঠলো। আমার ঘরে তাদের সাদরে আমন্ত্রণ করায় যেন বেশ প্রফুল্ল হয়ে উঠেছে তারা। তখনি আন্টি এলো রুমে। হাতে একটা শপিং ব্যাগ। পড়নে তখনো বাসি কাপড়। নাকে মুখে ঘাম চিকচিক করছে। কাজের চাপে গোসল করার সময় পায়নি। তিন আমার বিছানায় এসে বসলেন। মলিন মুখে বললেন,

‘কাল যাচ্ছ?’

আমি মুচকি হেসে বললাম,

‘এছাড়া উপায় নেই তো। বাবাকে তো চেনো। এরপর নয়তো বাড়ির দরজা চিরতরে আমার জন্য বন্ধ হয়ে যাবে। তাছাড়া এক্সাম ও ঘনিয়ে এসেছে। বই খাতা সব বাড়িতে। না গেলে হচ্ছেনা বললেই চলে।’

আন্টি মাথা নাড়লেন। মলিন হেসে বললেন,

‘তুমি কেন যে আমার মেয়ে হলেনা? তুমি চলে গেলে রুমটা ফাঁকা হয়ে যাবে। আমি আবারও একা হয়ে যাব। তোমায় যেতে দিতে ইচ্ছা হচ্ছে না। আবার জোর করে রেখে দেওয়ার অধিকার ও নেই আমার।’

আন্টির চোখ ছলছল করছে। আন্টির কোনো সন্তান নেই। আমায় তিনি এ কয়দিন নিজের সন্তানের মতো করে রেখেছেন। এই মানুষটাকে রেখে যেতে আমার ও কষ্ট হবে।

‘তুমি কি বোকা আন্টি! আমি যাচ্ছি অল্প দিনের জন্য। আবার তো সেই তোমার নাগালের কাছেই চলে আসবো। যখন তখন চলে আসবো তোমার হাতের রান্না খেতে। তখন বিরক্ত হলেও লাভ নেই। তোমায় বিরক্ত করা আমি এ জনমে বন্ধ করবো না।’

আন্টি হাসলো। শপিং ব্যাগটা এগিয়ে দিয়ে বললো,

‘আমার তো কোনো মেয়ে নেই তাই কখনো মেয়ের জন্য শপিং করা হয়নি। তোমাদের বয়সী ছেলে মেয়েদের পছন্দ অপছন্দ সম্পর্কে অতটাও বুঝি না। তার উপর বয়স হয়েছে। এখন কি আর অত বুঝ আছে? দেখ তো কেমন কিনেছি।’

আমি মুচকি হেসে ব্যাগ খুললাম। ভেতরে সুতার কাজ করা চমৎকার একটা শাড়ি। আসমানী এবং গাঢ় নীলের কম্বিনেশনের শাড়িটা চোখ ধাঁধানো। আমি আপ্লুত হলাম। আন্টিকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বললাম,

‘কে বলেছে তুমি বুড়িয়ে গেছ? তোমার চোখ তো এখনো কুড়ির ঘরে আটকে আছে।’

_____________

রোদ যখন একদম বিলীনের পথে তখন আমি ছাদে গেলাম। কয়েকদিনেই এই ছাদটার মায়ায় পড়েছি। এই যে ফুল, মাথার উপরে এক খন্ড আকাশ, মৃদু হাল্কা বাতাস সবই যেন এ বাড়ির একটা অংশ। ছাদটা অধিকাংশ সময় ফাঁকা পড়ে রয়। এ বাড়ির কেউই খুব একটা আসা যাওয়া করে না এখানে। এজন্য বোধহয় ছাদটাও আমায় আপন করে নিয়েছে।

‘আপনায় উদাসিনী লাগছে। কারণ কি?’

আমি না ঘুরেও কন্ঠের মালিককে চিনতে পারলাম। না চিনে উপায় নেই। আমার ধ্যান জ্ঞান সব যে এই ব্যক্তিতেই আটকে আছে।
স্বচ্ছ বিশাল এক বালতি হাতে ছাদে এসেছে। ছাদের এক কোনে পানির কল থেকে বালতিতে পানি ভরতে দিয়েছে।

‘গাছগুলো আপনার?’

‘বলতে পারেন। তবে আমি খুব একটা যত্ন নেই না। পানি দেওয়া, যত্ন নেওয়া এসব মায়ের কাজ। নিজের যত্ন নিতেই সময় হয়না সেখানে গাছের যত্নের কথা ভাবা বিলাসিতা।’

স্বচ্ছ লাল রঙের মগে করে গাছে পানি দিচ্ছে। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি। স্বচ্ছ আমার দিকে না তাকিয়েই বললো,

‘আপনি আজকাল অনেক বেশি আমায় নজরে রাখছেন অতিথি। আমার এখন কি ভাবা উচিত? আপনি প্রেমে পড়েছেন নাকি ভালোবেসে ফেলেছেন?’

‘দুটোর মাঝে পার্থক্য আছে কি?’

‘অবশ্যই। প্রেমে যখন তখন পড়া যায়। যেকোনো বয়সে পড়া যায়। আপনি আপনার ষাট বছর বয়সেও নির্দ্বিধায় প্রেমে পড়ে যেতে পারবেন। কিন্তু ভালোবাসার সংজ্ঞা আলাদা। ভালোবাসাটা হুট করে হয়না। কখনো প্রেমে পড়লেও ভালোবাসা হয়ে ওঠে না।’

আমি হাসলাম। দু পা এগিয়ে যেয়ে তার কিছুটা পাশে দাঁড়ালাম।

‘মনে হচ্ছে আপনার এ ব্যাপারে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা আছে। কখনো কাউকে ভালোবেসেছিলেন নাকি?’

স্বচ্ছ গাছে পানি দেওয়া থামিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। ঝাঁকড়া চুলগুলো হাত দিয়ে নাড়িয়ে বললো,

‘যদি হ্যাঁ বলি আপনি কি কষ্ট পাবেন অতিথি?’

আমি সোজা চোখে তাকালাম। এই লোক কখনোই সোজা ভাবে কিছু বলতে পারেনা। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে তীরটা সর্বদা আমার দিকেই তাক করবে। আমাকে অস্বস্তিতে ফেলাই যেন তার একমাত্র লক্ষ্য। আমিও তার জবাব না দিয়ে উল্ট প্রশ্ন করলাম,

‘আমি কষ্ট পেলে কি আপনি আপনার ভালোবাসার ইতিহাস বদলে ফেলবেন?’

স্বচ্ছ বিভ্রান্ত হলো না। মুচকি হেসে বললো,

‘আপনার জন্য এটুকু করতেই পারি।’

‘কেন করবেন? কারণ আছে নিশ্চই। কিংবা এমনো হতে পারে আপনি আমার মাঝে আটকে গেছেন। লেট মি আস্ক ইউ! প্রেমে পড়েছেন নাকি ভালোবেসে ফেলেছেন?’

আমি চকচকে চোখে চেয়ে আছি স্বচ্ছর দিকে উত্তরের আশায়। স্বচ্ছর দৃষ্টি শান্ত হয়ে এসেছে। কেমন ঘোর লেগে যাচ্ছে তার চোখে তাকালে। আমি শক্ত হয়ে দাঁড়ালাম। তার মুখ থেকে হ্যাঁ না দু ধরনের উত্তর শোনার জন্যই নিজেকে প্রস্তুত করলাম। স্বচ্ছ হুট করেই উত্তর দিলো না। সময় নিলো। চোখ থেকে চশমা খুলে চশমার গ্লাস গেঞ্জিতে মুছলো। পুনরায় তা চোখে দিয়ে আমার দিকে ফিরলো। বললো,

‘আমি কেন চশমা পড়ে থাকি জানেন?’

‘স্পষ্ট দেখতে সমস্যা বলে নয়?’

‘সবাই তেমনটাই ভাবে। কিন্তু আমার চোখের দৃষ্টিশক্তি ঠিকঠাক রয়েছে। আমি কেবল নিজেকে লুকাতে এ পথ বেছে নিয়েছি। কেউ চাইলেই আমার চোখে তাকিয়ে আমার ভেতর পড়ে ফেলতে পারে না। তবে আমি আপনায় একটা সুযোগ দিতে চাই। নিজেই উত্তর খুঁজে নিন!’

স্বচ্ছ পুনরায় চোখ থেকে চশমা খুলে মাথা ঝুকলো। আমার নিকটে। আমাদের মাঝের দূরত্বও ক্রমশ হ্রাস হয়ে এলো। স্বচ্ছর দেওয়া সুযোগটা আমি কাজে লাগাতে পারলাম না। তার অনুভূতি বুঝতে যেয়ে আমি নিজের অনুভূতি প্রকাশ করে ফেলার ভয়ে তটস্থ হলাম। দ্রুত দু পা পিছিয়ে গিয়ে বড় শ্বাস ফেললাম। স্বচ্ছ ভ্রু বাঁকালো।

‘কি হলো?’

‘আপনার নিজেকে লুকানোর এত পরিশ্রম বৃথা হতে দিতে পারি না।’

‘সত্যিই কি তাই?’

‘আপনি বেশি ভাবছেন।’

স্বচ্ছ হাসে। ইতিমধ্যে আকাশ আঁধারে ছেয়ে এসেছে। সন্ধ্যা আজান পড়ে গেছে। স্বচ্ছ আমার দিকে না তাকিয়েই বললো,

‘মাথায় কাপড় দেন অতিথি। সন্ধ্যায় খোলা চুলে থাকাটা ভালো না।’

আমি তার কথা শুনলাম। ওড়নার এক কোনা তুলে সযত্নে চুল ঢেকে দিলাম। আমাদের মাঝে আর কথা হলো না। নিরবে কিছু সময় কাটলো। ছাদ থেকে নামার সময়ে আমি নিজ থেকে তাকে জানালাম,

‘কাল ফিরে যাচ্ছি। আর হয়তো দেখা না হতে পারে।’

স্বচ্ছর প্রতিক্রিয়া তেমন জোরালো দেখালো না। সে ভিষণ স্বাভাবিক ভাবে মাথা দোলালো। মুখে বললো,

‘আচ্ছা। সাবধানে যাবেন।’

আমার এত কষ্ট হলো! ব্যাস এতটুকুই? আরো কিছু বলতে পারতো। সামান্য মন খারাপ হওয়াটা কি উচিত ছিলো না? আমার চলে যাওয়াটা কি এতটাই স্বাভাবিক তার কাছে? বুকে যন্ত্রণা চেপেও মুচকি হাসলাম। সে মুহূর্তেই তার উপর থেকে নিজের সেধে বাড়িয়ে দেওয়া প্রেমের দাবি তুলে নিলাম। বুঝে নিলাম এই মানবটা কখনোই আমার হওয়ার নয়। সে আমার জন্য নয়। আমরা দুজন দুজনের জীবনে কেবল অতিরিক্ত একটা অধ্যায়। যা নিছক অপ্রয়োজনীয়।

তৃতীয় তলায় এসে আমি থামলাম। আমার গন্তব্য এখানেই সমাপ্ত। স্বচ্ছদের ফ্লাট দ্বিতীয় তলায়। আমি তাকে কিছু বলা ছাড়াই ফ্লাটের দরজা খুলে যেতে নিলে স্বচ্ছর কথায় থেমে গেলাম।

‘অপরিচিত কাউকে খুব বেশি ভরসা করবেন না। সবাই কিন্তু ‘ইমতিয়াজ আরফিন স্বচ্ছ’ নয়।’

কথাটা বলেই সে দ্রুত পায়ে নেমে গেলেন। একবার ও পেছনে ফিরে তাকালেন না। আমি তাকে যেতে দেখলাম। সাথে দেখলাম আমার প্রথম প্রেমকে হারিয়ে যেতে। গভীরে, ভিষণ গভীরে। ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

চলবে……..