#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২৭।
জুম্মার নামাজ শেষ হতে না হতেই মহলের বাইরে গ্রামবাসীর ভিড় নামে। পুরুষেরা খেয়ে চলে গেলেও, নারী জাতির আবদার, তারা নতুন বউ দেখবে। তনুকা মহলের ভেতর। বসার ঘরে বড়ো কেদারা এনে তার আসন করা হয়েছে। সেই আসনে বসার পর থেকেই, নিজেকে কোনো অংশে কোনো রাজ্যের রাণীর চেয়ে কম মনে হচ্ছে না যেন। মহিলারা আসছে, একে একে দেখছে। প্রশংসায় ভাসছে সকলে। নতুন বউ তাদের কাছে কোনো হুরের চেয়েও কম কিছু না।
মেহতাব খাবারের আয়োজন দেখছে। গ্রামবাসী সকলের মুখে তৃপ্তির হাসি। বিরিয়ানির গন্ধে মৌ মৌ করছে চারদিক। সকলে পেট পুরে খাচ্ছে। এই বিরিয়ানির মাংসের স্বাদ যেন অমৃতের ন্যায়। সকলের ভাবমূর্তি দেখে খুশি হয় মেহতাব। গ্রামের মানুষদের চোখে মুখে খুশি দেখলে, খুশি আসে তার বক্ষঃস্থলেও।
_______
বড্ড শখের এই লাল জামা। উচ্চতায় তার থেকেও দুই তিন ইঞ্চি বেশি। যার দরুন এখন মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। রেনু হাঁটুর কাছের অংশটা দুহাতে চেপে ধরে অল্প উপরে তুলে। তারপর ছোট ছোট পায়ে বেরিয়ে আসে মহল ছেড়ে। সারাদিনের ব্যস্ততায় ইশফাককে একবারও দেখা হয়নি তার। জরুরি তলপে এখন তাকে দেখা প্রয়োজন। সে ধীর পায়ে বাগানের পেছনে আসে। সামনে সামিয়ানার ভেতর পুরুষ মানুষের ঢল। সেখানে সে কোনোভাবেই যেতে পারবে না। ভাইজান দেখলে তার জান নিবে। সে দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ। হঠাৎ ভেতর থেকে একটি ছেলেকে বেরিয়ে আসতে দেখে খুশি হয়; তাকে হাত উঠিয়ে ডাকে। ছেলেটা এগিয়ে এসে বলে,
‘কিছু লাগব, আপা?’
‘ভেতরে ইশফাক ভাই আছেন?’
‘জি, আছেন তো।’
‘উনাকে গিয়ে বলুন, কেউ একজন বাইরে ডাকছেন উনাকে। খুবই জরুরি। আর শুনুন, কানে কানে বলবেন, কেউ যেন টের না পায়।’
‘জি, আইচ্ছা।’
ছেলেটা ভেতরে যায়। রেনু দাঁড়িয়ে রয় ঠাই। সময় বয়ে যায় কয়েক ক্ষণ। ইশফাকের দেখা মেলে না। সে ক্ষিপ্ত হয়। ভাবে, একবার দেখা দিলে কী হয়? এত পাষাণ কেন উনি?
তার কষ্ট প্রশমিত করতেই সেখানে ততক্ষণাৎ আগমন ঘটে ইশফাকের। লাল রঙের পান্জাবীতে চমৎকার লাগছে তাকে। রেনু বিস্ময় নিয়ে চেয়ে বলে,
‘আপনি আমার সাথে মিলিয়ে পরেছেন?’
ইশফাক নিজেকে একবার খেয়াল করে বলে,
‘মোটেও না। ভাইজান কাল শপিং করার সময় আমার জন্য এই পাঞ্জাবীটা কিনেছিলেন। বলেছিলেন, আজকে পরার জন্য; তাই পরেছি।’
রেনুর মুখে স্বচ্ছল হাসি উবে যায়। মনঃক্ষুন্ন হলো তার। বলল,
‘আমাকে কেমন লাগছে?’
‘ভালো।’
‘শুধু ভালো?’
‘এর থেকে বেশি প্রশংসা করতে আমি পারি না।’
রেনু বিরক্ত গলায় বলল,
‘পারেনটা কী আপনি?’
‘আপনার ভাইজানের সব হুকুম মানতে।’
‘হ্যাঁ, ঐ একটা কাজ ছাড়া আপনার দ্বারা আর কিছুই সম্ভব না।’
‘এখানে আসাটা আপনার উচিত হয়নি। ভেতরে আপনার ভাইজানও আছেন।’
‘তাতে কী? আমি কাউকে ভয় পায় নাকি?’
ইশফাক ভ্রু উঁচিয়ে রগড় সুরে বলে,
‘তাই? কাউকে ভয় পান না? ভাইজানকে ডাকব?’
‘এই, একদম ভয় দেখাবেন না। আমার আপনাকে দেখতে ইচ্ছে করছিল, তাই এসেছি।’
‘সবসময় কেবল নিজের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিলে বিপদে পড়বেন।’
‘পড়লে পড়ব।’
‘আপনি বড্ড অবুঝ। অবশ্য আপনার যা বয়স, এই বয়সে এসব কিছু স্বাভাবিক।’
‘সবসময় বয়স নিয়ে কথা বলবেন না তো। আমার বয়সে আমার সহপাঠী কয়েকজন বিয়ে করে এক বাচ্চার মাও হয়ে গিয়েছে, আর আপনি এসেছেন বয়সের দোষ ধরতে।’
ইশফাক ক্ষীণ হাসে। এতই ক্ষীণ যে রেনু তার হাসিও ধরতে পারল না। ইশফাক বলল,
‘ভেতরে যান। আপনার জন্য আমি কোনো ঝামেলায় পড়তে চাই না।’
‘এত ভীতু কেন আপনি?’
‘এমনিতেই। ভেতরের যান।’
রেনুর মন খারাপ হয় ভীষণ। রাগও হয় কিঞ্চিৎ। কোথায় ভেবেছিল, তার এই লাল পরীর সাজ দেখিয়ে আজ ইশফাককে কুপোকাত করে দিবে, তা না লোকটা তাকে আমলেই নিল না। মাত্রাধিক বিষন্ন হলো সে। ফের জামা ধরে উপরে তুলে চলল মহলের দিকে। ইশফাক ডাকল তাকে। রেনু ভ্রু কুঁচকে ফিরে চাইল। বলল,
‘আর কোনো জ্ঞান দেওয়া বাকি আছে?’
জবাব না দিয়ে এগিয়ে আসে সে। পাঞ্জাবীর পকেট হাতড়িয়ে বের করে আনে একটা পাথরের সেট। রেনুর চোখের সামনে তা ধরতেই সে চমকে যায়। এটা সেই নেকলেসটা যেটা রেনু দোকানে পছন্দ করেও আর কিনেনি। ইশফাক এটা তাকে দিয়ে বলে,
‘এটা আপনার জন্য।’
রেনুর চোখ মুখ খুশিতে ঝলমলিয়ে ওঠে। সে আপ্লুত সুরে বলে,
‘আমাকে পরিয়ে দিন।’
‘আমি?’
ইশফাক ইতস্তত বোধ করে। রেনু খুশি হয়ে বলে,
‘হ্যাঁ, পরিয়ে দিন।’
সে ঘুরে দাঁড়ায়। এক হাতে ঘাড় থেকে চুলগুলো সরিয়ে আনে এক পাশে। জামার গলা পেছনে বড়ো। উন্মুক্ত ফরসা পিঠ দৃশ্যমান। ইশফাক চোখ নামায়। একরাশ অস্বস্তি নিয়ে নেকলেসটা সামনে থেকে এনে পেছনে আটকে দেয়। তারপর বলে,
‘হয়ে গিয়েছে।’
চুল ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায় রেনু। নেকলেসটায় একবার হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘এবার কেমন লাগছে আমায়?’
‘ভালো।’
‘আবারও শুধু ভালো?’
‘হ্যাঁ।’
রেনু নাক মুখ কুঁচকে বলে উঠে,
‘আপনি আসলে ভীষণ তিক্ত এক জীব। উপরওয়ালা জানেন, কী দেখে যে আপনার প্রেমে পড়েছিলাম।’
বলেই হাঁটা ধরে সে। আর দাঁড়াবে না। যদিও এখন আর মন খারাপ নেই। মানুষটা কত যত্ন করে তার জন্য এটা কিনেছেন, আবার পরিয়েও দিয়েছেন। ভালো না বাসলে এতকিছু করত বুঝি?
________
অর্ধেকের বেশি মানুষের খাওয়া শেষ। দমে দমে বিরিয়ানির পাতিল বসানো হচ্ছে। মহলের বিরিয়ানি অনেক আগেই পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে মহলে। বাইরে থেকে আর কোনো বিরিয়ানি ভেতরে যাবে না।
দুপুর বারোটায় চেয়ারে বসেছিল তনুকা। এখন তিনটা বাজতে চলল। দুই ঘন্টার উপরে টানা এক জায়গায় বসে আছে সে। কোমর যেন ধরে গিয়েছে। এইদিকে বিরিয়ানির গন্ধে খিদাও বাড়ছে তার। অথচ আম্বিরা বেগমের অনুমতি বিহীন খেতেও পারছে না। আম্বিরা বেগম তো কেবল নামে চাবি দিয়ে দায়িত্ব দিয়েছেন তাকে, এখনও মহলের ভেতরে সব তাঁর হুকুমেই চলে। তা নিয়ে অবশ্য তনুকার কিছুই যায় আসে না। এই মহল, এই ক্ষমতা, এই সম্পত্তি কোনোকিছুতেই তার কোনো আগ্রহ নেই। যেটাতে আগ্রহ আছে, সেটাও যে কখনো তার হবে কি না সে ব্যাপারে নিশ্চিত নয়। তাই এখন অতসব না ভেবে কেবল এক প্লেট বিরিয়ানি খেয়ে পেট ঠান্ডা করতে চায় সে।
রেনু ফের বাইরে আসে। তার বেহায়া মন যেন আজকে একটু বেশিই বেহায়াপনা করতে চাইছে। অন্দরে প্রবেশের প্রধান ফটকের কাছে দাঁড়িয়েছে সে। অস্থির দৃষ্টি ঐ দূরের সামিয়ানার ভেতরে, ইশফাকের খোঁজে। এর মাঝেই দুজন ছেলে এক বিশাল মাংসের পাতিল নিয়ে সেদিক দিয়ে পা বাড়ায়। সেই পাতিলে আবার বড়ো করে লেখা, “গ্রামবাসীর বিরিয়ানির মাংস।” রেনু পাতিলের ভেতরে লাল লাল মাংস দেখে আর লোভ সামলাতে পারে না। ওদের ততক্ষণাৎ দাঁড় করিয়ে বলল,
‘আমি এখান থেকে একটা মাংস খাই?’
‘জি আপা, খান। সব তো আপনাদের জন্যই।’
রেনু খুশি হয়ে এক টুকরো মাংস মুখের সামনে তুলতেই আচমকা এক হাত সজোরে ধাক্কা দিয়ে তার সেই হাতের মাংসটা ফেলে দেয়। আকস্মিক এমন ঘটনায় ভড়কে যায় সে। চকিতে উপস্থিত সেই হাতের মালিকের দিকে তাকায়। ইশফাককে দেখে আরেকদফা চমকায় সে। জিজ্ঞেস করে,
‘মাংসট ফেলে দিলেন কেন?’
ইশফাক সেই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে উল্টো সেই ছেলে দুটোকে ধমকে উঠে বলল,
‘ভাইজানের হুকুম অমান্য করছো কোন সাহসে? ভাইজান বলেছেন না, গ্রামবাসীর জন্য রান্না করা মাংস মহলের কাউকে যেন দেওয়া না হয়। তবে কোন সাহসে উনাকে খেতে দিচ্ছিলে?’
রেনু হতভম্ব হয় এই কথা শুনে। ছেলে দুটো নত মস্তিষ্কে বলে উঠে,
‘ক্ষমা করবেন সাহেব, উনি চাইছিলেন তাই…’
‘সবকিছুর ঊর্ধ্বে ভাইজানের হুকুম। তারপর অন্যকিছু। যাও এখান থেকে। ঐদিকে বাবুর্চি মাংসের জন্য অপেক্ষা করছে।’
ছেলে দুজন দ্রুত স্থান ত্যাগ করে। রেনু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘এটা কেমন ব্যবহার? আমি এখান থেকে এক টুকরো মাংস খেলে ভাইজান নিশ্চয়ই মেরে ফেলতেন না। আশ্চর্য! আপনি এমন কেন করলেন?’
‘আপনার ভাইজানের হুকুম তাই।’
‘সামন্য মাংসের উপর এত হুকুমদারি কেন?’
‘জানি না আমি। তবে এইটুকু জানি, গ্রামবাসীর মাংস মহলের কাউকে খেতে দেওয়া হবে না। আর ভাইজানের হুকুমের বিরুদ্ধে না যাওয়াই ভালো।’
রেনু কপাল কুঁচকাল। বলল,
‘এমন অদ্ভুত হুকুম ভাইজান কেন দিলেন?’
‘এতকিছু জেনে আপনার কোনো লাভ নেই। অন্দরে তো মাংস বিরিয়ানি পাঠানো হয়েছে সব, সেখান থেকে খান গিয়ে।’
ইশফাক চলে আসে। রেনু হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে রয় কিছুক্ষণ। তার মাথাতেই ধরে না, “ভাইজান এমন অদ্ভুত হুকুম কেন দিল? বউমনি কি এই নিয়ে কিছু জানে? তাকেই না হয় একবার জিজ্ঞেস করা যাক।’
রেনু অতঃপর ছুটল, “বউমনি, বউমনি” ডেকে ডেকে।
চলবে….
#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২৮।
তনুকার মুখে এতক্ষণে কিছু পড়েছে। বিরিয়ানির এক লোকমা মুখে তুলতেই মনে হলো, অমৃতের স্বাদ আস্বাদন করছে সে। কী দারুণ হয়েছে! খুদা পেটে তো সব খাবারই অসাধারণ লাগে, তারউপর বিরিয়ানি তার প্রিয়। সে পরপর কয়েক লোকমা খেয়ে একটু স্থির হয়। এক গ্লাস পানি ঢকঢক করে গিলে আবার বাকি খাওয়ায় মনোযোগ দেয়।
দরজাটা শব্দ করে খুলে যায়। আচমকা শব্দে চমকে তাকায় তনুকা। রেনু হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। তাকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে তনুকা জিজ্ঞেস করে,
‘তুমি খেয়েছ, রেনু?’
‘আর খাওয়া! তোমার সাথে একটা জরুরি কথা বলার আছে।’
তনুকা খাওয়া ফেলে পূর্ণ মনোযোগে তাকে দেখে বলে,
‘কী কথা? বলো।’
রেনু পা তুলে বিছানায় বসে। তারপর কিছু সময় পূর্বে ঘটে যাওয়ার ঘটনার বিশদ আলোচনা করে। উদ্বিগ্ন কন্ঠে প্রশ্ন করে,
‘ভাইজানের এমন অদ্ভুত হুকুমের কারণ তুমি কি জানো, বউমনি?’
তনুকাও নিজেও অবাক সব শুনে। মাথা নাড়িয়ে বলে,
‘না, আমি তো এসব কিছুই জানি না। শুনে অবাক লাগছে। তোমার ভাইজানের কাছ থেকে জানতে হবে।’
‘আচ্ছা। তুমি জেনে আমাকেও জানিও।’
‘ঠিক আছে, এখন গিয়ে আগে খেয়ে নাও।’
রেনু উঠে দাঁড়াল। চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই তনুকা ফের ডেকে বলল,
‘তোমার গলার নেকলেসটা সুন্দর। কবে কিনলে?’
রেনু মিষ্টি হেসে স্বলজ্জ সুরে বলে,
‘কিনিনি তো। ইশফাক উপহার দিয়েছেন।’
তনুকা হেসে বলে,
‘বাবা, তাই। সুন্দর হয়েছে তো।’
‘হু, কাউকে বলো না কিন্তু।’
‘আচ্ছা, বলব না।’
রেনু রুম ছাড়ে। তনুকার বিরিয়ানির প্লেটটা হাতে নেয়। একটা মাংসের টুকরো হাতে নিয়ে ভালোমতো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে বলে,
‘আশ্চর্য, বিরিয়ানির মাংস আলাদা কেন?’
___________
সবার খাওয়া দাওয়া শেষ। তবে মেহতাব এখনও খায়নি। সকল গ্রামবাসী আজ পেট পুরে খেয়ে গিয়েছেন। মেহতাবের আত্মতৃপ্ত হয়েছে তাতে। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে খাইয়েছে সকলকে। বিরিয়ানির প্রশংসা ছিল সকলের মুখে মুখে। এমন স্বাদ যে, আগামী এক বছরেও এই স্বাদ জিভ থেকে যাবে না।
বাইরের সব কাজ মিটিয়ে অন্দরে ফেরে মেহতাব। মহলের ভেতরের পরিবেশও এখন বেশ শান্ত। আম্বিরা বেগম তাকে দেখে ছুটে এলেন। বললেন,
‘বাবা, জলদি গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে খেতে এসো। সারাদিন কিচ্ছু পেটে পড়েনি, খুব কষ্ট হয়েছে তাই না?’
মেহতাব হেসে বলে,
‘না আম্মা, গ্রামের মানুষদের খাওয়াতে পেরেছি, তাতেই আমার অন্তর শান্তি।’
‘এইজন্যই তোমাকে নিয়ে আমার এত গর্ব।’
মেহতাব এদিক ওদিক চেয়ে বলে,
‘তনু কি ঘরে?’
‘হ্যাঁ। সেই যে বিকেলে ঢুকেছিল, আর বের হয়নি।’
‘খেয়েছে ও?’
‘তো কি তোমার জন্য না খেয়ে থাকবে? সবার আগেই খেয়ে নিয়েছে।’
‘আহা! এভাবে বলছেন কেন, আম্মা। আমি তো চাই না, ও আমার জন্য না খেয়ে থাকুক।’
‘আচ্ছা হয়েছে, এখন গিয়ে হাতমুখ ধৌও। আমি বিরিয়ানি তোমার ঘরেই পাঠাচ্ছি।’
‘ঠিক আছে।’
ঘরে এসে মেহতাব দেখল আলো নেভানো। অন্ধকার কক্ষে কারোর নিশ্বাসের শব্দও ঠাহর করা যাচ্ছে না। মেহতাব আলো জ্বালাল তাই। দেখল, খাটে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন তার বিবিজান। প্রসন্ন হাসল মেহতাব। তনুকার দিকে এগিয়ে এসে বিছানায় বসল। গায়ের ভারি শাড়ি গয়না খুলে সুতি গামিজ জড়িয়েছে। মুখের উপর প্রসাধনীর রেশ মাত্র নেই। নিরেট শূন্য মুখ, তাও ভীষণ চিত্তাকর্ষক ঠেকছে মেহতাবের নিকট। সে সপ্রতিভ ভঙিতে এগিয়ে এসে ঠোঁট ছোঁয়ায় তনুকার কপালে। তারপর দুই চোখের পাতায়। সঙ্গে সঙ্গেই চোখ মেলে তাকায় তনুকা। ঘুম জড়ানো কন্ঠে শুধায়,
‘আমার ঘুমের সুযোগ নিচ্ছেন বুঝি?’
মেহতাব ঠোঁট ছড়িয়ে হাসে। জিজ্ঞেস করে,
‘তোমার কি তাই মনে হয়, বিবিজান?’
‘আপনার কাজ তো তাই প্রমাণ করছে।’
‘ক্লান্ত ভীষণ। একটু স্বস্তি পেতে এসেছিলাম।’
‘আমার মাঝে স্বস্তি খুঁজে লাভ নেই, পাবেন না।’
‘যদি বলি, অবশ্যই পাব।’
তনুকা উঠে বসে। ম্লান হেসে বলে,
‘আমি বলছি তো, সম্ভব না।’
‘মেহতাব মজুমদারের নিকট অসম্ভব বলে কোনো কাজ নেই।’
তনুকা আর ঘাটাল না। প্রশ্ন করল,
‘খেয়েছেন?’
‘না।’
‘ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নিন।’
মেহতাব উঠে ফ্রেশ হতে যায়। গায়ের পাঞ্জাবী পাজামা ছেড়ে একটা ট্রাউজার প্যান্ট আর টি-শার্ট পরে আসে। মেহতাবকে এমন ভাবে খুব একটা দেখা যায় না। সারাক্ষণ পাঞ্জাবী পাজামাতেই থাকে। আজ এই পোশাকে অন্যরকম লাগছে। এতদিনের পুরোদস্তুর সুদর্শন পুরুষকে এখন সদ্য পঁচিশে পা দেওয়া এক উদ্দীপ্ত তরুণ লাগছে। তনুকার দৃষ্টি বেহায়া হয়। তাকে আগাগোড়া মেপে নেয়। নিজের এমন লাগামহীন দৃষ্টিতে বড্ড বিরক্ত সে। চোখ নামিয়ে নিচে তাকায়। মেহতাব তার শিউরে বসেছে। তনুকার নিমজ্জিত দৃষ্টি দেখে জিজ্ঞেস করে,
‘কী ব্যাপার, তাকাচ্ছো না যে?’
তনুকা জবাব দেয় না। এর মাঝেই এক ভৃত্য বিরিয়ানির প্লেট রেখে যায়। সাথে পানি আর সালাত। মেহতাব ট্রে থেকে প্লেট নিয়ে তনুকার সামনে রাখে। স্বগতোক্তি করে বলে,
‘খাইয়ে দাও তো, বিবি।’
তনুকা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। বলে,
‘আমি কেন? আপনার হাত নেই?’
‘নিজের হাতে খেতে ইচ্ছে করছে না। তার উপর সারাদিনের এত কাজের পর এখন আর গায়ে এইটুকুও শক্তি নেই যে, নিজ হাতে খাব।’
তনুকার মায়া হলো। নিজ চোখে সে মানুষটাকে সকাল থেকে খাটতে দেখেছে। তাই ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও মানবতার টানে খাবারের প্লেটটা হাতে তুলে নিল। লোমকা তুলল মেহতাবের মুখের সামনে। মেহতাব খুশি হয়ে সঙ্গে সঙ্গে মুখে নিল খাবার। সারাদিনের ক্লান্তি যেন তার এক নিমিষেই ধুয়ে গেল তাতে।
তনুকা মনোযোগ সহিত খাওয়াচ্ছে মেহতাবকে। তার দৃষ্টি খাবারের প্লেটের দিকে থাকলেও, মেহতাবের নিমিষ দৃষ্টি তার দিকেই তাক করা। তনুকা আরেকবার লোকমা দিয়ে বলল,
‘একটা কথা বলব?’
মুখ ভরা খাবার নিয়ে মেহতাব কেবল ছোট্ট করে “হু” বলল। তনুকা জিজ্ঞেস করল,
‘বিরিয়ানির মাংস আলাদা করেছিলেন কেন?’
এমন প্রশ্নে মেহতাবের কপালে ভাঁজ পড়ে। মুখের খাবারটা গিলে বলে,
‘এটা তো সবসময়ই করি। অন্দর আর গ্রামের জন্য আলাদা আলাদা হিসেবে মাংস করা থাকে, তাই। আমি যতবার গ্রামের মানুষ খাইয়েছি, এই নিয়মেই করেছি। যেন, হিসেবে গোলমাল না হয়।’
মেহতাবের উত্তরে কোনো জড়তা নেই। তনুকা আরেক লোকমা তার মুখে দিয়ে বলল,
‘আপনার সহকারীটা বোধ হয় আপনাকে একটু বেশিই ভয় পায়।’
মেহতাব প্রশ্ন করার আগেই তনুকা প্রশ্নের ধাঁচ বুঝতে পেরেই উত্তর দেয়,
‘গ্রামবাসীর জন্য আলাদা করা মাংস থেকে রেনু একটা মাংসের টুকরো খেতে চেয়েছিল, উনি নাকি সেটুকুও খেতে দেননি। বেচারি রাগ করে এসে বিচার দিয়েছে আমাকে।’
মেহতাব খাবার শেষ করে বলে,
‘ইশফাক আমার খুব বাধ্য। আমি বলেছিলাম, গ্রামবাসীর খাওয়া শেষ না হওয়া অবধি উনাদের মাংস যেন মহলবাসী কাউকে খেতে না দেওয়া না হয়। এতে খাবার শর্ট পড়ার একটা সম্ভবনা থেকে যায়, তাই হয়তো ও এমনটা করেছে।’
‘এক টুকরো মাংস খেলে নিশ্চয়ই খাবার শর্ট পড়ে যেত না?’
‘হ্যাঁ, সেটাই তো। ও হয়তো বুঝতে পারেনি; আমি বুঝিয়ে বলব ওকে।’
মেহতাবের খাওয়া শেষ। সে মুখ ধুয়ে এসে তনুকার ওড়না টেনে মুখ মুছে। বিরক্ত হয় তনুকা। ওড়না টান দিয়ে সরিয়ে নেয়। মেহতাব গা এলিয়ে দেয় বিছানায়। চোখ জুড়ে রাজ্যের ঘুম তার। তনুকা ততক্ষণে খাবারের প্লেটগুলো নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গিয়েছে। প্লেট সব গুছিয়ে রেখে সে রেনুর ঘরে যায়। এবার আর দরজায় টোকা দেয় না। রেনুই নিষেধ করেছিল তাকে।
ঘরে গিয়ে তাকে পায় পড়ার টেবিলে। তনুকা চুপি চুপি পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। মেয়েটাকে দেখে, বইয়ের ভাঁজে লুকিয়ে ইশফাকের দেওয়া সেই হারটাকেই দেখছে। তনুকা কিঞ্চিৎ হাসে। বলে উঠে,
‘দেখতে দেখতে নিশ্চয়ই হারে কয়টা পাথর আছে সেটাও মুখস্থ হয়ে গিয়েছে?’
অকস্মাৎ কারোর গলার স্বর পেয়ে ধরফরিয়ে উঠে রেনু। বইটা বন্ধ করে দেয় সঙ্গে সঙ্গে। পরে তনুকাকে দেখে নিশ্বাস ফেলে। আরেকটু হলেই দম আটকে মারা যাচ্ছিল। বুকে থু থু দিয়ে বলে উঠে,
‘ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে, বউমনি।’
তনুকা হাসতে হাসতে টেবিলের আরেক চেয়ারে বসে। বলে,
‘তোমার এই ইশফাক বাবু তো বড্ড ভীতু।’
তারপর সে মেহতাবের বলা কথাগুলো খুলে বলে। রেনু মাথায় হাত দিয়ে বসে সব শুনে। আফসোস নিয়ে বলে,
‘ভাইজান হুকুম দিয়েছিলেন বলে, এক টুকরো মাংসও উনি আমাকে খেতে দিলেন না? আশ্চর্য, এই লোকটা এত আহাম্মক কেন? আমি খেয়েছি জানলে, ভাইজান নিশ্চয়ই রাগ করতেন না?’
‘একদমই না। বরং তোমাকে তখন খেতে না দেওয়াতে ইশফাক ভাইয়ের উপর উনি এখন রাগ করেছেন।’
‘বেশ হয়েছে। এবার ভাইজান গিয়ে উনাকে আচ্ছা মতো শুনিয়ে আসুক, আমি খুশি হবো।’
‘তাই আর…’
তনুকা বাকি কথা শেষ না করেই থেমে যায়। হঠাৎই কারোর কান্নার শব্দে বুকে মোচড় দেয় তার। কেউ একজন বিকট শব্দে কাঁদছেন। ততক্ষণে রেনুর কানেও সেই শব্দ চলে আসে। এক সেকেন্ড সময় নিয়ে রেনু চেঁচিয়ে উঠে বলে,
‘বউমনি, আম্মা এভাবে কাঁদছেন কেন?’
চলবে…..