প্রিয় নিবেদিতা পর্ব-০১

0
371

#প্রিয়_নিবেদিতা🖤
#লেখিকাঃ #ইশা_আহমেদ
#সূচনা_পর্ব

“অরিন! অরিন দাঁড়াতে বলেছি আমি। তুমি যদি এক সেকেন্ডের মধ্যে না দাঁড়াও তাহলে কিন্তু আজ আর বাড়িতে যেতে পারবে না। এবার ভেবে দেখো কি করবে”

অরিনের পা থেমে গেলো। কলেজ ব্যাগটা শক্ত করে চেপে ধরলো সে। সে বুঝতে পারেনি আজ তাকে এমন পরিস্থিতিতে পরতে হবে। কেনো যে সে এই জল্লাদের সামনেই পরলো আজ। বলিষ্ঠ পুরুষটি তার সামনা সামনি এসে দাঁড়ালো। অরিন মাথা নিচু করেই রইলো। অরিন তার থেকে বেশ খাটো হওয়ায় পুরুষটি ঝুঁকে বলল,,,

“আমার থেকে পালিয়ে বাঁচতে পারবে না অরিন রানী, তাই চেষ্টা করে লাভ নেই।”

অরিন এবার চোখ তুলে তাকালো। পুরুষটিকে এক প্রকার হুমকি দেওয়ার সুরে বলল,,,“সমস্যা কি আপনার? আপনি আমায় এতো জ্বালান কেনো? রাস্তায় মেয়ে দেখলেই বিরক্ত করতে ইচ্ছে করে?”

ধূসর নামক পুরুষটি হাসলো। এরপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,,
“রাস্তায় সব মেয়ে দেখলে বিরক্ত করতে ইচ্ছে করে না। শুধু তোমাকে দেখলে বিরক্ত করতে ইচ্ছে করে আর সাথে আরো অনেক কিছু করতে ইচ্ছে করে”

ধূসরের কথা শুনে অরিন বিরক্ত হলো। বিরবির করে বলল,,“অসভ্য লোক”

“কি বললে শুনিনি আবারও বলো মেয়ে। আর আজ এতো সাহস কোথা থেকে পেলে বলো তো। তুমি তো আমার দিকে তাকাও ই না আবার আজ হুমকি দিচ্ছো”

“এমপির ছেলে হয়ে মাথা কিনে নিয়েছেন?সহ্যের সীমা লঙ্ঘন করবেন না দয়া করে।”

“মাথা কেনো কিনবো কিনলে পুরো তুমিটাকেই কিনে ফেলবো বুঝেছো মেয়ে”

“পথ ছাড়ুন বাড়ি যেতে হবে আমার। আমার পরিবারের লোকজন চিন্তা করবে দেরি হলে”

ধূসর দুষ্টুমি করে বলল,,,
“তুমি চাইলে আমি বাইকে করে পৌঁছে দিয়ে আসতে পারি”

“আমার দু’টো পা আছে এবং আমি সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মতোই চলাফেরা করতে পারি। তাই আপনার বাইকে যাওয়ার প্রশ্নই উঠে না।”

অরিন হাঁটা ধরলো কথাগুলো বলে। ধূসর মৃদু হাসে। মেয়েটাকে রাগাতে তার একটু বেশিই ভালো লাগে। একটু না অনেক বেশিই ভালো লাগে। বাইকের কাছে এসে বাইকে উঠে বসলো। মেয়েটাকে একা সে ছাড়বে নাহ। তার প্রিয় জিনিসে কেউ চোখ তুলে তাকাক এই বিষয়টা তার পছন্দ না। তার জন্যই অরিনের পিছু পিছু সে প্রতিদিন তার অগোচরে বাড়ি অব্ধি যায়। মেয়েটা কিছু কারণ বসত তাকে পছন্দ করে নাহ। তবে সেই কারণগুলো আজও সে উদ্ধার করতে পারলো না। অরিন মাথার ওড়না টেনে মাথা নিচু করে হেঁটে চলেছে। ধূসর হাসলো। এই মেয়েটাও না কি কোন এক সময়ে চঞ্চল হরিণীর ন্যায় ছুটে বেড়াতো। সে সব ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে।

অরিনকে তার নিজ বাড়িতে প্রবেশ করতে দেখে ধূসর স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে বাইক ঘুরিয়ে নেয় ভার্সিটির উদ্দেশ্যে। ভার্সিটিতে আজ সব বন্ধুরা মিলে আড্ডা দিবে। তবে সে আজ দেরি করে ফেলেছে। কিছুক্ষণ বাদে ভার্সিটিতে পৌঁছে যায় ধূসর। বাইক রেখে বন্ধুদের দিকে এগিয়ে যায় সে। কাছাকাছি আসতেই ধূসরের প্রিয় বন্ধু উমেদ এসে বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে কানে কানে ফিসফিস করে বলল,,,

“ভাবিকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিস ঠিক মতো?”

ধূসর উমেদকে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে,,
“কেমন আছিস সবাই?”

বন্ধু মহলের একজন বলে উঠে,,,“ধূসর আমাদের তিনদিন আগেই দেখা হয়েছে তুই এমন ভাবে বলছিস যেনো আমাদের যুগ যুগ ধরে দেখা হয় না”

ধূসর নুরার কথা শুনে হেসে বলল,,,
“তেমন কিছু না। বল কেমন আছিস সবাই?”

উমেদ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে ধূসরের দিকে। ছেলেটার মতিগতি সে বুঝে উঠতে পারে নাহ। সে তো বেশ ভালো মতোই জিজ্ঞেস করলো কথাটা তবে ধূসর তা সুক্ষ্ম ভাবে এড়িয়ে গেল। সবাই একে একে ধূসরের প্রশ্নের জবাব দিলো। ধূসরদের বন্ধু মহলের সদস্য ৬ জন। চার জন ছেলে আর দু’জন মেয়ে। উমেদ,ধূসর নাফিজ, ফাহাদ,নুরা আর স্নিগ্ধা। সবাই খুব ভালো বন্ধু।সদ্য মাস্টার্স শেষ করেছে তারা। ফাহাদ বিষাদময় কন্ঠে হুট করে শুধালো,,

“নদীর বিয়ে হয়েছে শুক্রবার”

সবাই হতবিহ্বল হয়ে তাকালো ফাহাদের পানে। অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রইলো পাঁচ জোড়া চোখ। নদী তাদের থেকে বছর একের জুনিয়র। খুব ভালো মেয়ে বলেই জানতো সবাই। ফাহাদের সাথে দু’বছরের সম্পর্ক। এতো ভালো মেয়ে,ছেলেদের সাথে কথা বলতো না তার এমন কাজে যে শুনবে সেই হতভম্ব হয়ে যাবে। উমেদ নিরবতা ভেঙে বলল,,

“কি বলছিস ফাহাদ? মজা করছিস তুই আমাদের সাথে?”

ফাহাদ বিষন্ন কন্ঠে শুধালো,,
“মজা কেনো করবো উমেদ। এই ব্যাপারটা মজার না। সত্যি নদীর বিয়ে হয়েছে এবং ও নিজেও রাজি ছিলো”

ধূসর এবার মুখ খুললো। রাগে তার চোখ জোড়া লাল হয়ে গিয়েছে। ছলনা,ধোঁকা জিনিসটা সে পছন্দ করে না। নিজেকে সামলে গম্ভীর কন্ঠে বলল,,,
“তুই আগে কেনো বলিসনি আমাকে। ওই মেয়েকে তুলে নিয়ে আসতাম দরকার হলে”

“জোর করে ভালোবাসা হয় না। আমি যাকে ভালোবাসি সেই তো আমাকে চায় না। জোর করে রাখতে আমি চাই না। হয়তো সে আমার ভাগ্যে ছিলো না”

নুরা শান্তনা দিতে বলল,,“তুই মোটেও কষ্ট পাবি না ফাহাদ। ওই মেয়েটা তোকে ভালোই বাসে তবে তুই কেনো কষ্ট পাবি। জানি আমি যতো সহজে বলতে পারছি ব্যাপারটা এতোটাও সহজ নয়। তবে তুই চেষ্টা কর নিজেকে সামলে নেওয়ার। আল্লাহ হয়তো এর থেকে উত্তম কিছু রেখেছে তোর জন্য।”

ফাহাদকে কিছু সময়ের জন্য হলেও এই বিষাদময় স্মৃতি থেকে সরাতে চাইলো বন্ধুমহল। হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠলো সবাই মিলে। স্নিগ্ধা মুগ্ধ চোখে কেউ একজনকে দেখতে লাগলো। গত কয়েক বছর ধরে সে মানুষটাকে এক পাক্ষিক ভালোবেসে আসছে তবে বন্ধুত্বের খাতিরে বলে উঠতে পারলো না নিজের মনের কথা। তাই আজও লুকিয়ে লুকিয়েই দেখে যেতে হচ্ছে ভালোবাসার মানুষটিকে। অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসলো। আদেও পাবে কি তাকে? কে জানে!

“কি রে মা আজ দেরি হলো যে কলেজ থেকে আসতে?”

অরিন জুতো জোড়া খুলে একপাশে রেখে বাড়িতে প্রবেশ করলো। ব্যাগটা পুরোনো সোফাটার উপর রেখে মায়ের কাছে আসলো অরিন।মাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,,
“আজকে একটু লাইব্রেরিতে গিয়েছিলাম আম্মা তাই দেরি হয়েছে। হায়াত কোথায় ও স্কুল থেকে ফিরেনি?”

অরিন না চাইতেও মিথ্যা বলে ফেললো। অরিনের আম্মু অরুনি শেখ মেয়েকে বললেন,,
“হায়াত এখনো আসেনি। তুই বরং যা একটু বিশ্রাম নে। তারপর খেতে আয়। আবার তো বিকালে টিউশনি আছে”

অরিন সম্মতি জানিয়ে নিজের ছোট্ট রুমটায় আসলো। পর্দার ফাঁকা দিয়ে রোদ এসে পরছে ছোট্ট ঘরটায়। ঘরের বড় জানালা ঘেঁষে একপাশে কাঠের ছোট্ট একটা টেবিল। তার উপর গুটি কয়েক বইখাতা সাজানো, একটা খাট এবং একটা ছোট সাইজের আলমারি। খুব পরিপাটি করে গুছানো। অরিন নিজের কাঁধের ব্যাগটা টেবিলের উপর রেখে ঘরে রাখা দেওয়াল ঘড়িতে সময় দেখে নিলো। প্রায় একটা বাজে। ফ্রেশ হতে চলে গেলো। ফ্রেশ হয়ে এসে পর্দা টেনে শুয়ে পরলো। তার এখন বিশ্রামের প্রয়োজন। চোখ বন্ধ করতেই ধূসরের করা কাজের কথা মনে পরলো তার। তবে তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাইলো অরিন। কিছুক্ষণ ঘুমানো প্রয়োজন তার।

গোধুলি রাঙা বিকাল। ভার্সিটিতে বন্ধুদের সাথে আড্ডা শেষে বাড়ি ফিরছে ধূসর এবং উমেদ। উমেদ একটা বাইকে আর ধূসর আরেকটা বাইকে। সারাটা দুপুর বন্ধুরা মিলে আড্ডা দিয়েছে, দুপুরেও খেয়েছে ভার্সিটির ক্যান্টিনে। উমেদ প্রচুর বিরক্ত নিজের বন্ধুর খামখেয়ালি আচরণে। ছেলেটার মন বুঝে উঠতে পারে না। কখন কি করে বুঝতে পারলো না এতো বছর এক সাথে থেকেও। হঠাৎ ধূসর বাইক পাশাপাশি এনে তাকে উদ্দেশ্য করে বলে,,,

“এখন তুই সোজা বাড়ি যাবি। আন্টি আমাকে ফোন করেছিলো। তোর ফোন কোথায়? ফোন কি সাইলেন্ট করে পকেটে রাখার জন্য কিনেছিস! বাসায় যাবি এখনই আমি তোকে রাতে ফোন করে নিবো যা এখন”

“কিন্তু ধূসর আমার তো তোর সাথে কিছু কথা ছিলো!”

“রাতে শুনবো তোর সব আজাইরা কথা এখন বাড়ি যা”

ধূসর উমেদকে আর কথা বলার সুযোগ দিলো না বাইকের গতি বাড়িয়ে নিজ গন্তব্যে চলে গেলো। গন্তব্য এখন তার নিবেদিতা। খবর পেয়েছে তার নিবেদিতাকে নাকি কিছু ছেলে মিলে কয়েকদিন যাবত জ্বালাচ্ছে। সেই খবরই নিতে যাচ্ছে। তার জিনিসে চোখ তুলে তাকানোর ফল যে খুব একটা ভালো হবে না তা সবার জানা উচিত। গন্তব্যে পৌঁছে দেখলো এলাকার কিছু বখাটে অরিনের দিকে বাজে দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে। অরিন যথেষ্ট শালীনতা বজায় রেখে চললেও ছেলেগুলোর বাজে দৃষ্টিতে দেখছে।

রাগে ধূসরের শরীর কাঁপছে। তবে নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করলো। নিজেকে শান্ত করার বৃথা প্রচেষ্টা করলো। অরিন ততক্ষণে কোচিং সেন্টারে প্রবেশ করেছে। ধূসর মনে মনে পরিকল্পনা করে ফেললো ছেলেগুলোকে কিভাবে শিক্ষা দিবে। তাই এখন শান্ত দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে হাসলো। এরপর প্রিয় নারীর মুখটা কল্পনা করে আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল,,,

~❝আকাশ তোমার বুকে যেমন চাঁদের বসবাস তেমনি আমার
বুকের বাঁ পাশটায় আমার নিবেদিতার বসবাস।❞~

#চলবে~