প্রিয় পৌষমাস পর্ব-৩+৪

0
5

#প্রিয়_পৌষমাস ৩.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️

থমথমে অবস্থা বসার ঘরে। পৌষী ভয়ে চুপসে আছে। নিজের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছে। সৌরভ বেশ গম্ভীর হয়ে আছে। গভীর মনোযোগ দিয়ে কিছু ভাবছে। চিন্তায় আছে নিজের মেয়েকে নিয়ে। সে একজন ম্যাথ বিভাগীয় প্রধান অধ্যক্ষ। আর তার মেয়ে হয়েছে ফেলার। যে ক্লাস টেস্টেও ফেইল করে। এই মুখ সে কীভাবে অন্যেদের দেখাবে। মেয়েটা পড়াশোনায় এত অমনোযোগী কেন সে এটাই বুঝে না। এগারো সাবজেক্টের চার বিষয়ে সে ত্রিশের মধ্যে পনেরোর নিচে পেয়েছে। ভাবা যায়! বুজে রাখা চোখদুটো অকস্মাৎ খুলল। ইশারায় পাশে বসতে বলল পৌষীকে। গলার স্বরে কিঞ্চিৎ দৃড়তা।

‘দেখ পৌষী, তোমার আম্মু এই রেজাল্ট কার্ড দেখেনি এখনো। ভাগ্যে ভালো আমিই আগে দেখেছি। নয়ত এখন কি কান্ড হত বুঝতে পারছো?’

পৌষী ছলছল চোখে তার বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। সৌরভ ধমক দিয়ে উঠল,

‘জবাব দাও পৌষী? এত বাজে রেজাল্ট কীভাবে করলে? পড়াশোনা কি করনি, না’কি শুধু ফাঁকিবাজি করেছো?’

পৌষী নাক টানল। ঠোঁট গোল করে নিজের কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে সে। আচমকাই গৌরব উপস্থিত হল সেখানে। তার বড় পাপাকে দেখে দু’চোখের নোনা জল ছেড়ে দিয়েছে। সৌরভ অবাক! এটা আদৌ তার মেয়ে! কিছুই বলা যায় না। বলার আগেই নিজের চোখের সাগর বানিয়ে দেবে। গৌরব অস্থির হয়ে গেল। পৌষীকে নিজের কাছে বসিয়ে চোখের জল মুছলো। সৌরভের দিকে চোখ পাকিয়ে তেতে উঠল,

‘তুই আমার আম্মাজানকে বকছিস কেনো? সাহস তো কম না তোর।’

সৌরভ বিদ্রুপের সুর তুলল, ‘তোমার আম্মাজান কি করেছে জানো, ক্লাসটেস্টে চার বিষয়ে ফেইল।’

‘তো কি হয়েছে? এরকম তিন/চারটা বিষয়েও ফেইল করলে কিছু হয় না। আমিও এরকম কত ফেইল করেছি।’

‘এজন্যই তোমার আম্মাজান তোমার মতই ফেলার হয়েছে।’

পৌষী আবারও নিজের নাক টানল। গৌরবের কাঁধ ধরে বলল,
‘বড় পাপাহ, জানো পাপাহ- আম্মু আমাকে একটুও আদর করে না। সারাক্ষণই বকে। তুমি অদলবদল করে আমাকে নিয়ে যাও। আমি আর এদের সাথে থাকব না। আমি আজ থেকে তোমার মেয়ে। আর ঐ সংকর জাতীকে তোমার ভাইকে দিয়ে দাও।’

সৌরভের কৌতুহলী দু’চোখ। আচমকাই প্রশ্ন করল,
‘সংকর জাতী! সেটা আবার কে?’

পৌষী নাক টানতে টানতেই জবাব দিল, ‘ঐ আরাভটা আর কি?’

সৌরভ তীর্যক দৃষ্টি ফেলল মেয়ের দিকে। রুষ্ট গলায় জবাব দিল,
‘সংকর জাতী এটা কেমন শব্দ?’

গৌরবও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আছে। তার ছেলের এমন নাম কেন বোধগম্য নয় তার। কিঞ্চিৎ ভাবনায় মশগুল সে। ব্যাপারটা বেশ ঘোলাটে তার কাছে। পৌষী নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরল। মুখ ফসকে বলে দিয়েছে সে। এখন তার প্রফেসর বাপ কি আবার চেঁচাবে তার উপর? সৌরভ নিজমনে বিড়বিড় করল, পুরো মায়ের কপিক্যাট। তার মাও তো তাকে কম জ্বালায়নি। এ মেয়েটাও আরাভকে জ্বালিয়ে অঙ্গার করে ছাড়বে। নয়ত বংশের মুখ উজ্জ্বল করবে কীভাবে? সৌরভ বসার ঘর ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। মেয়ের দিকে একপলক তাকাল। সামান্য ধমকে এই মেয়ে কেঁদেকেটে একাকার। ধরাও যায় না ছোঁয়াও যায় না। মেয়ের শ্বশুর-শাশুড়ী এসে হাজির। বড়ই অদ্ভুত সম্পর্ক জুড়েছে সে।

গৌরব পৌষীকে নিজের রুমে নিয়ে এল। মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে বুঝিয়ে গেল অনেকক্ষণ। এবার থেকে পড়াশোনায় যেন ফাঁকিবাজি না করে। পৌষীও সায় দিল। সে এবার থেকে অবশ্যই পড়বে। তবে এবার থেকে বড় পাপাকে নিজের পাপা বলবে সে। গৌরব হাসল। তারপর রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল। সাফা পৌষীর দিকে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে আছে। তার এমন তাকানো দেখে পৌষী নাক টানা বন্ধ করে ইশারায় দরজা বন্ধ করতে বলল। সাফা দরজা বন্ধ করতে পৌষী মুখ টিপে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেল। সাফা ভ্যাবাচ্যাকা খেল। এই মেয়ের মাথায় কি সমস্যা আছে না’কি? একটু আগে কেঁদেকুটে চোখ ফুলিয়ে এল। আবার এখন দাঁত বের করে হাসছে। বিস্ময় ধরে না রাখতে পেরে জিজ্ঞেস করল,

‘তুই হাসছিস কেন পৌষী? একটু আগেই তো মরাকান্না জুড়ে দিলি দেখলাম।’

পৌষী দাঁত কেলিয়ে জবাব দিল,
‘ও তুই বুঝবি না। পাপার বকা থেকে বাঁচতে এটাই আমার নিঞ্জা টেকনিক। আর বড় পাপা তো আছেই আমাকে বাঁচানোর জন্য। দারুন না আইডিয়া!’

সাফা থ’ হয়ে আছে। ‘কিন্তু চোখে এত জল কেমনে আনলি? আমার তো মাথা ভনভন করছে।’

‘সব নিঞ্জা টেকনিক। এসব অভিনয় তো আমার বা হাতের খেল।’

সাফা আর জবাব দিল না কিছুই। এই মেয়ে মহা ধড়িবাজ।
__

নাস্তার টেবিলে সবার আগে গিয়ে বসেছে পৌষী। পাশে সাফা, আরিবা। গৌরবের পাশের চেয়ার টেনে সে তার পাশে বসেছে। সৌরভের দিকে একদমই তাকাচ্ছে না। সৌরভ আড়চোখে মেয়েকে দেখছ। এই মেয়েকে সামান্য বকলেও তখন বড় পাপার পাশে ঘুরঘুর করবে। আরাভ আসতেই দেখল তার চেয়ারে পৌষী বসে আছে। সে এসেই চোখ রাঙালো।

‘আমার চেয়ার ছেড়ে উঠো পৌষী? তোমার চেয়ার ওপাশে কিন্তু।’

পৌষী ঘাড় বাঁকা করে তাকালো আরাভের দিকে। সবার সামনে তাকে তুমি করে ডাকে। আবার পৌষী বলেও কি সুন্দর করে ডাকবে। কিন্তু যখন কেউ থাকবে না তখন বলবে ঐ পৌষমাস সর এখান থেকে। সে সুন্দর করে জবাব দিল,

‘তুমি বসবে আরাভ ভাই?’

আরাভ তীক্ষ্ণ নজরে তাকাল। সুন্দর করে তাকে আরাভ ভাই ডাকা মানে, নিশ্চয় কোন কু-মতলব আছে এর মনে। রয়েসয়ে জবাব দিল সে।

‘না বোন তুমি এখানেই বস। আমি বরং পাশের চেয়ারে বসছি।’

আরাভের বোন ডাকা শুনে সৌরভ গৌরব দু’জনেই তার দিকে তাকাল। আরাভের সাথে চোখাচোখি হতে তিনজনেই লজ্জায় শেষ। এদের কান্ডে আরাভ ফোৎ করে নিশ্বাস ছাড়ল। এখন সবার সামনে বউ ডাকবে না’কি। দুই বাপ তার জীবনটা ত্যানা ত্যানা করে দিল। এক বিচ্ছুকে তার জীবনে জুটিয়ে দিয়েছে। এই মেয়ে প্রতি মুহুর্তে তাকে ঘোল খাইয়ে ছাড়ছে। কখন কি করে তার কোন হদিস নেই। সে চুপচাপ খাওয়া শুরু করল। খাওয়ার মাঝে বুঝল তার তরকারী বেশ ঝাল হয়েছে। তাও যেনোতেনো ঝাল নয়, একবারে বোম্বে মরিচের ঝাল। খাবার রেখে ঝালে সে জ্বিহ্বা বের করে দিল।

আলিশবা ছেলের এমন কান্ডে হতবাক। এত ঝাল আসল কোত্থেকে? পানিতেও আরাভের ঝাল কমল না বরং বাড়ল। শেষে না পেরে প্রিয়া চিনির বয়াম থেকে চিনি আরাভের মুখে তুলে দিল। এদিকে হতভম্ব খাবার টেবিলের সবাই। পৌষী ভয় পেল। সে তো একটু মরিচ দিয়েছিল। কিন্তু এমন ঝাল হবে জানত না। ভয়ে তার চোখে পানি টলমল করছে। সত্যি সে জানতো না এমন হবে। এখন নিজের উপর রাগ হচ্ছে। খাবার আর মুখে দিলো না। উঠে চলে গেল নিজের রুমে।

আরাভ খাবার রেখে চুপচাপ বসে আছে। মনের মাঝে রাগ তার ধলা পাকছে। সে জানে এই কাজ কে করতে পারে? তাও সবার সামনে মুখ বুঝে সহ্য করছে। পৌষীর এভাবে চলে যাওয়াই তার সন্দেহকে সত্যি করল। খাওয়া শেষ করে সে ভার্সিটির উদ্দেশ্য রওনা দিল। বের হতেই দেখল পৌষী কাচুমাচু হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে দেখেও না দেখার ভান করল। মাত্র বাইকে পা রাখতে পৌষী তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে পড়ল। দু’হাত দু’কানে তার। কান্না ভেজানো নরম গলায় বলে উঠল,

‘সর‍্যিই আরাভ ভাই। আমি বুঝিনি মরিচটা এত ঝাল।’

আরাভ জবাব দিল না। চোখের নজর নিচের দিকেই রাখল। বাইক স্টার্ট করার জন্য চাবি ঘুরাতেই পৌষী আবারও বলে উঠল,

‘আরাভ ভাই সর‍্যিই বললাম তো। আমি বুঝিনি, মাফ করে দাও না।’

আরাভ বাইকের স্টার্ট না থামিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে মাফ করব, একশর্তে।’

‘কিসের শর্ত?’

‘তোকে পাঁচ প্লেট ফুচকা খেতে হবে বোম্বে মরিচ দিয়ে।’

পৌষী আৎকে উঠল। বোম্বে মরিচের ফুচকা খেলে সে তো অক্কা যাবে। কীভাবে খাবে? নিশ্চুপ রইল। আরাভ ফের বলে উঠল,

‘তাহলে তোকে মাফও করব না। যা সর আমার সামনে থেকে।’

পৌষী নিজের নাক টানল। ফ্যাস ফ্যাস করে বলল,
‘কিন্তু আমি কি ইচ্ছে করে তোমাকে ঝাল খাইয়েছি। তুমি পাপাকে কেন আমার রেজাল্ট দিয়েছো। তাই তো রাগ করে তোমার খাবারে এক টুকরো বোম্বে মরিচ মিশিয়ে দিয়েছি। এটা কি আমার দোষ না’কি? তোমার জন্যই তো হল এসব!’

আরাভ নিজের কপালে এক হাত ঠেকাল। মাথা বাঁকিয়ে বলল,
‘তুই এত মাথামোটা কেন পৌষমাস? তোর রেজাল্ট কার্ড আমি কেন ছোট পাপাকে দেখাতে যাব? ছোট পাপা নিজেই পেয়েছে। ভোর সকালে তোকে ডাকতে গিয়ে তোর খাটের নিচে পেয়েছে। এটাই তোকে আমি তখন বলতে চেয়েছিলাম। অথচ তুই তো আমাকেই চোর বানিয়ে দিলি। তুই আসলেই একটা নির্বোধ গাই গরু। যা সর আমার সামনে থেকে।’

পৌষী নাক ফুলালো। তেতে উঠল আরাভের উপর,
‘আমার তো তোমার কাছে ক্ষমা চাওয়াই উচিৎ হয়নি। আসলে ওরা ঠিকই বলে তুমি একটা সংকর জাতী। তোমার সুন্দর চেহারার পেছনে একটা কালকেউটে বাস করে। আমি আর কখনোই ক্ষমা চাইব না বলে দিলাম।’

আরাভও চেঁচালো,
‘মনে হয়, আমি তোর ক্ষমার জন্য মরে যাচ্ছি।’

পৌষী ভেংচি কেটে হনহনিয়ে বাসায় ঢুকল। আরাভও নিজের বাইক চালিয়ে বাইরে বেরুলো।

তিন তলার বারান্দা থেকে গৌরব সবই দেখল। এ দু’জনকে নিয়ে বড্ড ভয়ে আছে সে। এ দুজনের মাঝে আদৌ প্রেম হবে তো। কিন্তু তারা যে ছোট বেলায় একটা অকাজ করে রেখেছে। কি হবে তখন? যখন জানতে পারবে দুজনের মাঝে একটা সম্পর্ক আছে? এই ভয়েই তার হৃদপিণ্ডের ধুকপুকানি বেড়ে গেছে। আলিশবাকে ডাকল,

‘আরাভের আম্মু একটু পানি দাও তো।’

চলবে,,,

#প্রিয়_পৌষমাস ৪.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️

দুপুর থেকে ঝুম বৃষ্টি। প্রকৃতিতে হেমন্ত হলেও আবহাওয়া যেন গ্রীষ্ম আর বর্ষাকালের মত। হয় কাঠফাটা রোদ নয়ত বর্ষাকালের মত চলতে থাকে মুষলধারার প্রবল বর্ষণ।

পৌষী এখনো স্কুলে, বাসায় ফেরেনি সে। এদিকে ঘড়ির কাটায় দুটো বাজতে চলল। প্রিয়া মেয়ের ফেরার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল। অসময়ের বৃষ্টিতে আসবে কীভাবে? যাওয়ার সময় কড়া রোদে বেরিয়েছে, তাই ছাতাও নেওয়া হয়নি। বাসায় তার পাপাও নেই। দুশ্চিন্তায় মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। তখনি আগমন হল আরাভের। তার ছোট মা’কে এত চিন্তিত দেখে জিজ্ঞেস করল,

‘কি হয়েছে ছোট আম্মু?’

প্রিয়া আরাভকে দেখে যেনো স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল। চট করে বলল,

‘বাবাজী, তুমি পৌষীর স্কুলে যেতে পারবে? ও তো স্কুলে যাওয়ার সময় ছাতা নিয়ে যায়নি।’

আরাভ বিনাবাক্যে রাজি হল। যেভাবে ফিরে এল সেভাবে আবার বেরিয়ে পড়ল। বাইকে বসতেই মনে পড়ল তার রেইন কোট লাগবে। আর পৌষীর জন্য একটা ছাতা। অবশ্য সে বলার আগেই প্রিয়া ছাতা নিয়ে বেরিয়ে এল। পাশে আলিশবার হাতে তার রেইন কোট। মৃদু হেসে বলে উঠল,

‘বলার আগেই দেখি দু’জনে হাজির।’

প্রিয়াও মৃদু হাসল। আলিশবা ছেলেকে টিপ্পনী মারল,

‘ভালো কাজে যাচ্ছো, তাই তো দ্রুত ছুটে এলাম।’

আরাভ কিঞ্চিৎ অবাক, ‘ভালো কাজ মানে? আমি কি আর কোনো কাজ করি না।’

প্রিয়া আরাভকে থামাল। ‘আরে মজা করছে তোমার সাথে, তুমি যাও তো বাবাজী।’

আরাভ যেতেই দু’জনেই হেসে উঠল। ফোৎ ফোৎ শব্দ করে নিশ্বাস ছাড়ল প্রিয়া।

‘আপু আরেকটু হলে তোমার ছেলে রেগে যেত কিন্তু। সারাক্ষণই তো সাপ বেজির মত লেগে থাকে সে আর পৌষী। এখন তোমার ছেলের মুড ঠিক আছে, তাই এক কথায় রাজি হয়েছে।’

আলিশবা হাসল। প্রিয়ার কাঁধে হাত রেখে জবাব দিল,
‘আরে নারে পৌষীর বেলায় একদমই রাগবে না। যেগুলো সবার সামনে দেখায় না, সবই লোক দেখানো।’

‘আপু তাই যেনো হয়।’

বসার ঘরের টিভি বন্ধ রেখে আরিবা জবাব দিল, ‘কি নিয়ে কথা বলছো ছোট আম্মু?’

আলিশবা ধমক দিল, ‘ছোট মানুষ সবকিছুতে নাক গলাতে হবে তোর?

আরিবা মনে মনে ফুঁসে উঠল, সে কীসের ছোট? তার বয়স তো পৌষী আপুর থেকে মাত্র দু’বছরের কম। তাও না’কি সে ছোট? তার থেকে সব কথায় লুকিয়ে যায়। মুড আচমকাই খারাপ হল তার। পূর্ণী হতাশ হল আরিবার কান্ডে। মলিন গলায় বলল,

‘কি হয়েছে আপু? গাল ফুলালে কেনো? আম্মুতো আমাকেও সবকিছু বলে না। তখন কি আমি গাল ফুলায় না’কি তোমার মত।’

আরিবা ভ্রুকুঞ্চন করল মুহুর্তে। দশ বছরের পুঁচকি মেয়ে নিজেকে তার সাথে তুলনা করে। কি সাংঘাতিক ব্যাপার!
___

ঝুম বৃষ্টিতে ক্লাস বন্ধ দীর্ঘ ত্রিশ মিনিট ধরে। অন্ধকার আর বৃষ্টির তান্ডবে ক্লাসের সবাইকে ছুটি দিয়েছে। এ সুযোগ লুফে নিয়েছে ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীরাও। বারান্দায় গোল করে দাঁড়িয়ে কেউ বৃষ্টি দেখছে, আবার কেউ বৃষ্টির পানি নিয়ে জলকেলি খেলছে। এর ব্যতিক্রম নয় পৌষীও। সাফা আর তার আরেক বান্ধুবী তিতলিকে নিয়ে জলকেলি খেলায় মেতেছে সে। তাদের সাথে ক্লাসের আরও দু’জন ছেলে বন্ধুও আছে। পার্থ আর সারিফ। একে অপরের সাথে খুনশুটিতে মত্ত তারা পাঁচজন। কেউ কাউকে ছাড় দিচ্ছে না। এর মাঝে আগমন ঘটে আরাভের। সে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে পৌষীকে ডাকার জন্য। তার মাঝে ঘটে সবচেয়ে বড় অঘটন!

আরাভ আর তিতলির মাঝে হুট করে ধাক্কা লাগে। তিতলি তখন দরজার ভেতর থেকে বের হচ্ছে, তখন আরাভ বাহিরে দাঁড়ানো। তিতলি তাল সামলাতে না পেরে নিচে গিয়ে পড়ে। কিন্তু আরাভ তখনো রেইনকোটের দু’পকেটে দু’হাত ঢুকিয়ে সঠান দাঁড়িয়ে আছে। তিতলির হাতে মুষ্টিবদ্ধ পানি গিয়ে পড়ে আরাভের জুতার মাঝে। আরাভ বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকালো। কিন্তু তিতলি হা হয়ে আছে আরাভকে দেখে। আহ! তার ক্রাশবয় আজ নিজেই ধরা দিয়েছে। এত হ্যান্ডসামও হয় কোন পুরুষ মানুষ। তার তো মাথায় ভনভন করছে। এর আগেও সে কয়েকবার পোষীকে বলতে গিয়েও বলতে পারেনি লজ্জায়। তার ক্রাশবয়কে দেখানোর জন্য। একবছর আগে সে রাস্তায় দেখেছিল একবার আরাভকে। সেই থেকেই এই পাষণ্ড লোককে মন দিয়ে বসে আছে। মোবাইল নাম্বারে কল দিলেও রিসিভ করে না। তার নাম্বারগুলো ব্লক করে দেয়। কত নিষ্ঠুর পুরুষ!

কিন্তু আজ অন্যরকম এক দিনের শুরু হল তার। কত সুন্দর বৃষ্টিময় দিনে রোমান্টিক মোমেন্ট! ইশ! এমন একটা মুহুর্ত সে ক্যামেরা বন্দী করতে পারল না। তার জন্য আক্ষেপে পুড়ল। আরাভ তখনো ভ্রুকুঞ্চন করে আছে। রুক্ষভাষায় তিতলিকে জিজ্ঞেস করল,

‘পৌষী কোথায়?’

পৌষী তখন টেবিলের নিচ থেকে কিঞ্চিৎ নিজের মাথা বের করে জবাব দিল,

‘এই তো আমি এখানে। আমাকে নিতে এসেছো আরাভ ভাই?’

চক্ষুদ্বয় গোল গোল করে তাকিয়ে আছে আরাভ। চোখদুটো কোটর থেকে বের হবার উপক্রম। বেঞ্চের নিচে দুই বেনুনি পাকানো আর গলায় সাদা স্কার্ফ জুলিয়ে বসে আছে তাদের ঘরের আদরের দুলারি। আরাভের মুখের কোণে হাসি, সে মিটমিট করে হাসল। এই মেয়ে না’কি তাকে সামলাবে? অথচ এই মেয়েকে সামলাতে সামলাতে অর্ধেক জীবনই পার হয়ে যাবে তার। মাথামোটা একটা! কবে বড় হবে এই মেয়ে? সে জবাবে বলল,

‘জলদি বের হ, বাসায় যেতে হবে।’

পৌষী আরাভকে দেখে খুশিতে গদগদ হয়ে গেল। বেঞ্চের নিচ থেকে দ্রুত বেরিয়ে এল। আরাভ শুধু পৌষীর কাজই দেখে যাচ্ছে। পৌষী নিজের গায়ে লেগে থাকা ময়লা ঝেড়ে ফেলল। আরাভের কাছে এসে বলল,

‘চলো আরাভ ভাই।’

তিতলি বোকার মত দাঁড়িয়ে আছে। তার সাথে আরাভ হাই হ্যালোও করেনি। কি অদ্ভুদ লোক! সে চোখমুখ কুঁচকে রাখল। পৌষী তাকে বাই বলে চলে গেল। সাফা পার্থের সাথে বেরুলো। তিতলি তখনো ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে।
আরাভ বাইক স্টার্ট দিতেই পৌষী পেছনে গিয়ে বসল। রেইনকোটের সামান্য কাপড় ধরে বসেছে সে। আরাভ চেঁচিয়ে উঠল,

‘তুমুল বৃষ্টিতে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছি। দুপুরের খাবার এখনো পেটে পড়েনি। খিদেয় পেট ছোঁ ছোঁ করছে। কিন্তু যাওয়ার সময় যদি তোর গাফিলতির জন্য কোন দুর্ঘটনা হয়। আমি তোকে হাসপাতালে না নিয়ে এই পঁচা ডোবায় ফেলে যাবো কিন্তু পৌষী।’

পৌষী অবাক হল। সে আবার কি করেছে? তাই জবাব দিল ধীর গলায়,
‘এত চেঁচাচ্চো কেন? আমি আবার কি করলাম?

‘তুই কিছু করিসনি? তাহলে শক্ত করে আমাকে ধরিস না কী জন্য?’

‘ আশ্চর্য তো! আমি তো শক্ত করেই তোমার রেইনকোট ধরলাম। আবার কি ধরব শক্ত করে।’

আরাভ পেছন থেকে পৌষীর এক হাত টেনে তার কাঁধে, অন্য হাত তার কোমরে পেঁচিয়ে রাখল। পৌষী ফের অবাক হল। এভাবে ধরতে হবে কেন? আগেই তো ভালো ছিল। উশখুশ করল কিছুসময়। কিন্তু আরাভ ভ্রুক্ষেপহীন। সে বাইক স্টার্ট দিল। কিছু দূর যেতেই স্পীড ব্রেকার এল সামনে। গতি কমাতে গিয়ে উল্টো পৌষী তীব্র ভাবে বাড়ি খেল আরাভের কাঁধের সাথে। সে নাক ধরে আছে। আরাভ বাইক থামাল। অস্থির হয়ে বাইক থেকে নেমে পৌষীর নাক ধরে দেখল, সিরিয়াস কিছু কি’না। কিন্তু বেশি সিরিয়াস নয় দেখে তবেই শান্ত হল। সামনে ফার্মেসী দেখতে পেয়ে পৌষীকে সেখানে নিতে চাইল। কিন্তু সে রাজি হল না। আরাভ তাকে বসিয়ে রেখে নিজে গেল দোকানে। কিছু ব্যথার ওষুধ নিয়ে ফিরছিল। আচমকাই দেখা হল তার ভার্সিটির আরেকজন ছেলের সাথে। তাকে দেখে কাছে এসে কথা বলল। কুশলাদি জিজ্ঞেস করে শেষে বলে উঠল,

‘তোর বাইকে মেয়েটা কে রে আরাভ?’

আরাভের চোয়াল শক্ত হল মুহুর্তে। সে এক পলক পৌষীকে তাকিয়ে দেখল। মেয়েটা তখনো নাক ধরে আছে। আরাভ কিছুটা রুক্ষ ভাষায় জবাব দিল,

‘আমার কাজিন। কেন?’

সাফওয়ানের চোখেমুখে উচ্ছ্বাস উপচে পড়ল তখন। অতি খুশিতে হুট করে যেন লাফিয়ে উঠল তার বক্ষস্থল। ফের বলে উঠল, ‘ভালোই তো।’

আরাভ চোখমুখ কুঁচকে জবাব দিল, ‘কিসের ভালো?’

সাফওয়ানের উপচে পড়া হাসি দিয়ে ফের জবাব দিল,
‘তোর কাজিনকে সামলে রাখিস কিন্তু।’

‘সেটা তুই না বললেও রাখব, আসছি।’

সাফওয়ান ঠোঁট কামড়ে হাসল। তার তৃষ্ণার্ত চাউনি তখন পৌষীর দিকে নিবদ্ধ। অথচ পৌষী এসব সম্পর্কে সম্পূর্ণ বে-খবর।

চলবে,,,,,