প্রিয় পৌষমাস পর্ব-১১+১২

0
5

#প্রিয়_পৌষমাস ১১.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️

বর্তমান,,

কলেজ শেষ করে মাত্রই বাসায় ফিরল সৌরভ। মুখে উৎকন্ঠার ছাপ। মাঝে মাঝে তার নিজেকে মনে হয় সে মহা অন্যায় করেছে। একজন প্রফেসর হয়ে নিজেই আইন ভেঙেছে। এমনটা না করলেও পারত। বাসায় এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে। বড্ড অপরাধী লাগছে এখন। সে যদি সময় মত বুঝত তাহলে এর খেসারত তার মেয়ে আজ দিত না। একহাত কপালে রেখে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। গায়ের কাপড় বদলানো হয়নি তার। চোখ বন্ধ আর পা দুখানা বিছানার বাইরে ঝুলছে।

স্বামীর এমন দৈন্যদশা দেখে প্রিয়া অবাক হল বেশ। হঠাৎই এমন লাগছে কেন তাকে? শরীর খারাপ করেনি তো? আজকাল রাতে ঠিকভাবে ঘুমায় না, খায় না। সারাদিন কি সব চিন্তা করে সে বুঝে না। স্বামীর শিয়রের পাশে বসল। নরম সুরে জিজ্ঞেস করল,

‘কি হয়েছে? শরীর খারাপ করেছে?’

সৌরভ কপাল থেকে হাত সরালো প্রিয়ার কথা শুনে। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল হঠাৎই। কেমন অসহায়ত্ব তার চোখমুখে। বলে উঠল,

‘সর‍্যিই প্রিয়ারানী! আজ আমার ভুলেই আমার মেয়েটা কষ্ট পাচ্ছে। ভবিষ্যতের কথা ভাবা উচিৎ ছিল আমার। বড্ড অন্যায় হয়ে গেছে মেয়েটার সাথে।’

প্রিয়া জানে তার স্বামী কি নিয়ে কথা বলছে।কিন্তু এটা নিয়ে এত চিন্তিত হওয়ার কি আছে, তা বুঝতে পারল না। এমনটা তো হয়নি, মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি, সংসার করার পর তার বিয়ে ভেঙে গেছে। ছোটবেলায় মজারচ্ছলে করা বিয়ে নিয়ে এত কষ্ট পাওয়ার কি আছে? সৌরভকে সান্ত্বনা স্বরূপ বলল,

‘তুমি এত কষ্ট কেন পাচ্ছো? ছোট বেলায় ওরা অবুঝ ছিল। এখন প্রাপ্তবয়স্ক দু’জন। তাদের পছন্দ অপছন্দকে আমাদের সম্মান ও গ্রহণ করা উচিৎ। তাই আরাভের সিদ্ধান্তকেও আমাদের গ্রহণ করতে হবে।’

বিছানা ছেড়ে তড়িৎ উঠে বসল সৌরভ। মলিন গলায় বলল,

‘বিষয় পছন্দ অপছন্দ নিয়ে নয়, প্রিয়ারানী। আরাভের এঙ্গেইজমেন্ট হয়ে গেছে গতকাল। মেয়েটার বাড়ি নেত্রকোনায়। মেয়ের পরিবার চাচ্ছে দেশে বিয়ের অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে। তাই আরাভ আমাকে কল দিয়েছে। বলল, ছোট পাপাহ আমি কি তোমার ছেলে হিসেবে দেশে আসার অনুমতি পেতে পারি? আমি অবাক হয়েছি তার কথা শুনে। তখন জবাব দিলাম তোমাকে অনুমতি দেয়ার আমি কে? সে বিনিময়ে বলল, কারণ তুমি আমার ছোট পাপাহ। তোমার আশীর্বাদ আমি চাই। প্লিজ অনুমতি দাও, নয়ত দেশে আসা হবে না আমার। আমার কিছুটা রাগ হল তার কথায়। তাই বললাম, তোমার বাড়ি, তোমার দেশ। আমি কেউ নই তোমাকে অনুমতি দেয়ার। নিজের দেশে আসতে কারো অনুমতির প্রয়োজন হয় না। চলে এস।
আরাভ শুনে বোধহয় হাসল তখন। বলল, তুমি অভিমান করে আছ আমার উপর। প্লিজ অভিমান কর না তোমার বাবাজীর উপর। আমি খুব শীঘ্রই ফিরছি। আমার বিয়ের আয়োজনের দায়িত্ব তোমার উপর থাকবে কিন্তু। সবকিছুই তুমি দেখবে।

আমি প্রতিত্তোরে আর কিছুই বলেনি। কেমন যেন লাগে আজকাল। সবকিছু কত দ্রুতই পরিবর্তন হয়ে যায়, তাই না প্রিয়ারানী।’

প্রিয়া সৌরভের সব কথায় শুনল। আপাতত দুশ্চিন্তা মুক্ত রাখতে হবে নিজের স্বামীকে। তাই মুখের কোণে কৃত্রিম রাগের প্রতিফলন ঘটালো। যাতে বাহ্যিক চিন্তাগুলো থেকে বেরুতে পারে দ্রুতই। সৌরভকে ফ্রেশ হতে বলল আগে। পরে তারা এ নিয়ে কথা বলবে। সৌরভ কোনভাবে উঠল নিজের ক্লান্ত শরীর নিয়ে। উদ্দেশ্য ফ্রেশ হওয়া।
__

পড়ন্ত বিকেল। সাজ সাজ রব তাদের পুরো ভবন জুড়ে। চতুর্থ তলার এক ভাড়াটিয়ার মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে পুরো ভবন কৃত্রিম সাজে সজ্জিত হয়েছে। সৌরভদের পুরো পরিবার আমন্ত্রিত সেখানে। বিকেল হতেই তাদেরও ডাক পড়ল সেই বাসায় যাওয়ার জন্য। প্রিয়া অবশ্য একবার ঘুরে এসেছে। নাজমা হাঁটতে পারে না এখন। তাই যাওয়া হয়নি। পূর্ণী সবার আগে পৌঁছে গেছে তাদের বাসায়। আনন্দ আর হৈচৈ এর মাঝে ডুবে আছে সে। পৌষী এসব থেকে একটু দূরেই থাকে। কেমন যেন লাগে তার। গিজগিজ করা মানুষ তার একদমই পছন্দ নয়। শান্ত পরিবেশ নেই বিধায় এসব অনুষ্ঠান থেকে সে দূরেই থাকে। তার এত হৈচৈ ভালো লাগে না। তবে আজ তাকে যেতেই হবে। বিয়ের কনে তার এক বছরের সিনিয়র। অনেক অনুরোধ করেছে তাকে যাওয়ার জন্য। তাই ভাবল আজকে যাবে সে। আর কত ঘর বন্দি থাকবে। কি লাভ নিজেকে এত কষ্ট দিয়ে? এবার থেকে সে আর চুপচাপ থাকবে না, হাসি-খুশিতে থাকবে। তার বাবার হাসিও তার কারণে মিলিয়ে গেছে। তাই বাবার মুখের হাসিও তার ফিরিয়ে আনতে হবে। এবার থেকে সে হাসিখুশিই থাকবে।

যদিও তার মায়ের নিষেধাজ্ঞা নেই। তবে তার বাবার অনুমতি লাগবে। অনুমতির জন্য সে তার মায়ের রুমে গেল। দেখল, তার বাবা-মা দুজনই আলাপচারিতায় ব্যস্ত। কি নিয়ে কথা হচ্ছে তার জানা নেই। তবে মায়ের কাছে তার ইচ্ছের কথা জানালো। প্রিয়া কিছু বলার আগে সৌরভই বলে উঠল,

‘যাও, সমস্যা নেই। তবে সাবধানে থেক। পরিচিত অপরিচিত অনেক ছেলেপুলে আসবে, তাদের থেকে দূরত্ব বজায় রেখ।’

পৌষী বাবার কথায় সায় জানিয়ে নিজের রুমে ফিরল। যাক তার বাবা অনুমতি দিয়েছে। সে হলুদ রঙা জামা পরল। সাথে ম্যাচিং করা পাথরের গহনাদি। বেরুবার সময় নাজমা দেখে ভীষণ অবাক হল। নাতনীকে এমন সাজে মনে হয় অনেকদিন পরে দেখেছে সে। তাই ভূত দেখার মত চমকে উঠল। বলল,
‘এত সাইজা কোথায় যাও? আজ তো পাত্রের লাইন লাগায় বা বইন।’

পৌষী নিজের দাদুর কথায় আলতো হাসল। জবাবে বলল, ‘তোমার তো খুশি হওয়ার দরকার। নাতনীর বিয়া খাবা।’

নাজমা জহুরী চোখে পর্যবেক্ষণ করল। এসব কি সত্যি তার নাতনী বলছে, না অন্য কেউ। যে বিয়ের নাম শুনলেই ক্ষেপে যেত। কিন্তু আজ গলার সুর এত নরম। ব্যাপারটা ঠিক হজম হল না তার। পুনরায় জিজ্ঞেস করল,
‘তাইলে জলদি আমার বইনের বিয়া খামু।’

পৌষীর মুখে তখনও মৃদু হাসি। বেরিয়ে যেতে যেতে জবাব দিল,
‘ভাগ্যে থাকলে খেতেও পার, এ আর এমন কি।’

পৌষীকে দেখে বিয়ের কনে বেশ অবাক। সে ভেবেছিল হয়ত পৌষী আসবে না। কিন্তু সত্যি যে এসেছে তাতেই খুশি সে। হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হতে বেশি বাকি নেই। নিফাকে তখন সাজানো হচ্ছে হলুদের জন্য। তার বড় বোন নীলা রুমে এসে দেখে পৌষী একপাশে চুপচাপ বসে আছে। হলুদে সব মেয়েরাই শাড়ি পরেছে শুধু পৌষী ছাড়া। পূর্ণীও শাড়ি পরে ঘুরছে। নীলা কিছু একটা ভাবল। সে সবুজ আর হলুদের মিশেলে জামদানী একটা শাড়ি নিয়ে পৌষীকে তার কাছে ডাকল। পৌষী ভেবেছিল কোনো প্রয়োজনে হয়ত তার ডাক পরেছে। কিন্তু এসে দেখে তাকে শাড়ি পরার জন্য তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে। সে মুখে না বলে ফেনা তুললেও নীলা তার কোনো নিষেধাজ্ঞায় শুনল না। শাড়ি পরিয়ে চুলগুলো খোলা ছেড়ে তার সাথে চুলের মাঝে বেলীফুলের গাজরাও পরালো। পরানো শেষে নীলা একপলক পৌষীকে দেখল। বেশ সুন্দর লাগছে তাকে। অথচ পৌষী লজ্জায় শেষ। সে এতটাও সাজবে তা ভাবেনি।

স্টেজে ডাকা হল সবাইকে। কনের পিছু পিছু সবাই আসছিল। পৌষী কিছুটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে হাঁটছে। নিফাকে স্টেজে বসানো হলে সবগুলো মেয়ে সামনের চেয়ারে বসল। পৌষী সেখানেও দূরত্ব বজায় রেখে একটু পেছনে বসেছে। তাদের ছাদেই হলুদের অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। চেয়ারে বসে সে কিছুটা হাসফাস করছে। এভাবে তার শাড়ি পরা হয় না। আবার লজ্জাও লাগছে। এত কিছুর মাঝে নিজেকে সেইভ রাখার চেষ্টা করছে কিছুটা। আশেপাশে একবার চোখ বুলালো। গিজগিজ করছে পুরো ছাদ। এদের মাঝে দুটো মেয়ে আবার তাদের ক্রাশ নিয়ে কথা বলছিল। সে প্রথমে মনোযোগ দেয়নি। পরে ভালো করে শুনল তাদের কথা। একজন বলছে, এমন ছেলে সে আর কখনই দেখেনি। এই প্রথমবার দেখেছে। ছেলেরাও এত সুন্দর হয়। সে তো প্রথম দেখায় প্রেমে পরে গেছে।

পৌষী অবাক হল না। মেয়েরাও আজকাল ছেলে দেখলে এত ডং শুরু করে দেয়। কি সব ক্রাশ নামক বাঁশ খায়। তার এসব শুনতে বেশ বিরক্ত লাগে। এই মেয়েগুলো পারে না ছেলেদের গায়ে উঠে যেতে। না পেরে নিজেই উঠে গেল চেয়ার ছেড়ে। নিজমনে কিছু অশ্রাব্য বাক্যও ছুঁড়ল তাদের উদ্দেশ্য। কিন্তু যাওয়ার সময় তার চোখ পড়ল ছাদের এককোণে। ছাদের বাগান সে দিকেই। আগে অবশ্য তাদের বাগান আরও অনেক সুন্দর ছিল। কিন্তু ইদানীং এর সৌন্দর্য কমেছে দ্বিগুণ। আগের মত যত্ন নেওয়া হয় না আর। সেও আসে না, তার বাবাও সুযোগ পায় না। তাই ধীরে ধীরে এই ছাদের বাগানের সৌন্দর্যও কমে গেছে। কিন্তু এখানে কোন এক মানব অবয়বকে দেখে সে থমকে গেছে। খুব চেনা পরিচিত মনে হল। তবে নিজের ভ্রম ভেবে উড়িয়ে দিল। আর যাই হোক সেই লোক এখানে কেন আসবে?

চলবে,,,,

#প্রিয়_পৌষমাস ১২.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️

বাসায় এসেও স্বস্তিতে নেই পৌষী। ভেতরে প্রবেশ করে মায়ের প্রশ্নের সম্মুখীন হল। পূর্ণীকে ছাড়া কেন এসেছে? সে কিছুটা বিরক্ত হল। তার বোন না আসলে জোর করে নিয়ে আসবে না’কি? কিন্তু তার মা উল্টো ধমক দিল। অন্তত তার বোনের আশেপাশে থাকত এখন। একা আসার কি দরকার ছিল? পৌষী মায়ের এসব প্রশ্নের জবাব না দিয়ে নিজের রুমে ফিরে গেল। প্রিয়া মেয়ের আচরণে ক্ষুব্ধ। ছোট বোনকে রেখে কেউ এভাবে বাসায় আসে? নিজে ছুটে গেল ছোট মেয়েকে নিয়ে আসার জন্য।

গায়ের শাড়ি পরিবর্তন করে শুয়ে পড়ল পৌষী। ঘুম নেই দু’চোখে। কেমন যেন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। রাত হলেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। অতীত তাকে কুড়ে কুড়ে খায়। ছাদ থেকে মিউজিকের মৃদু শব্দ ভেসে আসছে। শব্দের মাত্রা কম হলেও কর্ণকুহরে ঠিকই স্পষ্ট পৌঁছে যাচ্ছে গানের সুর।

‘হাসিতে হাসিতে ফুল
ফুরিয়েছে আজ সব
চলে গেছে ঢলে গেছে
কালকের কলরব।
কথা ছিলা সাথে তোর
বলা হল শেষ না,
খালি খালি চারিপাশ
এ আমার দেশ না।
কি উপায় ফেরা যায়,
তোর স্বপ্নতে আবার।।’

ঘুমন্ত পৌষীর বিছানায় বসা এক মানব অবয়ব। ঘরের বাতি নিভানো। কিন্তু জানালা দিয়ে উঁকি দেয়া সড়কের সোডিয়াম আলোতে ঘর কিছুটা আলোকিত। সেই আলোতে মানব মূর্তি কিছুটা স্পষ্ট হলেও তার মুখ তখনও অস্পষ্ট। কিন্তু তার কাছে সেই মানব যেন খুব পরিচিত, খুব কাছের কেউ। ঘুমন্ত পৌষী চোখ বন্ধ করেও তাকে অনুভব করছে। তার অস্পষ্ট শান্ত নিবিড় দু’চোখে যেন হাজার আকুতি। তার শিয়রের পাশে বসে তার মাথায় হাত বুলাচ্ছে। আচমকা তার একহাত টেনে নিজের বক্ষপিঞ্জরে চেপে ধরল। সেই মানবের বিড়বিড় করা অস্পষ্ট শব্দগুলোও পৌষী শুনতে পেল।

‘আমি ফিরে এসেছি, আগের মত এবারও কি আমায় ফিরিয়ে দিবি?’
উচ্ছ্বসিত হল পৌষীর তনুমন। ইচ্ছে করল সেও ছুঁয়ে দিক তাকে। বলতে চাইল,
‘প্লিজ যাবেন না, এভাবে পাশে থাকুন।’
তার দু’গালে হাত রাখল সে মানব। বলল,
‘আমার দিকে তাকাবি না, রাগ করেছিস?’

সহসাই পৌষীর বন্ধ দু’চোখ থেকে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল চিবুকে। নিজের সাথে নিজেই যুদ্ধে করছে। এই চোখ খোলা যাবে না। খুললেই তো হারিয়ে যাবে। সে তো রোজই স্বপ্নে আসে শুধু। নিভৃতেই বিচরণ করে সেখানে। আলো ফুটতেই আবার হারিয়ে যায়। আজ না হয় এভাবেই রাত কাটিয়ে দেবে সে। দু’চোখ খুলেনি সে। কিন্তু সে মানব নাছোড়বান্দা। পৌষীকে একান্তই কাছে টানল। বক্ষপিঞ্জরে বন্ধি করতে কত ব্যাকুলতা তার মাঝে। পৌষী লজ্জায় গুটিয়ে গেল। না চাইতেও এবার দু’চোখ মেলে তাকাল। কিন্তু যা দেখল, তাতে মনটা ব্যতীত হল আরও একবার। সে বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে আছে। রুম জুড়ে ঘুটঘুটে অন্ধকার। বিছানা খালি পড়ে আছে। নেই সেই মানব অবয়ব। শুধু স্বপ্নতে এভাবে আসে সে। স্বপ্নতে তাকে কাছে টেনে নেয়। বলে, না বলা কত কথা। সে শুনে আর লজ্জায় নিজেকে গুটিয়ে নেয়। রাত তার এভাবেই কাটে বেশিরভাগ। হয় নির্ঘুম, না হয় তার স্বপ্নতে বিচরণ করে।

আজ বাকি রাত আর ঘুম হয়নি। ভোরের দিকে নামাজ পড়ে আবার শুয়ে পড়ল। কখন দু’চোখে রাজ্যের ঘুম নামল সে টেরই পায়নি।
ঘুম ভাঙল সকাল এগারো’টায়। তাও পূর্ণীর চেঁচামেচিতে। বিয়ের অনুষ্ঠান কনভেনশন হলে হবে। তাই হলে যেতে হবে সবাইকে। বোনকে তাড়া দিল,
‘আপু জলদি উঠ। রেডি হতে হবে।’
পৌষী নিভু নিভু চোখে তাকাল। দু’চোখে এখানো ঘুমের রেশ রয়ে গেছে। মুখে হাই উঠছে বার বার। পূর্ণী বোনের কাজে বিরক্ত হল। কিছুটা ধমক দিয়ে বলল,
‘জলদি উঠ, বারোটার মধ্যে হলে উপস্থিত হতে বলছে।’

পৌষী ভ্রু কুঁচকে আছে। বোনের দিকে কঠিন কিছু বাক্য ছুঁড়ল,
‘যা তো বিরক্ত করিস না।’

‘তুই এমন কেন আপু? তোর মধ্যে কোন সামাজিকতায় নাই। একজন মানুষ এত করে তোকে যেতে বলেছে, অথচ তুই নিজের মতই পড়ে আছিস। কালরাতেও কাউকে কিছু না বলে চলে এলি। সবাই তোকে খুঁজতে গিয়ে দেখল তুই নাই। পরে জানতে পারল বাসায় চলে এসেছিস। এখন বিয়েতে যাওয়ারও তাড়া নাই। তুই আসলে জানি কেমন!’
বোনকে পালটা কিছু তীর্যক বাক্যে ছুঁড়ে পূর্ণী দুপদাপ পা ফেলে রুমের বাইরে চলে গেল।

পৌষী চুপচাপ বোনের যাওয়া দেখল। তার বোন তাকে কথায় কথায় ধমক দেয়। সে অবাক হয় না। আসলেই সে কেমন অদ্ভুতুড়ে। তার মধ্যে আজব প্রাণী বাস করে। তার বোনের কথা সত্যি। সে আসলে সামাজিকতা রক্ষা বোঝে না। কিন্তু এমন কেন সে? শেষে বোনের কথায় নিজের আলস্যের খোলস ছেড়ে বিছানা ছেড়ে নামল। ফ্রেশ হল খুব দ্রুত। হালকা কিছু খাবার খেতে হবে। নয়ত খিদের ছোটে তার পেটে তান্ডব নৃত্য হবে। একবারে তৈরি হয়েই রুম থেকে বের হল। খাওয়ার টেবিলে নাস্তা রাখায় ছিল। রুটি ছিল আর সবজি। সাথে কিছু ফলও। আরেক প্লেটে স্যান্ডউইচ। সে কিছুটা দ্বিধান্বিত। এত নাস্তা কেন আজ টেবিলে। রুটিও আবার স্যান্ডউইচ? তবে এত ভেবে তার কি লাভ। সে খাওয়ায় মনোযোগ দিল। রুটি ছেড়ে একপিচ স্যান্ডউইচ নিল। দু’গ্লাস পানি খেল সাথে। তার দাদু বসার ঘরেই ছিল। সে তাকে খেয়াল না করলেও নাজমা ঠিকই খেয়াল করল। দূরত্ব সামনের করিডোর শুধু। সেখান থেকে নাজমার কিছু বাক্য ভেসে এল।

‘বিয়েতে যাও তাইলে।’
পৌষী খাওয়ার মাঝে জবাব দিল, হুম।
‘যাও, সাবধানে। তাড়াতাড়ি ফিরা আইসো কিন্তু।’
‘তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে কেন?’
‘আইলেই দেখবা।’

পৌষী চুপচাপ খেয়ে উঠল। পূর্ণী আগেই বের হয়ে গেছে। তাই দ্রুত বোনকে ধরার জন্য বের হল। কিন্তু করিডোর পার হতে গিয়ে সে বসার ঘরে কিছু একটা দেখেছে। তার দাদুর পাশে কেউ একজন বসে ছিল। তার দৃষ্টি এক সেকেন্ড থেকেও কম সময়ের মধ্যে তাকে দেখেছে। এটা কি ভ্রম ছিল না’কি সত্যি! সে কি একবার বসার ঘর দেখবে? না’কি কাউকে জিজ্ঞেস করবে। তাদের পরিবারের শুধু সে আর পূর্ণী যাচ্ছে শুধু। তার বাবাও বাসায় নেই। বাকিরা কেউ যাচ্ছে না কেন? কিছু প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে তার ছোট্ট মাথায়। নিজের কৌতুহল দমিয়ে কয়েক মিনিট পর ফিরে এল বাসায়। বসার ঘরে নিজের দাদুর মুখোমুখি হল সে। নাজমা নাতনীকে ফিরে আসতে দেখে ভীষণ অবাক হল। বলল,

‘ফিরা আইলা কা?’
‘দাদু, তোমরা কেউ যাবে না?’
নাজমা মাথা নাড়িয়ে বলল, না।’
‘কিন্তু কেন দাদু?’
‘মেহমান আইবো আজকে।’
‘কে আসবে?’
‘আইলেই দেখবা।’

পৌষী নিজের প্রশ্নের জবাব ঠিকঠাক মত পায়নি। তবে এর মাঝে সে একটু আগে কোন এক অবয়বকে দেখেছিল। সেই লোকটা কোথায়? এখন নেই কেন? এতটা ভুল কি করে হতে পারে? সে কি তবে ভুল দেখেছে? তার চোখ আর মস্তিষ্ক কিসব দেখছে সে বুঝতেই পারছে না। অদ্ভুত লাগছে ভাবতে। সে পাগল হয়ে যাচ্ছে না’তো? কিন্তু এতটাও ভ্রম কিভাবে হয়?

হলের উদ্দেশ্য গাড়িতে উঠল সে। পূর্ণীও আছে তার সাথে। নিফা, নীলার সাথেই বসেছে। নিফা রাতের কথা জিজ্ঞেস করল। এভাবে কেন চলে গেল সে। নীলাও বোনের মতই অনেকগুলো প্রশ্ন ছুঁড়ল। কিন্তু পৌষী নিরুত্তোর। পূর্ণী নিজের বোনের হয়ে জবাব দিল, আপু বেশি লোক সমাগমে বেশিক্ষণ থাকতে পারে না। ওর মাথাব্যথা শুরু হয়ে যায় তখন। এজন্য কাউকে না বলে চলে গেছে। নীলা তখন উল্টো ধমক দিল। আরে আমাদের বললে কি হত। ওষুধ তো ছিল। খেলে আরাম পেত, মাথাব্যথাও করত না। পৌষী মাথা নাড়ালো, না আপু শুধু ওষুধে কাজ হয় না। ঘুমানো লাগে আমার। নয়ত শরীর খারাপ করে ভীষণ। নীলা চুপ হয়ে গেল। পরক্ষণেই বলে উঠল, অহহ।

গাড়ি চলতে শুরু করেছে। বাড়ির প্রধান ফটক পেরিয়ে মাত্রই রাস্তায় উঠেছে। পৌষীর আচমকাই চোখ পড়ল তাদের তৃতীয় তলায়। তার পাশের দখিনা বারান্দায় একটা টাওয়েল শুকাতে দেওয়া আছে। চোখেমুখে রাজ্যের বিস্ময় তার। এটাতো তার আরাভ ভাইয়ের বারান্দা। এই বারান্দা গত পাঁচ বছরেও খোলা হয়নি আর। শুধু মাসে একবার করে এই রুমের সাফসাফাই করা হয়। তারপর আবার বন্ধ করে রাখা হয়। কিন্তু টাওয়েল কে শুকাতে দিয়েছে। এই রুমে তো কারো প্রবেশ করার কথা না। তাহলে?
পূর্ণীকে জিজ্ঞেস করল আরাভের ভাইয়ের রুমে কেউ ছিল কাল? পূর্ণী বলল, হ্যাঁ ছিল। নিফা আপুর কাজিন। প্রশ্নের উত্তর পেয়েও সন্তুষ্ট নয় সে। তবুও মনকে শান্ত রাখল।

হলে এসে ঘোরাঘুরি করে খাবার শেষে ঘন্টা দু’য়েকও পার হয়নি তখন। ঘড়ির কাটায় দুটো বিশ মাত্র। তার মুঠোফোন কম্পিত হল হঠাৎ। পৌষী দেখল তার বাবা কল দিচ্ছে বার বার। দ্রুতই কল রিসিভ করতেই সৌরভের কড়া নির্দেশ এল। দশ মিনিটের মাঝে বাড়ি উপস্থিত হওয়া চাই। সাথে পূর্ণীকেও নিয়ে যেতে হবে। পৌষীর মেজাজ চটল। দশ মিনিট, এত জরুরি তলব কেন? সে পূর্ণীকে খুঁজতে লাগল। মেয়েটা এত দুরন্ত স্বভাবের। সারাক্ষণ টই টই করে ঘুরে বেড়ায়। তাকে খুঁজতেই দু’মিনিট পার হয়ে গেল। রাস্তায় নেমে রিকশার অপেক্ষায় আরও একমিনিট খোয়া গেল। সে সময় দেখছে বার বার। শেষে রিকশা পেয়ে দু’বোন উঠে গেল তাতে। বোনের এত হুলুস্থুল দেখে পূর্ণী নিজের কৌতুহল দমিয়ে রাখতে পারল না। বলল,

‘হঠাৎ করে এত তড়িঘড়ি করে যেতে বলল কেন আমাদের?’
‘আমি কি করে বলব?’
‘আচ্ছা, আপু পাত্রপক্ষ আসেনি তো তোমাকে দেখতে।’

পৌষী চোখমুখ কঠিন করে তাকাল। পূর্ণী আলতো হেসে বোনকে সান্ত্বনা দিল।
‘আরে, আমি তো ধারণা করছি শুধু। সত্যি হতেও পারে আবার নাও হতে পারে।’
পৌষী চুপ করে বোনের সব কথায় শুনল। তবে জবাব দিল না। বাসায় এসে ফটক পেরিয়ে সিঁড়িরুমে প্রবেশ করবে মাত্র। হুট করে তাদের বাড়ির প্রধান ফটকে একটা গাড়ির আগমন ঘটল তখন। পৌষী না চাইতেও তাকাল সেদিকে। হঠাৎই পাশ থেকে পূর্ণী চেঁচিয়ে উঠল,

‘আরিবা আপু, বড় পাপাহ।’

পৌষী যারপরনাই অবাক। তার বড় পাপাহ এসেছে। সেও চেঁচালো, ‘বড় পাপাহ।’
গাড়ি থেকে একে একে সবাই নামল। পৌষী, পূর্ণী দুজনেই ছুটে গেল। তাদেরকে জড়িয়ে ধরল। আলিশবা দু’বোনকে বুকে জড়িয়ে নিল। আরিবা পাশে দাঁড়িয়ে হাসছে। সেও সবার সাথে কুশল বিনিময় করল। গৌরব দু’বোনকে দু’হাত দিয়ে আগলে নিল। মাথায় হাত রেখে বলল,
‘কেমন আছে আমার আম্মাজান’রা?
দু’জনেই কান্নামিশ্রিত গলায় জবাব দিল, ভালোই।’

কিন্তু সবার শেষে অপরিচিত একটা মুখ নামল। দু’বোনই অবাক হয়ে দেখল। কে এই মেয়ে? আরিবা পরিচয় করালো তার সাথে,
‘আকসা আপু।’
আকসাকে দেখে পৌষীর মুখ চুপসে গেল মুহুর্তে। কিন্তু সবাইকে দেখলেও সেই চেনা মুখটা দেখল না সে। আরাভ ভাই কি আসেনি তবে? তার বেহাইয়া মনটা সেই নিষ্ঠুর লোকটাকে খুঁজল। আচম্বিত পূর্ণী বলে উঠল,

‘আরাভ ভাই কোথায়?’
আরিবা চটজলদি জবাব দিল, ‘ভাইয়া আসেনি এখনো। সে তো সবার আগে এসেছে।’

পৌষী ফের একবার চমকালো। আরাভ ভাই এসেছে, কিন্তু কোথায়?’

চলবে,,