প্রিয় পৌষমাস পর্ব-২৯+৩০

0
153

#প্রিয়_পৌষমাস ২৯.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️

চলছে তুমুল লড়াই দু’ভাইয়ের মধ্যে। বেয়াই হওয়ার সুবাদে গৌরব সৌরভকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েছে। কে কার থেকে বেশি ডিঙ্কস করতে পারবে? সেই থেকে ছাদের মধ্যিখানে চলছে দু’ভাইয়ের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা। দু’জনের সামনে রাখা কোল্ড ডিঙ্কসের অনেকগুলো বোতল। আলিশবা অবশ্য একবার এসে নিজের স্বামীকে ধমক দিয়ে গেছে। কিন্তু গৌরব বউকে শাহাদাৎ আঙ্গুল তাক করে বলে উঠল, ডিষ্টার্ব করবে না’তো। আমি এখনো ইয়াং হ্যাজবেন্ড, ইয়াং বাবা। তারউপর এখন ইয়াং শ্বশুর হয়ে গেছি। পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে ইয়াং দাদাও হয়ে যাব। সেই খুশিতে আমরা দু’বেয়াই একটু আনন্দ করতেই পারি। তারপর সৌরভের দিকে এক ভ্রু উঁচিয়ে বলল, তাই না বেয়াইসাব!

সৌরভও ভাইয়ের সাথে তাল মিলালো, জ্বী বেয়াইসাব।’

আলিশবা হায় হায় করে জায়গা প্রস্থান করল। তার স্বামী যদি একটু তার কথা শুনত। প্রিয়াকে ডেকে পাঠালো সে। প্রিয়া সৌরভকে দেখে চুপচাপ চোখ পাকালো শুধু। কিন্তু সৌরভ বউয়ের চোখ পাকানো দেখেও না দেখার ভান করল। সেও গৌরবের মত রগড় গলায় বলল,
‘প্রিয়ারানী আজকের রাত হচ্ছে আমার আর আমার বেয়াইয়ের। শুধু শুধু তোমরা এসে ডিষ্টার্ব কর না’তো।’

প্রিয়াও নিশ্চুপ নেমে এল। আলিশবাকে ডেকে বলল, বাদ দাও আপু। দু’জনেই পাগল হয়ে গেছে। একটু পাগলামি করুক। তারপর দেখবে নিজ থেকেই ঠিক হয়ে গেছে।
আলিশবা হাসল শুধু। তবে আজকে তার নিজেরও আনন্দ হচ্ছে বেশ। প্রিয়াকে বলল, চল আমরাও কিছু করি। প্রিয়া অবাক হল। বলল, কি করবে আপু? আলিশবা বলল, আমরা গানের প্রতিযোগিতা করতে পারি। তার মাঝে শোভা এসে উপস্থিত। দু’জায়ের কথা শুনে সেও বলে উঠল, ‘ভালো আইডিয়া তো ভাবী। আমিও আছি কিন্তু।

প্রিয়া চটজলদি ভাবল কিছু। বলে উঠল, আচ্ছা আমি প্রীতি আর রাহীকে ডেকে নিয়ে আসি। ওরা দারুণ গান গাইতে পারে কিন্তু।
প্রিয়া বলেই ছুটল দু’জনকে ডাকতে। কিছু সময়ের মাঝে তাদের আসর জমতে শুরু করল। ছাদের একপ্রান্তে সৌরভ গৌরব তাদের বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে। অন্যপ্রান্তে প্রিয়া আলিশবা তাদের বন্ধু-বান্ধব নিয়ে গানের আসর বসিয়েছে। প্রিয়া আলিশবার গানের আসর জমে ক্ষীর। তাদের সাথে ঘরের অন্যান্য মহিলারা এসে উপস্থিত। প্রিয়া প্রীতি একদলে আর আলিশবা রাহী অন্যদলে। শোভা তাদের বিচারক। এভাবে চলছে তাদের মধ্যেকার আড্ডা।

হঠাৎ করে সৌরভদের কানে বউদের গানের সুর ভেসে গেল। দু’জনেই তখন হতবাক। এমন মিহিসুরে কে গান গাইতে পারে। পরশ ছিল তাদের মাঝে। সে বলে উঠল, তোদের বউরা মিলে গানের আসর জমিয়েছে। সৌরভ আৎকে উঠল। বলল, আমার বউ গান গাইতে পারে? কই আমাকে তো কখনো গান শোনালো না। পরশ টিপ্পনী মারল। বলল, শালা তোর বউ না, আমার বউ গান গাইতে পারে। শুনছিস না, ঐটা আমার বউয়ের গানের গলা।

সৌরভ এক ভ্রু উঁচিয়ে বলল, শালা ডাকবি না একদম, পারলে বেয়াই ডাক।
পরশ চমকে উঠল। অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাল তার দিকে। বলল, মানে! তোকে কেন বেয়াই ডাকব?
সৌরভ হো হো করে হেসে উঠল তখন। পরশের কাঁধে হাত রেখে বলল, তুই আসলে কি ছেলের বাপ হইছোস? আমার সন্দেহ হয়।
পরশ তখনও হা হয়ে আছে। বলল, তোর কথা মাথার উপর দিয়ে গেল।
সৌরভ আবার বলে উঠল, দূর হাদারাম, দুই ছেলের বাপ তুই। তোর মাথায় এখনো ঢুকে নাই, তোর ছেলে’রা বড় হইছে। কেউ আর বাচ্চা নাই।

পরশ মাথা চুলকালো। সৌরভের দিকে তাকিয়ে আছে উদগ্রীব হয়ে। বলল, বড় হয়েছে কোথায়? একজন একুশ, অন্যজন আটারোতে পড়ল মাত্রই। কারো পড়াশোনা শেষ হয়নি। বিয়েরও ঢের সময় বাকী এখনো।
সৌরভ আবারও টিপ্পনী মারল। বলল, কিন্তু তোর ছেলে তো তার মন লেনদেন করে বসে আছে আমার মেয়ের সাথে।’

পরশ চমকালো। বলল, কে? তোর মেয়ে পূর্ণী?
সৌরভ বলল, দূর, পূর্ণী হতে যাবে কেন? আমার কি আর মেয়ে নাই।
গৌরব এবার ভাইয়ের কথায় জবাব দিয়ে উঠল, তুই কি আরও কোথাও মেয়ে পয়দা করে রেখেছিস না’কি?
সৌরভ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল তখন। বলল,
বেয়াইসাব বোধহয় আপনার ভুলে যাওয়ার ব্যামো আছে। আমার তিনটা মেয়ে পৌষী, আরিবা ও পূর্ণী। বুঝেছেন বেয়াইসাব।

পরশ আৎকে উঠল এবার। বলল, তুই কি পার্থ আর আরিবার কথা বলছিস?
সৌরভ মাথা নাড়াল। অথচ গৌরব হা হয়ে আছে। ডিঙ্কস পান করা ছেড়ে দিয়ে পরশ আর সৌরভের কথায় শুনছে। তার মনটাও বড্ড ব্যাকুল জানার জন্য। পরশ তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে উঠল নিজেকে নিয়ে। বলল, কোথায় আমার ছেলে, আর কোথায় তোদের মেয়ে? তারউপর সে মধ্যবিত্ত বাবার ঘরের ছেলে। সে তো ভাঙাঘরে ঘুমিয়ে চাঁদ ধরার স্বপ্ন দেখছে। আমার ছেলে বড্ড অবুঝ, তাই বলে আমি তো আর অবুঝপনা করতে পারি না। ওর হয়ে আমি ক্ষমাপ্রার্থী। মাফ করে দিস দোস্ত।

গৌরব এবার মুখ খুলল, দেখ তোর ছেলে এখনও ছোট। পড়াশোনা শেষ হয়নি তার। আমার মেয়েরও হয়নি। যদি ততদিন আমার মেয়ের জন্য অপেক্ষা করতে পারে। তাহলে আমি নির্দ্বিধায় তোর ছেলের হাতে আমার মেয়েকে তুলে দেব। তবে শর্ত একটাই আগে পড়াশোনা তারপর এসব নিয়ে কথা বলব।

পরশ বেশ দ্বিধাদ্বন্দে ভুগল। তার মত এমন পরিবারে তাদের মেয়ে বিয়ে দিবে এটা ভাবতেও তার কাছে অকল্পনীয় ঠেকছে। কিছুসময় ভাবল সে। শেষে বলল, আমি কি পার্থ’র সাথে এ নিয়ে কথা বলব।
গৌরব মাথা নাড়িয়ে বলল, না। এটা গোপন থাক। যদি দু’জন দু’জনকে পছন্দ করে তারপর এটা নিয়ে কথা তুলব। তার আগে নয় কিন্তু।

আরিবা হৈচৈ শুনে ছাদে এল মাত্র। কিন্তু প্রবেশ করার মুহুর্তে তার বাবার মুখে বিয়ের কথা শুনে পুরো বাকরুদ্ধ সে। তার বিয়ে, তাও পার্থ’র সাথে। অসম্ভব! সে তো ইয়ানকে পছন্দ করে। ছেলেটা বাংলাদেশী নয়, তার বাড়ি ইন্দোনেশিয়া। এটা নিয়ে এতদিন দুঃচিন্তায় ভুগছিল। তার পাপাহ অন্য দেশের ছেলে হওয়াতে যদি মেনে না নেয়। তখন সে কি করবে! আর এখন দেশে এসে তার বিয়ের কথা বলে যাচ্ছে। তার অস্থিরতা বাড়ল। নিজমনে পার্থকে গালি ছুঁড়ল। কিন্তু পরক্ষনেই মনে হল, তার পার্থকে পছন্দ নয়। এটা যখন জানবে তখন তো আর জোর করবে না। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে সেও তার মায়েদের গানের আসরে যোগদান করল।

সকালে আলো ফুটতেই পাখির কিচিরমিচির শব্দেই ঘুম ভাঙলো পৌষীর। তার পাশে শুয়ে আছে গভীর ঘুমে তলিয়ে যাওয়া আরাভ। সে অপলক তাকিয়ে আছে আরাভের দিকে। কেমন করে ব্যাঙ্গের মত হাত পা ছড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। তার দেখেই হাসি পাচ্ছে। অথচ জেগে থাকলে মনে হবে এর মত এত সুদর্শন, পরিপাটি ও গোছানো ছেলে যেন একটাও নেই। হঠাৎ করে তার মাথায় দুষ্টবুদ্ধি চাপল। কালো রংপেন্সিল নিয়ে ঠোঁটের উপরিভাগ এঁকে দিল সুন্দর করে। চোখের ভ্রু আরও মোটা করে দিল। দেখতে রাজা মহাশয়ের মতই লাগছে। তারপর হাসতে হাসতে সে ওয়াশরুমে চলে গেল।

নাস্তার টেবিলে বসে সবাই আলাপ জুড়ে দিয়েছে। খাওয়ার তুলনায় কথা চলে বেশি তাদের। শোভা খাচ্ছে আর পাশে বসে অন্যেদের খাবারের তদারকি করছে। পূর্ণী মনে মনে কিছু একটা ভাবল। আচমকাই বলে উঠল, আচ্ছা ফুফী, কিয়াম ভাইয়াকে কেমন মেয়ে বিয়ে করাবে? শোভা বোধহয় মজা পেল। বলল, কেন’রে বিয়ের ঘটকালি করবি?
পূর্ণী কিঞ্চিৎ হাসল। বলল, না, ফুফী। শুধু জানতে চাচ্ছিলাম আর কি?
শোভা হেসে উঠল। পূর্ণী নিজের ফুফুর ঠান্ডা মাথা দেখে আরও একটু যেন সুযোগ পেল। তাই আবার বলে উঠল, আচ্ছা, কিয়াম ভাইয়াকে বিয়ে কখন করাবে?
শোভা এবার চমকালো ভীষণ। বলল, কেন’রে? হঠাৎ করে তোর কিয়ামকে নিয়ে এত চিন্তা কেন বল তো?
পূর্ণী ঘাবড়ালো বোধহয়। আমতা আমতা করল এবার। বলল, আমি নিছকই মজা করে জানতে চাচ্ছি। বিয়ে খেতে ইচ্ছে হচ্ছে তাই।

শোভা বলল, কিয়ামের বয়স পঁচিশ ছাব্বিশ হলে বিয়ে করাবো। তার আগে নয়।
পূর্ণী বলল, যদি তোমার ছেলে ততদিনে অন্য কোন মেয়ের সাথে প্রেম করে বসে থাকে। তখন কি করবে?

শোভা মুখ টিপে হাসল। পূর্ণীর দিকে তীক্ষ্ণ নজর দিয়ে বলল, তোর এসব নিয়ে ভাবতে হবে না। আমার ছেলে বাইরে যত ইটিসপিটিস করুক না কেন? তারপরও ছেলের বউ কিন্তু আমি তোকেই বানাবো। বুঝেছিস বোকা মেয়ে।

পূর্ণী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। চোখ পিটপিট করে জবাব দিল, মানে আমি কেন?
শোভা জবাব না দিয়ে হাসল শুধু। পূর্ণী লজ্জায় গুটিয়ে গেল মুহুর্তে। হুট করে বলল, আমার খাবার শেষ। তোমরা খাও। আমি গেলাম।

কিয়াম নিজের রুম থেকে বের হয়েছে মাত্র। সে খাওয়ার টেবিলের দিকেই আসছিল। পূর্ণী তখন হন্তদন্ত হয়ে নিজের রুমে যাওয়ার সময় কিয়ামের সাথে বেশ জোরে ধাক্কা খেল। পূর্ণী কোমরে হাত রেখে চেঁচিয়ে উঠল। বলল,
চোখ কি আসমানে নিয়ে হাঁটো কিয়াম ভাইয়া।
কিয়াম হতভম্বের মত মেঝেতে পড়ে আছে। সে মাত্রই বলতে নিল, আমি কি করলাম। তার আগেই পূর্ণী বলল, থাক আর সরি বলতে হবে না। তুমি যে দিনকানা সেটা আমি জানি। কিন্তু এবারের মত মাফ করে দিলাম। কিয়াম পুরো বেকুব বনে গেল। বিড়বিড় করে বলল, গাধী একটা।

আরাভ ঘুম থেকে উঠে কুলকুচি করল শুধু। আয়নায় মুখ দেখা হয়নি তার। তার আগেই বেরিয়ে এল রুম থেকে। খাওয়ার টেবিলে বসতেই সবার মুখ হা হয়ে গেল। কিয়াম দাঁত কেলিয়ে হেসে উঠল। প্রিয়া আলিশবাও মুখ টিপে হাসছে। গৌরব সৌরভ দেখেও না দেখার ভান করল। আরিবা ভাইয়ের মুখ দেখে হাসলেও চুপ করে থাকল। কিন্তু পূর্ণী দেখে চেঁচিয়ে উঠল। বলল,

‘দুলাভাই আগে তো দেখিনি। কিন্তু এখন রাতারাতি তোমার দাঁড়ি-গোঁফ উঠে গেছে কিভাবে?’

আরাভ থ হয়ে গেল তার কথা শুনে। পূর্ণী তখন ছোট একটা আয়না ধরল আরাভের সম্মুখে। তা দেখেই আরাভ ভ্রু কুঁচকালো। রাগে গজগজ করতে করতে নিজের রুমে ফিরে এল। কিন্তু রুমে এসে দেখল অন্যরকম এক দৃশ্য। পৌষীর হাতে তার মুঠোফোন। তাকে দেখে কেমন করে অগ্নিবর্ষণ করছে। আরাভ ভয় পেল কিছুটা। রাগ উবে গিয়ে হুট করে চুপচে গেল সে। আমতা আমতা করে বলল,

‘কি হয়েছে পৌষমাস? ‘

পৌষী মুঠোফোনের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করা মেসেজ দেখালো তাকে। সেখানে লেখা আছে স্পষ্টই।

‘কেমন আছো সুইটহার্ট? তুমি কখন ফিরবে? আই মিস ইউ সো মাচ বেবী।’

আরাভ বোকার মত হেসে উঠল। বলল, ‘আরে ও আমার কলিগ, আর কিছু না। বিশ্বাস কর।’ পৌষী জবাব দিল না কিছুই। মোবাইল বালিশে ছুঁড়ে ফেলে হনহনিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল। আরাভ তব্দা খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে তখনও। এটা কি হল? এটা সত্যিই তার কলিগ ছিল। আর কিছু না। কে বুঝাবে ওকে। তার কলিগ এমন মজায় করে তার সাথে। সে হা-হুতাশ করল আপনমনে। আসলে বউ মানে ভয়ংকর।

চলবে,,,

#প্রিয়_পৌষমাস ৩০.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️

বিয়ের মাত্র দু’দিন পেরুতেই খুশি যেন বিষাদে রূপান্তর হয়েছে। পৌষীর চোখমুখে বিরহের যাতনা স্পষ্ট। এত তাড়াতাড়ি তার জীবনে বিষাদ নেমে আসবে ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি। ওয়াশরুমের নল ছেড়ে নিভৃতে বসে দু’চোখের অশ্রু বিসর্জন করছে। তার হৃদয়ে দহন হচ্ছে। সেই দহনে তীব্রভাবে পুড়ছে সে। তার মন বেহায়ার মত বলতে চাইছে, এই লোকটাকে ছাড়া সে কীভাবে থাকবে? তার লোমকূপের শিরায় শিরায় মিশে গেছে। তাকে ছাড়া দিনগুলো কীভাবে কাটবে তার? কিন্তু প্রকাশ করতে পারল কই? আজকের রাত পেরুলেই আগামীকাল আরাভ চলে যাবে। তার চিরচেনা সেই নগরীতে। নিজের জড়তা আজও কাটেনি, কিছুটা অভিমানও মিশে আছে তার উপর। তবু ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে চেয়েছিল, সে যেন এই দেশেই থাকে। তাকে স্পষ্টভাবে জিজ্ঞেসও করেছিল, বাংলাদেশে থাকলে কি সমস্যা?

কিন্তু আরাভের স্পষ্ট উত্তর ছিল তার জন্য। এই দেশে সে কীভাবে থাকবে? সে কানাডায় সিটিজেনশীপ পেয়েছে। সেখানকার পরিবেশ, জীবনের নিরাপত্তা থেকে শুরু করে শিক্ষা, চিকিৎসা ও জীবন ব্যবস্থা সবই হাজারগুণ উন্নত এই দেশ থেকে। এখানে ভালো কোন ভবিষ্যৎ নেই তার। সে খুব অবাক হয়েছিল এ কথা শুনে। তারপর তাকে জিজ্ঞেস করল, বলতো নায়াগ্রা জলপ্রপাত কোথায় অবস্থিত? সে উত্তরে বলেছিল, কানাডার অন্টারিওতে। এই কথায় সে মুচকি হেসেছিল তখন। তারপর জবাবে বলল, সেই জলপ্রপাত আমার শহরেই। অন্টারিও কিন্তু কানাডার বাণিজ্যিক শহর ও জনবহুল প্রদেশের মধ্যে প্রধান। বুঝতে পারছো সেই শহর কত উন্নত। তোমার জামাই একজন কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। সে অন্টারিওতে একটা বেস্ট কোম্পানিতে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত। যার মাসিক স্যালারি বাংলাদেশি টাকায় বিশ লক্ষ টাকার সমান। তারপর বল, তুমি কি তারপরও এই দেশে থাকতে চাও? তুমি যদি চাও, আলবার্ট্রা ইউনিভার্সিটিতে তোমার ভর্তির জন্য চেষ্টা করব। যাবে আমার সাথে?

সে তখন হ্যাঁ না কোন জবাবই দেয়নি। তার শুধু মন পুড়ছে দূরদেশে গিয়ে একা কীভাবে থাকবে। নিজের দেশ হোক অন্নুনত, তাও এই দেশ তার জন্মভূমি। সে থাকতে পারবে না ভিন্নদেশে গিয়ে। কিন্তু আরাভের অনুপস্থিতিও তাকে বড্ড পোড়াবে। তাই তো ওয়াশরুমে চোখের জল ফেলছে নীরবে নিভৃতেই। এই ভেজা চোখ, এই হাহাকার সে আরাভকে দেখাতে চায় না। যে তার জন্য একটু নিজের উচ্চাকাঙ্খা বিসর্জন দিতে পারে না। সে যাবে না তার সাথে। এই দেশেই পড়ে থাকবে।

রাতের অন্ধকার বাড়ছে ক্রমশই। আরাভ রুমে এসে দেখে পৌষী নেই কোথাও। সে কিছুটা আশাহত হল। চোখ বুলিয়ে বুঝল ওয়াশরুমে তার অবস্থান। সে দরজায় মৃদুশব্দে করাঘাত করল।

‘পৌষমাস, ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এস জলদি। কিছু জরুরী কথা আছে তোমার সাথে।’

পৌষী নিরুত্তোর। জবাব দেয়ার ইচ্ছে নেই তার। চোখের জল মুছে মুখে ভালো করে পানির ঝাপটা দিল। আরও কিছু সময় ব্যয় করেই সে বেরিয়ে এল। আরাভ বিছানায় বসে পা দোলাচ্ছে তখন। পৌষীকে দেখে বলল,

‘আসো একসাথে রাতের খাবার খাই।’

পৌষীর চোখমুখে কাঠিন্যে। বলল, ‘খিদে নেই। তুমি খাও।

আরাভ মুখ টিপে হাসল। বউয়ের অভিমান বেশ টের পেল সে। কিন্তু না বোঝার অদৃশ্য ভান করল। রগড় গলায় বলল,
‘তুমি কি আমাকে মিস করবে, পৌষমাস?’
পৌষীর এককথায় জবাব, ‘না।’

আরাভ নিভৃতেই হাসল আবারও। পৌষীর একহাত টেনে নিজের মুখোমুখি বসালো। তারপর মুখের সামনে ভাতের নোকমা তুলে বলল, ‘হা কর তো বউ। খেতে না চাইলেও খেয়ে নাও। আজকের রাতেই তো আছি, কাল থেকে কিন্তু নিজের হাতে খেতে হবে।’

পৌষীর বক্ষস্থল কেঁপে উঠল বোধহয়। চোখ তুলে একপলক চাইল আরাভের দিকে। তৃষ্ণার্ত দু’চোখ ছলছল করছে অজান্তেই। কিন্তু নিজেকে সংযত করল বেশ সন্তপর্ণে। এই নোনাজল, এই হাহাকার ও যাতনা এই লোককে দেখিয়ে কি লাভ। সে তো নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে উন্নত শহরের মাঝে। সে কাঁদবে না একদমই। কোনো উচ্চবাচ্য ছাড়াই আরাভের হাত থেকে খাবার খেয়ে নিল সে। কিন্তু হুট করে আবদার করে উঠল আরাভ,

‘শুধু নিজে খাবে? জামাইকে খাইয়ে দিবে না।’

‘নিজেই তো আমাকে ভাত মেখে খাওয়াচ্ছো। তাহলে আমি কীভাবে খাওয়াবো?’

আরাভ ফের হাসল। কিন্তু এই হাসিতে যে একরাশ কষ্ট আর হতাশা লুকানো ছিল তা পৌষীর অজানাই থাকল। আরাভ প্রতিত্তোরে জবাব দেয়নি আর। দু’জনের খাওয়া শেষ হতে সে বাইরে গেল প্লেট রাখার জন্য। আরাভ যেতেই পৌষী অস্থিরভাবে পায়চারী করছে পুরো রুম ছেড়ে। এভাবে না বললেই পারত আরাভকে। কিন্তু কি করবে? নিজের অভিমানকে দমাতেই পারছে না। আরাভ রুমে ফিরে আসতেই দু’জনেই ভীষণ চুপচাপ। আরাভ রুম ছেড়ে বারান্দায় গিয়ে বসল। চুপ থাকা আরাভ যেন বেশ ভয়ংকর মানব। তাই পৌষীর ইচ্ছে হলেও আরাভের কাছে গিয়ে বসতে পারেনি। তার ভয় লাগে এই আরাভকে। কিন্তু আরাভের এমন নিশ্চুপতা তাকে ভীষণ পীড়া দেয়। কি করবে সে এখন? সদুত্তর পায় না নিজের কাছে।

দীর্ঘ সময় কাটিয়ে আরাভ রুমে এল। পৌষী তখন শুয়ে পড়েছে। অথচ নির্ঘুম তার দু’চোখ। আরাভও তার গা ঘেঁষে শুয়ে পড়ল। তাকে কাছে টানল অন্যান্য দিনের মত। পৌষীর কষ্টগুলো নিভৃতেই জমা হচ্ছে হৃদ কাননে। তাই মুখ ফসকে রুক্ষস্বর বেরিয়ে এল। বলল, প্লিজ ছাড়ো তো, ঘুমাতে দাও। আরাভ ছাড়ল না। বরং জড়িয়ে নিল দৃঢ় বন্ধনে। কিছুসময় পর টের পেল পৌষীর সিক্ত চোখমুখের। মেয়েটা কেঁদেকেটে একদম অবস্থা খারাপ করে ফেলেছে নিজের। মাত্র কিছু মুহুর্তের মাঝে চোখমুখ ফুলিয়ে ফেলেছে। কি মারাত্মক ব্যাপার! সে চোখের নোনাজল মুছে তার অধর ছোঁয়ালো সেখানে। রগড় গলায় বলল,

‘কে যেন বলেছিল, জামাইকে মিস করবে না। তাহলে এখন এত কাঁদছে কেন?’

পৌষী হঠাৎই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। বলল, ‘আমি এমনই কাঁদছি। তোমার জন্য কাঁদছি কে বলল?
‘আমার জন্য কাঁদছো কখন বললাম, জামাইয়ের জন্য কাঁদছো বলেছি? জামাইকে ভালোটালো বাসো না’কি, পৌষমাস?’

‘কোন জামাই? আমি তাকে চিনি না।’

আরাভ মৃদুশব্দ তুলে হেসে উঠল। রগড় গলায় বলল, ‘ও আচ্ছা! জামাইকে চিনো না তাহলে।’
পৌষীর কাট কাট জবাব, না।
আরাভ মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, ‘তাহলে জামাইয়ের সাথে চল। আর এভাবে একা একা বিছানায় কাঁদতে হবে না।’
পৌষী প্রতিত্তোর করেনি কিছুই। সেই রাতটা কাটল এভাবেই। আরাভ ক্লান্ত হয়ে ভোর রাতে ঘুমিয়েছে। কিন্তু পৌষীর চোখ ছিল নিদ্রাহীন।
___

সময় দ্রুত বহমান। আরাভ কানাডায় যাওয়ার তিনদিন গত হয়েছে আজ। পৌষীর ভাবতেই দু’চোখে নোনাজলের স্রোত নামে। বড্ড কষ্ট হয় তার। তার জামাই তাকে এভাবে রেখে চলে গেল। একটিবারও তার কথা ভাবল না। গত তিনদিনে তাকে কল দিয়েছে মাত্র দু’বার। পৌঁছানোর পর একবার, তার একদিন পরে কল দিয়ে বলেছে সে ভালো আছে। তার জন্য চিন্তা না করতে। ব্যস, এইটুকুই কথা হয়েছে তাদের মাঝে। আরাভকে ছাড়া তার একটুও ভালো লাগে না। চারপাশটা কেমন শূন্য শূন্য, যেন কেউ কোথাও নেই। কানাডা পৌঁছে কি তবে তাকে ভুলে গেল। নিজের কষ্টকে ভোলার জন্য আজ ভার্সিটি এসেছে। প্রায় বেশকিছু দিন ক্লাস মিস গিয়েছে তার। তাই কেমন যেন অগোছালো লাগছে। সে উদাসীন ছিল পুরো ক্লাস জুড়ে। শেষে সাফা তাকে ক্যান্টিনে নিয়ে এসেছে। কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি। তার উদাসীনতা কমেনি একটুও। সাফা বুঝল জামাইয়ের বিরহে বেচারি বড্ড কষ্ট পাচ্ছে। তাই বলে উঠল,

‘তোর আরাভ ভাইয়ের সাথে যাওয়া উচিৎ ছিল কিন্তু।’

পৌষীর শুকনো মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘তুই জানিস না, আমি যদি সাথে যাই, সে আর দেশে ফিরবে না।’

‘এখনো তো ঠিক নেই, দেশে কবে ফিরবে? তখন কি করবি?’
‘জানি না রে।’

পৌষী ক্যান্টিন ছেড়ে বেরিয়ে এল। সাফাকে বলল, ‘চলে যাচ্ছি। বাড়ি যাব। ভার্সিটিতে এসেও ভালো লাগছে না।’

সাফা আটকালো না আর। পৌষী এলোমেলো কদমে ছুটে চলল বাড়ির উদ্দেশ্য। আজ নিজেদের গাড়ি করে আসেনি। তাই বাসে উঠতে হবে তাকে। সে বাসের জন্য অপেক্ষারত। আচমকাই এক চেনা মুখ দেখে সে থমকালো। চেহারায় আগেরমত জৌলুশতা নেই, গায়ের উজ্জ্বল বর্ণ শ্যামবর্ণ হয়ে গেছে। আধ-পুরানো কুঁচকানো নীল শার্ট জড়ানো। চোখদুটো কোটরে দেবে আছে। তার এমন বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে তার অস্থিরতা বাড়ল হঠাৎ করে। যদি তার সাথে উল্টাপাল্টা কিছু করে বসে এই লোক। নিজমনে দোয়া-দরুদ পড়ে নিল। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে সাফওয়ান বলে উঠল,

‘পৌষী মাত্র পাঁচ মিনিট সময় হবে তোমার? কিছু কথা বলতে চাই তোমাকে।

পৌষী ঘাবড়ালো ভীষণ। বলল,
‘কিন্তু আপনি আমাকে চিনলেন কীভাবে? আমি তো আজকে অন্যরঙের বোরকা পরিহিত। হিজাবও ভিন্ন পরেছি। তাও কিভাবে চিনতে পারলেন?’

সাফওয়ান হাসল। সেই হাসিতে অসহায়ত্ব। সে যদি আজ আরাভ হত। তাহলে হয়ত এই মেয়েকে নিজের করে পেত। অথচ ভাগ্যের কি পরিহাস! মেয়েটা তার হয়নি। যে ছেড়ে গেছে সেই ঘুরেফিরে তাকেই পেল। বিড়বিড় করল আপনমনে, ভালোবাসার মানুষ যেই রূপে থাকুক না কেন, তাকে খুব সহজেই চেনা যায়। এটা খুব বেশি কঠিন নয়। কিন্তু মুখ ফুটে বলল অন্যকিছু,

‘তোমার হাঁটা দেখে।’

পৌষী সেই কথার জবাব দেয়নি আর। কিন্তু সাফওয়ানের অসহায়ত্ব অনুরোধ ফেলতে পারেনি আর। কি বলতে চায় তাকে? জানার জন্য ব্যাকুল হল সেও। বলল,
‘ঠিক আছে বলুন। কিন্তু সময় মাত্র পাঁচ মিনিট।’

সাফওয়ান রেষ্টুরেন্টের ভেতর বসতে আবদার করল। কিন্তু পৌষী সেই আবদার নাকোচ করে দিল সাথে সাথেই। বলল,
‘এখানেই বলুন, অন্য কোথাও যেতে পারব না।’

সাফওয়ান হতাশ হলেও কিছুই বলল না জবাবে। কিছু ভ্রান্ত ধারণা আর ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটাতে সে এসেছে এখানে। আর কিছু নয়। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘আরাভ কেমন আছে?’

‘ভালো।’
‘আরাভ কিন্তু তোমাকে অনেক ভালোবাসে, তাই না! তবে তার একটা ভ্রান্ত ধারণা আছে। তার মতে, আমি না’কি তোমাকে কষ্ট দিয়েছি। তোমার সাথে প্রেমের অভিনয় করেছি। এজন্য সে আমার উপর চরমভাবে প্রতিশোধ নিচ্ছে। আমার বিরুদ্ধে মানহানীর মামলা ঠুকে দিয়েছে সে। পুলিশ আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে এখন। আর আমি সেই ভয়ে উদভ্রান্তের মত পালিয়ে বেড়াচ্ছি দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। পৌষী তুমিই বল, আমি কি অন্যায় করেছি তোমার সাথে? ভালোই তো বেসেছিলাম শুধু!’

‘সত্যিটা আপনিই বলুন, কি করেছেন আমার সাথে? আরাভ আপনাকে এমনিতে মামলা ঠুকে দিল?’

‘দেখ, তুমি আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছো? এটা যেমন ঠিক। প্রথমে কিন্তু তুমিই আমার সাথে নিজ থেকে কথা বলতে। আমার সাথে ঘুরেছো। বরং আমার কাছে এসেছিল তুমিই আগে, আমি নই।’

‘আমি আপনার কাছে যাইনি। একা একা আমি বিষন্ন মনে ঘুরতে বেরিয়েছি আপনি এসে আমাকে সঙ্গ দিয়েছেন। এর থেকে বেশি কিছু নয়। কিন্তু আপনি বলেছেন আমি আপনার সাথে প্রেমের অভিনয় করেছি। আপনাকে ধোঁকা দিয়েছি। এসব কখন করেছি আমি? আপনার সাথে রিলেশন তো দূরে থাক, আপনার সাথে খুব বেশিই কথাই হইনি কখনো। তাহলে প্রেমে ধোঁকা, অভিনয় এসবের প্রশ্ন আসল কীভাবে?’

সাফওয়ান হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে আছে। আমতা আমতা করে বলল, ‘আসলে আমি আরাভের উপর ক্ষুব্ধ ছিলাম। তোমাকে না পাওয়ার পেছনে তাকেই দায়ী করতাম। এজন্য সবাইকে বললাম, তুমি আমার সাথে প্রতারণা করেছো। বন্ধুমহল থেকে আরাভের কানেও পৌঁছায় একই কথা। কিন্তু সে এখন আমার উপর চওড়া হয়েছে। বলছে, আমি না’কি তোমাকে বাজেভাবে দেখতাম। প্লিজ, আমার অপরাধ আমি স্বীকার করছি, আমি মিথ্যা বলেছি। কিন্তু তোমাকে বাজেভাবে দেখতাম এটা অন্তত বলতে পারে না। আমি তোমাকে সত্যিই ভালোবাসতাম। এটা তুমি বিশ্বাস কর বা না কর। কিন্তু এটাই সত্যি।’

পৌষীর মুখটা পাংশুটে বর্ণ ধারণ করেছে। কথা বলতে ভালো লাগছে না তার। শেষোক্ত কথার জবাব দিয়ে বলল, ‘আপনার নামের মামলা উঠিয়ে দেব। পুলিশ আর ডিষ্টার্ব করবে না। এখন যেতে পারেন।’

সাফওয়ান আরও কিছু বলতে চাইল। কিন্তু পৌষীর বিরক্তিকর চাউনি দেখে সাহস হল না তার। চুপচাপ সে পৌষীর যাওয়া দেখল শুধু।

চলবে,,,,,