প্রিয় বিকালফুল পর্ব-০৩

0
65

#প্রিয়_বিকালফুল(০৩)
#তানিয়া_মাহি(নীরু)

“এই পিচ্চি মেয়ের সাথে তুমি আমার বিয়ে ঠিক করেছ, আম্মা? ওর এখন যা বয়স তখন আমি বিয়ে করলে ওর বয়সী একটা মেয়ে হতো আমার। কীভাবে পারো তুমি এমন উদ্ভট কাজ করতে? বিয়ে করছি না বলে তুমি এমন একটা কাজ করবে? আর এই পিচ্চি মেয়েও রাজি হয়ে গেল আমাকে বিয়ে করতে? ওর বাবা-মা আমার বয়স জানে না? ওর বয়সের দ্বিগুণ আমার বয়স। মানে তোমাদের চোখ আর মস্তিষ্ক কি কাজ করা কি বন্ধ করে দিল? এই মেয়ের সাথে আমি সংসার করব!?”

উৎসর কথায় তেড়ে এলেন ফরিনা বেগম। ছেলের বুকে ধাক্কা দিয়ে বলে উঠলেন,“মায়ের মুখের ওপর কথা? নিজের পছন্দে তো একবার একজনকে নিয়ে এসেছিলে, কী হলো? এবার তোমাকে আমার পছন্দেই বিয়ে করতে হবে। বয়সে তাদের কোন সমস্যা না থাকলে তোমার কেন হচ্ছে শুনি? আর এই মেয়ে কে? বিয়ের সাজে কেন?”

শেষের কথাটা নিতুর দিকে তাকিয়ে বললেন তিনি। নিতু সবগুলো কথা ছেড়ে একটা কথাতেই পড়ে রইল। কানে বাজতে লাগল সে কথা। -নিজের পছন্দে তো একবার একজনকে নিয়ে এসেছিলে, কী হলো?

বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল নিতুর। উৎসর দিকে এক পলকে চেয়ে রইল সে। তার মানে উৎস বিয়ে করেছিল!? তাহলে এখন আবার বিয়ে কেন? আশেপাশে হয়তো কাউকে খুঁজলো সে। হয়তো কোন এক পরিচিত মুখ যার সাথে উৎস জীবন সাজিয়েছিল। কিন্তু সে কোথায়? কী হয়েছিল উৎসর সাথে? তার নিজের অবর্তমানে কী কী ঘটে গেছে!?

মাথা নিচু হয়ে এলো নিতুর। উৎস বলে উঠল,“আম্মা, আর যা-ই হোক নিজের হাঁটুর বয়সী কোন বাচ্চা মেয়েকে বিয়ে করতে পারব না আমি। বিয়ের পর ও-লে-লে ও করতে পারব না। অনেক পথ জার্নি করে এসেছি এসব আর ভালো লাগছে না। এসব চলতেই থাকলে আমি কিন্তু বাড়িতে তুলকালাম কান্ড বাধিয়ে দিব বলে রাখলাম।”

ফরিনা বেগম নিতুর দিকে ইশারা করে বলল,“এই মেয়ে কে? তুমি কি ওকে বিয়ে করে এনেছ? যদি বিয়ে করে আনো তবে তোমাদের মেনে নিব কি না সেটা ভেবে দেখব তবে যদি বিয়ে না করো তবে জেনে রাখো সোহাকেই বিয়ে করতে হবে তোমার আর সেটা আজ, এখনই, এই মুহূর্তে। আজ কোন মাফ নেই মানে মাফ নেইই। তুমি আমাকে বেশ ভালো করেই চেনো, উৎস। দুইটা অপশনের যেকোন একটা আজ হতেই হবে। হয় সোহা নয়তো এই মেয়ে।”

উৎস মনে মনে ভাবলো, মরার চেয়ে খোঁড়া হয়ে থাকা ভালো। সবাইকে অবাক করে দিয়ে সে হঠাৎ নিতুর হাত ধরে মাকে দেখিয়ে বলল,

“ও নিতু। হ্যাঁ, আমরা আজই বিয়ে করেছি। শুনেছ? শান্তি পেয়েছ এবার? ভেবেছিলাম সারপ্রাইজ দেবো কিন্তু বাড়িতে যে পরিস্থিতি তৈরি করে রেখেছ! এবার এসব বন্ধ করো।”

উৎসর কথা কানে যেতেই নিতু অবাকচোখে উৎসর দিকে চেয়ে রইল। চোখ দুটো যেন এখনই বিস্ফোরিত হবে। আশেপাশের সবার মধ্যে ফিসফিস শব্দে কথা বলাবলি শুরু হলো৷ সোহা কান্না করতে করতে এতক্ষণে রুমের ভেতরে চলে গিয়েছে। সবার মুখে বিস্ময়, রাগ, অভিমান ঠিকড়ে পড়লেও ফরিনা বেগমের মুখে উজ্জ্বল হাসি খেলে গেল। নিতুর গালে হাত দিয়ে বললেন,

“মাশাআল্লাহ! কী সুন্দর দেখতে আমার বউমা! এ যেন আকাশের চাঁদটা জমিনে নেমে এসেছে।”

ফরিনা বেগমের কঠিন রূপ থেকে হঠাৎ এমন পল্টি খাওয়া দেখে এক পাশে থেকে সোহার মা সোহার বাবাকে বলে উঠল,“গাড়ি বের করো। আপার তো বউ পছন্দ হয়েই গেছে। আমি আর আমার মেয়েকে নিয়ে এখানে অপমানিত হতে চাই না। এখনই গাড়ি বের করো। এখানে আর এক মুহূর্তও না।”

সোহা দৌঁড়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। হাতে নিজের পার্সব্যাগ। সেটাই আনতে সম্ভবত দৌঁড়ে ভেতরে গিয়েছিল। মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠল,

“আমার বিয়ে হলো না, মা। আমার কী হবে এখন? আমি ফেসবুকে ম্যারিড স্ট্যাটাস দিয়েছি।”

সোহার মা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, “কিচ্ছু হবে না, মা। পোস্ট ডিলিট দিয়ে দিলেই হবে। আমি তোকে আরও ভালো ছেলের সাথে বিয়ে দেব। তখন বিয়ের পর জামাইসহ ছবি তুলে স্ট্যাটাস দিবি।”

“আমার এখন স্যাড পোস্ট দিতে ইচ্ছে করছে, মা। এই লোক আমার মন ভেঙে দিয়েছে।”

“আগে বাড়ি যাই চল, পরে যা ইচ্ছে পোস্ট করে দিস। মুখোশ খুলে দিস এদের৷ প্রয়োজনে লাইভে গিয়ে আসল চেহারা সামনে আনবি।” বলেই মেয়েকে ধরাধরি করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন তারা তিনজনে।

অনেকেই মুহূর্তের মধ্যে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছে। হাতেগোনা কয়েকজন সেখানে এখনো উপস্থিত। ড্রয়িংরুমে এসে বসেছে সবাই। নিতু আর উৎস পাশাপাশি বসে আছে। কারও মুখে কোন কথা নেই। ফরিনা বেগম নিরবতা ভেঙে বলে উঠলেন,

“তোমরা বিয়ে করলে কখন?”

উৎস একবার নিতুর দিকে চাইল। নিতু তখনও কিংকর্তব্যবিমুঢ়। কী হচ্ছে, কী হতে চলেছে কিছুই বুঝতে পারছে না। এই অবস্থায় কিছু বলা উচিৎ হবে কি না সেটাও বুঝতে পারছে না। সে শুধু মাথা নিচু করে চুপচাপ অপ*রাধীর মতো বসে আছে।

উৎস মায়ের প্রশ্নের জবাবে বলল,”আজ ওর বাবা ওকে জোর করে অন্য জায়গায় বিয়ে দিয়ে দিচ্ছিল। আমি গিয়ে ওকে নিয়ে এসেছি। কাজি অফিসে বিয়ে করে নিয়েছি দুজন।”

ফরিনা বেগম সহসা বলে উঠলেন,“প্রমাণ দেখাও।”
”কীসের প্রমাণ?”
“বিয়ে করেছ তার প্রমাণ।”

নিতু উৎসর দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল, “বিয়ে করেছি কি না সেটার প্রমাণ চাচ্ছে এই মহিলা। সকালে দেখা গেল ডেকে আমার কাছে বাসর হয়েছে কি না সেটার প্রমাণ চাইল তখন কী করব? আপনার আম্মা কিন্তু একটা চিজ, মেজর সাহেব!। আমার নিজেকে এখন সত্যি সত্যিই আনলাকি মনে হচ্ছে। নিতু যেখানে, বিপদ সেখানে। আল্লাহ রক্ষা করো এবারের মতো।”

নিতুর কথা নিতু ব্যতীত আর কেউ শুনল না। উৎস মাকে বলল, ”কাগজপত্র এক সপ্তাহ পর দেবে। আমি বিয়ে করেছি সেটা তোমার অবিশ্বাস হচ্ছে? আমি এই রাতে লালশাড়ি পরা কোন মেয়েকে তোমার সামনে হাজির করব কীভাবে? মেয়ে এত সস্তা না-কি যে বউ সেজে রাস্তায় ঘুরে বেড়াবে আর আমি টুপ করে তুলে আনব? অনেক রাত হয়েছে,আম্মা। এসব আর ভালো লাগছে না, আমি রুমে যাচ্ছি।” বলেই উঠে দাঁড়ালো উৎস।

নিতু মাথা তুলে উৎসর দিকে চাইল। ফরিনা বেগম বললেন,“তুমি একা একা রুমে চলে যাচ্ছ, তোমার বউ কি এখানে সোফায় ঘুমাবে নাকি?”

জিহ্বায় কামড় খেল উৎস। মা তার বড্ড চালাক। যেকোনো পরিস্থিতিতে আসল ঘটনা ধরে ফেলতে ওস্তাদ। তার চোখে ধূলো দেওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। সে মায়ের কথার উত্তর না দিয়ে নিতুকে ডেকে বলল,

”এসো, ঘুমোবে না? আলাদা করে ডাকতে হবে কেন? আমি যেখানে যাব, তুমি বসে না থেকে সেখানেই তো যাবে তাই না?”

নিতু উঠে দাঁড়ালো। উৎস নিজের রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়াতেই ফরিনা বেগম একজনকে ডেকে বললেন,
“যা তো কাজিকে ডেকে নিয়ে আয়। ওদের আমি আবার বিয়ে দেব।”

দুজনের চোখ যেন চড়কগাছ। উৎস আর নিতু একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করছে। উৎসর মন বলছে তার মা কিছু সন্দেহ করেছে বা তার কোন কথাই বিশ্বাস করেনি। মায়েদের কেন এত চালাক হতে হবে এই কথাটাই বুঝতে পারে না সে। বয়স তো তার কম হলো না। বিয়ের বয়সও পেরিয়ে যাওয়ার যোগাড়। প্রায় পয়ত্রিশ হতে চলল। এ বয়সে মা তাকে বিয়ে করাতে উঠে পড়ে লেগেছে। যেন জিন্দা যেকোন একটা মেয়ের সাথে বিয়েটা দিয়ে দিতে পারলেই তিনি বেঁচে যান। এমন পরিস্থিতিতে কিছু বলা মানে আরও ফেঁসে যাওয়া। এক বিপদ থেকে পালিয়ে আরেকটা বিপদে এভাবে পড়তে হবে সেটা কল্পনাও করতে পারেনি নিতু। এখন তার সবকিছু এলোমেলো লাগছে। ইচ্ছে করছে সব সত্য বলে দিতে কিন্তু যে মানুষটা তাকে আশ্রয় দেওয়ার কথা ভেবেছিল তাকে বিপদে ফেলা ঠিক হবে কি না সেটাই ভেবে পাচ্ছে না সে কিন্তু তার কথা ভেবে নিজেকে এমন বিপদে ফেলাও তো বেইনসাফি কাজ।

দুজনকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ফরিনা বেগম আবার বলে উঠলেন,“দাঁড়িয়ে রইলে কেন? বোসো। শুনলে না আমার কথা? তোমাদের আবার বিয়ে পড়ানো হবে তারপর রুমে যাবে। আমি কোন ত্রুটি রাখতে চাই না। ছেলের বিয়ে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে আবার দিতে চাই। নিজের চোখকে শান্ত করতে চাই।”

উৎস মায়ের দিকে এগিয়ে এসে কণ্ঠস্বর নরম করে বলল,“আম্মা, এতরাতে এসব ঝামেলা না করলেই হচ্ছে না? কেন এমন করছো?”

“বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে কেন তোমার? লাগবে তো আধাঘণ্টা। এটুকু সময় দেরি করে রুমে গেলে কিছুই হবে না। তুমি আমার কথা না শুনলে আমি ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দেব, উৎস। মাথায় রেখ আমার কথা।”

“ভয় দেখাচ্ছ? আমি এসব আর করতে পারব না। আমি রুমে যাচ্ছি।”

“আমার কথামতো কাজ না হলে আমি তোমাকে এই রাতে বাড়ি থেকে বের করে দেব, উৎস। ভেবো না মেজর হয়েছ বলে তোমাকে মাথায় করে রাখব। অনেক বছর চুপ করে থেকেছি। আজ আমার কথাই শেষ কথা। তুমি নতুন করে আমার সামনে এখনই আবার বিয়ে না করলে আমি সত্যি সত্যি ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দেব। আগামীতে হাতেপায়ে ধরতে আসবে না। প্রয়োজনে আমি নিজেই এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাব।”

নিতু অসহায় চোখে উৎসর দিকে তাকিয়ে আছে। হুটহাট কিছু বলে দেওয়া বা কোন সিদ্ধান্ত চুপচাপ মেনে নেওয়া দুটোই এখন বোকামি হবে। এতক্ষণ সে শুধু মাথা ঠান্ডা করে ভাবছিল কী করা যায় কিন্তু কিছুতেই কিছু মাথায় আসছে না। শুধু মনে হলো দুজনের আলাদা করে একটু কথা বলা প্রয়োজন। সে লজ্জার মাথা খেয়ে ফরিনা বেগমের দিকে এগিয়ে গেল। মাথানিচু করে বলল,

“আম্মা, আমি একটু ওর সাথে আলাদা করে কথা বলি? রাস্তায় একটু ঝামেলা হয়েছিল তো তাই মাথাটা একটু গরম। আমি একটু বোঝাই? কাজি সাহেব আসতে আসতে আমরা একটু ফ্রেশও হয়ে আসি।”

ফরিনা বেগম কিছুক্ষণ নিশ্চুপ রইলেন। মেয়েটা ভুল কিছু বলেনি ভেবে বললেন, “যাও। দশ মিনিট সময় দিলাম। দশ মিনিট পরই আমি তোমাদের দুজনকে আবার এখানে চাই। চাই মানে চাই। কথার যেন কোন নড়চড় না হয়। আজ যদি আমার সামনে আবার বিয়েটা না হয় তাহলে আমি কিছু একটা করে ফেলব। উৎস, আমাকে নিশ্চয়ই তুমি চেনো। আমার কথার যেন কোন অন্যথা না হয় এবার।”

কথাগুলো বলেই ফরিনা বেগম ত্রস্ত পায়ে নিজের রুমে চলে গেলেন। উৎস নিতুকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“আমার সাথে আসুন।

চলবে…..