প্রিয় বিকালফুল পর্ব-২৪

0
19

#প্রিয়_বিকালফুল(২৪)
#তানিয়া_মাহি(নীরু)

নিতু প্রায় সারাদিন উৎসের সাথে কোন কথা বলেনি৷ উৎস বারবার এটা ওটা করে নিতুর রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করেছে। নিতু নিজেও মনে মনে চায় দুজনের দূরত্ব এবার অন্তত কমে যাক। একটা মানুষকে এতগুলো বছর ভালোবাসার পর যখন নিজের প্রতি সেই মানুষটার ভালোবাসা অনুভব করছে তখন তো এই ভালোবাসা লুফে নেওয়া উচিত। তৃষ্ণার্ত কাকের মতো ছটফট করা প্রাণটা এবার ভালোবাসায় শীতল করে নেওয়া প্রয়োজন কিন্তু নিতু সেটা পারছে না। ভেতরকার অভিমান যেন বারবার তার গলা চেপে চুপ করিয়ে রেখেছে। উৎসের চোখে চোখ রেখে সে কথা বলতে পারছে না। সে পারছে না উৎসের এত নত হওয়ার পরও সবকিছু স্বাভাবিক করে নিতে। কেউ একটা আটকে দিচ্ছে তাকে। উৎসের কাছে যেতে বাঁধা দিচ্ছে। মনে করিয়ে দিচ্ছে ভালোবাসা না পাওয়ার কথা।

সবকিছু বুঝেও মনকে শান্ত করতে পারছে না নিতু। সব ভুলে একবার উৎসের বুকে আশ্রয় করে নিতে পারছে না সে। নিজের কাছে নিজেকে হেরে যেতে দেখে নিজেরই অবাক লাগছে, নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে তার। এ কেমন যন্ত্রণা! কাছে যেতে চেয়েও যে পা টা আটকে যাচ্ছে।

সারাক্ষণ উৎস মস্তিষ্ক জুড়ে বসে আছে, মনের মধ্যে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অথচ শরীর অবধি এসে পৌঁছাতে পারছে না। পারছে না হাত দুটি ধরে আরও একবার মনের কথা বলতে। সম্ভব হচ্ছে না বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে সমস্ত আ*গুন নিভিয়ে নেওয়া। এমন অস্থির সময় কেন কাটতে চাইছে না? কেন সবকিছু সহজ হচ্ছে না?

বিছানায় আজ রাতে দুটো দেহই জায়গা পেয়েছে শুধু দূরত্বটা আগের মতোই রয়ে গেছে। দুজন দুইদিকে ঘুরে চুপচাপ শুয়ে আছে। উৎসের মনটা ছটফট করছে নিতুর সাথে আগের মতো স্বাভাবিক হতে। সে খুব করে চাইছে নিতু আগের মতো হয়ে যাক। তার এই চুপচাপ স্বভাব একেবারেই মেনে নিতে পারছে না সে।

নিতুকে নিয়ে ভাবনার সমাপ্তি ঘটিয়ে উৎস নিতুর দিকে ফিরল। মৃদু গলায় ডাকল,

“নিতু…”

নিতু একটু নড়েচড়ে উঠল। জবাব দিল,
“হুম?”
“এদিকে হবে না?”
“এভাবেই ঠিক আছি।”
“প্লিজ।”

কিছুক্ষণ নিরব রইল দুজনই। তারপর নিতু ঘুরলো। উৎসের দিকে হয়ে তার চোখে চোখ রেখে বলল,
“ঘুমাননি কেন?”
“ঘুম নেই।”
“কেন?”

নিতুর প্রশ্নের জবাব এলো না। কিছুক্ষণ পর উৎস বলল,“আমাকে মাফ করতে পারছো না? যে-ই তুমি কাছে আসতে কতকিছু করতে আর আজ কি না দূরত্ব বাড়িয়েই চলেছ?”

নিতু দীর্ঘশ্বাস ফেলল। চাপাস্বরে বলল,“আপনি আপনার জায়গায় একদম ঠিক ছিলেন আর আমিও খুব একটা ভুল ছিলাম তা না। আমরা দুজনই নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেছি কিন্তু সমস্যাটা আমার। আমি কিছুতে ইগোকে সরিয়ে আগের মতো হতে পারছি না। আমি বুঝতে পারছি না আমার সাথে এমন কেন হচ্ছে! আমি কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারছি না আপনার সাথে।”

নিতু একটু থেমেই ফের বলে উঠল,“আমার অশান্তি লাগছে, উৎস। আমি একটু ভালো থাকতে চাই। আমার খারাপ থাকার পাল্লা এত ভারি হয়ে উঠেছে যে আমি খুব করে চাইলেও ভালো থাকতে পারছি না। আমি একটু ভালো থাকতে চাই।”

শেষের কথাগুলোতে নিতুর গলা ভারি হলো। উৎস বুঝল নিতুকে। সে ঠোঁট টিপে মৃদু হাসার চেষ্টা করে বলল,“সময় নাও তবে প্লিজ চলে যাওয়ার কথা ভেবো না। আমি আরেকটা বার ভালোবাসার কাছে হেরে যেতে চাই না।”

দুজনের আর কথা হলো না। নিতুর কান্না পাচ্ছে। নিজের সাথে যু*দ্ধ করে জিতে যাওয়াটা যে বেশ কঠিন। মস্তিষ্ক চায় এক আর মন চায় আরেক। একই দেহে যখন মন আর মস্তিষ্কের যু*দ্ধ চলে তখন মানুষটা হয়ে যায় অসহায়।

ফুঁপিয়ে উঠল নিতু। উৎস নিতুর কান্নার শব্দ পেতেই চোখ বন্ধ করে নিল। কী ভেবে নিজে থেকেই নিতুকে টেনে নিজের বুকে জড়িয়ে নিল। এই প্রথম নিজের ব্যক্তিগত পুরুষের স্পর্শ, বুক পেয়ে যেন আরও বাঁধভাঙা হলো নিতু। এ স্পর্শে শিহরন নয় আহ্লাদ যেন কয়েকগুণ বেড়ে গেল। চলে গেল নিয়ন্ত্রণের বাহিরে। উৎসের বুকে মুখ গুজে বারবার ফুঁপিয়ে উঠল। কান্না জড়ানো গলায় পরক্ষণেই বলে উঠল,

“ছাড়ুন আমাকে। একদম ধরবেন না। আপনি আমার কেউ নন।”

উৎস নিতুকে না ছেড়ে আরও শক্ত করে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল। মৃদু গলায় বলল,

“আচ্ছা আমি তোমার কেউ নই। তুমি কেঁদে নাও। ইচ্ছেমতো কাঁদার জন্যও একটা বুক প্রয়োজন হয় সেটা নাহয় আমিই দিলাম তোমায়। আমি একটুও ভাববো না তুমি আমাকে মাফ করে দিয়েছ।”

নিতু তবুও নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টায় ব্যস্ত।____

নিতু সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজেকে উৎসের অতি নিকটে আবিষ্কার করল। উৎস তখনো ঘুমে। এক হাতে জড়িয়ে ধরে আছে নিতুকে। নিতু ধীরে ধীরে ছাড়িয়ে নিল নিজেকে। উঠে ফ্রেশ হতে চলে গেল। গতকালের পরনের জামাটা এখনো পরিবর্তন করা হয়নি তার। সারাদিন রুমে চুপচাপ বসে অথবা ঘুমিয়ে কাটিয়েছিল গতকাল। মাত্র দুটো ড্রেস নিয়ে এসেছে সে নিজের সাথে। সেখান থেকেই একটা পরে নিল। রুমে এসে বন্যাকে কল দিল। এই সময়টা বন্যার অফিসে যাওয়ার আগ মুহূর্ত। কিছুক্ষণ রিং হতেই কল রিসিভ হলো। ওপাশ থেকে বন্যা বলে উঠল,

“বর পেয়ে বান্ধবীকে ভুলে গেলি?”

নিতু জানালার দিকে এগিয়ে গেল। পর্দাটা হালকা সরিয়ে বলল,
“তোকে ভুলে গেলে আমার মনুষ্যত্ব নামক জিনিসটাই হারিয়ে যাবে।”
“হয়েছে হয়েছে। কী করছিস বল?”
“ফ্রেশ হলাম।”
“তোর বর?”
“সে ঘুমায়।”
“সবকিছু ঠিকঠাক হলো?”
“উহু।”
“একটা দিন, একটা রাত চলে গেল তাও ঠিকঠাক হলো না? এটা কোন কথা!”
“সে চেষ্টা করছে।”
“তুমি দাম দিচ্ছ না? পস্তাবি শা*লি।”
“ভাই, আমি কিছুতেই নরমাল হতে পারছি না। ফিরে আসতে চেয়েছিলাম, উনি নিয়ে এসেছেন যেকোন মূল্যে। আমিও সবকিছু ঠিক করে নিতে চাইছি কিন্তু কিছুতেই পারছি না। এখন আমার চোখে উনার কোন দোষও দেখছি না তবুও।”

বন্যা মৃদু গলায় বলল,“উনি দ্বিতীয়বার কাউকে ভালোবাসতে পারবে না, এই কথাটা শুধু ভুলে যা তুই। এবার ভেবে দেখ উনার কোন ভুল নেই। নিজের ভুল দেখতে পাবি। প্লিজ মনকে বোঝা, নিতু।”

“হুম।”

নিতু ফের বলল,“আমার জামাকাপড় কিছু পাঠাতে পারবি?”
“আমি অফিসের জন্য বের হব। ওখান থেকেই পাঠিয়ে দিব তাহলে। এখন নিয়ে বের হই।”
“ঠিক আছে।”

বন্যার সাথে কথা শেষ করে রান্নাঘরে গেল নিতু। কাজের মেয়েটা নাশতা তৈরি করছিল। নিতুকে দেখেই আলাপ জমানোর চেষ্টা করল সে। নিতুও চা করতে করতে মেয়েটার সাথে ভালো সময় পার করল। দুই কাপ চা নিয়ে ফরিনা বেগমের রুমে টোকা দিল নিতু। ফরিনা বেগম ভেতর থেকে বলে উঠলেন,

“দরজা খোলা আছে।”

নিতু রুমে ঢুকতেই তার হাতে চায়ের কাপ দেখে ফরিনা বেগম বেশ উচ্ছ্বসিত হলেন। নিতু এক কাপ চা এগিয়ে দিতেই তিনি হেসে বললেন,

“আবার সেই চা! কতদিন খাই না। তোর বানানো চায়ের কোন তুলনাই হয় না, মা।”

নিতু গিয়ে ফরিনা বেগমের পাশে বসল। নিজের চায়ের কাপটা পাশে রেখে মাথানিচু করে বলল,
“আম্মা, আমার মন ভালো নেই৷ প্লিজ একটু মন ভালো করে দিন।”

ফরিনা বেগম চায়ের কাপে চুমুক বসালেন তারপর চোখ বন্ধ করে একবার শ্বাস নিলেন। চায়ের কাপটা পাশে রেখে হাত বাড়িয়ে নিতুকে কাছে ডাকলেন। ভালো করে বসে বললেন,

“কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়।”

নিতু দেরি করল না। ফরিনা বেগমের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। ফরিনা বেগম বিভিন্ন কথা শুরু করলেন। মেয়ের মন ভালো করার দায়িত্ব নিয়েছেন বলে কথা! দুজনের ধীরে ধীরে স্বাভাবিকভাবেই কথা চলছিল। ফরিনা বেগমের কোন কোন কথায় মৃদু হাসি ফুটছিল নিতুর ঠোঁটে। দুজনে যখনই মেতে উঠল গল্পে তখনই দরজায় শব্দ হলো। নিতু এবং ফরিনা বেগম দুজনই একসাথে সেদিকে তাকালো। উৎস দাঁড়িয়ে আছে৷ দুজনকে একসাথে এবং সাথে চায়ের কাপ দেখে বলে উঠল,

“এক কাপ চা হবে, প্লিজ?”

#চলবে……