প্রিয় বিকালফুল পর্ব-২৮

0
156

#প্রিয়_বিকালফুল(২৮)
#তানিয়া_মাহি(নীরু)

“আমি একটা মানুষ যার জীবনের একটা দীর্ঘ সময় কেটেছে মিথ্যের মধ্যে। যে মানুষটা ঠকালো তাকেই ভালোবেসে ঠকে যাওয়ার কারণে আমি তোমাকে হারাতে বসেছিলাম। কত বোকা আমি!”

নিতু কোমলস্বরে শুধালো, “আপনি আমাকে বিশ্বাস করেছেন? আমি আপনাকে সত্যিটা জানাতে ভয় পাচ্ছিলাম৷ মনে হয়েছিল আপনি আমাকেই ভুল বুঝবেন।”

উৎস নিতুর গাল ছুঁয়ে বলল,“আমি অবুঝ নই, নিতু তবে সত্যিটা হজম করতে কিঞ্চিৎ সময় লাগছে এবং লাগবে।”
“আপনি বিশ্বাস করেছেন তো যে আমি মিথ্যা বলিনি? আমিই আপনার..”

নিতুকে থামিয়ে দিয়ে উৎস বলে উঠল,
“প্রিয় বিকালফুল।”

নিতু এক পলকে চেয়ে রইল উৎসের দিকে। উৎসের হাত তখনও নিতুর গাল ছুঁয়ে আছে। দুজনের চোখ দুজনাতে সীমাবদ্ধ। কোন এক ক্ষণে নিতুর চোখ ছলছল করে উঠল। মৃদু গলায় বলল,

“আপনার বিকালফুল জুই ছিল না, আপনার বিকালফুল ছিলাম আমি, ক্যামেলিয়া।”

উৎসের মধ্যে আফসোসের সৃষ্টি হলো।
“তুমি তো তোমার নামটাও বলেছিলে না। শুধু হিন্ট দিয়েছিলে কোন এক ফুলের নামে তোমার নাম৷ জুই যখন সামনে এসেছিল, নিজের পরিচয় দিয়েছিল স্বাভাবিকভাবে আমি তাকেই মেনে নিয়েছিলাম। আমার এখন ভীষণ আফসোস হচ্ছে। মানুষ চিনতে না পেরে আমার জীবনের এতগুলো বছর নষ্ট হলো। আমাকে এত ভালোবাসা, এত করে চাওয়া মানুষটাকে আমি চিনতেই পারিনি।”

নিতু নিজের গালে রাখা উৎসের হাতে নিজেও হাত রাখল। বলল,
“আপনার প্রতি অনুভূতি জন্মেছিল সেটা প্রগাঢ় ভালোবাসায় রূপ নেওয়ার আগেই সবচেয়ে কাছের বন্ধুটি আপনাকে কেড়ে নিল। আপনিও চিনলেন না। আমি পরে জুইয়ের সাথে কখনো এ বিষয়ে কথাও বলিনি। শুধু সে একবার সবকিছু সামনে আসার ভয়ে আমাকে অনুরোধ করেছিল আমি যেন আসল সত্যিটা আপনাকে না জানাই। সে আমাকে বলেছিল, আপনাকে প্রচন্ড ভালোবাসে। আমিও চাইলাম আপনি ভালো থাকুন। তবে আপনাদের দুজনকে নিজের চোখের সামনে একসাথে দেখতে পারছিলাম না। কান্না আসতো আমার। তখনই মায়ের সাথে জিদ করে ওইটুকু বয়সে সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিই। নিজের এলাকা ছাড়ি। নির্দিষ্ট একটা সময়ে নিজেকে কিছুটা ভালো রাখার দায়ে বিদেশে পাড়ি জমাই। ভেবেছিলাম আপনারা ভালোই আছেন।”

উৎস নিতুর দিকে কিছুটা এগিয়ে নিতুর কপালে চুমু খেলো। মায়াভরা চোখে নিতুকে দেখলো কিছুক্ষণ।

“আশা করছি আমার সত্যিকারের বিকালফুলের সাথে আমার সারাটা জীবন ভালো কাটবে। সৃষ্টিকর্তা যেহেতু নিজেই তোমাকে দ্বিতীয়বারের মতো আমার কাছে পাঠিয়েছেন, আমার করে দিয়েছেন সেহেতু তোমাকে আমার সাথে তিনিই ভালো রাখবেন। উনার পর তোমার সব দায়িত্ব আমার। আমি থাকাকালীন একটা আঁচড় তো দূর কোন কঠোর কথাও তোমাকে আঘা-*ত করতে পারবে না। আমি গত কয়েকদিনে বুঝেছি, আমার ভালো থাকার কারণ হয়ে উঠেছ তুমি আর আজ! এত বড়, এত কঠিন সত্য জানার পর তোমাকে না ভেবে থাকাও যে অসম্ভব। আমি ভালোবাসাকে নয় ঠকানোকে ভয় পেতাম। ভালোবাসা তো ভালো রাখে। ভালোবাসা কখনো কমতে দিও না। তোমার কাজ শুধু আমাকে একটু ভালোবাসা, আমি কিঞ্চিৎ ভালোবাসা ছাড়া কিছুই চাই না, নিতু।”

নিতু প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে চোখে চোখ রেখে বলল,“আপনি না থাকাকালীন এগারো বছর শুধু আপনাকেই ভালোবেসেছি। একবার ভাবুন আপনি আমার হয়েছেন এটা জানার পর আমার অনুভূতি ঠিক কতটুকু লাগামছাড়া আপনাকে ভালোবাসতে!?”

উৎস আলগোছে নিতুকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে নিল। পুরোনো সত্য সামনে আসায়, নতুন পরিচয়ের এই মানুষটাকে বুকে নিতেই যেন মুহূর্তের মধ্যে বুকটা শীতল হয়ে গেল। নিতুও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রইল প্রিয় মানুষটাকে। ওভাবেই স্বল্প আওয়াজে বলল,

“সকাল অনেকক্ষণ আগেই হয়ে গেছে, সাহেব। ফ্রেশ হয়ে নিন। আমি যাই চা করি। চায়ের নেশা চড়ে যাচ্ছে।”

উৎস নিতুকে ছেড়ে সোজা হয়ে বসে বলে উঠল,“তোমার কি চায়ের পরিবর্তে কখনো আমাকে পাওয়ার নেশা চড়ে না?”

নিতু দুষ্টু হেসে জবাবে বলল,“চড়েছিল বলেই তো আপনার নেশায় এখনও আমি জর্জরিত।”

উৎস আনমনে বলে উঠল,“তা আপনার নেশা কাটবে কখন?”
“সব নেশা কি কাটে আর কাটলেও কি লেবু-পানিতে কাটে। আপনার নেশা কাটাতে আপনাকেই লাগবে। আপনিই যেখানে মুখ্য সেখানে নেশা কে আর নেশা কাটায় কে সেটা ভাবার ফুরসত আছে কি?”

উৎস কিছু বলার আগে নিতু এবার উঠে দাঁড়ালো। বলল,
“জলদি ফ্রেশ হয়ে নিন। আমি এখনই আসছি।”
“আজ থেকে তুমি করে বললে হয় না?”

উৎসের প্রশ্নে মুচকি হাসলো নিতু। কিছুক্ষণ উৎসের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে চুপ রইল। ঠোঁট কামড়ে বলল,

“উমমম, তোমার সাথে তুমি করে বলতে হবে? সমস্যা নেই। তুমি করেই নাহয় বললাম।” বলেই হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল নিতু।

নিতু চা বানানোর উদ্দেশ্যে নিচে এলো। রান্নাঘর ফাঁকা। কাজের মেয়েটা এখনো আসেনি। নিতু সরাসরি ফরিনা বেগমের রুমে প্রবেশ করল। ফরিনা বেগম কারও সাথে ফোনে কথা বলছিলেন। নিতুকে দেখে অল্পতেই কথা শেষ করলেন তিনি। নিতু পাশে গিয়ে বসতেই তিনি মলিন মুখে বললেন,

“দুইদিন পরপর কী ঝামেলায় পড়তে হচ্ছে দেখ তো, মা।”

নিতু শুধালো,“কী হয়েছে, আম্মা?”
“যে মেয়েটা কাজ করছিল বাসায় সে রাতে বাড়ি গেল। এখনো আসছে না দেখে কল দিলাম। এখন সে কল রিসিভ করে বলছে সে নাকি কাজে আসবে না। আগে থেকে না বলে কীভাবে বিপদে ফেলে দিল? এভাবে কেউ কাজ ছাড়ে? অন্তত দুই সপ্তাহ হাতে রেখে বলবে তো যাওয়ার কথা। এখন আবার নতুন করে কাকে খুঁজবো? কোথায় খুঁজবো?”

নিতু ফরিনা বেগমকে আশ্বস্ত করে বলল,“এখন আর আপাতত কাউকে নিতে হবে না, আম্মা। আমিই পুরোটা দেখে নিতে পারব। সময় নিয়ে বাড়ি, কাপড় পরিষ্কারের জন্য ছুটা কাজের বুয়া নিলেই হবে। রান্নাটা আমিই দেখে নেব। আপনার ছেলে তো কালকের দিন পরই চলে যাবে। বাসায় আমি আর আপনি। কোন সমস্যা হবে না।”

ফরিনা বেগম আফসোস করে বললেন, “তোমার তো চাপ হয়ে যাবে।”
“কিচ্ছু হবে না।”
“কিছু হবে না বললে তো হবে না। আমি জানি সমস্যা হবে।”
“এত চিন্তা করতে হবে না। আপনি বিশ্রাম নিন। আমি গিয়ে দেখি নাশতা কী বানানো যায়।”
“আমিও আসছি চলো।”
“আপনি কেন আসবেন? আপনি রুমেই থাকুন। প্রয়োজনে আপনার ছেলেকে কানে ধরে নিয়ে আসব।”

ফরিনা বেগম মুচকি হাসলেন।
“কানে ধরার মতো অনুমতি দিল?”
“দেবে না মানে? তেলিয়ে তেলিয়ে বউ নিয়ে আসছে, বউয়ের অত্যা**চারও সহ্য করতে হবে। বউকে কাজে হেল্পও করতে হবে।”
“অবশ্যই। প্রয়োজনে সব কাজ করে দিতে বাধ্য আমার ছেলে।”

নিতু ঠোঁট টিপে হেসে বলল,“ইয়েস শাশুড়িআম্মা।”

নিতুর চা নিয়ে রুমে আসতে দেরি হচ্ছে দেখে ফ্রেশ হয়ে উৎস নিজেই নিচের দিকে রওয়ানা দিল। নিচে এসে রান্নাঘরে উঁকি দিতেই দেখলো নিতু আটা মাখছে। রান্নাঘর, এদিকে ওদিকে খুঁজে কাউকে না পেয়ে রান্নাঘরে এসে নিতুর পাশে দাঁড়ালো।

“মেয়েটা কোথায়?”

নিতু হাতের উল্টোপাশ দিয়ে কপাল মুছে শুধালো,“কোন মেয়ে?”
“কাজ করে যে।”
“কাজ ছেড়ে দিয়েছে। আসবে না আর।”
“বাড়িতে এই সমস্যাটা দেখছি খুব হচ্ছে।”
“এখন আর আলাদা করে কাউকে রাখতে হবে না। বাসায় মানুষ থাকব দুজন। আমিই করে নিতে পারব। তুমি এক কাজ করো এখন।”

উৎস উৎসুকভাব জানতে চাইলো,“কী করতে হবে বলো। আমি করে দিচ্ছি।”

নিতু মৃদু হেসে আটা মাখানো হাতেই উৎসের গাল টেনে দিয়ে বলল,“এই না হলে আমার জামাই! আলু ভাজি হচ্ছে ওটা একটু নেড়ে দাও শুধু। নিচে যেন পুড়ে না যায় খেয়াল রাখো।”

উৎস নিতুর কথামতো কাজ করল। নিতুও নিজের কাজ করছে। কয়েকটা রুটি বানিয়ে অন্য চুলায় সেঁকা শুরু করল। কাজের ফাঁকে নিতুকে পেয়াজ, মরিচ বের করতে দেখে উৎস বলে উঠল,

“কী করবে?”
“ডিম ভাজি। পেয়াজ, মরিচ কাটতে হবে।”

নিতুর হাতে থেকে ওগুলো নিয়ে বলল,“আমাকে দাও, আমি কেটে দিচ্ছি।”
“পারবে?”
“অভ্যেস আছে।”

উৎসের দিকে এগিয়ে এলো নিতু। বুকের বাম পাশে এক আঙুল দিয়ে ঠেস দিয়ে বলল,“আর কীসের অভ্যেস আছে আমার বরের?”

উৎস ঘাড় ঘুরিয়ে একবার পিছনে দেখে ফের নিতুর দিকে তাকিয়ে ডান হাতে নিতুর কোমর ধরে টেনে নিজের কাছে নিয়ে বলল,

“তুমি চাইলে বউকে আদর করার অভ্যেস গড়ে তুলব।”

#চলবে……