প্রিয় বিকালফুল পর্ব-৪৯

0
39

#প্রিয়_বিকালফুল(৪৯)
#তানিয়া_মাহি(নীরু)

বসার ঘরে স্বামীর প্রাক্তন স্ত্রীকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে নিতু। গা যেন কেউ আ*গুনের জ্ব*লন্ত শিখায় পু*ড়িয়ে দিচ্ছে তার। মনে রাগ, ক্ষোভ ঢেকে ধীরপায়ে সিঁড়িবেয়ে নেমে এলো সে। ইশারায় ফরিনা বেগমকে নিজের রুমে যেতে বলল নিতু। ফরিনা বেগম নুরজাহান বেগমকে সাথে নিয়ে নিজের রুমে চলে গেলেন।

নিতুকে দেখেই বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো জুঁই। নিতুর শারীরিক পরিবর্তন হয়তো খেয়ালও করল সে। কিছু মুহূর্ত মৌনাবস্থায় নিতুকে পর্যবেক্ষণ করল সে। তারপর মুখ মলিন করে বলল,

“উৎস বাসায় আছে?”

নিতুর চলাফেরা এখন অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। শরীর এখন আর অনেককিছু সায় দেয় না। খুব কষ্টে নিজে নিজে সোফায় বসলো। হাত দিয়ে ইশারায় জুঁইকেও বসতে বলে বলল,

“আমার বরকে দিয়ে আপনার কী কাজ?”

জুঁই বাম হাতের অনামিকায় পরে থাকা রিংটার দিকে তাকিয়ে বলল,“এটা ফিরিয়ে দিতে এসেছিলাম। আমি সবরকম স্মৃতি শেষ করে এই পিছুটান থেকে বেরিয়ে যেতে চাইছি। এটা উৎস আমাকে ভালোবাসার চিহ্ন হিসেবে সবসময় সাথে রাখতে বলেছিল, আমি আর রাখতে পারছি না। মানুষটা তো এখন আর আমার নেই। রিং রেখে কী করব?”

নিতু শুধালো,“এই পিছুটান কবে থেকে তৈরি হলো? আমি আসার পর থেকে? চার, পাঁচ বছর যখন সে সিঙ্গেল ছিল তখন আপনি কোথায় ছিলেন? প্রাক্তনের প্রতি এত ভালোবাসা, পিছুটান থাকলে কি আর টাকার জন্য অন্য পুরুষের সাথে চলে যেতেন? এখন এসেছেন সামান্য রিং ফেরত দিয়ে পিছুটান মেটাতে? আপনার কি মনে হয়? একা আপনিই চালাক? বাকি সবাই ঘাসে মুখ দিয়ে চলে?”

ভ্রু কুঁচকে নিতুর দিকে তাকালো জুঁই।
“মানে?”
“রিং ফেরত দেওয়ার দোহায় দিয়ে ব্যক্তিগত জীবন আবার দেখতে এসেছেন? জানতে এসেছেন আমরা কেমন আছি? খুব ভালো আছি। দুজন মানুষের ভালোবাসা যখন খাঁটি হয় তখন আল্লাহই হয়তো চায় তারা এক হোক। দেখুন ভেতরে ভেতরে আপনি এত কিছু করলেন, এত সময় গেল সমাপ্তিতে উৎস আমারই হলো৷ ভাগ্যে ছিল সে আমার তাই আপনার মতো মানুষ কিছুই করতে পারেনি। আর রইল রিংয়ের কথা? ওটা রাস্তায় কোন গরিব মানুষকে দিয়ে দেবেন, তার উপকার হবে৷ উৎসকে এসব ফিরিয়ে দিতে হবে না। উৎস এসবের দিকে ফিরেও তাকাবে না৷ ”

জুঁই মুখ নিচু করে কিছুক্ষণ নিরব রইল তারপর সোজা হয়ে বসে বলল,“আমি আমার কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত, ক্যামেলিয়া।”

নিতু তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,“আপনি কখনো আমার বেস্টফ্রেন্ড ছিলেন সেটা ভাবতেও আমার কুণ্ঠাবোধ হয়। আমি আপনাকে আমার ভালোবাসার কথা শেয়ার করেছিলাম। আপনি জানতেন, ওই সময়ে আমি এই মানুষটার মাঝে ঠিক কতটা ডুবে গিয়েছিলাম! আপনি কী করলেন? আমারই ফোন চুরি করে, আমি সেজে তার সাথে সম্পর্কে গেলেন৷ একটা বার আমার কথা ভেবে দেখলেন না। এরপর আমার কী অবস্থা হয়েছিল সেটা জানার চেষ্টা করলেন না। তাকে নিলেন ভালো করলেন শুধু টাকার জন্য কিছু সময় সঙ্গ দিলেন? জীবনে টাকাই সব? টাকার কাছে তো গেলেন আবার কেন পিছনে ফিরে আমার সেই ক্ষ*ত তাজা করছেন? কেন নিজেকে আবার এত নিচে নামাচ্ছেন আপনি? আত্মসম্মান বজায় রাখুন অন্তত। একটা কথা মাথায় রাখবেন উৎস আপনার ব্যাপারে সব সত্যি জানে আর আমি তাকে যতটুকু চিনেছি সে সুপুরুষ। আপনি কোনভাবেই, কোন কিছু করেই তাকে গলাতে বা টলাতে পারবেন না শুধু শুধু অপমানিত হবেন। আমাকে দেখে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন সেটা। সে এক নারীতে আসক্ত, আপনি চেষ্টা করে যেতেই পারেন তবে আমার স্বামী ভালো বলে আমি ছেড়ে দিয়ে রাখব না। আমি আপনাকে ওর ধারেকাছেও আসতে দেব না। এক ভুল আমি একবারই করেছি।”

জুঁই পূর্বের মতোই নিরব। মুখে কোন কথা নেই। যেন কেউ আদেশ করেছে নিরবতা পালনের। নিতু পুনরায় কিছু বলবে তার পূর্বেই জুঁই আঙুল থেকে রিংটা খুলে সামনে রাখল। মুখ ভার করে বলল,

“যার সাথে সম্পর্ক ছিল তার সামনেই সব ছিন্ন করতে চেয়েছিলাম যদিও আগে তার প্রতি সেরকম ভালোবাসা ছিল না কিন্তু তুই আসার পর আমি অনেক কিছু বুঝতে পেরেছি। আমার জিদ চেপেছিল তাকে ফিরে পাবার কিন্তু সবসময় সবকিছু নিজের ইচ্ছেমতো হয় না। আমি ভুল করেছিলাম সেটা এখন বুঝতেও পারি তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম উৎসের কাছে থেকে একবার মাফ চেয়ে নেব।”

নিতু চকিতে বলে উঠল, “ভুল বুঝতে পেরেছেন! আলহামদুলিল্লাহ। আমি তাকে বলব মাফ করে দিতে যদিও তার চিন্তাভাবনা আমার থেকেও উন্নত তাকে এ কথা নতুন করে বলতে হবে না। সে ক্ষমা করতে পছন্দ করে।”

জুঁই মাথানিচু করে বলল,“পারলে তুইও মাফ করে দিস।”
“আমি উৎসের মতো এত দয়ালু না। আমার এগারো বছর সময় আমি কখনো ভুলব না। আমি মাফও করতে পারব না। দুঃখিত আমি এত ভালো মানুষ নই। আমার সাথে অন্যায় করা সবাইকে মাফ করে দিলে আমি নিজেও আমার সাথে অন্যায় করে ফেলব। দুনিয়ার সবাই ক্ষমাশীল হলেও আমি হতে পারছি না।”

জুঁই কিছু বলল না। কিছুক্ষণ চুপ রইল শুধু। নিতু খেয়াল করল জুঁইয়ের চোখ টলমল করছে। নিতু তবুও একবিন্দু টললো না। নিতু আত্মকেন্দ্রিক নারী। অন্যদের ক্ষ*তি না করলেও নিজের ক্ষ*তি করেছে এমন কাউকে সে কারও মন রক্ষার্থে ক্ষমা করতে পারে না। সবার উর্ধ্বে সে নিজেকে রাখে। কারও মন রাখার দায় তার নেই।

জুঁই আর কিছু না বলে কিছুক্ষণ নিতুর মুখের দিকে চেয়ে রইল। নিতু বাহিরের দরজা ইশারায় দেখিয়ে দিতেই আলগোছে বেরিয়ে গেল সে।
__

আজ দিয়ে চারদিন বন্যা নিতুদের বাসায় এলো। নিতু বাসায় এক প্রকার বন্দী হয়ে পড়েছে। শুধু সপ্তাহে একদিনের মতো বের হয়। বাসায় যখন একদম দমবন্ধকর পরিবেশ তৈরি হয়, চার দেয়ালের মাঝে আর মন টিকতে চায় না তখনই শাশুড়ি আর নিজের মাকে নিয়ে বের হয়৷ বিকেলের দিকে বের হয়ে সন্ধ্যায় ফিরে আসে। এভাবেই দিন চলছে তার।

আজও তার বিকেলে একটু বের হওয়ার কথা ছিল কিন্তু দুপুরেই বন্যা জানালো সে নিতুর বাসায় আসবে বিকেলে। জরুরি কথা আছে তার সাথে। নিতু বাহিরে বের হওয়ার সিদ্ধান্ত বদলে ফেলল। বন্যা আসার আগে কাজের মেয়েটাকে জানিয়েছিল বন্যা আসলে যেন তাকে সোজা নিতুর রুমে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। হলোও তাই।

দুজনে পাশাপাশি বসে আছে। বন্যাকে ক্লান্ত-শ্রান্ত দেখাচ্ছে। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে পিঠের ওপর পড়ে আছে। বুকের ওড়নাটা কুঁচকে-বুচকে আছে। নিতু কাজের মেয়েটাকে বলে নাশতার ব্যবস্থা করিয়েছে। বন্যাকে এমন অবস্থায় এসে বসতে দেখে বলল,

“ আগে ফ্রেশ হয়ে এসে বোস তারপর সব কথা শুনছি।”

বন্যা ওড়না দিয়ে কপালের ঘাম মুছে বলল,”দোস্ত, আশরাফকে বিয়ে করা আমার ঠিক হবে? লোকটা আমার পিছু ছাড়ছে না। আমার পরিবার তার কথা বলতে পুরো পাগল।”

নিতু কিছুক্ষণ চুপ থেকে বন্যাকে প্রশ্ন করল,“উনাকে তোর কেমন লাগে? কমদিন তো হলো না তোর পিছে পড়ে আছে শুনছি। সেদিন দেখাও করেছিস।”

বন্যা একটু ভেবে বলল,“আমার খারাপ তেমন লাগে না তবুও তোর ব্যাপারটা আমি মাথা থেকে সরাতে পারি না।”

নিতু আশ্বস্ত করে বলল,“মানুষ সারাজীবন এক রকম থাকে না, বন্যা।”
“তুই একবার কথা বলে দেখবি?”

বন্যার হঠাৎ এমন প্রস্তাবে থতমত খেয়ে গেল নিতু। আমতা আমতা করে বলল,“আমি কী কথা বলব?”

“আমি বুঝতে পারছি না কিছু। দিশেহারা লাগছে। একবার মন টানছে তো আরেকবার টানছে না। একবার মনে হচ্ছে লোকটা ভালো হয়ে গেছে আবার মনে হচ্ছে হয়তো হয়নি। তবে একেবারে না করেও দিতে ইচ্ছে করছে না। আমি নিজেকেই নিজে বুঝতে পারছি না, নিতু। এত বছর বয়সে এসে এমন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছি আমি।”

নিতু নিরবতা ভেঙে বলল,“আজ আমার এমনিতেও বের হওয়ার কথা ছিল। হাঁটতে বের হই মাঝেমধ্যে। সপ্তাহে ছয়দিন বাড়ি আর একদিন বাহিরের পরিবেশের সাথে একটু সময় কাটাই। তুই আশরাফ ভাইকে আশেপাশে আসতে বলবি? আমি এই অবস্থায় দূরে কোথাও যেতেও পারব না তাছাড়া উৎস জানতে পারলে রাগ করবে।”

বন্যাকে উৎফুল্ল দেখালো। বলে উঠল,“হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই।”

বাসায় বলে বন্যার সাথে বেরিয়েছে নিতু। উদ্দেশ্য একটু হাঁটাহাঁটি করা এবং আশরাফের সাথে সাক্ষাৎ করা। আশরাফকে বলার পরপরই সে তাদের আগেই নির্দিষ্ট জায়গায় এসে হাজির। তিনজনে বসেছে এক জায়গায়। কথা চলছে বেশ কিছুক্ষণ ধরে। নিতু, বন্যা, আশরাফ তিনজনই এটা ওটা নিয়ে কথা বলছে। বন্যা বলছে আশরাফের এমন করে সময় নষ্টের কথা কারণ বন্যা নাকি তাকে কিছুতেই বিয়ে করবে না। ওদিকে আশরাফ নাছোড়বান্দা। সে বলে যাচ্ছে, বন্যার মুখ থেকে ‘হ্যাঁ’ বের করিয়েই সে ছাড়বে। বিয়ে করলে বন্যাকেই করবে।

এতকিছুর মাঝে নিতু দুজনের কথা শুনে কিছুক্ষণ পরপর প্রলম্বিত শ্বাস ফেলছে। নিতু একসময় দুজনকে থামিয়ে দিয়ে আশরাফকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“সেদিন আপনাকে থানায় অপমানিত হতে হয়েছিল বলে কি প্রতিশোধ নিতে চাইছেন?”

থেমে গেল আশরাফ, বন্যা দুজনই। দুজনের নজরই নিতুর দিকে। আশরাফ এতক্ষণ হাস্যোজ্জ্বল মুখে বন্যার সাথে মিষ্টি তর্কবিতর্ক করলেও নিতুর প্রশ্নে দমে গেল। মুখ মলিন করে বলল,

“মেয়েদের সম্মান কতটা দামি সেটা বোনকে দয়ে বুঝেছি। সেদিন আপনাদের সাথে যা করেছিলাম তার জন্য আমি প্রতিদিন অনুতপ্ত হই। এখনো খারাপ লাগে আমার এটা ভেবে যে, কত বাজে পুরুষ হয়ে ছিলাম আমি! বিশ্বাস করুন, আমার বোন বন্যাকে ভীষণ পছন্দ করে। প্রতিদিন আমার কাছে তার খোঁজ নেয়। আম্মার সাথে বসে গল্প করে ওকে নিয়ে। তাছাড়া আমি নিজেও উনার প্রতি দূর্বল। পরিবারের দায়িত্ব নেওয়া, এত পরিশ্রম করা, আত্মনির্ভরশীল মেয়েকে কে পছন্দ করবে না? আমার উনাকে চাওয়ার মাঝে কোন নেগেটিভিটি নেই বিশ্বাস করুন। আমি অতীতে যা করেছি তার জন্য আমাকে নিয়ে সংশয় থাকবে জানি কিন্তু আপনারা আমার বোনকে সাহায্য করেছিলেন এরপরও কেন প্রতিশোধের মনোভাব থাকবে বলুন? তাছাড়া আমি জানি, আমি অতীতে ভুল ছিলাম।”

নিতু কী বলবে বুঝতে পারছে না। সে নিজেও আশরাফের আচরণের পরিবর্তন লক্ষ্য করেছে। প্রথমে যখন বন্যাকে নিয়ে সন্দেহ হয়েছিল তখন থেকেই আশরাফকে নিয়ে খোঁজ খবর নিয়েছিল। পরবর্তীতে খারাপ কিছু খুঁজে পায়নি সে।

নিতু বন্যার দিকে তাকালো। বন্যা নিজেও নিরব চোখে আশরাফের দিকে চেয়ে আছে। নিতু বুঝতে পারে বন্যা আশরাফকে পছন্দ করে, হয়তো চায়ও কিন্তু নিতুর জন্যই সামান্য দোটানা কাজ করে মাঝেমধ্যে যার দরুণ সে শান্তি পায় না। নিশ্চিন্ত হতে পারে না।

দুজনকে দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে গলা খাঁকারি দিল নিতু। মৃদু গলায় বলল,

“শুনুন আশরাফ সাহেব, বিশ্বাস করছি আপনাকে। বান্ধবীকেও দিতে রাজি তবে মাথায় রাখবেন উৎস সাহেবের কথা। বান্ধবীকে কখনো কষ্টে দেখলে আপনাকে কিন্তু আস্ত রাখা হবে না।”

নিতুর কথায় মুচকি হাসলো আশরাফ। বন্যার দিকে চেয়ে বলল,“আপনার বান্ধবীকে খারাপ থাকতে দেওয়া যায় না তাহলে।”

#চলবে…..