#প্রিয়_বিকালফুল(৫১)
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
দরজার পর্দাটা হঠাৎই নড়ে উঠল। নজরে আসতেই কথা বলা বন্ধ করে দিল নিতু। এ সময়ে বাড়ির ভেতরে বাতাস আসার কথা নয় এমনকি পর্দাও নড়ার কথা নয়। নিতু মায়ের দিকে একবার চেয়ে ইশারায় চুপ করে থাকতে বলল। বাহিরের দিকে নজর নিবদ্ধ করে কাঁপাকাঁপা গলায় বলে উঠল,
“ ক কে বাহিরে?”
কোন সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। নিতু বিছানা থেকে নেমে ধীরপায়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। দরজার বাহিরেই এক কদম দূরে একটা বিড়াল মাছের কাটা নিয়ে এসে চিবোচ্ছে দেখে কিছুটা স্বস্তি পেল সে। মায়ের দিকে ফিরে বলল,
“এখানে বিড়াল, আম্মা। মাছের কাটা খাচ্ছে সে। আশেপাশে আর কেউ নেই।”
নিশ্চিন্ত হলেন নুরজাহান বেগমও। প্রাণ ফিরল যেন বুকে। নিজের স্বামী ঘটিত মেয়ের জঘন্য অতীত কখনো সামনে আসুক সেটা তিনি চান না। নিজেই তো এতদিন মেয়েকে অবিশ্বাস করে স্বামীর কথায় সবসময় ভুলে ছিলেন। নিজের মেয়েকেই সত্যিটা বলার সুযোগ দেননি, তার কথা শোনেননি যার কারণে এত দূরত্ব বেড়েছিল মেয়ের সাথে। সব মেয়েদের নাকি মা হয় সবচেয়ে কাছের মানুষ, সবচেয়ে কাছের বন্ধু অথচ তাদের মধ্যে ছিল কত দূরত্ব! মেয়েটা বিপদে পড়েছিল, মাকে জানাতে এসেছিল আর মা! ধমকে চুপ করিয়ে দিয়েছিল। মা এমন হয়!? ধিক্কার আসে নিজের প্রতি।
নিতু এসে ফের নিজের জায়গায় বসলো। নুরজাহান বেগম পূর্ণদৃষ্টিতে মেয়ের দিকে চাইলেন। মৃদু গলায় শুধালেন,
“কী হয়েছিল সেদিন?”
নিতু মায়ের দিকে অবাকদৃষ্টিতে চাইলো। মুখে করুণভাব এনে বলল,“এই প্রশ্নটা যদি সেদিন করতে তাহলে আমার কৈশোর-যৌবন উভয়কালই কতই না ভালো কাটতো, মা! আমি আমার ভয়, খারাপ লাগার কথাগুলো তোমাকে জানাতে পারতাম। জানাতে পারতাম আমার প্রথম প্রেমের কথা, আমি কীভাবে উৎসের প্রেমে পড়ে, ভালোবেসে অতি ইন্ট্রোভার্ট চরিত্রের জন্য আবার তাকে হারিয়েছিলাম, জানতে আমার বেস্টফ্রেন্ড কীভাবে আমাকে ঠকিয়েছিল, তুমি জানতে এতগুলো বছর কী পরিমাণ ঘৃণা আমি তোমাদের দুজনকে করেছি, তুমি এটাও জানতে বিদেশের একা জীবন আমার কখনোই ভালো লাগেনি, তোমার কাছে ছুটে আসতে মনটা ছটফট করেছে তবুও তোমার স্বামীর জন্য আমি আসতে পারিনি। এখন ভালো আছি, মা। অতীত ঘেটে আর কী হবে? ”
মেয়ের এতটুকু কথায় মাথা নিচু করে নিয়েছেন নুরজাহান বেগম৷ স্বামী স্বামী করে আসলেই তো তিনি মেয়ের দিকে সেভাবে নজর দেননি।
নুরজাহান বেগম মাথানিচু করেই বলে উঠলেন,“যেটা অনেক বছর আগে জানতে চাওয়ার কথা ছিল সেটা আজ জানতে চাওয়া হাস্যকর তবুও তুই বললে আত্মাটা একটু শান্তি পেত আর লোকটার খারাপ ইচ্ছে, চরিত্র কত ভয়াবহ সেটা জানতাম। তার প্রতি বিন্দুমাত্র সম্মান আর ভালোবাসা নেই।”
নিতু কিছুক্ষণ চুপ রইল। কালো অতীত কাউকে বলা তো দূর তার মনে করতেও ইচ্ছে করে না। তবুও মাঝেমধ্যে কাউকে বলে হালকা হতে ইচ্ছে করে তার।
নিতু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করল,“তখন তোমার সবে বিয়ে হয়েছে। সবে বলব না, বিয়ে তিন কি সাড়ে তিন হয়েছে কি হয়নি৷ যাক সময় ছাড়ো। আমার এত ডিটেইলস মনে নেই। সেদিন স্কুল থেকে এসে দেখি তুমি বাসায় নেই। হয়তো কোন বান্ধবীর বাড়ি গিয়েছিলে। বাসায় ছিল তোমার স্বামী। তখনও তো তার আসল মুখোশ আমার সামনে খোলা ছিল না তাই তাকে তখনো বাবা বলেই ভাবতাম৷ স্কুল ইউনিফর্ম যখন চেঞ্জ করা শুরু করেছি তখনই হঠাৎ ড্রেসিংটেবিলের আয়নায় চোখ যায়। দরজা হালকা ফাঁকা। যদিও বয়ঃসন্ধি তখনও আমাকে স্পর্শ করেনি কিন্তু তোমার মারফতে আমি চাহনি, গুড টাচ, ব্যাড টাচ এগুলো বুঝতাম। দরজার বাহিরে উনাকে ওভাবে দেখে আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। ভয় পেয়ে গেছিলাম আমি। উনি আমার ভয়কে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিতে তৎক্ষনাৎ আমার রুমে ঢুকে আমাকে এক মুহূর্ত সময় না দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন আমার দিকে। প্রথমে এতসব আমার মস্তিষ্ক ধরতে পারেনি৷ মুহূর্ত কয়েক লেগেছিল উদ্দেশ্য বুঝতে। বয়স কম হলেও বুঝব না এত কম বয়সও ছিল না আমার। বয়স, শারীরিক গরন তেমন ছিল বলেই তোমার স্বামী ওমন করতে পেরেছিল। আমি যখন উদ্দেশ্য বুঝলাম তখনই চিৎকার করে তোমাকে ডাকাডাকি শুরু করলাম৷ আমার মুখ চেপে ধরা হলো। আমার মুখ, গলা, কাধ, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে ব্যাড টাচ টের পাচ্ছিলাম আমি। কান্না করছিলাম। ওত বড় মানুষকে সরানোর শক্তি ছিল না আমার কিন্তু দুই, তিন মিনিটে যখন তার কর্মকান্ড বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছিল তখন অসহ্য যন্ত্রণায় কোথায় থেকে যেন শক্তি এলো৷ লা*ত্থি বসালাম তলপেট বরাবর। অকস্মাৎ আঘা*তে টলে গিয়েছিল সে আর আমিও সেটার সুযোগ নিয়ে কয়েকবার তাকে আঘা*ত করে নিজেকে বাঁচিয়ে নিয়ে ঘর থেকে পালিয়েছিলাম। শুধু ভয় আর লজ্জায় এই কথা কাউকে বলতে পারিনি আমি। তোমাকে বলার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু তুমি আমার কথাই শোনোনি। সেদিন থেকে ওই লোকের সামনে যাওয়া বাদ দিয়েছিলাম আমি৷ মাস খানেকের জন্য নানাবাড়িও থেকে এসেছিলাম৷ তারপর যে তিন, চার বছর তোমার কাছে আর নানাবাড়িতে মিলিয়ে থাকতাম তাতেও লোকটা সুযোগ নিতে চাইতো। কী কঠিন সময় ছিল আমার তোমাকে ছাড়া! ”
নিতু থামলো। নুরজাহান বেগমের চোখে পানি৷ নিতু নিজের গলা থেকে ওড়না নামিয়ে একটা ছোট আর প্রায় অস্পষ্ট দাগ দেখিয়ে বলল,
“তোমার সম্মানীয় স্বামীর খারাপ উদ্দেশ্যের দাগ এটা।”
_____
উৎস বাসায় ফিরল রাত নয়টায়। হাতে দুইটা বড় বড় ব্যাগ। রুমে দরজার পাশে রাখতেই চোখ গেল নিতুর ওপর। নিতু আজ শাড়ি পরেছে। শরীরে লেপ্টে আছে গাঢ় সবুজ রঙের একটা জামদানি শাড়ি। নিতুর ওজন আগের চেয়ে অনেকটা বেড়েছে। পেট উঁচু হয়েছে অধ্যাধিক। সবরকম পোশাকেই সেটা টের পাওয়া যায়।
উৎস কিছুক্ষণ সেখানেই দাঁড়িয়ে এক পলকে নিতুকে দেখল। কতগুলো মাস এই মানুষটাকে সে এভাবে সামনাসামনি দেখতে পারে না, ছুঁতে পারে না। কী অসহায় লাগতো তার নিতুর এই সময়ে কাছে থাকতে না পেরে! যে সময়ে একটা মেয়ের তার নিজের স্বামীকে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সেই সময়ই উৎস থেকেছে দূরে দূরে।
উৎস আর সময় নষ্ট না করে দ্রুতপায়ে এগিয়ে গেল নিতুর দিকে। মুহূর্তেই বুকে জড়িয়ে নিল প্রিয়তমাকে। এতগুলো দিন পর এভাবে উৎসকে কাছে পেয়ে প্রায় কেঁদেই ফেলল নিতু।
নিতু বলে উঠল,“কত মিস করেছি তোমায় জানো? আমার দিনগুলো যে কীভাবে কেটেছে সেটা আমিই জানি। খুব দূরত্ব রাখতে শিখে গেছো তুমি। একটুও আমার কাছে আসতে ইচ্ছে করেনি তোমার?”
উৎস মুহূর্ত কয়েক পর ছাড়ল নিতুকে। নিতুর হাতটা নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে বলল,“এই যে, এখানটায় জ্ব*লেপু*ড়ে শেষ হয়ে যেত। ভালো কি তুমি একা বাসো? আমি বাসি না? আমার খারাপ লাগবে না কেন? এবার এসেছি। অনেকদিন আর কেউ আমাদের আলাদা করতে পারবে না।”
নিতু এবার শক্ত করে উৎসকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠল,“এবার আর যেতে দিচ্ছি না।”
“এভাবে ধরে রাখবে?”
“হ্যাঁ শক্ত করে৷ কিছুদিন পর আরও একজন আসছে আমার দল ভারি করতে।”
উৎস হেসে উঠল। নিতুকে ছেড়ে হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল মেঝেতে। নিতুকে এক হাতে কাছে টেনে তার পেটের ওপর গাল ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে মৃদু গলায় ডাকল,
“বাবা তো এসে গেছে। জুনিয়র এখন কেমন বোধ করছে? মাকে কেমন জ্বা*লানো হচ্ছে শুনি?”
নিতু খিলখিল করে হেসে উঠল। বলল, “সে এখন ব্যথা দিয়ে নড়ে ওঠে।”
“কী! মাকে ব্যথা দেওয়া হয় এখন!? নট ফেয়ার!”
দুজনের দুষ্টুমিষ্টি ক্ষণে চলতে থাকলো সময়। কতদিন পর দুজন একসাথে আর সাথে অস্তিত্বে মিশে থাকা আরও একটা প্রাণ।
____
উৎস বাড়ি ফেরার পর প্রতিদিন নিয়ম করে নিতুকে নিয়ে বিকেলে বের হয়। বাড়ি থেকে কিছুটা দূরের ফাঁকা মাঠটাহ সন্ধ্যা অবধি থেকে দুজনে মিলে পুনরায় বাড়ি ফিরে আসে। আজও সেরকমই হলো। তবে বের হতে হতে দেরি হলো কিছুটা।
নুরজাহান বেগম কয়েকদিন হলো বাড়ি ফেরার কথা বলছিলেন। বাড়িতে যাওয়া জরুরি অনুভব করছিলেন নুরুল ছাড়া পাওয়ার পর থেকে কিন্তু উৎস কিছুতেই ফিরতে দেয়নি। সে জানিয়েছে ওখানে কোনো ঝামেলা হলে সে নিজে সবকিছু দেখে নেবে। নিতুর ডেলিভারির আর বেশি সময় দেরি নেই। এই সময়ে নুরজাহান বেগমের দূরে থাকা নিতুর জন্য মোটেও ভালো নয়।
নুরুল গত কয়েকদিন টানা কল করেছিল নুরজাহান বেগমকে। গত পরশু থেকে আর কোন কল আসেনি তার ফোন থেকে। যে মানুষ প্রতিদিন কল করে বাড়ি লিখে দেওয়ার জন্য ঝামেলা করছিল হঠাৎ করে সেটা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কিঞ্চিৎ সন্দেহ হচ্ছে নুরজাহান বেগমের তার জন্য আরও বেশি করে তিনি বাড়ি ফিরতে চাইছেন। নুরুল ইসলাম আবার করে কোন ছক কষছে কি-না সেটা জানা দরকার।
বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা হতে চলেছে। চারদিকে মৃদু অন্ধকার। সূর্য ডুবেছে অনেকক্ষণ হলো। চারদিকে এখনই মাগরিবের আজান শুরু হবে৷ উৎস আর নিতু পাশাপাশি হাঁটছিল। এটা ওটা নিয়ে কথা চলছিল দুজনের। সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় তাদের গন্তব্য এখন গাড়ি। বাড়ি ফিরতে হবে এখনই।
দুজনে প্রায় গাড়ির কাছাকাছি আসতেই উৎস নিতুকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করল,
“তোমার জীবনের সবচেয়ে বড় শত্রুকে যদি নিজে হাতে প্রাণে মা**রার সুযোগ পাও তাহলে সুযোগ কাজে লাগাবে?”
#চলবে……