প্রিয় মন্ত্রী মশাই পর্ব-৩৩

0
92

#প্রিয়_মন্ত্রী_মশাই
#পর্বসংখ্যা_৩৩
#আহিয়া_শিকদার

“নীলার শোকে পাগল প্রায় যখন আপনারা তার পরদিনই দাদিজান এর মৃত্যু আপনাদের আরো নেতিয়ে ফেলে।কিন্তু একবার ও কি ভেবে দেখেছিলেন দাদিজানের মৃত্যু স্বাভাবিক কি না? দাদজানের মৃত্যুর পরপরই কেনো বাড়ির কাজের মেয়েটি কাজ ছেড়ে দিয়েছিল?”

শুভ্রার কথা কারোর ই বোধ গম্য হলো না।বুঝতে পারল না শুভ্রা কি বোঝাতে চাইলো।

“তোমার দাদিজানের মৃত্যু স্বাভাবিক নয় বলতে কি বোঝাতে চাইছো নাত বউ?তোমার দাদিজনের হার্টের সমস্যা ছিল।নীলার মৃত্যু সহ্য করতে পারেন নি।হার্ট এ্যাটাকেই মৃত্যু হয়েছিল আয়নার।কাজের মেয়েটি সব সময় আয়নার সাথে সাথেই থাকতো।খুব ভালোবাসত এবং সম্মান করতো।আয়নার মৃত্যুর পর ওর নাকি এই বাড়িতে থাকতে কষ্ট হচ্ছিল তাই কাজ ছেড়ে গ্রামে চলে গেছে।”

আজমল শিকদারের কথায় সবাই হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ায়।কিন্তু ঘামতে শুরু করেছে নিতুল আর নাইজা শিকদার।

“দাদিজান নীলার প্রেগন্যান্সি বিষয়ে জানতেন।আগের কার মানুষ হিসেবে তিনি নীলার পরিবর্তন গুলো ভালো ভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন।একই সাথে তিনি নিতুল ভাইয়াকে সন্দেহ করতেন।তার সন্দেহ সত্যি হয়েছিল নীলার মৃত্যুর পরের দিন। নিতুল ভাইয়ার সাথে ঘনিষ্ট মুহূর্তের ছবি পেয়েছিলেন তিনি।যেগুলো নিতুল ভাইয়া তুলেছিল নীলাকে ব্লাকমেইল করার জন্য।সব কিছু জানতে পাওয়াই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল দাদিজানের জন্য। দাডিজানকে বিষ ইনজেক্ট করেছিলেন।যেই বিষের অস্তিত্ব কিছু সময়ের মধ্যে শরীর থেকে মুছে যায়।বাড়ির কাজের মেয়েটা দেখেছিল। মেয়েটাকে টাকার লোভ দেখিয়ে মুখ বন্ধ করে দেয়।”

স্ত্রীর এমন মৃত্যুর কথা শুনে কেঁপে উঠলেন আজমল শিকদার।এই বয়সে এসে এতো বড় সত্যের মুখোমুখি হতে হবে কখনো কল্পনাও করেন নি।মুখে বার বার আওড়াচ্ছেন,

“রাস্তা থেকে কালসাপকে তুলে এনে থাকার জায়গা দিয়েছিলাম।দুধ কলা দিয়ে কাল সাপ পুষেছিলাম এতদিন।”

“এই বাড়িতে যেদিন আমি নিতুল ভাইয়াকে দেখতে পাই সেদিন ই ওনাকে আমার চেনা চেনা লাগছিল।কিন্তু ততটা মাথা ঘামাই নি।নিতুল ভাইয়াও রামিজ আংকেলের বিল্ডিং এ দেখে ছিল আমাকে। রাইমা যখন নীলার মৃত্যুর বিষয়ে সব বলে তখনই সবটা পরিষ্কার হয় আমার কাছে।বুঝতে পারি কেনো নিতুল ভাইয়াকে চেনা চেনা লাগছিল। সে সময় মন্ত্রী মশাইকে বাড়ির বাইরে বের হতে দেখি।ওনাকে সবটা জানানো জরুরি মনে হয়েছিল আমার।মাথায় আর অন্য কিছু ছিল না।তাই ঘর থেকে দৌড়ে বের হই।ঘরের বাইরেই নিতুল ভাইয়াকে দেখতে পাই।বুঝে যাই উনি হয়তো সবটা বুঝে ফেলেছেন।কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় পিছন থেকে ধাক্কা মারেন উনি আমায়।ফলস্বরূপ সিঁড়ি থেকে পরে যাই আমি।তখন মনে হয়েছিল আমার বেঁচে থাকার মেয়াদ এখানেই হয়তো সমাপ্তি।বার বার মন্ত্রী মশাইকে বোঝাতে চেয়েছিলাম নিতুল ভাইয়ার কথা কিন্তু পারিনি।”

এবার আর কোনোভাবেই নিজেকে কন্ট্রোল করা সম্ভব হলো না আরহামের পক্ষে।শুভ্রার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে নিতুলের কলার চেপে ধরলো।মারতে শুরু করলো ইচ্ছে মতো।তাকে থামাতে গেলো ফারহাদরা।
আরহামকে শান্ত করিয়ে সোফায় বসিয়েছে ফাহিম। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে আরহাম।

“আর এই এতো অপরাধে নিতুল ভাইয়াকে সাথ কে দিয়েছে জানেন?

ভয়ে গলা শুকিয়ে এসেছে নাইজা শিকদার আর নিতুলের।তারা একে অপরের দিকে চাওয়া চাওয়ি করছে। তা দেখে হাসলো শুভ্রা।

“শুরু থেকে নিতুল ভাইয়ার সব অপরাধের সঙ্গি ছিল কাকিমনি ওরফে রেজাউল চৌধুরীর একমাত্র বোন”

এত কিছুর মাঝেও বজ্রপাতের ন্যায় আরেকটি কথা বলল শুভ্রা।সবাই হতভম্ব। কারো মুখে কোন রাঁ নেই।নিস্তব্ধ পরিবেশ।সবাই শান্ত। কারো মুখে কোন রা নেই।পাথর বনে গেছে যেনো সবাই।এতো এতো সত্যি কোনোভাবেই নেওয়া সম্ভব হচ্ছেনা তাদের পক্ষে।

আজাদ শিকদার সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। আর যাই হোক শুভ্রার কথায় তিনি বিশ্বাস করেন নি।কয়েক বছরের প্রণয়ের সম্পর্কে বিয়ে হয়েছে নাইজা বেগমের সাথে।এতো বছরেও তিনি জানতে পারলেন না নাইজা বেগম তারই ভার্সিটি জীবনের বন্ধু রেজাউল চৌধুরীর বোন?এটা অসম্ভব। নিতুলের প্রতিটা অপকর্ম বিশ্বাস করেছেন তিনি তাই বলে যে স্ত্রীর সম্পর্কে এসব বিশ্বাস করবেন?

“তোমার সব কথাই বিশ্বাস করেছি আমি।কিন্তু এখন যেটা বললে সেটা কিভাবে বিশ্বাস করব আমি? নাইজা কোনোভাবেই এসব করতে পারে না।তাছাড়া ও রেজাউল এর বোন হবে কিভাবে?”

“কাকাই আপনি কি কাকি মণির পরিবার সম্পর্কে কিছু জানেন?”

“এতিম নাইজা।কেউ নেই ওর আমরা ছাড়া।”

“ভালোবাসায় অন্ধ আপনি কখনোই স্ত্রীর পরিবার সম্পর্কে খোঁজ নেন নি। কাকিমণি আপনাকে যা বুঝিয়েছে তাই বুঝেছেন। আপনি তো জানেন রেজাউল চৌধুরীর একটা বোন ছিল।আর সেই বোনটাই নাইজা চৌধুরী। ”

চোখ বড় বড় করে তাকালো নাইজা শিকদার আর নিতুল।মনে হচ্ছে চোখ বাইরে বেরিয়ে আসবে।তাদের অবস্থা দেখে বেশ শব্দ করেই হাসলো শুভ্রা আর ফারহাদরা।হাসতে হাসতে মাটিতে লুটিয়ে পরার মত অবস্থা।এরকম একটা নিস্তব্ধ পরিবেশে তাদের হাসি যেনো ঝংকার তুলছে।

“ভাইয়া দেখো বেচারাদের মুখের অবস্থা।মনে হচ্ছে ভেবেছিল আমরা যদি পুলিশের হাতে তুলে দেই তাহলে রেজাউল চৌধুরী ওদের বাঁচিয়ে নেবে।হয়তো ভাবতেও পারেনি ওদের আসল পরিচয় এভাবে প্রকাশ করব। দাদা ভাই যাও তো একটু নিয়ে আসো বাইরে দার করে রাখা অতিথিদের।”

শুভ্রার হেয়ালি কথায় উচ্চস্বরে হেসে উঠলো ফারহাদরা।নিস্তব্ধ,গুমোট পরিবেশে পাঁচ ভাইবোনের হাসি যেনো ঝংকার তুলছে।দেয়ালের সাথে বারি খাচ্ছে। ফারহাদ গলা একটু উঁচিয়ে ডাকলো,
“নিয়ে এসো ওনাকে ভিতরে”

পর পর কয়েকজন অফিসার রেজাউল চৌধুরীকে নিয়ে ভিতরে ঢুকলো।সাথে আয়েশা চৌধুরী,আরাজ আর মাহিদ।
তাদের দেখে বিস্মিত হলো সবাই।রেজাউল চৌধুরীকে দেখে আজাদ শিকদারের রাগে হাত মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে এলো।

আরাজ অপলক তাকিয়ে আছে শুভ্রার দিকে। চোখাচোখি হয় শুভ্রার সাথে।চোখ নামিয়ে নেয় আরাজ।অপরাধীর ন্যায় দাড়িয়ে থাকলো।শুভ্রা দেখেও না দেখার ভান করলো।

“তো মিস্টার মীরজাফর,কতদিন পর দেখা হলো।সব কিছু নিয়ে এসেছেন তো নাকি আবারো ভুল করেছেন?”

মুখ বাঁকিয়ে তাকালো শুভ্রার দিকে মাহিদ। ঘাড় থেকে ব্যাগ নামিয়ে রাখলো টেবিলে।

“মাহিদ মির্জা কখনো কিছু ভুলে যায়না।”

ব্যাগ থেকে যাবতীয় জিনিস বের করে প্রজেক্টর সেট করলো মাহিদ।প্লে করা হলো একটা ভিডিও।যেখানে ড্রাগ ডিলার হিসেবে রেজাউল চৌধুরীকে দেখা যাচ্ছে।পাশে এখন মহিলাও আছে।কিছুক্ষন ভিডিও চলার পর মহিলার মুখ স্পষ্ট হলো।বিস্মিত হলো সবাই।রেজাউল চৌধুরীর সাথে নাইজা শিকদার।

“বাবা,রেজাউল চৌধুরী আর কাকাই ছিল বেস্ট ফ্রেণ্ড।সব সময় একই সাথে দেখা যেতো তিন জনকে।ভার্সিটিতে থাকা অবস্থাতেই ড্রা গ অ্যাডিক্টেড হয় রেজাউল চৌধুরী।পরবর্তীতে নিজেই ড্রা গের ব্যবসা শুরু করে। ছোট থেকেই নাইজা চৌধুরী থাকতেন দেশের বাইরে নানার বাড়িতে। ড্রা গের ব্যবসায় বড় একটা অংশ ছিলেন তিনি।দুই ভাইবোন মিলে একই সাথে কাজ করতেন।বাবা কিছুটা বুঝতে পেরেছিলেন।তাই তিনি সব সময় সাবধান করতেন রেজাউল চৌধুরীকে কে।কিন্তু তিনি বাবার কথায় কোনো কান দেন নি।বাবা পুলিশ হতে চেয়েছিলেন সেটা তিনি জানতেন।আমাদের বাড়িতে ওনার যাওয়া আসা লেগেই থাকতো। বাবা আর দাদুন এর মধ্যে দুরত্ব সৃষ্টি করেন উনি।ভেবেছিলেন এতে করে বাবাকে আটকাতে পারবেন।কিন্তু পারেননি।গাজীপুরে একটা বড় এরিয়া ওনার ছিল।যেখানে উনি ড্রা গের যাবতীয় কাজ করতেন।বিভিন্ন কলেজ,ভার্সিটিতে সাপ্লাই করতেন।এমনকি আমাদের ভার্সিটিতেও।সেদিন বাবা মার মৃত্যুর সময় তিনিই ছিলেন সেখানে।সমস্ত প্রমাণ জোগাড় করেছিল বাবা।পরের দিনই রেজাউল চৌধুরীর সমস্ত অপকর্মের প্রমাণ কোর্টে জমা দেওয়ার কথা ছিল।কিন্তু তার আগেই ,,,

গলা বার বার কেঁপে কেঁপে উঠছে শুভ্রার।বাবা মায়ের মৃত্যুর সময়টা মনে করতে চায়না সে।

“যে প্রমাণের জন্য তিনি আমার বাবা মাকে মেরে ফেলেছেন সেটা পান নি। মায়ের সন্দেহ হওয়ায় অন্য ফাইল নিয়ে গিয়েছিল আসল টা রেখে।সেখানেই রেজাউল আংকেলের সমস্ত কুকীর্তির কথা উল্লেখ ছিল।”

একটা ফাইল এগিয়ে দেয় শুভ্রা ফারহাদের দিকে। ফারহাদ অবাক হয়ে শুভ্রাকেই দেখছে।তার বোনটা ভিতরে এতো কষ্ট চেপে রেখেছিল অথচো তারা জানতেও পারেনি।

“এই ফাইলটিতে ওনার সমস্ত কুকীর্তির প্রমাণ আছে।যদিও এটার হদিস আমার আগে পেলে উনি এতো দিনে জেলে থাকতো। বাবা আর কাকাইয়ের মধ্যেকার ভালো সম্পর্ক নষ্ট করে দিয়েছিলেন নাইজা চৌধুরী।ফলস্বরূপ কোনো যোগাযোগ ছিল না আমাদের সাথে।

চলবে,,,,,