প্রিয় মন্ত্রী মশাই পর্ব-৩৪

0
98

#প্রিয়_মন্ত্রী_মশাই
#পর্বসংখ্যা_৩৪
#আহিয়া_শিকদার

আজাদ শিকদার নাইজা শিকদারের চোখে চোখ রাখলেন।কিন্তু দেখতে পেলেন না কোনো অপরাধবোধ।

“তাহলে কি তোমার এত বছরের ভালোবাসা সবটাই মিথ্যে ছিল?”

ধক করে উঠলো নাইজা শিকদারের বুক।আজাদ শিকদারের দুই হাত চেপে ধরলেন তিনি।

” আমি তোমাকে সত্যি ভালোবাসি আজাদ।”

ঝটকা মেরে হাত সরিয়ে নিল আজাদ শিকদার। আর একবারও তাকালো না নাইজা শিকদারের দিকে।মাথা নিচু করে দাড়িয়ে থাকা নিতুলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।

“কিসের অভাব রেখেছিলাম নিতুল।যখন যা চেয়েছো তাই তোমার সামনে এনে দিয়েছি।নিজের সন্তানের চেয়েও বেশি ভালোবেসেছি।কখনো বুঝতে দেই নি তুমি আমাদের সন্তান নও।ফুটপাতে বসে যখন কাদছিলে তখনই তোমাকে নিজেদের কাছে এনেছিলাম।দেশের বাইরে থাকতাম কারণ যেনো কখনও তোমার মনে এই বিষয়টা না আছে।কিভাবে তুমি এমনটা করতে পারলে?”

বলতে বলতেই কেঁদে উঠলেন আজাদ শিকদার।বাবার কথা শুনে থমকে গেছে নেহা।তবে বাকিরা শান্ত।যেনো তারা জানে।

আয়েশা চৌধুরী একমনে তাকিয়ে আছে নিতুলের দিকে।শুভ্রা এসে দাড়ালো তার পাশে।

“আন্টি যা ভাবছেন তাই ঠিক। নিতুল ভাইয়াই আপনার বড় ছেলে রায়াজ।আপনার ছেলে মারা যায়নি।এগুলো সব প্ল্যান ছিল রেজাউল চৌধুরী আর নাইজা শিকদারের।ইচ্ছাকৃত কাকাই এর সামনে নিতুল ভাইয়াকে এনেছিল।যাতে করে শিকদার বাড়ির সমস্ত সম্পত্তির মালিক হতে পারে।আপনাদের মেয়ে সবটা জানতো।তাইতো ওকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছে।সকলের সামনে উপস্থাপন করেছে আপনার ছেলে এবং মেয়ে মারা গেছে।মিস্টার আরাজ চৌধুরীকেও নিজের খেলার গুটি বানাতে চেয়েছিলেন কিন্তু পারেন নি।”

নিতুলকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন আয়েশা চৌধুরী। নিতুলের চোখেও পানি।কতবছর পর মাকে কাছে পেলো।আজকে প্রথম বারের মতো বাবার উপর প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে তার।বাবার লোভের কারণেই তাকে মা, ভাই বোনের থেকে আলাদা হতে হয়েছে। আরাজ কাপা কাপা পায়ে এগিয়ে এলো নিতুলের সামনে।বরাবর রেজাউল চৌধুরীকে দায়ী করে এসেছে ভাই বোনের মৃত্যুর জন্য।এজন্য বাবা মায়ের সাথে তার দুরত্ব সৃষ্টি হয়েছে।তাছাড়া বাবার অবৈধ কাজে সামিল না হওয়ার কারণেও।আজকে যখন দেখলো তার এতদিনের সকল ভাবনা ভুল তখন নিজেকে অপদার্থ ছাড়া কিছুই মনে হচ্ছেনা তার কাছে।

নিতুল হাজার চেষ্টার পরেও আরাজকে কাছে টানতে পারলো না।

“নিতুল ভাইয়া যে কটা দিন আপনাদের সাথে থাকতো না সে দিনগুলোয় এদেশেই থাকতো এবং রেজাউল চৌধুরীর সাথে আলাদা বাসায়।প্রায় সময় দেখা করতে যেতেন রেজাউল চৌধুরী।আমার পিছনে পড়ে গিয়েছিল।তখনো হয়তো জানতো না আমি সেই মেয়েটা।যার কারণে প্রায় সময় আমাকে ফলো করতো।এমনকি রাতেও বাড়ির বাইরে থাকতো।তবে সবসময় নিজেকে ঢেকে রাখতো যার কারণে তখন জানতাম না উনি আমাকে ফলো করেন।আমি ওনাকে একজন ড্রাগ ডিলার হিসেবেই চিনতাম।যে আমাদের ভার্সিটিতে ড্রাগ সাপ্লাই করতো।ভাইয়াদের সাথে মিলে ধরার প্ল্যান করেছিলাম কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত পারিনি। নিতুল ভাইয়ার পরিবর্তে সেদিন রাতে মিস্টার আরাজ চৌধুরী মার খেয়েছিলেন।”

বলেই চোখ ঘুরিয়ে তাকায় আরাজের দিকে। আরাজ তার দিকেই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। পারলে গিলে ফেলবে এমন ভাব।

“তুমি এত কিছু জানলে কিভাবে?”

আজাদ শিকদারের কথায় সবার নজর এবার যায় শুভ্রার দিকে।বোকা বোকা হাসি দেয় শুভ্রা।মাথা চুলকিয়ে বলে,

“আমিতো কখনো কোমায় চিলামই না।এতদিন লেগেছে আমার সম্পূর্ণ ভাবে সুস্থ হতে।এর মাঝেই ভাইয়ারা আর মন্ত্রী মশাই সহ সমস্ত প্রমাণ জোগাড় করেছি। তবে মন্ত্রী মশাই সমস্ত জানতো না।”

“আমাকে ক্ষমা করো মা”

হাত জোড় করে বলে আজাদ শিকদার।তৎক্ষণাৎ শুভ্রা ওনার হাত নামিয়ে ফেলে।রাগান্বিত হয়ে বলে,

“আপনি কোনো অপরাধ করেন নি কাকাই।আপনি কেনো ক্ষমা চাচ্ছেন।আপনিও তো ভুক্তভুগী।যারা অপরাধ করেছে তারা এর যোগ্য শাস্তি পাবে।”

কিছু সময়ের মধ্যেই রেজাউল চৌধুরীদের নিয়ে যাওয়া হলো। কেউ ফিরেও তাকাল না তাদের দিকে।আয়েশা চৌধুরী কেঁদে কেটে অস্থির।আরাজ তাকে আটকাতে পারছে না।সব সময় দেখেছে ভাই বোনদের জন্য কাদতে।আজকে কাছে পেয়েও যেনো পেলো না।পুরো বাড়ি এখন শান্ত।ক্ষণে ক্ষণে শুধু সকলের নিশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে।

আজমল শিকদার,নীলিমা শিকদার,আসাদ শিকদার,আজাদ শিকদার চলে গেলেন নিজেদের ঘরে।জোর করেই পাঠানো হলো তাদের।আজাদ শিকদারের দিকে তাকিয়ে খারাপ লাগছে সবার।

নেহার চোখ দিয়ে অনবরত পানি পরছে।অপরাধ বোধ কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে তাকে।আর বসে থাকতে পারলো না।কিছু বলার উদ্দেশ্যে উঠে দাড়ালো কিন্তু তাকে থামিয়ে দিলো শুভ্রা।জড়িয়ে ধরলো।কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,

“আমরা জানি বাসর রাতে তুমি আমাকে ড্রাগ দিয়েছিলে এবং সেদিন সিঁড়িতে তুমি তেল রেখেছিলে।ঘরের হিডেন ক্যামেরা থেকে মন্ত্রী মশাই ড্রাগ দেওয়া জানতে পেরেছেন এই রাইমা তেল ফেলা দেখেছিল।আপু তুমি ভালো একটা মেয়ে।মন্ত্রী মশাইয়ের প্রতি তোমার মোহ এটা।এখন আর এসব সবার সামনে বলার দরকার নেই।ঘরে যাও তুমি।তোমার জীবনেও মন্ত্রী মশাইয়ের মতো একজন আসবে যে তোমাকে অনেক ভালবাসবে।”

নেহার কানে কানে বলার কারণে কেউ শুনতে পেলো না তার কথা।নেহা শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো শুভ্রাকে।ডুকরে কেঁদে উঠলো।

“মিস্টার চৌধুরী,অনেক অনেক ধন্যবাদ আমাকে সবসময় প্রোটেক্ট করার জন্য।আমার কিন্তু মনে আছে সেদিন আপনি আমাকে আগুন থেকে বের করেছিলেন।আমিতো ড্রাগ অ্যাডিক্টেড হয়েছিলাম বাজে বন্ধুদের জন্য কিন্তু আপনি কার জন্য হলেন?যদি কারণটা আমি হই তাহলে অন্তত আমার জন্যই ছেড়ে দিন।একজন ভালো বন্ধু হিসেবে সব সময় পাশে থাকবেন।রিমিকে নিজের করে নিন।”

মুচকি হেসে আয়েশা চৌধুরীকে নিয়ে চলে গেলো আরাজ।এতো বছরে ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে শুভ্রা তার নয়।ফাহিমদের আর বাড়ি যাওয়া হলো না।শিকদার বাড়িতেই থেকে গেলো তারা।
_______________

নিজ ঘরের বেলকনিতে বসে আছে শুভ্রা। বুকের সাথে জড়িয়ে রেখেছে বাবা-মায়ের ছবি। আজ বড্ড বেশি মনে পড়ছে তার বাবা-মাকে। সারাদিনের চঞ্চল হাসি খুশি এই মেয়েটার নিরবতা যেনো প্রকৃতিও মানতে পারছে না। তাইতো আকাশের বুক চিরে বেরিয়ে আসলো অশ্রুকনা।ভিজিয়ে দিতে শুরু করলো শুভ্রার মলিন মুখশ্রী। ছুঁয়ে দিলো শুভ্রাকে।

মলিন হাসলো শুভ্রা। তার চোখ থেকে অশ্রুকণা গড়ানোর আগেই প্রকৃতি নিজেকে ঝরিয়ে দিলো। পড়তে দিলো না শুভ্রার চোখের পানি। ভালোলাগা ছড়িয়ে দিলো শুভ্রার ভিতরে। মেতে উঠল শুভ্রার ছেলেমানুষির সাথে।

আরহাম ঘরে এসে দেখলো শুভ্রাকে।কিন্তু কোনো বাধা দিলোনা।সেও গিয়ে বসলো শুভ্রার সাথে।

“ভিজবে বৃষ্টিতে শুভ্রপরী?”

আকাশ থেকে পরলো যেনো শুভ্রা।চোখ গোল গোল করে তাকালো আরহামের দিকে।মৃদু হাসলো আরহাম।শুভ্রার হাত ধরে ঘর থেকে বেরিয়ে পরলো।উদ্দেশ্য বাগান।কারণ ছাদে যে অন্য একজোড়া ভালোবাসার মানুষ নিজেদের মধ্যে সকল বোঝাপরা করছে।ফাহিম আর রাইমা ছাদে ব্যস্ত হয়ে পরেছে নিজেদের মধ্যেকার সকল দুরত্বের অবসান ঘটাতে।

বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা শরীরে পরতেই শিউরে উঠলো শুভ্রা।বাগানের ঠিক মাঝখানে তারা।কিছুক্ষণের মধ্যেই ভিজে গেলো।বাচ্চাদের মত আচরণ করতে শুরু করলো শুভ্রা।সাথে তাল মিলালো আরহাম।
এক হাতে শুভ্রার কোমর পেচিয়ে ধরলো।আরেক হাত রাখলো শুভ্রার ওষ্ঠদয়ে।আলতো ছুঁয়ে দিতে শুরু করলো।

“ভালোবাসি আমার শুভ্রপরী,ভালোবাসি।তোমার মন্ত্রী মশাই ভালোবাসে তোমাকে। ৫ বছর আগে ২৬ বছরের এক যুবকের বুকের তীব্র ব্যাথা হিসেবে জায়গা করে নিয়েছিলে তুমি।আজও অবস্থান তোমার সেখানেই।আমৃত্যু এভাবেই আরহামের বুকের তীব্র ব্যথার কারণ হয়ে থাকবে তুমি।”

চলবে,,,,,,,