প্রিয় মন্ত্রী মশাই পর্ব-০৩

0
107

গল্পঃ #প্রিয়_মন্ত্রী_মশাই
পর্বসংখা : ৩
লেখিকা :#আহিয়া_শিকদার_আহি
____________

সকাল ১১:২৩ ,হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারের বাইরে ব্রেঞ্চে বিধ্বস্ত অবস্থায় বসে আছে আরহাম। দৃষ্টি তার অপারেশন থিয়েটারের দিকে। পড়নের শুভ্র পাঞ্জাবি লাল বর্ণ ধারণ করেছে। শারা শরীর রক্তে ভিজে আছে। দেখে মনে হচ্ছে রক্ত দিয়ে গোসল করেছে সে।কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা চোখের সামনে বার বার ভেসে উঠছে। কানে একটি নারী কন্ঠ বার বার প্রতিধ্বনি হচ্ছে। নাহ্ আর সহ্য করতে পারছে না আরহাম । দুই হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে।

______

নির্বাচনের পর শপথ গ্রহণের পালা এসেছে। কালকেই সকল ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছিল। আজকে সকাল ১১ টায় শপথ গ্রহণ করানো হবে। সব কিছু পর্যবেক্ষণ করছিল পুলিশ এবং বিভিন্ন আইনসভার মানুষ। যতো পারছে কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। মিডিয়ার মানুষ এবং বিভিন্ন উচ্চপদস্থ মানুষের বিচরণ চলছে।

তখনি সেখানে উপস্থিত হয় আরহাম। শুভ্র পাঞ্জাবি-পাজামা, হাতে ব্র্যান্ডেড ঘড়ি, চোখে কালো সানগ্লাস। ঘাড় সমান লম্বা চুল গুলো আলগোছে পিছনে ঝুটি করা। দেখে মনে হচ্ছে কোনো মাফিয়া। উপস্থিত জনগণের মধ্যে হই হই পরে যায়। মন্ত্রীর এই রকম সাজ কতো মেয়েদের হার্ট ব্রেক করছে সে যদি জানতো।গার্ডরা তাকে চারিদিন থেকে ঘিরে রেখেছে।

রাগে ফোস ফোস করছে শুভ্রা। শুভ্র রঙের একটি শাড়ি জড়ানো তার গায়ে। ঠিক যেনো শুভ্র পরি। তার সাথে থাকা কয়েকটা মেয়ে মন্ত্রী মশাইয়ের সৌন্দর্যের প্রশংসা করছে। সহ্য হচ্ছে না তার। তারা কেনো করবে? মন্ত্রী মশাই তো শুধু তার।
আরহামের থেকে কিছুটা দুরত্বে সে। আর ধৈর্য ধরতে না পেরে কল দিলো আরহামের নাম্বারে।
সবে মাত্র সামনের দিকে এগোতে ধরেছিল আরহাম। ফোন বাজতেই থেমে যায় সে। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসির রেখা দেখা যায়। হয়তো বুঝতে পেরেছে কে কল দিয়েছে। পকেট থেকে ফোন বের করার সাথে সাথেই তার মুখের হাসি আরেকটু প্রসারিত হয়। ফোনের স্ক্রিনে জ্বল জ্বল করছে একটি নাম ‘শুভ্রপরী’ । দীর্ঘ সময় পর কালকে রাতে একবার এই নাম্বার থেকে কল এসেছিল। তখন রমণীটি হয়তো জানতো না তার মন্ত্রী মশাই তার সম্পর্কে সকল তথ্য বের করেছে। এখনো হয়তো জানে না।এখন সে খোলা বইয়ের মতো মন্ত্রী মশাইয়ের কাছে।

” আসসালামুআলাইকুম মন্ত্রী মশাই”

” ওয়ালাইকুমুসসালাম।কে বলছেন?”

” এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেছেন? ”

দাঁত কিড়মিড় করছে শুভ্রা। কালেক রাতেও তো এই লোক তার কথা শুনেছিল তাহলে আজকে কিভাবে তার কন্ঠস্বর চিনতে পারছে না?

এদিকে মুখ টিপে হাসছে আরহাম। সে বুঝতে পারছে অপর পাশের মানুষটি রেগে গেছে। আরহামের মুখে হাসি দেখে সকলেই অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

” আপনি কে বলছেন ? আর আমার ব্যক্তিগত নাম্বার কোথায় পেলেন?আপনি এমন কোন ব্যক্তি যাকে আমার মনে রাখার কথা?”

রাগের চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায় শুভ্রা।

” আপনার বাচ্চার মা আমি। ডান দিকে তাকান”

অবাক হয় আরহাম। সে ভাবতেও পারে নি এমন কোনো জবাব দিবে মেয়েটি। আরো একবার অসভ্য, নির্লজ্জ মেয়ে বলে আখ্যায়িত করে শুভ্রাকে।

আরহামের ডান দিকে অবস্থান শুভ্রার। আরহাম তাকায় সেদিকে। দেখতে পায় শুভ্র রাঙানো রমণীটিকে।

শুভ্রা এগিয়ে আসছিল আরহামের দিকে। গার্ডরা বাধা দিতে চাইলে আরহাম নিষেধ করে তাদের। তাছাড়া অনেকই চিনতে পেরেছে শুভ্রাকে। এই তো কালকের সেই নির্লজ্জ মেয়েটা।

আরহামের প্রায় কাছেই চলে এসেছে শুভ্রা। তখনি দেখতে পায় কেউ একজন আরহামের দিকে বন্দুক তাক করেছে দুর থেকে। চমকে যায় শুভ্রা। হাতে থাকা ফোনটা পরে যায় নিচে। আরহাম ভ্রু কুচকে তাকায় তার দিকে।

” মন্ত্রী মশাই”

জোড়ে চিল্লিয়ে উঠে শুভ্রা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই পর পর দুটো গুলি চলার শব্দ পাওয়া যায়। হতভম্ব হয়ে যায় সকলে। আরহাম তাকায় তার বুকের উপর পড়ে যাওয়া রমনীটির দিকে। বুকে তরল জাতীয় কিছু অনুভব করে সে। মাথা যেনো কিছুক্ষণের জন্য শূন্য হয়ে গেছে। যতক্ষনে বুঝতে পারে ঘটনা ততক্ষনে পরে যেতে নেয় শুভ্রা। নিজ বাহুডরে আগলে নেয় তাকে আরহাম। তাকায় একবার দূরে অবস্থানরত মানুষটির দিকে যে কিনা গুলি চালিয়েছে।
পুলিশ কিছু করার আগেই লোকটি পালিয়ে যায় সেখান থেকে।
আরহামের মস্তিষ্ক সচল হতেই দ্রুত শুভ্রাকে নিয়ে গাড়িতে উঠে সে। ফাহিম ছিলো স্টেজে কোনো একটা কাজে। সময় হলো না তাকে সাথে নেওয়ার । খুব দ্রুত হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা হয় আরহাম।
এতক্ষণের ঘটনা গুলো যেনো সকলের মাথার উপর দিয়ে গেলো। কি থেকে কি হয়ে গেলো এতো টুকু সময়ের মধ্যে।
সকলে এটা ঠিকই বুঝতে পেরেছে গুলি করা হয়েছিল আরহামের উদ্দেশ্যে। কিছুক্ষণের মধ্যে নিউজ চ্যানেল গুলোতে হই হই উঠে যায়।

” এই মেয়ে চোখ খোলো। শুভ্রপরী , এই শুভ্রপরী । চোখ খোলো বলছি।”

অবাক হয় ড্রাইভার। আরহামকে এর আগে কখনোই এতো বিচলিত হতে দেখে নি সে।

আরহামের এতক্ষণে মনে পড়ে শুভ্রা মাস্ক পরে আছে। এক টানে খুলে ফেলে সে মাস্ক। চোখের সামনে দৃশ্যমান হয় আদুরে এক মুখশ্রী। ভয়ংকর সুন্দর সেই চোখ জোড়া বন্ধ, গোলাপের ন্যায় ঠোঁট জোড়া কেমন প্রাণহীন দেখা যাচ্ছে।

হাসপাতালে পৌঁছে শুভ্রাকে কোলে নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে সে। সকলেই তার দিয়েক তাকিয়ে আছে। কিন্তু তার আরহামের কোনো ভাবান্তর হচ্ছে না।

______________

হাসপাতালে উপস্থিত হয় ফাহিম। পাগল পাগল অবস্থা তার। নিজের একমাত্র আদুরে বোন অপারেশন থিয়েটারে মানতে পারছেনা সে। তাকে কেনো তার বোনের জায়গায় আঘাত করা হলো না?তার ছোট নিস্পাপ বোনযে কষ্ট পাচ্ছে।
আরহাম কারো উপস্থিতি টের পেয়ে তাকায় সামনের দিকে। দেখতে পায় বোনের জন্য ফাহিমের আতঙ্কিত চেহারা। দেখতে পায় ফাহিমের চোখে বোনকে সুরক্ষা না দিতে পারার অপরাধবোধ।

” বাসায় জানিয়েছিস ফাহিম?”

” না”

” এখনি জানানোর দরকার নেই।”

” আচ্ছা”

আরহাম বুঝতে পারছে ফাহিমের ভিতরের অবস্থা। দৃষ্টি ঘুরতে আবার তাকায় অপারেশন থিয়েটারের দিকে। যেখানে এক শুভ্রপরীর চিকিৎসা চলছে।
তখনি ডাক্তার বেরিয়ে আসে ওটি থেকে। উঠে দাড়ায় আরহাম।

” শি ইজ আউট অফ ডেঞ্জার স্যার। যেহেতু বুলেট দুটো বুকের অনেকতা উপরদিকে লেগেছে তাই বেশি সমস্যা হয় নি।কিছুক্ষণ পর কেবিনে শিফ্ট করানো হবে।”

বলেই ডাক্তার চলে যায় নিজ বরাদ্দকৃত কেবিনে। আরহাম যেনো এতক্ষণ এটা শোনার অপেক্ষাতেই ছিল।

” খোজ নে ফাহিম। কে বা কারা এমন করলো? আর সাজিদ কে গোডাউনে নিয়ে যা।”

আরহামের এমন শান্ত কন্ঠ শুনে চমকে উঠে ফাহিম। সাজিদকে কেনো গোডাউনে নিয়ে যেতে বলছে?

” ভাই, শুভ্রার জ্ঞান ফেরা অব্দি থাকি? আপনি বাসায় যান ভাই। বাইরে মিডিয়ার লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে। গার্ডরা অনেক কষ্ট তাদের আটকিয়ে রেখেছে। আপনি চলুন, আপনাকে পাঠানোর ব্যবস্থা করছি।এখানে থাকা আপনার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে।”

আরহাম মনোযোগ দিয়ে শোনে ফাহিমের কথা। এই ছেলেটাকে সে দুচোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে পারে। আরহাম তাকায় একবার শুভ্রার দিকে যাকে কেবিনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এতো টুকু সময়ের মধ্যে মেয়েটির সাথে কি হয়ে গেলো। ভাবতেই একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরহাম।
অতঃপর ফাহিমের সাথে হাটা ধরে। ফাহিম আরহামকে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে চলে আসে। পুরো হাপাতাল গার্ড দিয়ে ঘিরে রাখা।

___________

শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে আছে আরহাম। তার শরীরে লেগে থাকা সব রক্ত ধুয়ে যাচ্ছে। চেয়ে আছে সে রক্তের দিকে। কিছু সময়ের ব্যবধানে কতো বড় ঘটনা ঘটে গেলো। সকালের কথা ভাবতেই দমে যাওয়া রাগ আবার বেড়ে যায়। সে কিভাবে এতটা অসতর্ক হতে পারলো? নিজের উপর নিজেরই রাগ হচ্ছে তার। সামনে থাকা আয়নায় সজোরে ঘুষি মারে আরহাম। মুহূর্তের মধ্যেই ভেঙে গুড়ো গুড়ো হয়ে গেলো আয়নাটি সাথে তার হাত থেকে বইতে শুরু করলো রক্তের ধারা। না সে নিজের রক্ত দেখে মোটেও বিচলিত হচ্ছে না বরং তার শরীরে লেগে থাকা শুভ্রার রক্ত তাকে বিচলিত করছে।
ভুলতে পারছে না সে শুভ্রার রক্তাক্ত দেহটি। কিভাবে তার চোখের সামনেই চঞ্চল হরিণীর ন্যায় চোখ জোড়া শীতল হয়ে গেলো। আরহামের জন্যই তো আজকে মেয়েটার এতো বড় ক্ষতি হলো। নিজেকে নিজের কাছেই অপরাধী মনে হচ্ছে তার। আজতো শুভ্রার জায়গায় তার হাসপাতালে থাকার কথা ছিল। সময় মতো মেয়েটি না আসলে হয়তো সে নিজেই আজ রক্তাক্ত হতো।
আরহাম পারছে না আর ওসব ভাবতে। মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে তার। যতো দ্রুত সম্ভব বের হয় ওয়াশরুম থেকে। মেয়েটাকে ওভাবে রেখে সে কোনোভাবেই থাকতে পারছে না।

________

চলবে,,,,,,

#আহিয়া_শিকদার_আহি_শ্যামাপাখি