প্রিয় সুখ-৫
________________
নীহারিকার চিৎকারের পরের কারণ তার পা।ডান পা টা এমন ভাবে ফেঁসে গিয়েছে সে খুব ব্যথা অনুভব করছে।টেনে বের করতে পারছে না।টানতে নিয়েই চিৎকারের আবির্ভাব।বিমুগ্ধ ভ্রু কুঁচকে দু পা সোফার উপরে রেখে দেখছে।ফ্লোরে বসে নীহারিকা প্রানপ্রনে চেষ্টা করছে নিজের পা বের করার।তিশা এসে নীহারিকাকে সাহায্য করতে চায়।বিমুগ্ধ উপর থেকে বলে উঠে,’ এত বড় কলিজার মানুষের সাহায্য লাগে না কি?আরে উনি নিজের চেষ্টায় পারবে।তুই এত প্যারা নিচ্ছিস কেন?’
রাগে নীহারিকা খুব জোড়ে নিজের পা টান মারে।একদম নিচের দিকে পাতার উপরের একটা অংশের চামড়া উঠে রক্তাক্ত হয়।সে মনে মনে ঠিক করে এই অসভ্য,বিষাক্ত মানুষটার সাথে কথা বলবে না আর।উঠে যেতে যেতে তবুও ফিরে তাকিয়ে বলল,’ মানুষ হয়ে মানুষের সাথে এমন ব্যবহার করা উঁচিত না।আমার মনে হয় আপনার মন বলতে কিছু নেই।শুধু মস্তিষ্ক থাকলেই মানুষ হয় না কেউ।’
‘ তাই না কি মিস ক্ষেপা মহিলা?আপনি বরং মন খুঁজে পেতে আমাকে সাহায্য করুন।আমি মানুষকে ধার দি।দান নয়।যে সাহায্যটা আগে করেছি সেটা শোধ করুন আগে।তারপর দেখা যাবে অন্য কিছু করা যায় কিনা।’
বিমুগ্ধ লাফিয়ে সোফা থেকে নামলো।হঠাৎ ফিরে তাকিয়ে বলল,’ আপনি তো আচ্ছা বাজে মহিলা!এভাবে আমার দামি শার্ট ফেলে দিলেন?দাম কত জানেন?পুরো এগারোশো টাকা।তার মধ্যে জুতোও দিলেন ফেলে।আবার সাহায্যও আশা করেন?খুবই খারাপ বুঝলেন।’
বিমুগ্ধ হাসতে হাসতে নিজের জামা জুতো কুড়িয়ে নেয়।নীহারিকা হোটেল বয়ের কাছে টেলিফোন আছে কি না জানতে চায়।আছে বলতেই সে ফোন করতে যায়।বাবার ফোন নাম্বার বাদে সে কারো ফোন নাম্বারই জানে না।এমন কি নিজেরটাও না।অনেক বার কল করার পরেও ফোন রিসিভ হয় না।চিন্তায় নীহারিকা অনেক সময় ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকে।বাবার কিছু হলো না তো?কি থেকে কি করে ফেলেছে সে।এসব একদম উঁচিত হয়নি।মুহিতা মুহিতের সাথে কি নিয়ে কথা কাঁটা কাঁটি করে এসে দাঁড়ায় নীহারিকার কাছে।নীহারিকা তখনো টেলিফোনে কল করে যাচ্ছিল।মুহিতা বলল,’কাকে এত কল করছ?বয়ফ্রেন্ডকে?ভাইরে ভাই তোমরা আজ কালকার মেয়ে হয়েও বোকার মত একটা ছেলের হাত ধরে পালিয়ে আসো।এখন নিশ্চুইয় ফোন ধরছে না।কিছুক্ষণ পরে নাম্বার আসবে বন্ধ।তারপর পুরো দমে গায়েব।এসব তো এখন গাঁধাও বুঝে।তবুও বোকা মেয়ে গুলো একুই ভুল বার বার করে।’ বেশ বিরক্তি নিয়ে নীহারিকা বলল,’ আমার বাবাকে কল করছিলাম।বয়ফ্রেন্ড বলতে কেউ নেই আমার।’ভারী অবাক হয়ে মুহিতা বলল,’ কি বলো?সত্যি??তাহলে পালালে কেন?’
‘ বাবা জোর করে বিয়ে দিতে চেয়েছিল।তাই পালিয়ে এসেছি।কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ভুল করেছি।’
‘ এটার জন্যেই বলে ভাবিয়া করিও কাজ করিয়া ভাবিও না।আমারও একুই ভুল হয়ে গেছে।এই বজ্জাত টারে বিয়া করে।’‘ আপনি বিবাহিত??’ ‘ হুম।মুহিত আমার হাজবেন্ড।’
নীহারিকার মাথায় আসে এদের জন্য একুই রুম কেন নিতে বলা হয়েছে।বুঝতে পেরে সে বলল,’ ওহ আচ্ছা।আপনারা সবাই একে অপরের আত্নীয় হন??’
অর্পন এসে দাঁড়ায় পাশে।চাবি দিচ্ছে সে সবাইকে।মুহিতা চাবি নিতে নিতে বলল,’ না।সব বন্ধু।আচ্ছা আমি যাই।মুহিতের সাথে ঝগড়া করেছি।আজকে রুমে ঢুকতে দিবো না।তাই আগেভাগে যাই।’
মুহিতা চলে গেল।অর্পন নীহারিকার দিকে চাবি এগিয়ে দিয়ে বলল,’ আপনার নাম যেন কি?’
চাবি হাতে নিয়ে নীহারিকা বলল,’ নীহারিকা।পুরো নাম এখন বলতে ইচ্ছে করছে না।’
অর্পন হাসলো।নীহারিকার এই ছেলেটিকেও পছন্দ না।কেন সে বুঝতে পারছে না।অর্পন নিজে থেকে বলল,’ আমার নাম অর্পন মাহবুব।পেশায় একজন কার্ডিওলজিস্ট।আর আপনি??’
নীহারিকা সোজা গলায় বলল,’ আপনার সাথে কোন এক কারণে আমার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।তাই বলতে আগ্রহী নই।’
সে চাবি নিয়ে চলে যায়।অর্পন অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে কিছু মুহূর্ত।পরক্ষনে হেসে ফেলে।একটা মানুষ কিভাবে এত সহজ সরল ভাবে মনের কথা বলে দিতে পারে?এমন কি সে এটাও ভাবেনি যে সামনের মানুষটার খারাপ লাগবে কি না? নিজের অপছন্দের কথা খুব সহজ ভাবেই বলে দেওয়ার ক্ষমতা দেখে অর্পন মুগ্ধ হলো।বিমুগ্ধ পিঠ থাপড়ে বলল,’ যা চাচ্ছিস তা হবে না।মিস ক্ষেপা মহিলা তোকে একদম পছন্দ করে না।’অর্পন চাপা রাগ প্রকাশ করে বলল,’ সব কিছুতে নিজের ধারণাকে কাজে লাগাতে চাস কেন?সবাই তোর এসব উদ্ভুত বিদ্যায় অবাক হলেও আমি হইনা।মন পড়তে পারার অসীম ক্ষমতা তোর থাকলেও সব সময় সেটা ফলবে এমন তো নয়।’
বিমুগ্ধ দুষ্টু হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে বলল,’ শুধু শুধু ক্ষেপে যাচ্ছিস কেন?এখনো তো মেয়েটার মুখই দেখলি না।তার আগেই পছন্দ করে বসে আছিস?আরে সর্বনাশ তুই তো প্রেমে পড়ে গেছিস।আমার মনে হচ্ছে ভালোবাসা নামক রোগে তুই খুব দ্রুত আক্রান্ত হবি।’ চমকে তাকায় অর্পন।এসব কিছুই সে এখনো অনুভব করেনি।এই বিমুগ্ধ সব কিভাবে বুঝল? যতই মুখে বলুক সে অবাক হয় না আসলে সে ঠিকই অবাক হয়।খুব অবাক হয়!বিমুগ্ধ শিস বাজিয়ে নিজের চাবিটা খপ করে নিয়ে সামনে হাঁটতে থাকে।সাথে নেয় ছোট ছেলেটিকে।পিছনে একপলক তাকিয়ে চিন্তিত অর্পনকে বলে উঠে,’ তুই ভাই ছ্যাঁকা খাবি।আমি শতভাগ নিশ্চিত।তার চেয়ে ভালো ছিলো তিশার প্রেমে পড়া।কেন যে পড়লি না?দুঃখ!’
খুবই আফসোসের সুর তুলে বিমুগ্ধ চলে গেল।অর্পন তাকিয়ে রইল শুধু মাত্র।মুখটা হা হয়ে গেল কিছুটা।
________________
নীহারিকা শুধু একটি জামা নিয়ে নিজের বাড়ি থেকে পালিয়েছে।রুমে ঢুকে সে প্রথমে গোসল করেছে।সারা দিনের ক্লান্তি তাকে জেঁকে বসেছিল।খুব অস্বস্তি হচ্ছিল।তাই গোসল করেছে।ওয়াসরুমের ফ্লোরে অনেক সময় বসে সে ভেবেছে কয়েক ঘন্টায় কত কিছু হয়েছে।সে পালিয়ে এসেছে।এখন আবার আফসোসও হচ্ছে।আগের দিন গুলো কত ভালো ছিলো।আজকের এই দিনটি যেন দুঃস্বপ্ন হয়।হঠাৎ যেন ঘুমটা ভেঙ্গে যায়।উঠে দেখে সে নিজের বাড়িতে।মনে মনে হাজার বার সে চাইছে এটা যেন স্বপ্নই হয়।খুব খারাপ স্বপ্ন!যে স্বপ্ন সে জীবনে দ্বিতীয় বার আর দেখতে চায় না।পা টা খুব জ্বলছে।মায়ের কথা মনে করে সে অনেক সময় নিয়ে কেঁদেছে।খুব বিপদে পড়লে সবার আগে আল্লাহর পরে প্রতিটি মানুষ বাবা মায়ের কথা ভাবে।তাদের কাছে পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা জাগে।এখন সেই আকাঙ্ক্ষাটা নীহারিকার বুক দখল করে অবস্থান করছে।শোকের সাগরে অবগাহন করছে সে।
ওয়াসরুম থেকে বের হয়ে নীহারিকা লক্ষ করলো তার রুমটা অন্ধকার।সে তো আলো জ্বালিয়ে রুমে ঢুকে ছিল।এখন অন্ধকার হলো কিভাবে?সচেতন হয়ে নীহারিকা চোখ কান খোলা রাখে।তার মনে হচ্ছে রুমে কেউ আছে।নিঃশ্বাসের একটা উত্তেজিত হিস হিস শব্দ কানে এসে লাগছে।নীহারিকা দ্রুত ওয়াসরুমের আলো জ্বলাতে যায়।কি অদ্ভুত!আলো জ্বলছে না।তার মানে কি বিদ্যুৎ চলে গেছে?না কি কেউ ইচ্ছে করে করেছে?হোটেলে বিদ্যুৎ কেন যাবে??ভয়ে পায়ের তালু ঝিঁঝিঁ করছে।নিঃশব্দে নীহারিকা বৃদ্ধা আঙ্গুল টিপে টিপে বিছানার এক পাশে যায়।হঠাৎ মনে পড়ে।এদিকেই একটা ছুরি আছে।ফল কাঁটার ছুরি।নীহারিকা খুবই নিঁখুত পায়ের ছাপ ফেলে ধীরে সুস্থে সাহসিকতার সাথে বিছানার পাশে এসে দাঁড়ায়।হাতড়ে হাতড়ে ছুরিতে হাত দিতেই একটা আপেল গড়িয়ে পড়ে নিচে।একটা ধপ করে শব্দ হয়।নীহারিকা নিজেই চমকিত হয়ে আরো জড়োসড়ো হয়ে পড়ে।ধাক্কা লেগে সবকটি ফল নিচে পরে গিয়েছে ।একটা বিঁকট শব্দ।কেউ নিচু গলায় বলল,’ কি হয়েছে?’
নীহারিকা বুঝতে পারছে মানুষটি তার আশেপাশে।খুব পাশে!আঁতঙ্কিত হয়ে নীহারিকা এলোমেলো ছুরি ঘুরিয়ে চিৎকার করে বলল,’ একদম কাছে আসবেন না? খুন করে দিবো।’
পরক্ষণেই চেঁচানোর শব্দ।নীহারিকা চমকে উঠে।যন্ত্রণা মিশ্রীত কন্ঠ ভেঁসে আসে কানে,’ মিস ক্ষেপা মহিলা আপনি যে খুনি সেটা তো আমি বুঝতে পারিনি।হাতটা পুরো গেলো।’
নীহারিকা শুধলো।মনে মনে নিরুচ্চারে বলল,’ বিমুগ্ধ!’
বাম হাতটা নিজের দু’হাতের মাঝ তালুতে নিয়ে বিমুগ্ধ হেসে উঠে বলল,’ আপনি কিন্তু খুব ডেঞ্জারাস মহিলা।’
নীহারিকা ধাতস্থ হওয়া কন্ঠে বলল,’ আপনি মারাত্নক লেভেলের অসভ্য।ছিঃ একটা মেয়ের রুমে আপনি নক না করেই কিভাবে ঢুকতে পারেন?আর আর দরজার চাবি কোথায় পেয়েছেন?রুমে আলো নেই কেন?আলো নিভিয়ে দিলেন কিভাবে?ধ্যৎ আপনি রুমে ঢুকলেন কিভাবে??’
নীহারিকা এক প্রকার চিৎকার চেঁচামেঁচি করা শুরু করে।বিমুগ্ধ না পাড়তে মুখ চেপে দেয়ালের সাথে মিশিয়ে দেয় নীহারিকাকে।এবার খুব ভয় করছে নীহারিকার।ঠকঠক করে তার শরীর কাঁপতে শুরু করে।গলা শুঁকিয়ে যাচ্ছে বার বার।নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে যেন!বিমুগ্ধ ফিসফিস করে বলল,’ চিৎকার করলে আর মুখই খুলবো না।সিদ্ধান্ত নিন।চিৎকার করবেন না কি মুখ বন্ধ রেখে কথা শুনবেন।’
নীহারিকা মনে মনে ঠিক করে একবার মুখ খুলে তো দেখ তারপর বুঝাবো আমি কি।সে মাথা নাড়ালো।মানে সে চিৎকার করবেনা।বিমুগ্ধ হেঁসে সংযোত গলায় বলল,’ বোকা পেয়েছেন??আমি মুখ খুলে দিলেই যে আপনি চিৎকার করবেন সে আমি জানি।প্রথমত আমি বোকা নই।দ্বিতীয়ত আমাকে বোকা বানানো এত সহজ নয়। দ্রুত বলুন।হাত রক্তাক্ত আমার।’নীহারিকা এবার সত্যি মাথা ঝাকালো।সে কিছুই করবে না।বিমুগ্ধ মুখ ছেড়ে বলল,’ আপনার মাথায় প্রবলেম আছে।আমি ভেবেছি ফ্রিতে চিকিৎসা করবো।এভাবে কেউ দরজা খোলা রাখে?’
নীহারিকা অবাক হয়ে বলল,’ আমি দরজা খোলা রেখেছি?’
‘ তা না হলে আমি কি উড়ে এসেছি?মানুষের উপকার করাই উঁচিত না।পা কেঁটেছে বলে আমি ঔষুধ নিয়ে এসেছি এদিকে আমার হাত জখম করে রেখে দিয়েছেন।’বিমুগ্ধর দর্পণে পতিত আলোক-রশ্মির প্রত্যাবর্তন হচ্ছে।নীহারিকা ছায়াটা দেখছে শুধু।হঠাৎ রিনঝিনে নিচু গলায় বলে উঠে,’আমি অন্ধকারে থাকতে পারিনা বেশিক্ষণ।ভয় করে খুব।এই যে আমার হাত কাঁপছে।পা কাঁপছে।সয়ং আমি নিজে কাঁপছি।আপনি কি আলোর ব্যবস্থা করতে পারবেন?’
নীহারিকা সত্যি ভয় পায় অন্ধকার।সে রাতে বেশিরভাগ সময় নিজের রুমের লাইট জ্বালিয়ে ঘুমায়।পরে তার বাবা এসে লাইট বন্ধ করে।তার হাত পা কাঁপছে।বিমুগ্ধ লাইটার বের করে পকেট থেকে।নীহারিকা দেয়াল ঘেঁষে বসা।লাইটার মুখের উপরে ধরতেই আলোর উজ্জ্বল রশ্মি ছড়িয়ে পড়ে চোখে মুখে।নিস্তব্ধতা চারপাশে।একটা হলুদ আলোর শিখা।নীহারিকা হাঁটু ভেঙ্গে বসে আছে।আলো চোখে পড়তেই সে চোখ তুলে তাকায়।সেই দৃষ্টি ধারালো ধনুকের ছোঁড়া তীর ছিলো যেন।বিমুগ্ধ এক হাঁটু ভেঙ্গে বসে ছিল ফ্লোরে।তারপর দু’হাঁটু ভেঙ্গে বসে।আহামরি কি কিছু আছে মেয়েটার মুখে? না নেই।সাধারণ মানুষের মত দু’টি চোখ।দুজোড়া ভ্রু, নাকের পাটা মিসৃন,একটা ঠোঁট।কাঁপছে ধকধক করে।দু’পাশের গালও নড়ছে।হায় সর্বনাশ বাম চোখ লাফাচ্ছে!নিঃশ্বাসের তাড়নায় আলো নিভছে জ্বলছে।এলোমেলো হয়ে আবার জায়গায় এসে থামছে।বিমুগ্ধর সম্বিৎ ফিরে আসে নিজের মুখে আগুনের তাপ লাগতেই।নীহারিকার মাথার পাশ বেয়ে গাল গড়িয়ে ঘাম গলার পাশে নেমে যাচ্ছে।নাক মুখ সব ঘামে ভিঁজা।হাত গুলোও কাঁপছে ভূমিকম্পের মত। অপ্রতিরোধ্য তুফান বিমুগ্ধের পাঁজড়ের হাঁড়ে হাঁড়ে নিজের শক্তি দিয়ে চেপে বসতে চাইছে।ঘোর লাগা কন্ঠে সে বলল,’আপনি একটু অদ্ভুত দেখতে!না মিস ক্ষেপা মহিলা, না আপনি পুরোই অদ্ভুত দেখতে।আপনাকে আমি কোথাও দেখেছি।খুব মিল তার সাথে আপনার। আপনি কখনো সিলেট গিয়েছিলেন? আমার কাছে?নিজের মাথার চিৎকাসার জন্য? আপনাকে তো আমার মানসিক রোগী মনে হয় তাই প্রশ্নটা করলাম।’বিমুগ্ধ হেঁসে ফেলল।নীহারিকা নার্ভাস হয়ে পড়েছিল।এতো কাছ থেকে তাকে আগে কখন কোন ছেলে দেখেনি।সে নিজেও কাউকে দেখনি।বিমুগ্ধ আবার নির্নিমেষ চেয়ে রইলো।তার সত্যি মনে হচ্ছে কোথাও দেখেছে এই মেয়েকে। মনে পড়েছে। অবাক ব্যাপার! তার সাথে এত মিল! নীহারিকা দু’হাতে মুখ ডেকে চেঁচিয়ে বলল,’ বিছানার পাশ থেকে আমার ওড়নাটা দিন।’
বিমুগ্ধ দিলো।তারপর হুট করে আবার সামনে বসে বলল,’আপনার যে এতক্ষণ ওড়না ছিলো না সেটা আমি লক্ষ করলাম না কেন?’
‘ সেটা আমি কিভাবে জানবো?আপনি রুম থেকে বের হন।তা না হলে আমি কিন্তু আপনাকে খুন করে দিবো বলে দিচ্ছি।অসভ্যতামির সীমা থাকা উঁচিত।আপনাকে না একবার বলেছি আমার থেকে দূরে থাকবেন?কানে যায় না কথা?বেয়াদপ একটা।’
রাগে অসাড় হয়ে আসা গলায় নীহারিকা বলল।প্রকৃত অর্থে সে ভয় পাচ্ছে।খুব ভয়।রাস্তা খুঁজচ্ছে।ছুঁটে পালানোর জন্য।ধপ করে লাইট জ্বলে উঠে।নীহারিকা মুখে হাত দিয়ে কাঁপছিল।শব্দ পর্যন্ত করতে চাইছিল না।বিমুগ্ধকে বিছানায় আবিষ্কার করে নীহারিকা।সে দৌড়ে দরজার কাছে যায়।দেখে দরজা খোলা।কিছু না ভেবেই সে দরজা খুলে এক দৌড় দেয়।হঠাৎ ধাক্কা খায় তিশার সাথে।এলোমেলো হয়ে দৌড়াতে দেখে তিশা বলল,’ আপনার কি হয়েছে?এভাবে দৌড়াচ্ছেন কেন?এনি প্রবলেম??’
নীহারিকা হাঁপিয়ে উঠা কন্ঠে বলল,’আপনার বন্ধু একটা খুবই বখাটে ছেলে।অসভ্য।নক না করে একটা মেয়ের রুমে ঢুকে গেল।আমি পুলিশের কাছে কেস করবো।কুত্তার বাচ্চা একটা।জানোয়ার।’
থরথর করে গালের দু’পাশ কাঁপছে নীহারিকার।তিশা অবাক হওয়া গলায় বলল,’ নীহারিকা!’
আসলে সে চিনতে পারেনি।আগে তো নীহারিকার চেহারা দেখেনি সে।নীহারিকা চোখ ভর্তি পানি নিয়ে মাথা দুলালো।তিশা শান্ত করতে বলল,’ আপনি ভুল বুঝচ্ছেন।ও মাঝে মাঝে ফাইজলামি করে ঠিক কিন্তু কখনো কোন মেয়ের সাথে সে মিস বিহেভ করে না।’
‘ মিস বিহেভ কম করেছে এত সময়? আপনি বলতে চাইছেন আরো বেশি কিছু করা দরকার ছিলো?’
‘ আমি নিজেই ওকে পাঠিয়েছি।আসলে আমিই যেতাম।কিন্তু আমার একটা ফোন এসেছিলো আমি বলেছি তুই যা।তাই ও এসেছে।আপনি চলুন আমার সাথে।’
একদম সটাং উত্তর নীহারিকার।সে যাবে না।খালি পায়ে দাঁড়িয়ে আছে সে।হাত গুলো উড়না চেপে ধরে আছে।হেলে ধুলে কাঁপছে সে।তিশা ধরে টেনে টুনে রুমে নিয়ে আসে।বিমুগ্ধের হাত রক্তে ভেসে যাচ্ছে।বিছানার উপরে বসে সে হাত চেপে ধরে রেখেছে।তিশার চোখ চড়কগাছ।দৌড়ে ছুটে এসে বলল,’ তোর হাত কাঁটল কেমনে?’
‘ রাক্ষসী দাঁত বসাতে না পেরে ছুরি বসিয়ে দিয়েছে।’
‘ রাক্ষসী পেলি কই?’
‘ তোর সামনেই তো কাপঁছে দাঁড়িয়ে।মিস ক্ষেপা মহিলা।’
তিশা উত্তেজিত হয়ে সবাইকে ডাকতে যায়।নীহারিকা ওড়ানা কামড়াচ্ছিল।দূর থেকে সে দেখে নিলো।ইশ্ ভয়াবহ জখম হয়েছে।তার অনুশোচনা হচ্ছে।বিমুগ্ধ হেসে উঠে বলল,’ আপনি খুব ভিতু।রাতে লাইট জ্বালিয়ে ঘুমান তাই না? অন্ধকারকে এত ভয় পাওয়ার কি আছে?’
নীহারিকা দু পা এগিয়ে এসে বলল,’ একদম এসব বলবেন না।’
‘ কিসব বললাম? ‘
‘ আপনি আমাকে আগে থেকে চিনেন? আমার সম্পর্কে এতো কিছু জানেন কিভাবে?
‘ সেটা তো ম্যাজিক। তবে আপনি সত্যি সত্যি পালিয়েছেন?আমার এবার নিজের বলা কথার উপরে সন্দেহ হচ্ছে।যে অন্ধকার ভয় পায় সে আবার পালাতক আসামী?’বিমুগ্ধ হেলে দুলে হাসছে।যেন খুব মজার কৌতুক।নীহারিকা একটু দমে গিয়ে বলল,’আপনার ব্যথা করছে না?’
‘ তেমন একটা না।’ নির্বিকার গলা বিমুগ্ধের।
‘ কি বলেন এতটা কেঁটে গেছে আপনি বলছেন ব্যথা করছে না?’
‘ আসলে আরো ব্যথা পাওয়া উঁচিত ছিলো।আমার নিজেরও বোন আছে।এভাবে কোন ছেলে না বলে আমার বোনের রুমে প্রবেশ করলে আমি তো খুন করে দিতাম।আপনি সামান্য হাত কেঁটেছেন।কিন্তু দোষ আপনারও আছে।দরজা খোলা রেখেছিলেন কেন?আমি তো দরজা খোলা দেখে ঢুকেছি।তখনই লাইট অফ হয়ে গেছে।আপনাকে এভাবে ভয় দেখানোর জন্য স্যরি।’
বিমুগ্ধ সুন্দর একটা কন্ঠে খুবই বিনিত ভঙ্গীতে বলল।নীহারিকার সাথে এই প্রথম মানুষটা এত সুন্দর করে কথা বলেছে।মোহনীয় চোখে নীহারিকা ক্ষত স্থানের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যে বিছানার অপর প্রান্তে এসে বসেছে সে নিজেও টের পেলো না।নিচে কিছু লাগছে!সে উঠে দেখে ফোন।বিমুগ্ধের।ফোনটা হাতে নিতেই সে আশ্চর্য রকম চমকে উঠে বলল,’ আপনার সাথে এই লোকটা কে??আর এই মহিলাটা কে?’
বিমুগ্ধ মাথা তুলে দেখে তার ফোন নীহারিকার হাতে।দ্রুত কেঁড়ে নিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বলল,’ লজ্জা লজ্জা।এভাবে কারো ফোনে হাত দেওয়া একদম উঁচিত না।আপনার শিক্ষার বড্ড অভাব মিস ক্ষেপা মহিলা।আপনার জন্য অফসোস হচ্ছে।কাল চলে যাবেন।তা না হলে শিক্ষা দিয়ে দিতাম।’
নীহারিকা কথার তোয়াক্কা না করে মুঠো ফোনটা আবার নিজের হাতে নিতে হাত বাড়িয়ে দেয়।বিমুগ্ধ অবাক হয়ে বলল,’ আপনি কি চুরিও করেন?’ পরক্ষনেই হাসলো সে।নীহারিকা অধৈর্য্য হয়ে বলল,’ প্লিজ ফোনটা দিন।আপনার ফোনের এই লোক আর এই মহিলা দুজনকেই আমার খুব পরিচিত মনে হচ্ছে।’ বিমুগ্ধের হাত থেকে জোড় করেই টেনে নেয় ফোন।তারপর বলে,’ এরা কে হয় আপনার?’
‘ আমার বাপ আর মা।আর কার ছবি এতো রং ঠং করে ফোনের উপরে দিবো।’
‘ আপনি শিউর?’
বিমুগ্ধ এবার হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লো বিছানায়।রক্ত লেগে সাদা বিছানা লাল হয়ে উঠেছে।নীহারিকার চোখ বের হয়ে আসবে যেন।সে এখনো ফোনের দিকে তাকিয়ে খুটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে।যেন তাদের মুখের রগ খুঁজে বেড়াচ্ছে।বিমুগ্ধ বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে বলল,’ লাইক সিরিয়াসলি?বাপ মা আমার কি না এটা জানতে আমার শিউর হতে হবে?’ কথা শেষ করে বিমুগ্ধ আবার হাসলো।নীহারিকা পাশে বসে বলল,’ বিশ্বাস করুন এই লোকের ছবি আমাদের বাসায় ঝুলানো ফ্যামলি ফ্রেমে আছে।এই লোক তো মৃত।মৃত মানুষ আপনার পাশে কি করছে।’
বিমুগ্ধ হাসি থামিয়ে দিল।উঠে বসে সে নিজের ফোন এক প্রকার কেড়ে নিয়ে অবাক হওয়ার একটা হাস্যকর নাটক রচনা করে বলল,’ সিরিয়াসলি?কত সালে মারা গিয়েছে?’
‘ আমার জন্মেরও অনেক আগে।’
‘ কি বলেন?আমি ভুতের ছেলে?মৃত আত্নার ছেলে??মানে আমি মানুষ না?ইয়েস আমার তো সারা জীবনের তপস্যা সত্য হয়ে গেছে।
‘ আমি সত্যি বলছি।’
‘আপনি তো আমার স্বপ্ন সত্যি করেদিলেন মিস ক্ষেপা মহিলা।আমার একটা সাহায্য শোধ করেছেন দেখে খুঁশি লাগছে।’ বিমুগ্ধ আবার হাসতে শুরু করলো।এই ছেলে হাসি ছাড়া কিছু কি করতে পারে না?সারাক্ষণ হাসে।রাগে না কেন?রাগ হয় না বুঝি?কিভাবে?নীহারিকা স্বভাবিক ভাবে বলল,’ দেখুন আমি সত্যি বলছি।জন্ম থেকে উনাকে আমি ছবিতে দেখে এসেছি।চিনতে বিন্দু মাত্র ভুল হবে না।’
‘ মৃত ব্যক্তি বিয়ে করে কিভাবে?মানুষকে বিয়ে করে কিভাবে?সংসার করে কিভাবে?রোগী দেখে কিভাবে?দু’দুটি সন্তান জন্ম দেয় কিভাবে?আপনি না এসব ছাড়ুন।আর ব্যাগ গুঁছিয়ে নিন।এখনি আবার পালাতে হবে।’
বিস্মৃত হয়ে নীহারিকা জানতে চাইল,’ মানে?’
‘ এটা ভালো হোটেল না।এখানে অপকর্ম হয় অনেক।মেয়ে পাঁচার হয়,নারী নিয়ে অনেক কান্ড হয়।সবচেয়ে বড় কথা বড় বড় নামীদামী মানুষ ফুর্তি করতে আসে।মেয়ে পাঁচার করে এরা।একবার ফেঁসে গেলে বের হওয়া অনেক মুসকিল।
‘ আপনি যদি এত কিছু জানতেন তাহলে এখানে নিয়ে আসলেন কেন?’
‘ আমি ভবিষ্যৎ বলতে পারি না কি? কিভাবে আগে আগে জানবো এসব এখানে চলে।’
বিমুগ্ধ কাঁটা হাত এক হাতে ধরে রুম থেকে বের হতেই নিবে হঠাৎ সে নীহারিকার খুব কাছে এসে ঝুঁকে পড়ে।আচমকা নীহারিকা ভয় পেয়ে যায় খুব।সে সরে যায়।বিমুগ্ধ নিজের ঠোঁটে কামড় বসিয়ে হেসে বলল,’ আমি নিজেই আপনার থেকে দূরে থাকতে চাইছি কিন্তু ভাগ্য অদ্ভুত ভাবে ফাঁসিয়ে দিচ্ছে।শুধু এই রাত তারপর আমি আমার জীবনে আপনাকে কখনো দেখতে চাই না।’
নীহারিকার মুখে ফুঁ মেরে বিমুগ্ধ বের হয়ে যায়।নীহারিকা ভাবে কথাগুলো কি রাগ ছিলো?না অভিমান?অভিমান কেন হবে?এই ছেলে মানুষ না।সে নিশ্চিত।তা না হলে হাত কেঁটে দেওয়ায় রাগ কেন করলো না?অনুভুতি নেই না কি?’
_______________
ফয়সাল আগে ভাগে লাফিয়ে নিচে নেমে যায়।এসবে সে দারুন দক্ষ।বিমুগ্ধ নিজেও লাফিয়ে নেমে যায়।নীহারিকা ভাবে এত উঁচু থেকে লাফিয়ে পড়লে তার পা নিশ্চিত ভাঙ্গবে।পা গেল যাক।তবুও সে এদের হাতে পড়তে চায় না।মেইন দরজা দিয়ে তারা খুব সাবধানে বেরিয়ে এসেছে।দেয়াল টপকানো বড় ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।হোটেলের মেইন গেইট দিয়ে বের হওয়া যাবে না।চোখ বন্ধ করে নীহারিকা লাফ দিতে প্রস্তুত হয়।বিমুগ্ধ দু পকেটে হাত রেখে বলল,’ পা ভাঙ্গবে নিশ্চিত।’ থেমে যায় নীহারিকা।এই মানুষটা বলেছে মানে সে নিশ্চিত তার পা ভাঙ্গবে।নীহারিকা বসে পড়ে দেয়ালে।অন্য দিকে হোটেলের লোকেরা তাদের খুঁজতে শুরু করে।এই হোটেল থেকে মানুষ গায়েব হয়।এটা নীহারিকা এক হোটেল বয়কে বলতে শুনেছে।আসলে তো কেউ গায়েব হয় না গায়েব করা হয়।নীহারিকা কিছু বলার আগেই পা টান মানে বিমুগ্ধ।পড়তে পড়তে বেঁচে যায় নিহারীকা।মুখ থুবড়ে পরে রাস্তায়।পা ভাঙ্গেনী দেখে নীহারিকার খুশি লাগছে।কিন্তু হাত কেঁটেছে।নীহারিকা মৃদূ কন্ঠে বলল,’ আপনার বন্ধুদের রেখে পালাচ্ছেন কেন’
‘ আমি পালানোর মত মানুষনা।আর ওরা গাঁধা না আপনার মত যে অপেক্ষা করে বসে থাকবে আমি কখন যাবো ওদের নিতে।বোকামির লেভেল থাকা দরকার ।আমার জন্য বসে ছিলেন? কেন? আপনার জন্যেই দেয়াল টপকাতে হয়েছে।ওদের সাথে বেড় হতে পারলেন না?’
নীহারিকা চুপ করে থাকে।ওরা বের হয়ে আর আসেনি দেখেই সবার সন্দেহ হয়।তারপর থেকেই চোখ রাখে বাকি রুমের দিকে।বিমুগ্ধ সবার সাথেই বের হয়। ভেবে নীহারিকা নিজেই বের হয়ে যাবে। কিন্তু হঠাৎ কি মনে করে সে আবার ফিরে এলো।
‘ মিস ক্ষেপা মহিলা আমাদের পথ এটুকুই।আপনি আপনার মতো হাঁটা শুরু করুন।বেশি যেতে হবে না কিছু দূরে গেলেই একটা বাস পাবেন মনে হয়।এখন রাত দশটা মেবি।এই সময় সিলেটের একটা বাস ঢাকা পথে থাকে।আর হ্যাঁ পালানো বন্ধ করুন।ভালো থাকবেন মিস ক্ষেপা মহিলা।ক্ষেপলে আপনাকে মোটামুটি সুন্দরই লাগে।’
বিমুগ্ধ মিষ্টি হাসলো।হাসলে ছেলেটার কপাল কুঁচকে যায়।নাকটা দাম্ভিকের তাড়ায় উঁচু হয়ে যায়।নীহারিকা বলতে চাইল বাসে তুলে দিয়ে যান?কিন্তু বলতে পারলো না।লজ্জায় মিইয়ে যাওয়া চোখে সে শুধু দেখতে লাগলো।অসভ্য এই ছেলেটাকে তার হঠাৎ পবিত্র মনে হচ্ছে।তার জন্য আবার ফিরে এসেছিল?তাকে বাঁচাতে?সে তো কেউ না।কয়েক ঘন্টার পরিচিত ক্ষেপা মহিলা মাত্র।কত বিরক্তই না করত।অথচ তাকে বাঁচাতে এত পরিশ্রম করে এসেছে!নীহারিকা অপলক তাকিয়ে রইলো।বিমুগ্ধ ফয়সালের হাত ধরে হেঁটে চলেছে।নীহারিকার মন হঠাৎ তার আয়ত্ত থেকে ফঁসকে পড়ে যায়।বারং বার চায় একবার তাকাক।একবার তাকালে কি খুব ক্ষতি?উনি তো সবার মন পড়ে বলে দিতে পারে।মনের বিজ্ঞানী।তাহলে কেন বুঝতে পারছে না।নীহারিকা চাইছে,খুব করে চাইছে একবার তার দিকে ফিরে অদ্ভুত ভাবে হাসুক,ডেকে বলুক মিস ক্ষেপা মহিলা!
__________
রি-চেক করা হয়নি।দুঃখিত।
ভুলগুলো আল্লাহর দেওয়া মহান গুন ক্ষমার চোখে দেখবেন।
#চলবে…………
@হাফসা আলম……………..