প্রিয় সুখ পর্ব-১৩

0
6

প্রিয় সুখ-১৩
____________________
মুহূর্তের মাঝে যেন তাযিন মেনে নিল। সে নিজেকে বডিগার্ড হিসেবেই গ্রহন করেছে। শাহিন ভাই তীক্ষ্ন চোখে পরখ করে বললেন,’ ভালো ভালো। এমন একটা শক্ত পক্ত ছেলেকে বডিগার্ড বানিয়ে তুই বেশ ভালো কাজ করেছিস। তা এখানে কেন এসেছিস? ‘
কথার মাঝেই নীহারিকা বুঝতে পারল বার বার তিনি কি শুনতে চাইছে। কিন্তু মিতু আপু তো কখনোই উনার কাছে তাকে পাঠাবে না। জীবনেও না। নিজেকে শুধরাল নীহারিকা। কোমল গলায় বলল,’ ভাইয়া উনি আমাকে বলেছে আপনাদের বাড়ি দেখিয়ে দিতে। তাই এসেছি।’
মুখটা মুহূর্তে ফ্যাকাশে হয়ে উঠে শাহিন ভাইয়ার। হতাশ গলায় ছোট করে বললেন,’ ওহ।’
থেমে বললেন, ‘ তা কেন? আপনার কি প্রয়োজন আমাকে? ‘
‘ প্রয়োজন একটু আছে। পার্সোনাল কথা জানতে চাইব। যদি আপনি মাইন্ড না করেন।’
শাহিন ভাই কিছু সময় নিয়ে ভাবলেন। চোখ নিচের দিকে দিয়ে তিনি গভীর ভাবনায় ডুবে নিচের দিকে তাকিয়েই বললেন,’ আচ্ছা বলুন। চেষ্টা করব জানাবার। ‘
তাযিন এবার খুবই গম্ভীর ভাবে প্রশ্ন করল। তাকে দেখে শাহিন ভাই ভারী অবাক হয়ে উত্তরের জায়গায় বললেন,’আপনি প্রশ্ন করার ব্যাপারে খুব প্রফেশনাল।’ তাযিনের মুখে কোন প্রতিক্রিয়া হলো না। সে চুপ করে আগের মত তাকিয়ে রইল। শাহিন ভাই নিশ্চিত খুব তাড়া জানার। একটু মৌন থেকে তাযিন মুখ খুলে আবার বলল,’আপনার সাথে মিতুয়ার কোন সম্পর্ক ছিল? ‘
চমকে উঠে শাহিন ভাইয়া বললেন,’ এসব পুরোন কথা। এখন আসছে কেন? ‘
‘ বললে ক্ষতি নেই তো। ‘
‘ অনেক বছর আগে ছিল। আমার দিক থেকে এখনও আছে। শুধু ও বদলে গিয়েছে। আসলে বদলেনি। আমিই বদলে দিয়েছি।পৃথিবীর সব কিছুই পরিবর্তনশীল। শুধু সৃষ্টি কর্তা ছাড়া।’
তাযিন যথেষ্ট কৌতুহলি হয়ে বলল,’ বদলেছে কিভাবে? ‘
‘ বিয়ের সময় যখন ওর বাবা মায়ের কাছে প্রস্তাব পাঠাতে বলল তখন আমি অনার্স করিনি। বিয়ে হলে পড়ার ক্ষতি হবে ভেবে আমি তাকে অপেক্ষা করতে বলেছিলাম। ক্যারিয়ারকে ইম্পর্টেন্ট দিয়েছি। সে বলেছিল অপেক্ষা করবে। কিন্তু মা বাবা যখন জোড় করতে শুরু করে তখন ও আমাকে অনেক বুঝাতে চাইল আমিই বুঝলাম না। যখন বুঝলাম তখন খুব দেরি হয়ে গেছে। পরে জানতে পেরেছি খালা না কি আমার মায়ের সাথেও কথা বলেছিল। মা তাকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। আর বলে দিল আমি না কি কখনো বিয়ে করব না তাকে। আমার বিয়ে অনেক আগেই অন্য জায়গায় ঠিক হয়ে আছে। অথচ আমি এসব কিছুই জানতাম না। মিতু জিদ করে বিয়ে করে নিল। তখন আমি ঢাকায় ছিলাম। এসে যখন শুনি তখন অনেক দেরি হয়ে যায়। মিতুর পাঠান সব চিঠি আব্বা পোস্ট অফিস থেকে আমার কাছে পৌছানর নিষেধাজ্ঞা করেছে। কোন চিঠি আমার কাছে যাইনি। আমি এখানকার পরিস্থিতি বুঝতে পারিনি। গ্রামের মেয়েদের বিয়ে তাড়াতাড়ি হয় আমি জানতাম। কিন্তু মিতু রাজি হবে না সেটাও জানতাম। তাই ভেবেছি বাড়িতে তো এমন অনেকে বলাবলি করেই। এটা কোন বড় ব্যাপার না। তাই আমি তেমন পাত্তা দিলামনা। আমি মিতুয়ার অনুভূতি গুলো বুঝতে পারিনি তখন। তাই হয় তো সে এখন আমারটা বুঝতে পারছে না।’
তাযিন সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে। চোখ জোড়া রাখে একদম তীব্র ভাবে স্থির। স্বাভাবিক কন্ঠে সে বলল,’ তা এখন কি বুঝাতে চাইছেন আপনি? ‘
শাহিন ভাইয়া যখন চোখ তুলে তাকায় নীহারিকার কি যে কষ্ট হলো সে বলে বুঝাতে পারবে না। মিতু আপুকে এত ভালোবাসে উনি? এত ভালোবাসা হয়? বছরের পর বছর না পেয়েও কেউ এত ভালোবাসে? আহারে বেচারা। পরক্ষণেই রেগে আগুন নীহারিকা। শুধু ভালোবাসলেই হয় না আগলে রাখতে জানতে হয়। মস্তিষ্ক বেশ বড় রকমের টান খেল তার। রাগে শরীর ঝনঝন করে উঠল। মিতু আপু তাদের এসব কিছু বললেনি। তারা কি এতটাই পর? তীব্র রাগ ঢেলে নীহারিকা রূক্ষ কন্ঠে বলল,’ স্বপ্ন দেখিয়েছেন তখন মনে হয়নি আমি পূরণ করতে পারব না? পড়ালেখা খুব গুরুত্বপূর্ণ যখন তখন প্রেম করতে বলেছে কে? যতসব। আমি যাচ্ছি আপনি থাকেন। অসহ্য লাগছে।’
মুখ ঘুরিয়ে নেয় নীহারিকা। তার ভাষ্যমতে প্রেম যদি ক্যারিয়ার ঠিক করার আগেই করতে পারে। তাহলে বিয়ে কেন করতে পারবে না? তার ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক শাহিন ভাইকে বুঝতে পুরোদমে অক্ষম। রাগে ঝাঁ ঝাঁ করে উঠে তার চোখমুখ। সে দ্রুত কিছু দূর পায়ের বড় জায়গা তৈরি করে সরে পড়ে। তাযিন কিছু সময় সে দিকে দৃষ্টিপাত করে মাথা ঘুরিয়ে শাহিনের দিকে তাকাল। আহত কন্ঠে শাহিন চেঁচিয়ে উঠে বলল,’ নীহু তুই ভুল বুঝতাছস ভাইরে।’
পিছন ফেরে উত্তর পাঠাল নীহারিকা,’ মোটেও না শাহিন ভাই। আমার আপনার উপরে প্রচন্ড রাগ আর ঘৃণা কাজ করছে।’
মেয়েটা খুব আবেগপ্রবণ। অথচ কি রাগ? ভাবে তাযিন। ঠোঁট তার বাম পাশে বেঁকে বসে। চোখ গাঢ় স্থির হয়ে রয়। শাহিন ভাইকে উদ্দেশ্য করে তাযিন বলল,’ এখন কেন তার পিছনে ঘুরছেন সেটা বলুন? ‘
‘ নীহু তো চলে যাচ্ছে আপনি যাবেন না? ‘
‘ উনি কোথাও যাবে না। দূরে দাঁড়িয়ে শুনবে সব। প্রকৃত অর্থে অতটা সাহসী নয় তিনি। শুধু সাহস দেখাতে খুব দক্ষ।’
শাহিন ভাই ভারী অবাক হয়ে তাযিনের চোখে নিজের ভিজে উঠা চোখ জোড়ার দৃষ্টি বসিয়ে দিল। নরম কন্ঠে বলল,’ আপনি খুব গভীরের মানুষ।’
‘ প্রশ্ন পাল্টে কথা বলা বন্ধ করুন।’
বাচ্চাদের মত দু’হাতের পিঠ দিয়ে শাহিন ভাই চোখ মুছে একচিলতি মিশ্র হাঁসি মাখিয়ে বলল,’ বন্ধ করলে কি পাব?’
‘ মিতুয়াকে।’
অবাক বিস্ফারিত চক্ষু মেলে তাকায় শাহিন ভাই। এই একটা জিনিস তার জীবনে অসম্ভব বলেই তিনি জানেন। অবিশ্বাস্য চোখে তিনি তাকিয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। তাযিন পিছনে একবার চিন্তিত চোখে তাকিয়ে মনে মনে হাসল। নীহারিকা বড় বটগাছের ঝুলে পড়া লতার শক্ত ঢালের পিছলে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে। অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে আসছে গ্রাম। রাতটা যেন খুব দ্রুতই গ্রামে হানা দেয়। বটগাছের পাতা চেপ্টা। সবুজ, ঝকঝকে। ঠিক মানুষের সতেজ চেহারার মত চক চক করতে জানে এই পাতা। নীহারিকা একটা পাতা ছিড়তে গিয়ে ভাবল কি কথা হচ্ছে তাদের মাঝে? ভাবতে ভাবতে সে আর পাতা ছিড়ল না। শাহিন ভাই কনকনে ঠান্ডায় মানুষ যেভাবে কাঁপে ঠিক সেভাবে কাঁপছে। তার কম্পন দেখে তাযিন বাহুতে হাত রেখে বলল,’ আর ইউ ওকে।’
‘ আমি একদম ওকে। মিতুয়াকে কিভাবে পাব বলবেন? কিভাবে? আমি দীর্ঘ বছর অপেক্ষায় রয়েছি। শুধু একটি জিনিসের। সে আমার হবে। শুধু আমার। আপনি কি আমার জন্য কিছু করতে পারবেন? কিছু একটা?’
তাযিন মৃদূ হেসে বলল,’ আমি কখনো কারো জন্য কিছু করি না। যা করি শুধু নিজের জন্য।’
চোখে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল শাহিন ভাই। তিনি তো মুর্খ মানুষ নয়? তাহলে এই মানুষটাকে ধরতে পারছে না কেন? কিভাবে যেন কথা বলে?
‘ আপনি কি জানেন ও ডিভোর্সি?’
চকিতেই ফিরে চাইল শাহিন ভাই। এক রোখা কন্ঠে বলল,’জানি। এতে আমার সমস্যা নেই। আমি যে কোন পরিস্থিতিতেই মিতুয়াকে মেনে নিতে পারব।’
‘ গ্রেট। আমরা এবার যেতে পারি?’
‘ কিভাবে কি হবে কিছুই তো বললেন না?’
তাযিন অনেকটুকু ঝুঁকে কানের নিকটে এসে বলল,’ একটু টেকনিক খাটালে আপনার এত বছর অপেক্ষা করতে হত না। বেশি কিছু করতে হবে না। শুধু ধরে বেঁধে দু’তিন ঘন্টা কথা বলবেন। মাফ চাইবেন। মেয়েদের মন হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে নরম বস্তু। মাটির চেয়েও নরম।’
কথার কিছুই বুঝল না শাহিন ভাই। তিনি চেয়ে রইলেন অপলক ভাবে। তাযিন দ্রুত পায়ে জায়গা প্রস্থান করল। নীহারিকা শুকনো পাতার মড়মড় শব্দে চমকে উঠে পাশে তাকায়। তাযিন হঠাৎ করে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠে,’ এখানে কি করছেন?’
কন্ঠটা ভূতুরে শুনাল। গা ঝমঝম করে উঠে নীহারিকার। তাযিন ঠিক টের পায়। আর একটু ভয়ে ঢেলে সে বলল,’আল্লাহ এই গাছে তো ভূত থাকে। আপনি জানেন না?’
‘ চুপ একদম। চলুন।’ নীহারিকা বড় বড় পা বাড়িয়ে একটু দূরে এসেই দেয় এক দৌড়। তাযিন হাসল। তার জন্য এটা ছিল খুব হাসি। অন্ধাকারের কালো আঁধার রজনীতে তার সেই হাসি ধরার সাহস এই মুহূর্তে নীহারিকার ছিল না।

নৌকার বুকে যখন তারা বসল মাঝির হাতে তখন হারিকেন ঝুলছিল। হলুদ কমলা রশ্নীর মিশ্র রঙ্গ ছড়িয়ে পড়ছিল দীঘির স্বচ্ছ দোল খেলান পানির উপরিভাগে। ঢেউ খেলান চুলের মত এঁকেবেঁকে বইছে পানির ধারা। কলকল শব্দ তুলে মাঝি যখন হাতের হারিকেন রেখে বৈঠা তুলে বাইতে শুরু করল নীহারিকা রাগী কন্ঠস্বর তুলে তখন বলল,’আপনার সাথে আসাই আমার ভুল হয়েছে।’
তাযিন শান্ত চোখে একবার ফিরে তাকিয়ে পুনরায় চক্ষু ফিরিয়ে হারিকেনের হলুদ আলোর ঝকঝকে রূপের উপরে রেখে ছোট করে বলল,’ কারণ?’
অনেক অপেক্ষার পর একটা সুযোগ পেলে মানুষ যেভাবে হামলে পড়ে নীহারিকা ঠিক তেমন ভাবে হামলে পড়ে বলল,’ কারণ একটাই আপনি একটা ফালতু মানুষ। এবং যার মাথা ভর্তি সব ফালতু বুদ্ধী। অসহ্য।’
মুখে বিতৃষ্ণার ছাপ। তাযিন অপর প্রান্ত থেকে তীর্যক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। অগোচরেই সে তাকিয়ে থাকে কিছু গোপন মুহূর্ত অতিবাহিত করে। নীহারিকা তখন মনে মনে বিড়বিড় করতে ব্যস্ত। মেয়েটা মনের সাথে খুব পাকা পোক্ত সম্পর্কে রয়েছে। নিজের সব কথা সে নিজের মনকে বলে। এ যেন এক মনকন্যা। যে নিজের মনের মত চলে। মনের কথা শুনে। মনকে ভালোবাসে। চলন্ত নৌকার বুকে হেঁটে তাযিন নীহারিকার খুব কাছে এসে বসল। হাতে হারিকেন নিয়ে মাঝির উদ্দেশ্যে বলল,’ চাচা এটা আমি নিচ্ছি। আপনার কি কোন সমস্যা হবে? ‘
মাঝি ক্লান্ত ম্লান মুখে একটু হাসতে চেয়ে বলল,’ না কিচ্ছু সমস্যা হইব না।’
নীহারিকার শরীর বেয়ে হিম করা শীতল বাতাস স্পর্শ করতেই তার মন ভালো হয়ে উঠে। খুব দ্রুত যাদের রাগ উঠে তাদের রাগ নামেও দ্রুত। নীহারিকা তাদের মাঝেই অন্তর্ভুক্ত। হালকা হালকা হাসছে সে। ভাল লাগা ঠোঁটে ফুঁটে উঠে। পাশটা ভারী অনুভব হতেই সে ফিরে তাকায়। তাযিনকে পাশে বসে থাকতে দেখেই ভয় পেয়ে উঠে। বুকে হাত দিয়ে সে তীব্র ক্ষোভে ফেঁটে পড়ে বলল,’ আপনি এখানে কি করছেন? ‘
‘ আমার বসতে ইচ্ছে করেছে। তাই এসেছি। কোন সমস্যা?’
নীহারিকা কিছু বলল না। চেপে বসল।
‘ আমার মাথায় ফালতু বুদ্ধী বললেন কেন?’
‘ কারণ আমার এটাই মনে হয়। কি প্রয়োজন ছিল শাহিন ভাইয়ার সাথে দেখা করার? আগে উনার প্রতি আমার অনেক শ্রদ্ধা ছিল। সব এখন উড়ে বাতাসে গিয়ে মিশেছে।’
‘ এমন কেন হলো?’
‘ আচ্ছা আপনি সব সময় জেনে বুঝে অবুঝের অভিনয় করেন কেন বলবেন?’
নীহারিকার কন্ঠ সুন্দর। যখন ঝাঁ ঝাঁ করে কথা বলে তখন মনে হয় সুন্দর কন্ঠস্বরটা আরও সুন্দর হয়ে উঠে। রাগলে কাউকে এত সুন্দর লাগে আগে কখনো অনুভব করেনি তাযিন। এই জীবনে তার অনেক অনুভুতিই সে অনুভব করছে এখন। সাদামাটা জীবন জটিল ধাঁধায় রূপ নিয়েছে।
‘ শুনুন ভুলেও মিতু আপুর সাথে শাহিন ভাইয়ের মিল করাতে যাবেন না। তাহলে আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না।’
দীর্ঘশ্বাস নিয়ে তাযিন চোখে চোখ রাখে। নীহারিকার মুখের উপরে ছড়িয়ে ছিঁটিয়ে পড়ে হারিকেনের আলো। দুজনের চেহারা ধারণ করেছে কমলা রঙ্গে। স্বচ্ছ কন্ঠেস্বরে তাযিন বলল,’ আপনি আগে থেকেই খারাপ। আলাদা করে খারাপ আর হতে পারবেন না।’
‘ আমি খারাপ?’ অবাক কন্ঠ নীহারিকার। তাযিন যথেষ্ট স্বাভাবিক গলায় বলল,’ হুম। খারাপের লেভেল ছাড়িয়ে আপনি অবস্থান করছেন চরমে। আর মিতুয়ার সাথে শাহিনের বিয়েতে আপনাকে আমি নিজ হাতে কার্ড দিয়ে আসব।’
‘ শাহিন ভাইয়া মোটেও ভালো না। উনি নিজের ক্যারিয়ারের জন্য মিতু আপুকে ছেড়েছে। আর আপনি তার সাথেই বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন?’
‘ হুম লেগেছি।’
নীহারিকার ইচ্ছে করছে দু’হাতে ধাক্কা দিয়ে নতুন হওয়া খালাত ভাইকে পানিতে ফেলে দিতে। অসভ্য বেয়াদপ ছেলে একটা। নাক মুখ কুঁচকে নিয়ে সে অন্যদিকে মুখ করে। কিছুমুহূর্ত কেঁটে যায় নিরবে নিভৃতে। হঠাৎ তাযিন শীতল স্বরে ডেকে উঠে,’ নীহারিকা।’
প্রবল বেগে চমকে উঠে নীহারিকা। চোখ ফিরিয়ে সে তাযিনের দিকে তাকায়। তাযিন হারিকেনের শিখার দিকে দৃষ্টিপাত করে বলল,’ প্রেম, ভালোবাসা একটি পুরুষের জন্যে সব কিছু নয়। নারীদের মত অতিরঞ্জিত হয়ে কল্পনায় ডুবে থাকতে পারে না এরা। এদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন বাস্তব। সেই বাস্তবতার একঘেয়েমি দূর করতে, আর প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে তাদের প্রয়োজন হয় একটি সঙ্গীর। যার মাঝে তারা কিছু মুহূর্ত, কিছু সময়, ডুবে থাকবে কল্পনায়। সারা দিনের বাস্তবতা ঘেটে এসে তারা এক টুকরো সময় কল্পনায় বাস করার জন্যেই ভালোবাসে। এই ভালোবাসা অতি আকাঙ্ক্ষিত। প্রিয়সুখ। শান্তি ভরা শ্বাস। খুব ক্ষুদ্র কল্পনিক সময় হলেও এই সময় জুড়ে থাকে তাদের সারা দিনের পথ চলা। বাস্তবতায় থেকেও তারা এই সময়টা পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকে। ঘড়ি দেখে কিছু সময়পর পর। দ্রুত সেই সুখের সন্ধানে ছুটে। নারী ছাড়া বাড়ি হয় না। হাজার বাস্তবতাকে উল্টেপাল্টে পুরুষ একটি বাড়ি তৈরি করে। সেই কল্পনাকে সাজাতে। তাকে নিয়ে সুন্দর সুখের, অভিমানে ভেজা সংসার সাজাতে। পুরুষের জীবনটা তোমরা নারীরা যতটা সহজ বলে উড়িয়ে দেও ঠিক ততটা নয়। এরা কল্পনাতে সুখ খুঁজে। সেই সুখের জন্য তারা বাস্তবে বিচরন করে। কারণ বাস্তবতা না থাকলে সুখ কখনো ধরা দিবে না। কল্পনিক সেই রমনী নামক সুখের জন্য তারা বাস্তবতার পাহাড় সমান কষ্ট সহ্য করে।’
মন্ত্রমুগ্ধের মত প্রতিটি কথা নীহারিকার কানে এসে পর্দা ভেদ করে হৃৎপিণ্ডে কোমল আঘাতের রচনা করে। মুহূর্তে পৃথিবী জুড়ে হাওয়ার নেয় তীব্র ভালো লাগার বাতাস হয়। তাযিনের চোখে হলুদ শিখা জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। আশ্চর্য মোহনীয়তার জন্মদিচ্ছে সেই আলোকরশ্নী। নীহারিকা চোখ ফিরিয়ে নেয় দ্রুত। উদাসীন কন্ঠে সে বলল,’ এসবের সাথে শাহিন ভাই বা মিতু আপুর সম্পর্কের কানেকশন খুঁজে পাচ্ছি না আমি।’
তাযিন কিছু সময় মৌন থেকে বলল,’ পাবেন। খুঁজে দেখুন। কল্পনার রাজ্য সাজাতে বাস্তবতার প্রয়োজন। পুরুষ জাতির বাস্তবতা হচ্ছে তার ক্যারিয়ার। ইচ্ছে করে কেউ নিজের সুখ হারাতে চায় না। সবার একটি দায়বদ্ধতা থাকে। সে হয় তো ভিন্ন। কিন্তু থাকে। হাত পা বাঁধা প্রতিটি মানুষের। স্থান কাল পাত্র ভেদে পরিস্থিতি আলাদা।’
নীহারিকা একটু অস্থিরতা অনুভব করল। কথা ঘুরিয়ে সে বলল,’ আপনি শাহিন ভাইয়ের পক্ষ নিচ্ছেন কেন?’
‘ কারণ তাকে আমার ভুল মানুষ মনে হলো না। আমি মানুষের চোখ দেখে মন পড়তে পারি।’
নীহারিতা চমকে উঠে। তাযিন চমৎকার হাসি দিয়ে হারিকানের আলো নিভু নিভু করে দেয়। মাঝি চিৎকার করে বলে তারা নিজের পাড়ায় পৌছে গেছে। তাযিন আগে নেমে যায়। নীহারিকা তখনও স্তব্ধ। চিঠিতে চোখের বিশেষ দিক ছিল। তাযিন দিয়েছে?
‘ হাত ধরুন। উঠার সময় একবার পড়েছেন।’
নীহারিকা সরু চোখে তাকিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল,’ তাতে আপনার কি?’
‘ কিছু কিছু মানুষের ব্যথা জীবনের প্রতিটি পৃষ্ঠাকে আঘাত প্রাপ্ত করে এক সাথে ঘায়েল করে। সে ব্যথা খুব তীব্র।’
অন্ধকারে পোঁকার ঝিঁ ঝিঁ ডাকের সাথে হালকা কন্ঠের নিচু শব্দ গুলো কেমন যেন শুনাল। নীহারিকার কানে প্রতিটি কথা পৌছল না। এ অল্প অল্প শুনল। তাযিনের কন্ঠে তাড়া,’ দ্রুত নামুন। রাত বাড়ছে। আমি জানোয়ারের আহার হতে চাইছি না।’
জানোয়ারের কথা শুনে নীহারিকা দ্রুত হাত চেপে ধরে। তাযিন উপলব্ধি করতে পারছে নীহারিকার হাত ভারী ঠান্ডা। যার মেজাজ এত হাই তার শরীর এত ঠান্ডা কেন? কথাটা ভেবে সে হাসল। এই ঠান্ডা বরফের নেয় হাতের অধিকারীনির চোখে আগুনজ্বালা। তার উত্তপ্ত শরীর কেমন যেন আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠে। নীহারিকা নামতেই সে দ্রুত হাত সরিয়ে নেয়। বাকি পথ সে বোবার মত পাড়ি জমাল।
__________________
সন্ধ্যায় সবাই ঘরের হলরুমে বসে ছিল। নীহারিকা ফ্রেশ হয়ে আসতেই মিতু আপু লাফিয়ে উঠে বলল,’ তুই কোথায় ছিলিরে?’
শুকনো ঢোক গিলে নীহারিকা চোখ গরম করে বলল,’ সব কথা তোকে বলতে হবে।’
‘ অবশ্যই হবে আমি তোর বড়।’
নীহারিকা বুঝতে পারছে মিতু আপু রেগে যাচ্ছে। তাই সে নরম কন্ঠে বলল,’ আপু খুব পায়ে ব্যথা করছে। প্লিজ আপু কিছু কর। দেখ ফুলে গেছে।’
মিতু আপু দেখল সত্যি নীহারিকার পায়ের মুড়িয়া ফুলে গিয়েছে। রাগে হনহন করতে করতে তিনি নিজের রুমে গেল। ঔষুধ নিয়ে এসে নীহারিকার গায়ের উপরে ছুড়ে দিয়ে বলল,’ তুই লাগা।’
‘ আপু তুই লাগিয়ে দে না।’
‘ আমি কি তোর বেতন ভুক্ত কর্মচারী?’
মিতু আপুর ঝাঁঝাল কন্ঠ। নীহারিকা বড্ড দুঃখ করে বলল,’ তুই তো আমার বিনাবেতন ভুক্ত মিতু আপু। থাক লাগাতে হবে না আমি নিজেই লাগিয়ে নিব।’
নীহারিকা ঔষুধ তুলতে যায়। মিতু আপু রাগে গজগজ করতে করতে হাত থেকে খপ করে নিয়ে নেয়। মলম লাগিয়ে দিতে দিতে নীহারিকা মিতু আপুকে হাসানর বাহানা তৈরি করে। তাযিন, শান্ত, মুহিত, অর্পন ছিল ডাইনিং টেবিলে। এই টেবিল বিয়ে উপলক্ষে মামা কিনেছে। এর আগে নানুর বাড়িতে ডায়নিং টেবিল ছিল না। অর্পন খুব ব্যস্ত। ফোনে কথা বলছে কখনো। কখনো আবার ল্যাপটপে কাজ করছে। রোগীদের খোঁজ খবর নিচ্ছে সে খুব চিন্তিত ভঙ্গীতে। তাযিন বই পড়ছিল। তার সামনে পরীক্ষা। শান্ত চোখের ভাষায় ফাবিহার সাথে শয়তানি করছিল। মেয়েটাকে বেশিই মায়াবী লাগছে তার। শ্যামলা রঙ্গের এই মেয়েটি যে এত সুন্দর হতে পারে চোখে না দেখলে তো সে বুঝতেই পারত না। তার উপরে চুল গুলো কি ঘন কালো। শান্ত বুঝতে পারছে তার সাথে কিছু একটা হচ্ছে। কি হচ্ছে? সে বিদেশ ফেরত ছেলে। আমেরিকায় তার শত ধবধবে ফর্সা প্রেমিকা রয়েছে। এত সুন্দর অপ্সরীর মত মেয়ে দেখে এমন অনুভব হয়নি। শান্ত তাযিনের সাথেই দেশে ফিরেছে। তার মাঝে তারা দু’জনেই বিদেশ থেকে ঘুরে এসেছে। সেটা তাদের জন্মস্থান।সুন্দরী মেয়ে দেখতে দেখতে মনে হয় তার চোখ বিরক্ত হয়ে গিয়েছে। তা না হলে এই মেয়েকে এত সুন্দর লাগার কারণ কি?

রূবাইদা এসে মুখটা মলিন করে কামরুল শামার পাশে দাঁড়াল। তাকে বেশ দুঃখি মনে হচ্ছে। শামা খালামনি মৃদূ হেসে বললেন,’ কি হয়েছে রূবাইদা?’
রূমাইদার দুঃখ বাদ ভেঙ্গে নেমে পড়ল অভিমান হয়ে। খুব কষ্ট মিশিয়ে সে বলল,’ আন্টি কেউ আমাকে তাদের দলে নেয় না।’
শামা খালামনি অবাক হয়ে বললেন,’ দল কই পেলে তুমি? এখানে কি কারও আলাদা দল রয়েছে?’
‘ আছে তো। এই যে ওটা মিতু আপু মানে সবাই ওকে মিতু আপুই ডাকে। বয়সে যদিও আমি বড়। ওটা মিতু আপুর দল। আর ওটা তাযিনের। দুই দলের কেউই আমাকে তেমন পাত্তা দিচ্ছে না।’
শামা খালামনি মনে মনে খুব হাসলেন। মুখে তা প্রকাশ না করে উঠে গেলন। তাযিনের সামনে উপস্থিত হয়ে বললেন,’বিমুগ্ধ তুই না কি রূবাইদাকে পাত্তা দিচ্ছিস না?’
তাযিন চোখ মুখ কুঁচকে তাকাল। চাপা অস্বস্তি তার চোখে মুখে। মুখ ঘুরিয়ে সে বলল,’ আম্মি আমি এখানে আড্ডা দিচ্ছি না। পড়ছি।তুমি জানো আমার পরীক্ষা রয়েছে।’
‘ তাই বলে নিজের হবু ওয়াইফকে সময় দিবে না। এটা কেমন কথা আন্টি? তুমিই বুঝাও।’
ইংরেজির কটকট শব্দে কথা গুলো বলল রূবাইদা। কথা শুনেই বুঝা যাচ্ছে এই মেয়ে বাঙালীবংশভূত হলেও তার প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা আমেরিকার। নীহারিকার পায়ে হাত বুলাতে বুলাতে থমকে যায় মিতু আপু। অবাক হওয়া কন্ঠে তিনি বললেন,’ নীহুরে এই মাইয়া তো আমগো খালাত ভাবি।’
নীহারিকার দৃষ্টিতে তেমন কোন ভাব প্রকাশ পেল না। সে অবাকই হয়নি। এই ছেলের বিয়ে হলে তার কি? যতসব ফালতু মানুষ। অসহ্য লাগে নীহারিকার। হঠাৎ তার মাথায় আসে শামাখালামনি বিমুগ্ধ ডাকল? আশ্চর্য সে খুব। একটু দূর থেকেই প্রশ্ন করল,’ খালামনি বিমুগ্ধটা কে?’
শামাখালামনি আরও অবাক হয়ে বললেন,’ এমা তুমি তো প্রথম দিনেই চিনেছিলে। এখন ভুলে যাচ্ছ? তাযিনের নামই তো বিমুগ্ধ। ‘
‘ কিভাবে খালামনি? আপনিই তো বললেন উনার নাম তাযিন।’
‘ আরে এটা ওর ডাকনাম। আমি যখন প্রথম ছোট বিমুগ্ধকে কোলে নিলাম তখন আমি বিমুগ্ধ নয়নে তাকে দেখছিলাম। তখন বিমুগ্ধের আব্বি আমার দৃষ্টি দেখে বললেন, ছেলের নাম দিবে বিমুগ্ধ। এই নাম তো আর স্কুল কলেজে দেওয়া যায় না। তাই নাম রাখা হয়েছে তাযিন। ওর বিমুগ্ধ নামটা শুধু খুব কাছের মানুষরাই জানে।’
নীহারিকা শান্ত স্নিগ্ধ চোখে তাকাল তাযিনের মুখমন্ডলের দিকে। তাযিন তখন চায়ে চুমুকে ব্যস্ত। এই লোক চায়ে নীহারিকাকেও হারিয়ে দিল। মিতু আপু পা মালিশে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। পরিবারের সবাই এই খবর শুনে খুবই আনন্দিত হয়ে পড়ল। তাযিনের বিয়ে যে রূবাইদার সাথে ঠিক তা আজই তারা জেনেছে। রূবাইদাকে খুব যত্ন করা হচ্ছে। এটা তাদের বংশের প্রথম ছেলের বিয়ে। একটা হইচই ভাব পড়ে গেল। রূবাইদা মহা খুশি। তার অতিসুন্দর রূপ প্রকাশিত হচ্ছে খুব। তাযিন অনেক সময় পরে চোখ তুলে নীহারিকাকে খুঁজল। নীহারিকা পূর্বে তাকিয়ে থেকেই মিলাতে ব্যস্ত। দুই নামের সাথে সে তো দুই সত্ত্বারও পরিচয় পেয়েছিল। তাহলে এ কে? ও কে? দু’জনেই যদি এক হয় তাহলে বিমুগ্ধ কোথায় হারিয়ে গেল? সে তো তাকেই খুঁজে বেড়াচ্ছে। দু’টি চোখ এক বিন্দুতে যখন আবদ্ধ হলো তাযিন তখন খুব অবাক হলো। সে নীহারিকার এই শান্ত স্থির চোখ পড়তে অক্ষম হয়ে পড়ল। সে কিছুই ধরতে পারল না। খুব কি দূর্বলতা প্রকাশ করছে? না কি আহতের একরাশ ছাপ? আবার মনে হচ্ছে মনে মনে খুব করে কিছু জিনিস এলোমলো করে মিলাতে চাইছে। পাজেলের মত। তাযিন দৃষ্টি নিবন্ধিত রেখেই মনে মনে আওড়ালো,
‘ মানুষের ঠোঁট মিথ্যার একটা ফোঁয়ারা হয়।
কিন্তু চক্ষু বড্ড বেশি সৎ।
এই চোখ মিথ্যা শিখেনি।
বলতেও পারে না।
আপনি কেন চোখ পড়তে পারেন না?’
দীর্ঘশ্বাসে বুক যখন ভারী হয়ে আসতে শুরু করল জাওয়াদ নামক আর এক অসহ্য প্রানী এসে হাজির হলো নীহারিকার পায়ের সন্নিকটে। উত্তেজিত চিন্তিত কন্ঠেস্বরে সে বলে উঠে,’ কি হয়েছে তোমার? পায়ে কিভাবে লেগেছে?’
নীহারিকার আড়ষ্ট ভাব দেখে সে নিজেকে শুধরে নিয়ে বলল,’ কি হয়েছে আপনার? আপনি করেই ডাকব। তবুও বলুন কি হয়েছে?’
নীহারিকা ম্লান সুরে বলল,’ বেশি কিছু নয়। সামান্য ব্যথা। আমি পড়ে গিয়েছিলাম।’
জাওয়াদকে পাগলের মত দেখাল। সে হুমড়ি খেয়ে পড়ল পায়ের কাছে। সাদা পা জোড়ার দিকে হাত বাড়িতে যাবে দ্রুত তা সরিয়ে নিল নীহারিকা। তার এহেন কান্ডে জাওয়াদ হাসল একটু। তারপর বলল,’ আমি তো ডাক্তার। ডাক্তার ভেবেই ধরব। অন্য কিছু নয়।’
তবুও নীহারিকা দিল না। আফিয়া বিলকিস গরম পানি নিয়ে হাজির। তিনি বেশ বকাঝকা করছে। জাওয়াদকে দেখে দ্রুত জামার ওড়না ঠিক করে নিয়ে বলল,’ আসলে জাওয়াদ বুঝতে পারছি না পায়ে কি হয়েছে। বলছেও না। তাই ভাবলাম পানির ছেক দিব।’
জাওয়াদ হাত চুবিয়ে কাপড় ভিজাতে ভিজাতে বলল,’এটি খুবই ভাল আন্টি। আপনার মেয়ে পড়ে গিয়েছে কিছুর উপরে। মনে হচ্ছে কাঠ হবে। তাই এমন ব্যথা পেয়েছে সে।’
নীহারিকা রাগী চোখে তাকাল। মা চোখ রাঙানী দিয়ে পা টেনে ধরল সোজা করে। কালসেটে দাগ দেখেই তিনি আর্তনাদ করে উঠে বললেন,’ নীহু তুই আজকে আমার হাত থেকে থাপ্পড় খাবি। অসভ্য মেয়ে। এত লেগেছে কিভাবে?’
নীহারিকা ভাবল সত্যি খাবে। কিন্তু আফিয়া দিল না। মুখটা বুকের মাঝে নিয়ে বলল,’ তুই সত্যি খুব অসভ্য হয়ে পড়ছিস দিনকে দিন। কোথায় ছিলি তুই? ‘
‘ মা প্লিজ চুপ করবা। সবাই তাকিয়ে আছে।’
আফিয়া দেখল জাওয়াদ মুখ টিপে হাসছে। ছেলেটা এত সুন্দর বলার বাহিরে। তার তো খুব পছন্দ। শুধু মেয়েটা বড্ড বাঁকা। বাপের মত হইলে যা হয়। তিনি আর কিছু বললেন না। তবে চুপিচুপি নীহারিকাকে খুব বোকলেন। মা জাতি বকেও বেশি। ভালোবাসা প্রকাশ করেও বেশি। জাওয়াদ যত্নের সাথে পা দেখল। সে যেন এই পা ছুঁতে পেরে আকাশেবাতাসে আনন্দিত। পা গরম পানি দিয়ে পরিষ্কার করে মুছে দিল। নিচের পাতা দেখে আঁতকে উঠা গলায় বলল,’ আপনার পায়ে তো কিছু ঢুকেছে? লোহার কিছু।’
নীহারিকা উবু হয়ে দেখল সত্যি তো! নীহারিকার আশেপাশে ভীর জমে গেল। নানু ইচ্ছামত বকাঝকা করতে শুরু করলেন। মামা ছুটাছুটি করে ঔষুধ নিয়ে আসল। একটা হট্টগোল শুরু হলো। এই সবে একদম শান্ত তাযিন। তার সব মনোযোগ বইয়ের পাতায়। যেন এই পরীক্ষা বাঁচামরার। তার কোন ভাবান্তর হলো না। সবচেয়ে চিন্তিত বিচলিত মানুষটি হচ্ছে মিতু আপু। তিনি প্রায় কেঁদেই দিবেন ভাব। জাওয়াদ পায়ে ব্যান্ডেজ করতে করতে বলল,’ আপনার পা জোড়া তো দারুন সুন্দর।’
এইবার চোখ উপরে তুলে তাকাল তাযিন। তার সূক্ষ্ম দৃষ্টি এই দৃশ্য এড়িয়ে যেতে পারল না। সবাই হো হো করে হাসল। কারণ নীহারিকাকে ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে। পায়ের একটু তারিফ করে তাকে বিভ্রান্ত করেছে। নীহারিকা বুঝতে পারল না তার পায়ে এত বড় ক্ষত হলো আর সে টেরই পেলনা। কিভাবে? মনে পড়ে সে তো শুধু তাযিনকে পর্যবেক্ষণ করে সময় পার করে দিয়েছে। কি পাগল সে? রাগে দুঃখে তার এখন ইচ্ছে করছে ক্ষতস্থান চেপে ধরতে। জাওয়াদ রসিকতা ছেড়ে সিরিয়াস ভাব নিয়ে বলল,’ আমি মোটেও মজা করছি না নীহারিকা। সত্যি আপনার পা জোড়া অসম্ভব সৌন্দর্যে মন্ডিত।’
ঠাস করে কাঁচের কাপটা ভেঙ্গে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে পড়ল নিচে। তাযিন এখনো শান্ত হয়ে বসে আছে। তার হাত থেকে যে পড়েছে তাতে তার বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। সে নির্বিকার। সবাই যখন এদিক সেদিক মনোযোগী হয়ে উঠল। সে তখন প্রচন্ড আক্রোশ নিয়ে নীহারিকার দিকে চেয়ে রইল। নীহারিকা একটু ভীতু হলো। টকটকে চোখজোড়া!
_______________

#চলবে…………
@হাফসা আলম……………..