প্রিয় সুখ পর্ব-১৪

0
5

প্রিয় সুখ-১৪
__________________
রাত দশটা ছুঁই ছুঁই। এই সময়ে গ্রাম অর্ধ নিদ্রায় ডুবে রয়েছে। তাদের কাছে এই সময়টা গভীর ঘুমের দেশ হাতড়ানোর সময়। সবাই খাওয়া দাওয়া করে ঘুমাতে পা বাড়াল। নানু আটটা বাজেই কুপোকাত। মিতু আপু আর ফাবিহা খুব সাবধানে নীহারিকাকে উপরে তুলছে। সে বার বার বলছে সে হাঁটতে পারছে। কেউ কোথায় শুনলো না। ছাদের উপরের গাঢ় হলুদ চকচকে আলোর ঝলক যখন চোখে পড়ল সাথে সাথে চোখ মুখ কুঁচকে নিয়ে সে বিরক্তি কন্ঠে বলল,’ ছাদে কি করছি আমরা?’
মিতু আপুর গাল ভর্তি হাসি। নিঃসন্দেহেই তিনি দারুন হাসেন। তার এই হাসি দেখতে সব সময় ভালো লাগলেও এই মুহূর্তে লাগছে না। সে অসাড় হয়ে আসা কন্ঠে বলল,’ আপু ঘুম আসছে। চল ঘুমাই।’
মিতু আপু ছাদের মাঝে নিয়ে এসে দাঁড়ায়। নীহারিকা অবাক হয়ে দেখে পাটি বিছানো ছাদের মাঝে। বেশ দারুন একটা পরিবেশ। মনে হচ্ছে খেলার জন্য তৈরি। অথবা আড্ডা। নীহারিটা ভ্রুকুঁটি করে। এভাবে তাকাতে দেখে মিতু আপু মুখ বাঁকা করে বলল,’ ভ্রু কি তোর বাঁকা হইয়া গেছে?’
‘ না হয়নি। এসব কি আপু? তোরা আজ না ঘুমানোর প্ল্যান করেছিস? ‘
‘ একরকম তাই। চল বস। ‘
নীহারিকা বসল। শব্দ তুলে পায়ের ধ্বনি বেজে উঠল। একে একে উঠে আসল বাকিরা। তাযিন বাদে সবাই হাজির। জাওয়াদকে দেখে নীহারিকা একটু বিরক্ত হয়েছে। সে মুখটা অন্যদিকে রেখে বসে রইল। জাওয়াদ বসল মুখোমুখি। তারা লুডু খেলবে। নীহারিকা খেলবে না বলেছিল। মিতু আপু জেতে বসিয়ে দিল। না পারতে সে খেলতে বসল। দু’টি ঘর দুই পাটিতে। চারজোড়া খেলবে। মোট আটজন। এদের মাঝে চারজন প্রথম রাউন্ডে বাদ। পরের রাউন্ড থেকে জিতে যাবে দুইজন। এভাবে খেলা এগিয়ে যাবে। তিশা বেশ খোশ মেজাজে বলল,’ ওয়াও সত্যি আমার খুব এক্সাইটেড লাগছে। ‘
অর্পন আগেই দু’হাত উপরে তুলে বলে দিল সে খেলছে না। মুহিত লুডু খেলেনা। এই খেলা তার ভাল লাগে না। তার মতে লুডু খেললে পিছন থেকে কাঁটতে হয়। সে পিছন থেকে আঘাত করে না। তাই খেলবে না। সবাই যখন গোল হয়ে বসল। তখন সবাইকে অবাক করে দিয়ে তাযিন আর রূবাইদা হাজির। বেশ খুশিতেই ছিল নীহারিকা। তাযিনকে দেখে মুখটা পানসে হয়ে গেল। সে নাকটা কিঞ্চিত উঁচিয়ে নিল। রূবাইদা ঘরটা দেখে ভুত দেখার মত চমকে উঠে বলল,’ এটা কি? এখানে কি হচ্ছে? তোমরা খেলছ?’
মিতু আপু বলল,’ হুম খেলছি। আপনি খেলবেন? ‘
রূবাইদা মুখটা থেবলা করে বলল,’ দুঃখিত আমি খেলতে পারি না।’
মিতু আপু হেসে সান্তনার সুরে বলল,’ সমস্যা নেই পরে দেখিয়ে দিব আপনাকে। অনেক মজার এবং সহজ।’
রূবাইদা অবাক হয়ে তাকাল। নীহারিকা এই প্রথম লক্ষ করল রূবাইদার চোখজোড়া সোনালী। কেমন যেন? তার গায়ের রংটাও অত্যাধিক সুন্দর। চুলগুলো লম্বা সরু বাদামি রঙ্গের, সিল্কি। বাতাসে তুলোর মত উড়ে বেড়াচ্ছে। সে একজন আমেরিকান। তবে ড্রেস পড়েছে বাঙালি নিয়মেই। খুশিতে উৎফুল্ল কন্ঠে সে বলল,’ তুমি তো খুব ভালো মিতু আপু।’
মিতু আপু সাথে সাথে রেগে গেলেন। বললেন,’ আপনার ছোট হই।’
‘ তো কি হয়েছে সবাই তো মিতু আপুই ডাকে। আমিও ডাকবো।’ খুব অসন্তুষ্ট চোখে তাকাল মিতু আপু। অসহ্য দৃষ্টিভঙ্গি তার। তাযিন বেশ ফুরফুরে মেজাজে রয়েছে। মুচকি হাসি তার ঠোঁটে আঁকা। দু’পা গোল করে সে বসে পড়ে। খেলা তাকে বুঝাতে হলো না। সে নিজে থেকেই বুঝদার ভাব নিয়ে বলল,’ আমিও খেলব।’
সাথে সাথে আশ্চর্য হলো সবাই। শান্ত প্রশ্ন করে,’ না না তোর সাথে খেলমু না। তুই হালা ডেঞ্জারাস।’
‘ ক্যান ও তোরে কি করছে? ‘ তিশা গলা উঁচিয়ে বলল। মুহিতা উৎসব কন্ঠে বলে উঠল,’ ওই দোস্ত তুই খেলা শুরু কর। এই বলদের কথা শুনতে যাইবি ক্যান?’
তাযিন, শান্ত, মুহিতা, তিশা একটি দল। অন্যদিকে নীহারিকা, মিতু আপু, ফাবিহা, আর জাওয়াদ। এই খেলায় নীহারিকার প্রিয় গুটি রয়েছে। সে নীল ছাড়া খেলতে চায় না। মিতু আপু এটা নিয়ে খুবই সন্দিহান। তার ধারণা এর জন্যেই নীহারিকা বাজিমাত করে। এবার তিনি সম্পূর্ন গুটির চাল বদলে দিবেন। তাই নিজেই নীলে ভাগ বসালেন। নীহারিকার বিষন্ন চাহনি, ক্লান্ত শরীরে খেলতে চাইছে না। তাই সে বুঝতেই পাড়ল না মিতু আপুর এই কুটিল বুদ্ধি। প্রথম গুটি কাঁটা যাওয়ার পরেই সে নড়েচড়ে বসে। এই জীবনে তার এই খেলায় হারার রেকর্ড খুবই স্বল্প। খেলায় মন দিতে গিয়ে সে হাসল। মিতু আপুটা খুব বাচ্চা স্বভাবের। বোকা একটা। নীল গুটি সুন্দর দেখেই সে এই গুটি দিয়ে খেলে। তাছাড়া কিছু না।
নীহারিকা একে একে যখন গুটি কাটা শুরু করল মিতু আপু তখন চিৎকার করে বলল,’ তুই এত নির্দয় পাষাণ কিভাবে হতে পারিস? একটুও কি তোর দয়া মায়া হয় না? আল্লাহ বিচার করবে।’
তিনি প্রায় কেঁদেই দিচ্ছে। নীহারিকা মিটমিটে হাসছে। সে জানে একটা পর্যায়ে মিতু আপু কেঁদেই দিবে। এটা সব সময় হয়। তবুও যে কেন খেলতে আসে কে জানে। জাওয়াদ তাজ্জব হয়ে রইল। এমন ডেঞ্জারাস খেলোয়াড় সে আগে দেখি। সে যখন যা চাইছে তাই যেন পেয়ে যাচ্ছে। আশ্চর্য তো! এই গুটিও কি নীহারিকার প্রেমে পড়ে গিয়েছে? ভয়ংকর প্রেম!
তাযিনের সাথে মুহিতার ভালো টক্কর। শান্ত অনেক আগেই শেষ। মনটা বিষন্ন করে সে যখন মুহিতের পাশে বসল সে তখন হু হা করে হাসতে শুরু করল। তারপর বলল,’ আমি তো জানতামই এমন হইব। তাই তো কইলাম আমি খেলতেই পছন্দ করি না। প্রকৃত অর্থে আমি একদিন খেলেছিলাম তাযিন্নার সাথে। এমন হারা হারছি। নাউজুবিল্লাহ।’
তার মুখটা খুব দুঃখি দেখাল। শান্তর ভালো লাগছে। জঘন্য ভাবে শুধু সে না। আরও কেউও হেরেছে।
মুহিতা আর তাযিন খেলবে পরের রাউন্ডে। আর মিতু আপুকে কাঁদিয়ে নীহারিকা আর জাওয়াদ টিকে রইল। যদিও জাওয়াদ নীহারিকার কাছে একবার হেরেছে। এতে তার মাঝে বিন্দুমাত্র আফসোস প্রকাশ পাচ্ছে না। তাযিন যখন নীহারিকার সামনে বসল বেশ রেগে তাকাল নীহারিকা। এর সাথে সে খেলবে না। উঠে যেতে নিবে মিতু আপু ভাঙ্গা গলায় বলল,’ উঠতাছস ক্যান? সারা জীবন তো আমারে হারাইলি। এখন নিজের হারার সময় আসতেই উঠ্ঠা যাইতাছস? ‘
ভ্রু জোড়া কুঁচকে তাচ্ছ্যিলের হাসি হাসল। এই ছেলের সাথে সে হারবে? তার রেকর্ড আছে। ভাঙ্গা এত সহজ না। খুব হাস্যকর কন্ঠে সে বলল,’ কে হারাবে আমাকে? উনি? হাউ ফানি। ‘
‘ ফানি টানি কিছু না। ওরে হারা তারপর কথা বলতে আসবি।’
‘ মিতু আপু খেলতে ইচ্ছে করছে না। ঘুম আসছে।’
বেশ আহ্লাদি কন্ঠে বলল। মিতু আপু স্ট্রেট হয়ে বসে রইল। ফাবিহা বলল,’ নীহু ভয় পাইস না। আমি জানি তুই এরেও হারাই দিবি।’
নীহারিকা বিরক্ত হয়ে বলল,’ আমি মোটেও হারার ভয় পাচ্ছি না ফাবিহা।’
বলেই সে বসে পড়ল। একটা কটকটে দৃষ্টি নিয়ে সে তাকাল তাযিনের দিকে। তাযিনের ডান পাশের ঠোঁট জোড়া আরও হেলে পড়ে বেঁকে বসে। জাওয়াদ নিঃসন্দেহে খুব ভালো খেলোয়ার। কিন্তু সে খেলে কম নীহারিকাকে দেখে বেশি। তাযিনের পাশে খুব উত্তেজিত হয়ে বসে পড়ে রূবাইদা। সে খুবই আনন্দিত। তার ফিয়ন্সে যে কত বেষ্ট, ভাবতেই বুকটা ফুলে ফুলে উঠছে। এই খেলায় সবচেয়ে বেশি কাঁটা পড়ল নীহারিকার গুটি। কিন্তু খুবই আশ্চর্যের বিষয় তবুও সে হারছে না। প্রথমে গেল মুহিতা। নীহারিকা জাওয়াদকে হারাতে হলো না। তাযিন পর পর সব গুটি নিঁখুত ভাবে কেঁটে দিল। ভারী অবাক হয়ে জাওয়াদ বলল,’ কি ভাই তোমার সাথে মনে হচ্ছে আমার জন্ম থেকে শত্রুতা। এমন ভয়ংকর নির্মম ভাবে কেউ হারায়? আই ডোন্ট বিলিভ ইট। সিরিয়াসলি?’
তাযিন এমন ভাবে তাকাল যেন আরও ভয়ংকর ভাবে হারাতে পারলে সে একটু খুশি অবশ্য হত। খেলার মাঝে টান টান উত্তেজনা শুরু হতেই অর্পন উঠে আসল। এসবে সে মোটেও ভাউ দেয় না। কিন্তু এই মুহূর্তে সে খুবই এক্সাইটেড ফিল করছে। মনে হচ্ছে না দেখলে অনেক কিছু মিস। নীহারিকা অদ্ভুত ভাবে ঘামছে। তার মাথার ওড়নার দু’পাশ কপালের ঘামে ভিজে উঠেছে। গরমে তার মুখ চোখ লাল হয়ে উঠছে। নিঃশ্বাস একদম এলোমেলো। তার হঠাৎ ভয় করছে। মনে হচ্ছে সে হারবে। মনে প্রানে সে চাইছে জিতে যেতে। কখনো নীহারিকা এমন অদ্ভুত অনুভূতির শিকার হয়নি। আজ হচ্ছে। কি আশ্চর্য! সে জানে হারার সবচেয়ে মূল উপকরণ হচ্ছে ভীতি। যে ভীতু হয়ে পড়ে সেই সব সময় হারে। তাযিনের প্রয়োজন মাত্র এক। নীহারিকা এখনও ঘুরছে। আড়াআড়ি চোখে সে একবার নীহারিকার দিকে তাকাল। হলুদ লাইটের সোনালী আলোতে তার চোখ মুখের ঘামের পানি চিকচিক করে উঠছে। টেনশনে তার চোখের পাতা বারংবার উঠানামা করছে। নিচের দিকে তাকিয়ে তাযিন হাসল। তার এই হাসির পূর্ন অর্থ খুঁজে পেলনা কেউই। নীহারিকার যখন পাঁচ সংখ্যা দিয়ে গুটিটি মূল ঘরে প্রবেশ করাল, তখন সে যে আনন্দ এই জীবনে প্রকাশ করেনি তা সে প্রকাশিত করে বসল। চিৎকার করে উঠল সে। তাযিনের দিকে খুবই দুঃখি ভঙ্গীতে তাকিয়ে বলল,’ আহারে বেঁচারা ভায়া।’
তারপর ওড়নাটা ঠিক করে নিয়ে হাত দিয়ে নিজের গালে বাতাস প্রদান করল কিছু সময়। সবাই কিছু সময় স্তব্ধ হয়ে রইল। মিতু আপু দারুন বিরক্ত হয়ে বলল,’ ভাইয়া আপনাকে আমি খুবই চতুর ভেবেছিলাম। আপনিও ওরে হারাতে পারলেন না?’
‘ হেরে যে জিতে যেতে পারে সেই প্রকৃত বাজিগার। সব সময় জিতে মজা নেই। মাঝে মাঝে হারা উঁচিৎ।’
আড়চোখে তাকাল তাযিন। চোখে মুখে এক অদৃশ্য সৌন্দর্য্য সে অনুভব করতে পারছে। মেয়েটা এত অল্পতে খুশি হয় সে আগে জানত না। প্রকৃত অর্থে সে এই মেয়েকে এখনো বুঝে উঠতে পারেনি। আরও বুঝার প্রয়োজন রয়েছে। এর মাঝে মারাত্নক অদ্ভুত কিছু তো একটা আছে। যা মুহূর্তে অন্যের জীবন উলটপালট করে দিচ্ছে।

নীহারিকা গ্রিলের কাছে এসে দাঁড়াল। ঠান্ডা মোলায়ন বাতাস বইছে। হাওয়ার বেগে ছুটে এসে তার মুখে কপালে লেপ্টে মিশে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ আগে সে প্রচন্ড ঘাম ছিল। তাই ঠান্ডাটা এখন ভালোই লাগছে। কোনের দিকে দাঁড়িয়ে সে যখন বাতাসে মগ্ন পাশে এসে কেউ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে পড়ে। কিছু সময় পরেই চমকে উঠে নীহারিকা। জাওয়াদকে দেখেই সে পাশ কেঁটে যেতে চায়। জাওয়াদ পথ আটকে দিয়ে বলল,’ আমাকে দেখে কি আপনার বখাটে ছেলে মনে হয়?’
নীহারিকা সোজা গলায় বলল,’ তা কেন মনে হবে?’
‘ এই যে কেমন করে যেন তাকান।’
‘ কেমন করে তাকাই?’
‘ দাঁড়ান বলছি। সোজা হয়ে দাঁড়ান।’
‘ পারব না।’
নীহারিকা বড্ড ত্যাড়া প্রকৃতির মেয়ে। জাওয়াদ বুঝতে পারে। তবুও বারে বারে এই মেয়েকে তার ভালো লাগে। হাতটা নীহারিকার সামনে রেখেই সে বলল,’ ঠিক আছে এভাবে থাকুন। এবার বলি। আপনি চোখটাকে ছোট করে বাঁকা ত্যাড়া করে আমার দিকে তাকান। এভাবে মেয়েরা বখাটে ছেলেদের দিকেই তাকায়। আপনি প্রমান করতে চাইছেন আমি বখাটে। শান্তর ভাষায় বখাইট্টা।’
নীহারিকার হাসি পেয়ে বসল। সে হাসতে শুরু করল। সেই হাসি অপূর্ব নয়ন ডুবিয়ে দেখতে লাগল জাওয়াদ। মেয়েটার কথা বলার ধরণ সুন্দর। হাসি সুন্দর। চোখ সুন্দর। কি সুন্দর নয় এর মাঝে? একটা মানুষ এত সুন্দর কি করে হতে পারে? সে তো আরও হাজারো সুন্দরীকে দেখেছে। কই তখন তো এত সুন্দর মনে হয়নি। ইদানিং জাওয়াদ নিজের মাঝে পরিবর্তন লক্ষ করে। অদ্ভুত পরিবর্তন। যেমন সে ঘুমাতে পারে না। একা বসে থাকতে পারে না। সব সময় চোখ শুধু তাকেই দেখতে চায়। তাহলে কি সত্যি সে প্রেমে পড়েছে? নীহারিকা নামক অসুখে আক্রান্ত হচ্ছে!
‘ আমি এমন কিছুই মনে করি না। শুধু ভালো লাগে না তাই ইগনোর করি।’
‘ তাহলে আপনি শিকার করছেন যে আপনি আমাকে ইগনোর করেন?’
নীহারিকা একটু ইতস্তত বোধ করে। জাওয়াদ বেশ রেগে যাওয়ার ভাব করে বলল,’ আমি এই মুহূর্তে এখান থেকে লাফ দিব। বেশি না হাত পা ভাঙ্গবে। আপনার কাছে ইগনোরের শিকার হওয়ার থেকে এটাই উত্তম। কিছু সময় ব্যথা নিয়ে মেতে থাকতে পারব।’
জাওয়াদ সত্যি লাফাতে নেয়। নীহারিকা প্রচন্ড অস্বস্তি নিয়ে বাহু চেপে ধরে বলল,’ আপনি কি পাগল? সোজা হয়ে দাঁড়ান।’
জাওয়াদ চুলে হাত বুলাতে বুলাতে হাসল। আজ কাল সে ডাক্তারী কম পাগলামী বেশি করছে। নীহারিকা হেসে বলল,’ আমি বাবাকে বলে দিব এই পাগলকে এখানে কেন পাঠিয়েছে উনি।’
‘ আমি চিরকৃতজ্ঞ তার প্রতি। যদিও তিনি পাঠায়নি। আমিই এসেছিলাম। প্রথমে এত বিরক্ত হলাম যে ফিরে চলে যেতে ইচ্ছে করল। কিন্তু আপনাকে দেখে থমকে গেলাম। আমি কি খুব নির্লজ্জ হয়ে পড়ছি?’
‘ খুব বেশিই। এসব আমার পছন্দ নয়। অতি আদিখ্যেতা আমাকে দেখাবেন না।’
‘ আচ্ছা দেখালাম না। আর কী দেখাতে হবে না।’
জাওয়াদ বেশ আগ্রহিত। নীহারিকা সরু চোখে তাকিয়ে বলল,’ ন্যাকামি বন্ধ করুন। অতিরিক্ত কেয়ার ফেয়ার বন্ধ করুন। স্বাভাবিক আচরন করুন। নাটক করবেন না। এসব বিরক্ত লাগে।’
‘ আমি নাটক করি?’ চোখ কটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম জাওয়াদের। নীহারিকা পাত্তাই দিলনা এমন করে বলল,’ হুম করেন। আর অতিরঞ্জিত ব্যাপার গুলো আমার একদম অসহ্য লাগে।’
‘ আপনি ভারী অদ্ভুত মেয়ে নীহারিকা।’
‘ হুম অদ্ভুত। এখন কি অস্কার প্রদান করবেন?’
জাওয়াদ হাসতে লাগল। বলল,’ আমার আপনার অদ্ভুত ভাব পছন্দ খুব।’
‘ আর আমার আপনার অস্বাভাবিক আচরণ একদম অপছন্দ। ‘
‘ এই যে আপনার মুখের উপরে ছুড়ে মারা সত্য কথা গুলো আমার দারুন লাগে।’
নীহারিকা বুঝে এই লোকের মাথার তার ছিড়া। তাই সে ভাল ভাবে বলল,’ রাস্তা ছেড়ে দিলে আমি খুশি হব।’
‘ রাস্তা ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে আমার খুশি লাগছে।’
বিরক্ত চোখে তাকাল নীহারিকা।
‘ আপনাকে আমার কোন এঙ্গেল থেকে ডাক্তার মনে হচ্ছে না।’
জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকে নিয়ে তীক্ষ্ণ কন্ঠে জানতে চাইল,’ কেন?’
‘ কারণ আমার আপনার কথা বার্তা খুবই অদ্ভুত লাগছে।’
‘ আসলে আমি এমন ছিলাম না। দু’দিনে আপনি কি হাল করেছেন দেখুন। বাবা একবার আমাকে দেখলে নিশ্চিত সেন্সলেস হয়ে পড়বে।’
জাওয়াদ হাসছে। এত সুন্দর একটা ছেলে কি না এমন পাগলের মত ব্যবহার করছে। উন্মাদ একটা। নাক মুখ ঝিঁটকে দূরে সরে দাঁড়ায় আরও। জাওয়াদ ভয় দেখানোর জন্য বলল,’ আপনার পিছনে যদি ভুত এসে দাঁড়ায়? ধরেন একটা ভুত সত্যি আপনার পিছনে। অনুভুতি কেমন হবে?’
নীহারিকার মুখের রংটা এক ফোঁটাও পরিবর্তন হলো না। সে পূর্বের নেয় দূরের দিকে তাকিয়ে বলল,’ স্বাভাবিক হবে। কারণ আমি ভুতে বিশ্বাস করি না। জ্বীনকে ভয় পাই না।’
‘ ভারী ইন্টারেস্টিং আপনি।’
‘ সাথে খুব রগচটা। রাগিয়ে দিচ্ছেন আপনি আমাকে।’
‘ রাগলে আপনাকে সবচেয়ে বেশি সুন্দর লাগে।’
‘ আপনি অসুন্দর কিছু দেখেন না । আমার মাঝে?’
নীহারিকার দৃষ্টি সরু। নাকটা উঁচু বেশ। রাগ নাকের ডগায় ঝুলছে যেন। ফিচেল হাসল সে। বলল,’ পছন্দের মানুষের সব ভালো লাগে। আপনি জানেন না?’
‘ আমি যে কারও পছন্দের হতে পারি আমি তো সেটাই জানতাম না। ‘
নীহারিকা হাসছে। তার এই লোকটাকে একটা পাগলা কাক মনে হচ্ছে। অথচ এই লোক বকের মত সুন্দর। ছেলেদের অতি সৌন্দর্য্য নীহারিকার অপছন্দ। জাওয়াদ সেই হাসির সাথে তাল মিলিয়ে হাসল। কিন্তু তার হাসতে ইচ্ছে করছে না। তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে। গভীর আরও একটু গভীর ভাবে।

চোখ ফিরিয়ে নীহারিকা সামনে তাকিয়ে দেখল তাযিন তেজি, জিদ্দি চোখটাকে শান্ত নিরব করে নির্ণিমেষ চেয়ে রয়েছে। তার চোখের দৃষ্টি এতটাই শান্ত যে অন্যের মনকে হয় তো বরফে পরিণত করার মারাত্নক ক্ষমতা রাখে। হাতে তার সিগারেটের শেষ অংশ পুড়ে ছাই। আগুন স্পর্শ করছে তার আঙ্গুলের মাথা। বাতাসে তার মাঝের ঝাকড়া চুলগুলো এলোমেলো হয়ে উড়ছে থেকে থেকে। দু’পাশ ছাটাই করা চুল তার। মাঝে সব চুলের জঙ্গল। বিশাল আকার কপাল। সরু নাক। গভীর চক্ষু। হলুদ আলো এসে যখন তার মুখের উপরে বসে তখন চোখজোড়া ঝলক মেরে উঠে। জ্বল জ্বল করে জ্বলে উঠে স্বচ্ছ চোখ। নীহারিকাকে ছোট চোখে অপলক তাকিয়ে থাকতে দেখে জাওয়াদ পিছনে ঘুরে তাকায়। তাযিনের হাতের সিগারেট তার আঙ্গুলের মাথা জ্বালাতে ব্যস্ত তখন। জাওয়াদ দ্রুত পায়ে হাত থেকে ছুড়ে ফেলে সিগারেট। হেসে বলে উঠে,’ মিস্টার তাযিন হচ্ছে আমার দেখা সবচেয়ে বিচক্ষণ পুরুষ। সে কি না সিগারেটে হাত পুড়িয়ে ফেলছে? দিনকাল কি খুব খারাপ হয়ে পড়ল না কি?’
তাযিন চোখ একবার বুজে নিয়ে বলল,’ না। আমার দিনকাল কখনো খারাপ থাকে না। নিজেকে খারাপ রাখতে আমি শিখিনি।’
‘ তা তো জানি। আচ্ছা তুমি তো সিলেট শিফট করেছ। কেমন চলছে কাজ? আর তোমার তো পরীক্ষা? ‘
‘ আমি ঢাকা ব্যাক করছি। হুম পরীক্ষা আছে।’
তাদের মাঝে কিছু কথা হয় আলাদা ধরণের। নীহারিকা সুযোগ বুঝে পাশ কাঁটিয়ে চলে যেতে নেয়। জাওয়াদ ডেকে বসে। বিরক্তিতে মুখ কুঁচকাল সে। ঠোঁট নাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,’ কি হয়েছে?’
‘ আরে তুমি তোমার খালাত ভাইয়ের সম্পর্কে তেমন কিছু জানো না। এসো জানিয়ে দি।’
নীহারিকা তাযিনের দিকে চোখ ঘুরিয়ে বলল,’ আমি তো তাকে ভালো করে চিনিই না। আর অচেনা মানুষ গুলোর প্রতি আমার আগ্রহ খুবই ক্ষুদ্র।’
সে আর দাঁড়াল না। একে বারে সিঁড়িতে এসে থামল। মিতু আপুকে ডাকল। তিনি গ্রামের গল্পে ব্যস্ত। ফাবিহার খবর নেই। সিঁড়ির মাঝে এসে নীহারিকা বুঝতে পারল তার পিছনে কেউ আছে। পিছনে তাকিতেই দেখে তাযিন। পাশ ছেড়ে সে বলল,’ আমার নামতে অসুবিধা হবে এবং সময় লাগবে। আপনি আগে চলে জান।’
তাযিন নিজে থেকেই বলল,’ আমি সাহায্য করব?’
চকিতে নীহারিকা তাকাল। কিছু বলল না। সে নিজে নিজেই নামতে শুরু করল। তাযিন দু’সিঁড়ি দ্রুত নামল। নীহারিকার পাশে দাঁড়িয়ে বলল,’ আপনি আমাকে ভাল করে চিনেন না?’
শীতল কন্ঠে ঝড় ঝড় ভাব। একটা সিগারেট আবার ধরায় সে। নীহারিকা খুব অস্থিরতা যুক্ত কন্ঠে বলল,’ সিগারেট মৃত্যুর কারণ। আপনি জানেন না? জীবনের চেয়ে সিগারেট গুরুত্বপূর্ণ?’
‘ আপনি হয় তো ভুলে গিয়েছেন আমি বিদেশি। বিদেশেই বড় হয়ে উঠা।’
‘ তো কি হয়েছে? এতে কি আপনি মহান কোন কাজ করে ফেলেছেন?’
তাযিন ঈষৎ হাসল। বলল,’ আমি কিন্তু মদের বোতলও শেষ করেছি অনেক।’
নাক ছিটকে নীহারিকা উপরের সিঁড়িতে উঠে পড়ে বলল,’ ছিঃ। হারাম এসব আপনি জানেন না?’
‘ হারামকে কয়জনে মানে? আমি তো আরও অবাধ্য। বিদেশি ছেলে। ভদ্র গুন্ডা। প্রেম হারাম। তাই বলে কি মানুষের মন প্রেমে পড়া থেকে বিরত থাকছে?’
‘ আপনি দুরে সরুন তো। ‘
তাযিন সরে গেলনা। উল্টো উপরের সিঁড়িতে উঠে এলো। অদ্ভুত আচরণের বশবর্তি হয়ে সে নীহারিকার দিকে আর একটু চেপে দাঁড়াল। দেয়ালের সাথে ঠেসে চোখ ফাঁটা করে তাকিয়ে রইল নীহারিকা। হচ্ছেটা কি? সে আকাশ থেকে পড়েছে যেন। পড়ে আবার বেঁচে উঠে স্বাভাবিক হয়ে হাঁটছে। এমন কিছু হলে নিঃসন্দেহে সে অবাক হত। কিন্তু এই মুহূর্তে সে আরও অবাক। তাযিন দু’পা এগিয়ে এলো। কাছাকাছি আসতেই নীহারিকা বলল,’ এসব কি? দূরে সরুন।’
‘ আমি যথেষ্ট দূরেই রয়েছি মিস।’
বুকের শব্দের সাথে পেড়ে উঠা কঠিন। এক হাত দূরে দাঁড়িয়ে থেকেও যেন নিয়ন্ত্রণ করছে নীহারিকার হৃদস্পন্দনকে। ক্রমান্বয়ে সেই শব্দ তার মস্তিষ্কে বাড়ি খাচ্ছে। ভারী হচ্ছে শ্বাস নিঃশ্বাস। চোখ বড় করে তাকিয়ে রয়েছে সে। তাযিনের অতিশান্ত চোখ। নীহারিকা নিচু কন্ঠে জানতে চাইল,’ আপনি রেগে আছেন?’
তাযিন এখনো তাকিয়ে। নীহারিকা বলল,’ এত রেগে যাচ্ছেন কেন?’
‘ রাগটা বুঝলেন কিভাবে?’ তাযিনের ভারী কন্ঠস্বর। নীহারিকা এদিক সেদিক চোখ বুলিয়ে বলল,’ আমি বুঝি।’
‘ আর একটু যদি বুঝতেন! ‘
‘ কি বুঝার কথা বলছেন?’
তাযিন শুধলো। রগরগে কন্ঠে বলল,’ আপনি কিভাবে বুঝলেন রেগে যাচ্ছি? আমার গভীর রাগ খুব কম মানুষ বুঝতে পারে।’
‘ আপনি যখন খুব রেগে যান, চোখ তখন অতিমাত্রায় ঠান্ড হয়ে যায়। কিন্তু লালছে ভাব ফুঁটে উঠে আশেপাশে।’
তাযিন কিঞ্চিত হেসে বলল,’ আমাকে লক্ষ্য করেন?’
অস্বস্তিতে কাঁটা হয়ে নীহারিকা জবাবে বলল, না।’
তাযিন পুনরায় বলল,’ আপনি খুব বুদ্ধিমতী।’
নীহারিকার মিহি কন্ঠে জবাব,’ আমার কোন সন্দেহ নেই।’
উপর থেকে রূবাইদার কন্ঠ পাওয়া যাচ্ছে। সে ডাকছে,’ তাযু তুমি কি এখানে আছ? ‘
তাযিন জবাব দিল না। নীহারিকা একবার আড়চোখে তাকিয়ে বুঝল সে বিরক্ত। তাই বেশি ভাব নিয়ে বলল,’ হুম রূবাইদা আপু। ভাইয়া এখানেই আছে।’
তাযিন তাকাল। রুক্ষ কন্ঠে বলল,’ আমি আপনার ভাই নই।’
‘ খালাত ভাই তো।’
‘ ভাই ডাকার অধিকার আমি সবাইকে দিনা।’
‘ এত বড় ছেলেকে নাম ধরে ডাকব?’
‘ আপনি আমার সামনে থেকে সরুন।’
ঝাঁঝাল কন্ঠ তাযিনের। অবাক হয়ে গেল নীহারিকা। তারপর রেগে হনহনিয়ে হাঁটতে যায় সে। পড়ে যেতে নেয়। ফাবিহা কথা থেকে যেন আসে। তার হাতে বক্স। মুখ খুশিতে চকচকে। নীহারিকাকে পড়তে দেখে বলল,’ ওই লুলা আমারে ধর।’
চোখ রাঙ্গীয়ে নীহারিকা বলল,’ লুলা বলবি না থাপড়ামু।’
‘ তোর বড় হই। সম্মান কর হারামি।’
জাওয়াদ উপর থেকে গলা ঝারে,’ আপনি কি আবার ব্যথা পেয়েছন? খুব কেয়ারলেস তো আপনি।’
সবাইকে রেখে আগে যায়গা ত্যাগ করল তাযিন। এক গোলা আগুন মনে হলো তাকে।
__________________
মিতু আপুর পাশের বালিশে ঝপ করে পড়ে ফাবিহা। নীহারিকা অপর পাশে। দু’জনেরই মিতু আপু চাই। নীহারিকা আর ফাবিহা পিঠাপিঠি। মানে একবছরের ছোট বড়। তাই দু’জনেরই ছোট বেলায় বেশি ঝগড়া হত। তাই মিতু আপু মাঝে বর্ডারের দায়িত্ব পালন করত। এখনও করছে। যদিও নীহারিকা এখন মোটেও ঝগড়া করে না। ফাবিহা মুচকি মুচকি হাসছে। তার হাতে কাগজ। মিতু আপু কপাল কুঁচকালেন। উঠে একটু উঁকি ঝুঁকি দিলেন। নীহারিকার ঘুম তখন আসি আসি। ফাবিহা কাগজের ভাজ খুলে। মিতু আপু নীহারিকাকে ডাকে ফিসফিস করে। সেও উঠে বসে কাত হয়ে। ফাবিহা চিঠি খুলে। তাতে লেখা,
শ্যামকন্যা,
আমি হাজার সুন্দরীর ভিরে বড় হয়ে উঠা ছেলে। এত সাদা রূপের মাঝে আমি কখনো হারিয়ে যাইনি। নিজেকে সহজেই আমি ধরে রাখতে পেরেছি। আজ কি যেন হলো। আমি হারিয়ে গেলাম। আপনি যে কত সুন্দর তা আমি আপনার চোখের মাঝে ডুব না দিতে পারলে জানতে পারতাম না। এমন ভয়াবহ আকারের সুন্দর ডাগর চোখ আমি আগে কখনো দেখিনি। সেই চোখের সুশ্রী ভাষা আমাকে কাবু করছে। আমি কি উল্টোপাল্টা বলছি? আসলে আমি ওতো লিখতে পারি না। বলতেও পারি না। খুব সহজ ভাষায় আমি নিজেকে উপস্থাপন করতে অবশ্য পারি। এই যে সন্ধ্যায় আমি আশ্চর্য হয়ে আপনার চোখ দেখছিলাম। আপনি কি টের পেয়েছিলেন? কেন পেলেন না? আপনি কখন উঠে গেলেন? আমি তো টেরই পেলাম না। মনে হলো আপনি এখনো আমার চোখের সামনে। আমার মনে হচ্ছে কয়েকঘন্টার ব্যবধানে আমার দুনিয়া ঘুরে গেল। আমি বুঝতে পারছি না কোন এঙ্গেলে ঘুরছি আমি। তবে ঘুরছি তা বলতে পারব। আমি পেশায় একজন ইংরেজি শিক্ষক। ইংরেজিতে বুঝিয়ে বলার অসম্ভব ক্ষমতা আমার রয়েছে। যদিও আমি বাংলায় লিখেছি। কিন্তু আমি বুঝিয়ে বলতে পারছি না। আমার মন ভালো নেই। বুঝতে পারছি না কেন। হঠাৎ করে কিছু বুঝতে না পারার কারণ কি আপনি জানেন? যদি জেনে থাকেন তাহলে বলুন। আমি বরাবরই অশান্ত। কিন্তু আমার মন বড়ো শান্ত ছিল। আজ কেমন যেন হয়ে গিয়েছে। আপনি কি আমার মন ভালো করে দিতে পারবেন? ফালতু হলেও আমি বুঝতে পারছি না কেন যেন আমার মনে হচ্ছে এই অশান্ত মনকে আপনিই শান্ত করতে পারবেন। আপনার চুল গুলো সম্পর্কে বলা হলো না। বেশি দেখিনি তো তাই। তবে লুকিয়ে দেখেছি। অন্যায় করেছি তাই না? দুঃখিত। তবে আমি আপনার চুলের উঁচুনিচু ঢেউয়ের উপরে ভাসতে থাকা রোদের মতই নিজেকে মনে করছি। কেন বলবেন? আপনি বরং সব কিছু ফেলে মন ভালো করার ধান্ধা খুঁজুন। প্লিজ।
ইতি অশান্ত মনের শান্ত।
ফাবিহা লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসল। বুকের শব্দ বাড়ছে। তারও হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। কেউ এত সুন্দর করে চিঠিতে মন ভাল করার আকুল আবেদন করতে পারে? তার আগে জানা ছিল না। তার ভাল লাগছে। নিচের ঠোঁট কামড়ে সে চিঠি বুকের উপরে দু’হাতে ঢেকে রাখে। বুকের শব্দে চিঠি মিশে যেন একাকার। চোখ রাখে উপরে। সিলিং ফ্যানটা ঘুরঘুর করছে। ঠিক তার মনের মত। মাতাল হাওয়া ছুটে আসছে। কোন দিক দিয়ে আসছে বুঝতে পারছে না। হায় আল্লাহ তার তো শান্তর মত বুঝতে না পারার রোগ হয়েছে। এত মহা ভয়ংকর ব্যাপার!
চোখ ঘুরিয়ে পাশে তাকিয়ে ধরফরিয়ে উঠে সে। লাফিয়ে বিছানার উপরে বসে সে মুখটা কাঁচুমাচু করে নেয়। চোখ টিপটিপ করে জোড় পূর্বক হাসার চেষ্টা করে বলল,’ আপু তুই ঘুমাস নি?’
ফাবিহা অবাক। সে ভেবেছিল দু’জনেই ঘুম। চিঠি পড়তে তার অবশ্যই আলোর প্রয়োজন। যেহেতু তারা ঘুমে ছিল তাই সে চিঠি নিয়ে বসেছিল। এত মগ্ন ছিল যে সে বুঝতেই পারেনি মিতু আপু দেখছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। নীহারিকার জহুরী নজর। চমকে উঠে ফাবিহা বলল,’ নীহু তুইও জীবিত?’
‘ আমি মরলাম কবে? ‘ বাঁকা ঠোঁটে বলল নীহারিকা। মিতু আপু আগুন। চোখে লাভা যেন উপচে পড়ছে। ফাবিহা সাহস নিয়ে বলল,’ মিতু আপু তোর কি হয়েছে?’
মিতু আপু কিছু বলল না। শুধু আগুন চোখে তাকিয়ে রইল। নীহারিকা বুঝল মহল মহা গরম। সে বলল,’ আপু এখন ঘুম আসছে। সকালে কথা বলব এসব নিয়ে। ঘুমা তুই।’
মিতু আপু ঝাঁঝাল কন্ঠে বলল,’ ওই শান্তর সাথে তোর দেখাই হলো মাত্র। এখনই প্রেম করছিস? ‘
‘ প্রেম কোথায় করলাম?’ ফাবিহা নাকচ করে বলল। নীহারিকা থামাতে চাইল। কিছুই হলো না। ওই বারের চিঠি আপু গিলেছিল মানুষের নাম ছিল না বলেই। কিন্তু এই শান্তকে তো আপু চিনেই। সাড়ে নয় পুরাই সর্বনাশ। দু বোনের খুব ঝগড়া হয়। মিতু আপু একটা সময় চিঠি ছিড়ে টকরো টকরো করে ফ্লোরে ছুড়ে মারে। ফাবিহা রেগে এবার বলল,’ আপু তুই এটা কেন করলি? আমি তো বলেছিই আর কথা বলব না। তবুও তুই ছিড়ে কেন ফেললি?’
‘ বেশ করেছি। তোকে কত বলেছি প্রেমের চক্করে পড়বি না। এসব ভালো না। ওই ছেলে তোকে ঠকাবে। আমি নিশ্চিত। বুঝে শুনে কেউ ফাঁসে বল? ’
ফাবিহার মাথা ঠিক রইল না। সে খুব খারাপ ভাবে বলল,’ দেখ আপু তোর সাথে যা হয়েছে তা সবার সাথে হবে এমন তো নয়। আর সব কিছুর একটা সীমা থাকে। আমার আলাদা ইচ্ছে রয়েছে। তুই সব কিছু চাপিয়ে দিবি না। আমি তোর চাকর নই। যে তোর সব কথা শুনব।’
ফাবিহা রেগে বেরিয়ে গেল। মিতু আপু কিছু সময় তাকিয়ে থেকে বললেন,’ মেয়েটা বোকা। না রে নীহু? ‘
নীহারিকা কিছু বলল না। সে জানে মিতু আপু খুবই আহত হয়েছে। কিন্তু তিনি তা প্রকাশ করবেন না। এখন ঘুমিয়ে পড়বে। এমন অভিনয় কেউ ধরতেই পারবে না। মনে হবে তিনি অতল সাগরে তলিয়ে ঘুমাচ্ছে। আসলে সে ঘুমাবে না। জেগে জেগে পুরনো কথা ভাববে। মিতু আপু সত্যি খুব কষ্টে রয়েছে। তার জন্য কিছু একটা করা উঁচিৎ।
______________
রাত নিঝুম। ফাবিহা বসে রয়েছে বাড়ির বারান্দায়। খুব মন খারাপ লাগছে তার। মিতু আপু কি কষ্ট পেয়েছে? অবশ্যই পাওয়ার কথা। পাশে কারও অবয়ব দেখে ভয় পেয়ে উঠে ফাবিহা। চিৎকার করতেই যাচ্ছিল সে, মুখ চেপে ধরে শান্ত। ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,’ আমি অশান্ত।’
ফাবিহা চোখ উল্টে দেখে। রাগ বাড়ে শতগুন। এই ছেলেটার জন্য আজ অনেক বছর পরে মিতু আপুর সাথে সে খারাপ ব্যবহার করেছে। ঝগড়া সব সময় হলেও খারাপ ব্যবহার কখনো করে না সে। হাতটা সরিয়ে রাগী দৃষ্টি ছড়িয়ে দিয়ে বলল,’ আপনি এখানে কি করছেন?’
শান্ত চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল,’ আমি ভেবেছি আপনি মন ভালো করার ঔষুধ তৈরি করে ফেলেছেন। আমাকে দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন।’
‘ দেখুন আপনার জন্য আমার কাছে কোন ঔষুধ নেই। সো এসব কথা আমাকে শুনাবেন না।’
‘ তাহলে চিঠি ফিরিয়ে দিন। অন্য কারো থেকে চেয়ে নিব।’
রাগে শরীর জ্বলে উঠে ফাবিহার। বেশ উঁচু কন্ঠে সে বলল,’আপনি তো আচ্ছা অসভ্য।’
‘ কেন জানতেন না বুঝি?’
শান্ত ডান চোখটা টিপ মারে। ফাবিহা ভড়কে যায়। নিজেকে সামলে নিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে। কঠিন গলায় বলে,’ চিঠি নেই।’
‘ খেয়ে ফেলেছেন? কাগজ আপনার প্রিয়? আগে জানলে চকলেট না দিয়ে কাগজই দিতাম।’
ফাবিহা কিছু বলল না। শান্ত অনেক কথা বলল। উত্তর দিল না। তার মন খারাপ। খুব খারাপ। মিতু আপুকে স্যরি বলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু ইগো ঢুকে পড়ছে। তাই সে চুপ করে বসে রইল। শান্ত একটা সময় হাতে হাত রাখল। অনেক্ষণ ডাকছিল। শুনছিল না দেখেই এই হাতের স্পর্শ। কেঁপে উঠে ফাবিহা। দ্রুত হাত সরিয়ে নিয়ে বলল,’ বিদেশি মেয়ে পেয়েছেন না কি? ভুলেও এমন ভাববেন না। হাত কেঁটে রেখে দিব।’
শান্ত বিড়বিড় করে বলল,’ বোন সব গুলাই তো ডাকু। বাপরে।’
‘ বিড়বিড় করছেন কেন?’
‘ আপনি আমার চিঠি রিটার্ন করুন। আমি খুব অসুস্থ হয়ে পড়ছি। দ্রুত চিকিৎসা প্রয়োজন।’ নির্বিকার ভঙ্গীতে বলল শান্ত। তার চোখ চঞ্চল। ফাবিহা যদি একবার তাকাত তাহলে দেখত এই চোখ শ্যামকন্যাকে দেখছে। অসম্ভব গভীর দৃষ্টি তার নিঁখুত চাহনিতে।
‘ আপনার চিঠি নেই। আবার লিখে দিয়েন।’
ভারী অবাক হয়ে শান্ত বলল,’ আমি চিঠি বার বার লিখতে পারি না। অনেক কষ্টে বাংলায় লিখেছি। ইংরেজি আমার মাতৃভাষা। এক ঘন্টা পরিশ্রমের ফল সেই চিঠি। আর আপনি বলছেন সেই চিঠি নেই?’
‘ না নেই।’
‘ তাহলে রোগ ভাল করুন।’
রেগে ফাবিহা বলল,’ আপনার কারণে ঝগড়া হয়েছে আমার মিতু আপুর সাথে। আপনি আমার সাথে আর কথা বলবেন না। একদম না। দূরে থাকবেন। ‘
ফাবিহা উঠে গেল। শান্ত স্তব্ধ। তার জন্য ঝগড়া হওয়ার কারণ সে ধরতে পারল না। কিন্তু বুকে ব্যথা করছে খুব। সে কি দূর্বল হয়ে পড়েছে এই শ্যামকন্যার চক্ষু সাগরের বানে।
_________________
ডানপাশের রুমের উপরের চৌকাঠ ঘুণে খেয়েছে। শামা খালামনি ঠিক করেছে এবার ঘরটা ঠিক করে দিবেন। তাদের তো কম দেয়নি আল্লাহ। মা কেন অনাদরে থাকবে। আর বাড়ি ঠিক করলে তার ভাইটারই লাভ। তাযিনের বাবার সাথে কথা শেষ করে তিনি ঘরে ফিরলেন একটার ও পরে। ঢুকে দেখলেন সবাই ঘুমিয়ে গিয়েছে। শুধু লাইট জ্বলছে। আনজুম ফোনে ব্যস্ত। এরা এত কি দেখে এই ফোনে বুঝেন না তিনি। এই রুমে তিন বোন আর আনজুম ঘুমায়। তিনি ভেতরে প্রবেশ করে আনজুমকে ঝাড়লেন। আনজু তখন ক্ষেপে বলল,’ তোমাদের সব ভালোবাসা শুধু দাভাইয়ের জন্য। আমি তো বানের জলে ভেসে এসেছি। শুধু বকা আর বকা খাওয়ার জন্যেই এই ভেসে আসা।’
সামনে থেকে কেউ বলে উঠল,’ তুই জলে ভেসে নয় ড্রেনের পাশে পড়েছিলি। আমি দয়া করে নিয়ে এসেছিলাম।’
আনজু অভিমানি গলায় ইংরেজিতে বলল,’ ভাইয়া। তুই আবার শুরু করলি? নিজের রুমে যা।’
তাযিন আর জবাব দিল না। সে হেলে দাঁড়াল দরজার সাথে। বড্ড মায়াবী গলায় ডাকল,’ আম্মি তোমাকে আমার প্রয়োজন।’
শামাখালামনি অবাক হলেন। পিছনে ঘুরে ছেলের উশকু-খুশকু চুল, ফ্যাকাসে চেহারা দেখে কিছু সময় তিনি স্তব্ধ হয়ে রইলেন। নিজেকে সামলে বললেন,’ তোমার আমাকে এত রাতে প্রয়োজন হওয়ার কথা নয় বিমুগ্ধ।’
ক্ষীণ কন্ঠে তাযিন বলল,’ আম্মি তুমি এসো প্লিজ।’
‘ এই মুহূর্তে তোমার গার্লফ্রেন্ড বা প্রেমিকা যাই বল তাদের প্রয়োজন। কারণ এত রাতে মায়ের বুকে ঘুমানর ছেলে তুমি নউ বিমুগ্ধ। আমি জানি।’
কথাটা বলে শামা ছেলের নিকটে এসে দাঁড়াল। রক্তাক্ত চোখ দেখে তিনি আঁতকে উঠলেন। ছেলে অসুস্থ!
‘ আম্মি চেষ্টা কর। ইউ ক্যান আন্ডারস্ট্যান্ড মি। ‘
শামা বললেন,’ তুমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসো আব্বিকে। আর বুঝার জন্য বল আমাকে? তোমাকে আমি বুঝি না। এটা তুমি জানোনা? ‘
‘ আম্মি আমার একটা অংশ জর্জড়িত। ‘
আঁতকে উঠা কন্ঠে শামা বললেন,’ তুমি কি আবার পুরনো কথা ভাবছ মাই সান? ‘
অস্থির চোখে তাযিন তাকাল। মায়ের একটা হাতে সে হাত রাখল। সে কম্পিত কন্ঠে মায়ের কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল,’ আমি সব ঝাপসা দেখছি আম্মি। সে আমাকে প্রচন্ড ভাবে জর্জড়িত করে তুলছে। তুমি কি সাহায্য করবে একটু। আহত স্থান সারিয়ে তুলতে? ‘
আর্তনাদ করে উঠে শামা। চিৎকার করে বলে উঠে,’ ও মাই গড। তোমার বডি পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। এত জ্বর? আল্লাহ ।’
ছুটে আসে আনজুম। ভাইয়ের এক হাত ধরতেই সে হতবিহ্বল। তাযিন আর কিছু সময় স্থায়ী হয়ে ধপ করে বিশাল সুঠাম দেহ নিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। তীব্র জ্বরে সে জ্ঞান হারিয়েছে।

মিতু আপু হন্তদন্ত হয়ে ছুঁটে আসল। সাথে আসল ফাহাদ। ফাবিহার ডাকে তিনি নিচে গিয়েছিল। যদিও সে ঠিক করেছিল ফাবিহার সাথে কথা বলবে না। কিন্তু পৃথিবীর একজন মানুষ বাদে সে সবাইকে দ্রুত ক্ষমা করে দিতে পারে। নীহারিকা গভীর ঘুমে আচ্ছাদিত। মিতু আপু যখন ঝাঁকি দিয়ে ডাকল তখন সে দ্রুত উঠে বসল। শরীর কাঁপলে লাগল থরথর করে। মাথা ব্যথা হয়ে উঠল। বুকের শব্দ হতে শুরু করল। এভাবে কেউ জাগিয়ে তুলে? যেই রাগ নিয়ে তাকাবে মিতু আপু বলল,’ তাযিন ভাইয়ের মারাত্নক জ্বর। আমার তো মনে হচ্ছে ভালুজ্বর। এই জ্বরে জ্ঞান থাকে না। উনারও নেই।’
হঠাৎ উত্তেজিত গলায় নীহারিকা বলল,’ কি বলছিস আপু? কটা বাজে এখন?’
‘ ঘড়ি দেখার সময় আছে না কি? দ্রুত নিচে চল। ‘
ওড়না খুঁজে মাথায় পেঁচিয়ে দৌঁড়ে রুম থেকে বের হয় সে। পায়ে প্রচন্ড ব্যথা তার। কিন্তু এখন সেই ব্যথা অনুভবের চেয়ে মনের ব্যথার জোর অনেকখানি বেশি অনুভব করছে সে।
ছোট খালামনির রুমে প্রচুর ভীর। বাড়ি ভর্তি সব মানুষ জমা হয়েছে এই রুমে। কিছু মেহমান আছে তাদের ভীরে। কারণ কাল থেকে মামার বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু হবে ঝাকঝমক ভাবে। কাল তার হলুদ।তাই কিছু মেহমান আগেই এসে হাজির হয়েছে। ভীরের সামনে কি হচ্ছে জানার প্রবল আগ্রহ আর কৌতুহল নিয়ে নীহারিকা মানুষ ঠেলে রুমে প্রবেশ করল। সাথে সাথে তার শরীর অসাড় হয়ে আসল। মানুষটা কতটা অসুস্থ! মুখটা একটু খানিতেই শুকিয়ে গিয়েছে অনেক। জ্বরের তাপে সে বেহুশ। অর্পন অনবরত শরীর পানি দিয়ে মুছে দিচ্ছে। এত সুন্দর একটি শরীরের অধিকারী যে এই পুরুষ অসুস্থ না হলে মিতু আপু বিশ্বাসই করত না। বাপরে যেমন তার তেজ তেমন তার বডি। অর্পন সহ সবাই খুব চিন্তিত। আনজুম বাচ্চাদের মত কাঁদছে। মেয়েটা কি ভাইকে খুব ভালোবাসে? দেখে তো তেমন মনে হয় না। অথচ এখন কিভাবে কাঁদছে। সবাই এটা ওটা এগিয়ে দিচ্ছে। রাসেল মামা ছুঁটে এসে বেশ চিন্তিত সুরে বলল,’ বুবু আমি কি হসপিটালে নেওয়ার ব্যবস্থা করব?’
সবচেয়ে শান্ত শামাখালামনি। তিনি ছেলের পাশে বসে দোয়া পড়ছেন। ফু দিচ্ছেন। আল্লাকে মনে প্রাণে ডাকছেন। আল্লাহ ছাড়া বিপদ থেকে রক্ষার কোন পথ নেই। তিনি খুব শক্ত মহিলা। এত শক্ত মনের মানুষ নীহারিকা আর দেখেনি। সে অসুস্থ হলে তার মা তো আরও অসুস্থ হয়ে পড়ে। শামাখালানি তাযিনের মাথায় জলপট্টি দিচ্ছেন। মুখ বার বার মুছে দিচ্ছেন। কিছুসময় চুপ থেকে তিনি বললেন,’ তার দরকার নেই।’
মামা হতভম্ব হয়ে বললেন,’ কি বলছিস বুবু? এত ভয়ংকর জ্বর আমি কখনো দেখিনি। শরীর কেমন লালছে হয়ে উঠেছে। ছেলেটার অনেক কষ্ট হচ্ছে। এখনই চিকিৎসার প্রয়োজন। ডাক্তার হলেই হয় না। সরঞ্জামের প্রয়োজন হয়। চল নিয়ে যাই। মুহিত ধর তো।’
শামা খালামনি মুহিত ভাই আর শান্ত ভাইয়ের সাহায্যে ভিজে যাওয়া টি-শার্ট পরিবর্তন করে দিলেন। মাথা মুছতে মুছতে বললেন,’ ওর এমন হয়। এটা স্বাভাবিক।’
জাওয়াদ অবাক হয়ে বলল,’ বলেন কি আন্টি?’
‘ হুম। যখন ও খুব চিন্তিত হয়ে পড়ে। কিছু ভেবে উঠতে না পারে অথবা ওর মন গভীর ভাবে আহত হলে তা বিমুগ্ধ সহ্য করতে পারে না। তখন তার ভারী মাত্রায় জ্বর উঠে। ছোট থেকেই সে এই রোগের শিকার। ডাক্তার দেখিয়েছি। কিন্তু কাজ হয়নি। জন্ম থেকেই ও এমন। কমে যাবে যখন ওর মস্তিষ্ক ঠান্ডা হবে। শরীরে পানি দিতে হবে খুব।’
অর্পন খুব কাজে নেমেছে। তাযিনকে সে যত্নের সাথে সুস্থ করতে ব্যস্ত। রাত গভীর হয়। মেহমানরা সরে যায় নিজের রুমের দিকে। বাড়ির লোকেরা ফ্লোরে বসে পড়ে। মিতু আপু ঘুমে কাহিল। সবাই নিচে বসে। মিতু আপু মাথা রাখে নীহারিকার কোলে। তার কাঁধে ফাবিহার মাথা। দু’জনেই ঘুমিয়ে পড়েছে। মা তাদের রুমে যেতে বলেছে। কেউ গেল না। নতুন হলেও তাদের ভাই হয় তো। খুব মায়া না জন্মালেও একটু জন্মেছে। প্রিয়ম, ফাহাদরাও বসে রইল। তিশা আপু লম্বা হয়ে ফ্লোরে ঘুমিয়ে গেল। শান্ত আর মুহিব ভাই তো পায়ের কাছে। ব্যস্ত অর্পন আর জাওয়াদ। ইনজেকশন দেওয়া হলো জ্বর কমানোর। একটা সময় সবাই ক্লান্ত হয়ে রুমেই শুয়ে পড়ল আঁকাবাঁকা হয়ে। শুধু জেগে রইল শামাখালামনি, আনজুম, আর বাহিরের একটি অধ্যায় নীহারিকা। তার ঘুমই আসল না। সে শুধু তাকিয়ে রইল অসুস্থ ফ্যাকাসে ম্লান মুখশ্রীর দিকে। এই লোটার হাসি পৃথিবীর সৃষ্ট। চুল গুলো কপালে লেপ্টে শুয়ে আছে। ঘুমের মাঝে কত সুন্দর লাগছে! যখন সুস্থ হবে নীহারিকা চেতিয়ে দিতে বলবে,’ আপনি হা করে ঘুমান। যা বাজে লাগে।’
মনে মনে সহস্র বার নীহারিকা বলল,’ আপনি সুস্থ হয়ে উঠুন। তাযিন হয়ে রাগে ঝলসে দিন। আর বিমুগ্ধের মত মুগ্ধকরা হাসি হাসুন। আপনার ওই হাসির মাঝে অদ্ভুত মাদক রয়েছে। তাকিয়ে থাকার নেশা। শুধু তাকিয়ে থেকে আপনাকে উৎঘাটন করার একটা উপায় রয়েছে। শুধু মনোযোগ দিয়ে কিছু সময় তাকিয়ে থাকলে আমি ঠিক বিমুগ্ধ হন বা তাযিন আপনার রহস্য ভেদ করতে পারবই। আপনি সুস্থ হয়ে উঠুন। ‘

ভোরের দিকে জ্ঞান ফিরে হালকা হালকা তাযিনের। সে চোখ খুলে চারপাশে একবার দেখে। মাথায় কেউ ইটের বাড়ির কড়াঘাত করেছে। এমন অসহ্য যন্ত্রণার শিকার হচ্ছে সে। দু’হাতে মাথা চেপে ধরল সে। নামজ পড়ে উঠেছে সবাই। মিতু আপু আর ফাবিহাকে অনেক কষ্টে উঠাতে হয়েছে নীহারিকার। নামাজ পড়ে তারা মাত্র বসেছে। নীহারিকার ইচ্ছে হলো একটু দোয়া পড়ে ফু দিয়ে তাযিনের খাড়া চুল গুলো কপাল থেকে সরিয়ে দিতে। কিন্তু তা সে ভুলেও করতে পারল না। প্রথম দর্শনেই তাযিন দেখল নীহারিকা কোমল ক্লান্ত চাহনি দিয়ে তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে। চোখে অজস্র দুঃখের আত্নপ্রকাশ তার জন্যে। যেন সে অসহায়। খুব অসহায়। তাই এভাবে তাকিয়ে রয়েছে। সে কি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অসহায় মানুষ? যে তাকে এমন অসহায় চাহনি দিয়ে দেখতে হবে? মোটেও সে অসহায় নয়।
‘ আপনি এখানে কি করছেন? ‘
উপস্থিত সবাই তাযিনের দিকে তাকাল। সে এখন সুস্থ। মুখ দেখে আন্দাজ করতে পারছে শামাখালামনি। তিনি দ্রুত এসে জড়িয়ে ধরলেন। এবার তিনি কাঁদলেন। ভারী অবাক হয়ে গেল সবাই। যখন অসুস্থ ছিল এই মহিলা কি যে একটা হার্ড কভার ভাব দিলেন সবাই রিতিমত শক্ড ছিল। এখন তো সবাই আরও শক্ড। ছেলেকে চুমু দিয়ে তিনি বললেন,’ আমার আব্বাজান কেমন আছে এখন?’
গম্ভীর হয়ে তাযিন বলল,’ আপনি রুম থেকে বের হয়ে যান।’
নীহারিকা আশ্চর্য রকমের চমকাচ্ছে। বাকরূদ্ধ হয়ে রইল সে। তাযিন তাকেই বলছে বের হয়ে যেতে। কিন্তু কেন? হুট করে তাযিন পাশে থাকা কাঁচের বাটি গ্লাস ছুড়ে দিয়ে বলল,’ আপনিকে আমি বের হতে বললাম কথা কানে যায় না? আই সে গেট আউট। চোখের সামনে থেকে বের হয়ে যেতে বলেছি। তাকিয়ে থাকতে নয়।’
তার চিৎকারে সবাই এবার বিস্ফারিত চোখে তাকাল। ভয়ে নীহারিতার শক্ত কঠিন অন্তর আত্না কেঁপে উঠল। সে দু পা পিছিয়ে গেল। শামাখালামনি দ্রুত বললেন,’ আসলে ও অসুস্থ এখন। জ্বরের তাপে বলছে। নীহু মামুনি কিছু মনে কর না। তুমি রুমে যাও। অনেক ক্লান্ত তুমি। যাও।’
নীহারিকা ঠাই দাঁড়িয়ে রইল। তাযিনের চোখ শক্ত। কঠিন একদম নির্দয় পাষাণের নেয়। সে কি করেছে? তার দোষ কোথায়? তার সাথে এত নিচ বাজে ব্যবহার কেন? শতপ্রশ্ন মাথায় নিয়ে অভিমানে নীহারিকার মনের প্রতিটি অংশ খান খান হয়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেল অদৃশ্য ভাবে। সে এত নিচু ব্যবহারের যোগ্য? অথচ এই লোকের জন্য সে সারাটা রাত প্রার্থনা করেছে। আর উনার সো কল্ড হবু বউ পড়ে পড়ে ঘুমিয়েছে। তাও নিজের রুমে। এত সময় ব্যয় করে সে হাঁড় ভাঙ্গা অপমান পেল! মুফতমে তার মুখে সেই অপমান ছুড়ে দেওয়া হলো। তাযিন আবার চেঁচিয়ে উঠে। নীহারিকা স্তব্ধ হয়ে ভাবল এই মানুষটা তাকে এত অপছন্দ করে কেন? পাশে তাকিয়ে সে দেখল জাওয়াদ ঝিমুচ্ছিল। এই বিকট চিৎকারে সে সজাক হয়ে ক্ষীপ্ত চোখে তাকিয়ে আছে। অথচ এই অতিসৌদর্শন পুরুষটি তার মাঝে কত পছন্দের জিনিসই না খুঁজে বেড়ায়। এই লোকটাই যত সমস্যা। মনে মনে প্রচুর অভিমানে নীহারিকা জর্জড়িত হয়ে ঠিক করল এই লোকের সাথে কোন কথা সে বলবে না। তার উঁচু গলা নিয়েই থাকুক সে। নীহারিকা দ্রুত রুম ত্যাগের জন্য পা বাড়ায়। খারাপ লাগলেও সবাই অবাক হয়ে রইল। সাথে এও ভাবছে জ্বরে মানুষ আবলতাবল বকেই। এটা বড় ব্যাপার নয়।
নীহারিকা আর তাকাল না। বেরিয়ে গেল। শেষ মুহূর্তে সে যদি একবার তাকাত দেখতে পেত একটি অসুস্থ চোখ, জীর্ণশীর্ণ শরীরের ব্যাকুল আবেদনময়ী দৃষ্টি জোড়া কিছু চাইছে। বার বার চাইছে। কি তা? ফিরে আসা চাইছে? তাযিন নেতিয়ে গেল। মনে মনে সে বলে উঠল,’আর একবার ফিরে তাকালে কি খুব ক্ষতি হয়ে যেত? এত জোড়েও তো চিৎকার করিনি। আমার পক্ষ থেকে এই চিৎকার ছিল অতিক্ষুদ্র। কারণ আমি আরও রেগে চিৎকার করে আগুন ছড়িয়ে দিতে পারি। একবার তাকালেই হত। আমি আর একটু ক্লান্ত চোখে দেখতাম। রাতজাগা ক্লান্ত ঝুলে পড়া দুটি নয়ন। তাযিন চোখ বুজে নিল। বাকি সে জানে না।
‘ পৃথিবী এঁফোড় ওফোঁড় হয়ে যাক।
যতটুকু চক্ষুবন্দী করেছে ততটুকুই তার থাক।’
_________________
ভুলগুলো আল্লাহর দেওয়া মহান গুন ক্ষমার চোখে দেখবেন।
#চলবে…………
@হাফসা আলম……………..