প্রিয় সুখ পর্ব-২৩

0
30

প্রিয় সুখ- ২৩
_________________
কান্নার শব্দের মত বাজে আর নিম্ন শ্রেনীর আওয়াজ বোধহয় আর নেই। কেমন যেন একটি বিষন্ন হৃদয়বিদারক হাহাকার এই কান্নার সাথে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। সুরটি নিজের সাথে আশেপাশের মানুষের মাঝে দুঃখ বিলি করে বেড়ায়। অনেকটা ফিরিওয়ালার মত। কান্না মানুষের দূর্বল চিত্তকে সকলের সামনে প্রদর্শন করে একটি নরম সুর হয়ে। বড় কোমল এই সত্তাটি। যা মানুষের হৃদয়কে অন্যের চোখে দৃষ্টির পানিতে ভাসিয়ে দেখিয়ে দেয়। আয়নার মত প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে। রাত গভীর হচ্ছে। চারপাশের অন্ধকার দলা পাকিয়ে গিড়ে ধরছে। আবছা আবছা হয়ে আসছে আশেপাশের নিরবতা। শান্ত নিশ্চুপ ঝিঁঝি পোঁকার গুন গুনে গানের মাঝে মিতু আপুর বাচ্চা স্বরূপ কান্না বড্ড বেমানান। রুমে বসে পা ছড়িয়ে তিনি কাঁদছেন। নীহারিকা ক্রমেই বিরক্ত হয়ে উঠছে। চোখ মুখ কুঁচকে রেখেছে সে। সরু চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে মুখের উপরে। ঘরে মৃদু আলোর ছিটে রয়েছে। অন্ধকার মিতু আপুর খুব প্রিয়। কারণ তার ধরণা তার জীবনে শুধু অন্ধকারের উপস্থিতি আছে। নীহারিকার জন্য ঘুটঘুটে অন্ধকারে ঢেকে দিতে পারিনি রুমটি। অধৈর্য্য হয়ে নীহারিকা গলা ছাড়ল,’ তোর যদি এতই কান্না করার ইচ্ছে থাকে আমার রুম থেকে বের হ। এসব ন্যাকামি আমার সাথে দেখাবি না। ‘
নাক টানতে টানতে মিতু আপু বলল,’ এভাবে কথা বলছিস কেন? আমি কি তোর পর?’
‘ আপন পরের কথা আসছে না। তোর যখন বিয়ে থেকে ভাগার এতই ইচ্ছে ছিল তাহলে এখন কাঁদছিস কেন?’ ঝাঝাল কণ্ঠ নীহারিকার। কথা কানে নিলেন না মিতু আপু। বিশ্রী শব্দে তিনি কেঁদে বুক ভাসাচ্ছেন। নীহারিকা কানে বালিশ চাপে। কাঁথা মুড়িয়ে নেয় শরীরে। অসহ্য অনুভূতি সব। মিতু আপু হঠাৎ ভদ্র মেয়ের মত উঠে বারান্দায় চলে গেলেন। কান্নার শব্দ ধিম হয়ে আসছে। চমকে উঠে নীহারিকা লাফিয়ে উঠল। আশেপাশে না দেখতে পেয়ে সে দ্রুত উঠে বসে। পা জোড়া রাখে নিচের ফ্লোরে। উঠতে গিয়ে ধপ করে পড়ে। ফ্লোর ভর্তি পানি দেখে সে চেঁচিয়ে উঠে। মিতু আপু হুড়মুড়িয়ে রুমে এসে হাসির রোল ফেলে দেয়ন। হি হি করে তিনি বিটক কিটকিটে শব্দে হাসতে শুরু করেন। নীহারিকা রাগে ঝরঝরা চোখে তাকিয়ে দেখে মিতু আপুর চোখ ভর্তি পানি মুখ ভর্তি হাসি। সামনের লাইটের আলো তাকে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মত আলোকিত করে রেখেছে। কিছু বলতে চেয়েও সে বলতে পারল না। প্রিয়ম ছুটে এসে দেখে বাঁকা পায়ে নীহারিকা বিছানার কোণ ঘেঁষে পড়ে আছে। দু হাতে সে তাকে টেনে তুলে। শাসনের সুরে বলে উঠে,’ তুই গাঁজা টাঁজা খাস না কি ইদানিং?’ ঝগড়া করার মুডে নীহারিকা বলল,’ খাই তো। তুই নিজেই তো দিয়ে যাস। আহ পা।’ প্রিয়ম পা দেখে। সাদা পা জোড়া লাল হয়ে উঠেছে। বিরক্ত হয়ে সে বরফ নিয়ে আসে ফ্রিজ থেকে। মিতু আপু পা ধরতে গেলেই নীহারিকা চেঁচিয়ে উঠছে। যা শুনে এবার মা ছুঁটে এসেছেন। প্রচন্ড রাগে তিনি কথা বলছিলেন না মেয়ের সাথে। রাগ দ্বিগুন হয়ে উঠেছে এবার। আগুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন তিনি। কিছু বলছেন না। নীহারিকা মায়ের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে ন্যাকামি করে চেঁচাতে চায়। অথচ সে জানে এসব তাকে দিয়ে হয় না। এক ফোঁটাও কার্যকর হলো না। ফ্রিজ থেকে নিয়ে আসা বরফ তিনি জোড় করে লাগিয়ে দিলেন। পায়ের ব্যথা কমিয়ে দিতে স্প্রে করলেন। এবার নীহারিকা মাকে জড়িয়ে খুবই দুঃখিত কন্ঠে বলে উঠল,’ স্যরি মা। আমি যার সাথে গিয়েছিলাম সে কাউকে বলতে নিষেধ করেছে। তাই বলতে পারছি না। শুনলে তুমি বকা দিতে না।’ আফিয়া বিলকিস গলার স্বর যথেষ্ট কঠিন করে বললেন,’ আমি এখনও তোকে বকছি না।’ কিছু একটা বলতে নিয়ে নীহারিকা একটু থেকে ভেবে দেখল এখন বললে আগুনে ঘিয়ের মত কাজ করবে। ফলে সে কথা ঘুরিয়ে বলল,’ ওকে বক। চুপ করে থাকবে না। আর এমন অ্যাটিটিউড তোমাকে মানায় না। হাসলে মানায়।’ নীহারিকা মাকে জাপ্টে ধরে। রাগ অনেকটা কমে আসে আফিয়া বিলকিসের। তিনি জানে মেয়ে কখনো আজেবাজে কিছু করবে না। যদিও সে ভয়ংকর কাজ করে তবেও মাফ করা যায়। দু’ বছরে অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে তার। শুধু রাগটা বেড়ে গেছে। নীহারিকার পা মালিশ করতে করতে তিনি বললেন,’ তোর বাবা খুব রাগ করেছে। যত গুরুত্বপূর্ন কাজই থাকুক না কেন ফোন ধরা দরকার ছিল।’
হঠাৎ মনে পড়ার একটা চঞ্চল ভাব প্রকাশ করে নীহারিকা বলল,’ মা ওই অভদ্র ছেলেটা এখনও আছে?’
‘ অভদ্র মানে?’ চারপাশে তাকাল আফিয়া। প্রিয়ম নিজের দিকে তাকাল। সে মোটেও অভদ্র নয়। আপু তাকে বলদ গাঁধা যাই বলুক অভদ্র বলবে না। এটা আবার কে? হঠাৎ মনে পড়ার ভঙ্গীতে সে হেসে বলল,’ জাওয়াদ্দা? সে তো চলে গেছে।’ নীহারিকা ভাইয়ের সম্মোদনে বেশ মজা পেল। দু’জনে হাত মিলিয়ে কাশি দিল। যা দেখে মা প্রচন্ড রেগে বললেন,’ তোদের মধ্যে চলছে কি? আর ছেলেটা মোটেও অভদ্র নয়। যথেষ্ট ভালো এবং আমার পছন্দের। আমি চাই তোরাও পছন্দ করা শুরু কর। এত সুন্দর এবং সব দিকে পারফেক্ট ছেলে সবার কপালে জুটে না।’ তিনি উঠে দাড়ালেন। জ্ঞানটা ভারী ছিল। নীহারিকা ভ্রু বাঁকিয়ে মায়ের দিকে কিছুমুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বলল,’ তোমরা কি ওর সাথে আমার আবার বিয়ে দেওয়ার প্লান করছ না কি?’
‘ দিলে কি করবি? তোর কি কোন ছেলে পছন্দ আছে?’
‘ ওহ মা আবার শুরু করেছ? তোমাদের কাছে বিয়ে বাদে কোন কথা নেই?’ প্রিয়ম ফোঁড়ন কাটল। তখন দৃষ্টি স্থির নীহারিকার। সে বিস্মৃত হয়ে বলল,’ যাকে বিয়ে করব না বলে পালিয়েছি তাকে আবার বিয়ে করব? সিরিয়াসলি? মা তোমার মাথা আজ গরম। যাও তো।’
‘ তুই সত্যি বেয়াদপ হয়ে যাচ্ছিস নীহারিকা। এসব মোটেও ভালো না। পরীক্ষা কেমন হয়েছে?’
‘ মোটামুটি।’ মৃদু সুর নীহারিকার।
‘ হ তোদের তো সবই মোটামুটি থাকে। ভালোও না খারাপও না। যা পড়তে বস। কাল তো পরীক্ষা নেই। ক্লাস আছে?’
‘ হুম আছে।’
মিতু আপুর দিকে চেয়ে রইল আফিয়া বিলকিস। হঠাৎ তিনি আফসোস করে বলে উঠলেন,’ আসলে তোরা চাচ্ছিস কি? মা বাবার সম্মান নিয়ে টানা টানি করতে ভালো লাগে? মিতু তোর থেকে আমি এটা কখনো আশা করি নি। যখন এসব করার সময় ছিল তুই করলি না। অপছন্দের ছেলের সাথে বিয়ে দিলেও তোরা এসব করস। পছন্দের ছেলের সাথে বিয়ে দিলেও এসব করছিস। বিয়েতে সমস্যা কি তোদের?’
উত্তরের আশায় দাড়িয়ে রইলেন তিনি। সময় নিয়ে ভেবে মিতু আপু, নীহারিকা, প্রিয়ম এক সাথেই বলে উঠল,’ বিয়ে নিজেই সমস্যা।’ দু’ বোন প্রিয়মের দিকে তাকাতেই সে মায়ের দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বলল,’ মা তোমার সমস্যা কি? তুমি বিয়ে বিয়ে করছ কেন? যাও তো।’ ছেলের কথায় তিনি দমলেন না। আরও কিছুক্ষণ অগনিত ঝাড়ি দিয়ে গেলেন। এবার আর কেউ তর্কে জড়ালো না। চুপ করে গিলে গেল। বকতে বকতে রুম ত্যাগ করলেন মা। খাবার ঘরে পাঠানো হলো তিন ভাই বোনের। জমিয়ে খেতে বসে মুহূর্তের মাঝে ভুলেই গেল মিতু আপু কত বড় অন্যায় করেছে। অদ্ভুত ব্যাপার মিতু আপু বিয়ের শাড়ি পড়ে খাবার খেয়েছে। সব শেষ করে ঘুমানোর আগে তার মনে পড়ে পরনের শাড়ির কথা। আলমারি খুলতেই নীহারিকা তেজি গলায় বলল,’ ভুলেও তুই আমার জামা, টি-শার্ট এমন কি ওড়নাও ধরবি না। কি ভেবেছিস সব ভুলে গেছি? বল পালিয়েছিস কেন?’ অসহায় চোখের দৃষ্টি নিন্মে নিয়ে গেলেন মিতু আপু। তাকে দেখে কেউ বলবে না তিনি পঁচিশের কন্যা। আচরণ এখনও আঠারোতে ঠেকে আছে। রাগে শরীর কাঁটা দিচ্ছে নীহারিকার। মিতু আপুর দিকে সে জহুরী নজরে তাকিয়ে। প্রিয়ম চেয়ারে বসে বসে দৃষ্টি বিনিময় দেখছে। তার ওতো কৌতূহল নেই। তবে সেও জানতে চায় পছন্দের ছেলেকে ফেলে পালানোর মানে কি? মিতু আপু অল্প অল্প গলায় টেনে টেনে বলা শুরু করলেন,’ আসলে নীহারিকা আমি তো শাহিন ভাইকে পছন্দ করি।’
‘ সেটা আমরা জানি। তারপর?’
‘ তার সাথে আমার একটা সম্পর্কও ছিল।’
‘ সেটাও জানি।’ প্রিয়ম বলল।
‘ ছোট ভাইয়ের সামনেই বলতাম?’ প্রিয়মের দিকে তাকাল একবার মিতু আপু। নীহারিকা কপাল কুঁচকে বলল,’ ছোট কোন দিক থেকে? উনিশ বছরে পড়বে সে। বল তুই। এমন আজাইরা নাটক বন্ধ কর।’
‘ প্রেম যখন ছিল তখন তিনি অনেক ভালোবাসতেন।’
এবার আসল কাহিনী ধরতে পারল নীহারিকা প্রিয়ম। তারা বেশ রেগে তাকিয়ে চেঁচাল,’ তুই নাটক বন্ধ কর। জানি এখন কিছুই বলবি না।’
হু হা শব্দ করে ডাকাতের মত হাসল মিতু আপু। তারপর থাপ করে আলমারি খুলে একটা জামা তুলেই ওয়াশরুমে ছুটল। গাঁ কাপানো চিৎকার করল নীহারিকা। প্রিয়ম বিরক্ত হয়ে বলল,’ তোরা মাইয়া জাত সত্যি প্যাড়া। তোগো মন বুঝা আর রাত জেগে তারা গনা একুই ব্যাপার। যা পাগল ছাগল।’
মিতু আপুর কাহিনী এই প্রথম বুঝতে পারছে না নীহারিকা। তিনি কেন এমন করল? তাযিন কি কি যেন করে এই বিয়েটা ঠিক করেছিল। সব মাটি হয়ে গেল। ছেলেটা সত্যি বলেছিল। মিতু আপুর মাথায় আগে থেকেই এসব চলছে।
তাযিনের কথা মনে পড়তেই নীহারিকাকে একটু বেখেয়ালি দেখাল।
________________
রাস্তার বুকে ঠান্ডার একটা রেশ আছে। বৃষ্টি নিজের সাথে শীতলতা নিয়ে আসে। রাস্তা ঘিরে এখনও গাড়ির আনাগোনা। এই শহরে ধূলোবালি ভর্তি হলেও একটা স্নিগ্ধ সুবাস আছে। দু’পাশের বড় বড় মেহগুনি গাছ গুলো সেই সুবাস গায়ে মেখে দাড়িয়ে পরম যত্নে দোল খাচ্ছে। ঝিরি ঝিরি বাতাসের সাথে যেন টুকরো টুকরো বৃষ্টি উড়ে এসে বিমুগ্ধের শরীর স্পর্শ করছে। গেটের কাছে এসে থামতেই সে ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলল। ঘটনাটা এমন দাড়াল, তীরে এসে তরী ডুবলো। এত পথ সে কোন কিছু না ভেবেই যখন বাইক চালাচ্ছিল কিছুই ঘটল না তখন। যেই হঠাৎ তার মাথায় আসল এত বড় রোডে সে বাইক তেমন চালায় না। বেশি গাড়ির মাঝে সে ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলে। ঠিক তখনই সে থুবড়ে পড়ল। কাত হয়ে সে খুব সাবধানে নিজের শরীরকে বাঁচিয়ে নিল। কিন্তু হাত পায়ে যথেষ্ট কেঁটেছে। বিমুগ্ধ বাইক রেখেই গেটের সামনে আসল। দারোয়ান কোথায় গেলো? বিমুগ্ধ দেখল সে অর্ধ কাতর হয়ে পড়ে আছে। দু’ তলা ছোট অফিস এটি। অর্পণের বাবার মুলত জাহাজের ব্যবসা। অফিসে কাজ তেমন হয় না। বেশি মানুষও নেই। শুধু মিটিং, হিসেব এসবের জন্যেই অফিস। বিমুগ্ধ মেইন ডোর খোলা দেখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে হাসল। কি বুঝে সে এই মুহূর্তে হাসছে তা বুঝতে অপারোগ প্রকৃতি। খুব সাবধানে সে ভিতরে প্রবেশ করল। একদম নিঃশব্দে। পায়ের জুতো জোড়া আগেই সে খুলে রেখেছে বাহিরে। নিচের তলার সব বাতি বন্ধ। অন্ধকার। দেখে কেউ বুঝতেই পারবে না এখানে কিছু হয়েছে। বিমুগ্ধ কিছুক্ষণ আধার কালো রুমে দাড়িয়ে ভাবল কোন রুমে হতে পারে তারা। সিড়ি বেয়ে বিমুগ্ধ পিছনের একটি রুমের কাছে আসতেই দেখল তারা অর্পণকে ধরে ফেলেছে। চেয়ারে বসিয়ে তাকে জোর করছে কিছু একটার জন্য। এত সিরিয়াস একটি মুহূর্তে কোন রকম প্রস্তুতি না নিয়ে বিমুগ্ধ হাসতে হাসতে ভিতরে প্রবেশ করল। অর্পণ মনে মনে বিড়বিড় করল,’ স্টুপিড।’ দলের একজন সাথে সাথে চিৎকার করে বলল,’ তুই কে? ভিতরে ঢুকলি কখন?’
টি-শার্ট ঠিক করে বিমুগ্ধ হাত উপরে নিতেই তারা ভাবল বিমুগ্ধ মারার বা কিছু বের করছে। তাই তারা অর্পণের পেটে ঘুষি বসিয়ে বলল,’ এদিকে আসলে ভালো হবে না বলে দিলাম। এই ছেলের মৃত্যু আশা করি তুই চাস না? বেশি কিছু না শুধু এর বাপরে ফোন করে বলতে বল কেইস তুলতে। তাহলে তোকে এবং একে ছেড়ে দিব।’
বিমুগ্ধ দু’ হাত উপরে তুলে বলল,’ মৃত্যু চাইব না কেন? অবশ্যই চাই। তবে আপনারা মারলে পছন্দ হবে না।’
অর্পণ গলা ছেড়ে এবার চেঁচাল,’ ওই শালা তোকে একা আসতে বলেছে কে? একা আসলি ক্যান?’ অর্পণ চারপাশে তাকাল। পুলিশ তো সে দেখছে না। অফিস থেকে কল করা হয়েছে অর্পণকে। তাই সে এখানে এসেছে। এসেই বুঝতে পেরেছে পরিবেশ ভালো না। দু’জন গার্ডই পড়ে ছিল আধমরা হয়ে। তাই সে খুব গোপনে বিমুগ্ধকে কল করেছে এখানে পুলিশ নিয়ে আসতে। ততক্ষণ সে এদের আটকে রাখবে। কিন্তু বিমুগ্ধ এভাবে চলে আসবে সে কল্পনাও করেনি। অর্পণের ঠোঁট নাক ফাটিয়ে রক্তাক্ত করে রেখেছে। মার গুলো শুধু শুধু খেয়েছে। এবার তো মনে হয় মরতেও হবে। নিজের কাজে আফসোস করা ছাড়া কিছুই করার নেই তার। বিমু্গ্ধ হিরোর বেশ ধরল কিছুক্ষণ। তার দাড়ানো অ্যাটিটিউড যথা সম্ভব ভালো ছিল। চেয়ার নিয়ে যখনই সে বসতে যাবে তখনই পিছন থেকে লাঠি দিয়ে তার পায়ে আঘাত করা হলো। হাঁটু ভেঙ্গে সে মুখ থুবড়ে পড়তেই তার অবস্থা আরও খারাপ হয়ে আসল। আগেই সে এক্সিডেন্ট করে জখম হয়েছিল। এবার দলের ভিড়ে আনন্দ ছেঁয়ে গেল। অর্পণ রেগে গেল। চেয়ার ছেড়ে উঠতে নিলে তাকেও মারা হলো কয়েক বাড়ি। বিমুগ্ধ নিচে বসে থেকে কিছুক্ষণ দেখল সব। তারপর হুট করে হাসল। তার এমন হুট হাট হাসির রোগটি বিস্মৃত করল ছেলে গুলোকে। তারা বেশ রগ চটা ভাব নিয়ে বলল,’ এই ছেলে তোর কি হয় অর্পণ?’
‘ আমার ফ্রেন্ড। ওকে যেতে দে। তোদের ডিল আমার সাথে। আমার বাপ আর কোম্পানির সাথে। ও শুধু আমার কথায় এসেছে। ছেড়ে দে মাসুম।’
‘ কাজ তো শয়তানের মত। নাম রেখেছে মাসুম।’ চোখ সরু করে তাকাল বিমুগ্ধ। তার পিঠে লাঠি দিয়ে আঘাত করে প্রায় শুয়ে দিল। অর্পণের খুব খারাপ লাগছে। তার ভুল হয়েছে বিমুগ্ধকে বলে। আগেই বুঝা উঁচিত ছিল বিমুগ্ধ একটা আধপাগল। সোজা পুলিশে ফোন করলেই পারত। কিন্তু পুলিশকে ব্যাখা করার প্রয়োজন পড়ত। কিন্তু বিমুগ্ধকে সেটা করতে হয়নি। বলা মাত্র ছুঁটে এসেছে। এই গুরুতর মুহূর্তে অর্পণের মনে হলো বিমুগ্ধ অসাধারণ একটি মানব চরিত্র। টেবিলের উপরে চায়ের দু’টি কাপ রাখা। বিমুগ্ধে বেশ অনেকক্ষণ থেকে সেটা দেখছে। হুট করে উঠে সে দু’টি কাপই ছুড়ে মারে লাঠি হাতের ছেলে গুলোর দিকে। তারপর একটি লাঠি তুলে নিয়ে যে তাকে আঘাত করেছে তার পায়ে লাথি মেরে বসিয়ে দেয় হাঁটু ভেঙ্গে। ডান হাত বেয়ে রক্ত পড়ছে বিমুগ্ধের। হাতটা একটু ঝেরে সে অর্পণের দিকে তাকিয়ে বলল,’ বলদের বাচ্চা বলদ। তোরে কে বলেছে এমন হিরো সাজতে?’
অর্পণ পিছনের ছেলের হাত বাকিয়ে বলল,’ সাজি নি আমি হিরোই। তোরে কে বলছে খালি হাতে চলে আসতে?’
‘ আমি কি মেয়ে দেখতে এসেছি? আচ্ছা ভালো কথা মনে করেছিস। তোদের দেশে মেয়ে দেখতে গেলে কি কি নিতে হয়?’
চোখ গরম করে তাকাল অর্পণ। মাসুম নামের ছেলেটি এবার গর্জন করে উঠল,’ অর্পণ তোর বাপরে ফোন কর। তা না হইলে এখনই দুইডারে মেরে এখানে পুতে রাখব।’ সে তেড়ে গেল। বিমুগ্ধ চেয়ারে বসেই স্টিক দিয়ে বাড়ি মারে। এতে তার কিছুই হলো না। মাসুম আদেশের সুরে বলল,’ অনেকক্ষণ এদের নাটক দেখতাছি। ওই তোরা দাড়াই আছস কা? মার দুইডারে।’ তাদের একজন বলল,’ বস বলেছে শুধু ভয় দেখাইতে। বেশি মারামারি করতে নিষেধ করেছে মাসুম ভাই।’ কথাটা কানে নিল না মাসুম। নিজেই আগ বাড়িয়ে বিমুগ্ধের টি-শার্ট টেনে ধরল। মুখ বরাবর ঘুষি বসাতেই যাবে অর্পণ পিছন থেকে টেবিলের ফাইল ছুড়ে মারে। এতে সবাই ঝাপিয়ে পড়ে। মারামারির একটা বড় আকার ধারণ করে। নাটক সিনেমার মত একজন দশজনের উপরে ভারী পড়ছে না। পাঁচজনের এই ছোট দলের সাথে মারামারি করতে গিয়ে বিমুগ্ধের টি-শার্ট ছিড়ল। ঠোঁট ফাটল। চুল ছিড়ল। একটা পর্যায়ে পরিস্থিতি হাতের নাগালের বাহিরে চলে গেল। তারা পাঁচজন ভারী পড়তে লাগল। বিমুগ্ধ মারামারি মোটামুটি পাড়লেও অর্পণ এই বিদ্যায় গাঁধা। আমেরিকার মত এদেশে এত বেশি সুযোগ নেই যে পড়ালেখার পাশাপাশি সবাই ফাইটিং শিখবে। তার উপরে তারা এখন রিভলবার বের করেছে। বিমুগ্ধ রুমের লাইট অফ করে দিয়ে অর্পণের হাত ধরে রুম থেকে ছুঁটে বের হয়ে যায়। প্রথমে অর্পণ ভয় পেয়ে চিৎকার করতে শুরু করে। বিমুগ্ধ মাঝ পথে তাকে থামিয়ে পিঠে বেধরাম কিছু দেয়। অর্পণ ভেবে পায় না এটা কেমন বিচার? দু’জনেই অন্য রুমে এসে টেবিলের পিছনে লুকিয়ে পড়ে। হাঁপাতে হাঁপাতে অর্পণ বলল,’ মারলি কা?’
কথা শুনে বিমুগ্ধ হাসতেই নিবে অর্পণ মুখ চেপে ধরে বলল,’ ডাকাতের মত হাসবি না শালা।’
মুখ থেকে হাত সরিয়ে বিমুগ্ধ শ্বাস নিতে নিতে বলল,’ আমার উচিত ছিল তোরে সেখানে রেখে আসা। মার খাইতি। আরও খাইতি। তখন আক্কেল ঠিকানায় আসতো।’
‘ তুই একা আসতে গেলি কা?’
‘ চুপ কর বলদ। তুই জানিস তুই মারামারিতে ঢেঁড়শ। তাহলে ওদের সাথে লাগতে গেলি কেন?’
‘ একদম ফালতু বকবি না। তোরে আমি পুলিশ নিয়ে আসতে বলেছি। একা চলে আসলি কেন? আমি কি তোরে পার্টিতে ইনভাইট করেছি?’
‘ সেটাই তো করেছিস। দেখ কেমন খাওয়াইলি।’
অর্পণ সাহস করে বিমুগ্ধের পিঠে একটা ঘুষি মারল। তার প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। এখন তারা বের হবে কিভাবে?
‘ ওহ মারছিস কেন?’ বিমুগ্ধের কন্ঠে বিরক্তির একটা ঝাপ পড়ছে। সে নিজের হাত পা দু’ হাত দিয়ে চেপে ধরছে। ঠোঁটের রক্ত ডান হাতের বৃদ্ধা আঙ্গুলের সাহায্য মুছতে শুরু করেছে। কপালে গালে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব হচ্ছে। জানালা দিয়ে খুব মৃদু আলো এসে টেবিলের পিছনে পড়ছে। ধীমি সেই আলোয় অর্পণ আবিষ্কার করল বিমুগ্ধের শরীর প্রচন্ড আহত। তার প্যান্টের অংশ ছিড়া। হাত কাঁটা। কপাল ফাঁটা। গাল লাল হয়ে আছে। চোখের পাশেও রক্ত। ছেলেটার পুরো শরীরই তো শেষ? মনে মনে অর্পণ প্রচন্ড কষ্ট পেল। তবে তা বেশি প্রকাশ না করে বলল,’ চল তোরে ফাস্ট এইড করে দি।’
বিমুগ্ধে ফিচেল হাসল।’ তোর বাপের হসপিটাল এইটা? না আমার পাগলাগারদ?’
‘ কেন?’ অবুজের মত জিজ্ঞেস করল অর্পণ।’
‘ আমরা পালিয়ে আছি। তোর কি মনে হয় ওদের হাতে এবার পড়লে তুই মারামারি করে বাঁচতে পারবি? বলদ।’
‘ তুই যেন কত পারছ যানা আছে। আর ওরা প্রফেশনাল ছিল। আমরা কিভাবে পারব বল? এত সহজ না।’
‘ হয়েছে নিজের অপারোগতা আমার উপরে চালাতে হবে না। তোকে দিয়ে তো একজনকেই সামলানো যাচ্ছিলো না। তাই তো পালাতে হয়েছে।’
‘ তুমি যেন সবাইকে ফিট করে দিয়েছ? নাটক মারো? দেখলাম তো কেমন পারো।’ অর্পণ মুখটাকে বাঁকিয়ে নিল।
‘ তোর থেকে তো ভালোই। ফালতু বকবক বন্ধ কর। প্যাড়া লাগতাছে। পুলিশ আসবে নো চিন্তা।’
উদগ্রীব হয়ে অর্পণ প্রশ্ন করল,’ তুই কল করেছিস?’
হেসে উঠে বিমুগ্ধ সুর টেনে বলল,’ না। ভবিষ্যৎ বাণী। তুই তো জানিস আমি এসব কত পারি।’
‘ তাহলে তো আসবেই।’ হঠাৎ দু’জনেই হেসে ফেলল এক সাথে। তাদের হাসি দেখে মনে হচ্ছে এখানে হাস্যরস কৌতুকের আড্ডা জমেছে। অর্পণ বিমুগ্ধের গালে হাত দিয়ে একটু দেখার চেষ্টা করল। বিমুগ্ধ মুখ ঝামটা দিতেই অর্পণ একটা ছোট থাপ্পড় বসিয়ে দিল। বিমুগ্ধও কম না। সেও বসিয়ে দিল একটি। তারপর মাথাটা রাখল পিছনের দেয়াল ঘেঁষে। দু’ জনে অনেক সময় কথা কাঁটাকাটি করল। তারা প্রায় ভুলতে বসল যে তারা বিপদে রয়েছে। বিমুগ্ধের কেমন ঘুম ঘুম পাচ্ছে। ব্যাপারটা অর্পণকে একটু অবাক করল। পরে ভাবল বিমুগ্ধ সেন্সলেস হচ্ছে না তো? দ্রুত সে উঠে রুমের ওয়াশরুম খুঁজতে শুরু করল। অন্ধকারে তেমন কিছু দেখা যাচ্ছে না। বিমুগ্ধের ফোন সে মারামারির সময়ই ফেলে এসেছে। ওয়াশরুম থেকে পানি নিয়ে এসে অর্পণ বিমুগ্ধের মুখ মাথা ভিজিয়ে দিল। তীর্যক চোখে কিছুক্ষণ এসব কান্ড দেখল বিমুগ্ধ। নিচে থেকে চিৎকার শুনা যাচ্ছে। এটা তিশার ফাঁটা বাশের মত গলা। বুঝতে পেরে দু’জনেই দ্রুত উঠে দাড়াল। দরজা খুলে বাহিরে উঁকি দিতেই দেখল পুলিশ এসে হাজির। অর্পণ আগে থেকেই সুনিশ্চিত ছিল বিমুগ্ধ যখন বলেছে পুলিশ আসবেই। দু’জনে এবার রাজকিয় ভাব নিয়ে বের হল। তাদের করুন অবস্থা দেখে মুহিত ভয় পেয়ে বলল,’ তোদের এসব কি হইছে?’
তিশা আরও আতঙ্কিত হয়ে বলল,’ বিমুগ্ধ তুই এক্সিডেন্ট করেছিস? আল্লাহ। বাইক বাহিরে পড়ে আছে।’
অর্পণ বিস্মৃত চোখে তাকাল বিমুগ্ধের দিকে। এসব তো সে জানেই না। তাই তো আগেই ক্ষতবিক্ষত হয়ে বিমুগ্ধ এসেছিল। সে উল্টো ভেবেছিল বাহিরে কারও সাথে মারামারি করেছে। অর্পণ অনাবিল গলায় জানতে চাইল,’তুই সত্যি এক্সিডেন্ট করেছিস?’
ঘাড়ে হাত রেখে বিমুগ্ধ মাথা এদিক সেদিক করল। প্রচন্ড ব্যথায় তার ঘাড় ব্যথা হয়ে আছে। বন্ধুরা নিমেষহারা চোখে তাকিয়ে আছে দু’জনের দিকে। কি অবস্থা! অর্পণের বাম চোখ ফুলে আছে। কালছে হয়ে গেছে ঠোঁট। চুল সব কপালে লেপ্টে আছে। শার্ট ছিড়া। বিমুগ্ধের অবস্থা আরও খারাপ। অর্পণ কি ভেবে দৌড়ে একটি রুমে গেল। সেখান থেকে পানির বোতল নিয়ে এসে সে বিমুগ্ধের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলল,’ দ্রুত গিল। তোর ভারী শরীর তোলার ইচ্ছা আমার নেই। তোদের কারও আছে?’ তিশা মুখ কুঁচকে বলল,’ ভুলেও না।’ সবাই হাসল এক তালে। পুলিশ অফিসারের সাথে কথা বলতে গেল অর্পণ। মাঝ পথে বিমুগ্ধ থামিয়ে দিয়ে বলল,’ বলে দিস ওদের বসকে শুক্রবারে আমার রেস্টুরেন্টে আসতে।’
বিস্ফারিত চোখে তাকাল বন্ধুরা। বিমুগ্ধ ভ্রু কুঁচকে মুখ ঝামটা মেরে বলল,’ এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?’
অর্পণ রেগে আগুণ হয়ে বলল,’ শালা ঝামেলা গায়ে মাখার সখ বেশি না?’
‘ তুই শুধু এটা বলে আয়। অনেক হিসাব বাকি। আমার ফোন কিনে দিতে হবে তোকে।’
আকাশ থেকে পড়ার মত বড় অদ্ভুত মুখ করে তাকায় অর্পণ।
‘ আমাকে?’
‘ অবশ্যই। তোর জন্যেই তো আমার ফোন ভাঙ্গল। সেম টু সেম চাই। এমন কি যেখান থেকে কিনেছি সেখান থেকেই আসতে হবে। মেড ইন আমেরিকা।’ চিত হয়ে সোফার গায়ে পড়তে পড়তে বলল বিমুগ্ধ। হাঁড়িপানার মত মুখ অর্পণের। ফোনটা তাকে আমেরিকা থেকে এনে দিতে হবে? ওহ ভ্যাট অনেক বেশি হবে। এত সময়ের সব সহানুভূতি উবে গেল তার। শান্ত স্বাগতোক্তির গলায় বলল,’ ও দিতে পারবে চিন্তা নাই। বাপের কত টাকা দেখ।’
অর্পণের মুখের ভাব দেখে সবাই হেসে দিল। শুধু বিমুগ্ধ সিরিয়াস। মুহিত সন্দিহান হয়ে বলল,’ তুই কি করতে চাইছিস বল তো? ওদের নিজের হাতের খাবার খাওয়াবি বলে আমার মনে হয় না।’
‘ আমি সেটাই করব।’ নিরবিচ্ছিন্ন বার্তা বিমুগ্ধের। সবাই তার দিকে বেশিক্ষণ আর চেয়ে থাকল না। সবাই উপরে নিচে বসল। অর্পন আসতেই তাকে ধরল খাওয়াতে। এদের কান্ড দেখে অর্পণের নিজেকে পাগল মনে হচ্ছে। এই অবস্থায় সে আর যাই হোক পার্টি করার ইচ্ছায় নেই। তবে তিশা পা ছড়িয়ে বসে আছে। সে আজ ঝালঝাল গ্রিল চিকেন না খেয়ে উঠবেই না। এই ব্যথা কাতর মুহূর্তে একটা অবাস্তব অসহ্য ভালো পাগলামি শুরু হয়ে গেল।
__________________
ভোরের একটু আগে নীহারিকার ঘুম ছুঁটেছে। অন্ধকার এখনও কাঁটেনি। শীত শীত অনুভূতি। বৃষ্টির ফলে হয় তো। গায়ে একটি কাঁথা ছিল। এখন কোথায় দেখতেই এপাশ ওপাশে তাকাল সে। মিতু আপু ফুলো চোখে ঘুমিয়ে আছে। গভীর সেই নিদ্রা। আদুরে মুখশ্রী। মেয়েটা এতো বড় হয়েও অবুঝ। আসলেই কি অবুঝ? নীহারিকার মনে হচ্ছে এই মেয়েটিকে সে বুঝতে পারছে না। কিছুতেই না। বিয়ে থেকে পালিয়ে এসে সে পরের দিন চাকরির ইন্টারভিউ দিবে! সত্যি পাগল। দৃষ্টি পায়ের কাছে যেতেই নীহারিকা নিজের হলুদ রঙ্গা কাঁথাটি আবিষ্কার করল। উঠে বসে মিতু আপুর জড়োসড়ো শরীরে টেনে দিল। দু’ হাত এদিক সেদিক মেলে সে বারান্দায় উপস্থিত হলো। হাতে তার তুতু, বেরিক। এদের সকালের সূর্য দেখাতে হবে। লালাভ সূর্য। বারান্দার ঝুলন্ত দড়িতে খাঁচা ঝুলিয়ে নীহারিকা অন্ধকার পরিবেশ দেখছে। রুমের ডিম লাইটের আলো আসছে ব্যালকনিতে। আজ আর লাইট জ্বালিয়ে ঘুময়নি সে। মিতু আপুর অসুবিধা হবে তাহলে। মাঝে মাঝে অন্যের জন্য নিজেকে একটু ত্যাগ করতে হয়। আর এই মেয়েটি তো মিতু আপু। পাতলা ঠোঁটে হাসল নীহারিকা। তার চুল উড়ছে। এসে পড়ছে চোখেমুখে। ওড়না টেনে মাথায় রাখল সে। আযান পড়ছে চারপাশে। কি মনোরম মুহূর্ত। তৃপ্তিপ্রদ, শান্তির, স্নিগ্ধতার একটি সময়। একটি ভালোবাসার সুর। যার ভাষা পৃথিবীর সব ভাষার চেয়ে শক্তিশালী। নীহারিকার চোখ থমকালো। বিণৎ অদ্ভুত দৃশ্যপট। চমকের সাথে আঁখি উদগ্রীব। গ্রিলের আরও কাছে গিয়ে সে আবছা অন্ধকারে দেখল গেটের বাহিরে একটি গাড়ি। অন্ধকারে তেমন দেখা যাওয়ার কথা না। কিন্তু সে দেখতে পাচ্ছে। হালকা সাদা আলো কোথা থেকে যেন আসছে। কেউ গাড়ির সামনের পিঠে পা ভাঁজ করে বসে আছে। মাথায় একটি হাত। নীহারিকার চোখ কপালে। সে স্পষ্ট দেখছে মানুষটির হাতে সাদা ব্যান্ডেজ। মাথার একপাশেও সাদা কিছু দেখা যাচ্ছে। খালি শরীর মনে হচ্ছে। আবার মনে হচ্ছে কিছু আছে গায়ের উপরে। সূর্য তখন পৃথিবী আলোকিত করার জন্য লাল হয়ে উঠছে। গাছের আড়ালে তার আলো চলে আসছে মনে হচ্ছে। স্তব্ধ হয়ে নীহারিকা ঠিক কত সময় দাঁড়িয়ে ছিল সে বলতে পারবে না। ফজরের নামাজ সে পড়তে ভুলে গিয়েছে প্রায়। হঠাৎ বুকের মাঝে অজানা একটি আতঙ্ক এসে ভর করল। পুরোনো দম বন্ধ করা অনুভূতি যেন নড়ে উঠল। এক ছুঁটে সে রুমের ভেতরে প্রবেশ করেছে। এটা হতেই পারে না। বিমুগ্ধ তার বাসার সামনে এই ভোরে? কিভাবে সম্ভব? এটা অসম্ভব। মনের ভুল। নীহারিকা নিজের পাগলামি চিন্তায় হাসল খুব। কিছুক্ষণ পরে কি ভেবে আবার বারান্দায় এসে হাজির। কোথায়? নেই তো কিছু। এটা একটি দৃষ্টিভ্রম। মানুষটা কি তাকে বিরক্ত করছে? বুকে হাত দিয়ে জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিচ্ছে নীহারিকা। ইদানিং প্রচন্ড শ্বাস কষ্ট হচ্ছে। আগে কখনো হতো না। বৃষ্টিতে ভেজার ফলে হয় তো। এই বৃষ্টিই কাল। বৃষ্টিতে ভিজা বন্ধ করে দিতে হবে। একদম বন্ধ। তা না হলে এই হেলোসিনেশন হতেই থাকবে। মাঝে মাঝেই সকালে সে এই মানুষটাকে দেখে। হুট করে আসে হুট করে গায়েব হয়ে যায়। এটা সম্পূর্ন মনের ভুল। নিজেকে বুঝিয়ে দিল নীহারিকা। রহস্যজনক মানুষদের নিয়ে বেশি ভাবতে নেই। এরা হয়তো জীবনটাই রহস্যময় করে তলে। রুমে প্রবেশ করতে করতে নীহারিকা আর একবার অভিভূত নয়নে চেয়ে রইল। সত্যি কি সব দৃষ্টিভ্রম, চোখের ভুল? এই মানুষটা কি কখনো এমন পাগলামি করতে পারে? ভয়ংকর সব প্রেমিকের মত? নিজের গালে দু’ টি চড় বসালো নীহারিকা। প্রেমিক হতে যাবে কেন? ছিঃ।
_______________
রোদমুখে বাড়ি এসে নীহারিকা কিছুসময় রাগ নিয়ে বসে থাকে। মা বুঝতে পারে কোন এক বিশেষ কারণে তার কন্যাটি চরম রেগে আছে। রুমে গিয়ে মিতু আপুর সন্ধান মিলল না। পরক্ষনেই মনে পড়ল মিতু আপু চাকরি খুঁজতে কোমড় বেঁধে নেমে পড়েছে। যে কোন মূল্যে তার একটি চাকরির বেশ প্রয়োজন। তাই পালানোর সময় নিজের সকল কাগজ পত্রকে সঙ্গী বানিয়েছে। নীহারিকা অবাক হয়ে যায় তার বোনের এত নিখুঁত পরিকল্পনা দেখে। নারীদের ভালোবাসার চেয়েও প্রতিশোধের নেশা তীব্র। রমণীদের হাতে শেষ হয়েছে বেশ কিছু নামিদামী রাজ্য। ফলস্বরূপ বলা বাহুল্য এদের পরিকল্পনা কাঁপিয়ে দেওয়ার মত। ঠান্ড পানিতে ঝপঝপ করে গোসল সেরে নিল নীহারিকা। ভিঁজা এলোকেশের বিন্দুযত্ন করল না সে। ধপাস করে বিছানায় পড়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। এই অসময়ে ক্ষুধার্ত তার চোখজোড়া নিড়িবিলি নিশ্চুপ হয়ে নিভে গেল। রাগে না কি দুঃখে ঠিক কোন কারণে এই নিদ্রার উদ্ভব বুঝা যাচ্ছে না। শুধু ভারী শ্বাসের উত্তাপ অনুভব করছে চারপাশের প্রকৃতি। আফিয়া বিলকিস মেয়ের রুমে ঢুকে বিস্ময়ে হতবাক। সাথে রগরগ করে রেগেও গেলেন। কিন্তু তিনি সাধারণ মায়েদের মত চিৎকার চেঁচামেচি করে মেয়েকে তুলে দিলেন না। সাবধানে তোয়ালে দিয়ে ঝুলে থাকা চুলের পানি মুছে তা ফ্লোর থেকে তুলে রাখলেন মেয়ের পাশে। তারপর কাঁথা গায়ে জড়িয়ে লক্ষ করলেন মেয়ের মুখ বিষন্ন। আজ কি এমন হলো? নীহারিকা তো কখনো বিষন্ন হয় না!

ঘুটঘুটে আঁধারের ধাক্কায় যেন ঘুমের সেই আনন্দিত মজা উবে গেল। চোখ গুলো একদমই ধীরে না খুলে চট করে খুলে ফেলল নীহারিকা। উঠে হুড়মুড়িয়ে লক্ষ্য করল তার ঘর অন্ধকার। কেন? চমকে উঠল নীহারিকা। মেরেদন্ড বেয়ে গরমের তাপে জমে থাকা ঘাম বেয়ে বেয়ে গড়িয়ে পড়তে শুরু করল। কপালেও জমে গেল। অন্ধকারের সাথে নীহারিকার সম্পর্ক কেন বিদঘুটে সে জানে না। অথচ ভারী আশ্চর্যের বিষয় নীহারিকা রাতে একা একাই ঘুরতে পারবে। তখন তার ভয় করে না। এই রোগ শুধু চারকোনার কামড়ায় তার ঘাড়ে চাপে। নিজেকে শক্ত করতে চাইল নীহারিকা। দু’ তিন বছর পুরনো সে হলে চিৎকার করে কেঁদে দেওয়ার চেষ্টা করত। যদিও সহজে তার লোচনে অম্বরের দেখা মিলে না। কিন্তু এখন যে নীহারিকা, সে যথেষ্ট শক্ত। কিন্তু বিদ্যুতের হলো কি? অনেক বছর ঘরে কারেন্ট যায় না। গেলেও দুই তিন মিনিট সর্বোচ্চ। নীহারিকা অপেক্ষা করবে দুই তিন মিনিট। তাই একটি গল্প মনে করার চেষ্টা করল। মনেও পড়ল। খুব ছোট বেলায় একবার দু’ দিনের জন্য বিদ্যুৎ গায়েব হয়ে গেল। মোমের সাদা অংশে ঘর ভরে গেল। নীহারিকার পড়ার টেবিলে একটি মোমের ব্যবস্থা থাকলেও সে চুপি সারে চারটি মোম জ্বালিয়ে দিয়ে ছিল। সেই মোম গলিয়ে হাতের তালুতে আলপনা একে ভয়ংকর কান্ড। মা যখন দেখল অনেক চিৎকার চেঁচামেচি করেছেন। বড় হওয়ার সাথে সাথে মা এখন আর আগের মত বকে না। গম্ভীর হয়ে রাগ দেখায়। নীহারিকা লক্ষ্য করতে চাইছে না তবুও তার ঠোঁট কাঁপছে। বুক টিপটিপ করছে। কয় মিনিট হয়েছে? আর কি গল্প মনে করা যায়। হ্যাঁ আরও একটি মনে পড়েছে। আগে বিদ্যুৎ চলে গেলে তারা খোলা আকাশের নিচে বসে গল্প করত। আনন্দ করত। দাদামশায় আর বাবা নামাজ পড়ত পাশেই। মাঝে মাঝে দাদামশাইয়ের কাঁধে উঠে যেত দুই ভাই বোন। সর্বনাশ। সর্বাঙ্গ ঘেমে একাকার নীহারিকার। তার মাথা ঝিমঝিম করছে। চোখ হয়ে আসছে ঝাপসা। নীহারিকা লক্ষ্য করল চার্জ লাইট হাতে ছুটে রুমে ঢুকছে বাবা। আলোর ঝলক চোখে পড়তেই জ্ঞান হারালো নীহারিকা। অদ্ভুত ভাবে তার চোখে আগুন লাল বিমুগ্ধের আর তার বাবার সাদা আলোর চার্জ লাইটে বেষ্টিত মুখশ্রী ভেসে উঠল। বিমুগ্ধকে কেন মনে পড়ছে? জ্ঞান হারাতে হারাতে একবার নীহারিকার মুখ পিলে চমকে উঠে ছিল।

চোখ মেলে লক্ষ্য করল ঘরে আলো আর আলো। বাবার চোখে মুখে আতঙ্ক। বাবাকে কখনো ভয় পেতে দেখেনি নীহারিকা। দেখলেও এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। তিনি ব্যতিব্যস্ত গন্ঠে বললেন,’ ঠিক আছিস মা?’ বলেই মাথায় হাত বুলিয়ে দিল নীহারিকার। মাথা নাড়ল সে। অনুভব করল বাবা নামক এই প্রানীটি তাকে অসম্ভব ভালোবাসে। যার সাথে প্রতিযোগীতায় কেউ টিকে থাকতে পারবে না। কখনোই না। প্রিয়ম ছুঁটে এসে বলল,’ বাবা দাদামশায় অদ্ভুৎ আচরণ করছে। বুকে না কি প্রচুর ব্যথা। মুখে কথা বলতে পারছে না। ঠোঁট মেলতে বললাম তাও পারছে না। দাঁতের সাথে দাঁত লেগে রয়েছে। আমি কিছু বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে…’
আর কথা শেষ করতে পারল না প্রিয়ম। মায়ের চিৎকার শোনা যাচ্ছে। বাবা এক প্রকার বদ্ধ উম্মাদের মত ছুঁটে গেলেন। নীহারিকা হতবিহ্বল। সে বিছানা থেকেই নামছে না। দম কেমন যেন থেমে থেমে যাচ্ছে। নিজের মাঝে শ্বাস প্রশ্বাসের কমতি উপলব্দি করছে সে। নীহারিকার বুকটাও কেমন যেন করছে। প্রিয়ম আবার ছুঁটে এসে বলল,’ আপু তুই যাবি হসপিটালে? বাবা দাদামশায়কে নিয়ে গেল। আমিও যাচ্ছি।’
নীহারিকা নিজের সব অসুখবিসুখ ছাড়িয়ে লাফিয়ে উঠল। তারও যেন জ্ঞান শূন্য হয়ে আসছে। কি নিবে কি পড়বে খুঁজেই পেল না। বোরখা পড়ার কথা সে ভুলেই গেল। প্রিয়মেরও মনে নেই। মাথায় ওড়না প্যাঁচিয়ে বের হয়ে আসল। ঘরের পোশাকে আবৃত সে। প্রিয়ম অর্ধ রাস্তায় এসে দেখল তার বোন কাঁপছে। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। আবার ঘরের দিকে সিএনজি ঘুরিয়ে নিতে ব্যস্ত হয়ে বলল ডাইভারকে। এতে ক্রুদ্ধ হয়ে রইল নীহারিকা। প্রিয়ম এক ছুটে ঘরে গেল। তালা ঝুলিয়ে আবার ফিরে এলো। লম্বা শীতের চাদর বোনের গায়ে জড়িয়ে তাকে দু’ হাতে জড়িয়ে ধরে নিয়ে বলল,’ মনে হচ্ছে তোকেও হসপিটালাইজড করতে হবে। এমন করছিস কেন?’
‘ কি করছি।’ অবাক হয়ে মাথা তুলে বলল নীহারিকা। প্রিয়ম ঝুঁকে এসে বলল,’ আপু তোর শরীর এভাবে কাঁপছে কেন? গলা থেকে কেমন যেন শব্দ আসছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে? ’
‘ না। মিতু আপু কই? কটা বাজে রে?’
‘ বাজে এখন এগারোটা। মিতু আপু মায়ের সাথে গিয়েছে। তুই দুপুর একটার একটু পরে থেকে রাতের দশটা পর্যন্ত ঘুমিয়েছিস। ব্রিলিয়ান্ট বোন আমার।’
‘ বকছিস কেন? আমি তোর ছোট?’
‘ বড় হয়ে উদ্ধার করেছিস। গাঁধা অসভ্য একটা। নেহাত দাদামশায় তোর প্রান প্রিয়। নয়লে কখনো নিতাম না। গরু।’ প্রিয়ম লক্ষ্য করল তার বোন তেমন কোন প্রতিবাদ করছে না। ঝগড়াও করছে না। শান্ত হয়ে বসে আছে সে। এটি নিতান্ত্বই আশ্চর্যের বিষয়।

হসপিটালের করিডোরে বসে বসে মিতু আপু ঝিমুচ্ছে। দিনেও ঘুমাতে পারেনি তিনি। বিগত কিছু দিন ঘুমের সাথে দেখা সাক্ষ্যৎ নেই। আজ চরম আকারে ঘুম আসছে। অথচ দাদামশায়ের জীবন মৃত্যু লড়াই। নীহারিকা একদম চুপ করে আছে। একটু পরে সে নিরবতা ছেদ করে বলল,’দাদামশায় ঠিক হয়ে যাবে তো মিতু আপু?’
মিতু আপু সান্ত্বনার ছলে বলে বলছেন,’ ধুর বুড়ার কিছু হবে না। যথেষ্ট শক্ত আছে। তুই জানিস আমারে কি ঝাড়িটাই না দিল আজ। মনে হচ্ছে বুড়ারে রেখে পালাইছি আমি।’ নীহারিকা হাসল না। সে মুখ ভার করে বসে রইল। অনেক্ষণ পরে রুম থেকে জাওয়াদ কে বের হতে দেখা গেল। চোখ লাল। মুখ লাল। ঘুম হয়নি বোধ হয়। নীহারিকার তেমন আগ্রহ নেই। জাওয়াদ নাফিজ উদ্দীনের সাথে গুরুতর ভঙ্গীতে কিছু কথা বলে নীহারিকার পাশে এসে দাঁড়াল। তারপর বসল। আশ্চর্য নীহারিকার হেল দোল হলো না। মেয়েটা এমন কেন? জাওয়াদের বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে আসলেও সে বেশিক্ষণ বিরক্ত হতে পারল না। নীহারিকার চোখ মুখও কেমন কেমন।
‘ মন খারাপ?’ ধীর কন্ঠ জাওয়াদের। চোখ তুলে এক পলক দৃষ্টি নিবন্ধন করল নীহারিকা। জাওয়াদ আশ্বস্ত করে বলল,’ ভালো হয়ে যাবে। চিন্তার কিছু নেই।’
‘ অপারেশন আপনি করছেন?’ নীহারিকার সহজ স্বর। জাওয়াদ ক্ষনিকের জন্য চমকে গিয়ে বলল,’ তুমি কিভাবে জান অপারেশন করতে হবে?’
‘ উত্তর দিন তো। ফালতু কথা বলা বন্ধ করুন।’
‘ না। আমি করছি না।’ পিছনে হেলান দিয়ে বসল জাওয়াদ। সারা দিনের ক্লান্তি তার অস্তিত্বে ভর করেছে। নীহারিকা কিছুক্ষণ লাল রঙ্গা মুখটির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,’ শুনেছি আপনি খুব ভালো সার্জেন। অপারেশ স্কিল দারুন। সার্জারিতে কম ভুল হয়। কেন করছেন না দাদামশায়েরটা?’
নিজের সম্পর্কিয় এত সুন্দর গুনগান শুনে খুশির সাথে আশ্চর্য রকমের চমকে গেল জাওয়াদ। ডাক্তারী জীবনের এই মোটামুটি সময়টিতে এটি তার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি মনে হচ্ছে। নীহারিকা! নীহারিকা তার সম্পর্কে এমন দারুন অনুভূতি পোষণ করে তা কল্পনাতীত। হতভম্ভ, চমকিত হয়ে অবিশ্বাস্য নয়নে নীহারিকার দিকে তাকিয়ে রইল সে। এই মেয়েটিকে সে সত্যি খুব ভালোবেসে ফেলেছে। একটু বেশিই।
‘ কি হয়েছে? ভুত দেখার মত তাকিয়ে আছেন কেন? সার্জারি করবেন?’ বেশ উত্তেজিত নীহারিকা। জাওয়াদ ঠোঁটে হাসলো। বলল,’ আমি সাথে থাকব। ডাঃ রেজা করবেন অপারেশন। আমার স্যার হন তিনি। তার ক্যারিয়ারে আমার থেকেও বেশি প্রাপ্তি। ডোন্ট ওয়ারি।’
মন খারাপ করে তাকাল নীহারিকা। এই মানুষটাকে অপছন্দ করলেও কেন যেন বিশ্বাস হচ্ছে। মন বলছে এনার থেকে ভালো সার্জন হয় না। মানুষজাতির মন বড়ই অদ্ভুত। বিশ্বাস, ভরসা গুলো কখন কার জন্য তৈরি হবে বলা বড্ড দুষ্কর।
___________________
ঠকঠক শব্দে ক্লান্ত চোখ খুলে গেল নীহারিকার। কড়া মেডিশিনের গন্ধে শ্বাসনালী যেন থেমে রয়েছে। হাত ব্যথা হয়ে আছে। কারণ জানতে নীহারিকা সোজা হয়ে বসল। হাতের দিকে তাকিয়ে সে অবাক। দাগ হয়ে আছে। সামনে কারো হাঁটার শব্দ হচ্ছে। করিডোর জুড়ে অন্ধকারবাতি। ভয় হতেই নীহারিকা বাবার প্রতিবিম্ব দেখতে পেল। তিনি গম্ভির সত্তায় পাইচারি করছেন। ঘুম বিশ্রাম ত্যাগ করেছেন বেশ আগেই। ছেলে মেয়ে বাবা মায়ের জন্য ঘুম নষ্ট করবে এটা আহামরি কিছু নয়। বেশ ভালো কাজ। নীহারিকার দারুন লাগল। কিছুক্ষণ সে আরাম করে পা মেলে সেই দৃশ্য অবলোপন করল। বাবার চূড়ান্ত পর্যায়ের চিন্তিত মুখ তাকে হঠাৎ করে হাসাল। তার পরনের সাদা শার্টের উপরে কালো চেক। কুঁচকে আছে সেই শার্ট। আয়রন ছাড়া পোশাক পড়ার একদম অভ্যাস নেই বাবার। অথচ আজ তিনি একদম সেই বিষয়ে নিজেকে খাটাচ্ছেন না। অপর প্রান্তের রুমের মানুষটা বাবা বলে? কি আশ্চর্য! নীহারিকার মনে হচ্ছে কেউ বেশ সময় নিয়ে পিছন থেকে আসছে। কিন্তু তার তাকাতে ইচ্ছে করছে না। চিন্তিত একটি ছেলেকে দেখতেই ভালো লাগছে। প্রিয়ম সামনের ব্যঞ্চিতে আরাম করে লম্বা হয়ে ঘুমচ্ছে। হসপিটালে জাওয়াদদের শেয়ার থাকায় সে একটি কেবিন অলরেডি ভাড়া নিয়ে দিয়েছে। যেখানে সকালে দাদামশায়কে রাখা হবে। অপারেশন করতে একটু সময় লাগবে। ব্লাড প্রেশার হাই সেটা নরমাল করার চেষ্টা চলছে। কেবিনে আফিয়া বিলকিস আর মিতু আপুর অবস্থান। জাওয়াদ নিজের কেবিনে যাওয়ার জন্য নীহারিকার পিছনে ঘুরল কিছুক্ষণ। কিন্তু অফারটা দিতেই পারল না। মেয়েটা মাত্রাঅতিরিক্ত রগরগা। হুট করে রনচন্ডি মস্তিষ্কে ভর করে। দাদার প্রতি বিশেষ দূর্বল। জাওয়াদ আল্লাহ আল্লাহ করছে। দাদামশায় সুস্থ হলেই তাকে পাটাবে। কিছুমানুষের কাছে তাদের দূর্বলতা ধরেই এগিয়ে যেতে হয়। পিছনে ফিরে আবছা আলোয় নীহারিকা পিলে চমকে উঠল। সে কি এখন বিমুগ্ধ নামক এই বান্দাকে রাত দিন দিবা স্বপ্ন দেখে? দু’ হাতে চোখ ঠিক করে নীহারিকা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইল। সাদা টিশার্টের উপরে হাটুর নিচ সমান লং নেবি ব্লু শার্ট। ছাই রঙ্গা থ্রি কোয়াটার সাথে কালো স্লিপার। হাটুর নিচের অংশ থেকে পা পর্যন্ত দৃশ্যমান। অসম্ভব সুন্দর পা জোড়া চমৎকার দেখাচ্ছে। হাতে পায়ে সাদা ব্যান্ডেজ। কেমন অদ্ভুৎ ভাবে হাঁটছে। পোশাকের অবস্থা আরও অদ্ভুৎ। এটা কেমন বেশ ভুশা? কয়েক মুহূর্তের জন্য বেক্কেল হয়ে গেল নীহারিকা। পোশাকের এমন অভিনব মিলন দৃশ্য সে এই জীবনে দেখেনি। মুখশ্রীতে ঘুমের রেশ। উসখুস চুলের বাহার। দেখেই বুঝা যাচ্ছে কেউ কলার ধরে উঠ বেটা আজ তোর খবর আছে, বলে টেনে তুলে হসপিটালে নিয়ে এসেছে। তার মাঝে চিন্তার চেয়েও বিরক্তি বেশি। আরে এটা তো বিমুগ্ধ নয়। সে তো কখনো বিরক্ত হয় না। তাযিন? নিজের পাগলামি বেশ ধরতে পারছে নীহারিকা। মাথাটা ব্যথা করছে। ঝিমঝিম করছে। সব ঝাপসা মনে হচ্ছে। দু’হাতে মাথা চেপে চুপ করে নিচু হয়ে গেল সে। এখন একদম নিশ্চুপতার প্রয়োজন। পাশের মানুষটি কে ছিল? নীহারিকার সর্বাঙ্গ অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে অদ্ভুৎ কিছু হবে। এটা কল্পনা হতেই পারে না। স্বপ্ন কখনো এতটা জীবন্ত হয় না। সত্যি হয় না। কি করছে সে হসপিটালে? চোখ বড় করে সেদিকে তাকিয়ে রইল। সব পরিষ্কার হচ্ছে। চোখের সামনে ঠকঠক শব্দ তুলে তাকে উপেক্ষা করে কয়েকটি পা এগিয়ে গেল। কিংকর্তব্যবিমূঢ় নীহারিকা!
______________
চলবে………….
ভুলত্রুটি আল্লাহর দেওয়া মহান গুন ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টি দিয়ে দেখবেন। নিশ্চুয়ই ক্ষমা একটি সুন্দর গুন।
#হাফসা