প্রিয় সুখ-২৮
__________
ট্রলি গুলো একটি একটি করে ঘরের ভিতরে একা হাতে টেনে নিচ্ছে রুবাইদা। তাকে ঘিরে পরিবারের সবার অতি আগ্রহকে সে উপেক্ষা করছে পুরো দমে। সে যেন নিজের বাড়িতে এসেছে। বেশিরভাগ সদস্য তাকে চিনতে পারল না। নাফিস উদ্দীন ব্যস্ত হয়ে বলে উঠলেন,’ আরে কে আপনি? এখানে কি করছেন? এভাবে বাড়িতে ঢুকে পরছেন কেন?’
রূবাইদা চোখ ছোট করে বলল,’ আমি আমেরিকা থেকে এসেছি। খুব টায়ার্ড। বাহিরে দাড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে না তাই ঢুকে পড়েছি আঙ্কেল।’ নাফিস উদ্দীন বাক্যহারা হয়ে গেলেন কয়ে মুহূর্তের জন্য। একটি মেয়ে আমেরিকা থেকে তাদের বাড়ি কেন আসবে? চিন্তিত সুরে তিনি এবার বললেন,’ আপনি আমাদের বাড়িতে কেন এসেছেন জানতে পারি?’
‘ আপনি আমাকে চিনেন না আঙ্কেল? আমি রূবাইদা। আপনি নিশ্চয় নীহারিকার বাবা? আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল।’ রূবাইদা মিষ্টি করে হেসে সোফার গায়ে বসে পড়ল। নাফিস উদ্দীন নীহারিকার দিকে তাকিয়ে বললেন,’ তোমার বান্ধবী?’ নীহারিকা সাথে সাথে বাজখাঁই গলায় উত্তর দিল,’ ভুলেও না। তোমার ভাইয়ের ছেলের বউ।’ মিতু আপু ফোঁড়ন কেটে বললেন,’ হবু বউ। মানে হবে হবে ভাব হওয়ার অভাব মাত্র।’ তারপর তিনি পা থেকে মাথা পর্যন্ত জিন্স, টপস পড়া রূবাইদাকে দেখে নিলেন। তারপর আশেপাশে চোখ বুলিয়ে তাযিন ভাইকে খুঁজলেন। কিন্তু কি আশ্চর্য এতো ভয়াবহ মুহূর্তে সেই বান্দা নিরুদ্দেশ। হবু বউ আমেরিকা থেকে রাতের দু’ টো বাজে এসে বাড়ির মানুষকে হরর অনুভূতি দিচ্ছে আর উনি পরে পরে ঘুমচ্ছেন! আজব মানুষ। নাফিস উদ্দীন আর কিছুই বললেন না। তিনি চিন্তা করতে পারছেন না বাড়িতে হচ্ছে কি? এখন এই মেয়েও এখানে থাকবে? বিয়ের আগেই? তিনি আর কিছু না বলে নিজের রুমের দিকে চলে গেলেন। কিন্তু রাবেয়া ফুফু ছাড়লেন না। তিনি তার উচু গলায় বললেন,’ এই বাড়িতে তুমি থাকবে? শুনেছি তোমাদের তো বিয়ে হয়নি। আর বিয়ে না হলে শ্বশুর বাড়িতে থাকা তো অনুচিৎ। তার উপরে এটা তোমার দাদাশ্বশুর বাড়ি।’ রূবাইদা বিরক্ত হলো বোধহয়। বলল,’ আমি নবীন আঙ্কেলকে বলে এসেছি। তায কোথায়?’
‘ আমেরিকা থেকে তুমি সোজা একজনের বাড়ি চলে আসলে তোমার বাবা মা কোথায়?’ রাবেয়া ফুফুর মুখ ভালো না। আফিয়া দ্রুত হাত টেনে ধরলেন। কানে কানে বললেন,’ চুপ করুন আপা।’
‘ চুপ কেন করব? আবার আমাদের ছেলেকে খুঁজে মরছে। ছিঃ। ‘ রাবেয়া ফুফুর এমন ছিঃ ছিঃ টাইপ চাহনীকে একদম পাত্তা দিলো না রূবাইদা। সে প্রচন্ড বিরক্ত এসবে। এখানে এসেছে খুবই ঝামেলায় পড়ে। এদের জন্যেই মূল ঝামেলা। কোথা থেকে যে এমন পরিবার যোগাড় করে নিয়েছে তায সে ভাবতে পারছে না। তার মাথা ধরেছে। আফিয়া ব্যস্ত হয়ে পড়লেন মেহমানদারীতে। বললেন,’ তুমি ফ্রেশ হয়ে এসো। আমি খাবার দিচ্ছি। নীহু যা রুম ঠিক করে দিয়ে আয়।’
নীহারিকা রূবাইদার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। এই মেয়েটিকে কোন একটি কারণে তার অসহ্য লাগে। পৃথিবীতে কাউকে অপছন্দ বা অসহ্য মনে করতে নেই। তাহলে তাদের সাথেই থাকতে হয়। নীহারিকার জীবনের সবচেয়ে বড় আক্কেল হয়েছে। এ জীবনে আর কখনো কোন মানুষকে মনে মনেও সে অপছন্দ করবে না। সব গুঁছিয়ে নিতেই রূবাইদা রুমে ঢুকল। নীহারিকার দিকে সে কেমন যেন করে তাকাচ্ছে। নীহারিকা এসব নিয়ে একদম ভাবছে না। তার প্রচন্ড রাগ উঠছে। শুধু শুধু কেন রাগ উঠছে বুঝতে পারছে না। রূবাইদা পথ আগলে প্রশ্ন করল,’তায কোথায়?’
নীহারিকা অবাক হয়ে গেল। কোন কথা নেই বার্তা নেই ডিরেক্ট এভাবে কেউ জিজ্ঞেস করে? নীহারিকা মুখটা স্বাভাবিক রেখে বলল,’ আমি জানি না।’ একটি মিথ্যে কথা বলল নীহারিকা। সে জানে বিমুগ্ধ পড়ে পড়ে ঘুমচ্ছে তারই রুমে তারই বিছানায়। কিন্তু সে বলল না। কেন তাও জানে না। অথচ তার একটুও অনুতপ্ত অনুভব হচ্ছে না। তার বেশ ভালো লাগছে। মাঝে মাঝে মিথ্যে বলে যে ভালো থাকা যায় এটি তার প্রমান। নীহারিকা মৃদু হাসল। রূবাইদা তার সোনালী চোখ দিয়ে নীহারিকাকে গিলে খাচ্ছে। তার বরফ রঙ্গা গাল লাল হয়ে আছে। নাক ফুলিয়ে বলল,’ কেউ জানে না সে কোথায় এটা কেমন কথা নীহারিকা? তোমাদের বাড়ি থেকে কি একজন মানুষ উধাও হয়ে গেছে?’
‘ তার খবর নিয়ে তো আমরা ঘুরি না।’ নীহারিকার কণ্ঠে একরাশ বিরক্তি। রূবাইদা বিছানায় বসে ফোন বের করল। একের পর এক কল করল। তারপর নীহারিকাকে আবার জিজ্ঞেস করল,’ তাযের রুম কোনটি?’
‘ যেটিতে সে আছে।’
‘ সেটি কোনটি?’
‘ তা আমি কিভাবে বলব? আপু আপনি যদি বেশি চিন্তিত হয়ে থাকেন তাহলে ঘরে ঘরে ঘুরে দেখতে পারেন।’
নীহারিকা যেতে চাইছে। রূবাইদা কথার মাঝে আঁটকে বলল,’ তায জেগে আছে। সে ইচ্ছে করে এসব করছে।’
‘ কিভাবে বুঝলেন জেগে আছে?’ মিতু আপু রুমে এসে পড়েছে। রূবাইদাকে তার ভালো লাগত। কিন্তু এখন আর লাগছে না। মানুষের পছন্দ গুলো হওয়ার বেগে পরিবর্তন হয়।
‘ কারণ তায এতো দ্রুত ঘুমায় না।’
‘ দ্রুত!’ মিতু আপু চোখ উল্টে নিলেন। নীহারিকা এদের এসব কথায় ঢুকতে চাইছে না। সে চলে যাওয়ার ধান্ধায় আছে।
‘ নীহারিকা তুমি কি সত্যি বলতে পারবে না তায কোথায়?’ নীহারিকার রাগ এতো বেশি হচ্ছিল যে তার ইচ্ছে করছিল টেবিলের উপরে রাখা ফুলদানি ছুঁড়ে দিতে। নিজেকে শান্ত করে সে বলল,’ অন্যের রুমে রয়েছে। সেটি আপনি কষ্ট করে খুঁজে নিবেন। আমাদের দেশে এখন অনেক রাত আপু। খুব ঘুম পাচ্ছে।’
নীহারিকা হাই তুলতে তুলতে রুম ছাড়ল। মিতু আপু বলল,’আপনার তাযিন ভাইকে এতো প্রয়োজন কেন? বাড়ি থেকে পালিয়েছেন?’
‘ পালাব কেন?’
‘ এভাবে তো মেয়েরা রাতে কারো বাড়ি আসে না তাই জানতে চাইলাম।’
‘ বাংলাদেশের এসব আমাদের দেশে চলে না। এমন কিছুই নয় মিতু আপু। তুমি বরং তাযের খবর দেও।’
‘ দুঃখিত আপু আমি সাংবাদিক নই। আমি মিতু আপু। জগৎের আপু। ছোট বড় সবাই আপু ডাকে। যেমন আপনি ডাকলেন। আপু ধরনের মেয়েরা ভাইয়াদের খবর রাখে না। আসি। শুভ ঘুম।’
মিতু এক ছুঁটে ছাদে। রূবাইদা অনেক গুলো রুম খুঁজল। বেশি রুম খুঁজে দেখা হলো না। আনজুমকে পেয়ে গেল। আনজুম অবাক হয়ে বলল,’ তুমি কি খুঁজে চলেছ রূবাইদা?’
‘ তাযকে। তুমি দেখেছ?’
‘ সে তো ঘুমে।’
‘ ঘুম? মানে কি? এতো তাড়াতাড়ি?’ রূবাইদার মুখ হা। আনজুম হেসে বলল,’ দাভাই নয়টার আগে ঘুমিয়েছে। তুমিও ঘুমিয়ে পড়ো। কাল দেখা করবে।’
‘ তুমি কি যান তায কি করেছে?’
‘ কি করেছে?’ না জানার ভান করে বলল আনজুম। প্রকৃত অর্থে সে জানে। রূবাইদা মুখটা ভীষণ করুন করে বলল,’থাক তোমাকে যেহেতু তায বলেনি আমিও বলতে চাইছি না। এরিকের সাথে কথা হয়? সে বাংলাদেশে আসছে। তুমি জানো?’
আনজুম উত্তর দিল না। সে নিজের রুমের দিকে হাঁটা দিয়েছে। এরিক তার জীবনে একটি অসম্ভব অধ্যায়ে রূপ নিচ্ছে। পৃথিবীতে খুব সহজ অধ্যায় গুলো হয়ে পড়ে চূড়ান্ত কঠিন।
_________________
ফজরের আজান পড়েছে চারপাশে। বাড়ির কাছে মসজিদ হওয়ার ফলে আজানের সুরের শব্দ উচ্চ শব্দে ভেসে আসে। আফিয়া বিলকিস উঠে পড়লেন। তার সাথে নাফিস উদ্দীনও বিছানা ত্যাগ করে ওজু করে নিয়ে সাদা পাঞ্জাবি গায়ে রুম থেকে বের হয়ে প্রথমে গেলেন মেয়েকে ডাকতে। সকালে উঠে মেয়ের মুখশ্রী দেখতে তার ভালো লাগে। নীহারিকা উঠতে একটু সময় লাগায়। তাই তিনিই ডেকে উঠান তাদের। দরজায় করাঘাত করছেন তিনি। উচ্চ শব্দে ডাকছেন। বিমুগ্ধ গভীর ঘুমে বিভোর। কেউ তাকে এত আগ্রহ নিয়ে ডাকছে তার কর্ণবিবরে সেটি এসে পৌছাচ্ছে ঠিক। কিন্তু তার উঠতে ইচ্ছে করছে না। এত সকালে কার মাথায় সমস্যা হয়েছে? বিমুগ্ধ এতো কড়া শব্দে প্রচন্ড রেগে গেল। তাকে কেউ কখনো এত সকালে ঘুম থেকে উঠায় না। খুব কম সে উঠে। যখন ঘুম কম হয় তখন। আজকের মত এতো মধুর ঘুম তার জীবনে আর আসেনি। সে একটু ঘুমতে চাইছে। কানের উপরে রাখা কুশন আরও চেপে ধরল সে। উপুত হয়ে শুয়ে সে বিছানার গভীরে মুখ গুঁজে নিয়েছে। কিন্তু অসহ্য শব্দ তাকে ঘুমতে দিচ্ছে না। বিরক্ত রাগ মিশিয়ে সে লাফিয়ে উঠল। ধারাম করে দরজা খুলে সে চেঁচাল,’ সমস্যা কি? এতো সকালে কেউ ডাকে?’ নাফিস উদ্দীন একদম চমকে গেলেন। তিনি তো ভুলেই বসে ছিলেন তার মেয়ে এখন এই রুমে নেই। বিমুগ্ধকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে তিনি অবাক হয়ে গেলেন। সারাদিন কি সব পাগলাটে পোশাক পড়ে ঘুরে বেড়ানো ছেলেটা সাদা পাঞ্জাবি পড়ে দাড়িয়ে আছে। তিনি বিমুগ্ধের ঘুমন্ত মুখশ্রী দেখে আরও অবাক হয়ে গেলেন। বিমুগ্ধকে পাঞ্জাবিতে তার ভাইয়ের প্রতিবিম্ব লাগছে। চোখের উপরে একটি হাত দিয়ে সে ভালো করে দেখার চেষ্টা করছে। কে এসেছে? আদো আদো চোখে ভালো করে তাকিয়ে সে আরও অসহ্য অনুভব করল। নাফিস উদ্দীন প্রশ্ন করলেন,’ তুমি নামাজ পড়ে নিয়েছ?’
বিমুগ্ধ কিছু না ভেবেই বলে ফেলল,’ এই সময় কিসের নামাজ?’ আশ্চর্য হয়ে গেলেন নাফিস উদ্দীন। বিমুগ্ধের দিকে তিনি এমন এক দৃষ্টিতে তাকালেন যেন ভুত দেখেছে। বিমুগ্ধ এবার প্রচন্ড পীড়ায় ভুগছে। ঘাড়ে হাত বুলিয়ে সে বলল,’ কিছু বলবেন আপনি?’
‘ তুমি নামাজ পড়ো না? ‘ তিনি এখনও অবাক।
অমসৃণ কন্ঠে বিমুগ্ধ বলল,’ কেন পড়ব না? মুসলিম যেহেতু নামাজ তো পড়িই। কিন্তু এতো ভোরে কিসের নামা….’
বিমুগ্ধ থেমে গেল। তার সব ঘুম উড়ে গেল মুহূর্তে। ফজর নামাজ তার জীবন দশায় সে খুব কম পড়েছে। বাকি গুলো কম বেশি পড়া হলেও ফজর নামাজে তার প্রচন্ড অলসতা। কারণ ঘুম। ছোট বেলায় যখন বাংলাদেশে ছিল তখন অল্প অল্প পড়ত। কিন্তু বিদেশ যাওয়ার পরে একদম বাদ দিয়ে দিয়েছিল। এখনও তেমন পড়ে না। বিমুগ্ধ এই প্রথম নাফিজ উদ্দীনের সামনে বিব্রত বোধ করছে। মুখে হাত বুলিয়ে পাঞ্জাবির হাতা সোজা করে সে কেশে নিল। ধর্মের উপরে তো আর কিছু নেই। এর উপরে কথা বলাও যাবে না। তাই সোজা হয়ে দাড়িয়ে গেল ভালো ছাত্রের মত। মিষ্টি গলায় বলার চেষ্টা করল। কিন্তু একটুও মিষ্টি গলা এলো না। গাম্ভির্য্যে ভরা কণ্ঠ তার,’ আপনি কি আমাকে নামাজের জন্য ডাকতে এসেছেন?’
নাফিজ উদ্দীন কেমন চোখে যেন তাকিয়ে আছে। যেন বিমুগ্ধ একটি নোংরা মানুষ। তিনি চাপা গলায় বললেন,’না। আমার মেয়েকে ডাকতে এসেছিলাম। তুমি যে এই রুমে ভুলে গিয়েছিলাম। পাঞ্জাবি পড়ে ছিলে তাই ভেবেছি নামাজ পড়েছ। দুঃখিত।’ বিমুগ্ধ চোখ মুখ কুচকালো। এত বয়স্ক একজন মানুষ এতো সহজে দুঃখিত বলে দিলো? অথচ এই কাজ সে কখন করত না। এই প্রথম তার মনে হচ্ছে এই মানুষটার মাঝে ভালো একজন মানুষ আছে। বিমুগ্ধ ঈষৎ হাসল। ঠোঁটে হাত বুলিয়ে বলল,’ মসজিদে যাবেন? অপেক্ষা করতে পারবেন? আমি পাঁচ মিনিটে আসছি। আমি এদিকের কিছুই চিনি না।’ নাফিজ উদ্দীন এতটাই বিহ্বল যে শুধু মাথা নাড়লেন। বিমুগ্ধ রুমে ঢুকে একদম মুখের উপরে দরজা লাগিয়ে দিল। নাফিস উদ্দীনের বিহ্বল ভাব কেটে গেল। মনে মনে তিনি বললেন,’ চূড়ান্ত বেয়াদপ।’
মসজিদে এসে একটি ভয়ংকর ঘটনা ঘটল। সকলে বিমুগ্ধকে ঘিরে ধরল। তাদের আগ্রহের শেষ নেই। বিমুগ্ধ এসবে নির্বাক হয়ে আছে। মানুষ তাকে এতো প্রশ্ন করছে সে কিছুর উত্তর দিলো না। চুপ করে শুধু নিচের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। এই এলাকায় নাফিস উদ্দীনরা বড় হয়েছে। ফলে সবাই তাদের চিনে। সকলে খুব পরিচিত তাদের। বিমুগ্ধের এহেন কান্ডে প্রিয়ম তার বাবাকে বলল,’ তাযিন ভাইয়া একটু অদ্ভুৎ বাবা। তবে খুব বেয়াদপ।’ নাফিস ছেলের দিকে চোখ রাঙ্গানী দিলেন। সে চুপ করে আছে। বিমুগ্ধ কারও সাথে কথা বলছে না। সবাই তাকে প্রশ্ন করে মনে মনে ভাবছে সে বোবা। কেউ কেউ তো বলেও দিল। প্রিয়ম মজা পেয়েছে। সে মিটমিট হাসছে। নাফিস উদ্দীনকে এবার প্রশ্ন করা শুরু করেছে সবাই। এক বয়স্ক লোক বললেন,’এই বিদেশি ছেলেটা কে নাফিস?’ নাফিস উদ্দীন হাতের তসবি গুনতে গুনতে বললেন,’ নবীন ভাইয়ের ছেলে।’ সবার চোখে মুখে কৌতুহল খেলা করছে। বিস্মৃত হয়ে সবাই আরও ঘিরে ধরল বিমুগ্ধকে। বিমুগ্ধ এখনো স্বাভাবিক। তার চেহারায় তেমন কিছু প্রকাশ পাচ্ছে না। যেন মানুষের কাজ প্রশ্ন করা আর তার কাজ চুপ করে শুধু শুনা। এবার বয়স্ক লোক বললেন,’ আহারে কত বছর পরে ফিরে এসেছে। ছেলেটা বোবা তাই নারে নাফিস? তোর বাবা যে মনে কষ্ট পেয়েছে এর ফল মনে হয়।’
‘ আমার বাবা কখনো কাউকে বদদোয়া দেয় না চাচা।’ নাফিস উদ্দীন বেশ রেগে গেলেন। এই ছেলে কথা বলছে না কেন? বললেই তো হয়। ভদ্রলোক জীভ কাঁটলেন। বললেন,’ দুঃখিত বাবা। আমি বুঝাতে চেয়েছি বাবা মাকে কষ্ট দিয়ে কেউ সুখি হয় না।’ বিমুগ্ধ এবার সকলের সামনে থেকে উঠে গেল। তরুন সমাজ হা করে তাকে দেখছে। বয়স্ক সমাজ আফসোস করছে। বিমুগ্ধ উঠে দাঁড়িয়ে নিজের চাচ্চুর দিকে তাকিয়ে বলল,’ আপনার হয়েছে? না আরও কিছুক্ষণ থাকবেন?’ উপস্থিত সবার মাথায় যেন বাজ পড়লো। এমন দৃষ্টি সকলের। কথা বলছে? তাও বাংলায়? বিস্ফারিত হয়ে একজন বললেন,’ তুমি কথা বলতে পারো?’ বিমুগ্ধ তার দিকে তাকিয়ে রইল। লোকটি ভয় পেয়ে একটু চুপ করে গেল। নাফিস উদ্দীন উঠে বলল,’চলো।’
সবাই যাওয়ার সময় নাফিস উদ্দীন শুনলেন একজন বলছে,’ ছেলেটা অসভ্য অনেক। বিদেশে থেকে কোন শিক্ষাই দেয়নি এর বাপ মা। বদমাইশ বাচ্চা।’ নাফিস উদ্দীন শান্ত চোখে তাকিয়ে বললেন,’ বদমাইশ বাচ্চা নয় আমার ভাইয়ের বাচ্চা।’ বিমুগ্ধ হাঁটছিল। মাঝ পথে সে থেমে গেল। পিছনে ফিরে তাকিয়ে রইল। নাফিস উদ্দীন তো অনেক আগে তাকে ছাড়িয়ে চলে গেছে। কিন্তু সে সেই স্থানের দিকে চেয়ে আছে। প্রিয়ম পিছনে এসে বলল,’আপনার এসব শুনতে কি ভালো লাগে? সবাই আপনাকে বেয়াদপ, অসভ্য ছাড়া কিছু ভাবেই না।’
বিমুগ্ধ মাথা বাঁকিয়ে তাকিয়ে হাঁটা দিল। প্রিয়ম আবার পিছন পিছন এসে বলল,’ আপনাকে নীহুর উচিৎ ছিল ধাক্কা দিয়ে ছাদ থেকে ফেলে দেওয়া।’ বিমুগ্ধ এবার ঠোঁটে হাসল। অল্প, মৃদু তার ছোঁয়া। প্রিয়ম দৌড়ে এসে ধরল বিমুগ্ধকে। তারপর রাগে গজগজ করতে করতে বলল,’আমার বোন থেকে দূরে থাকবেন।’ বিমুগ্ধ এবার প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে কাঁধে হাত তুলে দিল। প্রিয়ম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,’ আপনাকে আমার খুব অসহ্য লাগছে।’
‘ জানি।’ বিমুগ্ধ এতক্ষণে মুখ খুলল। প্রিয়মের বুক চিরে একটা আনন্দ বেরিয়ে এলো। সেই একমাত্র ব্যক্তি যে কথা বের করতে পেরেছে। তবে সেটা প্রকাশ না করে বলল,’ আপনি আমার বাবাকে ধাক্কা দিয়েছিলেন। সে বয়সে এবং সম্পর্কে আপনার বড়।’
‘ তাহলে তুই চাইছিস আমি তার কাছে ক্ষমা চাই?’
‘ অফ কোর্স। তবে আপু চায় না।’
প্রিয়মের কথাটা মনে পড়ে খুব বিরক্ত লাগল। আপু কেন চায় না সে জানে না। শুধু জানে আপু চায় না বিমুগ্ধ বাবাকে স্যরি বলুক।
‘ কারণ তোর বোন চায় আমি মন থেকে অনুতপ্ত হয়ে তার বাবাকে স্যরি বলি। অথচ আমি মন থেকে অনুতপ্ত হতে পারছি না।’ বিমুগ্ধ হাত উঠেই রাখল। প্রিয়ম বিরক্ত হয়েও কিছু করতে পারছে না। বাবার আদেশ বিমুগ্ধের সাথে থাকা। থাকতেই হবে এখন। ওহ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল প্রিয়ম। দূর থেকে তাদের দেখতে সত্যি সুন্দর লাগছে। সাদা পাঞ্জাবিতে দুই ভাই মনে হচ্ছে। বিমুগ্ধ গেট পেরিয়ে ভিতরে ঢুকতেই একটানে নিজের পাঞ্জাবি খুলে ফেলল। প্রিয়ম হতবাক। পায়ের দিকে তাকিয়ে সে অবাক। কনভার্স পড়ে মসজিদে গিয়েছে! অথচ তার চোখে মাত্র পড়ল। বিমুগ্ধ নিজের পাঞ্জাবি প্রিয়মের মুখে ছুড়ে দিল। রেগে চিৎকার করল প্রিয়ম। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই বিমুগ্ধের। হাতা কাটা ঢোলা একটি লম্বা টি-শার্ট তার গায়ে। এখন তাকে মোটেও পাঞ্জাবির ভদ্র ছেলেটি লাগছে না। প্রিয়মের মুখ আরও হা। বিমুগ্ধ এক দৌড় লাগাল। প্রিয়ম পাঞ্জাবি হাতে চেঁচিয়ে উঠে বলল,’ আপনি কোথায় যাচ্ছেন? বাবা আপনাকে খুঁজলে আমি কি বলব? আজব কই যাচ্ছেন?’ এবার দ্রুত প্রিয়ম পাঞ্জাবি বাহিরের একটি চেয়ারে রেখে শুকনো জামাকাপড় থেকে নিজের একটি টি-শার্ট খুঁজে নিল। পাঞ্জাবি খুলে সেও দ্রুত দিল এক দৌড়। দৌড়ে দৌড়ে টি-শার্ট গায়ে জড়াচ্ছে সে। বিমুগ্ধ মনে হচ্ছে অলিম্পিকে এসেছে। এই ব্যক্তি এতো জোরে কিভাবে দৌড়াতে পারে!
‘ আপনি দৌড়াচ্ছেন কেন? জগিং করছেন?’ প্রিয়ম হাপাতে হাপাতে প্রশ্ন করল। বিমুগ্ধ একবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে নিজের কাজে মন দিলো। প্রিয়ম আবার দৌড়াতে শুরু করেছে। সে দেখতে চায় এই ব্যক্তি আর কি করতে পারে। কিভাবে চমকে দিতে পারে। কতটা অবাক করে দিতে পারে। বিমুগ্ধের কাছ ঘেষে শ্বাসরোধ করা কণ্ঠে বলল,’ আপনি এভাবে এলোমেলো গলিতে ঘুরছেন কেন? হারিয়ে গেলে বাবাকে কি বলব? আমাকে তো আস্ত রাখবে না।’
বিমুগ্ধ এবার হাসল। প্রিয়ম নিজের কথার দিকে এতো বেশি মনোযোগী যে এখনই ধাক্কার সম্মুখী হতো সে। বিমুগ্ধ বিরক্ত হয়ে গেল। টেনে ধরে একদম নিজের পাশে দাড় করিয়ে দিল। প্রিয়ম এতেও অবাক। বিমুগ্ধ সিরিয়াস ভাব নিয়ে বলল,’ তুই সত্যি ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়ছিস?’
‘ হ্যা।’
‘ মনে হয় না আমার।’
‘ আপনি জানেন আপনার গার্লফ্রেন্ড এসেছে কাল দু’টো বাজে।’
‘ জানি।’
‘ এতো রাতে কেউ মানুষের বাড়ি আসে? আপনারা বিদেশি মানুষরা ভদ্রতা জানেন না?’
‘ যে বাড়িতে এসেছে তারা কেউ ভদ্রতা জানে না। ফলে আমাদের জানারও প্রয়োজন নেই। তুই কি জানিস তুই একটু গাধা প্রকৃতির? এই যেমন তোকে আমার পিছনে ঘুরতে বলা হয়েছে আর তুই ঘুরছিস।’ বিমুগ্ধ এটা বলেই আবার দৌড়। প্রিয়ম প্রথমে বুঝল না। সে দাড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। যখন বুঝতে পারল বিমুগ্ধ তাকে গাধা বলেছে তখন এক দৌড় দিয়ে চেঁচাতে লাগল,’ এই এই দাড়ান। দাড়ান বলছি।’ বিমুগ্ধকে আর কে পায়। কিন্তু প্রিয়ম আজ হাল ছাড়ছে না। মনে মনে ঠিক করেছে সুযোগ বুঝে একটা ঘুষি দিয়ে চোয়াল বাঁকিয়ে ছাড়বে সে। সকলের সাথে শত্রুতা করারই যেন বিমুগ্ধের কাজ।
___________________
ডাইনিং টেবিলটি ছয় চেয়ারের হওয়ায় বেশি মানুষ বসার সুযোগ নেই। ফলস্বরূপ নীহারিকা সোফায় পা গোল করে বসেছে। সাধারণত সে টেবিলে খাবার খায় না। বিছানায় বা সোফায় বসে খেতে বেশি পছন্দ করে সে। নাস্তার টেবিল জুড়ে নিশ্চুপতা থাকলেও টুং টুং কাঁটা চামচ আর ছুরির শব্দ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে। নীহারিকা এবার উঠে দাড়িয়ে গেল। সকলের সামনে একটি প্রাণঘাতি কাজ করল। বিমুগ্ধের হাত থেকে হুট করে কাঁটা চামচ আর ছুরি টেনে নিয়ে নিল। বিরক্তিতে কাঁটা হয়ে বলল,’ হাত দিয়ে খেতে পারেন না? কি এমন খাবার যে এসব লাগে? অসহ্য শব্দ। হাত দিয়ে খেতে ইচ্ছে করলে খাবেন না হলে রুমে গিয়ে খাবেন।’ নীহারিকা সেই চামচ আর ছুরি নিজের সাথে নিয়ে সোফায় বসল। আফিয়া বিলকিস বড় বড় চোখে তাকিয়ে রইলেন মেয়ের দিকে। তারপর রাগে গজগজ করে বললেন,’ এগুলো কোন ধরনের অসভ্যতা?’
‘ অসভ্যতার কি দেখলে?’
‘ ছেলেটা খাবার খাচ্ছে। তুই ওর ছুরি চামচ নিয়ে নিলি কেন?’
‘ ছুরি চামচ নিয়েছি মা। উনার হাত না। ফলে উনি খেতে পারবে। অসুবিধার কিছু নেই।’ নীহারিকা মায়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল। গা জ্বলে গেল আফিয়ার। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,’ তোর বাবারে ডাকব?’
‘ মা একদম বাবার ভয় দেখাবে না। উনি যে খাচ্ছে আর শব্দ করছে আমার মনে হচ্ছে কেউ মাথায় হাতুরি পিটাচ্ছে। এই লোকের জন্য আমার রাতে ঘুমও হয়নি। এখন তুমি যদি বকাবাদ্য শুরু করো আমি উঠে যাব বলে দিলাম।’
‘ তুই এতো বেয়াদপ কেন? আর এই লোক বলছিস কাকে? ভাইয়া বল। এখন থেকে যদি এসব শুনি পিটিয়ে তোর পিঠের ছাল তুলে নিব।’ নীহারিকা মায়ের রাগী মুখের দিকে তাকিয়েও লাপাত্তা আচরন করল। আফিয়া বিলকিস চামচ আর ছুরি নিয়ে এসে বিমুগ্ধকে দিয়ে বললেন,’ এই নেও আব্বু তুমি কিছু মনে করো না।’ বিমুগ্ধ নীহারিকার দিকে একবার তার মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে বলল,’খালামনি আপনার মেয়ে যেন আমাকে কখনো ভাইয়া না ডাকে। আর এসব লাগবে না।’ বিমুগ্ধ হাত ডুবিয়ে খেতে বসেছে। নীহারিকা ভ্রু কুঁটি করল। আফিয়া তো বেশ রেগে গেলেন। তার ধারণা নীহারিকার বেয়াদপির জন্য বিমুগ্ধ রেগে গিয়েছে। তিনি কিছুক্ষণ ঘ্যানঘ্যান করে চোখ রাঙ্গিয়ে বুঝিয়ে দিলেন নীহারিকার খবর আছে। বিমুগ্ধ হাত দিয়ে খাচ্ছে। বিষয়টা নীহারিকার একদম ভালো লাগছে না। সে ভেবেছিল বিমুগ্ধ উঠে যাবে। কিন্তু সে যে তার এমন ক্ষুদ্র অত্যাচারে আনন্দ খুঁজে নিবে কে জানত!
প্রিয়ম পা মালিশ করছে কিছুক্ষণ পর পর। পায়ের পাতা লাল হয়ে আছে। হাঁটু কাঁপছে। নীহারিকা কৌতুহলী হয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ল,’ পায়ে কি হয়েছে?’
‘ আজ দৌড়েছি অনেক দিন পরে তাই ব্যথা।’ প্রিয়মের কণ্ঠে ক্লান্তি। নীহারিকা পায়ের দিকে ভালো করে তাকিয়ে বলল,’ হঠাৎ আজ দৌড়ালি কেন? গরু একটা। মা কে ডাকি?’ প্রিয়ম একটু কাছে ঘেঁষে ফিসফিস করে বলল,’তাযিন ভাই মনে হয় অটিস্টিক। বেশি বুদ্ধি আর চুপচাপ থাকে সব সময়। স্বাভাবিক মানুষ এমন হয় না। তার উপরে সব উদ্ভট আচরণ।’
নীহারিকা একটু দূরের সোফার দিকে একবার তাকিয়ে আরও ঘেষে বলল,’ তোর এটা মনে হচ্ছে কেন?’
‘ তুই জানিস আজ কত মাইল দৌড়েছে? তার উপরে একটা কথার উত্তর পর্যন্ত দেয় না। বোবার মত থাকে। মোবারক দাদা তো বোবা ভেবেছিল। পরে যখন বাবার সাথে কথা বলল তখন অবাক হয়ে গেছে সবাই। পুরো মহল্লায় তাযিন ভাই কয়েকদিনের মাঝে বিখ্যাত বেয়াদপ আখ্যা পেতে যাচ্ছে দেখেনিস।’
‘ মসজিদেও গেছে?’ নীহারিকা অবাক হয়ে গেল যেন এমন ভাবে বিমুগ্ধের দিকে তাকাল। প্রিয়ম ক্ষীন গলায় বলল,’হুম।’
‘ বাবার সাথেও কথা বলেছে?’ নীহারিকা আরও অবাক। তার চোখ টিপটিপ করছে। প্রিয়ম নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল,’ হুম। সাথে সম্পূর্ণ মহল্লা ঘুরেও এসেছে। কি বলে যানিস?’
‘ তুই না বললে কি ভাবে জানব আজব।’
‘ বলে উনি যেখানে থাকবেন তার আশেপাশের মানুষ কেমন যেনে রাখা উচিৎ। আমি বললাম, কেন? আপনি কি ভালো মানুষের সাথে থাকতে বেশি পছন্দ করেন? উত্তর শুনে আমি অবাক। বলে আমি খারাপ মানুষের সাথে থাকতে বেশি পছন্দ করি। সবাই বেয়াদপ তো শুধু শুধু বলে না। আমি সত্যি বেয়াদপ। নিজেকে নিজে বেয়াদপ বলছে। তোর মনে হয় সুস্থ মানুষ উনি?’
‘ উনি সুস্থ মানুষই। শুধু মানুষকে বিরক্ত করার ক্ষমতা আছে। তুই যা কল্পনাও করতে পারবি না উনি তাই তোর সামনে করবে। যাতে তুই উনাকে এসবই ভাবিস।’
‘ তুই উনাকে এতো ভালো করে চিনিস?’ প্রিয়মের জিজ্ঞাসা সূচক কণ্ঠে জানার আগ্রহ। নীহারিকা থতমত খেয়ে গেল। সে আসলে এসব আনমনেই আওড়াচ্ছিল। কথা ঘুরিয়ে সে বলল,’ প্রিয়ম আমি এখন একটা মজার কাজ করতে যাচ্ছি। দোয়া করে দে তো।’ প্রিয়ম সত্যি সত্যি কিছু দোয়া পড়ে বোনের মাথায় ফু দিয়ে বলল,’ কি কাজ সেটা বল আগে।’
‘ তোকে কেন বলব? দোয়া তো আগেই করে দিয়েছিস।’ নীহারিকা ফিচেল হাসল। তার চোখে দুষ্টুমি। ঘটনা ভালো না। বড় কাঁচের টি টেবিলের উপর থেকে নীহারিকা আমের জুসের জগ উঠিয়ে প্রিয়মকে একটা চোখটিপ মারল। প্রিয়মের মনে উৎকণ্ঠা। নীহারিকা সোফার পিছনে ঘুরে এসে দ্রুত হাঁটার ভঙ্গী করে বিমুগ্ধের কাঁধের উপরে ঝুঁকে পড়ল। সব জুস তার সারা শরীরে মেখে একাকার। বিমুগ্ধ কাঁধ ঘুরিয়ে নীহারিকার দিকে তাকাল। তার চোখে মুখে একরাশ দুষ্টুমির ছাপ। বিমুগ্ধ হা করে তাকিয়ে রইল। নীহারিকা বিমুগ্ধের এভাবে তাকিয়ে থাকায় দারুন মজা পেয়েছে। তার রুম দখল করার শাস্তি কত প্রকার ও কি কি সে দেখিয়ে ছাড়বে। বিমুগ্ধের চোখের দিকে তাকিয়ে নীহারিকা দু’ চোখ চারবার বন্ধ করে আবার খুলল। তারপর দুঃখে ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে চেঁচিয়ে উঠে বলল,’ওপস স্যরি ভাইয়া। আমি খুবই দুঃখিত।’ ফিসফিসে হালকা গলায় আবার বলল,’ আমি ইচ্ছে করেই করেছি মিস্টার।’ তারপর দোষী মানুষের মত দাড়িয়ে গেল। বিমুগ্ধ এখন হা করে পিছনে তাকিয়ে আছে। বাবা মেয়ের ইচ্ছেকৃত দোষ করে দুঃখিত বলার দারুন গুণ আছে। নীহারিকার ইনোসেন্ট বাচ্চাদের মত চেহারা, তার ফিচেল হাসি, এমন কর্মকান্ড! সব বিমুগ্ধকে এক অন্যরকম মানুষের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। নীহারিকা এমন কাজ করতে পারে? সে কখনো ভাবেনি। দু’ হাত উপরে তুলে সে এখনও ভিঁজা শরীরে, আঠালো জামাকাপড় নিয়ে বসে আছে। তার অবস্থা দেখে সকলে ছুটে এসেছে। বিমুগ্ধর চোখ নীহারিকায় নিবন্ধ। আফিয়া চিৎকার চেঁচামেচি করে মেয়েকে বকা দিতে শুরু করেছে। প্রিয়ম বোনের ডিফেন্স। পায়ের ব্যথা ভুলে সে লাফিয়ে সোফার এপাশে এসে আদুরে গলায় বলল,’ আপুর কি দোষ? ও কি ইচ্ছে করে এটা করেছে?’ বলেই সে জগ নিজের হাতে নিয়ে বোনের গায়ে হাত বুলিয়ে বলল,’তুই ব্যথা পেয়েছিস আপু?’ তারপর কানের কাছে গিয়ে বলল,’ বেশ করেছিস। আমার তো ইচ্ছে করছিল উনাকে শরবতের পানিতে চুবাই।’ নীহারিকার ফুফু একটু অদ্ভুৎ ধরনের মানুষ। ঝগড়াটে মহিলার মত। উচ্চবাচ্য কথায় তিনি সবার আগে। কাপড় নিয়ে এসে বিমুগ্ধের টি-শার্ট ছুঁয়ে দিতেই লাফিয়ে উঠল বিমুগ্ধ। এক লাফে সে সোফার অপরপ্রান্তে। রাবেয়া ফুফু হতভম্ভ হয়ে বললেন,’ কি হয়েছে? লাফালাফি করছ কেন? আচ্ছা এক কাজ করো খুলে ফেলো গেঞ্জি। ঠান্ডা লেগে যাবে তো। বরফ ছিল শরবতে।’ বিমুগ্ধ কিছু বলল না। সে এখনও নীহারিকার কান্ড হজম করে উঠতে পারেনি। এই প্রথম কেউ তার সাথে এমন একটা কাজ করেছে। অথচ বিমুগ্ধের রাগ উঠছে না। সে বেশ শান্ত। নীহারিকার কোন বিষয়ে বিমুগ্ধের রাগ কাজ করে না। তার কোন কাজে সে রাগে না। নীহারিকার সাথে তার রাগের সম্পর্কই না। মিতা আপু, মমতা আপু, মৌ আপু সকলে ভিড় জমিয়ে ফেলেছে। বিমুগ্ধ এবার আরও ভড়কে গেল। কারণ টি-শার্ট ধরে তার খালামনি এবং ফুফু টানাটানি করছে। একজন বলছে আমি খুলে দিচ্ছি আর একজন বলছে আমি খুলে দিচ্ছি। একজন বলছে আমি মুছে দিচ্ছি তো আর একজনও সেম কথা রিপিট করছে। বিমুগ্ধ এহেন কান্ড জীবনে দেখেনি। তারা পানি ঢেলে দিচ্ছে তার গায়েই। থ্রি কোয়াটার ভিজে পায়ের তালু আঠালো হয়ে গেছে। বিমুগ্ধ বুঝতে পেরেছে এই দুই মহিলার মাঝে তেমন মিল নেই। অথচ গলায় গলায় খাতিল টাইপের আচরণ। খালামনি গেঞ্জি ছুঁয়েছে বলেই ফুফুও টানছে। নিজের দাভাইয়ের অবস্থা দেখে আনজুম হাসছে। নীহারিকা প্রিয়ম কে বলল,’ চল আমরা পালাই। মা এখনো আমাদের দিকে খেয়াল করেনি। করলে জীবন শেষ।’
‘ পালাবি?’ প্রিয়ম কপালে ভাঁজ ফেলল। তারপর নীহারিকাকে বলল,’ আপু আস্তে করে পিছনের দিকে যা। তারপর এক দৌড় লাগাবি। তবে সাবধান বাবার চোখে যেন না পড়িস। তাহলে কপালে শনি আছে। উনি গরম হয়ে আগুন।’ নীহারিকা নিজের বাবার দিকে একবার তাকাল। ডাইনিং টেবিলে বসে তিনি এসব কান্ডে প্রচন্ড বিরক্ত। সাথে রেগেও আছেন। নীহারিকা পিছনের দিকে গিয়ে প্রিয়মের লম্বা কায়ার পিছন দিয়ে এক দৌড় দিল। কিন্তু ঠিক তখনই এক ঘটনা ঘটল। মিতু আপু ছাদ থেকে দৌড়ে আসছিল। দুই বোনের সংঘর্ষে চিৎপটাং। নীহারিকা একদম ফ্লোরে পড়েছে। তার চিৎকারে সকলে আবার সেদিকে ছুটল। হট্টগোল যেন আরও হট্টগোলে রূপ নিয়েছে। মিতু আপু সিড়ির কাছে পরে ভয়ংকর অবস্থা। তবুও তিনি উঠে নীহারিকাকে টেনে তুলে আতঙ্কে চিৎকার করতে লাগলেন,’ আমি শেষ নীহু। আমি শেষ।’
‘ কোমড় আমার ভাঙ্গল আর শেষ তুই?’
‘ আমি মরতে যাচ্ছি। বাঁচা প্লিজ।’
‘ কি হইছে মিতু?’ আফিয়া চেঁচালেন। নীহারিকা ব্যথায় কুঁকিয়ে উঠছে। মা এটা দেখলে এবার মেরেই ফেলবে। আড়চোখে বিমুগ্ধের দিকে তাকিয়ে দেখল বিমুগ্ধ এখনও স্বাভাবিক ভঙ্গিতে মুখ হা করে তাকিয়ে আছে। নীহারিকা এমন ছুটাছুটিও করতে পারে? আসলেই নীহারিকাকে সে চিনে না। এই মেয়েটাকে সে জানে না। এর মন পড়তে পারছে না সে। মস্তিষ্কের ভাষা ঠিক ধরতে পারছে না। এ যেন নতুন এক অভিজ্ঞতা। বিমুগ্ধের মনে হচ্ছে নীহারিকাকে চিনতে চিনতে তার জীবন নিঃশেষ হয়ে যাবে। মিতু আপু আহাজারি করে বলল,’বোনু মা আর ফাবিহা এসে হাজির। আমি ছাদ থেকে দেখে আসছি। এখন কি হবে? মা জিন্দা মেরে দিবে আমারে। কিছু একটা কর। আমি নিশ্চিত সে আমারে ধোলাই করতে আসছে।’
‘ তোকে ধোলাই করা দরকার।’ নীহারিকা কোমড়ে হাত বুললাল। মৌ এগিয়ে এসে বলল,’ মিতু তুমি তোমার মাকে এতো ভয় পাচ্ছ কেন? কি হয়েছে?’
শুকনো কাশল মিতু আপু। তিনি যে বিয়ে থেকে পালিয়েছে সে খবর এখনও এরা জানে না। মমতা আপু খুবই বিরক্ত গলায় বললেন,’ মিতু তুমি বয়সেই বড় হয়েছ। সামান্য একটা বিষয়ে এত হাঙ্গামা করে বসে আছ। তোমার মা আর বোনই তো আসছে জল্লাদ তো না।’ মৌ বিমুগ্ধের দিকে তাকাল। এখনও সে একুই পোশাকে দাড়িয়ে। মিষ্টি হেসে সে বলল,’ তাযিন ভাইয়া আপনি পোশাক পরিবর্তন করবেন না?’ বিমুগ্ধ সব সময়ের মত নির্বিকার। মৌ আরও একটু কাছে এসে বলল,’ ভাইয়া কোন সমস্যা?’ বিমুগ্ধ নীহারিকার দিকে তাকিয়ে আছে। মৌ বিষয়টি লক্ষ্য করে থমকে গেল। এভাবে কেন তাকিয়ে আছে? নিজেকে বুঝিয়ে দিল রেগে আছে। মৌ হেসে হেসে বিমুগ্ধের আশেপাশে ঘুরঘুর করে। বিগত কয়েকদিন সে বিমুগ্ধের সাথে কথা বলার এতো চেষ্টা করেছে যে অন্য ছেলে হলে এতক্ষণে মৌ মৌ করে নেচে উঠত। যদিও মৌ জানে বিমুগ্ধের না কি বিয়ে ঠিক। কথাটা সে আরও অনেক আগে থেকে জানে। অথচ তার এখন খুব খারাপ লাগছে। এত অস্থির একটি ছেলের বিয়ে ঠিক? কেন? মৌ বর্তমানে মনোযোগী হয়ে উঠল। বিমুগ্ধের দিকে সে তাকিয়ে বিরক্ত হয়ে গেল। তার চোখ এখনও নীহারিকাময়। আজব এতো দেখার কি আছে? মৌ একটু উঁচুতে উঠে ফিসফিস করে বলল,’ ভাইয়া বেশি রাগ উঠছে? আপনি বরং নীহারিকার গালে একটা চড় মেরে দিন। বেয়াদপ হয়ে গেছে অনেক। আমি জানি ও ইচ্ছে করে করেছে। আপনি ওর রুম দখলে নিয়েছেন তো তাই। ও ছোট থেকেই এমন হিংসুটে। কালো মন।’ মৌ ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস নিল নীহারিকার দিকে তাকিয়ে। মুখ ঘুরিয়ে বিমুগ্ধের দিকে নিতেই সে ভয়ে শিটিয়ে গেল। কয়েক পা পিছিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে দেখল শুধু সে বাদে পিছনে কেউ নেই। তাহলে কি তাযিন ভাই তার দিকেই এভাবে তাকিয়ে আছে?
মিতু আপুর ভয় আতঙ্ক কমছে না। তিনি নীহারিকার হাত চেপে বললেন,’ প্লিজ কিছু কর। মা আমার অবস্থা খারাপ করে দিবে।’
নীহারিকা ভেবে বলল,’ আপাতত রুমে যা।’ বিমুগ্ধ ফোঁড়ন কাটল,’ আপনি অফিসে চলে যেতে পারেন।’ মিতু আপু চমকে গেল। বাঘের কাছ থেকে বাঁচতে সিংহের খাঁচায় যাবে? মন খারাপ করে তিনি বললেন,’ আপনার জন্য এসব হয়েছে তাযিন ভাই। অফিস যেতে পারব না।’
‘ তাহলে আপনার ভাগ্যে যা আছে তা ভোগ করুন।’ বিমুগ্ধ যেতেই নিচ্ছিল রাবেয়া ফুফু বিমুগ্ধের টি শার্ট টেনে ধরলেন। বিমুগ্ধ চোখ ছোট করে ভাবছে আজ কি এরা সত্যি তার পোশাক সকলের সামনে খুলে দিবে? সত্যি এই পরিবারের মেয়ে গুলো মারাত্নক ডেঞ্জারাস।
______________
চলবে………….
ভুলত্রুটি আল্লাহর দেওয়া মহান গুন ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টি দিয়ে দেখবেন। নিশ্চুয়ই ক্ষমা একটি সুন্দর গুন।
@হাফসা_আলম