প্রিয় সুখ পর্ব-৩০

0
65

প্রিয় সুখ-৩০
________________
শুক্রবারটি সাধারণত একটি ব্যস্ত পবিত্র দিন। এই দিনের সূর্য পবিত্রতা নিয়ে উঠে চাঁদ পবিত্রতায় ডুবে। আজকের সূর্যের অবস্থাও নিদারুণ সুন্দর। কমলা রঙ্গের সাথে হলুদ আলো। উঠান ভর্তি রোদ। চকচকে ঝকঝকে একটি দিন। কোলাহলে চারপাশ মুখিয়ে আছে। বাড়ির ভিতরটা আজকে অন্য সব দিনের থেকে আলাদা। জীবনে প্রথম নীহারিকা নিজের বাড়িতে এতো মানুষ দেখছে।সব পরিবারের মানুষ। পরিবার জিনিসটা যে কত সুন্দর হয় তা সে এই মুহূর্তে এসে বুঝেছে। ওই সে রোদের আলোতে পাঁচটি বেতের চেয়ারে বসে আছে পাঁচটি পুরুষ। তাদের কখনো সে নিজ চোখে এক সাথে দেখানি। আজ প্রথম এই সূর্য তাদের নিজের মাঝে পেয়ে খুব আনন্দিত। নীহারিকা ছাদের উপর থেকে সকালের এই দৃশ্য দেখে বিমুগ্ধ হয়ে গেছে। মাথার উপরের মস্ত আকাশ হাসছে। তার নিচের মানুষ গুলো গম্ভীর। হয় তো কখনো এটিরও শেষ হবে। পৃথিবীর সব কিছুর শেষ আছে। নাফিস উদ্দীন বসেছে পূর্বের দিকে। তার সাথে তার ছেলে। নবীন উদ্দীন বসেছে পশ্চিমের দিকে। তার সাথেও তার ছেলে। কিন্তু দাদামশায় একা বসে আছে। তার দু’টি ছেলের একটি ছেলেও তার পাশে নেই। কিন্তু তার মুখে একরত্তি হাসি ঝুলছে। কেন? তার এখন দুঃখিত হওয়ার কথা। করুন চোখে তাকিয়ে থাকার কথা। তিনি এতো শান্ত কেন? আবার হাসছেও! নীহারিকা ওড়না গায়ে জড়িয়ে খালি পায়ে এক ছুটে এসে হাজির হলো উঠানে। তার দিকে এবার সবাই তাকিয়ে। অথচ এতো সময় কেউ দাদামশায়ের দিকে তাকায়নি। দাদামশায় হেসে উঠে নীহারিকাকে কাছে ডাকল। নীহারিকা মাটিতে জেগে উঠা সবুজ ঘাঁসের বুকে বসল। হাতল যুক্ত চেয়ারে হাত রেখে বলল,’ আপনার ছেলে গুলো ভালো না দাদামশায়।’ দাদামশায় অস্থির হাসলেন। নীহারিকা আরও ছোট কণ্ঠে বলল,’ এদের আপনার মারা উচিৎ।’
‘ এতো বড় ছেলেদের মারব?’ অবাক হয়েগেলেন তিনি। নীহারিকা ফিসফিস করে বলল,’ অবশ্যয়। তারাও আমাদের মারে। আপনি তাদের বাবা আপনার কাছে তারা সব সময় ছোট থাকবে।’
‘ কিভাবে মারব?’
‘ লাঠি দিব? বড় দেখে খুঁজে দিব। ইচ্ছে মত পিটাবেন। শার্ট ছিড়ে দিবেন। একটা হুলুস্থূল কান্ড হবে। আমাদের সামনে লজ্জায় কুঁকড়ে যাবে।’ নীহারিকা মৃদু মৃদু হাসল। দাদামশায় হো হো করে ডাকাতের মত হাসছেন। তার দুই ছেলের দৃষ্টি এখন তার দিকে। গভীর ভাবে তারা বাবাকে দেখছে। দু’ জনেই হাসলো বাবার হাসিতে। আবার নিজেদের মাঝে দৃষ্টিবিনিময় হতেই তারা দু’ দিকে ফিরে গেলেন।
সেদিন বিমুগ্ধের আব্বি আম্মি এসে হাজির হয়েছিলেন ঠিক একঘন্টা পরে। আব্বি সত্যি সত্যি তিন দিন রুম থেকে বের হলেন না। ঘরের সকল খাবারের উপরে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে তিনি বাহির থেকে খাবার এনে খেয়েছেন। কারো সাথে কোন কথা বললেন না। রুম থেকে বের হলেন না। আজকের আগে তাকে দেখাও গেলো না। হঠাৎ শুক্রবারে তিনি এভাবে আত্মপ্রকাশ কেন করলেন নীহারিকা ধরতে পারল না। কিন্তু সে বুঝতে পারল এই মানুষটি মারাত্মক ধরনের। বিমুগ্ধের মত অদ্ভুৎ চরিত্রের। নীহারিকা কিছুক্ষণ গল্প করে চলে যেতে নিচ্ছিল। নবীন উদ্দীন গম্ভীর গলায় ডাকলেন,’ নীহারিকা এদিকে এসো। পাশে বসো।’ পিলে চমকে গেল নীহারিকা। এমন ভাবে তার নাম নেওয়া হলো যেন বহু দিন ধরে ডাকছে। নীহারিকা পাশের চেয়ারে কাচুমাচু করে বসল। বিমুগ্ধ স্বাভাবিক ভঙ্গীতে বাদাম চিবাচ্ছে। সব স্বাভাবিক।
‘ তোমাকে আমি কেন বসতে বলেছি জানো?’
‘ না।’ নীহারিকার ক্ষুদ্র কণ্ঠ।
‘ জানার আগ্রহ আছে?’
‘ তেমন একটা নেই। কিন্তু আপনি বলতে চাইলে আমি শুনব।’
নবীন উদ্দীনের মুখ সহজ হয়ে আসল। তিনি অকলুষিত গলায় বললেন,’ চলো গল্প করি।’
নীহারিকা একবার তাকাল। এই লোকও কি বিমুগ্ধের মত? নবীন উদ্দীন চট করে বললেন,’ হ্যাঁ আমি ওর মতোই। বাপ ছেলে দু’জনেই অসভ্য।’ তিনি হাসতে লাগলেন। নীহারিকা বিস্মৃত। নবীন উদ্দীন বললেন,’ তোমাকে আমার পছন্দ না। আমাকে কেমন লাগে তোমার?’
নীহারিকা একটু ভেবে বলল,’ আপনাকেও আমার খুব একটা ভালো লাগে না।’
‘ তুমি সত্যি কথা বলো। ভালো গুন। আই লাইক ইট। তোমাকে কি আমি শুধু অপছন্দ করি?
‘ মনে হচ্ছে।’
নবীন উদ্দীন দানবের মত হাসলেন। কিন্তু সেই শব্দ ওই প্রান্তে পৌছালো না। তিনি তীক্ষ্ন গলা ঝেরে বললেন,’ এটা সত্য নয়। আমি তোমাকে শুধু অপছন্দ করি না। তুমি হচ্ছো ঘৃণা এবং ভালোবাসা। ঘৃণা এবং ভালোবাসা মানে বুঝ?’
‘ না।’
‘ তুমি। মাত্রই বললাম। ধরতে পারলে না। বোকা মেয়ে।’ কিছুক্ষণ নিরবতা। নীহারিকা আড়চোখে বিমুগ্ধের দিকে তাকাচ্ছে। নবীন এবার ভালো করে নীহারিকার দিকে তাকাল। মেয়েটি অবিকল তার মা। তিনি চমকে গেলেন। ঠোঁটজোড়ায় বেশি মিল। নীহারিকার দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন,’ তোমাকে আমি ভালোবাসি। কারণ তুমি আমার মায়ের মত দেখতে। তোমাকে আমি ঘৃণা করি কারণ তুমি তোমার বাবার মেয়ে। ফলস্বরূপ তোমার প্রতি আমার অনুভূতি শূন্য। বুঝতে পেরেছ?’
‘ পেরেছি। বাবার মেয়ে তো বাবার মতই হবে তাই না?’ নীহারিকার প্রশ্ন। নবীন উদ্দীন মুচকি হেসে দাড়িতে হাত বুলালেন।
‘ সেটাই সেটাই। চলো গল্প করি। তোমার বাবার নামে নিন্দা করতে ইচ্ছে করছে। ছেলে মেয়ের সামনে বাবা মায়ের সম্পর্কে খারাপ কিছু বলা উচিৎ হবে না। ফলে অল্প বলব। তোমার বাবা হচ্ছে আস্ত একটি বানর। সে আগে গাছে গাছে লাফাত।’
‘ সত্যি?’ আগ্রহের সাথে জানতে চাইল নীহারিকা।
‘ আমি মিথ্যে বলব কেন? মিথ্যে আমি তোমার খালামনির সাথে বাদে কারো সাথে বলি না।’
‘ খালামনির সাথে মিথ্যে কেন বলেন?’
‘ কারণ বউয়ের সাথে মিথ্যে কথা বলা যায়। এটা বড় সমস্যা না। তুমি কি আমার প্রতি বিরক্ত?’
‘ একটু একটু।’
‘ তাহলে তোমার বাবার একটি গল্প শুনাই। সে একবার মজনু চাচার বাগানের সব ফুলের গাছ কেটে ফেলেছিল। মজনু চাচা রেগে আগুণ হয়ে যখন বাসায় আসল তাকে খুঁজে পাওয়া গেল না। আমি কিন্তু জানতাম। ভাই ভেবে তখন বাঁচিয়ে ছিলাম।’
‘ আপনার এখন আফসোস হয়?’ নীহারিকার গভীর প্রশ্ন।
‘ হচ্ছে। মাঝে মাঝে আমার ইচ্ছে করে তাকে চূড়ান্ত লেভেলের মার মারি। মেরে হাত পা ভেঙ্গে দি।’
‘ সাঙ্ঘাতিক ইচ্ছে। কিন্তু আফসোস করবেন না। আফসোস করা শয়তানের কাজ। যা পূর্বে ঘটে গিয়েছে তা ভুলে যাওয়া উচিৎ। সে এখন আপনার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আপনি চাইলে হাত পা ভাঙ্গতে পারেন। আমরা কিছু বলবো না।’ নীহারিকা উঠে দাড়াল। ভয়ে তার শরীর থেমে গিয়েছিল। কিন্তু এখন আর ভয় করছে না। বিমুগ্ধের বাবা একজন সাধারণ অদ্ভুৎ মানুষ। ছেলের থেকে ভালো আছে। কিন্তু ভয়ংকর। তার বাবাকে মারার কথা তার সামনেই বলছে! দেখতে চাইছে নীহারিকার রাগ কেমন। তিনি নীহারিকার সম্পর্কে ধারণা নিতে চাচ্ছিলেন। বিমুগ্ধ হেসে ফেলল। আব্বির এমন ভঙ্গুর মুখ দেখে সে বলল,’ আপনাদের রক্তে একটু সমস্যা আছে। এতো সহজে ধরা অসম্ভব।’
‘ তুমি এই মেয়ের থেকে দূরে থাকবে। আমি এই জন্যেই এসেছি। রূবাইদা চায় তোমাদের বিয়ে এই বাড়িতে হোক। দ্রুত এই বিষয়ে আলোচনা হবে। মেয়েটিকে আমি সত্যি ঘৃণা করি। তোমাকে ভালোবাসি। আশা কি ঘৃণার পাত্র হতে চাইছ না।’
‘ আপনি জানেন আমি আপনাকে কতটা ভালোবাসি। কিন্তু রাগেশ্বরীকে আপনি শুধু ঘৃণা করেন না। ভালোও বাসেন।’
‘ ঘৃণা ভালোবাসা মিশে নিঃশেষিত হয়। যখন কেউ কাউকে খুব ভালোবাসে সাথে খুব ঘৃণাও করতে শুরু করে তখন সব শেষ হয়ে যায়। তাদের মাঝে কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। দু’জন দু’জনের কাছে নতুন হয়ে যায়। একদম শুরুর মত। আর রাগেশ্বরী কেন ডাকছ? রেগে যায় না কি?’
‘ অসম্ভব মাত্রায়।’ বিমুগ্ধ ঘোর গলায় বলল। নবীন উদ্দীন ভ্রু কুঁচকে বললেন,’ দেখলাম না তো। শান্ত শিষ্ট একটি মেয়েকে এমন নাম দেওয়া তোমার উচিৎ হয়নি।’
‘ আপনি তো ঘৃণা করেন। দুঃখ পাচ্ছেন কেন?’
‘ মানবতার খাতিরে। আর কখনো এই নামে ডাকবে না। রাগী মানুষ হলে কথা ছিল।’
‘ আপনি সত্যি চিনতে পারেননি সে কেমন?’ বিমুগ্ধ উঠে দাঁড়াল। নবীন উদ্দীন বললেন,’ একটুও না।’
‘ হসপিটালের কথা ভুলে গেলেন?’
মনে পড়ার ভঙ্গীতে নবীন উদ্দীন হতবাক গলায় বললেন,’ আই সি। সি ইজ রিয়েলি এংরি গার্ল। তবে বেশি নয়।’
‘ অপেক্ষা আব্বি।’ বাবা ছেলে হাসতে লাগলেন। প্রিয়ম আশ্চর্য হয়ে সেই হাসি দেখছে। কি ধরণের মানুষ এরা? একুই বাড়িতে থাকে অথচ মনে হচ্ছে দু’ টি দেশ। বাংলাদেশ আর পাকিস্তান। প্রিয়ম নিজের পরিবারকে বাংলাদেশি হিসেবে মনে মনে ঘোষণা দিল। এরা বাপ ছেলে রাজাকার টাইপের। এরা সত্যি রাজাকার। দু’ জনই ভালো বন্ধু। শুধু নীহারিকায় তাকা থেমে যাচ্ছে। এই একটি অধ্যায় জীবনে না আসলে তাদের জীবন অন্যরকম। আলাদা। আনন্দের। মজার। একদম ভিন্ন ধর্মী।
___________
সকাল সাড়ে দশটা। বাড়িতে একটি উৎসব উৎসব পরিবেশ চলছে। এই পরিবেশ ঈদ বা কোন বিয়ের অনুষ্ঠানেই সম্ভব। অথচ বিগত তিনদিন নীহারিকাদের অন্দরমহলে ঈদ লেগেছে। মানুষে গিজগিজ করছে বাড়ি। এত মানুষ নীহারিকাদের বাড়িতে আগে কখনো দেখা যায়নি বলেই চমকে গেল জাওয়াদ। চোখ এদিক সেদিক করে সে সকলকেই মোটামুটি চিনে ফেলেছে। এরা সব পূর্ব পরিচিত। জাওয়াদ গোপনে ভিতরে প্রবেশ করল। সকলে তখন ব্যস্ত হয়ে কথা বার্তা বলছিল। আফিয়া বিলকিস সহ তার দুই বোন ড্রাইনিং টেবিলে বসে শবজি কাটায় ব্যস্ত। সাথে গল্পগুজব যুক্ত। রাবেয়া ফুফু মাঝে মাঝে আসেন। খুব বিরক্ত চোখে তাকিয়ে চলে যান। তার কোন বোন নেই ফলে বোনেদের এতো আদিখ্যেতা পছন্দ হচ্ছে না তার। এসব থেকে তিনি একটু দূরে থাকতে পছন্দ করে। তার দুই কন্যা সোফায় বসে টিভি দেখছে। নীহারিকা আর মিতাকে দেখা যাচ্ছে দূরে দাড়িয়ে কিছু একটা নিয়ে টানা হ্যাচড়া করছে। দরজা খোলাই ছিল। জাওয়াদ যখন প্রবেশ করল নীহারিকার ফুফুর দুই কন্যা আশ্চর্য হয়ে গেল। এত সুদর্শন একজন পুরুষ তাদের ঘরে এসে হাজির হয়েছে ভাবতেই বিস্ময় খেলে যাচ্ছে মন মস্তিষ্কে। মৌরি ফিসফিস করে বড় বোনকে বলল,’ এটা নীহারিকার হবু বর ছিল। হসপিটালেও দেখেছি। এখানে কি করছে রে?’
মমতা উঠে বলল,’ বিয়ে সাদি করেছে? ভাই এতো সুন্দর ছেলে আমি জীবনে দেখিনি। কি সুন্দর গায়ের রংটাও।’ চকচকা চোখে মমতা প্রায় ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে। মমতা আপু বিবাহিত। অথচ তার মুখ হা হয়েছে বোয়াল মাছের মত। তারা বাকরুদ্ধ হয়ে উজ্জ্বল নয়নে তাকিয়ে দেখছে অতিমাত্রায় রূপবান পুরুষটিকে। জাওয়াদের নজর একবার পরেছে। তার খুব অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। জাওয়াদকে এখানে দেখে চমকে গেলেন রাবেয়া ফুফুও। ছেলেটি ছবির থেকেও অনেক বেশি সুন্দর। কি করছে সে এই বাড়িতে? জাওয়াদ একা আসেনি আজ। তার সাথে মেসবাহ এবং তার সহধর্মিনী লীলাবতীও উপস্থিত হয়েছেন। বিশেষ কাজে তাকেও আসতে হয়েছে। ছেলেটা এতো নাছোড়বান্দা! খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে জেদ ধরে তাকে নিয়ে এসেছে। এই মেয়েটা তার ছেলেকে বৈরাগী বানিয়ে ছাড়ল। ভারী ভারী মুখ করে আছেন তিনি। তাকে টেনে ভিতরে ঢুকাল মুক্তা। আফিয়া বিলকিস হতভম্ভ হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তারপর ছুটে এসে ব্যস্ত ভঙ্গীমায় বললেন,’ আপনারা?’ একটু থেমে হেসে উঠে বললেন,’ আসুন আসুন।’ মৌরি মমতা লাফিয়ে উঠে গেল সোফা থেকে। আফিয়া এক প্রকার দৌড়ে গেলেন নিজের স্বামীর সন্ধানে। আজকে অবশ্য একটি বড় আয়োজন। জাওয়াদকে দাওয়াত করা হয়েছে। কিন্তু তার পরিবারকে আশা করা হয়নি। ফলস্বরূপ এটি ছিল সারপ্রাইজ। নীহারিকার দুই ফুফাত বোনের গদগদ অবস্থা। জাওয়াদকে তারা নজরে নজরে ছিন্ন করছে। জাওয়াদের অবশ্য এদিকে মনোযোগ কম। সে সোফায় বসে চারদিকে কাউকে খুঁজে চলেছে। নীহারিকাকে খোঁজ করার কথা থাকলেও এই মুহূর্তে সে অন্যজনের খোঁজে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছে। আর সে হচ্ছে শুধু মাত্র তাযিন।

নীহারিকা আর মিতা একটি ওড়না নিয়ে তুমুল ঝগড়া বাধিয়েছে। দু’ জনই সেটি নিতে আগ্রহী এবং কেউ ছাড় দিবে না। টানাটানির এক পর্যায়ে তারা ড্রইং রুমে এসে পৌছেছে। মিতা নিজের দিকে টেনে বলল,’ তুই এতো হিংসুটে কেন নীহু? প্লিজ দে না।’
নীহারিকা রাগে আগুন। তার শরীর দিয়ে যেন তাপ বের হচ্ছে। সে চিৎকার করে বলছে,’ মরে গেলেও দিব না। এটা আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ আপু। প্লিজ না।’
মিতা আরও এক টান দিয়ে বলল,’ আব্বু ইন্ডিয়ায় গিয়েছে। তাকে বলব তোর জন্য সুন্দর থেকে একটি নিয়ে আসতে। দিয়ে দে বোন প্লিজ।’
‘ মিতা আপু না। এটা গুরুত্বপূর্ণ বললাম না।’ ত্যাড়া গলা নীহারিকার। মিতা তবুও ছাড়ছে না। আজ এই ওড়না সে পড়বেই। জামার সাথে খুব মিলেছে। দুই বোনের চিৎকার চেঁচামেচিতে বাড়ি ভর্তি সবাই হাজির। লীলাবতী তাজ্জব হয়ে গেলেন। এই মেয়ে তো সেই মেয়েটা মনে হচ্ছে। কণ্ঠ শুনেই ধরতে পেরেছেন তিনি। মেয়েটিকে সরাসরি দেখা হয়নি। মেসবাহ ব্যতীত তারা মা ছেলে কেউই এই মেয়েকে সরাসরি দেখেননি। ছবি দেখেছে। সাধারণ একটি মেয়ে। আর ছেলে এই মেয়ের জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছে? সিরিয়াসলি? লীলাবতীর চোখ বেরিয়ে আসবে আসবে করছে। পৃথিবীতে তিনি কখনো দেখেননি মেয়ের বাড়িতে এসে এমন টানাটানির দৃশ্য। অথচ তার ছেলে মৃদু মৃদু হাসছে। মুগ্ধ হয়ে সে রাগান্বিত নীহারিকাকে দেখছে। রেগে রেগে নীহারিকা চেঁচামেচি করছে। তার খিটখিট শব্দদয় যেন মধুর। নিজের ছেলেকে দেখে লীলাবতি রিতিমত ভাষাহারা। জাওয়াদ উঠে গেল। লাফিয়ে তাও। তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে দুই বোন। সে সোজা নীহারিকার পাশে দিয়ে দাড়াল। কোমল সুরে বলল,’ ছেড়ে দেও নীহারিকা।’
পাশে তাকালো নীহারিকা। জাওয়াদকে দেখে বলল,’ আপনি এখানে কি করছেন?’
‘ তোমাকে দেখতে এসেছি।’
‘ মেয়ে দেখেনি কখনো?’
‘ না। তোমাকেই দেখা হয়েছে জীবনে প্রথম এবং শেষ।’
‘ ফিল্মি ডায়লগ ছাড়বেন না। এখন মেজাজ খারাপ জাওয়াদ। সরুন।’ জাওয়াদ অবাক হয়ে গেল। নীহারিকা তার নাম ধরে ডেকেছে। সাধারণত সে ডাকে না। হৃদয় আঙ্গিনায় ঢেউয়ের পানি এসে ভীর করেছে। এমন ভয়াবহ মুহূর্তে এসেও তার ভালো লাগছে। লীলাবতী অবাক হয়ে যাচ্ছে। মেয়েটা কিভাবে কথা বলছে তার ছেলের সাথে? ছেলে তার হাসছে! তার মধুর গোপন হাসি। সহজে এভাবে হাসে না সে। ভারী অবিশ্বাস্য! ঠোঁট কামড়ে জাওয়াদ বলল,’চলো তোমাকে সাহায্য করি।’ নীহারিকা ভ্রু কুটি করল,’ আপনার তো তিনদিন আগে আসার কথা ছিল। আসলেন না কেন?’ মিতা আপু এখনও ধরে রেখেছে ওড়না। নীহারিকা ছাড়ছে না। জাওয়াদ কিছুক্ষণ ভেবে বলল,’ কে বলেছে তোমাকে? ‘
‘ বিমুগ্ধ। প্রকৃত পক্ষে সে ধারণা করেছিল। সব ধারণা লাগে না। মাঝে মাঝে হয় এই আর কি।’
জাওয়াদের লাল চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। বিমুগ্ধ কে সে ধরতে পারছে। বেশ ধরতে পেরেছে। নীহারিকা, যার সাথে তার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল সে তাকে চিনলো না। অথচ বিমুগ্ধকে প্রথম দিনেই চিনে ফেলেছে। জাওয়াদ বেশ রেগে গেল। নীহারিকার হাতে হাত পড়তেই চমকে গেল নীহারিকা। জাওয়াদ শক্ত গলায় বলল,’ দেও আমি টেনে দিচ্ছি।’ নীহারিকা ছাড়তে পারছে না। ছাড়লেই মিতা নিয়ে দৌড় দিবে। তাই সে জাওয়াদের দিকে অগ্নি চোখে তাকিয়ে বলল,’ হাত সরান।’
‘ আচ্ছা।’ বলেও জাওয়াদ সরিয়ে নিল না। নীহারিকার হাত একদম ঠান্ডা। মৃত মানুষের মত। এটা প্রথম স্পর্শ। এর আগে কখনো ইচ্ছেকৃত ছোঁয়া হয়নি। নীহারিকা ক্রোধে কণ্ঠ কঠিন করে এদিক সেদিক তাকিয়ে হাত ঝাকাচ্ছে। দূরে বিমুগ্ধকে দেখা যাচ্ছে। তার চোখ শীতল। রেগে আছে কিনা বুঝার উপায় নেই। অথচ নীহারিকা মিইয়ে গেল। মন থেকে নড়ে উঠল ভয়। নিজের মধ্যে পরিবর্তন লক্ষ্য করল নীহারিকা। বিমুগ্ধকে তার ভয় লাগছে। মৃদু থেকে একটু বেশি। নীহারিকা চোখ সরাল। আরও একবার আড়চোখে তাকাল। বিমুগ্ধর চোখ স্থির। হাতের দিকে। নীহারিকা হাত দ্রুত ছেড়ে দিল। মিতা ধপ করে ফ্লোরে পড়ে গেল। নীহারিকার আড়াআড়ি দৃষ্টি ছুটছে বিমুগ্ধের অক্ষি পল্লবে। বুকে হাত গুঁজে দেয়ালে ঠেস দিয়েছে সে। গায়ে ফতুয়া। কালো ট্রাউজার। ফতুয়ার দু’ টি বোতামই খোলা। বুকের উপরিভাগ দৃশ্যমান। চোখেমুখে কোন প্রতিক্রিয়া নেই। নিশ্চুপ এক মুর্তি সে। পাথর কঠিন মুখমন্ডলের নাক লাল। নীহারিকার মনে হলো প্রথম ও শেষ বার সে কাউকে এতো ভয় পাচ্ছে। বিমুগ্ধ কি করবে ভাবছে। আগের বার তো খাবার ফেলেছিল। আরও কি কি করল। এবার কি করবে? মিতা দৌড়ে চলে যেতে নিল। মিতু আপু দৌড়ে এসে খপ করে ধরল। এই মেয়েগুলোকে তার এই জন্য অসহ্য লাগে। ছোট থেকে নীহারিকার প্রিয় জিনিস গুলো খুঁজে নিয়ে টানা হ্যাঁচড়া করা এদের স্বাভাব। বেয়াদ্দপ কত গুলো। একটা গালিও দিলেন তিনি মনে মনে। এত বড় মেয়ে অথচ ছোট বোনের সাথে লাগছে। মিতু আপু দাঁতে দাঁত চাপলেন,’ সমস্যা কি মিতা? এভাবে কেউ ছোট বোনের জিনিস নিয়ে টানাটানি করে?’
‘ তোমার সমস্যা কি? আমি নিয়েছি নীহারিকার জিনিস। তোমার না। ছাড়ো।’
‘ না ছাড়ছি না। কি খাও এতো শক্তি কোথা থেকে পাও। আল্লাহ। দজ্জাল।’ মিতু আপু শক্ত করে ধরে রেখেছে। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। ভয়ংকর সেই যুদ্ধের এক পাশে মিতু আপুর দল। ফাবিহা, নীহারিকা সহ। অন্য পাশে ওরা তিন বোন। কেউ বুঝতেই চেষ্টা করছে না তারা কত বড় বয়সে। নীহারিকার কাঁদো কাঁদো মুখ। এই ওড়নাটি তার খুব প্রিয়। টকটকে লাল রঙ্গের ওড়নার উপরে চিকন রেশমি সুতোর কাজ। গোলাপি রঙ্গ লালের সাথে মিশে একটা সুন্দর ওড়না তৈরি হয়েছে। এবার বড়রাও যুক্ত হয়েছে। বেশিরভাগ নীহারিকাকে দিয়ে দিতে বলছে। কিন্তু মিতা যেন শপথ করেছে সে দিবেই না। হাতা হাতি জারি রয়েছে। লীলাবতী এবার দারুন মজা পাচ্ছে। তিনি নীহারিকার দলে। মেয়েটি নিজের ওড়না রক্ষায় এভাবে কেন লেগে পড়েছে জানার খুব আগ্রহ তার। জিতে গেলেই জানতে চাইবেন। প্রিয়মের মাথায় হাত। ওড়না তার বোন জীবনে ছাড়ছে না। দাদামশায় নীহারিকার বাবা বিমুগ্ধের বাবা সবাই উপস্থিত হলেন। সকলের চোখেমুখে আতঙ্ক, বিস্ময় ভাব। নবীন বিহ্বল। নীহারিকা শুধু দেখতেই নয় আচরণেরও তার মা। নবীন উদ্দীনের মা একটু এমন ধরণের মানুষ ছিলেন। নিজের প্রিয় জিনিস কাউকে দিতেন না তিনি। এখনও মনে আছে একদা একটা শাড়ি তার ফুফু চেয়েছিল। কিন্তু মা সেই কি কান্না বাবার কাছে বসে। যাতে শাড়ি তাকে না দেওয়া হয়। শেষে তিনি জিতে গেলেন। এর পিছনে অবশ্য কারণ আছে। সেটা তাকে নবীন উদ্দীন নিজে কিনে দিয়েছিলেন। প্রথম উপার্জন দিয়ে। নতুন চাকরি পেয়ে। নীহারিকা কেন টানছে এই জিনিস! আকুলতায় ভরা সকলের চক্ষুকে উপেক্ষা করে বিমুগ্ধ জঘন্য এর উপরে মারাত্মক কাজ করে বসল। কাঁ/চি হাতে সে মাঝ বরাবর কেটে ফেলল ওড়না। এপাড় ওপাড় হয়ে গেল লাল দোপাট্টা। নীহারিকা গগন বিদায়ী এক চিৎকার দিয়ে উঠল। কেউ এটা আশা করেনি। বিমুগ্ধের চোখ মুখ তখন যথাসম্ভব লাল। নীহারিকা বিক্ষিপ্ত নয়নে তাকাল। তার চোখ বেয়ে পানি পড়ে পড়ে ভাব। হৃদয় এমন ভাবে ভাঙ্গল তার মনে হচ্ছে কেউ শরীর থেকে আত্মা আলাদা করে নিয়েছে। একটি ওড়নাই তো মাত্র। অথচ এটি তার কাছে মহা মূল্যবান। তার ভাইয়ের দেওয়া প্রথম উপহার ছিল। নীহারিকা ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস নিল। তার শ্বাস কষ্ট হচ্ছে। হাত দিয়ে সে বুক মালিশ করছে। বিমুগ্ধ একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। যেন সে তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধ থামিয়ে দিয়েছে। প্রিয়ম দ্রুত ছুটে গিয়ে দু’ হাতে বোনকে টেনে ধরল। বলল,’ সমস্যা নেই একটা ওড়নাই তো। আমি তোকে আবার কিনে দিব।’ নীহারিকা শুনলো না। বিমুগ্ধ তার সামনে নিজের প্রশস্ত শক্ত বুক নিয়ে তখনও দাড়িয়ে। সে আলোড়িত নয়নে দেখছে জাওয়াদকে। এই অঘটন ঘটেছে জাওয়াদের জন্যেই। কিন্তু বিমুগ্ধ এটার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে পারেনি। নীহারিকার বাবাও বেশ ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বললেন,’ এসব কি তাযিন? তোমার কোন কিছুতে বাঁধা প্রয়োগ করছি না তার মানে এই নয় যে তুমি যা খুশি করবে। নীহারিকা সরে এসো। আজ থেকে তুমি এদের আশেপাশে যাবে না। চলে এসো।’
নীহারিকা গেলো না। সে বিমুগ্ধের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। ইচ্ছে করছে গুনে গুনে দশটা চড় বসিয়ে দিতে। বিমুগ্ধ প্রস্তুতি নিল। সে জানে নীহারিকা এমন কিছু ঘটাবে। তবে সে ভুলে গেছে নীহারিকার মাইন্ড তার মন কিছুই সে নিজের বিদ্যা বুদ্ধি দিয়ে ধরতে পারে না। তার এই অংশটি নীহারিকার ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময় অচল থাকে। হাত থেকে টেনে নিল কাঁ/চি। তারপর বিমুগ্ধের ফতুয়া বুকের পাশ থেকে সে একদম কেঁটে দিল। সবাই আল্লাহ আল্লাহ করে চিৎকার করে উঠল। বিমুগ্ধ দু’ হাত দু’ দিকে দিয়ে স্তব্ধ হয়ে নিজের বুকের দিকে তাকিয়ে আছে। নীহারিকা শব্দ করে হাতের বস্তু ছুড়ে মারল। তারপর প্রায় কেঁদেই দিল। চিৎকার করে ওয়ার্নিং দিয়ে গেল,’ আপনাকে আমি কাঁদিয়ে ছাড়ব। কাঁদাবই। অসভ্য ইতর প্রকৃতির ছেলে। আস্ত বেয়াপদ।’ হনহন করে সে ছাদের দিকে চলে গেল। বিমুগ্ধের প্রশস্ত বুক। মেদ হীন পেট। পিটানো দেহ। কালো সোনালী লোমশ বুকটি সকলের সামনে উন্মুক্ত হয়ে আছে। নাফিস উদ্দীন রাগে গজগজ করতে করতে বললেন,’ তুমি চরম বেয়াদপ ছেলে।’ নবীন উদ্দীন আরও ক্ষেপে গেলেন। বললেন,’ তোর মেয়ে তো সাধু সন্ন্যাসী।’
‘ এই একদম মেয়ে নিয়ে কিছু বলবি না। তোর ছেলে সব সময় আমার মেয়ের পিছনে লাগছে। তুই জানিস ও আমার মেয়ের রুম পর্যন্ত দখল করেছে।’
‘ বাহ বাহ খোটা দিয়ে দিলি তো? তাই তো বলি তুই এতো দিন চুপ মেরে আছিস কিভাবে। আসলে একটা সুযোগ খুঁজে চলেছিলি।’ নবীন উদ্দীনের রাগে মাথার পাশের রগ ধপধপ করছে। নাফিস উদ্দীন ফোঁস ফোঁস করছেন,’ তোর ছেলে এটা ঠিক করেনি।’
‘ অবশ্যয় করেছে। এখন থেকে তুমি যা খুশি করতে পারবে। আমি অনুমতি দিয়েছি মাই সন।’ বাহবা দিয়ে বললেন তিনি।
‘ তুই তোর ছেলেকে শাসন করলি না ভাইয়া?’ অবাক হয়ে গেলেন নাফিস উদ্দীন।
‘ কেন করব? আমার ছেলে মহান কাজ করেছে।’
‘ মহান কাজ! আমার মেয়ের ওড়না ছিঁড়া মহান কাজ?’
‘ হ্যাঁ মহান কাজ। সে নারীজাতির ঝগড়া থামিয়েছে। আমি আজই আমার ছেলেকে পুরস্কৃত করব।’
‘ পুরস্কৃত করবেন?’ লীলাবতি হতবিহ্বল ভাব ধরে রাখতে না পেরে যুদ্ধের ময়দানে প্রবেশ করলেন।
‘ অবশ্যই। আমার ছেলে মহান কাজ করেছে। মহান ব্যক্তি সে। আর মহান ব্যক্তিদের কদর করতে হয়। অন্যথায় তারা হারিয়ে যায়। বাই দ্যা ওয়ে আপনার নাম কি মিস সুন্দরী?’ উৎসাহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন নবীন উদ্দীন। থতমত খেয়ে গেলেন লীলাবতী। তারপর স্বাভাবিক হয়ে মুচকি হেসে বললেন,’ লীলাবতী।’
মাথা ঝাঁকিয়ে নবীন উদ্দীন বললেন,’ নাইস নেম। এখানে এসেছেন কেন? ঝগড়া দেখতে? দর্শক আপনি?’
চমকে গেলেন লীলাবতী। ঘরশুদ্ধ সব পাগল না কি? এই জন্যেই তো ছেলেকে পাগল পাগল লাগছে।
‘ আমরা হচ্ছি সাইক্রিয়াটিস্ট। পাগল নই মিস লীলাবতি।’ লীলাবতী আর কিছুই ভাবতে পারলেন না। ত্রাস নয়নে তাকিয়ে রইলেন তিনি। কি হচ্ছে!

নীহারিকা কাঁদছে। তার হাতে ছিড়া ওড়না। প্রিয়ম যখন প্রথম টিউশনি করিয়ে ছিল তখন তার প্রথম টাকা দিয়ে সে সবার জন্য কিছু না কিছু কিনেছিল। হঠাৎ কেন যেন তার মনে হলো তার বোনকে এই লাল গোলাপি ওড়ানাটি দিলে দারুন হবে। হয়েছেও তাই। নীহারিকার খুব পছন্দ হয়েছিল। খালি পায়ে প্রিয়ম বোনের কামড়ায় ঢুকে আবিষ্কার করল তার বোন কাঁদছে। সহজে নীহারিকা কাঁদে না। সে খুব কষ্ট পেলেও কাঁদে না। প্রকৃত অর্থে নীহারিকাকে কাঁদানোর ক্ষমতা খুব কম মানুষের আছে। তাদের মাঝে বিমুগ্ধযে অন্যতম তা বেশ বুঝতে পারছে প্রিয়ম। বোনের পাশে বসে হুট করে জড়িয়ে ধরল সে। নীহারিকার শ্বাস কষ্টের শব্দ শুনা যাচ্ছে। প্রিয়ম মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,’ তোকে আমি দশটা ওড়না কিনে দিব আপু তবুও কাদিস না। তুই কাঁদলে ভালো লাগে না। মনে হয় পৃথিবীতে বিষণ্ণতা নেমেছে। চারিদিকে মেঘ জমেছে। বৃষ্টি আসবে আসবে করেও আসছে না। ভেবসা গরম ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বিষণ্ণ একটি বিকেল তোর কান্না। দুপুরের ঘুমটি শেষে যে অসহ্য অনুভূতিতে শুধু শুধু বুকের শব্দ বারে তোর কান্না ঠিক তেমন। কাঁদিস না।’
নীহারিকা প্রিয়মের নতুন টি-শার্ট ভিজিয়ে দিলো। আজ প্রিয়ম একটুও ঝগড়া করছে না। সে একদম বড় বিজ্ঞ ভাইয়ের মত মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। সান্ত্বনা দিয়ে সে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে বোনের চুলের খাজে খাজে। অস্থিরতা বাড়ছে। প্রিয়মের মনে হচ্ছে পৃথিবীতে তার বোনের কান্না হচ্ছে যুদ্ধে বিদ্ধস্ত অঞ্চলগুলোর মতই ধ্বংসস্তূপ। নীহারিকা থামল অনেক সময় পরে। ইনহেলার নিয়ে সে শ্বাসটান ঠিক করার চেষ্টায় আছে। তারপর ঠিক করে লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,’ মনে থাকে যেন দশটাই কিনে দিবি।’
প্রিয়ম অবাক হওয়ার ভান করে বলল,’ মানে কি? আমি তো তোকে সান্ত্বনা দিতে এসব বলেছি। এখন কিনে দিতেই হবে?’
নীহারিকা চোখ রাঙ্গিয়ে বলল,’ অবশ্যয়।’
‘ না পারবো না।’
‘ কেন পারবি না? তুই আমাকে মিথ্যা বললি?’ নীহারিকা মন খারাপ করতেই নিচ্ছিল। প্রিয়ম দ্রুত বলল,’ আচ্ছা দিব। তোরা মেয়েরা এতো নাটক কিভাবে করিস? শিখিয়ে দিবি একটু। টিভি সিনেমায় কাজ করব ভাবছি। তোকে দশটা ওড়না কিনে দিতে আমার জনম জনম শেষ।’
‘ মাত্র দশটা ওড়নার জন্য তোর জনম জনম শেষ?’ অবাক হয়ে গেলে নীহারিকা।
‘ আলবাদ শেষ।’
‘ তুই এতো কিপটা প্রিয়ম? আমি ভাবতে পারিনি।’ আফসোস করে বলল নীহারিকা। তার চুক চুক শব্দে প্রিয়ম চুল টেনে ধরল বোনের। বলল,’ তোর এতো ভাবতে হবে না। তোকে আমি বাকি মেয়েদের থেকে আলাদা ভেবেছিলাম। কিন্তু তুইও ভ্যাঁ ভ্যাঁ ছাগল। মেয়েদের মত এভাবে কাঁদছিস কেন? ছিঃ।’
নীহারিকা চোখ মুখ মুছে নিয়ে ইচ্ছে করে কিছু কি/ল বসিয়ে দিল প্রিয়মের পেশিতে। তারপর রাগে গজগজ করে ঠেলতে ঠেলতে বলল,’ তাহলে কি ছেলেদের মত কাঁদব? আমি ছেলে?’
প্রিয়ম বের হতে চাইছে না। তাকে ঠেলে বের করে দেওয়া হলো। সে চেঁচিয়ে বলল,’ না। ছেলেদের মত স্ট্রং হবি।’
দরজার এ পাশ থেকে নীহারিকা বলল,’ মেয়েদের চেয়ে শক্তিশালী পৃথিবীতে আর কেউ নেই। এবার তুই ভাগ। আর দশটা ওড়নার টাকা যোগার কর। যা।’
‘ তোরা মেয়েজাতি চরম লোভী। সান্ত্বনা দিলেও আমাদের লস। হায় আফসোস।’ প্রিয়ম আফসোস করতে করতে চলে গেল। রেখে গেল ভালোবাসা। কিছু অর্থ হীন ভালোবাসা গুলো হয় অমূল্য। মানি লেস।
______________
চলবে………….
ভুলত্রুটি আল্লাহর দেওয়া মহান গুন ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টি দিয়ে দেখবেন। নিশ্চুয়ই ক্ষমা একটি সুন্দর গুন।
@হাফসা_আলম