প্রিয় সুখ পর্ব-৩৩

0
35

প্রিয় সুখ-৩৩
________
মিতু আপুর হাতে ফোন। তিনি বিছানার নিচে বসে আছে। নীহারিকা উঠে বসল পাশে। মিতু আপুর দিকে তাকিয়ে বলল,’ রাতে ঘুমাছ না কেন?’
‘ তোকে একটা কাহিনী শুনাতে ইচ্ছে করছে।’
‘ কিন্তু আমার শুনতে ইচ্ছে করছে না। চল ঘুমাবি। তুই রাতে খুব অল্প ঘুমাস আপু।’
‘ আমার ডিভোর্স কেন হয়েছে কখনো জানতে চাইলি না কেন?’ মিতু আপু হাসতে হাসতে বলছে। যেন কোন কৌতুক রচনা করছে। নীহারিকা গম্ভীর গলায় বলল,’ এসব জেনে আমার কাজ কি? পাশের বাসার আন্টি পাইছস না কি? চল ঘুমাবি।’
নীহারিকা উঠে যেতে চাইলো। মিতু আপু টেনে ধরল। বলল,’ লোকটা আমাকে খুব মারত নীহারিকা। এক রাতে গলা টিপে ধরেছিল। আমার তখন মনে হচ্ছিল দম বন্ধ হয়ে আসছে। এই বুঝি মরে যাচ্ছি। শ্বাস বন্ধ হলে অনেক কষ্ট নীহু। আমি এই জন্যে কখনো সুইসাইড করতে চাইতাম না। সবাই কত কথা বলত আমি শুনতাম। মা সারাদিন বকাঝকা করত আমি তাবুও শুনতাম। আমাদের মেয়েদের মনের কোন গুরুত্ব নেই বুঝলি। মা কখনো আমার ইচ্ছে গুলো শুনে নাই। আমি যখন তাকে এসব বলতাম তিনি কমন ডায়লগ দিত। সংসারে মানিয়ে নিতে হয়। আসলে সংসারে মানিয়ে নেও বলতে কোন বাক্য নেই। যখন কাউকে আমরা ভালোবাসবো তখন তার জন্য খুশি হয়ে কিছু করা আর মানিয়ে নেওয়ার মাঝে অনেক পার্থক্য। মানিয়ে তো তার সাথেই নেওয়া হয় যার সাথে বাধ্য হয়ে থাকতে হয়। ভালোবাসায় মানিয়ে নেওয়ার কোন সম্পূর্ণ নেই। মানিয়ে নেওয়ার মাঝে কষ্ট আর কষ্ট। আর ভালোবাসার জন্য ছাড় দেওয়ার মাঝে আছে আনন্দ। সংসার হবে ভালোবাসার। মায়ার। অনুভূতির, দায়িত্বের। কষ্টের কেন হবে? তাই আমি ছেড়ে দিলাম এসব সংসার কখনো আনন্দের হয় না। হয় কষ্টের। আতর্নাদের। পৃথিবীতে আমরা যা থেকে দূরে থাকতে চাই তা কেন আমাদের আশেপাশে সামনে আগে পিছে ঘুরে বল তো? আমি এসব থেকে পালাতে চাই। দূরে থাকতে চাই। শান্তিতে থাকতে চাই।’
নীহারিকা বোনের কোলে মাথা রাখল। মিতু আপুর কোল খুব গরম। ঘুম আসে ভালো। এই যে নীহারিকার মাতাল করা ঘুম আসছে। মিতু আপু তার জীবনে শুধু আপু নয় সে একটি অন্যরকম অনুভূতির নাম। যার সাথে রাগ করা যায়। হাসা যায়। কাঁদা যায়। পৃথিবীতে এমন একটি মানুষেরও খুব দরকার। ফাবিহা বিছানার উপরে শুয়ে এসব দেখছে। সে নড়াচড়া করছে না। নীহারিকা আরও গভীর ভাবে জড়িয়ে ধরে বলল,’ শাহিন ভাই তো তোকে ভালোবাসে। তাকে ছাড়লি কেন?’
‘ ভালোবাসা যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমন খুব পিড়া দায়ক। সবার ভালোবাসা সুন্দর আর অমায়িক হয় না। আমি যদি উনাকে বিয়ে করি উনার মা কখনো মেনে নিবে না। আমি একজন বিবাহিত মেয়ে হয়ে তাকে কেন বিয়ে করব? যদি সে আমাকে বিয়ে করে তাহলে তার জীবন অনেক কষ্টের হয়ে যাবে। আমার মত। সবাই তার পিছনে আগে সামনে কথা শুনাবে। কারণ সে আমার সাথে জড়িয়ে যাবে। তাই আমি চাই না এসবে সে জড়িয়ে পড়ুক। তবুও অসভ্যটা পিছনে পড়ে আছে।’ মিতু আপু এবার নিজের আগের রূপে চলে এসেছে। এখন আর তিনি গম্ভীর নয়। নীহারিকা মিতু আপুর জীবনের একটি অধ্যায় শুনে খুব কষ্ট পেলো। তার মন খুব খারাপ হয়ে কান্না আসছে। কিন্তু সে কাঁদছে না। চুপ করে নিজের মাঝে সব গিলে নিচ্ছে। মিতু আপু বলল,’ যাকে আমি ভালোবাসবো তাকে বিয়ে করা কি উচিৎ?’
নীহারিকা কোলে মুখ ডোবাল। মিতু আপুর কোলে বিড়াল ছানার মাথা যেন। নীহারিকার সুক্ষ্ম কণ্ঠ, ‘ না উচিৎ নয়। পৃথিবীতে যাকে তুই ভালোবাসবি তাকে বিয়ে করার মাঝে মহৎ কোন ব্যাপার নেই। তোর উচিৎ তাকেই বিয়ে করা যে তোকে প্রচন্ড ভালোবাসবে। কারণ ভালোবাসাই পারে ভালোবাসাকে পাল্টে দিতে। যখন তুই এমন কাউকে বিয়ে করবি যে তোকে অসম্ভব ভালোবাসে তখন তার ভালোবাসা দেখতে দেখতে তুই মায়ায় পড়ে যাবি। তার মায়ার সাগরে ভাসতে ভাসতে তুই তাকে ভালোও বেসে ফেলতে পারিস। যখন তোকে কেউ পার্থিব জিনিসের ঊর্ধ্বে ভালোবাসবে, তখন সে তোকে খুব সম্মান করবে। মর্যাদা দিবে আকাশ সম। ভালোবাসা ছাড়া বেঁচে থাকা সম্ভব। কিন্তু সম্মান, মর্যাদা, ইজ্জত, চরিত্র ছাড়া একটি মেয়ে বেঁচে থাকতে পারে না। এগুলো তার জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ভালোবাসা তোকে একটা সময় কষ্ট দিবে। হয়তো বিষণ্ণতার সময় মনে পড়বে খুব। কিন্তু তোর সম্মান তোকে পৃথিবীর বুকে বাঁচতে শিখাবে। মাথা উঁচু করে। তাই এমন কাউকে বিয়ে করা উচিৎ যে তোকে ভালোবাসবে। যে তোকে সম্মান করবে। সীমাহীন উচ্চতায় বসাবে। ভালোবাসার আকাশে ভাসাবে।’
মিতু আপু অবাক হয়ে গেল। নীহারিকার দিকে তার ড্যাব ড্যাব নজর। এসব কি নীহারিকা বলছে? তার চিন্তাধারা এতো উর্ধমুখী? কি আশ্চর্য! নীহারিকা গভীর ঘুমে। তার ভারী নিঃশ্বাস মিতু আপুর কোল জুড়ে। নীহারিকার সবচেয়ে বড় সত্তা সে গোপন ভাবে থাকে। তার অনুভূতিগুলো অত্যন্ত গোপন। রাগ ব্যতিত সে সব গোপনে রেখে দিতে পারে। যত্ন করে। নিজের হৃদয়ের কুটিরে। ভুবন ভোলানো একটি অস্তিত্ব সে। নীহারিকার চুলে হাত গলিয়ে দিল মিতু আপু। মেয়েটিকে নিষ্পাপ লাগছে খুব। অথচ কত কিছু তার মাঝে। গুপ্ত একটি সম্পত্তি তার হৎপিণ্ড। কুয়াশার মত আচ্ছাদিত করে রেখেছে তার সকল চাওয়া পাওয়ার আঙ্গিনাকে। ঠিক পাহাড়ের উপরের চূড়ান্ত গভীর সবুজ গাছপালার মত।
________
ভার্সিটির ক্লাসে বসে নীহারিকার মনে হয় অনেকে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। গভীর ভাবে তার সব আচার আচরণ লক্ষ্য করে। মাঝে মাঝে পাশে তাকালেই কারো না কারো সাথে তার চোখের দৃষ্টি মিলিত হয়ে পরে। কি আশ্চর্য্যের বিষয়! অথচ নীহারিকা অবাক হয় না। হুট করে কারও চোখে চোখ পড়লে সে চমকে উঠে না। স্বাভাবিক ভাবে থাকে সব সময়। কেন? সাগরিকা বসেছে তিন সিট পিছনে। সে বার কয়েক নীহারিকাকে ডাকল। কথা বলতে চাইল। কিন্তু এত আজব মেয়ে সে বাপের জন্মে দেখেনি। কি বেয়াদপ। পাত্তাই দিল না? রাগে দুঃখে সাগরিকার কাঁদতে ইচ্ছে করল। সে জীবনেও এমন অদ্ভুত প্রানীর সাক্ষাৎ পায়নি। ক্লাসের সবাই তাকে নিয়ে হেসে ছিল। মিটমিট করে। উচ্চ শব্দ তার কানেও এসেছে কিছু। কি শয়তান মেয়ে! অথচ এই মেয়ের কাছে সে তার সবচেয়ে গোপন কথা শেয়ার করেছে। এক সাথে সিএনজিতে বসেছে। হসপিটালে গিয়েছে। ভাবটা এখন এমন যেন কিছুই হয়নি। সে জীবনে সাগরিকাকে দেখেনি। চিনেও না। ক্লাস শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত নীহারিকা ক্লাস করল। ব্যাগ কাঁধে নীহারিকা যখন বের হয়ে আসল ক্লাসের সামনেই সে একটি দল দেখতে পেল। চোখ ছোট করে কিছুক্ষণ তাদের ধোঁয়া উড়ানো দৃশ্য অবলোপন করল। একটু ধিরে সে অন্য পথে হেঁটে যেতে লাগল। কিন্তু বেশি দুর যেতে পারল না। তার আগেই একটি শক্ত কন্ঠে নিজের নাম বেজে উঠতে শুনতে পেল। পা থামাতে না চাইলেও সে থামাল। এরা সিনিয়র। কথা না শুনলে এই বুড়া বয়সে এসে রেগিং এর শিকার হতে হবে। তাই চুপ করে দাড়িয়ে রইল। কিন্তু সে ফিরল না। সামনে এসে দাড়াল দু’টি মেয়ে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার নীহারিকাকে পর্যবেক্ষণ করে বলল,’ নীহারিকা তো?’ বলতে ইচ্ছে করল, আমি নীহারিকা নই। কিন্তু তাকে বলতে হবে। বাধ্য হয়ে সে মাথা দুবার দুলাল। মানে সে নীহারিকা। মেয়েগুলো যেন সোনার হরিণ পেল। পিছনে সামনে চোখ বুলিয়ে টান মেরে নীহারিকার নেকাব খুলে ফেলল। হতবাক দৃষ্টি নীহারিকার। মেয়ে গুলো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চিৎকার করে পিছনে তাকিয়ে বলল,’ দোস্ত আগুন সুন্দরী।’ তারপর অট্টহাসির শোরগোল শুরু হয়ে গেল। মুখের নেকাব ঠিক করে দ্রুত পিছনে একবার তাকাল নীহারিকা। কোঁকড়া চুলের লম্বাটে ছেলেটি বেশ উজ্জ্বল দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে। রাগে শরীর রি রি করে উঠল নীহারিকার। পৃথিবীর সবকিছুতে সে প্রতিরোদ তৈরি করার চেষ্টা করলেও এই রাগ সে কখনো প্রতিরোধ করতে পারে না। চোখ তীর্যক করে সে হাসি মাখা মেয়েগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল কয়েক সেকেন্ড। তারচেয়েও কম সময় নিয়ে সে দ্রুত তাদের দুই জনের চুলের হেয়ার ব্যান্ড টেনে খুলে নিচে ছুড়ে মারল। ভয়ংকর চোখে একবার তাকিয়ে সে হনহন করে চলে গেল। মেয়ে দুজন ভারী ব্যথা পেল। সাথে আশ্চর্য তাদের আকাশ চুম্বি। সাগরিকা হেসে খুন। তবে গোপনে। একবার সে পিছনে তাকিয়ে দেখল শরৎ নামের কোঁকড়া চুলের ছেলেটিকে। সাথেই চমকে উঠল চোখ জোড়া। এই ছেলে নীহারিকার দিকে এমন চোখে কেন তাকিয়ে আছে? মন জমিনে ভয় ঢুকে গেল সাগরিকার। অজানা কারণে সে চুপসে যেতে লাগল।

বাহিরে এসে খোলা আকাশের নিচে দাড়িয়েও নীহারিকার ভয়ংকর সে রাগ কমছে না। মনে মনে সে কয়েক বার মেয়ে গুলোকে গাল দিয়েছে। কিন্তু সে ভাবতে পারেনি সিনিয়রদের সাথে বেয়াদপি করলে তাকে শাস্তি পেতে হবে। দুটি ছেলে তার পিছনে এসে দাড়াল। নীহারিকার ভ্রু কুচকে নেওয়া দেখে একজন বলল,’ তোমাকে শরৎ ভাই ডাকছে। আমাদের সাথে এসো।’ নীহারিকা অবাক হয়ে ভাবল কে এই শরৎ? কিন্তু ছেলেগুলো খুবই ত্যাড়া দিতে শুরু করল। নীহারিকা বিরক্ত হয়ে যেতে বাধ্য হল। একটা নিরিবিলি রুমের কাছে আসতেই সাগরিকা তার পাশে এসে ফিসফিস করে বলল,’ শুন নীহু এখন নাটক করা বন্ধ কর আর আমাকে তোর সাথে নে।’ কি যেন ভেবে নীহারিকা চট করে রাজি হয়ে গেল। সে সাগরিকাকে মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে জানালো,’ চল। তবে চিপকা চিপকি করবি না।’ সাগরিকা হাসল। মেয়েটি এখনও তার মায়ের ব্যাপারে ঢোল পিটায়নি। মানুষ তাহলে মন্দ নয়। একটি রুমে এসে থামতেই সাগরিকাকে আটকে ছেলে গুলো বলল,’ শুধু নীহারিকা যাবে।’
‘ বাহ নামও জানেন? আপনাদের সমস্যা কি? সাগরিকা না গেলে আমি যাব না। আর আমি যে জিনিস না বলি তা তখনো জোর করে হ্যা করানো যায় না। নামের সাথে এটাও জেনে নিন।’ হুংকারে মিশ্রিত কন্ঠ শুনে ছেলেগুলো ভড়কে গেল। কি ভেবে যেতে দিল। ছেলেটি বসে আছে জানালার সামনে। রোদ এসে পড়ছে তার ফিট করা শার্টে। ধোঁয়ার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। তীব্র নিকোটিনের গন্ধে দম বন্ধ করে রেখেছে দু’জনেই। ছেলেটি না ফিরেই বলল,’ শরৎ নাম তো শুনেছ নিশ্চয়ই?’ কোন জবাব আসল না পিছন থেকে। শরৎ মৃদু ভাবে চোখ ঘুরিয়ে পিছনে তাকাল। সূর্যের আলো তখন নীহারিকার চোখে খেলা করছে। মিশমিশে কালো চোখজোড়া সোনালিতে রূপ নিয়েছে। ভাসা ভাসা দু’টি চোখ। শরতের মনে হয় পৃথিবীর সকল রূপ সৃষ্টিকর্তা মেয়েদের দিয়ে দিয়েছেন। এই মেয়েটি সেই রূপেরই অংশ। একনজর দেখেছিল সে। আর কখনো এই চেহারা দেখার সৌভাগ্য বা দূর্ভাগ্য হয়নি তার। তবে সে রোজ দেখে মেয়েটিকে। ইচ্ছে করে জিজ্ঞেস করতে,’ এত রাগ কেন তোমার? কিন্তু করা হয়ে উঠেনি। আজ সে করবে। গলা ঠিক করে শরৎ বলবে বলবে করছে। কিছুই বলতে পারছে না। সাগরিকা ছেলেটির চক্ষুবিন্দে তাকিয়ে রয়েছে। এত কি দেখছে মানুষটা? নীহারিকার তো শুধু চোখই দৃশ্যমান। চোখের কার্নিশ বেয়ে লাল লাল আভা ফুটে উঠেছে নীহারিকার। শরৎ প্রবল আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল,’ নাম শুনোনি আমার? শরৎ। লোকে বলে শরৎ কাল। তুমি কি বলবে?’
‘ ভালো মানুষ না।’ নিম্ন স্বরে বলল নীহারিকা। তার কন্ঠে না আছে ভয় না আছে ভনিতা। মেয়েটি কি সুন্দর করে রাগ ঝাড়ে! আশ্চর্য্যের বিষয় তো! ঠোঁট বাকিয়ে সে বলল,’ কেন?’
‘ আপনার সাথে আমার কোন প্রয়োজন না থাকার পরেও ডেকেছেন তাই। মেয়েদের প্রয়োজনের বাহিরে কোন কথা বলতে ডাকা উচিৎ নয়। একা ডাকা তো আরও উচিৎ নয়। সো মিস্টার শরৎ হেমন্ত বসন্ত যেই হোন না কেন ভুলেও আমাকে রেগিং দিতে আসবেন না। আসি।’
শরৎ মুগ্ধ হয়ে গেল। রাগ রাগ গলাও এতো সুন্দর হয়! নীহারিকা যেতে পা বাড়াতেই সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বলল,’ দাড়াও। ভালো কথা ভালো লাগে না বুঝতে পেরেছি। আমার ফ্রেন্ডদের চুল টেনেছ কেন? ওরা সিনিয়র জানো না? বেয়াদপি করো? বড়দের সম্মান করতে হয়।’
‘ ওরা আমার অনুমতি বিহিন নেকাব খুলেছে কেন?’
‘ তোমাকে দেখার জন্য।’
‘ আমিও চুল খুলেছি দেখার জন্য। আসি আসসালামুয়ালাইকুম।’
শরতের বেশ হাসি পাচ্ছে। মেয়েটা রেগে রেগে সব কথা বলে। রাগের ব্যামো আছে না কি? নরম গলায় বলতে চেয়েও বলল না। রেগে বলল,’ এর শাস্তি তো তোমাকে পেতেই হবে। আজ আমার সাথে বসে সিগারেট খাবে। বলো কোন ব্র্যান্ড খেতে পছন্দ করবে? এটাই তোমার শাস্তি। বলো বলো?’ শরৎ ইচ্ছে করে এটা বলল। সে দেখেছে নীহারিকা সিগারেটের গন্ধেই চোখ উপরে তুলে ফেলছে। দূর্বল পয়েন্ট। নীহারিকার কানে হাসিতে ফেটে পড়ার শব্দ আসল। কোণে দাড়িয়ে সেই মেয়েগুলো। এবার সে চেয়ার টেনে বসল। আর একটা চেয়ার সাগরিকাকে টেনে দিয়ে বলল,’ যেটা আপনি পছন্দ করেন।’ সাথে সাথে হাসি বন্ধ হয়ে গেল। শরৎ হতভম্ব হয়ে গেল। ভয় দেখতে চেয়েছিল রাগ নয়। এই মেয়ে কি সত্যি সিগারেট খায়? নীহারিকার ত্যাড়া,’ দ্রুত দিন। আপনার কাছে নিশ্চয়ই আছে। বাসায় যেতে হবে।’
‘ তুমি সিগারেট খাও?’ শরৎ বিস্মৃত। নেকাবের ভেতরের মুখটির অবস্থা বুঝা গেল না। কিন্তু কন্ঠ বেশ শক্ত,’ না। এত বিস্মৃত হওয়ার কিছু নেই। কেউ একজন বলেছিল মেয়েরাও সিগারেট খেতে পারে। এদের জন্য আলাদা করে নিষেধাজ্ঞা নেই।’
চেয়ারে বসল শরৎ। ধিরে ধিরে পকেট হাতরে সিগারেটের প্যাকেট বের করল। তার এখন কেমন যেন লাগছে। সে চাইছে নীহারিকা যেন সিগারেট না ছোঁয়। কিন্তু এখন নিষেধ করতে পারবে না। প্রিয় বান্ধবীদের কথা দিয়েছে চুল টানার বিনিময়ে সে নীহারিকাকে জব্দ করবে। মনে হচ্ছে ব্যাপারটা উল্টো পড়ছে। সিগারেট ধরানো হলো। ধূসর রঙ্গের ধোঁয়ার সাথে মিশ্রীত বিশ্রী গন্ধ। নীহারিকা হাতেও নিল। সাগরিকার চোখ কটর থেকে বের হয়ে আসছে। অথচ বাংলাদেশের কিছুসংখ্যক মেয়ে ইদানিং ইয়াবা হিরোয়িন বিভিন্ন নেশা দ্রব্য অনায়াসে গিলছে। তবুও কিছু ক্ষেত্র আমাদের কাছে চিরো আশ্চর্যের হয়ে থাকবে। যেসকল বস্তু আমাদের দেশের ঐতিহ্যের সাথে মিলে না সেই সকল বিষয় শুনলেই চোখ কপালে উঠে। এসব ভাবনার মাঝেই সাগরিকা চমকে উঠল। শরতের ডান হাতের পিঠে নীহারিকা আগুন যুক্ত সিগারেট ছুঁড়ে দিয়েছে। হাত ঝেড়ে উঠে দাড়ায় শরৎ। তার চোখমুখ লাল টকটকা। নীহারিকার চোখ শান্তশীতল পানির মত স্তব্ধ। কিছু সময় শরৎ সহ তার বান্ধবীর ছোট দল ঘোরের মাঝে ছিল যেন। চুপ করে তারা দেখে গেল। প্রথমে চেঁচাল। তারপর নীহারিকার দিকে তেড়ে আসল। শরৎ এখনো স্তব্ধ জনতার মত মুখ করে রেখেছে। সাগরিকা কিছুই বুঝল না। নীহারিকার রাগ বেশি। কিন্তু এত রাগ? সামান্য কারণে মানুষকে আঘাত করতে পারে না নীহারিকা। অল্প আলাপে সে সুনিশ্চিত। তাহলে ঘটনা কি? এবার নীহারিকা উঠে দাড়িয়ে শরতের রক্ত লাল হয়ে উঠা চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,’ আমার ভাইকে থাপ্পড় দিয়েছিলেন না? এটা তার জন্য। আর বাসার আশেপাশে ঘুরা বন্ধ করুন তা না হলে আরও ভয়ংকর কিছু করতে পারি। রেগিং খাওয়ার বয়স শেষ। সিনিয়র সিনিয়র ভাব বন্ধ করুন। ভালো থাকবেন।’
নীহারিকা বেরিয়ে গেল রুম থেকে। তাকে জায়গা করে দিয়েছিল বাকিরা। শরৎ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। সে বেশ কিছুদিন ধরে নীহারিকাদের ঘরের বাহিরে ঘুরে বেড়িয়েছে। ফলে একদিন প্রিয়মের চোখে পড়ে। নীহারিকা তখন তার বারান্দায়। গেটের পাশ থেকে বেশ ভালোই দেখা যায় সেটি। শরৎ দ্বিতীয়বারের মত নীহারিকাকে দেখায় মগ্ন ছিল। আর নীহারিকা মগ্নছিল বেরিক তুতুর খাবার নিয়ে। প্রিয়ম টিউশন থেকে ফিরছিল। হুট করে নিজের ঘরের সামনে একটি ছেলেকে দেখে সে অবাক হলেও যখন দেখল সেই ছেলেটি তার বোনকেই পর্যবেক্ষণ করছে বেশ রাগ চড়ে বসে ছিল। ভার্সিটির পরে টিউশন। বেশ প্যাড়া দায়ক কার্যসম্পর্ণ করে সে ক্লান্ত। সাথে জমা হলো রাগ। দ্রুত সে কর্কশ ভাষায় চেঁচিয়ে বলে উঠল,’ কি চাই?’ শরৎ তখন সত্যি অন্যজগতে ছিল হয় তো। তার হুশই হলো না। প্রিয়মের সহ্য শক্তি কমে গেল। একটা ধাক্কা দিয়ে বসল। শরতও রেগে আগুন হয়ে গেল। চিৎকার করে কিছু অকথ্য ভাষা শুনিয়ে দিল। প্রিয়মেরও পাল্টা রাগ প্রকাশিত হলো। এদের চিৎকার বারান্দার রেলিং ভেদ করল। নীহারিকা উৎসুক হয়ে উঠল। সচকিত নয়নে সে রেলিং ধরল। বেশ আগ্রহীত সে। তখনই ভয়ংকর কান্ড ঘটে। প্রিয়মের গাল বরাবর থাপ্পড় বসিয়ে দেয় শরৎ। সে এক ভয়ংকর দৃশ্যের রূপ। প্রিয়মের গালে পঞ্চম আঙ্গুল। নীহারিকা ছুটে নিচের দিকে আসল। গেটের কোণ থেকে সে দৃশ্য দেখে শরৎ আস্তে সরে গেল। সে তখন সত্যি জানত না প্রিয়ম নীহারিকার ভাই। জানলে রাগ একটু দমিয়ে রাখার চেষ্টা করত। কিন্তু সে ভেবেছিল নীহারিকা তাকে দেখেনি। মেয়েটার চোখ তো দারুন তীক্ষ্ন! প্রতিশোধও ভালোই নিতে পারে। পোড়া হাতের দিকে চোখ রেখে শরৎ রাগে কটমট করে তাকিয়ে মৃদু ঠোঁট ঝুঁলিয়ে হাসল। এই হাসির প্রকৃত অর্থ কেউ বুঝে কি না কে জানে।

গেটের বাহিরে এসেই নীহারিকা ফোঁস করে শ্বাস ফেলেছে। এমন নয় যে সে ভয় পায়নি। এমন ভয়ংকর কান্ড করতে তারও ভয় করে। বুক কাঁপে। তবুও সে করে। ইদানিং ভালো লাগে। সে কি প্রতিবাদী হয়ে গেছে? কিন্তু নীহারিকা প্রতিবাদী হতে চায় না। সে শুধু মনের কথা মুখে শিকার করতে চায়। যার প্রতি তার যেমন চিন্তা কাজ করে তা দেখিয়ে দিতে চায়। এক কথায় সে স্পষ্টবাদী হতে চায় প্রতিবাদী নয়। সাগরিকা গুমুট মেরে প্রশ্ন করল,’ তোর ভয় লাগে না? জানিস শরৎ ভাইয়ের বাপ কে?’
চারপাশে উৎসুক ছেলে মেয়ে দেখে নীহারিকা অবাক হয়ে গেল। সাগরিকা বেশ বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে রইল তার মুখের দিকে। নীহারিকার চোখ তার চোখে পড়তেই সে বলল,’ হ্যাঁ ভয় তো আমি পেয়েছিলাম। আর উনার বাপ কে আমি জানি না উনি কে সেটাও জানি না শুধু আমার ভাইকে মেরেছে বলেই চিনতে পেরেছি।’
‘ সত্যি ভয় পেয়েছিলি? কই আমি তো দেখলাম না।’
‘ পেয়েছিলাম। আমি ঢকঢক করে কেঁপে ছিলাম। ভয়ে গলা শুকিয়ে গিয়েছিল। হাত পা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল।’
‘ কখন?’ হতভম্ব সাগরিকা।’
‘ নিজের সামনে। কারণ নিজের দূর্বলতা শুধু নিজের চোখের সামনেই ভাসমান হওয়া উঁচিত। অন্যের সামনে পাথর হয়ে সাহসীর লেভাস পরে থাকা উচিৎ। যেন তোমাকে দূর্বল না ভাবে। তুমি ওতটাও গাঁধা নও। সামনে থেকে সরো।’
‘ শরৎ ভাইয়ের বাবা কিন্তু মাফিয়া টাইপের লোক আমি বাবার কাছে শুনে ছিলাম। বেশ পাওয়ার ফুল।’
নীহারিকা বিরক্তির সাথে একবার চোখ রাখল সাগরিকার ভীতু সংকীর্ণ মুখের দিকে। ধীর পায়ে রাস্তার দু’পাশে সে দুবার যাওয়া আশা করে হঠাৎ প্রকপ রেগে আগুন হয়ে গেল। তার এহেন কান্ডে সাগরিকা আশ্চর্য ছাড়া কিছুই হতে পারল না। নীহারিকা থমথমে মুখ নিয়ে কিছু সময় অগ্নীয় চক্ষু মেলে চেয়ে রইল মাটির দিকে। এরা এখানে কি করছে? বিমুগ্ধকে দেখা যাচ্ছে নিজের গাড়ির উপরে বসে আছে। তার গায়ের পোশাকের কথা না বলাই ভালো। মনে হচ্ছে ইদুর টি-শার্টের ডান পাশের কাধের দিকে কুটকুট করে ছোট ছোট ছিদ্র করে দিয়েছে। এমন উদ্ভট পোশাক কোথায় পায় এই ব্যক্তি? ছাই রঙ্গা টি-শার্টের এক পাশে গোল গোল ছিড়া ডিজাইন দেখেই মেজাজ খারাপ হলো নীহারিকার। চোখে তার রোদ চশমা। কালো প্যান্ট। তার সামনের গাড়িটি জাওয়াদের। দু’ জনে কি প্ল্যান করে এসেছে? বন্ধু হয়ে গেলো না কি? ভার্সিটি ভর্তি মেয়ে ছেলেদের উৎসুক ব্যস্ত চোখ তাদের দিকে। জাওয়াদকে দেখে সাগরিকা চমকে গিয়ে বলল,’ ভাই সেই সুন্দর ডাক্তারটা না? এখানে কি করছে?’
‘ আমার মাথা করছে। একটা কাজ কর তুই আমার সামনে সামনে হাঁট। লুকিয়ে যেতে হবে।’
আরও বিস্ময়ে ফেঁটে পড়ল যখন সে বিমুগ্ধকে দেখল। আরে এটা তো আরও বড় মিরাক্কেল। বিমুগ্ধ নেমে এসে জাওয়াদের কাধে হাত দিয়ে বলল,’ আপনি এখানে এসেছেন কেন? রাগেশ্বরী তো আমার সাথেই যাবে। কারণ সে আমার বাড়িতে থাকে।’
‘ তোমার ভুল ধারণা শুধরে দেওয়ার জন্য বলছি যে নীহারিকা আমার সাথেই যায় বাড়িতে।’
‘ আর আপনার ধারণা ভঙ্গ করার জন্য বলছি, সে জীবনে মাত্র দুবার আপনার গাড়িতে উঠেছে। ফলে এসব বলে লাভ নেই।’
দু’ জনের রেশারেশি চলতেই থাকল। নীহারিকা মেয়েদের সাথে ছেলেদের ফিসফিস কথাও শুনছে। রাস্তায় এসব কেমন আচরণ? যদিও দু’ জন বন্ধুর মত কথা বলছে। এদের কার্যক্রম বুঝার উপায় নেই। বিমুগ্ধকে দেখেই শরৎ চমকে গেল। এই ছেলে এখানে কি করছে? আরে এটা তো তার বাবার সাথে যে ছেলেটিকে দেখেছিল সে। শরৎ রাগে ফোঁসফোঁস করে উঠল। এই ছেলের হাড্ডি ভাঙ্গতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু এখন আপাতত সেটা করা যাবে না। বাবার আদেশ। জাওয়াদের সৌন্দর্য্যে সাগরিকা সহ মেয়েরা মুগ্ধ। বিমুগ্ধের স্টাইলে সবাই ফিদা। এদের দু’ জনের এসব অসহ্য লাগছে নীহারিকার। সে খুব গোপনে চোখ ফাঁকি দিয়ে দূরে চলে এসেছে। সাগরিকাকে বলল,’ তুমি যাও এখন। আমি যেতে পারব।’
‘ তুমি বাসে করে যাবা?’
‘ হুম। আমার বাবার আসতে দেরি হবে। আমি নিজেই চলে যাব আজ।’
‘ আমিও যাব।’ সাগরিকা মনে মনে দোয়া করল যেন নীহারিকার মতের পরিবর্তন ঘটে। সে জীবনেও বাসে উঠেনি। এখন উঠলে জীবনের ভয়ংকর অভিজ্ঞতা হবে। নীহারিকা মুখ দেখে বুঝতে পেরে হাসল। সেও বাসে কয়েকবার উঠেছে মাত্র। কিন্তু একা জীবনে আজ প্রথম। নীহারিকা বলল,’ তুমি যদি আমার সাথে না যাও আমি তোমাকে আমাদের বাসায় ইনভাইট করব। রাজি হলে পিছা ছাড়।’ সাগরিকা খুশিতে গদগদ। বলল,’ অবশ্যয়। মনে থাকে যেন। কবে যাব?’
‘ দু’ দিন পরে এসো। এখন যাও।’
সাগরিকার গাড়ি আসল। নীহারিকাকে সে অনেক টানাটানি করল। কিন্তু নীহারিকাকে রাজি করানো অসম্ভব। বাসে উঠে নীহারিকার সত্যি ভীষণ বাজে অনুভব হলো। এতো ভীড়! প্রচুর ধাক্কা ধাক্কীর এক পর্যায়ে সে একটু দাড়াতে পারল। এসব হয়েছে জাওয়াদ আর বিমুগ্ধের কারণে। তা না হলে সে বাবার জন্যে অপেক্ষা করত। সিএনজি রিক্সার ভাড়া নেই তার কাছে। কারণ অবশ্য আসার সময় সে বেশি টাকা নিয়ে আসেনি। বিপদ যখন আসে সব দিক দিয়ে আসে। নীহারিকা ব্যাগ থেকে একটি লম্বা লোহার চিকন কাঠি নিজের হেজাবের নিচে দিয়ে চুলে ঢুকিয়ে রাখল। যাতে বেশি উড়ে না হয়। ধাক্কা ধাক্কীতে যখন সে সিদ্ধ হয়ে যাচ্ছিল ঠিক তখনই তার দু’ পাশে শক্ত দু’ টি হাত এসে পড়ল। রেগে আগুন হয়ে নীহারিকা হাত পিছনে নিতেই ফিসফিস করে কেউ বলল,’ আমি। একদম এটা বুকে ঢুকানোর চেষ্টা করবে না।’ নীহারিকা ঘাড় ঘুরিয়ে চাইল। বিমুগ্ধকে দেখে চমকে গেল। মানুষটিকে তো সে ফাঁকি দিয়ে এসেছিল। এখানে কিভাবে? আজ প্রায় আট দিন পরে তাদের দেখা হয়েছে। হঠাৎ করে বিমুগ্ধ কাউকে কিছু না বলে হারিয়ে গেল। সে নিজের বাসায় চলে গেল। সেদিন রাতে যখন নীহারিকা প্রিয়মকে পাঠাল তখন সে গিয়ে খুঁজে পেলো না কাউকে। বিমুগ্ধকে সারা রাত চিন্তিত হয়ে সবাই খুঁজে ছিল। সকাল দশটায় সে ফোন করল। বলল সে হসপিটালে। আজ হঠাৎ উদয় হয়েছে আজব ভাবে। নীহারিকা বিমুগ্ধের বুকে বাড়ি খাচ্ছে। হাত পায়ে কাঁপন ধরছে থরথর করে। ঘামাচ্ছে দিগুন তালে। কি ভীষণ অদ্ভুত লাগা। কড়া সুগন্ধির সাথে মিশ্রিত ভ্যাবসা ঘ্রাণ। বিমুগ্ধ কাঁপা কাঁপি অনুভূব করতে পারছে। আরও একটু দূরে সরে দাড়াল শক্ত করে। যাতে নীহারিকার গায়ের সাথে বেশি না লাগে। নীহারিকার তবুও অস্বস্তি লাগছে। বিমুগ্ধের দু’টি হাত যুক্ত বাহু তার দু’ পাশে। একজন পিছন থেকে বিমুগ্ধকে বলল,’ কি ভাই মেয়ে মানুষের গায়ের সাথে লেগে দাড়িয়ে আছেন কেন? এসব কেমন অসভ্যতা।’ নীহারিকা পিছনে ফিরে তাকাল। একটু পিছনে হেলে মিহি কণ্ঠে বলল,’ আপনাকে এখন আমি পাবলিকের হাতে গন পিটানি খাওয়াতে পারি। উঠেছেন কেন? আর এভাবে দাড়িয়ে না থেকে পাশে সরে আসুন।’
বিমুগ্ধ কিছু বলল না। তার চোখ মুখ ভয়াবহ লাল। গরমে ঘেমে শরীর ভিজে গেছে। মাথা চক্কর দিচ্ছে। আগে কখনো সে বাসে উঠেনি। কারণ আছে অবশ্য। বিমুগ্ধের ভীর যুক্ত মানুষের মাঝে থাকার সমস্যা আছে। সে এতো মানুষের গায়ে ঘেষা ঘেষি করতে পারে না। গাড়ির এক একটা ঝাঁকিতে তার শরীর মেচমেচ করে উঠছে। অথচ মুখ একদম স্বাভাবিক তার। যেন সে খুব অভিজ্ঞ প্যাসেঞ্জার। বিমুগ্ধ লোকটির গায়ের সাথে লেগে কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,’ আমার তুমি সে। রেগে আছে তো তাই এমন মুখ ঘুরিয়ে দাড়িয়ে আছে। রাগ করে কথা বলছে। তার রাগটা একটু বেশি। সিরিয়াস হবেন না আপনারা।’
বিমুগ্ধ নিচু চোখে নীহারিকাকে দেখছে। সবার ফিসফিসানি কমে যেতেই নীহারিকা চারপাশে দেখল। কি হলো? সব চুপ করে গেল কেন? পিছনের মানুষ নামার সময় বিমুগ্ধের শরীরে ঘেঁষে ঠেলে নামছিল। নীহারিকার গায়ের সাথে লাগতেই সে দু’ হাত উপরে তুলে বলল,’ দুঃখিত।’ নীহারিকার কঠিন চোখ। বিমুগ্ধ ভয় পাওয়ার অভিনয় করে বলল,’ বাসে উঠতে গেলে কেন? অসহ্য লাগছে।’ বিমুগ্ধ মৃদু হাসল। তার অবস্থা খারাপ। কিন্তু তার মুখমন্ডলে তার অপ্রকাশীত। নীহারিকা হাসছে। কিন্তু তার হাসি বুঝার উপায় নেই। সে তীক্ষ্ম গলায় বলল,’ আপনাকে কে উঠতে বলেছে? এখন অসহ্য অসহ্য করছেন কেন? আর একদম গায়ের সাথে লাগবেন না।’
‘ পাবলিক বাসে উঠবেন আর ধাক্কা খাবেন না এটা তো হয় না মেম।’ বিমুগ্ধ এবার ইচ্ছে করে নীহারিকার বাম পাশের বাহুতে তার বাহু দিয়ে একটা ধাক্কা দিল। নীহারিকা রেগে আগুন হয়ে বলল,’ ধাক্কা দিলেন কেন?’
‘ আমি? কখন?’ অবাক চোখ বিমুগ্ধের।
‘ আপনি একটা মিথ্যুক।
‘ জানি।’
‘ হঠাৎ কোথা থেকে উদিত হয়েছেন? আপনি তো গায়েব হয়ে গিয়ে ছিলেন।’
‘ কেন মিস করছিলে? ওহ।’ বিমুগ্ধ নাটকিয় ভঙ্গিতে বামবক্ষের পিঞ্জরে হাত বুলাল। চোখ মুখের ভাব এমন করল যেন সে আনন্দে, খুশিতে, আত্মহারা। নীহারিকা এসব দেখল একবার ঘুরে। হঠাৎ খুব জোড়ে ধাক্কা লাগায় নীহারিকা সামনের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছিল। যা দেখে বিমুগ্ধ দু’ বাহু চেপে নিজের বুকের সাথে ঠেসে ধরল। হেসে হেসে বলল,’ তোমাকে আমি দেখে নিব। বাসে উঠা ভুলিয়ে ছাড়ব।’ নীহারিকার রুদ্ধশ্বাস। হৃৎপিণ্ড লাফাচ্ছে বিমুগ্ধের। কি উচ্চ শব্দ তার। অনুভূতি গুলো এই ঘর্মাক্তর দুপুরে বসন্ত হয়ে এসেছে। নীহারিকার অদ্ভুৎ লাগছে। অসম্ভব লজ্জায় তার গাল নাক কান লালাভ হয়ে এসেছে। বিমুগ্ধের ভয়ংকর পুরুষালী ঘ্রাণ দম বন্ধ করে দিচ্ছে তার। তার ভালো লাগছে। জীবনে প্রথম মনে হচ্ছে পৃথিবীতে একটি মানুষ থাকা উচিৎ। যে শুধু এভাবে আগলে রাখবে। হেসে হেসে রাগ প্রকাশ করবে। এভাবে ঘ্রাণে পাগল করবে। শব্দের তাণ্ডবে ভষ্ম করবে। সত্যি একজনকে প্রয়োজন। যে পৃথিবীর কঠিনতা থেকে রক্ষা করবে। প্রতিটি নারীর জন্য এমন সব বডিগার্ডদের সত্যি বড্ড বেশি আব্যশক। বিমুগ্ধ কি তার জীবনের সেই মানুষটা? যাকে দেখে তার আকাশসম ভালোবাসা পাওয়ার কথা মনে পড়ছে? যার প্রেমে চূড়ান্ত ভাবে পড়তে ইচ্ছে করছে? যাকে ঘিরে হাজারো কঠিন কঠিন ভুল করতে ইচ্ছে করছে? নির্দোষ, নির্ভেজাল আবেগে বেয়ারা হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে? সত্যি এটাই কি সেই ছটফট সৃষ্টিকারী মানব? নীহারিকার ভাবনার জগৎ দীর্ঘ হলো। তার ধারণার বাহিরে রইল সে এখনও বিমুগ্ধের বিক্ষিপ্ত আগুনপিন্ড, হিরণ্যবক্ষার উপরে গৌরবের সাথে একচ্ছত্র অধিকার বলে অবস্থান করছে।
পাশের মেয়েটি একজন ভার্সিটি ছাত্রী হয় তো। গায়ে তার বোরকা হলেও হাতে বই। বিমুগ্ধের থেকে একটু দূরে অবস্থান তার। নীহারিকার পাশে। বাস ভর্তি অল্প বয়সী ছেলে মেয়েদের চোখ যখন বিমুগ্ধদের দিকে তখন তার চোখ নিচের দিকে। সে এদিক সেদিক চাপছে। তার পাশে মধ্যবয়স্ক এক ভদ্র পোশাকের পুরুষ। এক হাতে তার ফোন। তিনি চিৎকার চেঁচামেচি করে কাদের যেন নিজের গাড়ি ঠিক করার কথা বলছে। মেয়েটি আরও ঘেষে নীহারিকার গায়ের সাথে লেগে দাড়াল। বিমুগ্ধের চিল চোখ দেখল মধ্যবয়স্ত অতি ভদ্র বাংলাদেশি পুরুষ মানুষটির একটি হাত মেয়েটির বক্ষ ছুঁয়ে দিচ্ছে। কোমড়ে হাত রাখছে সকলের অগোচরে। তার হাতের ভয়াবহ আতঙ্কিত, জঘন্যতার খেতাব প্রাপ্ত ভদ্রতা জনিত ছোঁয়া অন্য একটি মেয়ের জীবনে নতুন করে একটি অধ্যায় লিখছে। যে অধ্যায় তাকে ভুলতে দিবে না। ঘুমাতে দিবে না। মুখস্ত ঠোঁটস্থ হয়ে শরীর, মন, আত্নাকে চূর্ণিত করবে। জীবনের একটি অবিশ্বাস্য কদর্য অনুভূতি হয়ে থাকবে। বাবা ভাই পুত্র স্বামী নামক পুরুষজাতির প্রতি জন্ম নিবে ঘৃণা। শ্রদ্ধা সম্মানের চোখে থাকবে অসহ্যতা। বিমুগ্ধ চোখ সরিয়ে নিল। অন্যের ব্যাপারে সে নাক গলাতে চাইছে না। এসব ঝামেলায় সে কখনো পরে না। মেয়েটি কিছু বলছে না। শুধু নড়াচড়া করছে। সরে আসছে। বিমুগ্ধ নীহারিকার দিকে অনেক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর কি হলো ঠিক বুঝা গেল না। বিমুগ্ধ নীহারিকার পিছনের সেই লোহার চিকন কাঠি বের করে বাতাসের বেগে হাতে ঢুকিয়ে দিল লোকটির। মেয়েটির কোমড় একটুর জন্যে বেঁচেছে। বিমুগ্ধ হাত সরালো না। ভদ্র লোক চিৎকার করে যখন হাত সরিয়ে নিল বিমুগ্ধ তখন আরো গভীর ভাবে গেঁথে দিয়ে দেখল এপাশ ওপাশ হয়েছে কি না। তারপর অতি সাবধানে ছেড়ে দিয়ে হৃদয় কাঁপানো হাসি দিয়ে মেয়েটিকে বলল,’ অসহ্যতা এভাবে প্রকাশ করতে হয়। না এভাবে বলতে হয়। ঘৃণা এভাবে দেখাতে হয়।’
সবাই অবাক। কেউ কিছু বুঝলো না। শুধু বুঝল মেয়েটি। অতি ভদ্র পুরুষকে দেখে বুঝায় যাচ্ছে না তিনি এমন গুনের একটি কাজ করে পুরুষজাতিকে ধন্য করতে পারেন। সাথে সাথে শুরু হলো চিৎকার চেঁচামেচি। ড্রাইভার গাড়ি থামাতে বাধ্য হলো। সকলে বিমুগ্ধের দিকে তাকিয়ে আছে। অথচ সে কিছুই দেখছে না যেন। তার মত কোন প্রাণীই নেই এই বাসে। যে আছে সে আপাতত নীহারিকার গার্ড। সে খুব সাবধানে নীহারিকার দু’ পাশে হাত দিয়ে রেখেছে। সবার এই অতি আগ্রহ, উত্তেজনা, চিৎকার, বিশৃঙ্খলা কিছুই তাকে ছুঁয়ে যেতে পারলো না। মেয়েটি বাস থেকে এক প্রকার পালিয়ে বের হয়ে গেল। সে এতো মানুষের হট্টগোলে আতঙ্কিত হয়ে গেছে। বেশিরভাগ মানুষ বের হতে শুরু করল। ভদ্র লোক সাধু মানুষের লেভাস পরিধান করে ধমকি দিয়ে বলল,’ তোর সাহস তো কম না? এই কাজ কিভাবে করলি? গুন্ডা/সন্ত্রাসীরাও এখন দেখি বাসে যাতায়াত করে। তোরে আমি পুলিশে দিব। তুই জানিস আমি কে?’ বলতে বলতে তার আর্তনাদে ফেঁটে পড়া গলা কষ্টে কাতর হয়ে উঠল। ফোন বের করে তিনি কাউকে কল করার জন্য নিলো। এক হাতে পারছিল না। অন্য হাত দিয়ে গড়গড়িয়ে রক্ত ধারা। গাড়ি ভর্তি কিছু মানুষ ক্ষিপ্রতা নিয়ে বিমুগ্ধকে এক বলছে,’ লাফাঙ্গা/গুন্ডা/সন্ত্রাসি।’ কেউ কেউ ভয়ে নেমে গেল। কেউ বা কারণ যানার জন্য আগ্রহীত। বিমুগ্ধের ভাব এতটাই প্রখর যে কেউ তাকে সাধারণ কিছু ভাবতেই পারছে না। তার ঠোঁট হাসছে। হাসছে চোখ। মুখে কোন কথা নেই। পূর্বের ন্যায় দাড়িয়ে। নীহারিকা রেগে গেল। বিমুগ্ধের বুকে ধাক্কা দিয়ে বলল,’ বাসে উঠে এসব কি শুরু করেছেন? এটা কি করলেন? আপনি কিভাবে কাউকে, এভাবে আহত করতে পারেন?’
‘ আরও একটি কাঠি পড়ে আসলে পুনরায় করে বুঝিয়ে দিতাম। হাত একটি এখনও অক্ষত আছে।’
‘ পুনরায় করতেন?’ বিস্ময়ে ফেঁটে পড়ল নীহারিকা। ভদ্র লোক পুলিশে কল করলেন। মনে হচ্ছে একটু বেশিই ভদ্র সমাজের তিনি। নীহারিকা এবার ভয় পেয়ে গেল। সে বিমুগ্ধকে শান্ত গলায় বলল,’ আপনি এমন কেন করেছেন?’
‘ ইচ্ছে করেছে। তুমি তো জানো আই লাভ মাই ওন ফিলিংস।’
‘ তাই বলে কারো হাতে এভাবে আঘাত করবেন?’
‘ অবশ্যয় করব। আমার ইচ্ছে করেছে বলে কথা। তোমার ইচ্ছে কি? বের হবে না বাসে থাকবে?’
‘ পুলিশকে ডাকা হয়েছে কেউ একে বের হতে দিবেন না আপনারা। রাস্তাঘাটে উশৃঙ্খলতা সৃষ্টি করবে? জঙ্গী/সন্ত্রাসী/গুন্ডা ছেলে একটা। পাগল টাগল না কি?’ লোকেদের শোরগোল বাড়ল। ভীর হয়ে গেল। ভদ্র লোকের বিরাট ফোর্স। আধাঘন্টায় পুলিশ এসে হাজির। নীহারিকা ভয়ে আঁতকে উঠল। সে জীবনে এমন ঘটনার শিকার হয়নি। বিমুগ্ধকে বলল,’ কেন করেছেন বলুন তো? প্লিজ।’
‘ ভবিষ্যতে যেন কেউ আমার প্রিয় জিনিসে হাত না দেয় তাই। অন্যায়ের বিরুদ্ধে চুপ করে থাকলে শুনেছি আল্লাহ ক্ষিপ্ত হয়। তখন নিজের জীবনে অভিজ্ঞতার শিকার হতে হয়। সৃষ্টিকর্তাকে রাগিয়ে তো লাভ নেই। তাই আমি আগে ভাগে নিজেকে সেফ করে নিয়েছি। স্বার্থ সবার আগে।’ নির্লিপ্ত ভঙ্গী বিমুগ্ধের। নীহারিকা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,’আপনি কখনো সিরিয়াস হবেন না?’
‘ আমি প্রচন্ড সিরিয়াস নীহারিকা। তোমার প্রতি আমার সিরিয়াস নেস আমি কখনো প্রকাশ করে বুঝাতে পারব না। মেয়েটিকে দেখার পরে আমার বুক শব্দ করতে লাগল। মস্তিষ্ক লাফাতে লাগল। শরীর উত্তপ্ত হয়ে উঠল। বার বার আম্মির কথা, তোমার কথা, আনজুমের কথা মনে পড়তে শুরু করল। নিজেকে প্রচন্ড কন্ট্রোল করতে চেয়েছি আমি। কিন্তু হচ্ছিল না। দেখ আমি ঘেমে গিয়েছি। আমার গলা শুকিয়ে গিয়েছে। আমার গরম হাত ঠান্ডা হয়ে গেছে। আমি কখনো অন্যের জন্য কিছু করি না। কখনো না। সব করি নিজের জন্য। আমি নিজেকে প্রবল ভাবে ভালোবাসি রাগেশ্বরী। এসব করেছি নিজের ভালো থাকার জন্য। শান্তির জন্য। এখন আমার এতো শান্তি, আনন্দ হচ্ছে যে সকলের সামনে তোমাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে। তোমাকে জড়িয়ে ধরলে কি সকলের সামনেই জুতো খুলে মারবে?’ বিমুগ্ধ মুচকি হাসল। সূর্যের কড়া আলোয় তা অসম্ভব সুন্দর লাগছে। নীহারিকা তাকিয়ে রইল। সকলের সামনে। ভরা রাস্তায় সে গভীর বিচক্ষণ অণুবীক্ষণ যন্ত্রের মত তীক্ষ্ণ ধারালো লোচন জোড়া দিয়ে বিমুগ্ধকে দেখতে দেখতে বুঝতে পারল পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের সাথে সাথে তাদের চরিত্রগুলোও এক একটি সত্তা হয়। খারাপ ভালো মানুষের মধ্যে নয় চরিত্রে থাকে। বিমুগ্ধের প্রতি নীহারিকার মোটেও সম্মান, শ্রদ্ধা কাজ করছে না। কারণ বিমুগ্ধ এভাবে কিছুই প্রকাশ করেনি। নিজেকে সে শ্রদ্ধেয় করে তুলেনি। যা কাজ করছে তাকে নিষ্ঠুর কিছু বলে। আশ্চর্যের মহাসাগর বলে। বিপদজনক যন্ত্রনা বলে। অসম্ভব আত্মটান বলে। ভেজাল মুক্ত একটি পাখি বলে। যে পাখি অনুভূতির ফেরিওয়ালা। যাকে রোম রোমে তীব্র ব্যাথার জন্ম দেওয়া ভালো লাগা বলে। এটাকেই কি মোহ, মায়া, অনুভূতি, ভালোবাসা বলে?
______________
চলবে………….
ভুলত্রুটি আল্লাহর দেওয়া মহান গুন ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টি দিয়ে দেখবেন। নিশ্চুয়ই ক্ষমা একটি সুন্দর গুন।
@হাফসা_আলম