প্রিয় সুখ-৪৬
হাফসা আলম
.
দিনটির শুরু হয়নি, সূর্য উঠেনি পূর্বে। রাত নিভু নিভু করে জ্বলছে গাছপালার শরীর জুড়ে। পাখিরা সবে সবে ডাকতে শুরু করলো। বাড়িটির নেম প্লেটের উপরে লেখা হয়েছে নবীন উদ্দিন সুখ। কিছু মানুষ হয় যারা নিজের উপরে কিছুই ভাবতে পারে না, নিজেকে খুব ভালোবাসে। নবীন উদ্দিন তাদের অন্তর্ভূক্ত। এটা খারাপ না, বেশ ভালো। নিজেকে ভালোবাসা উচিৎ। নিস্তব্ধ সূর্যের মত বাড়িটিও ঘুমিয়ে আছে। এরা রাতে জেগে থাকে সকালে ঘুমায় মনের মত। সবার মাঝেই কম বেশি এই স্বভাব আছে। কলিং বেলের তীব্র শব্দ। কেউ এসেছে। সময় কত! নবীন উদ্দিন দেখলেন ভোরের প্রায় সাড়ে চারটার মত বাজতে চলেছে। এই অসময়ে কে আসবে? চোর ডাকাত পড়লো না কি? ভয়ে ভয়ে তিনি স্ত্রীকে ডেকে তুললেন। শামা খুব বিরক্ত গলায় বলল,’ তুমি দেখো না কে এসেছে।’
‘ এই সময় সাইকো কিলারই আসতে পারে। সাধারণ কোন মানুষ তো হবে না। একা গেলে নিশ্চিৎ মরতে হবে।’ শরীরের উপরে একটি শার্ট চাপালেন তিনি।
‘ সাইকো কিলার হলে দোকা গেলেও মরতে হবে। দুইজন মরার চেয়ে একজন মরা ভালো।’ শামা বালিশ চাপা দিলো কানে। তিনি দ্রুত তাকে টেনে তুলল। শব্দ হচ্ছে পালা করে। যে বাহিরে আছে সে অধৈর্য্য।
‘ তোমাকে ছাড়া আমি মরতেও পারবো না। চলো চলো।’ নবীন উদ্দিনের কন্ঠটি বেশ শঙ্কিত শুনালো। শামা ব্যস্ত পায়ে রুম থেকে বের হলো। বিমুগ্ধের রুমটি খোলা। এলোমেলো হেঁটে সে নিচে নেমেছে। ভালো সুন্দর একটা ঘুম হচ্ছিলো। সারা রাত সে ঘুমাতে পারেনি তীব্র চিন্তায়। তার মনের মাঝে কোথাও একটি ভয় ছিলো। এতো সহজে নাফিস উদ্দিনকে সে বিশ্বাস করবে না। কিছু তো একটা মাথায় চলছে। তার মাঝে এতো রাতে কলিং বেলের এই শব্দ ঘুমটা পুরো নষ্ট করেছে। রাগে হনহনিয়ে সে দরজা খুলে হতভম্ব হয়ে গেলো। নাফিস উদ্দিনকে সাদা পায়জামা পাঞ্জাবিতে দেখা যাচ্ছে। খুব সুশৃঙ্খল। আতরের মোলায়েম গন্ধ লেগেছে নাকে। চোখ দুটি লম্বা করে খোলার চেষ্টা করলো বিমুগ্ধ। বেশ হতচকিত গলায় জিজ্ঞেস করলো,’ আপনি এখানে এতো রাতে কি করতে এসেছেন?’
পা থেকে মাথা পর্যন্ত তাকে দেখছে নাফিস উদ্দিন। খালি শরীরে একটি শর্টস পড়া। পায়ে একজোড়া সাদা সেন্ডেলও আছে। নাফিস উদ্দিন গম্ভীর গলায় অন্যদিকে মুখ করে বললেন,’ আমার সাথে মসজিদে চলো।’
নাফিস উদ্দিনকে দেখে নবীন উদ্দিন অনেক আগেই কেটে পড়েছেন। তিনি চাইছেন না ভোরের সুন্দর সময়টা ঝগড়ায় লিপ্ত হতে। বিমুগ্ধ যেমন ছিলো তেমনই বের হয়ে আসছিলো। নাফিস ধমকে উঠলেন,’ এভাবে কোথায় যাচ্ছ?’
‘ কেন মসজিদে?’ নিজের দিকে একবার নজর দিলো সে। নাফিস উদ্দিন রেগে তাকালেন। বিমুগ্ধ দৌড়ে ঘরে চলে গেলো। সকাল সকাল ঘুমটার জন্য বড্ড দুঃখ হচ্ছে। সে দ্রুত ফোন করলো অর্পণকে। ইদানিং বন্ধুদের থেকে বুদ্ধিও ধার করতে হচ্ছে। ঘুমে কাদা অর্পণ ফোন ধরেই চেঁচালো,’ আশিকির ভুত তোর এখনো নামে নাই? এতো রাতে বিরক্ত করছিস কেন?’
‘ ভুত নামার প্রশ্নই আসছে না। আমার হবু শ্বশুড় দরজার সামনে দাড়িয়ে আছে।’
‘ কি বলিস? আমি আগেই জানতাম এই লোকের মাঝে গন্ডগোল তো আছেই। সে আর যাই হোক তোর পক্ষে এতো দ্রুত রায় দিতেই পারে না।’
‘ আমি তো তাই সন্দেহ করছি। কিন্তু বুঝলাম না এতো সকাল সকাল কেন এসেছে? মসজিদে যেতে বলছে। নামাজের জন্য তো হঠাৎ করে মসজিদে যেতে বলবে না।’
‘ আয় হায় তোকে মনে হয় রহিমা করিমা ধরে বিয়ে দিয়ে দিবে।’ অর্পনের কন্ঠে চিন্তা। বিমুগ্ধের কপালে ভাজ। সে দ্রুত হাতে পোশাক পরিবর্তন করছে।
‘ ফালতু কথা রাখ। যেটা বলতে ফোন করেছি সেটা হলো আজকে সকালে আসার সময় আমার কালো পাঞ্জাবি নিয়ে আসবি।’
‘ এটা এই নিয়ে বারো বার বলেছিস। মনে আছে আমার।’
বিমুগ্ধ আতর গায়ে দিয়ে বলল,’ আচ্ছা রাখ। এই দাড়া দাড়া রহিমা করিমার সাথে বিয়ে দিতে পারে তুই সিউর?’
‘ মেয়েকে তোর মত পাগলের হাত থেকে বাঁচাতে বাপেরা অনেক কিছুই করতে পারে। আরে আরে রাগ করছিস কেন আমি মজা করেছি। হয় তো সত্যি নামাজের জন্য ডাকছে।’ বিমুগ্ধ ফোনটি পকেটে ঢুকিয়ে বের হলো নাফিস উদ্দিন তখন পায়চারি করছে। সাদা পাঞ্জাবিতে বিমুগ্ধকে দেখে মনে মনে প্রসন্ন হলেন। দুজনেই মসজিদে এসেছে। ঘুমে ঢুলে পড়তে ইচ্ছে করছিলো বিমুগ্ধের। আগে সে এতো ঘুম কাতর ছিলো না। ঔষুধের কারণে প্রচুর ঘুমানোর ফলে অভ্যাস খারাপ হয়েছে। দেখা গেল সকলে রুকু করছে। সে সিজদায় চলে যাচ্ছে। দাড়িয়ে দাড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। আবার মাথা ঝেরে নামাজে মন দিচ্ছে। সে বুঝতে পারছে তার ভবিষ্যৎ খুবই ভয়াবহ হতে যাচ্ছে। আজকের এই সকাল দিয়েই তার হবু শ্বশুড় বুঝিয়ে দিলো। তার আজাদ জিন্দেগীর তো বারোটা বাজতে চলেছে। বিমুগ্ধ সাদা সিড়ির উপরে বসে বসে সকালের স্নিগ্ধ সমীর উপভোগ করছে। ঘুম এখন আর নেই। বুকের ভিতরে নাম না জানা অপেক্ষা কাজ করছে। মানুষের মন হচ্ছে বিচিত্র একটি মঞ্চ। কখন কি হয় বলা মশকিল। আজকের এই সকালের ঘ্রাণও সেই মঞ্চের মত বিচিত্র। মনে হচ্ছে বহু বছরের অপেক্ষা, উৎকন্ঠা, হাত বাড়ালেই ছুঁয়ে দেখা যাবে। আর কিছু ঘন্টা, বা কয়েক মুহূর্ত! তারপর! তারপর সেই সময়টা আসবে। যা বহু প্রত্যাশার। বহু আকাঙ্খার। সময় যেন খুব নিম্ন ভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। বিমুগ্ধ চায় সময় দ্রুত চলুক। সে পৌছে যাক নিজের প্রার্থিত সময়ে, সুন্দর সময়ে। যেখানে নীহারিকা নামক মেয়েটির নাম চিরতরে জুড়ে যাবে তার সাথে। আমৃত্যু সে হবে তার। কাশির শব্দে বিমুগ্ধ বাস্তবে ফিরে আসে। পাশে তাকালো সে। নাফিস উদ্দিন বসেছে তার পাশে। তার চোখ মুখ এখন স্বচ্ছ। বিমুগ্ধের দিকে এক দৃষ্টে তাকালো তিনি। অনেকটা আতপ্ত হয়ে পরলো বিমুগ্ধ। জগতে সে কম মানুষ দেখেনি। মানসিক ভারসাম্যহীনতা মানুষের সামনেও সে কখনো এতোটা নার্ভাস অনুভব করেনি। চোখ সরিয়ে নিলো সে। নাফিস উদ্দিন মুচকি হাসলো। বিমুগ্ধ অবাক। থেমে থেমে নাফিস উদ্দিন বলল,’ নীহারিকা যখন জন্মেছিলো তখন শীতকাল। ভরা শীতে কাঁঠাল ধরেছিলো গাছে।’
‘ শীতকালে কাঁঠাল?’ বিমুগ্ধ ঘুরে বসলো।
‘ হ্যা। তোমরা বাড়ি করার সময় সে দুটি কাঁঠাল গাছ কেঁটেছ সেগুলোতে শীতে কাঁঠাল ধরে।’
‘ আগে বলবেন না। তাহলে কাঁটতাম না।’ খারাপ লাগা গলা তার।
‘ তোমাদের জমি যা খুশি করো আমার দেখার বিষয় না। কিন্তু যখন গাছ কাঁটা হলো আমার ভিষণ খারাপ লেগেছিলো। গাছ গুলো আমার মেয়ের জীবনের স্মৃতি। আমি খুব যত্ন করতাম। এসব গাছের যত্ন নিতে হয় না। তবুও সখ করেই করতাম। তুমি কি বুঝতে পারছ আমার মেয়ের সাথে যুক্ত গাছ আমার কাছে এতো সখের হলে আমার মেয়ে কতটা সখের?’
‘ বুঝতে পারছি।’ বিমুগ্ধের গলা গম্ভীর হয়ে উঠলো।
‘ মেয়েরা সৃষ্টিকর্তার সবচেয়ে অন্যরকম সৃষ্টি। এদের খুব মায়া করে, যত্ন করে তৈরি করেছে বলেই আমি মনে করি। সাথে এদের রয়েছে এক বুক কষ্ট। পুরুষের শাসনে চলতে হয় তো পুরুষরাই এদের ভাঙ্গে গড়ে।’
বিমুগ্ধ চুপ করে শুনছে।
‘ তুমি ছোট বাবার কাছে তোমার পছন্দের, ভালোবাসার, আবেগের নারীকে পা ধরে চেয়েছ। বলেছ দান করে দিতে। বিমুগ্ধ এই সম্পদের কোন মূল্য হয় না, এই সম্পদ দান করা যায় না। অথচ এই জগতের সব বাবাকে তার মেয়ে দান করে দিতে হয় অন্যকাউকে। এটা কতটা কষ্টের তুমি তখনই বুঝবে যখন তোমার মেয়ে হবে। প্রতিমুহূর্তে তুমি তার নিরাপত্তার ভয়ে থাকবে। নিজের মৃত্যুতেও তোমার ভয় হবে তার কথা চিন্তা করে। প্রতিমুহূর্তে তুমি তাকে ভালো জীবন দিতে চাইবে। সব সময় তার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তায় ডুবে থাকবে। কারণ দিন শেষে তুমি জানো মেয়েরা বাবামায়ের কাছে শুধু আমানত। জীবনের একটা সময় তাদের দান করে দিতে হয়। ফলে তার জীবনের সকল ইচ্ছেকে আমরা যেমন দাম দি তেমনই খুব সাবধানে রাখি। কেন জানো? অন্য একজন পুরুষের জন্য। আর আমার মেয়ের জীবনে সেই পুরুষ তুমি হতে যাচ্ছ। আমার এতো বছরের যত্ন, ভালোবাসা, আগলে রাখা, স্নেহের প্রিয় আদরের নারী আমি তোমাকে বুঝিয়ে দিবো। তবে বিমুগ্ধ মনে রাখবে সে যেমন তোমার আমানত ছিলো আমার কাছে তেমন তোমার সৃষ্টিকর্তার আমানত তোমার কাছে। তাকে যত্ন করা তোমার শুধু দায়িত্ব যেন না হয়। যদি কখনো মনে হয় এই আমানত তুমি সামলে রাখতে পারবে না তাহলে দয়া করে ফিরিয়ে দিও। আমি সৃষ্টিকর্তার আমানত মনে করে আমার মেয়েকে যত্নে রাখবো।’
নাফিস উদ্দিন উঠে পড়েছেন। বিমুগ্ধ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। সব সময় ভালোবাসার মানুষ হয়ে ভেবে দেখেছে। আজ প্রথম সে একটু ভেবে দেখতে বসলো, বাবাদের কেমন লাগে কন্যাকে দান করতে? চোখ মুখ অন্ধাকারে ডুবেছে। অন্যমনস্তক হয়ে ভাবছে সে। বিভোর চিন্তায় মগ্ন তাকে পিছন ঘুরে নাফিস উদ্দিন ডাক দিয়ে বলল,’ বসে থাকবে না কি? বিয়ে করতে চাও না? জীবনে প্রথম ছোট বাবার কাছে কিছু চাইছ না দিয়ে তো পারা যাচ্ছে না। দ্রুত চলো। দশ মিনিটে তোমার বিয়ে।’
হতভম্বের মত তাকিয়ে রইলো বিমুগ্ধ। তার মাথা তখন ভোঁ ভোঁ করে তালগোল পাকিয়েছে, অথচ হৃদয়ে বইছে স্বর্গীয় বাতাস।
_____________
নীহারিকা দোলনায় বসে ঘুমাচ্ছে। নামাজ পড়ে সকালের হাওয়া খেতে এসেই চোখ দুটি লেগে গেছে। জীবনটা এমনই বিচিত্র ঘটনায় ভরা। আরও একটু ভরীয়ে তুলল প্রিয়ম। এক মগ পানি তার মুখে ঢেলে দিলো। ধরফরিয়ে উঠলো সে। প্রচন্ড রেগে বলল,’ এটা কি ধরনের বেয়াদপি ইতর।’
প্রিয়ম সুন্দর হাসলো। যেন এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর হাসি তার। রমনীরা লুটুপুটি খায় হাসির ঝঙ্কারে। নীহারিকা তাকিয়ে রইলো। বিরক্তি রাগ মাথায়। ওয়াশরুম থেকে সে পানি নিয়ে এসে নিজের ভাইয়ের সুন্দর হাসির বারোটা বাজালো। এবার শান্তি লাগছে। জীবনটা রঙ্গীন মনে হচ্ছে। মিতু আপুকে সকাল সকাল সাজুগুজু করে ঘুরঘুর করতে দেখে রিতিমত সে অবাক। ড্যাব ড্যাব করে দেখলো কিছু সময়। মিতু আপুর ঠোঁট ভর্তি লাল লিপস্টিক। ভোরের এই সময়ে সে স্বামীর সাথে প্রেমসুখ ব্যক্ত করছে। হঠাৎ হঠাৎ চুমু খাচ্ছে ফোনের স্কিনে। ছোট ভাই বোনের কোন তোয়াক্কা নেই। বড়ই নির্লজ্জ মহিলা সে। নীহারিকা এসব দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার আজকেও একটি পরীক্ষা আছে। ইনকোর্স গুলো ভালো করে না দিলে টিচার নাম্বার দেয় না। বিশ নাম্বার যোগ হয়। সে ভিজা জামা পাল্টাতে ওয়াশরুমে ঢুকতে চাইলো। প্রিয়ম হাত টেনে ধরে রেখে বলল,’ আরে দাড়া। মা আসুক।’
‘ মা এসে কি করবে? আমার জামা পাল্টে দিবে বলদ।’
প্রিয়ম মুখ ছোট করে বলল,’ কত ডাকছিলাম। কিন্তু তোর তো ঘুমের ভুত চাপছে। না কি সামনের সাদা বাড়ি দেখতে বিভোর ছিলি? শুন নজর দিস না এতো। আমার বোনের ভবিষ্যৎ শ্বশুড়বাড়ি তোর নজরে জ্বলে যাবে।’
‘ সকাল সকাল কি গাঁজা খেয়ে আসলি?’
প্রিয়ম একটু ঘাবড়ে যাওয়া গলায় ঢং করে বলল,’ তুই কিভাবে জানলি আমি গাঁজা খাই?’
‘ চুপ বেয়াদপ উল্টাপাল্টা কথা শুধু। মা শুনলে হার্ট ফেল করবে।’
নীহারিকা ভাইয়ের চুল গুলো থেকে পানি ঝেরে দিলো। বেশ ভাবুক হয়ে বলল,’ কি হয়েছে আজকে? সবাই উঠে বসে আছে এতো সকালে?’
‘ সারপ্রাইজ আছে।’
‘ আমার জন্য?’ অবাক গলা তার। আফিয়া রুমে প্রবেশ করলো। তার হাতে ব্যাগ ভর্তি জিনিস। নীহারিকাকে টেনে বলল,’ কত বড় হয়ে গেছিস তাই না?’
‘ সে তো অনেক আগেই হয়েছি। তোমার পাকা চুলই তার প্রমান।’
নীহারিকা মায়ের চুল গুছিয়ে দিলো। একে একে রুমে বাসার নারী শরীর গুলো প্রবেশ করছে। প্রিয়ম ভেজা শার্ট খুলে একটি টিশার্ট পড়ে আসলো। বলল,’ কিন্তু আমি ছোটোই আছি। বয়স সবে ছয় সাত।’
মিতু আপু গাল টেনে বলল,’ ওলে আমাল বাবু ভাইতা রে।’
রৌদ্রমূখি হো হো করে হেসে ফেলল। প্রিয়ম চেঁচিয়ে বলল,’ এই পাগলকে খবর দিছে কে?’
ফাবিহা বলল,’ আমি দিয়েছি। সে বলেছে আজকের দিনে থাকতে চায়।’
‘ ধুর বাল তাই বলে তুমি ওকে আসতে বলবে? ও একটা কুফা। মসিবত।’ প্রিয়ম নাক কুঁচকে রুম থেকে বের হয়ে গেলো। রৌদ্রমূখির কি এটা খারাপ লাগলো? হয় তো! কত মজা করছিলো সবাই। তার জন্য সব খারাপ হয়ে গেছে। নীহারিকা চেঁচিয়ে প্রিয়মকে ডাকলো। বোনের কথা কিছুতেই ফেলা সম্ভব না। সে ফিরে আসলো গোমড়া মুখে। নীহারিকা বলল,’ স্যরি বল।’
প্রিয়ম কিছু জিজ্ঞেস না করেই বলল,’ স্যরি।’
‘ এবার যা বলদ।’
‘ হ্যা আমি বলদ আর তুমি বলদী। ভাইবোনের একটা ব্যাপার আছে না।’
পরিবেশ আবার আনন্দে ঝলমলে। নীহারিকা অবাক হয়ে দেখলো তাকে সকলে বউ সাজিয়েছে। লাল রঙ্গে রঞ্জিত একটি বেনারসি শাড়ি। অসংখ্য জরী সুতোর মিহি কাজ। লাল একটি দোপাট্টা। হাত ভর্তি লাল কাঁচের চুড়ি। গলায় একটি লম্বা স্বর্ণের চেইন পড়িয়ে সাজ শেষ করলো শামা খালামনি। নীহারিকা কখনো শুনেনি ছেলের বিয়েতে মা বউ সাজাতে। অবশ্য তাদের পরিবারের সকলের মাথার তার ছিঁরা। শামা খালামনি বয়সের তোয়াক্কা না করে বোনকে জড়িয়ে ধরে লাফিয়ে লাফিয়ে কতক্ষণ নাচলো। নীহারিকা শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো ভোর পাঁচটার দিকে দুই পরিবারের ছেলে মেয়ের বিয়েতে উড়াধুনা নাচানাচি। জীবনের সকল অদ্ভুৎ জিনিসের সাক্ষী সেই হচ্ছে। ভোর সকালে কারো বিয়ে হয়?
খুব সাধারণ আয়োজন। সকাল তখন পাঁচটা দশ হবে। নীহারিকাকে দশমিনিটে সাজানো হয়েছে। মাথায় লম্বা ঘোমটা মেলে দেওয়া হয়েছে মুখে। শাহীন ভাই দৌড়ে বাড়ির সদর দরজা ভেদ করে প্রবেশ করলো। বিয়েতে সবাই পরিবারের মানুষজন। শুধু ইফতি নেই। বেচারা চট্টগ্রাম থেকে তো আর প্লেন উড়িয়ে ভোরে ভোরে বিয়ে খেতে আসতে পারবে না। বিমুগ্ধের বন্ধুরা জরো হয়ে উপর নিচ বসে আছে। সকলের মাঝে অবিশ্বাস্য চোখ মুখে বসে রইলো বিমুগ্ধ। তার যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না এসব সত্যি। সব বাস্তব। সব জীবন্ত। সে শুধু তাকিয়ে রইলো শান্ত চোখে। মাথায় একটি টুপিও পরানো হয়েছে। নবীন উদ্দিন সোফায় এক কাত হয়ে ঘুমাচ্ছে। পরিবেশ তখন হাসি তামাশায় ভরা। বাড়ির পুরনো আমলের সদর দরজা ভেদ করে জাওয়াদের আগমন ছিল বিমুগ্ধের বুকে একটি ঝড়। চোখ দুটিতে তরতাজা হয়ে উঠলো হারিয়ে ফেলার ভয়। সে এলোমেলো চোখে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। জাওয়াদের গায়ে সাদা পাঞ্জাবী কেন? নাফিস উদ্দিন কি তাকে ধোঁকা দিতে চাইছে? সে অস্থির চিত্তে ঘামছে। নাফিস উদ্দিন টিস্যু পেপারের বক্স এগিয়ে দিয়ে বলল,’ এতো ভয় পাওয়ার কিছু নেই। সে এসেছে শুভেচ্ছা দিতে।’
বিমুগ্ধ তার দিকে তাকালো লাল চোখে। চিন্তায় চিন্তায় তার ভিতরে কি চলছে সেই জানে। কোন এক নাম না জানা পোকা মাথায় ঠুকরে চলেছে প্রতিনিয়ত। নিজের অবস্থা দেখে সে ভাবছে বিয়ে করতে এসেছে না কি জানাজায়! বিয়ে এতো উদ্বিগ্নতা, ভয়, দুশ্চিন্তার বিষয়! সাদা পাঞ্জাবিটা ভিজেছে। ভোরের ঠান্ডা বাতাস তাকে ভুলেও স্পর্শ করতে পারছে না। সে গম্ভীর নিঃশ্বাস নিতে নিতে বলল,’ উনাকে কেন ডেকেছেন? আমার শুভেচ্ছার প্রয়োজন নেই।’
রাগে তার চোখ মুখ অসম্ভব লাল হয়ে উঠেছে। জাওয়াদ তাকে দেখছে। কিছু বলছে না। তার হাতে একটি শপিং ব্যাগ। মূলত এটি দিতেই সে এসেছে। যদিও বাবা এবং নাফিস উদ্দিনের সম্পর্ক প্রায় নষ্ট। যতই হোক একমাত্র ছেলের দুই দুইবার বিয়ে ভেঙ্গেছে। তিনি ঘোষণা দিয়েছেন এই জগতের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে ধরে নিয়ে আসবেন। এবার আর কোন আয়োজন নেই। সোজা বিয়ে। মসজিদেই পড়াবেন। জাওয়াদ হাসে। দীর্ঘশ্বাস গুনে। সে তো জানে ভালোবাসার স্থান কখনো সৌন্দর্য, প্রভাব, প্রতিপত্তি দেখে হয় না। কখনো না। নীহারিকার জন্য সে বিয়ের যে গহনা তৈরি করেছে সেটি গিফট হিসেবে দিতে চায় । শত হোক বড় সখের সে সব। সে ভেবেছে নীহারিকা তার জীবনে আসবে। যদিও সব কিছু এখন অসম্ভব।
বিমুগ্ধ নাফিস উদ্দিনকে বিশ্বাস করছে না। তার বুকে ব্যথা করছে। ধুপধুপ শব্দ তাকে আতঙ্কিত করে তুলছে। বহু বার শাসন করে বলেছে প্লিজ এবার শব্দ করা বন্ধ কর। কে শুনে কার কথা! সে হতাশ এসবে। তার সকল জল্পনা কল্পনা, আতঙ্ক, ভয়, হৃদয়ের ঝড়ের শব্দ নিস্তব্ধ একটি আকাশে রূপ নিলো যখন স্বপ্নের মত সুখ পদচিহ্ন রোপণ করলো কক্ষে। হৈচৈয়ের মাঝে লাল টুকটুকে একজন নববধূর বেশে রাগেশ্বরীকে একদম ভিন্ন অন্যরকম আলাদা সত্ত্বার অধিকারী লাগছে। ঝড় থেমে যাওয়ার পরের প্রথম রোদের মত উজ্জ্বল হয়ে নীহারিকা খুব নিকটে এসে বসলো। বিমুগ্ধের সামনের পুরনো আমলের সোফাটি মুহুর্তে ধরিত্রীতে সবচেয়ে সুন্দর রূপ লাভ করেছে। পলক পড়া বন্ধ করে নিঝুম রাত্রীর নিশ্চুপতাকে ঘীরে বিমুগ্ধ তাকিয়ে। সকলে তার চঞ্চল রাগ নিভে যাওয়া দেখলো। শান্ত একটি লম্বা শিস মেরে বলল,’ বুকের ভিত্রের আগুন নিঁভছে খোকা?’
হো হো করে হাসার ধ্বনি ছুটলো। রৌদ্রমুখির পরনে একটি সাদা কাউন। সুন্দর কারুকাজ। এই রুমের সবচেয়ে দামি পোশাক। সেটি নিয়ে ছুঁটে সে বিমুগ্ধের পাশে বসলো। বিমুগ্ধের ধ্যান ভঙ্গ হলো না। সে শীতল চোখে তাকিয়ে আছে নীহারিকার দিকে।
‘ দেখি এদিকে তাকান। একটা ছবি তুলি।’ বলতে বলতে সে ছবি তুলে নিয়েছে। প্রিয়ম এসবে বিরক্ত। মিতু আপু বিমুগ্ধের অপর পাশে বসে বলল,’ তাযিন ভাই ভালো লাগছে নীহুকে?’
বিমুগ্ধের মুখটি এবার সন্দেহ প্রবন হয়ে উঠলো। সে চট করে বলল,’ এতো লম্বা ঘোমটা দিয়েছে কেন? আপনার খালুতো মানুষ সুবিধার না। একজনকে দেখিয়ে আবার রহিমা করিমা ধরে বিয়ে দিয়ে দিবে না তো?’
মিতু আপু হেসে বলল,’ আরে না। বিয়ের পরে মুখ দেখিয়েন। এমনেই তো কিছুক্ষণ পরে চোখ মুখ সবই আপনার।’ মিতু আপু চোখ মারলেন। বিমুগ্ধ অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলো। তবে শেষের কথায় হৃদয়ে ঠান্ডা বাতাস বইছে।
কাজি মসজিদের ইমাম। ধরে নিয়ে এসেছে আগেই। নীহারিকা হঠাৎ উঠে দাড়ালো। বিমুগ্ধ বিস্মৃত হয়ে ভাবলো আবার বিয়ে না করার ইচ্ছে জেগেছে না কি এই মেয়ের?
‘ বাবা তোমার সাথে কথা আছে। রুমে এসো।’
সকলের চোখে মুখে তীব্র বিহ্বল লেপ্টে দিয়ে সে রুমে চলে গেলো। নাফিস উদ্দিনও বেশ চিন্তিত। সবচেয়ে বেশি যার অবস্থা খারাপ সে বিমুগ্ধ। কয়েক গ্লাস পানি সে এক বসায় খেয়ে নিয়েছে। মুহিব তার পিছনে দাড়িয়ে ছিলো। চোখ মুখ বিমুগ্ধের খুব কঠিন। সে মুহিবের হাত ধরে বলল,’ এতো ভয় হচ্ছে কেন?’
মুহিব সান্ত্বনা দিয়ে বলল,’ ভয় করে লাভ নেই। বিয়ে যখন করছিস জীবনে বহু বিচিত্র ঘটনা ঘটবে। সবচেয়ে বিচিত্র হচ্ছে বিয়ের আগে এবং বিয়ের দিনই বউয়েরা কাঁদে। বিয়ের পরের দিন থেকে আমাদের মত অবলা পুরুষদের কপালে শনি শুরু হয়। আগেই বলেছি বিয়ে করিস না। এবার বুঝ ঠেলা।’
‘ দূর ও ওই ভয়ের কথা বলছে না। মিস নীহারিকার তো বিয়ে ভেঙ্গে দেওয়ার রেকর্ড আছে। এখন আবার কি করে সেটা ভেবেই বেঁচারা দোস্তর মন উতলা হচ্ছে।’
শান্তের কথায় মুহিব চিন্তিত হয়ে বসে রইলো। আসলেও তো এই মেয়ে তো সুবিধার না।
মেয়ের রুমে প্রবেশ করে নাফিস উদ্দিন একটু বিচলিত। নীহারিকা বিছানায় বসেছে। তার ঘোমটা তোলা। গোল গাল মুখশ্রীতে হালকা সাজ, লাল সুন্দর শাড়ি, দোপাট্টায় দেখে নাফিস উদ্দিনের হৃদয় খুশি হলো। এই সাজে প্রতিটি মেয়েকে দেখা বাবা মায়ের সখ। মেয়ের পাশে বসলেন। নীহারিকা হঠাৎ বাবার কোলে মাথা রাখলো। নাফিস উদ্দিন চমকে গেলেন। অনেকটা অবাক। এটা খুব নতুন। নীহারিকা তার মত রাগী, সাথে খুব একটা আবেগ অনুভূতি প্রকাশ করে না। খুব কষ্ট না পেলে সে কাঁদেও না। বাবার সাথে তার সব সময় সম্মানের সম্পর্ক। এমন আবেগ ঘন মিষ্টি দৃশ্য বড় হওয়ার পরে তেমন একটা নেই। প্রচন্ড উত্তেজিত হয়ে তিনি মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,’ কি হয়েছে? তোমার কি মন খারাপ? কেউ কিছু বলেছে? পরীক্ষা খারাপ হয়েছে? বিয়ে করতে চাও না? তুমি না চাইলে হবে না।’
চোখ দুটি তুলল সে। ছলছল চোখ। নীহারিকা কাঁদলে নাফিস উদ্দিনের ভালো লাগে না। কারণ যারা সহজে কাঁদে তাদেরটার তেমন একটা গুরুত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। যে খুব কম কাঁদে সে হঠাৎ কাঁদলে পরিবেশ কেমন অদ্ভুৎ হয়ে যায়। কান্নারত নীহারিকা বলল,’ বাবা তুমি কি কষ্ট পেয়েছ? রাগ করেছ?’
শান্ত চোখে তাকালেন নাফিস উদ্দিন। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,’ কেন?’
‘ তুমি তো বিমুগ্ধকে পছন্দ করো না। অথচ ভোরে উঠে বিয়ে দিচ্ছ তাই।’
‘ পছন্দ করি না সত্য। কিন্তু ওকে আমি ভাইয়ের ছেলে হিসেবে স্নেহ করি। আমি জানি জাওয়াদ বেস্ট। কিন্তু বিমুগ্ধকে মাপা যাবে না। তার অনুভূতি ভিন্ন। যে তোমার জন্য তোমার বাবার পায়ে পড়তে পারে সে কোন পর্যায়ের অনুভূতি তোমার জন্য বহন করে বুঝতে পেরেছ? আমি পেরেছি। তাই আমি চাই তুমি বিয়েটা করো। আমি খুশি হবো। তবে হ্যা ওর জন্য আমার কাছে দারুন শাস্তি আছে। এমন বেয়াদপকে শায়েস্তা না করলে মনে শান্তি পাবো না।’
জলভেজা চোখে নীহারিকা হেসে ফেলল। বাবার সাথে বিমুগ্ধের সম্পর্ক সব সময় হয় তো এমন টক ঝাল থাকবে। দুজনই দুইজনকে পছন্দ করে না। অথচ দুইজনই দুইজনকে সম্মান এবং স্নেহ করে।
বুকে হাত রেখে বিমুগ্ধ বলল,’ খালামনি এবার মনে হচ্ছে আমার হার্ট অ্যাটাক হয়েই যাবে।’
আফিয়া থু থু করে বলল,’ ছি আব্বু এমন অশুভ কথা বলতে নেই। হার্ট অ্যাটাক তো হবে তোমার দুশমনের।’
বিমুগ্ধ চোখ বড় করে জাওয়াদের দিকে তাকালো। থতমত খেয়ে জাওয়াদ বলল,’ আমি তোমার শত্রু? এখন তুমি চাইছ আমি মারা যাই?’
‘ আরে না। আপনি মারা গেলে আমার বাচ্চারা একজন অতি সুন্দর মামা হারাবে। এটা তো আমি কখনো চাইবো না।’
মামা বলতেই যেন বিমুগ্ধের মুখটা উজ্জ্বল হয়ে গেলো। জাওয়াদের মুখটা রাগে দুঃখে সৌন্দর্য হারালো। বাবার হাত ধরে নীহারিকা আসছে। বিমুগ্ধের উত্তেজনা থমকেছে। নাফিস উদ্দিন মেয়ের পাশে বসে বললেন,’ বিয়ে পড়ানো শুরু করুন।’
শান্ত ফরফরিয়ে বলল,’ কার সাথে?’
বিমুগ্ধ চোখ গরম করে তাকালো। সে হাসছে। বিমুগ্ধকে জীবনে কখনো এতটা নার্ভাস হতে দেখেনি তারা। মজা নিচ্ছে তাই। বিমুগ্ধ সত্যি ভিতর থেকে ঘেমে নেয়ে একাকার। তার ভিতরের তান্ডবলীলা সেই বুঝে। কবুল বলার সময়টা যখন চলে আসলো বিমুগ্ধের শিরদাড়া বেয়ে নেমে গেলো ক্লান্তির স্রোত, দুশ্চিন্তার ঢেউ। নীহারিকার কবুল বলা সে শুনেনি। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে করতে মিতু আপু চেঁচিয়ে বলল সে বলেছে। বিমুগ্ধ নিজের কানে শুনতে না পাওয়ার আফসোস গুনলো। একটি খুশির উত্তাপ! নবীন উদ্দিন বহু বছর পরে ভাইকে জাপ্টে ধরলো। মিতু আপুর হাতের তৈরি মিষ্টির বিচরণ চারপাশে। খেয়ে কেউ মজা পেলো না। কিন্তু আজকের জন্য সব মাফ। সকল মান অভিমান দূর হয়ে আজ যেন এক নতুন সুখের পাখি ডেকে উঠছে সকলের হৃদয়ে। অথচ সদ্য জামাই রূপে বিমুগ্ধের শরীর ভিজে চুপচুপে। শ্বশুরমশাইকে আবেগী হয়ে সে জড়িয়ে ধরলো হঠাৎ করে। নিম্ন স্বরে ধন্যবাদ সূচক গলায় বলল,’ আপনার এই ঋণ আমি কখনো ভুলবো না ছোট বাবা।’ এই ছেলেটা এতো পাগল! নাফিস উদ্দিন জানেন না, তবে তিনি অনুভব করলেন মাঝে মাঝে মনের বিরূদ্ধে গিয়ে, মাঝে মাঝে হেরে গিয়ে জিতার মত আনন্দ অনুভব করা সম্ভব।
______________
সূর্য তখন উঠেছে। চারপাশ একটু একটু করে আলোকিত হচ্ছে। রচিত হচ্ছে নতুন জীবন। সূচনা হচ্ছে পবিত্র ভালোবাসার নবীন পথচলা। নতুনত্বের এই খেলায় শুধু পুরনো মানুষ, পুরনো অনুভূতি। বিমুগ্ধ তখনও নিজের একান্ত অভিলাষে পাওয়া রমনির চন্দ্র মুখ দেখেনি। উস্কখুস্ক নিজেকে সামলে নিতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। নীহারিকার পাশে এখন তার অবস্থান। সে একটু ঘেষে বসলো। ফিসফিস করে বলল,’ এই দোপাট্টা সরবে কখন?’
মিতু আপু উপর থেকে ঝুকে ফিসফিস করে বলল,’ দশ মিনিট পরে।’
‘ কেন? আমার বউকে দেখার অধীকার আছে আমার।’ বিমুগ্ধের কন্ঠ একটু উচু। মিতু আপু হেসে ফেলল। একটি আয়না নিয়ে এসে বলল,’ আমরা এই সুন্দর নিয়ম পালন করবো তাই। বুঝতে পারছি না বিয়েটা কেন যে আয়োজন করে দেয়নি খালি সাহেব? তবুও এসব নিয়ম তো পালন করবোই।’
‘ দেয়নি কারণ তোদের বিয়ে থেকে ভাগার বহুত তজুরবা আছে।’ ফাবিয়া মিতু আপু থেকে আয়না নিয়ে নিলো। বিমুগ্ধকে বলল,’ নীহুর ওড়নায় আপনার মাথা এমন ভাবে রাখবেন যেন নীহুকে সরাসরি না দেখতে পান। তাকে আপনি আয়নায় দেখবেন।’
মনে হলো অনেক অনেক বছর ধরে সে অপেক্ষা করছ এই নারীর মুখদর্শনের জন্য ঠিক সেভাবেই ওড়নার তলায় মাথা ঢুকাতে গেলো সে। শান্ত ধরে ফেলল। বিমুগ্ধ প্রচন্ড রাগ নিয়ে তার দিকে তাকাতেই বলল,’ আস্তে দোস্ত। এতো হামলে পড়ছিস কেন? যেন এটা পাশের বাসার ভাবী?’
‘ এক চড় দিবো।’ বিমুগ্ধের কন্ঠমনিতে বিরক্তি, তাড়াহুড়া। শান্ত হো হো করে হেসে বলল,’ শুনো চান্দু এমন ভাবে তাকাবে যেন মনে হয় প্রথম দেখা জীবনে, আর আজই তুমি তাহার মুখের লাবন্যে পাগল হয়েছ।’
বিমুগ্ধ ঠিক সেভাবেই তাকালো। দর্পনের মুখে চেয়ে সে আবিষ্কার করলো নিজের স্ত্রীকে। বহু প্রতিক্ষার ফলকে। যুদ্ধের পরের শান্তিকে। মুগ্ধতায় ডুবে থাকা চোখে সে তাকিয়ে দেখলো নীহারিকার চোখ বন্ধ, গাল দুটি টুকটুকে লাল, অধর ডুবেছে অন্য অধরে। রক্তিম সেই লাবন্যে হারিয়ে যেতে যেতে বিমুগ্ধ চোখ দুটি মহিমান্বিত হয়ে উঠলো। পবিত্রতা এই মহাবিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান সৌন্দর্য।
মিতু আপু চেঁচিয়ে বলছে,’ বলুন তাযিন ভাই কি দেখছেন আয়নায়?’
বিমুগ্ধ পাক্কা দশ মিনিট তাকিয়ে ছিলো নিজের সদ্য হওয়া স্ত্রীর দিকে। শান্ত ত্যাক্ত বিরক্ত হয়ে ধাক্কা দিয়ে বলল,’ শালা জনম জনমের জন্য তোর হয়ে গেছে এবার আমাদের পা ব্যথা না করে বল কাকে দেখছিস?’
মুহিব তেড়ে এসে বলল,’ আমি বলছি আমি বলছি ও ওর ভবিষ্যৎ জীবনের বরবাদি দেখছে।’
সকলে হেসে ফেলল। বিমুগ্ধে আস্তে আস্তে নিজের একটি হাত নীহারিকার মসৃণ গালে রাখলো। কেঁপে উঠলো যেন মেয়েটির সারা দেহ। সে চোখ দুটি খুললো। নীহারিকার চোখের মনি স্থিন, বিমুগ্ধের আবেশী নজরে বন্দি। বিমুগ্ধ নরম স্বরে ধীরে ধীরে বলল,’ আমি দেখছি সেই সুখ যার অপেক্ষায় আমি বহু বসন্ত পার করেছি, দেখছি সেই সুখ যা আমি বহু কষ্টে পেয়েছি, দেখছি সেই সখের নারীকে যাকে হাজার বার চেয়েছি। আমি তাকে দেখছি যাকে আমার সকল আনন্দ, বেদনা, সুখের ভিরে সবচেয়ে বেশি কামনা করেছি। আমি আমার রাগেশ্বরীকে স্ত্রী রূপে দেখছি। যার সৌন্দর্য্যে আমার দুটি চোখ মুগ্ধতায় ঝলসে যাচ্ছে।’
নীহারিকা তার নয়নে তাকিয়ে রিনরিনে গলায় বলল,’ আমি দেখছি একজন পাগল প্রেমসত্ত্বার জীবনসঙ্গীকে। যে শুধু ভালোবাসতে জানে না, জগতের দৃঢ়তার সাথে লড়াই করে সে ভালোবাসা অর্জন করে নিতে জানে।’
পরিবেশে আনন্দে নেচে কুদে উঠলো। অল্পবয়স্কদের চিৎকার চেঁচামেচি, সিটি বাজানোর শব্দ, দাদামশায় নিজেও লাফিয়ে উঠলেন। খুশিতে গদগদ হয়ে বললেন,’ আমার নাতীনাতনি তো হিরোদের মত ডায়লগ দেয়।’
রৌদ্রমূখি বিভোর হয়ে বলল,’ উনি তো সত্যি জোস। ভাবছি সিনেমায় কাজ করতে বলবো। ওহ এমন একটা ছেলেকে বাংলাদেশের বিনোদন জগৎ পাবে না এটা তো হবে না।’
‘ হ্যা পৃথিবীর সবাই তো তোমার মত জাহান্নামের টিকেট কাটতে বসে আছে।’ প্রিয়ম পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় খোঁচা মেরে বলল।
‘ সবকিছুতে ধর্ম টানবে না বেয়াদপ।’
‘ সবকিছুতে আমার পরিবারকে টানবে না খারাপ মেয়ে।’
রৌদ্রমুখি আর তর্ক করলো না। সে তো খুশিতে পাগল হয়ে যাচ্ছে। এমন অদ্ভুৎ অদ্ভুৎ কাজ দেখে। সে জীবনেও শুনেনি ভোরে কারো বিয়ে হয়। বিষয়টা তার কাছে বেশ উপভোগ্য। বিমুগ্ধ নীহারিকার প্রতিটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দৃষ্টিকেও সে ফ্রেমবন্দি করছে। এই যে বিমুগ্ধ চুপিসারে নীহারিকার হাতটি ধরলো। ফিসফিস করে কানের কাছে বলল,’ তুমি আমার রাগেশ্বরী। সারাজীবনের জন্য।’ তার কন্ঠে ঝলমল করছে আবেগ। পুরুষ মানুষ এতো আবেগী হয়!
হয়, ভালোবাসা ক্ষুদ্র একটি বাক্য নয়। ভালোবাসা শুধু দুটি লাইনের কবিতা নয়। ভালোবাসা তাহলে কি? অনুভূতির একটি খেলা। হৃদয়ের এই খেলায় মানুষ রোজ পরাজিত হয়। রোজ হারিয়ে যায় অদৃশ্য অনুভূতিদের মায়াজালে। ভালোবাসা কষ্টে অর্জিত একটুকরো প্রিয় সুখ। বহু যুদ্ধ শেষের শান্তি। দুষ্প্রাপ্য এই প্রেম শুধু পেলেই হয় না। ভালোবাসা জীবন্ত একটি অনুভূতি। এটি যত্ন করতে হয়. আগলে রাখতে হয়, সময়ে সময়ে এর মান অভিমানে ডুবে যেতে হয়। ভালোবাসা সহজ বিষয় নয়। ভয়ংকর জটিল এই বিষয়টির যত্ন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নিতে হয়। তাহলেই ভালোবাসা জীবন্ত প্রানবন্ত থাকবে। পেয়ে গেলেই হয়ে গেলো এমন নয় ভালোবাসা। ভালোবাসা যত যতনে রাখা হবে এটি তত বেশি করে মায়ায় জড়িয়ে নিবে, হৃদয়কে শান্তি প্রদান করবে। বিমুগ্ধের জীবনের ভালোবাসার অধ্যায় মাত্র শুরু হয়েছে। সে মাত্র একটি ধাপ পার করেছে। ভালোবাসা পাওয়া যেমন ভাগ্যের বিষয় এটি আগলে রাখা আরও বড় ভাগ্যের বিষয়। সেই পরীক্ষায় সকল ভালোবাসার মানুষ জয়ী হতে পারে না। বিমুগ্ধের এই অতিমূল্যবান ভালোবাসা সে কতটা যত্নে রাখবে চিন্তা করতে না করতেই তার উপরে ঘূর্ণিঝড় হয়ে প্রবাহিত হলো শ্বশুরমশাই।
মেয়েটির কাঁপা হাত তখনও হাতে। চোখ দুটি তখনও নিচু, আর দুটি গাল লজ্জায় আরক্ত। বধূবধূ রূপ। পাগল করা স্নিগ্ধতা। নাফিস উদ্দিন তখনই এসে গম্ভীর গলায় বললেন,’ তা আর কত সময় বসে থাকবে তুমি? বাসায় যাও।’
বিমুগ্ধের কপালে ভাঁজ পড়েছে। সে ভেবে পাচ্ছে না শ্বশুরমশাই এতো ভালো হলো কিভাবে? পরক্ষণেই নিজেকে সুধরে নিলো সে। তার ছোট বাবা তো অনেক ভালো। সে উঠে দাড়ালো বউ নি। দরজার কাছে যেতে যেতে বলল,’ আসলেই কত সময় বসে থাকবো। আমার তো যাওয়া উচিৎ। আম্মি বউ বরণ করতে তোমরা আগে বাড়ি যাও।’
নাফিস উদ্দিনের দিকে তাকিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে বলল,’ ইশশ আগে বললে পালকির ব্যবস্থা করতাম। সমস্যা নেই সে যখন আপনাদের বাসায় আবার প্রথম আসবে তখন পালকিতে করে নিয়ে আসবো।’
‘ আমার মেয়ে কোথাও যাচ্ছে না। নীহারিকা তুমি রুমে যাও। আজকে তোমার পরীক্ষা আছে।’
‘ কিহহহহহহহহ!’ বিমুগ্ধ একটি চিৎকার করে উঠলো। উপস্থিত সকলে যে যেখানে ছিলো ছুঁটে চলে আসলো। নাফিস উদ্দিন নির্বিকার। নাস্তার ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত আফিয়া বলল,’ কি করছেন আপনি? নতুন জামাইকে না খাইয়ে কোথায় পাঠাচ্ছেন? মাত্র বিয়েটা হলো।’
‘ বিয়ে শেষ। এখন আবার কিসের মাত্র টাত্র? খাবার তাদের বাসায় পাঠানো হবে। আর ভাইয়া শুনো নীহারিকার মাস্টার্স শেষ হলে অনুষ্ঠান করে তারপর তোমার বাড়িতে পাঠাবো মেয়েকে। তার আগে তোমার এই উজবুক ছেলে যেন আমার বাড়িতে না আসে।’
মুখটা রাগান্বিত হয়ে থমথম করছে বিমুগ্ধের। তার চেহারার ক্রোধ দেখে নীহারিকার হাসি পেয়ে গেলো। শাহিন ভাই ফিসফিস করে মিতু আপুকে বলল,’ বাপরে এতো বড় শাস্তি? আমি হলে মরে যেতাম। বিয়ের পর পর বউকে নিজের কাছে নিয়ে আসার জন্য আমি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। বেঁচারার তো দুই তিন বছর অপেক্ষা করতে হবে। বড্ড দুঃখ হচ্ছে।’
সবাই বেশ অবাক হলো। নাফিস উদ্দিন সোফায় বসে আরাম করে চা খাচ্ছে। অথচ সকলে দাড়িয়ে আছে হাঁড়িপানা মুখ করে। বিমুগ্ধ কি করবে সকলে চিন্তা করছে। ভাঙ্গচূড় করবে? পা জড়িয়ে ধরবে? হ্যা এটা করতে পারে। তাহলেই নাফিস উদ্দিন গলে যাবে। নাফিস উদ্দিন পুনরায় বলল,’ সবাই এভাবে তাকিয়ে আছ কেন? তাযিন আমার ভাতিজা। আমার কাছে আমার মেয়েকে ভিক্ষা চাইলো, তাই আমি ছোট বাবা হিসেবে তার ইচ্ছে পূরণ করেছি। কিন্তু সে তো বলেনি বিয়ে করেই আমার মেয়েকে তার বাড়িতে নিয়ে যাবে। কি ঠিক বলেছি বাবা তাযিন।’ সুর টেনে বলল তিনি। বিমুগ্ধ স্তব্ধ হয়ে শুধু তাকে দেখছে। তার চোখ মুখ দেখে ভিতরটা বুঝা মশকিল। অর্পন মাথায় হাত দিয়ে বলল,’ শেষ। শালা বরবাদ হয়ে গেলো।’
শান্ত সবার মাঝে ফ্লোরে বসে হো হো করে ডাকাতের মত হাসছে। তার গড়াগড়ি করা হাসি দেখে সবার চোখ আকাশে। হাত থাপড়ে সে বলল,’ এটা দারুন হয়েছে আঙ্কেল। বরবাদির জীবনে তোকে মোবারক দোস্ত।’
কম বেশি সকলেই বুঝালো নাফিস উদ্দিনকে। কিন্তু তিনি তার কথায় অনড়। সবার ধারণা বিমুগ্ধ কিছু বলবে, জোড় করবে, সময় কমিয়ে নিয়ে আসবে। কিন্তু সকলকে অবাকশীর্ষে পৌছে দিয়ে সে কিছুই বলল না। নাফিস উদ্দিন নীহারিকাকে বলল,’ যাও পরীক্ষা আছে তোমার।’
নীহারিকা আজ নিরব দর্শক। সে চলে যাচ্ছিলো। বিমুগ্ধ আচম্বিত ছুটে এসে দুই হাতে তাকে জড়িয়ে ধরলো। সকল বড় ছোট আত্নীয়র সামনে। সকলের ঝুলে থাকা মুখ আরও ঝুলে গেলো। নাফিস উদ্দিন চোখ বড় করে আবার বন্ধ করলো। মনে মনে বিমুগ্ধকে তিনি দুটো বাংলা গালি দিলেন। সব কিছুকে উপেক্ষা করে বিমুগ্ধ তার রাগেশ্বরীকে হৃদয়ের মাঝে চেপে ধরে বলল,’ তুমি শুধু আমার হয়ে থেকো, আমি সারাজনম অপেক্ষা করে যাবো।’
একটু থেমে খুব গভীর ভাবে আলিঙ্গন করে রাখলো। কানের পাশে নিজের পবিত্র, অতি নিম্ন, প্রগাঢ় দুটি ঠোঁট চেপে ধরে ধীর স্বরটুকু মোহিত করে বলল,’
“ হে আমার জ্যোৎস্না
তোমার নিবিড় আলিঙ্গনে ভেসেছে আমার হৃদমোহনা। “
_____________
চলবে…
ভুলত্রুটি আল্লাহর দেওয়া সবচেয়ে সুন্দর গুন ক্ষমার চোখে দেখবেন। নিশ্চুয়ই ক্ষমা একটি মহান গুন। 🕊️