#প্রিয়তম
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব -২১
ইফাদের অনুমতি নিয়ে বান্ধবীদের সাথে শহরের বাইরে বেড়াতে যাওয়ায় রিতুকে খুব ঝেড়েছে ইফাদ। এ নিয়ে কথা কাটাকাটি শুরু হলেও শেষ হলো ইফাদ দেশে না ফেরার কাহিনীতে। দু’জনের কেউই কম যায় না। ইফাদ বলেছে সে রিতুকে নিজের কাছে নিয়ে আসবে। কিন্তু এতেও রিতু নাছোড়বান্দা৷ সে সবাইকে ছেড়ে কিছুতেই যাবে না। এসব নিয়ে বাকবিতন্ডার জের ধরে রিতু ফোন কেটে দিয়েছে। ইফাদও রাগ করে আর কল ব্যাক করল না। এই মেয়ে ইদানীং ওর কথা শুনছে না। বড্ড অবাধ্য হয়েছে। ওর অবাধ্যতার লাগাম টানার সময় এসে গেছে।
পরপর দু’দিন রাগ ভুলে রিতু নিজেই ইফাদকে ফোন করল। ইফাদ ধরল, তবে খুব ব্যস্ততা দেখাল। যারজন্য রিতুর রাগ আরো বেড়ে গেল। তাই ওকে বিরক্ত করবে না বলে ঠিক করল। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সন্তপর্ণে। ইফাদের এমন ব্যবহার বাড়ির ছোটদের সাথে শেয়ার করার পর রুফিরা ওকে খুব বোঝাল! তৌফ বিগলিত স্বরে বলল,
— ভাইয়া আপনারে সারপ্রাইজ দিবে ভাবি। এইজন্য এরকম করছে।
রিতুর কপাল কুঁচকে গেল,
— কীসের সারপ্রাইজ?
— গতবারের কথা মনে নাই? আপনাদের মধ্যে যোগাযোগ নাই, হঠাৎ একদিন ভাইয়া আইসা হাজির! এইবারেও তেমন কিছুই হবে।
শুনে বক্র গলায় রিতু বলল,
— তোমাদের ভাইয়া পাল্টে গেছে অনেক। আমাকে আর ভালোবাসে না। আগের মতো সময় দেয় না। সারাক্ষণ ব্যস্ততা দেখায়, ভন্ড লোক!
রুফি প্রতিবাদ করল,
— এভাবে বলো না ভাবি। ভাইয়া তোমাকে কত ভালোবাসে! আর তুমি তাকে ভন্ড বলছ? দিস ইজ
নট ফেয়ার!
নাবিলাও তাল মেলাল,
— এগজ্যাক্টলী! ভাইয়ার ভালোবাসা কত গভীর তা স্বচক্ষে দেখেছি আমরা। কীভাবে রাতদিন তোমাকে চোখে হারাত, জ্বর বাঁধাত। ইশ! কী রোমান্টিক!
নাবিলা এমন ভাবে বলল যে রিতু লজ্জায় লাল হয়ে গেল। তবে নিজের নার্ভাসনেস কাটাতে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলল,
— সব মিথ্যে…
অমি আত্মবিশ্বাসী সুরে বলল,
— ভাইয়া একটা না একটা কিছু তো চমক দিবেই। দেইখা নিয়েন ভাবি। এই অমির কথা বাসি হইলে ফলে।
রিতু অভিমান নিয়ে বলল,
— চাই না আমার চমক। চেনা আছে এই লোককে!
শুধু ঝগড়া করতে জানে। আমিও এবার আর গলছি না। হুহ!
বলে রিতু উদাসী ভঙ্গিতে বসে রইল। রুফিরা সবাই নিজেদের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। রিতুকে অনেক কিছু বলে বুঝ দিল। কিন্তু বিরহ যন্ত্রণায় দগ্ধ রিতুকে ওদের কোনো সান্ত্বনার সুর ওর হৃদয় ছুঁতে পারল না। রিতুর মতে এই পাষন্ড লোকটা কচুর ডাঁটি ছাড়া অন্য কোনো সারপ্রাইজ দিতে পারবে না। ওর কথা শুনে সবাই খুব হাসলো।
★
রাত গভীর হয়েছে। রিতু বিছানায় শুয়ে একটা বই পড়ছিল। ঘুম ঘুম ভাব চোখে। বই রেখে রিতু ঘুমানোর প্রস্তুতি নেবে এমন ফোনটা শব্দ করে বেজে ওঠল। উৎসুক ভঙ্গিতে রিতু ফোন হাতে নিলো ঠিকই তবে নাম্বারটা চেক করল না। ভেবে নিল ইফাদের ফোন। হলোও তাই। পরশু রাতে শেষ কথা হয়েছিল। এরপর রিতু অভিমান করে আর ফোন দেয়নি। এবার ইফাদ নিজে থেকে কল দেওয়ায় রিতুর ভাব বেড়ে গেল খানিকটা। ধীরেসুস্থে কল রিসিভ করে বলল,
— হ্যালো!
ওপাশ থেকে ইফাদের বলতে দেরি নেই,
— আমার মিষ্টি বউ! কী করছো তুমি?
ইফাদের কথা শুনে রিতু থতমত খেল। এত সহজভাবে কথা বলছে যেন কিছুই হয়নি ওদের মধ্যে। রিতু বিস্মিত গলায় বলল,
— নাক ডেকে ঘুমাচ্ছি। আর খবরদার এসব
আদিক্ষেতা আমাকে দেখাবেন না।
ইফাদ পাত্তা দিলো না ওর কথায়।
— কেন ভালো লাগছে না শুনতে?
রিতু ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল,
— আপনার সাথে আমার ঝগড়া হয়েছে। আপনি আমাকে বকেছেন। এখনো আমার রাগ কমেনি। আমার রাগ না ভেঙ্গে এভাবে কথা বলবেন
না৷ সাবধান!
ইফাদ এবারো যেন ওর কথা কানেই তুলল না। বলল,
— কিন্তু আমার যে রাগ ভাঙ্গাতে ইচ্ছে করছে না।
রিতু গাল রক্তিম হলো। রেগে ফোন কেটে দিতে যাবে তখনি ইফাদ বলল,
— নো নো। একদম ফোন কাটবে না।
রিতু কটমট করে বলল,
— তাহলে কী করব?
— চুমু খাবে। একটা টাইট হাগ করবে।
— রাখুন তো! পাগলে পেয়েছে আপনাকে?
ইফাদ ঠোঁট চেপে হাসল। বলল,
— জান!
রিতু কেমন ঘোরে পড়ে গেল। অস্ফুটস্বরে বলল,
— হু?
— রেগে আছো?
— আছি।
ইফাদ তোষামোদি কন্ঠে বলল,
— একশো চুমু তোমার কপালে। প্লিজ রাগ কমাও।
ইফাদ শব্দ করে যেন অদৃশ্য চুমু ছুঁড়লো। রিতুর রাগ পড়ে গেল। বলল,
— কমিয়েছি।
— তোমার ঘরের দরজাটা একবার খুলবে?
রিতু বিস্মিত হলো,
— কেন?
— একটা সারপ্রাইজ আছে!
— দরজার বাইরে?
— হ্যাঁ।
রিতুর খটকা লাগল। ইফাদও দরজা খুলতে বলছে। কিন্তু দরজার বাইরে থেকে চাপা হাসির শব্দ আসছে। মনে হচ্ছে কেউ ওখানে দাঁড়িয়ে আছে। ফিসফিস করে কথা বলছে। মানে কী? রিতু ঢোক গিলল। বাড়ির মানুষ ঘুমে। তাহলে বাইরে কে? চোর-ডাকাত নয়তো?
রিতু চুপ করে শোনার চেষ্টা করতেই ফোনের ওপাশ থেকে ইফাদ অধৈর্য গলায় আবারও তাড়া দিল,
— এত দেরি কেন? প্লিজ খুলো।
রিতুর কিছুই বোধগম্য হলো না। কী এমন সারপ্রাইজ যারজন্য দরজা খুলতে হবে এত রাতে? তাও বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে যাওয়ার পর! প্রথমে মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছিল না কিন্তু দু-সেকেন্ড যেতেই ও আধশোয়া অবস্থা থেকে তড়াক করে লাফিয়ে ওঠল। আমতাআমতা করে বলল,
— আপনি!
ইফাদ হাসি আটকাতে না পেরে বলল,
— এবার তো খুলো! আমার পা দুটো তো গেল সত্যি বলছি…
রিতু কথা বলা ভুলে গেল প্রায়। স্তব্ধ ভঙ্গিতে বসে রইল খাটের কিনারে! হৃদপিণ্ডে হাতুড়ি বাজছে। দরজায় টোকা পড়ল এবার। রিতু কি করবে বুঝতে পারল না। ইফাদ এসেছে, সত্যিই? উত্তেজনা, খুশিতে কাঁদোকাঁদো হয়ে গেল ওর মুখ। ওর পরণে ঢোলা পাজামা আর ইফাদের একটা ঢোলা শার্ট। এই বেশে সে কী করে দরজা খুলতে যাবে? ভাবল একবার চট করে কাপড় পাল্টে নেবে। কিন্তু সেই সুযোগটুকু ইফাদ ওকে দিলো না। একনাগাড়ে হাতুড়িপেটা করে যাচ্ছে দরজায়। রিতু পড়িমরি করে কোনোমতে ওড়না দিয়ে আপাদমস্তক ঢেকে নিয়ে দুরুদুরু মনে দরজা পুরোপুরি না খুলে বাইরে উঁকি দিলো। আর দেখল লম্বা-চওড়া শরীরটা নিয়ে ইফাদ দরজার দু’পাশে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঝকঝকে ফর্সা চেহারায় ক্লান্তি মিশে আছে। আর ওর চোখদুটো দরজার ফাঁক দিয়ে ঠিক ওর দিকেই চেয়ে হাসছে। রিতুর বুকের ঢিপঢিপ গাঢ় হলো। ঘোরে পড়ে গেল। দরজার ফাঁকটুকু দিয়ে হা করে তাকিয়ে রইল তার সুদর্শন বরের দিকে। ইফাদ তখনি হাসল। এরপর চট করে ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে দরজা আটকে ফুঁস করে শ্বাস ছেড়ে ওর সামনে দাঁড়াল। রিতুর সম্বিৎ ফিরে এলো। ততক্ষণে ইফাদ ঠিক ওর সামনে দাঁড়িয়ে। লজ্জায়, অস্বস্তিতে রিতুর মরমর দশা হলো। কোথায় নিজেকে লুকাবে সেটা বুঝতে পারল না। এই দু’দিন আগেও যে লোকটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঝগড়া করেছে, যাকে আজেবাজে অনেক কথা বলে রাগিয়ে দিয়েছে, যাকে প্রতিনিয়ত আঙুলের ইশারায় নাচিয়েছে এই মুহূর্তে সে মানুষটাকে নিজের সামনে দেখ রিতু চোখ তুলে তাকাতে পর্যন্ত পারল না। সব ভ্রম মনে হলো ওর। ইফাদ ওর অবস্থা দেখে মিটিমিটি হাসছে। রিতু চোখ তুলে তাকাতে তো পারলই না উল্টো কাঁপাকাঁপি শুরু করে দিল। ইফাদ ওকে ধাতস্থ হবার সময় দিলো না। কানের অতি নিকটে মুখ নিয়ে বলল,
— চার বছর পর দেখা। কেমন ফিল করছো আমার বউ?
ইফাদের গরম নিঃশ্বাস কানের উপর পড়তেই রিতু
জমে গেল। অদ্ভুত অনুভূতিতে টালমাটাল লাগল সব। চোখ তুলে তাকানোর চেষ্টা করেও পারল না। অসহায় লাগল নিজেকে। এমন কেন হচ্ছে বুঝতে পারছে না। ফোনে তো ঝালাপালা করে দেয় লোকটাকে। একটু আগেও ইচ্ছেমতো নাচাচ্ছিল মানুষটাকে। অথচ সামনাসামনি ইয়াফদের সামনে নিজের এই দশা! রিতু অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে গেল। চারবছর পর দেখা বলেই কী এমন হচ্ছে? নাকি ইফাদ আগের চেয়ে আরো সুদর্শন হয়ে গেছে বলে নিজের প্রতি ইনসিকিউরড লাগছে বুঝল না রিতু। ইফাদ ওর সংকোচ বুঝতে পারল। একটু জ্বালাতে ইচ্ছে করল ওর। ঊষ্ণ ঠোঁটদুটো ছুঁইয়ে দিল রিতুর ঠোঁটে। রিতু ওর শার্টের কলার আঁকড়ে ধরল। ইফাদ ঠোঁট ছেড়ে দিয়ে সরু গলায় বলল,
— সংকোচ কাটলো? সারপ্রাইজ কেমন লাগল বেইবি?
রিতুর সংকোচ একটু কমলো। ওর গলা জড়িয়ে অভিমানী স্বরে বলল,
— একটু ভালো না।
ইফাদ ভ্রু কুঁচকে বলল,
— আমি আসায় তুমি খুশি হওনি?
রিতু থতমত খেল। কথা গুলিয়ে যাচ্ছে ওর। দ্রুত মাথা
নেড়ে বলার চেষ্টা করল,
— খুশি হয়েছি।
ইফাদ ওর গালে আঁকিবুঁকি করতে করতে বলল,
— তাহলে বললে যে?
— আমাকে জানালে কী এমন হতো? গতবারও এমন করেছিলেন।
ইফাদ কপালের ভাঁজ সোজা করল। উত্তর না দিয়ে আপাদমস্তক রিতুকে পর্যবেক্ষণ করল। গায়ে কাঁটা দিলো রিতুর। এত লজ্জা-অস্বস্তি ওর জীবনে হয়নি।
ইফাদ ওর অবস্থা দেখে ঠোঁট কামড়ে অন্যরকম
হাসি। আবিষ্ট চোখে ওর মুখের দিকে চেয়ে বলল,
— তাহলে তো আমার জামা-প্যান্টে তোমাকে যে
ভীষণ হ’ট লাগে সেটা তো আর দেখা হতো না বেইবি!
________________
[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।]
চলবে…