প্রিয়তমা প্রজাপতি পর্ব-১০ এবং শেষ পর্ব

0
495

#প্রিয়তমা_প্রজাপতি🩷 [অন্তিম পর্ব]
~আফিয়া আফরিন

মিফান একটা কাগজ-কলম নিয়ে বসেছে। সিনিয়র বিয়ে করার কি সুবিধা আর অসুবিধা সেসব লিখে রাখছে।
প্রথমে সুবিধা গুলো পয়েন্ট আকারে লিখেছে।
১. সিনিয়রদের থেকে সব সময় আদর ভালোবাসা প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশি পাওয়া যায়।
২. সিনিয়রের সাথে বিয়ে করলে সব জায়গায় দাপট ই অন্যরকম হবে, কেমন একটা সিনিয়র সিনিয়র ভাব চলে আসবে শরীরে ।
৩. সিনিয়র বিয়ে করলে মাসিক হাত খরচ ও পাওয়া যাবে।
৪. সিনিয়ররা একজন টিচারের মতো পড়াশোনা সংক্রান্ত সকল সমস্যা সল্ভ করে দিবে, যে কোনো টপিকস না বুঝলে ডেমোও দিবে।
৫.সিনিয়র বিয়ে করলে নিজের কোন বই, গাইড কেনা লাগবে না, তার বই, গাইড দিয়েই নিজের পুরো ভার্সিটি লাইফ কাভার হয়ে যাবে।
৬. অভিমান কম করবে, ঝগড়া কম হবে, চিন্তাতে থাকলে সেই সময় ভালো পরামর্শ দিতে পারবে।
৭. আর সবসময় আগলে রাখবে।
৮. যেহেতু সিনিয়র সেহেতু সংসার সেই বেশি গোছানো রাখতে পারবে।

মিফান লেখা শেষে খাটে হেলান দিয়ে নিজের ভাগ্যের তারিফ করল বেশ কয়েকবার।
‘আরে মাম্মা তোমার তো লাকি কপাল। আরাম আর আরাম। তোমার তো কাজকর্ম করে বউকেও খাওয়াতে হবেনা, বউ উল্টো কাজকর্ম করে তোমাকে খাওয়াবে। আহা! কি শান্তির লাইফ।’

তারপর মিফান কতগুলো অসুবিধার কথাও চিন্তা করল। কিন্তু পরক্ষণে সাথে সাথে সেগুলো মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললো। তার আর অনিন্দিতার বয়সের গ্যাপ বেশি না, সাধারন ভাবে ধরতে গেলে তারা সমবয়সী। এখানে দুজন ঠিকঠাক থাকলে কোন সমস্যা হওয়ার কথা না।

শরীরে আয়েশ নিয়ে পকেট থেকে ফোন বের করল মিফান। অনিন্দিতাকে একটা ফোন দেওয়া দরকার। ওর নাম্বার ডায়াল করতেই বিজি দেখালো। তাই বেশ কিছুক্ষণ পর আবার ফোন দিল। তখন ও বিজি দেখাচ্ছে। পরপর আরো বেশ কয়েকবার ফোন দেওয়ার পর মিফান বুঝল, অনিন্দিতা তাকে ব্লক করে রেখেছে। কিন্তু আবার এই ব্লক করার কারণ টা কি? হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার, ফেসবুক সবকিছু চেক করল মিফান, অনিন্দিতা সব জায়গা থেকে তাকে ব্লক করে রেখেছে। আশ্চর্য! আশ্চর্য!
.
.
অনিন্দিতা দেখা করতে এসেছে তার ছেলেবেলার বান্ধবী নিরুর সাথে। নিরু শ্বশুরবাড়ি থেকে গতকাল রাতে বাড়ি এসে অনিন্দিতা কে ফোন করে জানিয়েছে। তাই অনিন্দিতা সকাল সকাল দেখা করার জন্য চলে এসেছে। দুজনের বেশ কয়েকমাস পর দেখা হলো। গতবছর নিরুর বিয়ের পর সে একবার বাপের বাড়ি এসেছিল তখনই দুজনের শেষ দেখা। আজ অনেকদিন পর দুজন কুশল বিনিময় করল।
বেশ অনেকক্ষণ দুজন নিজেদের মধ্যে গল্প গুজব করার পর অনিন্দিতা মিফানের কথাটা বলল।
‘নিরু, মিফানের কথা তোর মনে আছে রে?’

‘তোর চাচাতো ভাই? মনে থাকবে না আবার? কেন কি হয়েছে? বাঁদড়মুখো টা আবার তোর চুল টেনে ছিঁড়েছে নিশ্চয়ই?’

অনিন্দিতা হেসে জবাব দিলো, ‘আরেহ না। এইবার আর এমন কিছু করে নাই। কিন্তু, সমস্যা অন্য জায়গায়!’

‘কোন জায়গায়?’

‘ও আমাকে ভালোবাসে। বিয়ে করবে। বাসায় সবাই জানে, সবাই ওরে মাথায় তুলে নাচতেছে।’

অনিন্দিতার কথা শুনে প্রথমে অবাক হলেও পরে হাসতে হাসতে বলল, ‘শুধু পরিবারের সবাই মাথায় তুলে নাচতেছে? কিন্তু ম্যাডাম, আপনার চোখমুখের অবস্থা দেখেই তো বোঝা যাচ্ছে আপনিও মনে মনে নাচতেছেন। বাই দ্যা ওয়ে, কংগ্রাচুলেশন! মিফান এই প্রথম একটা কাজের কাজ করছে। সাব্বাশ ব্যাটা।’

‘তুইও দেখি ওর হয়ে সাফাই গাইছিস?’

‘তো গাইব না? আচ্ছা তাদের বিয়ে সাদী কবে?’

‘আরে, মাত্র শুরু। এখনই বিয়ে না, বিয়ে আরও এক/দুই বছর দেরি। কিন্তু ও আমার চেয়ে বয়সে ছোট, কেমন একটা দেখায় না?’

‘আরে বয়সে ছোট দেখেই তো আরো ভালো হয়েছে। মুখে মুখে তর্ক করবেনা, উল্টো তুই ওকে শাসনে রাখতে পারবি। তোর ভাই সব দিক থেকেই লাভ!’

অনিন্দিতা কিছু বলল না। নিরুর থেকে পরামর্শ পাওয়া গেছে, এখন সে নিশ্চিন্ত।
.
.
মিফান অনিন্দিতার খোঁজ করতে করতে ওর বাড়ি চলে এসেছে। বাড়ি এসে জানতে পারলাম অনিন্দিতা নাই। কোথায় গেছে সেটাও বলা যায় নাই।
মিফান বিড়বিড় করে বলল, ‘সব কিছুই আশ্চর্যজনক মনে হচ্ছে। এত বড় একটা ঢিঙ্গি বাহিরে বাহিরে ঘুরে বেড়াচ্ছে কেউ কিছু বলছে না। কোথায় গেছে কেউ কিছু জানেও না। আজব তো! যদি আমার হবু বউকে কেউ কিডন্যাপ করে নিয়ে যায়, তখন? একবার শুধু বউ বানিয়ে ঘরে নিয়ে যাই, দরজা বন্ধ করে সারা জীবনের মতো ঘরে বসিয়ে রাখবো। কারো কোনো রেস্পন্সিবিলিটি নাই? আমি একা আর কয় দিক সামলাবো!’

এমন সময় ঘরে প্রবেশ করলেন আলম খন্দকার। মিফান কে একা বিড়বিড় করতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘নিজের মনে একা কি বকবক করছো? আমাদেরকেও বল, আমরাও শুনি একটু!’

আচমকা ঘুরে তাকিয়ে অপ্রস্তুত বনে গেল মিফান। আমতা আমতা করে বলল, ‘না মানে বড় আব্বু তেমন কিছু না। দেখছিলাম ঘরের রং ঐদিকে একটু ঝাপসা হয়ে আসছে ওইটা ঠিক করা দরকার এটাই ভাবছিলাম আর কি।’

‘কিন্তু ঘরের রং আমি তো ঝাপসা দেখতে পাচ্ছি না। আর গতবছর ই তো ঘর রং করালাম। এত তাড়াতাড়ি তোর রং উঠেছে যাবার কথা না। চোখ আমার খারাপ হয়েছে না তোমার খারাপ হয়েছে বুঝতে পারছি না।’

মিফান মাথা চুলকে বোকা বোকা হাসি দিল। তারপর বলল, ‘আমি আসছি বড়ো আব্বু। আমার আবার একটা কাজ আছে তো।’

মিফান বেরিয়ে গেলে উনি নিজের মনেই হাসলেন। পাগল ছেলে একটা। এই পাগল ছেলের কাছে মেয়ে দিয়ে দিলেও সারা জীবন ভরসায় থাকা যাবে!
.
.
মিফান বের হতেই দরজায় অনিন্দিতার সাথে ধাক্কা খেলো। অনিন্দিতা বলল, ‘কি রে কানা নাকি? দিন দুপুরে চোখে দেখিস না? এভাবে দৌঁড়ে কোত্থেকে আসছিলি?’

‘বাঘের খোপ থেকে পালিয়ে এসেছি।’

‘কে বাঘ?’

‘তোমার আব্বু, তাছাড়া আবার কে?’

‘তুই আমার আব্বুকে বাঘ বলতে পারলি? তোর এত বড় সাহস মিফান? তোর সাথে তো সব সম্পর্ক বাতিল করে দেওয়া দরকার।’

‘বাঘ কে বাঘ বলব না তো কি বলব? যে হারে জেরা শুরু করেছিল, অল্পের জন্য বেঁচে ফিরেছি।’

‘কেন কি হয়েছে?’

‘আমার এখন কিছু হয় নাই। কিন্তু তার আগে তুমি বলো তুমি সব জায়গা থেকে আমাকে কেন ব্লক করে রেখেছো? কি শান্তি পাও তুমি এসব করে? আমাকে জ্বালাতে তোমার এত ভালো লাগে?’

অনিন্দিতা হাত নাড়িয়ে চুল উড়িয়ে ভ্রু নাচিয়ে বলল, ‘তোকে জ্বালিয়ে আমি আত্মিক শান্তি পাই। আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই আমি ব্লক করে রেখেছি তোকে। আমার যখন ইচ্ছা হবে তখন ব্লক খুলে দিব।’

‘এসব করে কি লাভ হয়?’

‘ওই যে বললাম আত্মিক শান্তি! বুঝতেই পারছিস, আমি তোর কপালে জুটলে তোকে এইরকম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে আমি আত্মিক শান্তি পাওয়ার চেষ্টা করব।’

মিফান বিড়বিড় করে বলল, ‘যেখনে তোমার হটনেসে জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাই, সেখানে আর আমাকে জ্বালানোর অন্য উপায় অবলম্বন করতে হবে না।’

অনিন্দিতা হাত উঁচিয়ে বলল, ‘কি বললি তুই?’

‘বললাম যে তোমার কিউটনেসে এমনিতেই সব সময় জ্বলে পুড়ে ছারখার হই। আমায় আর কত ছারখার করলে তুমি শান্তি পাবে বলতো?’

‘যতটা করা যায়, ততটাই করবো।’

‘ভালোবেসে এই এক জায়গায় আটকে গেছি। আমার আসলে উচিত তোমায় শাসন করা। কিন্তু ওই যে তোমাকে বকাবকি করা লাগবে, ধমকা ধমকি করা লাগবে; সেটা তো আমি পারবো না তাই না। ভালোবেসে একদম যাচ্ছে তাই ভাবে ফেঁসে গেছি।’

‘ভালোবেসে ৫০% ফেঁসে গেছিস, বিয়ের পরে একদম সম্পূর্ণ ভাবেই ফেঁসে যাবি। আগেভাগে চিন্তা কর, বিয়ে করবি না কি করবি না?’

‘এই মিফান এত সহজে হাল ছাড়ে না মিস প্রজাপতি। ভালো যখন বাসতে পেরেছি, তখন পুরোপুরি ভাবে ফেঁসে যেতেও রাজি আছি। ভালোবাসা কি আর নির্ভেজাল হয় কখনো, তার উপর আমি আবার তোমাকে ভালবাসতে গেছি। তুমি আবার কখনো ভেজাল বিহীন মানুষ ছিলে নাকি?’

‘হুহ!’

‘যাইহোক ব্লক টা খুলে দাও। ভালো লাগেনা এসব অত্যাচার।’

‘ভালো না লাগার জন্যই তো করছি, ভালো লাগলে করতাম নাকি?’

‘আচ্ছা এখন তো অনেক হয়েছে। একটু বোঝো এইবার আমাকে।’

‘বাড়ি যা, বাচ্চা মানুষ বেশিক্ষণ বাড়ির বাহিরে থাকতে হয় না। যাই আমিও, ঘুম ধরছে গিয়ে আরাম করে একটা ঘুম দেই।’

‘তার আগে ব্লকটা খুলে যাও।’

‘যখন আমার ইচ্ছে হবে তখন খুলব।’

‘তাহলে আমিও তোমার সাথে কথা বলবো না। থাকো তুমি তোমার রাগ আর জেদ নিয়ে। আমিও চললাম, থাকব নিজের মতো। তোমার সাথে কথা নাই আমার।’

অনিন্দিতা হাত নাড়িয়ে বলল, ‘আল্লাহ হাফেজ!’

মিফান রাগ করে চলে এলো। কিন্তু মেইন গেইট পর্যন্ত এসেই আবার ঘুরে গেল। অনিন্দিতা তখনো ওখানেই দাঁড়িয়ে ছিল। সে জানতো, মিফান আসবে। তাকে আসতেই হবে। ভালোবাসার টান ছিন্ন করা যে এতো সহজ নয়!
মিফানকে আসতে দেখে অনিন্দিতা জিজ্ঞেস করল, ‘আবার কোন নাট্যকলা করতে এসেছে সেখানে?’

মিফান নিশ্চুপ। বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে ধীরে সুস্থে বলল, ‘সরি তখন ঐভাবে বলতে চাই নাই। আসলে আমি….!’

অনিন্দিতা মিফানকে থামিয়ে বলল, ‘তোর কথা শেষ?’

‘হু?’

‘বললাম যে কথা কি শেষ?’

‘হ্যাঁ মানে না, না হ্যাঁ।’

‘কি হ্যাঁ আর না এর মাঝে আটকে গেলি। যা বাড়ি গিয়ে পড়তে বস, সামনের মাসে না তোর পরীক্ষা। পরীক্ষার আগে যেন বাহিরে ঘুরঘুর করতে না দেখি। একেবারে ঠ্যাং ভেঙে খোঁড়া করে রেখে দিব।’

মিফান আর কোনো কথা না বলে পা বাড়ালো। অনিন্দিতা ওখানে দাঁড়িয়েই মুখ চেপে হাসতে লাগল। এই অবুঝ ছেলে বিয়ে করলে তো সারা জীবন এর বুঝ দিতে দিতেই জীবন। মিফান এতো টুকু বুঝলো, সামনে তার পরীক্ষার কারণেই অনিন্দিতা আপাতত তাকে ব্লক করে রেখেছে। না রেখেও তো উপায় নেই। সারাদিন, এমনকি প্রতিটা সেকেন্ডে সেকেন্ডে একটা করে এসএমএস দিব। কোনো কাজের কথা না, অযথাই। তাই অনিন্দিতা ওর ভালোর কথা ভেবেই ব্লক করে রেখেছে। আর যেখানে এসবের জন্য তার সরি বলা লাগত, সেখানে মিফান নিজেই সরি বলে চলে গেল। এটাকেই বোধ হয় ভালোবাসা বলে!

মিফান মেইন গেইটের সামনে গিয়ে আবার থমকে দাঁড়ালো। একটু আগে সে তো অনেকখানি পর্যন্ত চলে এসেছিল, কিন্তু তখনও অনিন্দিতা দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল। কেনো? ওতো বলেছিল ও ঘুমাতে যাবে, তাহলে দরজার সামনেই কেন দাঁড়িয়ে ছিল?
মিফান তখন বিষয়টা খেয়াল করে নাই। এখন একটু গভীরভাবে খেয়াল করতেই তার মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল। তার মানে অনিন্দিতা জানতো, মিফান আবার আসবে।
গেইটে দাঁড়িয়েই মিফান নিজের চুল এলোমেলো করে উপরের দিকে তাকালো। বুকের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা অনুভব হচ্ছে। ব্যাপারটা সে ইতিমধ্যে বুঝে গেছে, ওই দিক থেকে ও সামথিং সামথিং ফিল হচ্ছে তাহলে!
মিফান মনে মনে বলল, ‘কেন তুমি ভাঙবে কিন্তু মচকাবে না, তাইনা? উফফফ, আমি তো জীবন যুদ্ধে না থুক্কু; অনিন্দিতা কে পাওয়ার যুদ্ধে আরও একবার জিতে গেলাম।’

ভালোবাসা জিনিস টা রহস্যময় আর অপ্রকাশ্য কেন? হয়তো এই রহস্যময় আর অপ্রকাশ্য ব্যাপারটা ধরতে পারলেই মানুষ ভালোবাসায় জিতে যায়।
এসব ভাবতে ভাবতেই মিফান বাড়ি পৌঁছে গেল।
.
.
দুই পরিবার মিলে একটা সিদ্ধান্তে এলেন। মিফান আর অনিন্দিতার কাবিন করে রাখবেন, আর ঘটা করে বিয়ে-শাদি পড়ে দিবেন। মিফান আর অনিন্দিতা কেউ জানানো হয়েছে সিদ্ধান্তটা, মিফান তো সাথে সাথে রাজি হয়ে গেছে কিন্তু অনিন্দিতা প্রথমে একটু দোনোমনো করেছে। কিন্তু, মিফান জানে অনিন্দিতার এই দোনোমনো করার বিষয়টা আসলে দেখানো। সে যে কত কষ্ট করে বিয়েতে রাজি হয়েছে, এটাই মিফানকে দেখাতে চায়। আর দেখাতে চাইবেই না কেন? পরবর্তী জীবনে তো এই ব্যাপার নিয়ে উঠতে বসতে খোঁচা দিতে পারবে।
এটুকু ভাবতেই মিফানের চোখে ভেসে উঠল তাদের কাল্পনিক পরবর্তী জীবন।
অনিন্দিতা তাকে শাসনের সুরে বলছে, ‘তোকে কি আমি ইচ্ছে করে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম? তোকে বিয়ে করতে তো আমি রাজিই হয় নাই। মাত্র আব্বু আর চাচুদের কথা মেনে নিয়ে তোকে বিয়ে করলাম। এটাকে না ডিরেক্ট দয়া বলে। আমার মধ্যে মায়া দয়া একটু বেশি তো তাই মানবিকতার খাতিরে তোকে বিয়ে করে নিয়েছি। নাহলে তোর মত বাঁদর মুখো কে, কে বিয়ে করত? আমি তোকে বিয়ে না করলে তোর বিয়ে হতো কখনো? এইজন্য না তোর আমার উপর কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। দিনে দুপুরে রাতে তিন বেলা নিয়ম করে আমার পা ধরে সালাম করা উচিত।’

মিফান জানি অনিন্দিতার পক্ষে এসব কথা বলা অসম্ভব কিছুই না। বলুক অথবা না বলুক, কিন্তু এসব ভাবতে তার ভালো লাগে। বড্ড বেশি ভালো লাগে। অনিন্দিতা তাকে সারা জীবন এভাবেই শাসন করে যাক। মা যেভাবে হাল ধরে এসেছে এতটা বছর, এইবার অনিন্দিতা সেই হালটা ধরুক। একটু ভালোবাসুক!
আচ্ছা অনিন্দিতা কি বিয়ের পর তাকে তুই তুই করে ডাকবে? ডাকতেই পারে। কিন্তু সেটা কি ভালো দেখাবে? লোকে কি বলবে? বউ হয়ে বরকে তুই তুই করে বলে, ছিঃ ছিঃ!
মিফান পরক্ষণেই ভাবলো, যার যা মন চায় ভাবুক তাতে তাদের কি? অনিন্দিতা তাকে ভালোবেসে তুই তোকারি করবে, অন্য মানুষকে তো আর করতে যাচ্ছে না। ভালোও তাকে বাসবে, শাসনও তাকেই করবে।

মিফানের খুব শখ অনিন্দিতার মুখ থেকে ভালবাসি কথাটা শোনার। কিন্তু অনিন্দিতা তো বলবে না। ইদানিং মিফান নিজেও অনিন্দিতার সাথে কথা বলার পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। সেও একটু শূন্যতা টের পাক, এই শূন্যতা থেকে যদি তার ভালবাসি বলতে পারার ক্ষমতাটা এসে যায় তাতে ক্ষতি কি! কিন্তু অনেক তো হলো, আর কত অপেক্ষার প্রহর গুনতে হবে? অনিন্দিতা এতো পেইন দিচ্ছে কেন?

কোনো এক বিকেলে….
_____________________

অনিন্দিতা মিফানকে ফোন করে শুধু একটা মাত্র কথাই বলল। সেটা হলো, ‘তুই এক্ষুনি আমার সাথে দক্ষিণ দিকের নদীর পাড়ে এসে দেখা করবি। এক্ষুনি মানে এক্ষুনি, আমি এক সেকেন্ডও দেরি করতে পারবো না।’

পরীক্ষা শেষে মিফানের আলস্য সময় কাটছিল। অনিন্দিতা যখন ফোন করেছিল তখন তার তন্দ্রা মতন লেগে এসেছিল। কিন্তু ম্যাডাম যখন ফোন করে বলেছে এক্ষুনি দেখা করতে হবে, তাহলে তো তার যাওয়া বাধ্যতামূলক।
মিফান সাইকেল চালিয়ে চলে এলো নদীর পাড়ে। কিন্তু যতদূর চোখ পড়লো কোথাও অনিন্দিতাকে দেখা গেল না। মিফানকে এত তাড়াতাড়ি আসতে বলল, অথচ নিজের আসার নাম গন্ধ নাই। এই মেয়ে বোধহয় সারা জীবন মিফানকে এইরকম অপেক্ষা করাতে করাতেই জীবন পার করে দিবে।

মিফান ফোন করল অনিন্দিতা কে। অনিন্দিতা ফোন ধরেই মিফানকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে নিজে বলল, ‘দুই মিনিট ওয়েট কর আমি আসছি।’

অগত্যা মিফান অপেক্ষা করতে লাগলো। দুই মিনিট পেরিয়ে ১০ মিনিট হয়ে গেল তাও ম্যাডামের আসার খবর নেই। মিফান গালে হাত দিয়ে নদীর পাড়ের মাছায় বসে রইলো।
পেছন থেকে চুরির আওয়াজ ভেসে আসছে। স্পষ্ট বুঝতে পারল অনিন্দিতা এসেছে। কিন্তু ফিরে তাকালো না। মুখ ঘুরিয়ে বসে রইলো। অনিন্দিতা মিফানের পেছনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘অনেকক্ষণ হলো এসেছিস?’

মিফান ছোট্টো করে বলল, ‘হু।’

‘অনেক অপেক্ষা করালাম মনে হয়?’

‘সারা জীবন তো এই ভাবে অপেক্ষা করাতে করাতেই কাটাবে, জানা কথাই।’

‘আচ্ছা? রাগ হয়েছে আমার উপর?’

‘আমার কারো উপর রাগ হয় না।’

‘বসবো তোর পাশে?’

‘জায়গাটা আমার বাপ দাদার একার সম্পত্তি না যে কেউ এখানে বসতে পারবে না।’

অনিন্দিতা হাসলো। মিফান তাকে খেয়াল ই করে নাই। রাগ করেছে ছেলেটা। রাগ ভাঙাতে হবে না তো। না ঠিক রাগ নয়, অভিমান। অভিমান জিনিসটা দীর্ঘক্ষন জমিয়ে রাখতে নেই, ঝেড়ে ফেলতে হয়।
অনিন্দিতা মিফানের পাশে বসলো। মিফানের দৃষ্টি নিচের দিকে নিবদ্ধ।
অনিন্দিতা বলল, ‘তোর হাত ধরতে পারি আমি?’

মিফান নিজের হাত গুটিয়ে নিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, ‘আমার হাত সরকারি সম্পত্তি না।’

অনিন্দিতা এবার জোরে জোরে হেসে উঠল। হাসির দমকে মিফান অনিন্দিতার দিকে তাকালো। আর তাতে সে অবাক না হয়ে পারলো না।
কাঁধ পর্যন্ত খোলা চুল, চোখে লেপ্টানো কাজল আর নীল শাড়িতে আবদ্ধ তার ব্যক্তিগত প্রজাপতির দিক থেকে সে চোখ ফিরিয়ে নিতে পারল না।
মানুষ এতো সুন্দর হয়? না মানুষ না তো, প্রজাপতি। আর প্রজাপতি তো একটু বেশিই সুন্দর হয়।

অনিন্দিতা হাসির রিনরিনে আওয়াজে মিফানের বুক কেঁপে উঠলো। চোখ সরিয়ে নিতে গিয়েও পারল না। বুকে ব্যথা করছে, কেমন যন্ত্রনাও হচ্ছে। অতি সুখে বোধহয় এমন ব্যথা হয় বুকের বা পাশে। এটাকেই বুঝি বলে ভালবাসার ব্যথা!

অনিন্দিতা হাত নাড়িয়ে বলল, ‘এভাবে ভ্যাবলার মত তাকিয়ে আছিস কেন? আমাকে জীবনে কখনো দেখিস নি?’

মিফান মন্ত্রমুগ্ধের মতো আওড়ালো, ‘তোমাকে দেখেছি সব সময় কিন্তু এই প্রজাপতিকে কখনো দেখি নাই। এই প্রজাপতি এতো বুকে ব্যাথার কারণ কেন?’

‘আমাকে দেখে ভ্যাবলা বনে গেলি‌। এটা মোটেও ঠিক নয়। তাহলে তো, দুইদিন পর আমার থেকে আরো কোনো সুন্দরী মেয়ে দেখলে এরকম ভ্যাবলা খেয়ে যাবি। শুধু ভ্যাবলা না, উষ্টা খেয়ে ড্রেনে পড়ে যাবি।’

‘সবাইকে কি আর প্রজাপতির মতো ভালোবাসা যায়? তাদের দেখে আমি উষ্টা খেয়ে ড্রেনেই পড়ে যাব, ওদের দেখলে আমার বুকে অসহনীয় ব্যাথাও হবে ন কিন্তু প্রজাপতিকে দেখার পর…..!’

‘আর বলতে হবে না। এখন তোকে খুব বড়ো একটা শাস্তি দিবো, যেটা তোকে মাথা পেতে গ্রহণ করতে হবে।’

মিফান গোমড়া মুখে বলল, ‘আবার কি শাস্তি?’

‘আমার হৃদয় হরণের অপরাধী তোকে প্রেম কারাগারে বন্দী হতে হবে। বল, রাজী? উহু, এখানে আর কোনো কথা হবেনা। এককথায় উত্তর দিবি, হ্যাঁ অথবা না!’

‘আজতো এক কথায় উত্তর দেওয়ার দিন না। তুমি আমাকে এই কটা দিন বহুৎ জ্বালিয়েছো, এবার আমি তোমাকে নিত্যদিন জ্বালাবো হৃদয়ের অঙ্গনে।’

‘আমাকে তো তোর প্রেমের কারাগারে বন্দী করেই ফেলেছিস। আমার জ্বালাবিও?’

‘হু। বিয়ে নিয়ে এতো নাটক করলে কেন?’

‘আমার নাটক করতে ভালো লাগে। কিছুদিন পর আমাদের বিয়ে না, বিয়ের পর কোন এক চ্যানেলে ভাবছি অডিশন দিতে যাব। কেমন হবে বলতো?’

‘তোমার নাটক দেখলে যেকোনো পরিচালক তোমায় চোখ বন্ধ করে নিয়ে নিবে।’

‘এটাই তো চাচ্ছি আমি।’

‘আর কি চাও? আমি ভালোবাসি, আমার ভালোবাসা চাও না?’

‘ইদানিং দেখছি আমার প্রতি তোর ভালোবাসা কমে গেছে। ব্যাপার কি হু? আমার প্রতি ভালোবাসা কমে গেলে কিন্তু আমি বাধ্য হবো তোকে বশ করে নিতে।’

‘কমে নাই। এই ভালোবাসা কখনো কমবে না। সারাজীবন উতলে দেওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকবে।’

‘তো একবার প্রজাপতি বলে ডাক না?’

‘শুধু প্রজাপতি না, তুমি আমার খুব প্রিয়তমা প্রজাপতি! একবার প্রকাশ্যে ভালবাসি বলে দাও না?’

‘বলতেই হবে?’

‘না বললেও চলে। তোমার কর্মকাণ্ডে আমি অনেক আগেই বুঝে নিয়েছি তোমার ভেতরেও সামথিং সামথিং ফিল হচ্ছে।’

‘খুব যত্ন করে তোকে ভালোবাসার শখ পুষে রেখেছি বুকের ভিতর। এইবার বলেন প্রিয়, আমি কি সারা জীবন আপনার হয়ে থাকতে পারি? আপনি কি আপনার পাশের জায়গাটা আমার জন্য রাখতে রাজি আছেন?’

মিফান হাসল। স্নিগ্ধ হাসি। সেই হাসিতে অনিন্দিতা মুখে না বলা সবকিছু অনুভব করে নিল। আলতো করে হাত রাখলো মিফানের হাতে।
অনিন্দিতার কাঁধে কোথা থেকে উড়ে এক প্রজাপতি বসল। মিফান তা দেখে বলল, ‘দুইখান প্রজাপতি। তবে আমার প্রজাপতি একটু বেশি সুন্দর!’

তারপর সময় গড়ালো। সন্ধ্যার আগমন ঘটছে ধীরে ধীরে। নীরবতা ভেঙ্গে মিফান স্নিগ্ধ কন্ঠে বলল,
‘রাত্রির শান্ত নদীর মতো নিস্তব্ধতা,
সাধারণের মধ্যে কিছু অসাধারণতা!
প্রেমের সংজ্ঞা স্পষ্টভাবে নাই আমার জানা,
পড়ন্ত বিকেলে দুজনের পথে ছুটে চলা,
শুধু তুমি আছো তাই বারবার প্রেমে পড়ে যাই;
গ্রীষ্মের শীতের মৃদু হাওয়ার মতো প্রেমও তৃষ্ণা চাই
ডায়েরির প্রথম দু’পাতায় তোমার সংঙ্গা লিখি,
ওহে আমার প্রিয়, আমার প্রিয়তমা প্রজাপতি!’

অনিন্দিতা খুব করে হাসল। সে বুঝল, শুধুমাত্র মিফানকে জ্বালিয়ে তার আত্মিক শান্তি আসে না। এই পুরো মিফান জুড়েই তার আত্মিক শান্তি নিহিত। মিফানেই তার জীবন সুন্দর!!
.
.
.
সমাপ্ত…..!