প্রিয় প্রহর পর্ব-১৭

0
653

#প্রিয়_প্রহর
লেখনীতে: #নুরুন্নাহার_তিথি
#পর্ব-১৭
শুভ্র আরোহীকে কি বলবে ভেবে পায় না। আরোহী বিষয়টা বুঝে মুচকি হেসে শুভ্রর হাত ছেড়ে রুমে চলে যায়। রুমে যেয়ে বিছানা গুছানো শেষে শুভ্র রুমে এসে বলে,
–ধন্যবাদ।

আরোহী শুভ্রর দিকে তাকায়। তারপর জবাবে হাসি দিয়ে ঘুমানোর জন্য শুয়ে পড়ে। এরপর শুভ্রও খুশি মনে শুয়ে পড়ে।

পরেরদিন,,,
আরোহীকে সকাল সকাল মেডিকেলে নামিয়ে দিয়ে শুভ্র চলে যায়। আরোহী ক্যান্টিনে যায়। ক্লাসের আরো পনেরো মিনিট আছে। এই পনেরো মিনিটে স্যান্ডুইচ বা কেকে-পেস্ট্রি খাবে। সকাল ৭.৪৫ বাজে। বাসা থেকে বেরিয়েছে ৭ টায়। এতো সকালে শুধু চকলেট মিল্ক আর সেদ্ধ ডিম খেয়ে হাতে আপেল নিয়ে খেতে খেতে বেরিয়েছে। বিয়ের আগেও এটাই করতো। মেডিকেলের ক্যান্টিনে এসে কেক, স্যান্ডুইচ খেয়ে নাস্তা শেষ করতো দুইবোন। এতো সকালে রুটি বা ভাত খেতে কষ্ট হয় আর বমি আসে।

আরোহী টেবিলে চেয়ার টেনে বসা মাত্র তানু হামলে পরে আরোহীর উপর।
–উফ তানু! কি হইছে তোর? এমন করে জড়ায়ে ধরিস কেন!

তানু দাঁত বের করে বলে,
–কালকে কি করছো বান্ধবী? ভাইয়ার কাছে পড়া কেমন বুঝলা আর উইশ কেমনে করছো?

আরোহী চোখ ছোট ছোট করে তাকায় তানুর দিকে। তানু থতমত খেয়ে যায় এমন করে তাকানোতে। তানু সারার দিকে তাকায় কিছু বলার জন্য। সারা ইশারা বুঝে বলে,

–আরে তুই তো ভয় পাচ্ছিলি, শুভ্র ভাইয়া পড়া বুঝানোর কথা বললে বকবে বলে। তাই জিঙ্গাসা করেছে।

আরোহী ক্যান্টিনের ছোট ছেলেটাকে ডেকে চার পিস স্যান্ডুইচ অর্ডার করে তারপর বলে,
–না। বকে নি। ভালো করেই বুঝিয়ে দিয়েছে।

আয়ানা আসে তখন।
–স্যরিরে। আজকে ঘুম থেকে উঠতো লেট হয়ে গেছে।

আয়ানা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলে। তানু আয়ানাকে ব্যাঙ্গ করে বলে,
–বিয়ে হয়েছে আরুর আর লেট করিস তুই! বিয়ের আগে তো আরুকে ঘুম থেকে তুলতে লেট হতো। এখন তো জলদি উঠার কথা তোর।

সারা তানুর সাথে তাল মিলিয়ে বলে,
–আরে তানু বেবি, তুমি বুঝো না কেনো! আয়ুর সেও তো আয়ুকে রাত জেগে এনাটমি বুঝায় দেয়। আর সারারাত তাদের এই বোজানোতে চলে যায়!

আয়ানা ওদের ফাজলামি দেখে বলে,
–শোন! ওর এতো সময় নাই। সামনের মাসে ওর এমবিবিএস ফাইনাল। সেই সেপ্টেম্বর থেকে ডেট পিচাচ্ছে। ফাইনালি ধ্রুবের ইন্টার্ন শুরু হবে মার্চ থেকে। কালকে আমি অনেক রাত পর্যন্ত পড়াশোনা করছি। আর মেঘ ভাইয়া মাত্র আমায় নামায় দিয়া গেলো।

তানু মেঘের নাম শুনে বলে,
–হাহ! তোর এক ভাই তো গম্ভীর হয়ে থাকে আর আরেকটা রেগে থাকে। তোর দুই ভাই আমারে চরম ছ্যাঁকা দিছে। ক্রাশ খাইছিলাম দুইটার উপর। আর দুইটাই সিক্রেটলি মিঙ্গেল।

আরোহী স্যান্ডুইচে কামড় দিয়ে খেতে খেতে বলে,
–ইফান ভাই কিন্তু এতদম সিঙ্গেল।

তানু বলে,
–তোর ওই খালাতো ভাইটা! যেটা রামগরুর ছানার মতো হাসে না। তাই না? কেমনে জানি তার মধ্য তোদের নীড় ভাই ও মেঘ ভাইয়ের বাতাস লেগে গেছে যে সে একদম কম কথা বলে আর রাগী।

আয়ানা কপাল কুঁচকে খেতে খেতে বলে,
–ইফান ভাই খুব ভালো। সে একদম খালুর মতো হয়েছে। খালু নাকি আগে এমন ছিলো। পড়াশোনা নিয়ে পরে থাকতো। এমনে এমনে কি এতো নামকরা নিউরোসার্জন সে! আর ইফান ভাইয়া, সেও যথেষ্ট হাসে। আমাদের সাথে তো দারুন মজা করে। ভাইয়ার ইন্টার্ন শেষ হবে। তারপর ঢাকা মেডিকেলে বা সরোয়ার্দি তে ট্রাই করবে। সেও খালুর মতো নিউরোসার্জন হতে চায়। তবে খালামুনি ভাইয়াকে বিয়ে না করে বিদেশ যেতে দিবে না। তাই ভাইয়া এখন আপাতোতো হায়ার ডিগ্রীর জন্য যেতে পারছে না।

তানু বলে,
–আমি ফেসবুকে নক করছিলাম। সে দুই মাস হলো মেসেজ সিন করলো না আর না রিকুয়েস্ট একসেপ্ট করলো। আমিও সুন্দর করে রিকুয়েস্ট ক্যান্সেল করে দিছি।

চার জন হেসে উঠে। আরোহী তানুকে বলে,
–শোন তানু। ভাইয়া ফেসবুকে ঢুকে না আর ঢুকলেও মেসেজিং কম করে। কারন তার মেসেজিং করতে ভালো লাগে না।

সারা এসবের মাঝে বলে,
–উফ! তোদের বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড কাহিনী শুনতে শুনতে যে ক্লাস টাইম হয়ে এলো দেখেছিস? আমরা চারটা তো এখানে। তবে পাঁচ নাম্বার জন কই মরলো?

তানু পানি খেয়ে বলে,
–ইশু আছে কোথাও অভ্র ভাইয়ের সাথে। এক বিয়াত্তা আর দুই মিঙ্গেল প্রাণীর মধ্যে আমি আর তুই ফেঁসে গেলাম রে!

সারা ভ্রঁ কুঁচকে বলে,
–তুমি তো খালি ক্রাশ খাও। আমি তাও না। আমি আশা করি যে আমি নিজের মনকে পিউর রাখলে স্বামী হিসেবে যে আসবে সেও আমার মতো হবে।

সারার কথায় আরোহী ও আয়ানা মুচকি হাসে আর তানু মুখ ভেঙচি দিয়ে উঠে পরে।
_______

কেটে যায় এক মাসের কিছু বেশি সময়। আরোহীদের পরিক্ষা শেষ হয়েছে। কয়দিন বন্ধ পেয়েছে। আরোহী শেষ পরিক্ষার দিন ওদের বাসায় গিয়ে দুইদিন থেকে এসেছে। বন্ধ পেয়েছে মাত্র পনেরো দিন। দুইদিন শুভ্র যায়নি আর না আরোহীকে কোনো ফোন করে খবর নিয়েছে। আরোহীর বিষয়টা খারাপ লাগলেও আর পাত্তা দেয়নি।
আজ সকালে একা একাই শুভ্রদের বাড়িতে চলে এসেছে। ওর ফুপি মানা করেছিল একা না আসতে। শুভ্র যেয়ে নিয়ে আসবে বলেছিল। তবে আরোহী জোর করেই চলে এসেছে। শুভ্রকে অস্বস্তিতে ফেলতে চাইলো না।

বাসায় এসে আরোহী ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরে গেছে কিছু বানাবে। শুভ্রর মা মানে আরোহীর ফুফি ওরে ঢুকতেই দিলো না এই বলে যে, ” এখন মাত্র এসছিস। এখন রান্না করার দরকার নাই।”

আরোহী বাধ্য হয়ে চলে এসেছে। ভাবলো কার্টুন দেখবে তাই ডোরেমন খুলে বসে গেলো।

দুপুরের পর আরোহী এক প্রকার জোর করে বিকেলের নাস্তা আর রাতের জন্য চিকেন উইংস দিয়ে একটা স্পাইসি রেসেপি বানাবে বলে রান্নাঘরে যায়। এই রেসেপিটা শুভ্রর পছন্দ হবে কারন শুভ্র ইন্সট্রাগ্রামের স্টোরিতে দেখেছিলো স্পাইসি চিকেন শুভ্রর পছন্দ। অন্য খাবারে বেশি ঝাল খেতে না পারলেও এই রেসেপিটাতে পারে। এই রেসেপিতে তেঁতুল ও চিনির ব্যাবহার আছে।

শুভ্র আজকেও সাড়ে দশটার পর বাসায় ফিরে। সে এখনো জানে না যে আরোহী চলে এসেছে। ফেব্রুয়ারি মাস তাই শীতের তিব্রতা কমেছে। আরোহী ব্যালকনির ডিভানে কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে পাতলা কম্বল গায়ে দিয়ে আরাম করে শুয়ে আছে। ডিভানের সাইডের থাই গ্লাস খুলে দিয়েছে আকাশ দেখার জন্য।

শুভ্র রুমে ঢুকে আগে পাখা চালিয়ে নিয়েছে। তারপর বিছানায় শুয়ে পড়লো। দুইদিন ধরে এগারোটার পর বাসায় ফিরে। আজকে জলদি কাজ শেষ তাই এসে পড়েছে। এই মাসের শেষে ইংল্যান্ড যেতে হবে। একটা সার্জারি আছে। ওই সার্জারিটা ভালো ভাবে করতে পারলে সে হার্টসার্জনের ডিগ্রী পাবে। ওই রোগীকে তার হেলথ কন্ডিশনের কারনে লেট করে সার্জারি করতে হবে। রোগী অনেকটা বৃদ্ধ। ৬০ বছর বয়স। রোগীর ছেলেরা অনেক উচ্চ পর্যায়ে আছে। আর শুভ্র যেখানে এপ্লাই করেছে সেটাতে ওই রোগী একজন ডাক্তার। শুভ্র সেখানে পড়াশোনা করেছে।

ইংল্যান্ড যাবে তার প্রিপারেশন আবার রোগীর চাপ সব মিলিয়ে শুভ্র স্ট্রেসে আছে। শুভ্র পাঁচ মিনিট পর ওয়াশরুমে যায়। সে এখনো বুঝতে পারে নি যে আরোহী এসেছে। ফ্রেশ হয়ে তোয়ালে রাখতে ব্যালকনিতে যেয়ে দেখে ডিভানে কিছু একটা দেখা যাচ্ছে। শুভ্র সেখানে যেয়ে দেখে আরোহী আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। অবাক হয়ে শুভ্র! যে আরোহী কখন আসলো? সে আরোহীকে ডাক দেয়,

–রুহি!

আরোহী কি এক ধ্যানে ছিলো যে খেয়াল নেই। আর কানে তো আরমান মালিকের গান,,
” ইতনি মোহাব্বত কারু না,
মে ডুব না যায়ু কাহি!
ওয়াপাস কিনারে পে আনা
মে ডুব না যায়ু কাহি।
দেখা যাবছে চেহরা তেরা,
মে তো হাফতোছে সোয়া নেহি।
বোল দো না জারা,
দিলমে যো হে ছুপা,
মে কিসি সে কাহুঙ্গা নেহি,
মে কিসি সে কাহুঙ্গা নেহি। ”
(নিজ দায়িত্বে বাকিটা শুনে নিবেন।)

শুভ্র আরোহীর কোনো হেলদোল না দেখে আরোহীর বাহুতে হাত দেয়। আরোহী হঠাৎ ধরফরিয়ে উঠে বসে। এরপর শুভ্রর দিকে তাকায়। তারপর বলে,

–ওহ আপনি! কখন এলেন?

–বিশ মিনিট হবে। তো তুমি কখন এলে? জানাওনি তো

–সকালে এসেছি। আপনি কি এই দুইদিন আমার কোনো খোঁজ নিয়েছেন যে জানাবো?

শুভ্রর কথার প্রেক্ষিতে আরোহী জবাব দেয়। শুভ্র এমনিতে প্রেশারে ছিল তাই মাথায় আসেনি। শুভ্র বলে,

–অনেক ব্যাস্ত ছিলাম আর এই মাসের শেষে ইংল্যান্ড যেতে হবে। একটা সার্জারি আছে। যেটা ভালো করে করতে পারলে হার্টসার্জন হয়ে যাবো অফিশিয়ালি।

–ওয়াও। ভালো। সমস্যা নেই আমি কিছু মনে করিনি। আর তাছাড়া আপনার সাথে আমার এখনো মনে করার মতো সম্পর্ক গড়ে উঠেনি। ডাইনিংয়ে আসুন ডিনার করবো।

আরোহী চলে যায়। শুভ্রর খারাপ লাগে তবে এখন আর ভেবে লাভ নেই। আর আরোহী তার খবর ঠিক নিয়েছে তার মায়ের কাছ থেকে তা শুভ্র জানে। কারন কালকে রাতে তার মা বলছিলো আরোহীর সাথে হওয়া কথাগুলো তবে আরোহী যে আজ আসবে তা বলেনি।

শুভ্রর কাছে আরোহীর বানানো রান্নাটা অনেক ভালো লেগেছে। প্রশংসা করেছে তবে জানতে চায়নি কে বানিয়েছে। শুভ্র বুঝেই গেছে এটা আরোহী বানিয়েছে কারন তার মা এভাবে রান্না করে না।
_______

ধ্রুব এক ধারছে পড়েই যাচ্ছে। রেজাল্ট ভালো হলে যদি ঢাকা মেডিকেলে ইন্টার্নের সুযোগ পায় তো তার আয়ানার সাথে দেখা করাটা সুযোগ হবে। আর তিনটা পরিক্ষা বাকি।

আয়ানা ধ্রুবকে ফোন করতে চাচ্ছে কিন্তু ভয় পাচ্ছে যে ধ্রুবর পড়াতে ডিস্টার্ব হবে নাকি এই নিয়ে। আয়ানার সময় কাটছে না। আরোহী চলে গেছে আর তার কোনো কাজ নেই।

এতো ভাবার মাঝে ফোন করেই বসলো হুট করে। ধ্রুব ফোন রিসিভ করে বলে,

–কি ম্যাম! এতোক্ষন লাগে একটা ফোন করতে? কতোক্ষন নাম্বার ডায়েল করে কেটেছেন বলেন তো?

–তুমি বুঝলা কিভাবে?

–আমি আপনাকে খুব ভালো করে চিনি। আর সকালে তো মেসেজে বলেছিলেন যে আরু চলে গেছে। তো ম্যাম! খেয়েছেন?

— হ্যাঁ। তুমি খাইছো? নাকি বই ছেড়ে উঠোনি?

–না গো এখনো খাওয়া হয়নি। আজকে বউ থাকলে খাইয়ে দিতো!

আয়ানাও মজা করে বলে,
–নিয়ে যাও বিয়ে করে। আমি তোমারে খাওয়ায় দিবো।

–এখন না। আমার ইন্টার্ন শুরু হবে। ইন্টার্ন শেষ হলে তারপর তোমায় নিয়ে আসবো বিয়ে করে।

আয়ানা লজ্জা পায় কিছুটা।
–আচ্ছা। তুমি আগে খেয়ে নাও তারপর পড়তে বসো। আর খাওয়ার পর আমাকে মেসেজ করে বলবা, খেয়েছো যে। কালকে পরিক্ষা ভালো হবে ইনশাল্লাহ।

চলবে ইনশাআল্লাহ,
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। কার্টেসি ছাড়া দয়া করে কপি করবেন না। রিচেক করা হয়নি।