প্রিয় বেলা পর্ব-০৯

0
554

প্রিয় বেলা

৯.
পশ্চিম আকাশে সূর্য ডুবেছে। নভস্থলে নিকষকৃষ্ণ আঁধার। পড়াতে পড়াতে একটু বেশিই দেড়ি হয়ে গেছে বেলার। এখন রাত ৭টা বেজে ৪মিনিট। এলাকাটা নির্জন। রাতের দিকে যানবাহনের দেখা পাওয়া বেশ মুশকিল। বেলা কাঁধের ব্যাগটা ভালোভাবে নিয়ে মেনরোডের দিকে পা বাড়ালো। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ দৃষ্টি গেল সূদুর পাশের রাস্তায়। আদ্র দাঁড়িয়ে আছে। সঙ্গে সেই প্রথম দিনের ছেলেগুলো। যাদের একজনকে বেলা চিনে। তাদের এলাকারই। শুকনা, পাতলা একটা ছেলে।
আরেকটু কাছাকাছি হতেই চোখাচোখি হলো দু’জন। অথচ একদম অচেনার মতো আদ্র তৎক্ষণাৎ চোখ সরিয়ে নিয়েছে। যেন সে চিনেই না বেলাকে। বেলা অবাক হলো খুব। বিস্ময়ে কিছুক্ষণ চেয়েই রইলো আদ্রর পানে। আদ্র আর তাকায় নি। একবারের জন্যও না। সরব পাশে রিকশা থামতেই চকিতে তাকালো সে। বয়স্ক রিকশাচালক সবকটি দাঁত বের করে হাসলো। জিজ্ঞেস করলো,
—“কোথায় যাইবেন মা? উঠেন, পোঁছাইয়া দেই।”

বেলার খটকা লাগলো। সে তো রিকশা ডাকে নি। আগ বাড়িয়ে আসার প্রয়োজন কি? বেলা স্পষ্ট ভাষায় মানা করে বললো,
—“আমি যাবো না। আপনি যান।”
—“আফনি কি ডরাইতেছেন মা? ডরাইয়েন না। আমি কিন্তু মা ডাকছি আপনারে। ভুল কাম করতাম না।”

তার সন্দেহ দ্বিগুণ বাড়লো। অচেনা লোকের এমন ভুলোমনা কথা বিশ্বাস করার মতো বোকা সে না। কণ্ঠে অনেকটা শক্ত ভাব নিয়ে বেলা বললো,
—“যাবো না একবার বলেছি তো চাচা। জোড়াজোড়ি করছেন কেন? আপনি যান।”

রিকশা চালক যেন একটু হতাশ হলো। একবার ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকালো। তারপর বেশ অনুরোধ করে বললো,
—“এমন কইরেন না মা। স্যারে কইছে আপনারে যেন ভালোমতো পোঁছাইয়া দেই। আপনি না গেলে স্যারে রাগ কইরবো।”

বেলার ভ্রু কুঞ্চিত হলো। আগের ন্যায়ই বললো, “আশ্চর্য! আপনার স্যার বললেই আমাকে যেতে হবে নাকি? কে আপনার স্যার?”
—“আদ্র স্যার।”
বেলা ক্ষীণ থতমত খেয়ে গেল। আদ্রর নাম শুনে স্বাভাবিক হলো তার কুঁচকালো ভ্রুযুগল। ভাবলো খানিক্ষণ। তার কি ওঠা উচিত রিকশায়? আশেপাশে খালি রিকশা নেই। বাস আসতে আরও আধঘণ্টা। দেড়ি হয়ে যাবে খুব। অনেক ভেবে বেলা শেষে উঠে পরলো রিকশায়। ঠিকানা বলতে নিলেই রিকশা চালক হেসে বললো, “আমি জানি মা।”

বেলা চুপচাপ হয়ে যায়। মনে সন্দেহের দানা এখনো বিরাজমান। এদিক-ওদিক তাকিয়ে রাস্তা পরখ করছে সে। অর্ধেক রাস্তা পার হওয়ার পর রিকশাচালকের ফোনে কল এলো হঠাৎ। তিনি খুব সাবধানে কথা বললেন যেন। ওপাশের ব্যক্তির কথা শুনে শুধু বললেন, “আইচ্ছা, চিন্তা কইরো না।”

রাস্তার মোড় ঘুরে গেল। চিরচেনা এলাকায় প্রবেশ করতেই মনে মনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো বেলা। রিকশা চালক একবার পেছনে ফিরে তার দিকে তাকালো। মুচকি হেসে বললো,
—“এহন ডর কমছে মা?”

বেলা অপ্রতিভ হলো খুব। লজ্জিত কণ্ঠে ছোট্ট করে বললো, “দুঃখীত চাচা। কিছু মনে করবেন না।”
রিকশা চালক আবারও হাসলো,
—“আরে নাহ্! কিছু মনে করি নাইকা। ডর থাহা ভালো। তা আফনার বাসা কইনটা মা? আদ্র স্যারের ফরের বাসা না?”
—“জি।”

ধারণা সঠিক হওয়ায় প্রফুল্ল মনে মাথা দুলালেন তিনি। কিছুক্ষণ থেমে আবারো জিজ্ঞেস করলেন,
—“আফনি কি হন আদ্র স্যারের?”
বেলা থতমত খেলো। পিটপিট করলো নেত্রপল্লব। থেমে থেমে বললো,
—“কিছু না। আমরা প্রতিবেশী।”

এ কথার পিঠে রিকশা চালক আর কিছু বললেন না। ঝকঝকে সাদা দাঁত বের করে নিঃশব্দে হাসলেন মাত্র। ভীষণ অর্থপূর্ণ হাসি।

__________

আবহাওয়া একটু শীতল হতেই হাত, পা ঠান্ডায় কেঁপে ওঠে বেলার। সে ঠান্ডা একদমই সহ্য করতে পারে না। ক্ষীণ পাওয়ারে চলা ফ্যানের বাতাসেও কেমন গা শিরশির করে ওঠে। ফ্যানের সুইচটা বন্ধ করে দিলো সে। মায়ের সঙ্গে হাত লাগিয়ে টেবিল থেকে আধখাওয়া খাবারের বাটিগুলো রান্নাঘরে রাখতে লাগলো। প্রভা বেগমের হাঁটুতে ব্যথা। তিনি বেশি হাঁটতে পারেন না। একটু কাজ করতেই হাঁপিয়ে ওঠেন।
ডাইনিংয়ের চেয়ার টেনে বসে একগ্লাস পানি খেলেন তিনি। হঠাৎ কিছু মনে পরায় সচকিত কণ্ঠে বললেন,
—“এই বেলা, ছাদ থেকে কাপড় এনেছিলি বিকালে?”
—“আমি বিকালে বাসায় ছিলাম? তুমি আনো নি?”
—“না। মনে ছিলো না। যা তো মা, এখন গিয়ে নিয়ে আয়। ভাগ্যিস মনে পরেছিল! নইলে তো সারারাত বাহিরেই থাকতো কাপড়গুলো।”

বেলা বিরক্ত হলো। এই ঠান্ডায় ছাদে গিয়ে কাপড় আনার মোটেও ইচ্ছে নেই তার। চুপচাপ রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বললো,
—“তোমার ছেলেকে পাঠাও। আমি এই ঠান্ডায় যেতে পারবো না।”
প্রভা বেগম স্বভাবসুলভই শান্ত রইলেন। নরম সুরে বললেন,
—“এই রাতে বিহান ছাদে যেতে পারবে? তোর মনে হয়? উলটো কোনো আকাম করে আসবে। তুই একটু যা না মা। আমার পায়ে ব্যথা জানিসই। নইলে আমিই যেতাম।”

ভেতর থেকে আপনা-আপনি দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো বেলার। চুলায় চা বানানোর জন্য পানি বসিয়েছিল সে। এখন আর খেতে ইচ্ছে করছে না। কেতলি নামিয়ে রাখলো সে। প্রভা বেগম ডাইনিং থেকে আবারো ডেকে উঠলেন, “বেলা, যাবি না?”
চুলার গ্যাস বন্ধ করে বেলা জবাব দিলো, “যাচ্ছি।”

বিছানার এককোণে বসে বিহান ফোনে কার্টুন দেখছে। তার পাশেই বেলার ওড়না। সেটা নিয়ে গায়ে জড়িয়ে নিলো বেলা। রুম থেকে বেরোনোর সময় একবার বিরক্তিভরা দৃষ্টিতে তাকালো বিহানের দিকে। ধমক দিয়ে বললো,
—“ফোন রেখে একটু কাজও তো করতে পারিস বিহান। এত ফোনে কি দেখিস?”
ফোনে গভীর মনোযোগ রেখে বিহান দায়সারা ভাবে উত্তর দিলো,
—“কালকে করবো কাজ। এখন কথা বলিও না তো বুবু।”

__________

ছাদে এসে ক্ষীণ অন্যমনস্ক হয়ে পরলো বেলা। আদ্রর কথা হুট করেই মানসপটে এসে হানা দিচ্ছে। তাকে সে বুঝে উঠতে পারেনা। মস্তিষ্কে বড়সড় জট পাকিয়ে ফেলে। ভাবনা হয় এলোমেলো। আদ্রর ব্যবহার, চোখের অন্যরকম চাহনি বেলার কাছে অস্পষ্ট। আদ্রর করা হুটহাট কাজগুলোও তাকে ভাবিয়ে তোলে খুব। আজ বিকালে যখন আদ্র আদেশ করে বেলাকে দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছিল, কল কাটার পর আদ্রর বারান্দায় একবার হলেও তাকিয়ে ছিল বেলা। লোকটা তখন কান থেকে ফোন নামিয়ে ব্যস্ত পায়ে রুমে ঢুকছিল। এই যে, সামান্য বিষয়ে তাকে নিয়ে অস্থির হয়ে পরা আদ্র ভীষণ ভীতু করে তোলে তাকে। অবাস্তব কিছু ভাবনা মাথায় জেঁকে বসতে চায়। যা চায় না বেলা। চাওয়াটাও বড্ড দুঃসাহসের কাজ।

তার থেকে কাপড় নিতে নিতে হঠাৎ তারে থাকা সুঁইয়ের ন্যায় সূক্ষ্ণ কিছু আঙুলে বিঁধে যায় বেলার। ব্যথায় মৃদু কাতরে ওঠে সে। দ্রুত নিজেকে সামলে নিলেও টনটন করে উঠে আঘাতের স্থান।
আদ্র পাশের ছাদেই ছিল। বেনসনের তিন নম্বর সিগারেটের ধোঁয়া উঁড়াচ্ছিল সে। মুখ থেকে আগত বিষাক্ত ধোঁয়াগুলো বায়ুর বিশুদ্ধতায় মিশে যাচ্ছিল তরতর করে। আদ্রর চোখ বন্ধ। গায়ে ধূসর রঙের টি-শার্ট। সরব কানে কারো চিৎকার ভেসে আসতেই চোখ মেললো সে। পাশ ফিরে তাকালো। বেলাকে দেখে তৎক্ষণাৎ ফেলে দিলো সিগারেট। তা গিয়ে পরলো বাগানের কোনো এক সুন্দর ফুলগাছের আড়ালে। বেলা তখনো আদ্রকে দেখেনি। তীব্র অন্ধকার সেখানে। শীতও বাড়ছে। দ্রুত কাপড় নিয়ে চলে যেতে চাইছিলো সে। তাকে বাঁধা দিয়ে আদ্র উঁচু কণ্ঠে ডেকে উঠে,
—“বেলা।”

আকস্মাৎ ডাকে বেলা চমকে যায়। পেছনে ফিরে আদ্রর মুখোমুখি দাঁড়াতেই আদ্র আবার বলে,
—“এদিকে আসুন।”
বেলা জড়োসড়ো পায়ে কাছে এগোয়। অবাক স্বরে জিজ্ঞেস করে,
—“আপনি এত রাতে ছাদে কি করছেন?”

আদ্রর ভাবলেশহীন উত্তর, “সিগারেট খেতে এসেছিলাম।”
বেলা হকচকালো। নিঃসঙ্কোচ কথাটি শুনে অবাক নেত্রে চেয়ে রইলো। খেয়ালে এলো, আদ্রর গালে সদ্য একটা আঁচড় লেগে আছে। বেশ গভীর। সেদিকে তাকিয়ে বেলা জিজ্ঞেস করলো,
—“গালে ব্যথা পেলেন কিভাবে?”
—“একজনকে মারতে গিয়ে ভুলে লেগে গিয়েছে।”

বেলার ভ্রু কুঞ্চিত হলো। থেমে থেমে বললো,
—“এমন কাজ করেনই কেন, যেখানে নিজের ক্ষতি হবে।”
আদ্র হাসলো। নিঃশব্দে, নিষ্প্রভ ভাবে।
—“কিছু কিছু ক্ষতির মাঝে আনন্দও লুকিয়ে থাকে বেলা। আপনি বুঝবেন না।”

বেলা সত্যিই বুঝলো না। গায়ের চাদরটা আরেকটু আষ্ঠেপৃষ্ঠে নিলো। গালের আঁচড়টির দিকে আরেকবার দৃষ্টি ফেলে বললো,
—“ব্যান্ডেজ করেননি কেন?”
—“ইচ্ছে হয়নি। আপনি করিয়ে দেবেন?”

বেলা আবারও অপ্রস্তুত হলো। এদিক-ওদিক তাকালো। হাসফাস করে বললো, “আমি—”
বলার মাঝেই হঠাৎ রেলিং টপকে বেলার একদম কাছাকাছি চলে এলো আদ্র। বিস্ময়ে চোখ বড় বড় হলো তার। কণ্ঠ কেঁপে উঠলো। শীতে লাল হওয়া গাল গরম হতে শুরু করলো আবার। নিশ্বাস হলো ভারী। বিমূঢ় হয়ে সে বললো,
—“আপনি এছাদে এসেছেন কেন? পাগল নাকি?”
নির্লিপ্ত কণ্ঠে আদ্রর স্বগোতক্তি, “হয়তো।”

বেলা দূরে সরে দাঁড়ালো। ব্যগ্র হয়ে অনুরোধ করলো,
—“আপনি দয়া করে আপনাদের ছাদে চলে যান। কেউ দেখে ফেললে অন্যকিছু ভাববে। আদ্র, যাচ্ছেন না কেন?”

আদ্র তবুও গেল না। তাকিয়ে তাকিয়ে শুধু দেখতে লাগলো বেলাকে। বেলার লজ্জা লাগছে। কণ্ঠে শব্দজোট লেগে গেছ যেন। কাঁপা কাঁপা স্বরে বেলা অস্বস্থি নিয়ে বললো,
—“এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? যাচ্ছেন না কেন?”

আদ্রর মুখশ্রী নিমিষেই শক্ত হয়ে এলো। দৃষ্টি হলো গম্ভীর, নির্নিমেষ, পলকহীন। এগিয়ে এসে ঘনিষ্ঠ হলো বেলার সঙ্গে। বেলার দু’গালে হাত রেখে কপালে কপাল ঠেকালো। চোখ বুজলো অতি নিবিড়ভাবে। বেলার হাত থেকে কাপড় ফসকে মেঝেতে পরে গেছে। চোখ খিঁচে বন্ধ করে রেখেছে সেও। আদ্র স্নিগ্ধ কণ্ঠে তখন আওড়ালো,
—“আপনাকে দেখার তৃষ্ণা আমার কখনোই মিটবে না বেলা।”

__________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা