প্রিয় বেলা পর্ব-১২+১৩

0
612

প্রিয় বেলা

১২.
অনলের তীব্রতা বাড়ছে। প্রচন্ড ঝড়ে ওলোটপালোট হচ্ছে সবকিছু। বৃষ্টির সে কি ঝাপটা, শব্দ! অশান্ত বক্ষস্থলে গাঢ় যন্ত্রণা। আদ্রের জড়িয়ে ধরার ধরণ পাল্টেছে। বাঁধন হয়েছে আরও প্রগাঢ়। কাঁধে আগের মতোই কপাল ঠেকিয়ে অনবরত নিশ্বাস নিচ্ছে সে। বেলা একপলক আদ্রকে দেখতে চাইলো। কিন্তু তার কাটা দাগযুক্ত গাল ছাড়া আর কিছুই দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না তার। ধীর স্থির বেলা পিঠে থাকা হাতটা আলতো বোলালো। মৃদু স্বরে বললো,
—“শান্ত হন আদ্র। ছাড়ুন।”

আদ্র নিজ জায়গা হতে বিন্দু মাত্র সরলো না। ওভাবেই রইলো। বেলা নিজেকে ছাঁড়ানোর চেষ্টা করে বললো,
—“ছাড়ছেন না কেন? কেউ দেখে ফেলবে।”

আদ্র সরে এলো মুহুর্তেই। তার চোখ এখনো রক্তলাল। কপালে অসংখ্য বলিরেখার ভাঁজ। অনিমেষ চোখে একবার বেলার দিকে তাকালো সে। তার সঙ্গে সঙ্গে বেলাও বৃষ্টিতে কাকভেঁজা হয়ে গেছে। লাল রঙের কামিজটা ভিঁজে একাকার। নিকষকৃষ্ণ কেশ বেয়ে অবিরাম পানি ঝরছে। আদ্র তৎক্ষণাৎ অন্যদিকে তাকালো। প্রশ্ন করলো, “ছাতা এনেছেন?”
বেলা ছোট্ট করে জবাব দেয়,
—“না।”
—“ওদিকটায় গাড়ি রেখে এসেছি আমি। আসুন।”

আদ্র নিজের হাতের মুঠোয় বেলার হাত গুঁজে নিলো প্রবল অধিকার বোধ নিয়ে। বেলা নিশ্চুপ ভাবে তার সঙ্গে হাঁটছে। মাঝে মাঝে আড়চোখে দেখছে তাকে। সুদূরে গাড়ি পার্ক করা। বৃষ্টির দরুণ জনমানবহীন এলাকাটা আরও নিস্তব্ধ লাগছে। গাড়ির দরজা খুলে বেলাকে ঢুকতে ইশারা করলো আদ্র। বেলা বিনা বাক্য ব্যয়ে ভেতরে ঢুকে পরলো। আদ্রও ড্রাইভিং সীটে বসে গাড়ির জানালাগুলো লাগিয়ে দিলো এক এক করে। এসি আগে থেকেই বন্ধ।
পেছনের সীট থেকে একটা কালো রঙা জ্যাকেট নিলো আদ্র। বেলার পানে এগিয়ে দিয়ে বললো,
—“জ্যাকেটটা গায়ে জড়িয়ে নিন বেলা।”

বেলা বাহিরের তাকিয়ে ছিল। শরীর ভিঁজে থাকার কারণে হঠাৎ হঠাৎ কেঁপে উঠছিল সে। চোখ মুদে আসছিল ক্লান্তিতে। আদ্রর কথায় ঘোর কাটলো তার। চমকিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “জি?”
—“আপনার জামাটা একটু বেশিই পাতলা বেলা। জ্যাকেটটা পড়ে নিন।”

বেলা অপ্রস্তুত হলো ভীষণ। অপ্রতিভ ভাবে জ্যাকেটটা নিলো। গায়ে জড়িয়ে নিলো পরক্ষণেই। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে আদ্র গম্ভীর স্বরে আবার বললো,
—“আমি করিম আঙ্কেলকে বলে দেব আরও সাবধান হতে। উনার থেকে উনার নাম্বারটা মনে করে নিয়ে নিবেন।”
—“তার আর প্রয়োজন নেই।”
—“কেন?” ভ্রু কুঞ্চিত করে প্রশ্ন ছুঁড়লো আদ্র। বেলা মলিন কণ্ঠে বললো,
—“আমি আসলে টিউশনটা ছেড়ে দিয়েছি। নতুন টিউশন না পাওয়া অব্দি এটার ঝামেলা কয়েকদিন নেই।”
—“তাতে কি? আপনার ভার্সিটি নেই? করিম আঙ্কেল ভার্সিটি পৌঁছে দেবেন আপনাকে।”

বেলা কথা বাড়াতে গিয়েও আবার চুপ হয়ে গেল। সে বৃষ্টিতে বেশিক্ষণ ভিঁজতে পারে না। জ্বর, সর্দি, মাথা ব্যথায় নাজেহাল অবস্থা হয়। এখনো মাথা ব্যথার অসহনীয় যন্ত্রণায় চোখ খুলে রাখা দায় হয়ে পরেছে। আস্তে আস্তে শরীরের সম্পূর্ণ ভর সীটে ছেড়ে দিলো বেলা। আধখোলা চোখে অস্পষ্ট দেখতে পেল, গম্ভীর মুখো আদ্র ভ্রু কুঁচকে ড্রাইভ করছে। বেলার দিকে তাকাচ্ছে না। অথচ ঘুমিয়ে যাওয়ার আগ অব্দি বেলা আদ্রর দিকেই তাকিয়ে ছিল। একমনে, নির্নিমেষ ভাবে।

বৃষ্টি এখনো কমে নি। নির্জন রাস্তার একপাশে গাড়ি দাঁড় করানো। হেডলাইটের আলোয় যা একটু রাস্তা দেখা যাচ্ছে। গাড়ির ছোট বাতিগুলো আদ্র নিভিয়ে দিয়েছে। আবছা আলোয় বেলার ঘুমন্ত মুখখানায় নিষ্পলক চেয়ে আছে সে। গভীর, তৃষ্ণাতুর দৃষ্টিতে। প্রিয়তমাকে মনভরে দেখার তৃষ্ণা। ঘুমিয়ে থাকলেও শীতে মেয়েটার শরীর থেকে থেকে কাঁপছে। নাক লাল হয়ে আছে। আদ্রর ঠোঁটে অকারণেই ক্ষীণ হাসি বিদ্যমান। হাত বাড়িয়ে বেলাকে নিজের বুকে টেনে নিলো সে। একহাতে বেলাকে আঁকড়ে অন্যহাত দিয়ে এলোমেলো চুলগুলো কানের পেছনে ঠেলে দিলো অতি সন্তপর্ণে। অধর ছোঁয়ালো তার কপালে। এরপর বেলার দিকে তাকিয়ে আনমনে বলে উঠলো,
—“শুনছেন বেলা? আপনি পাশে থাকলে আমার ক্লান্তি আসে না।”

__________

সায়েদ সাহেব আজ অফিসে যাননি। বাসা থেকেই জমি বেঁচার কাজগুলো সেরে ফেলছেন। সকালেই একজন লোক নগত দশ লক্ষ্য টাকা দিয়ে গেছেন সায়েদ সাহেবকে। বিনিময়ে নিজের প্রাণপ্রিয় জমিটি লোকটির নামে লিখে দিতে হয়েছে তার। সে থেকে এখন পর্যন্ত সোফায় বসে আছেন তিনি। টেবিলে থাকা এত এত টাকাগুলোর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন একটু পরপরই। প্রভা বেগম মন খারাপ করে কাজ করছেন। স্বামীর কষ্টে তার ভেতরটাও সূক্ষ্ণ ব্যথায় কাতরাচ্ছে। বিহানও আজ ভদ্র ছেলের মতো চুপচাপ টেবিলে বসে পড়ছে। বাড়িটা কেমন ভুতুড়ে বাড়ি হয়ে গেছে। শব্দহীন, বিষণ্ণ প্রত্যেকটা মানুষ। বেলা আস্তে করে বাবার পাশে বসলো। মৃদু কণ্ঠে ডাকলো, “বাবা?”

সায়েদ সাহেব যেন শুনতে পেলেন না। বেলা আরও একবার ডাকতেই সম্বিৎ ফিরলো উনার। হকচকিয়ে বললে,
—“কি– কি হয়েছে?”
বেলা আগের মতোই বললো,
—“এত চুপচাপ বসে আছো কেন? নাস্তা খাবে না?”
—“হ্যাঁ, খাবো। আসলে ক্ষুধার কথা টের পাই নি। বিহানকে ডেকে নিয়ে আয়, যা।”

বলতে বলতে ব্যস্ত হয়ে পরলেন তিনি। বেশ কয়েকবার প্রভা বেগমকে ডাকলেন জলদি খাবার আনার জন্য। স্বামীর ডাকে প্রভা বেগম হন্তদন্ত পায়ে খাবার নিয়ে এলেন তক্ষুণি। বেলা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল সব। পরিবারের এই তীব্র জটিলতা ভেতরে ভেতরে হতাশায় ভরিয়ে দিলো তাকে।

টিউশন না থাকায় ভার্সিটির পর বাসায়ই থাকা হয় বেলার। হাতে অত কাজ থাকে না। বাসায় বসে বসে টিভি দেখে নতুবা ঘুমায়। বলা যায়, অনেকটা অলস সময় কাটছে তার। এরমধ্যে বেলাকে একদিন ডেকে নিয়ে এলেন রেখা। সোফায় সামনাসামনি বসিয়ে কিছু মেয়েদের ছবি ধরিয়ে দিলেন। চিন্তিত হয়ে বললেন,
—“দেখো তো বেলা, কোন মেয়েটাকে তোমার বেশি পছন্দ হয়। আমি আসলে বুঝতে পারছি না।”

বেলা হাতে থাকা ছবিগুলোর দিকে তাকালো। খুঁজে খুঁজে সবার শেষে যে ছবিটা ছিল, সেই মেয়েটাকে পছন্দ হলো তার। গায়ের রঙ খুব ফর্সা মেয়েটার। হলুদ শাড়ি যেন জ্বলজ্বল করে ফুটে উঠেছে। মিষ্টি মুখশ্রী, মায়াময়। রেখাকে ছবিটা দিয়ে বেলা বললো,
—“এই মেয়েটা দেখতে সুন্দর আন্টি।”
রেখা যেন নিমিষেই প্রচন্ড উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন,
—“আমারও এই মেয়েটাকেই খুব ভালো লেগেছে। কিন্তু ওই যে নীল শাড়ি পড়া একটা মেয়ে আছে না? ওকেও আমার ভালো লেগেছিল। তাই বুঝতে পারছিলাম না কাকে ফাইনাল করবো। তুমি আমাকে চিন্তা মুক্ত করে দিলে।”

বেলা কৃজ্ঞতা সমেত হাসলো। আয়াজ এবার মিটিমিটি হেসে বললো,
—“বেলা, মাকে জিজ্ঞেস করো মা কেন এত মেয়ের ছবি যোগার করেছে।”
আয়াজের কথা শুনে বেলা জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো রেখার দিকে। রেখা তখন কপট রাগ দেখিয়ে বললেন,
—“এত জিজ্ঞাসের কি আছে? বেলাকে আমি এমনিই বলতাম।”
তারপর বেলাকে বললেন,
—“বেলা, এই মেয়েকে আমি আমার ছেলেদের জন্য ঠিক করেছি। আমারও তো ইচ্ছা করে ছেলের বিয়ে দিতে, তাই না? আরুর বিয়েটাও তো হয়ে ফেল। এখন এদের মধ্যে কেউ একজন মেয়েটাকে বিয়ে করলেই শান্তি!”

বেলা আড়চোখে একবার আদ্রর দিকে তাকালো। যে আপাতত ফোন চালাতে মশগুল। আয়াজ দায়সারা ভাবে প্রতিউত্তর করলো,
—“ভাইয়ের টা জানি না। কিন্তু আমি এখন বিয়ে করতে পারবো না। চৈতি এখনো ছোট। ওর অনার্স শেষ হলেই তোমার ইচ্ছা পূরণ হবে।”
বেলা বিহ্বল হয়ে প্রশ্ন করলো,
—“এই চৈতি কে?”
আয়াজ মুচকি হাসলো। ফিসফিসিয়ে বললো, “আমার গার্লফ্রেন্ড।”
ওমনি ছবিগুলো টেবিলে রাখতে রাখতে রেখা বললেন, “এমন চুপিচুপি বলার কি আছে? সব আকাম তো আমার সামনেই করিস। ফাজিল ছেলে। গাঁধা।”

বেলা অবাক হয়ে রেখা আর আয়াজের দিকে তাকিয়ে রইলো। পরক্ষণেই খুব হাসি পেল তার। নিশব্দে হাসতে লাগলো। রেখা টেবিলের সবগুলো ছবি পাশে রেখে হলুদ রঙের শাড়ি পড়া মেয়েটির ছবি আদ্রর দিকে এগিয়ে দিলেন। প্রবল আগ্রহ নিয়ে বললেন,
—“দেখ তো আদ্র, তোর এই মেয়েটাকে কেমন লাগে?”

আদ্র নেত্রজোড়া ফোনের মাঝেই নিবদ্ধ রাখলো। নির্লিপ্ত স্বরে বললো,
—“ভালো লাগে নি।”
—“তুই দেখেছিস ছবিটা? ফোন রাখ। রেখে টেবিলে থাকা ছবিটার দিকে তাকা।”
আদ্র তবুও তাকালো না। বললো,
—“দেখে লাভ নেই। এদের ভালো লাগবে না আমার।”
রেখা রাগ মিশ্রিত কণ্ঠে বললেন,
—“কেন? মেয়েটা তো সুন্দরই।”

আদ্র বেলার মলিন মুখশ্রীতে গভীর দৃষ্টি ফেলল। অকপটে বললো,
—“আমি এমন মেয়েকে বিয়ে করবো মা, যার সাধারণতায় আমি বারবার মুগ্ধ হবো।”

______________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

প্রিয় বেলা

১৩.
পরিবেশ থমথমে। সেই থমথমে ভাবটা নিমিষেই কাটিয়ে আয়াজ মিটিমিটি হেসে উঠলো। তবুও রেখার তীক্ষ্ণতা কমলো না। তিনি জহুরি দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন,
—“এমন মেয়ে কোথায় খুঁজবো আমি, যার সবকিছুতে তুই মুগ্ধ হবি। পছন্দ কি আগে থেকেই করে রেখেছিস নাকি? কে মেয়েটা?”

আদ্র ফোনের স্ক্রীনে মনোযোগ দিলো। গম্ভীর স্বরে বললো, “পরে সময় হলে বলবো। আপাতত জেনে রাখো, তুমি তাকে চেনো।”
ভ্রু কুঞ্চিত হলো রেখার। তিনি মেয়েটাকে চেনেন? তার জানামতে বেশ কিছু মেয়েই আদ্রকে পছন্দ করে। কিন্তু আদ্র কখনো আগ্রহ প্রকাশ করেনি সেখানে। তাদের সঙ্গে কথা বলতেও কখনো দেখেনি রেখা। তবে কে হতে পারে? মস্তিষ্কে চাপ প্রয়োগ করলেন তিনি। কৌতূহলী মন উতলা হয়ে উঠলো ভীষণ। মায়ের হাবভাব বুঝে আদ্র আগেই জানিয়ে রাখলো,
—“আমি কিন্তু এখন কিছুই বলতে পারবো না তোমাকে। সময় আসুক। এমনিতেই জেনে যাবে।”

রেখা দমলেন না। চিন্তিত মুখে রাজ্যের ভাবনা জুড়ে দিলেন। আয়াজ তখন বেলাকে জিজ্ঞেস করলো,
—“তুমি বলো তো বেলা, তুমি আদ্র ভাইয়ের পছন্দের মানুষকে চেন?”
আয়াজের ঠোঁটে দুষ্টুমির হাসি খেলা করছে। বেলা হকচকিয়ে যায়। মিনমিন করে উত্তর দেয়,
—“আমি কিভাবে জানবো?”
রেখাও সায় দিলেন। বিরক্ত কণ্ঠে আয়াজকে বললেন,
—“আরে ও জানবে কিভাবে? হাঁদার মতো কথা বলিস কেন?”
আয়াজ নাক কুঁচকে বিড়বিড়ালো, “ও-ই তো জানবে মা। ভাই তো ওকেই জান, প্রাণ সব দিয়ে দিয়েছে।”

__________

রোদ্দুরে বেজায় বিরক্ত নিকষকৃষ্ণ কাকগুলি। কা, কা শব্দে বিশাল তোড়জোড় করছে তারা। অনেকে পাশের ঝিল থেকে স্নান করে কারেন্টের তারে এসে বসেছে। শরীর ঝাকিয়ে গায়ের পানিগুলো ঝেড়ে ফেলছে বারবার। চোখ,মুখ কুঁচকে একবার সেদিকে তাকালো বেলা। কাঁধের ব্যাগটা আরেকটু চেপে নিলো। কলেজ শেষ হয়েছে আরও আধঘণ্টা আগে। কিন্তু রিকশা চালক করিম এখনো আসছেন না। ঘেমে পরনের কামিজ শরীরের সঙ্গে লেপ্টে গেছে যেন। সরব ফোনে কল এলো তার। ফোন হাতেই ছিল। স্ক্রীনে আদ্রর নামটা ইংরেজী গুটিগুটি অক্ষরে ভেসে উঠছে। বেলা একটু অবাকই হলো। তিনদিন ধরে আদ্রর সঙ্গে দেখা নেই তার। আজ হঠাৎ কল দিলো কেন? পরক্ষণেই বিস্ময় ভাব কাটিয়ে কল রিসিভ করলো সে। কিছু বলার পূর্বেই আদ্র ওপাশ থেকে ডাকলো,
—“বেলা।”

বেলা ক্ষীণ থমকালো। আদ্রর কণ্ঠস্বরে ভাঙ্গা, ভাঙ্গা ভাব। দূর্বলতার স্বতঃস্ফূর্ত আভাস। বেলা নিঃশব্দে দীর্ঘনিশ্বাস ফেললো। ছোট্ট করে জবাব দিলো, “হু।”
—“আপনার ডান দিকে তাকান বেলা।”

বেলা কালবিলম্ব করলো না। তৎক্ষণাৎ তাকালো ডান পাশটায়। কালো রঙের একটা গাড়ি দাঁড় করানো। জানালা দিয়ে অস্পষ্ট আদ্রর মুখশ্রী দেখা যাচ্ছে। বেলা যেন আরও একদফা থমকালো। ভড়কালো, চমকালো, বিমূঢ় হলো ভীষণ। আদ্রর শুভ্র কপাল জুড়ে সাদা রঙের ব্যান্ডেজ বিরাজমান। নিষ্পলক দৃষ্টি বেলার দিকেই। সে চেয়েই রইলো। ওপাশ থেকে আদ্র দূর্বল কণ্ঠে আবার বললো,
—“আমি অপেক্ষা করছি বেলা। এদিকে আসুন।”

ফোন কেটে গেল। আড়ষ্ট, জোড়োসড়ো বেলা ধীরে ধীরে এগোলো গাড়িটির দিকে। গাড়ির কাছাকাছি আসতেই দরজা খুলে দিলো আদ্র। বেলা উঠে বসলো। নিষ্প্রাণ চোখে তাকিয়ে রইলো ক্ষতবিক্ষত আদ্রর মুখপানে। আদ্র হাসলো ক্ষীণ। ঢিমে আসা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
—“কেমন আছেন?”

বেলা সেকথার উত্তর দিলো না। তার নিশ্বাস আটকে আটকে আসছে। কণ্ঠনালিতে শব্দজোট। থেকে থেকে কেঁপে উঠছে অধরযুগল। হাত এগিয়ে আলতো করে কপালের ব্যান্ডেজ ছুঁলো সে। ছোট্ট করে শুধু বললো,
—“এসব– এসব কিভাবে হয়েছে?”

প্রতিউত্তরে আদ্র মুচকি হাসলো। উত্তর দিলো না। গাড়ি স্টার্ট করে ধীর গতিতে চালাতে লাগলো। বেলার অস্থিরতা বেড়ে দ্বিগুণ। চোখে পানি টলমল। আদ্রর হাত ঝাঁকিয়ে বেলা আবার জিজ্ঞেস করলো,
—“বলছেন না কেন? কিভাবে হয়েছে এসব?”
—“আমি এহাতে ইঞ্জুর্ড বেলা। ঝাঁকাবেন না। ব্যথা পাচ্ছি।”

বেলা সঙ্গে সঙ্গে হাত সরিয়ে নিলো। কিছু বলতে নিলেই তাকে থামিয়ে আদ্র বললো,
—“এখন কিছু জিজ্ঞেস করবেন না বেলা। আমি সব বলব। একটু অপেক্ষা করুন। ড্রাইভ করতে কষ্ট হচ্ছে আমার। একটু নিরিবিলি জায়গায় যেতে চাচ্ছি।”

বেলা নিশ্চুপ হয়ে যায়। নত হলো তার মস্তক। আঁখিজোড়া বেয়ে পানি গড়াচ্ছে। কষ্ট হচ্ছে তার। প্রচন্ড যন্ত্রণা। গাড়ির সামনের কাঁচে ফোন ফিট করে রাখা। যান্ত্রিক শহর পেরিয়ে নিরিবিলি রাস্তায় ঢুকতেই বেজে উঠলো তা। স্ক্রীনে মা নামটা ভাসমান। আদ্র সেদিকে একপলক তাকালো। বেলাকে বললো কল রিসিভ করতে। বেলাও তাই করলো। তৎক্ষণাৎ গমগমে গলায় রেখা বলে উঠলেন,
—“কোথায় তুই?”
আদ্র স্বাভাবিক স্বরে উত্তর দিলো,
—“ক্লাবে আছি।”
মুহুর্তেই তেঁতে উঠলেন তিনি,
—“এই তোর লজ্জা করে না? আবারও ওখানে গিয়েছিস কেন? তুই কি আমাকে মেরে ফেলতে চাস আদ্র? প্রথমে তোর বাবা রাজনীতির কারণে মারা গেল। এখন তুইও মরার জন্য এসব করছিস? আমার সুখ কি তোদের সহ্য হচ্ছে না?”

এটুকু বলে থামলেন রেখা। উগ্র মেজাজটা অল্প শান্ত হলো। নমনীয় কণ্ঠে অনুরোধ করলেন,
—“রাজনীতি ছেড়ে দেয় বাবা। কি লাভ এসব করে? তুইও কষ্ট পাচ্ছিস, আমরাও কষ্ট পাচ্ছি। আমাদের কথা অনতত ভাব। ছেড়ে দেয় বাবা।”

আদ্রর জবাব না পেয়ে ব্যস্ত হয়ে পরলেন রেখা। কাতর স্বরে ডাকতে লাগলেন, “আদ্র শুনছিস বাবা? আদ্র?”

আদ্র জোড়ালো নিশ্বাস ফেললো। প্রতুত্তরে শুধু বললো, “আমার আসতে রাত হবে মা। রাখছি।”
ওপাশ থেকে রেখার কান্নার আওয়াজ ছাড়া কিছুই শোনা গেল না।

গাড়ি থামলো তার একটু দূরেই। নির্জন স্থান। রাশি রাশি গাছপালা আর কিছু ট্রাকের আনাগোনা মাত্র।
গাড়ির সব জানালা খুলে দিলো আদ্র। বাঁধা না পেয়ে বাতাসগুলি মুক্ত হয়ে ছড়িয়ে পরলো গাড়ির ভেতর। এলোমেলো হলো বেলার ললাটের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কেশ, মাথার ঘোমটা। ক্লান্ত শরীর সীটে এলিয়ে দিলো আদ্র। নির্নিমেষ চোখে তাকালো বেলার নত মুখে। দু’হাত বাড়িয়ে দিলো। নিষ্প্রভ স্বরে আবদার করলো,
—“একটু বুকে আসবেন বেলা?”

বেলা সময় নিলো না। দূরত্ব কমালো। মিশে গেল আদ্রর বক্ষস্থলে।

______________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা