প্রিয় বেলা পর্ব-২৮+২৯

0
488

প্রিয় বেলা

২৮.
আদ্রর রুমে কখনো আসেনি বেলা। সুযোগই হয়নি। বিছানায় বসে পুরো রুমটা একবার পরখ করে নিলো সে। বড়োসড়ো একটা আয়তাকার রুম। একপাশে বিশাল বুকসেল্ফ, পড়ার টেবিল। বিভিন্ন রঙবেরঙের ফাইলের স্তুপে গোজামিল সেখানটা। দেওয়ালের একপাশে মাঝারি আকারের একটা পুরাতন কাঠের ফ্রেম টাঙ্গানো। পরিবারের সবার হাসোজ্জল মুখশ্রী ভেসে উঠছে ফ্রেমটিতে। আদ্রর বাবাও আছেন সাথে। তবে অনেকটা দূরে হওয়ায় ক্ষীণ অস্পষ্ট সবটা। কৌতূহলী বেলা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। দেওয়ালের কাছাকাছি এসে আলতো করে ছুঁলো ফ্রেমটা। মুজিব কোর্ট গায়ে সম্মানের সহিত বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আদ্রর বাবা। চেহারা অনেকটা আরুর সঙ্গে মেলে। তিন ছেলেমেয়েকে কি ভীষণ আদুরে ভাবে আগলে ধরে রেখেছেন। প্রাণবন্ত হাসিগুলো বাস্তবিকই যেন তার সামনে জ্বলজ্বল করে হাসছে।

—“আদ্রর যখন বারো বছর, তখন বেশ সখ করে ছবিটা তুলেছিলেন ওদের বাবা। সেই থেকে ছবিটা আদ্রর রুমেই টাঙানো। ফ্রেম নষ্ট হওয়ার পরও ফ্রেমটা ও পাল্টাতে চায় না। ওখানে নাকি ওর বাবার ছোঁয়া লেগে আছে।”

বলে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন রেখা। বেলা চমকে তাকালো। রেখার মুখশ্রী মলিন। কণ্ঠে হতাশ ভাব। একরাশ আফসোস, কষ্ট, যন্ত্রণা। বেলার কাছে এসে হাতের বাসন্তী রঙের শাড়িটা এগিয়ে দিলেন তিনি। কৃত্রিম হেসে বললেন,
—“তুমি নিশ্চই অনেক ক্লান্ত? এক শাড়ি পড়ে আর কতক্ষণ থাকবে? এটা পড়ে নিও। নাও।”
বেলা হাত বাড়িয়ে খুব সাবধানে নিলো। রেখা আবার বললেন,
—“মুখটা শুকনো লাগছে তোমার। ক্ষুধা লেগেছে? কিছু খাবে? নিয়ে আসবো?”
সে দ্রুত দিরুক্তি করলো, “না, না আন্টি। মা খাইয়েই দিয়েছিল। ক্ষুধা নেই এখন।”

রেখা শুনলেন। মুখের মলিন ভাব যেন আরও দ্বিগুণ বাড়লো। ফ্রেমের দিকে তাকিয়ে ম্লান কণ্ঠে বললেন,
—“আমার তিন ছেলেমেয়ের মাঝে আদ্রই সবচেয়ে বেশি তার বাবাকে ভালোবাসত। ছেলেটা আমার বাবার মৃত্যু সহজে মেনে নিতে পারেনি। মনে মনে কষ্ট পুষে রেখেছে।”

রেখার দৃষ্টি অনুসরণ করে বেলাও তাকালো। বারো বছর বয়সী আদ্রকে চিনতে তেমন অসুবিধে হয়নি তার। নেত্রকোণের সূক্ষ্ণ দাগটা সহজেই চোখে পরছে।
রেখা আচমকা বেলার হাত ধরলেন। তাকে বিছানায় বসিয়ে নিজেও বসলেন পাশে। অত্যন্ত সর্তক কণ্ঠে কেমন কাতরতা নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমাকে কি আদ্র কোনো রকম জোড় করেছে বিয়ের জন্য? সত্যি করে বলবে বেলা। তুমি কি আদ্রকে পছন্দ করো? নাকি বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছ?”

বেলা ভড়কে তাকায়। হতভম্ব হয়। চোখে বিস্ময়, বিমূঢ়তা। উত্তর দিতে পারে না। কণ্ঠনালিতে বিশ্রী শব্দজোট সৃষ্টি হয়। রেখার গভীর মুখপানে মায়া খুঁজে পায় সে। ছেলের চিন্তায় অস্থির হওয়া মায়ের কষ্ট দেখতে পায়। রেখা উত্তেজিত কণ্ঠে আবারও জিজ্ঞেস করেন,
—“উত্তর দিচ্ছো না কেন বেলা? ও কি সত্যিই জোড় করেছে তোমাকে?”
দমবন্ধকর অনুভূতি হলো বেলার। অস্বস্থি হলো ভেতরটা। মৃদু গলায় সে কোনোমতে উত্তর দিলো, “জোড় করেনি।”
—“তবে একা আদ্রই পাগলামি করতো না, তুমিও আগে থেকেই আমার ছেলেকে পছন্দ করতে?” বিহ্বল কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন রেখা।
বেলা প্রতিউত্তর করতে পারলো না। চুপচাপ রইলো। তিনি আরেক দফা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। চোখ ভেঙ্গে এলো যন্ত্রণায়। মেয়েটা সেধে সেধে কেন কষ্টের পেছনে ছুটছে? রাজনীতির বিশ্বে ভালো মানুষেরা আদৌ ঠিকেছে কখনো? তবুও থামলেন না তিনি। শেষ চেষ্টা করে গেলেন। খুব অনুরোধের সুরে বললেন,
—“আদ্র তোমাকে খুব ভালোবাসে। তুমি কি ওকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে আনতে পারবে বেলা? ও তোমার কথা শুনবে। ওকে একবার বলবে?”

বেলা পলক ঝাপটালো। নেত্রের অদৃশ্য ফ্রেমবন্ধী আদ্রর কৃত্রিম ছবিগুলো ভেসে উঠলো সামনে। টেলিভিশনে দেখানো গর্বে ফুলে ওঠা দাম্ভিক নেতার উচ্ছ্বাসিত মুখশ্রী হানা দিলো মস্তিষ্কে। সে দেখল, আদ্রর ভাষণ দেওয়ার সময়কার আনন্দ। চোখের সেই গভীর প্রশান্তি। তপ্ত নিশ্বাস ফেলে বেলা নমনীয় কণ্ঠে বোঝালো,
—“আমি বললে উনি হয়তো রাজনীতি ছেড়ে দেবেন আন্টি। কিন্তু এতে কি উনি শান্তি পাবেন? বরং মনের কষ্ট আরও বাড়বে। রাজনীতি করে উনি আনন্দ পান। সেই আনন্দ ছিনিয়ে নিতে চাইলে হয়তো উনি আমার ওপরও বিরক্ত হতে পারেন। কি দরকার আন্টি? উনি যেভাবে আছেন সেভাবেই থাকনা। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তো আমরা কেউ জানিনা। উনার বাবার মতো উনার পরিণতি নাও তো হতে পারে, তাই না?”

বেলা তাকালো রেখার দিকে। রেখার ভাবগতি বোঝা যাচ্ছে না। তিনি কিছু বলবেন তার পূর্বেই আদ্র ঢুকলো রুমে। অনেকটা শব্দ করেই। পায়ের ধুপাধাপ আওয়াজ কানে লাগছে খুব। রেখা দ্রুত বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। ছটপট কণ্ঠে বললেন,
—“এসেছিস? আয়াজ কোথায়? ক্ষুধা লাগলে নিচে চলে যাস। ফ্রিজে কেক আছে।”

ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আদ্র হাত ঘড়ি খুলে রাখলো। সেসবের উত্তর না দিয়ে অতি শান্ত স্বরে প্রশ্ন ছুঁড়লো, “তুমি প্রেশারের ঔষধ খেয়েছ?”
—“হ্যাঁ।”

চলে যাওয়ার আগে বেলার মাথায় স্বস্নেহে হাত বুলিয়ে দিলেন রেখা। দূর্বল হেসে বললেন,
—“পরের বার থেকে মা বলে ডাকবে, কেমন?”

প্রতিউত্তরে হালকা মাথা দুলালো বেলা। রেখা হন্তদন্ত পায়ে চলে গেলেন। মুখের মলিন ভাব ঢাকার ঢের চেষ্টা করলেন। অথচ বেলা ঠিকই বুঝতে পারলো উনার মনের অবস্থা।

ক্লান্তিতে বেলা একেবারে গোসল করেই বেরুলো। আদ্র বিছানায় আধ শুয়ে ফোন চাপছিল। পরনের লাল শার্টটি পালটে সাধারণ একটা টি-শার্ট পড়ে আছে সে। পেশিবহুল ফোলা বাহুগুলো যেন ইচ্ছে করেই দেখিয়ে রেখেছে। আকর্ষিত করতে চাইছে খুব। বেলা চোখ সরিয়ে নিলো। দক্ষিণের বড় জানালা গলিয়ে প্রবাহমান তেজি বাতাস আনাগোনা করছে। কি ভীষণ শীতল, ঠান্ডা। শরীর ছুঁতেই জায়গাটা শিরশির করে উঠলো যেন। দাঁতে দাঁত চেপে আসলো। আদ্র একপলক তাকালো সেদিকে। বললো,
—“ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন বেলা? এদিকে আসো।”

লজ্জায়, অস্বস্থিতে পা নড়ছে না তার। খুব ধীরস্থির ভাবে সে বিছানার এক কোণে পা উঠিয়ে বসলো। আদ্রর দিকে তাকাতেই দেখলো, লোকটা ভ্রু বাঁকিয়ে কেমন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছে তাকে। বিরক্তির স্পষ্ট ভাঁজ কপালে। বেলা দ্রুত অন্যদিকে তাকালো। জিজ্ঞেস করলো,
—“কি করেছি আমি। এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?”

আদ্র উত্তর দিলো না। কিছুক্ষণ অসন্তোষ চোখে দেখতে দেখতে হঠাৎই চোখের দৃষ্টি গাঢ় হয়ে উঠলো। দৃঢ়ভাবে প্রেয়সীর মাথা থেকে পা অব্দি খুব সময় দিয়ে দেখলো সে। কোমড়ের আশপাশটায় স্থির হতেই সূক্ষ্ণ যন্ত্রণা তৈরি হলো বক্ষে। অসহনীয়। স্নিগ্ধ বেলাকে ভীষণ পবিত্র মনে হলো তার। হাত টেনে নিজের পাশ ঘেঁষে বসালো। ব্যাঙ্কেট পুরো শরীরে সুন্দর করে ছড়িয়ে দিয়ে নির্বিকার সুরে বললো,
—“বিয়ে তো হয়েই গেছে। এখনো তোমার দূরত্ব, দূরত্ব খেলা শেষ হয়নি? হলে বলবে, তোমাকে ছুঁয়ে দিব।”

বেসালাম অদ্ভুদ কথার পিঠে ভয়ংকর লজ্জায় জড়োসড়ো বেলা। কম্পয়মান সর্বাঙ্গ। মিনমিন করে সে বললো, “আপনি এত খারাপ কেন?”
—“তুমি খারাপ বানালে কেন?”

পালটা প্রশ্নে হকচকালো বেলা। ইতস্তত করলো। আড়নজরে দেখলো লোকটাকে। পকেট হাতড়ে কি যেন বের করছে সে। অত্যন্ত গম্ভীর ভাবে বেলার হাত টেনে নিয়েছে। আঙুলের ভাঁজে খুব যতনে একটা আংটি পরিয়ে দিয়ে বললো,
—“এই রাতে নাকি স্ত্রীদের কিছু দিতে হয়। আয়াজ বলেছে। আমি জানতাম না। কিছু আনিও নি। ও-ই আংটিটা দিয়ে বলেছে তোমাকে যেন পরিয়ে দেই। এটা ওর পক্ষ থেকে তোমার জন্য উপহার।”

বেলা একপলক তাকালো আংটিটির দিকে। কারুকাজের নিপুণতা খুব সূক্ষ্ণ ভাবেই মন কেড়ে নিচ্ছে। অথচ বেলার অনুভূতি শূণ্য। আদ্র দেয়নি বলেই হয়তো।
চোখ বুজে ছোট্ট হামি দিয়ে উঠলো বেলা। ক্লান্তিতে ঘুম আসছে। চোখের পাতা মিলিত হতে চাচ্ছে তীব্র ভাবে। একহাতে তার বাহু টেনে নিজের বুকের মধ্যিখানে মাথা চেপে ধরলো আদ্র। আলতো করে, আদুরে ভঙ্গিতে। শুধালো,
—“তোমার কি ঘুম আসছে? তাহলে ঘুমিয়ে যাও। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।”

বেলা যেন আরও লেপ্টে গেল প্রেমিক পুরুষটির মাঝে। বিনাবাক্যে চোখ বুজলো। নীরবতা রইলো প্রায় অনেক্ষণ। বাহিরে কোলাহল নেই। সূদুর কোত্থেকে যেন নাম না জানা পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। নভস্থলে তারাদের প্রখর মেলা।
বেশ কিছুক্ষণ পর আদ্র নিষ্প্রভ স্বরে বললো,
—“তোমার কাছে আমার একটা উপহার পাওনা রইলো বেলা।”

___________________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

প্রিয় বেলা

২৯.
নিকষকৃষ্ণ আঁধার ডিঙ্গিয়ে সূর্যের তপ্তহীন কিরণ চারিদিকে ছড়িয়ে পরছে। পাখিদের কিচিরমিচির আওয়াজ প্রবল কোলাহল সৃষ্টি করছে। এয়ারকন্ডিশনের তীব্র শীতল স্পর্শে প্রিয়তমের বুকের উষ্ণতায় জড়োসড়ো হয়ে লেপ্টে আছে বেলা। টেলিভিশন চলছে অনেকটা শব্দ বাড়িয়েই। সময় সংবাদে একজন ভদ্র মহিলা খবর পড়ছেন,
—“কুমিল্লায় কাল রাত্রিবেলা তিনজন টেক্সিচালক গুরুতর ভাবে আহত হয়ে পরে ছিলেন মাঝরাস্তায়। এলাকার কিছু ভদ্র লোকের সাহায্যে এখন আপাতত সিটি হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি আছেন। ডাক্তাররা বলেছেন, বেঁচে ফিরবার সম্ভাবনা থাকলেও হাত, পা অকেজো হয়ে যেতে পারে তাদের। এছাড়া টেক্সিগুলোও বাজেভাবে ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। শুনলেন শিরনাম। এবার বিস্তারিত।”

বেলার ঘুম ভেঙ্গে গেল। তবে নেত্রপল্লব উন্মুক্ত হলো না। চোখ-মুখ কুঁচকে গেল তীব্র আলোর ছটায়। আদ্রর বক্ষস্থলে নিবিড়ভাবে মুখ লুকাতেই বিস্তর হাসলো সে। লহু কণ্ঠে ডাকলো,
—“বেলা? উঠবে না? ন’টা বেজে গেছে কিন্তু!”
বেলা ক্ষীণ নড়েচড়ে মাথা নাড়ালো। উঠবে না সে। তন্দ্রা ঘোর এখনো চোখের পাতায় দৃঢ় ভাবে এঁটে রয়েছে। বিছানা ছেড়ে উঠবার জো নেই। আদ্র আরও কয়েকবার ডাকলো। সারাশব্দ না পেয়ে পরক্ষণেই চুপ হয়ে গেল সে। টিভির ভলিউম একটু কমিয়ে দিলো। সেকেন্ড গড়ালো, এরপর মিনিট। তন্দ্রা ভাবটা যেন হঠাৎ-ই গা ঝাড়া দিয়ে উঠলো বেলার। চোখ মেললো সে। নিজের অবস্থান আদ্রর অতি নিকটে আবিষ্কার করতেই চমকিত হলো। ভড়কালো প্রচন্ড লজ্জায়। আদ্রর কোমড়ে থাকা তার দৃঢ় হাতের বাঁধন ঢিলে হয়ে আসলো। সরে যেতে চাইলেই পুরুষালি শক্ত হাতটি গিয়ে ঠেকলো পিঠের একদম মধ্যিখানে। টেনে এনে বুকের মাঝে আবারও মাথা চেপে ধরলো। খুব সাবধানী গলায় সর্তক করলো,
—“খবরদার, উঠবে না। এভাবেই থাকো। আমার সঙ্গে খবর দেখবে।”

বেলার আমতা আমতা কন্ঠস্বর,
—“খবর দেখে আমি কি করবো?”
—“তোমাকে লেডি রাজনীতিবিদ বানাবো আমি। তাই দেশের খুটিনাটি খবরাখবর রাখতে হলে তোমাকে খবর দেখতে হবে। একটু পর বাহিরে বের হবো। তখন রাজনৈতিক বইও নিয়ে আসবো কিছু। তুমি না বই পড়তে পছন্দ করো?”

বেলা পলক ঝাপটালো। সরে আসতে চাইলো। আদ্র এবারও অনড়ভাবে ধরে রইলো তাকে। চোখ, মুখ কুঁচকে অসম্ভব বিকৃতি করে প্রবল প্রতিবাদ জানালো বেলা, “ছাড়ুন আমাকে। এসব বই পড়বো না আমি। খবরও দেখবো না। আপনার রাজনীতি নিয়ে আপনিই থাকুন।”

প্রতিউত্তরে নিঃশব্দে হেসে দিলো আদ্র। বিরতিহীন, নিয়ন্ত্রণহীন ভাবে। হাসতে হাসতে সে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
—“রাজনীতি পছন্দ না তোমার?”
—“একদম না।”
—“এই রাজনীতিবিদকেও পছন্দ না?”

প্রশ্ন শুনে একটু থতমত খেয়ে গেল বেলা। নজর তুলে তাকালো। আদ্র শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নির্মলভাবে। বেলা বুঝে উঠতে পারলো না। লোকটা কি রাগ করলো এভাবে বলায়? বলা উচিত হয়নি বোধহয়। নত হয়ে সে আদ্রর শার্টের এককোণা খুব আলতো করে ধরলো। না ধরার সমান। স্নিগ্ধ গলায় মিনমিন করে বললো, “পছন্দ।”

আদ্রর তূখর দৃষ্টি তখন ভীষণ গভীর। আলাদা মাদকতার পরশ সুস্পষ্ট। ঘোর লাগা, অন্যরকম। হাত উঁচিয়ে বেলার গাল ছুঁলো নিষ্প্রভ ভাবে। ধীরস্থির কণ্ঠে শুধালো,
—“অথচ আমার মতো পছন্দ তুমি কখনোই করতে পারবে না বেলা।”

থেকে থেকে নিশ্বাস নিচ্ছে বেলা। আদ্রর দিকে তাকানোর সাহস নেই। লোকটার চাহনি মারাত্বক। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। জাদুকরের মতো সম্মোহন করে ফেলে নিমিষেই। আড়নজরে একবার টিভির দিকে তাকালো সে। বিজ্ঞানপন শেষ হয়ে এখন আবারও ওই টেক্সিচালকগুলোর সংবাদ দেখাচ্ছে। কি বিভৎস ভাবে মেরেছে তাদেরকে! চেহারা চেনার উপায় নেই। ব্যান্ডেজে আবৃত পুরো মুখশ্রী।

ক্লাবের দরজা, জানালা বন্ধ। বড়োসড়ো রুমটায় এখন শুধু আদ্র, আকিব আর ইখতিয়ার। ইখতিয়ার বেশ অসন্তোষ চোখে আকিবকে দেখছে বারবার। যেন আকিবের উপস্থিতি ঠিক পছন্দ হয়নি তার। ইশারা-ইঙ্গিতে বারবার চলে যেতে চলছে তাকে। আকিব বুঝতে একটু সময় নিলো। পরক্ষণেই নিজ থেকে বললো,
—“আমি তাহলে আসছি ভাই? আপনারা কথা বলুন।”

খরখর শব্দে দরজা খুলে তা আবার বাহির থেকে আটকে চলে গেল আকিব। ইখতিয়ার এবার সরাসরি মুচকি হেসে তাকালো আদ্রর মুখপানে। অথচ তার ভেতরটা আদ্রর জন্য কালো বিষে ভরে আছে। নিজ স্বার্থ না থাকলে কবেই এই নেতার দাপট বের করে জঙ্গলে লাশ ফেলে আসতো, তার ইয়ত্তা নেই।
ক্ষীণ চাটুকারিতার রেশ ধরে ইখতিয়ার তার কর্কশ কণ্ঠটা মোলায়েম করার চেষ্টা করলো,
—“কেমন আছো আদ্র সাহেব? টাকা পেয়ে তো ভুলেই গেলে। কল ধরছো না, না মেসেজ। পাশের এলাকার কলেজটাতে তো কাল থেকে ড্রাগস বেচার কথা। ভেবেছ কিছু এ বিষয়ে? তোমার ছেলেদের আসতে বলেছিলাম। ওরা তো এলো না।”

আদ্রর নির্লিপ্ত সুর, “আসবে। কাল ঠিক সময়ে পাঠিয়ে দেব আমি।”
ইখতিয়ার টেবিলে জোড়ে থাবা মারলো। হো হো করে হাসলো বিশ্রী কণ্ঠে। বললো,
—“এই না হলে নেতা।”

ইখতিয়ার থামলো। চারিদিকে তার কটু দৃষ্টি ফেলে দেখলো সবটা। ধীর গলায় বললো,
—“তা, কাল রাতে আমার ছেলেদের মারলে কেন? মারলে তো মারলে, একেবারে মেরেই ফেললে না কেন? এমনিতেও ওরা আর আমার কোনো কাজে লাগবে না। উটকো ঝামেলা কতগুলো!”

বলতে বলতে উৎসুক চোখে তাকালো সে। আদ্র সময় নিলো। টেবিল থেকে কফির মগ নিয়ে একটু করে চুমুক দিলো। কপালে ভাঁজ ফেলে সূক্ষ্ণ গলায় বললো,
—“স্বার্থ ছাড়া আমি কিছু করিনা মিস্টার ইখতিয়ার। নয়তো মেরেই ফেলতাম।”

ভ্রু কুঁচকে তাকালো ইখতিয়ার। জিজ্ঞেস করলো, “ওদেরকে মারার পেছনে তোমার কি স্বার্থ থাকতে পারে?”
—“আমার সঙ্গে একটা মেয়েকে প্রায়ই দেখতেন আপনি। আমার ক্ষতি করতে মেয়েটাকে মারার চেষ্টাও করেছিলেন। মারতে পারেন নি অবশ্য। সিনএনজির থাক্কায় মাঝরাস্তায় ফেলে দেওয়ার আদেশ দিয়েছিলেন। আমি শুধু তার থেকে একটু বেশি করেছি। হাত, পা ভেঙ্গে জন্মের গুন্ডামি করার সখ মিটিয়ে দিয়েছি মাত্র।”

কৌশলে স্বার্থের ব্যাপারটা এড়িয়ে গেল আদ্র। ইখতিয়ার খেয়াল করলো না। বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ সে। চোখ অত্যাধিক বড় বড়। থুতনি ঝুলিয়ে বিমূঢ় কণ্ঠে সে বললো,
—“তুমি জানতে?”
আদ্র হাসলো। দূর্বোধ্য হাসি। উত্তর দিলো না।

আদ্র এলো সন্ধ্যার দিকটায়। রুমে এসে বেলাকে দেখতে না পেয়ে বিরক্ত হলো সে। তৎক্ষণাৎ জোড়ে জোড়ে ডাকতে লাগলো তাকে। বেলা তখন রেখার রুমে ছিল। আদ্রর ছোটবেলার বিভিন্ন ঘটনা বলছিলেন তিনি। বেলা মন দিয়ে শুনছিল। হঠাৎ আদ্রর উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে ডাকার শব্দে হকচকালো সে। অপ্রস্তুত ভাবে তাকালো রেখার দিকে। রেখা মুচকি হাসলেন। ক্ষীণ লজ্জায় মিইয়ে গেল বেলা। তিনি বললেন, “যাও, ডাকছে তোমাকে। পরে রেগে যাবে নয়তো।”

এসির তাপমাত্রা কমিয়ে শার্টের বোতাম খুলছিল আদ্র। পিপাসায় কাতর তার গলদেশ, চক্ষুদ্বয়। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকানো। ঘামে লেপ্টে বাজে অবস্থা। তপ্ত নিশ্বাস ফেলে আদ্র আবারও ডেকে উঠলো বেলাকে। পরমুহুর্তেই দেখলো, ইতস্তত পায়ে রুমের ভেতর ঢুকছে বেলা। তার থেকে ভীষণ দূরত্ব রেখে দাঁড়ালো। মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
—“ডেকেছিলেন?”
আদ্র উত্তর দিলো না। পালটা প্রশ্ন করলো, “কোথায় ছিলে?”
—“মায়ের রুমে।”
—“আমি বাসায় আসলে একটু আশেপাশে থাকবে। ঠিকাছে?”

এবারও মাথা দুলায় বেলা। আদ্র চেয়ে রয়, নিষ্পলক। মেয়েটা অতিরিক্ত লজ্জা পায়। তার লজ্জাবউ। কথা ঠিক ভাবে বলতে পারে না। জড়তা কাজ করে। তার দিকে ঠিকভাবে তাকাতেও পারেনা। সর্বদা দৃষ্টি নামিয়ে রাখে। এই সাধারণ মেয়েটার মাঝে আছে কি আসলে? ক্ষণে ক্ষণে আদ্র খুব বাজেভাবে আটকে যাচ্ছে। বের হওয়ার সাধ্যি নেই। একবার তাকালে চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করে না। শক্ত করে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে রাখতে ইচ্ছে করে সর্বক্ষণ।
আদ্র সুদীর্ঘ নিশ্বাস ফেললো। বললো,
—“গোসল করতে যাচ্ছি। এসে যেন তোমাকে রুমে পাই।”
বেলা ছোট্ট করে উত্তর দিলো, “আচ্ছা”

বলে উঠে যেতে চাইলো সে। আদ্র যেতে দিলো না। হাত ধরলো জড়ালো ভাবে। কিছুক্ষণ আগের মতোই চেয়ে থেকে গাঢ় কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “তোমার কি আমাকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে না বেলা?”

বেলা কি বলবে ভেবে পায় না। হাসফাস করে। একরাশ ক্লেশে সিক্ত হয় গৌড় বর্ণের গালদু’টি। খুব করে বলতে চায়, “করবে না কেন? অবশ্যই করে।”
কিন্তু অকপটে সে বরাবরের মতোই নিশ্চুপ। আদ্র হাত ছেড়ে দেয়। উঠে দাঁড়ায়। বাথরুমে যেতে যেতে একরোখা কণ্ঠে বলে,
—“সমস্যা নেই। আমি শিখিয়ে দেব।”

_______________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা