#প্রিয়কাহন❤️
#লেখিকা ‘কায়ানাত আফরিন’
#পর্ব |১৯|
সেদিনের হলুদ বিকেলের পর কেটে গেলো আরও কয়েকটি বিকেল। তবে অভীর সেই কাছে আসা, কানের কাছে উত্যপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে তার প্রগাঢ় কন্ঠে ‘সরি’ বলা, এসবের কোনোকিছুই প্রিয়তা ভুলতে পারলো না। প্রিয়তা আত্নজেদী মেয়ে, সহজে কেউ তার মন কাড়তে পারেনা- তবে তুমুল অপছন্দের এই একগুঁয়ে অভী কিভাবে যেন তার মন কেড়ে নিলো। প্রিয়তার সাথেই অভীর প্রেমে পড়বে যারা ওর গল্প পড়ছে- তবুও এই ভালোলাগা থেকে বিচ্যুত হবে না। সেই ঘটনার পর অভীর সাথে সে কথা বলতে পারেলো লজ্জায়। হয়তো পারবেও না।
এখন মাসের শেষ সকাল। নিঃসন্দেহে সেটা সুন্দর। বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন সেমিস্টার ফাইনালের প্রবল চাপ। ক্লাসের পর ক্লাস করে হিমশিম খাচ্ছে সবাই। রুদ্র আর অদ্রি গল্প করছে হৈ হুল্লোড় করে, যেনো পরীক্ষার কোনো কিছুই তাদের মন মস্তিষ্কে নেই৷ তারা ব্যস্ত নিজেদের নিয়ে। প্রিয়তা চুপচাপ তাদের আলোচনা শুনে গেলো। তখন পেছন থেকে কেউ ডাক দিলো,
‘ এই পটেটো!’
চট করে ঘুরলো প্রিয়তা। চোখে সীমাহীন আক্রোশ। এই ক্যাম্পাসে একমাত্র একজনই আছে যে গলা হাঁকিয়ে তাকে পটেটো ডাকে। সে হলো অন্তু। রুদ্র ব্যাঙ্গ সুরে বললো,
‘ যা প্রিয়তা, দুলাভাইয়ের বন্ধু তোকে ডাকছে!’
ক্ষেপে গেলো অদ্রি। রেগেমেগে বললো,
‘ এই তোকে না বলেছি রুদ্র অভী ভাইয়াকে দুলাভাই ডাকতে না? ডাকলে অন্তু ভাইয়াকে ডাক। এরে পটাইতে পারলে শীঘ্রই অদ্রির বর হয়ে যাবে!’
‘ সে আশা বাদ দে বইন৷ অন্তু ভাইয়া জেনেশুনে কোনো ডাইনী কে বিয়ে করবো না।’
তারপরই শুরু হলো তুমুল যুদ্ধ বিগ্রহ। এদের রেখেই প্রিয়তা এগুলো অন্তুর দিকে। বিক্ষোভ সুরে বললো,
‘ আপনাকে না বলেছি এভাবে পটেটো ডাকবেন না?’
‘ তাহলে কি ডাকবো? ভাবি বলে ডাকবো নাকি?’
‘ মোটেও না…’
‘ তুমি বললেও ভাবি ডাকবো না। তোমার মত পিচ্চি আমার বন্ধুর বউ হবা তো কি হইসে, মান সম্মান উজাড় করে তোমার মতো বাচ্চা মেয়েকে আমি ভাবি ডাকতে পারবো না প্রিয়তা- আগেই বললাম। এতে অভী আমায় মারুক, কাটুক বা যা ইচ্ছে করুক!’
‘ কেন ডাকলেন সেটা তো বলেন?’
অন্তু ভাইয়া দুষ্টু হাসি দিলো এবার৷ চোখে মুখে বিরাজমান কৌতুহলতা। প্রিয়তার দিকে ঝুঁকলো সে। ভ্রু নাচিয়ে বললো,
‘ অভী আর তোমার মধ্যে প্রেম জমে ক্ষীর হয়ে গিয়েছে নাকি প্রিয়তা ভাবিইইই?’
গাল দুটো প্রিয়তার হয়ে উঠলো টকটকে লাল। পিছিয়ে গেলো। অন্তু হাসছে, বোধহয় ধরতে পেরেছে কোনো কিছু্। প্রিয়তা কি বলবে ভেবে পেলো না, কথা বলতে ভুলে গেলো। অন্তু আবার বললো,
‘ আমাদের ফাইনাল সেমিস্টার চলছে আর বেচারা ছেলেটার কি হলো কে জানে? আর আগের মতো বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয় না- হৈ হুল্লোড় করে না। নিজের ক্যাম্পাস ছেড়ে চুপচাপ এর আশেপাশে ঘুরঘুর করে, সন্ধ্যার সময় লোক লাগায় তার প্রেয়সীর পেছনে যাতে কোনো ঝামেলা না হয়- কাহিনি কি?’
কথাগুলো সত্যি। শতভাগ সত্যি। অভীর সাথে এখন কথা না হলেও হাজারো খুনসুটিময় অনুভূতি ব্যাক্ত হয়েছে ইশারায়। অভী যেন না বলেও বলেছে, ‘ প্রিয়তা তার দুর্বলতা!’। তাই ক্লাসের পর যখন বারান্দায় বা কমন রুমে দেখা হয় তখন সে চোখে অনুভূতি প্রকাশ করতে ভুলেনি। অদ্রির ভয়াবহ চোখের অগোচরে স্পর্শ করেছে বহুবার তার হাত। কখনও অনামিকা আঙুল চেপে ধরেছে। প্রিয়তা কেঁপে উঠেছে, তাকিয়েছে করুন দৃষ্টিতে কেউ দেখে ফেলবে এই ভেবে। কিন্ত অভী হেসেছে তখন- হেসেছে একটা প্রাণবন্ত হাসি।
‘ কোন দুনিয়ায় হারিয়ে গেলেন ম্যাডাম?’
প্রিয়তা সচকিত হলো এবার। জেগে ওঠা সেই অনুভূতিগুলো ধামাচাপা দিয়ে বলে উঠলো,
‘ এসব কিছুই না!’
‘ আমায় বললেন কি আর হবে? সারা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা জানে তোমাদের ক্যামিস্ট্রির খবর। জীবনেও তো হাত ধরে ঘুরো নাই, অভীর বাইকে ঘুরে বলাকা লেক, কাটা পাহাড়ের দিকে যাও নাই- তবুও সবাই জানে তোমাদের প্রেম জমে ক্ষীর। এর একটাই কারন, অগোচরে তোমরা সেই বাবা আদম যুগের ইশারায় ইশারায় কথা বলো, দু’তিনজন হলেও তা দেখে গুষ্ঠিসুদ্ধ প্রচার করেছে।’
প্রিয়তা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। এমনটা হবে এটা জানাই ছিলো। দিন দিন অভীকে কেমন যেন মনে হচ্ছে তার। ছন্নছাড়া – বাউণ্ডুলে ধরনের। অন্তু ফোড়ন কাটলো পুনরায়। বললো,
‘ যাই হোক এখন ওর থেকে একটু নিরাপদ দুরত্বই রেখো৷ লাস্ট সেমিস্টার চলছে, এটার ওপর চাকরি জীবনের অনেক কিছু নির্ভর করবে। এখন মহাশয় যদি ছায়াছবির সদ্য প্রেমে পড়া প্রেমিক পুরুষের মতো আচরণ করে সেটা নিশ্চয়ই ভালো হবে না৷ আই হোপ বুঝতেই পারছো। এখন ক্লাস আছে?’
‘ না, লাইব্রেরিতে যাবো। ‘
‘ তাহলে যাও৷ টেক কেয়ার!’
সানগ্লাস পড়ে সিটি বাজাতে বাজাতে চলে গেলো অন্তু। অদ্রি এগিয়ে এসে বললো,
‘ এত কি কথা তোর অন্তু ভাইয়ার সাথে?’
‘ তেমন কিছু না। ‘
‘ শোন, যদি অভী ভাইয়ার ম্যাটার হয় -আগাবি না। ব্যাটায় কি মনে করে তোকে? সেদিন কড়া বিহেভ করলো, ভার্সিটিতে ইগ্নোর করলো – আর বেছে বেছে রোম্যান্টিক বিকেলে তোকে পেয়ে সরি বললো। এক সরিতেই সব মাফ? শোন প্রিয়ু, তুই আমার বোন- তোরে জীবনেও আমি অপাত্রে ফেলবো না৷ যদি অভী ভাইয়া আবার তোকে ডিস্ট্রার্ব করে আমায় বলবি, ঝাঁসি কি রাণীর মতো বাতাসে ভেসে আসা দুলাভাইয়ের আমি টেংরি ভেঙে ফেলবো।’
প্রিয়তা ঠোঁট টিপে হাসলো কিছুক্ষণ। মেয়েটা এখনও জানেনা তাদের অব্যক্ত প্রণয়ের কথা। জানবে কিভাবে, সেটা তো এখনও অপ্রকাশিত। কিশোরী বয়সের নতুন সব গল্পের মতো তাদের গল্প। এই বয়সেও প্রিয়তার উড়তে মন চায় ভীষণ, বসন্তের হাওয়ার মতো ভেসে বেড়াতে মন চায়৷ অথচ ঝাঁসি কি রাণী অদ্রি তার এক অংশও জানে না। প্রিয়তা তাড়া দিলো। বললো,
‘ লাইব্রেরিতে চল!’
_____________
উপচে পড়া বইয়ের ভীড়ে প্রিয়তার চোখ সীমাবদ্ধ৷ নোটগুলো এক বসায় তৈরি করা যাবে না দেখেই মনটা ভীষণ খারাপ। মাথার ওপর ঘরের বিরাট সরকারি ফ্যানটি ঘুরছে। ঘট ঘট শব্দ করছে সেটা৷ নিয়মানুযয়ী সবাই পালন করছে পিনপতন নীরবতা।
প্রিয়তা হাতঘড়ির দিকে তাকালো। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। অদ্রি সেই কখন থেকে বসে আছে বেরোবে বলে। ওর অন্তরও ভীষণ অতিষ্ঠ। প্রিয়তা উঠা মাত্রই মেয়েটা হাফ ছেড়ে বাঁচলো। বইগুলো যথাস্থানে রেখে বেরোলো লাইব্রেরি থেকে।
আকাশে মেঘ জমেছে। তবে বৃষ্টি হবে না। এই মেঘ বাতাসে ভেসে চট্টগ্রাম থেকে দূরে কোথাও নিয়ে যাবে, তারপর নামবে ঝুমঝুমিয়ে বৃষ্টি। অদ্রি হতাশ হয়ে বললো,
‘ প্রিয়ু রুদ্র তো কল রিসিভ করছে না!’
‘ ব্যাপার না। ও বাচ্চা না যে কোলে তুলে বাড়িতে নিয়ে যেতে হবে। নিশ্চয়ই কোনো মেয়ের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ‘
নিজেদের মাঝে আলাপ চালাচ্ছিলো প্রিয়তা। তখনই পাশ থেকে হৈ হৈ করে চার-পাঁচজন সুর বেঁধে বলে উঠলো,
‘ আরে ভাবি!’
কিছুক্ষণের জন্য হার্টবিট বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো প্রিয়তার৷ পাশে ফিরে খানিকটা স্তব্ধ হলো। অভীর পুরো বন্ধুৃহলই এখানে আছে। দু তিনজনের সিগারেটের ধোঁয়ায় ঘোলাটে হয়ে গিয়েছে পরিবেশ। ক্যাম্পাসে সিগারেট খাওয়া মোটেও কোনো শোভনীয় আচরণ না। কিন্ত এদের এ কথা বলার দুঃসাহস কেউই করতে পারবে না। প্রিয়তা অপ্রস্তুত হয়ে তাকালো অভীর দিকে। চোখাচোখি হলো। অভীর নিরুত্তর চোখের গভীর দৃষ্টি সেই দিকে। ঠোঁটে স্মিত হাসি লুকায়িত। একজন বলে উঠলো,
‘ কি অবস্থা ভাবি?’
‘ আ-আলহামদুলিল্লাহ ভালো!’
প্রিয়তার অপ্রস্তুত প্রতিউত্তর। আর একজন বলে উঠলো,
‘ চা খাবেন ভাবি? বসেন, মোটেও লজ্জা পাবেন না। এই! তোরা সব সিগারেট নিভা! ভাবি আনকম্ফোর্টেবল হবে।’
ভাবি ভাবি শুনে প্রিয়তার লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে। প্রিয়তা নিশ্চিত এ সবই অভীর কারসাজি। ওর ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্টরা কিভাবে ওর দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। প্রিয়তা তড়িঘড়ি করে বললো,
‘ দরকার নেই ভাইয়া! আমার তাড়া আছে। বাসায় যাবো।’
অভী উঠলো ওদের কেন্দ্র বিন্দু থেকে। বললো,
‘ চলো আমার সাথে।’
প্রিয়তা আরও একদফা অবাক হলো। দেখলো মুখ টিপে হাসছে অভীর বন্ধুরা। স্পষ্ট ইঙ্গিত যে সে চায়না প্রিয়তা এখানে বসুক, আড্ডা দিক- বন্ধুদের কোনো দুষ্টু কথায় অস্বস্তিতে পড়ুক। কেউ জোর করলো না তাই। অদ্রি এতক্ষণ চুপ থাকলেও বাঁধা দিলো এখন। অভীকে রাগী কন্ঠে বললো,
‘ কোথায় যাচ্ছেন?’
অভী ভ্রু কুচকালো। বুঝলো ঘাড়ত্যাড়া শালীসাহেবার রাগ এখনও ভাঙানো হয়নি। তাই বললো,
‘ সেটা তোমায় বলার প্রয়োজন তো দেখছিনা অদ্রি?’
‘ প্রয়োজন আছে। আমার বোনকে আপনি চোখের সামনে নিয়ে যাবেন আর আমি কিছু বলবো না? ভুলে যাবেন না – আমি আপনাকে হবু দুলাভাই থেকে বহিষ্কার করেছি।’
অভী গা জ্বালানো হাসি দিয়ে বললো,
‘ তুমি বহিষ্কার করলেই তো আমি প্রিয়তার হবু বর থেকে বহিষ্কার হয়ে যাবো না।’
তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো অদ্রি। দু’চারটা কড়া কথা বলাতে অভী চোখ পাকিয়ে তাকাতেই ভয়ে কাবু হয়ে গেলো। অভী গম্ভীর কন্ঠে বললো,
‘ বললাম না। আমার কথা আছে প্রিয়তার সাথে। পথে বাঁধা হবে না। ধাক্কা মেরে বারান্দা থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিবো।’
এতটুকুতেই মুখ কাগজের মতো ফ্যাকাসে হয়ে গেলো অদ্রির। কি এমন গোপন কথা বলবে জানার জন্য তর না সইলেও চুপচাপ সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলো। অভী তাকালো আশপাশে। দেখলো মানুষের তেমন ধ্যান নেই। অতঃপর হাত ধরে প্রিয়তাকে বারান্দার একেবারে শেষ মাথায় রুমটির দিকে নিয়ে গলো। খালি ক্লাস, বাতাসে বদ্ধ গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। প্রিয়তার হাত পা জমে গেলো। আস্তে করে সরে যাওয়ার চেষ্টা করতেই দুহাত দিয়ে তাকে দেয়ালে আটকে ফেললো অভী।
প্রিয়তা স্তব্ধ হলো।নিঃশ্বাস হয়ে এলো ঘন। অভী মাথা নামিয়ে তার দিকে ঝুঁকেছে। আধো আলোয় স্পষ্ট প্রতীয়মান তার ঘোরমিশ্রিত অবয়ব। প্রিয়তা তাকাতে পারলো না। তাকালেই বুক ধুকধুক করবে। কোনোমতে বললো,
‘ ছাড়ুন আমায়।’
প্রিয়তা অভীর হাত চেপে সরে যাওয়ার চেষ্টা করতেই বন্ধন আরও দৃঢ় হলো। অভী হাসলো ওর বোকামো দেখে। দুষ্টু হেসে বললো,
‘ এবার? পারলে ছাড়িয়ে নাও নিজেকে আমার কাছ থেকে?’
.
.
.
.
#চলবে
ভুলক্রুটি মার্জনীয়।