প্রীতিলতা পর্ব-১১

0
388

#প্রীতিলতা ❤️

#লেখিকা:- Nowshin Nishi Chowdhury

#১১তম_পর্ব🍂

আমার সামনে সোফায় পায়ের উপর পা তুলে আমার মুখোমুখি বসে আছে সেই অদ্ভুত মেয়েটি। নজরটা এখনো আমাতেই নিবন্ধ। মাঝে মাঝে আবার আড়চোখে সাফওয়ানকে দেখছে সে।

ওর দৃষ্টির অর্থ বুঝতে পারছি না আমি। আমাকে এভাবে দেখার কি আছে। তার সাথে আমার প্রথম বার দেখা হচ্ছে। কিন্তু তার দৃষ্টি দেখে মনে হচ্ছে সে আমার উপর খুব রাগান্বিত।

আমিও ওকে পর্যবেক্ষণ করলাম। পরনে জিন্স আর উপরে ব্লু কালারের কুর্তি। নাম মাত্র একটা ওড়না স্কাপ এর মত গলায় জড়িয়ে রেখেছে। চুলগুলো লেয়ার কাট করা। পাশ্চাত্যের ছোঁয়া তার সর্বাঙ্গে।

আমার ভাবনার ভেতরে একটা সুমিষ্ট সালামের ধ্বনি কানে এসে লাগল। ধ্যান ভাঙতে সামনে তাকিয়ে দেখলাম মেয়েটি হাসছে। আমিও প্রতিদানে মুচকি হাসলাম। তারপর আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

— হাই আমি সাইমা।এন্ড ইউ?

ভাবিকে দেখলাম তাড়াতাড়ি গিয়ে সাইমার পাশে দাঁড়ালো। আমার দিকে তাকিয়ে ইতস্তত ভাবে হালকা হেসে সাইমাকে বলল,

— সাইমা ও তোমার ভাবি হয়। ভাবি বলে সম্বোধন কর।

সাইমা অবাক হওয়ার ভঙ্গিমা করলো। তারপর বলল,

— উপস্ সরি আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম। তা কেমন আছো ভাআআআবি।

তার বলার ধরন শুনে আমি ভ্রু কুচকে তার দিকে তাকালাম। মানছি ননদ ভাবির সম্পর্ক একটু কৌতুক পূর্ণ হয়। কিন্তু আমি তার কন্ঠে স্পষ্ট তাচ্ছিল্যের আভাস পেয়েছি। ভাবির দিকে তাকালাম ভাবির মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে। থমথমে চেহারা। সায়মার দিকে তাকিয়ে বললাম

— জি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?

সাইমাকে দেখলাম সাফয়ানের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল,

— ভালো, ইনফ্যাক্ট খুব ভালো।

আমিও তার দৃষ্টি অনুসরণ করে সাফওয়ানের দিকে তাকালাম। দেখলাম তিনি নজর সরিয়ে ভাইয়ার সাথে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

সাইমা সোফা থেকে কিছুটা সরে গিয়ে সামনে ঝুঁকে সাফওয়ান কে জিজ্ঞাসা করল,

— কেমন আছো সাফওয়ান?

আমি চমকে উঠলাম। এত দরদ মাখানো সম্বোধন…! ওকে কেন করলো? বুকের মধ্যে কেমন চিন চিন ব্যথা করে উঠলো। খারাপ লাগলেও বাহ্যিক দিক থেকে নিজেকে স্বাভাবিক রেখে আমি সাইমা কে বললাম,

— যতদূর বুঝতে পারছি সাফওয়ান তোমার বয়সে বড়। তার উপর সম্পর্কে তোমার ভাই হয় তাই অবশ্যই তোমাকে ভাইয়া সম্বোধন করা উচিত তাই না সাইমা…!

সাইমা আমার দিকে কেমন ঝলসানো দৃষ্টিতে তাকালো। আমাকে সায়মার দিকে এক নজরে তাকিয়ে থাকতে দেখে সাফওয়ান বলে উঠলেন,

— কল মি ভাইয়া। তোমাকে কতবার বলেছি সাইমা। সোজা কথা সোজাভাবে বুঝতে পারো না তুমি তাই না।

সাইমা গাল বাঁকিয়ে হেসে সোফায় হেলান দিয়ে বলল ,

— হ্যাঁ তুমি তো আমার ভাই লাগো। তা কবে থেকে বলতে পারো। আমি ত….

ভাবি সাইমাকে কথার মাঝে থামিয়ে দিলেন। আমার দিকে আড় চোখে তাকিয়ে বললেন।

— এটা কোন ধরনের মশকরা সাইমা। মানছি সাফওয়ান অনেকদিন পরে এসেছে এই বাড়িতে। ভাই ওর পিছনে লাগছো। কিন্তু এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। তুমি তো কাজ করছিল উপরে, তা নিচে আসলে কেন? কোন দরকার ছিল।

সাইমা ভাবীর দিকে তাকিয়ে বলল,

— কফির জন্য এসেছিলাম। নিচে নেমে দেখি আমাদের অনারেবল গেস্টরা এসে গেছে। তাই তাদের সাথে একটু দেখা করতে এলাম। কতদিন পরে আমাদের দেখা হচ্ছে তাই না সো কল্ড ভাইয়া।

ভাবি একপ্রকার সাইমাকে জোর করে দাঁড় করিয়ে বলল,

— তুমি ওপরে যাও আমি তোমার জন্য কফি পাঠিয়ে দিচ্ছি।

— নো থ্যাংকস। কফির নেশা চলে গেছে আমার।

— যাও তুমি ওপরে যাও আমি কফি পাঠিয়ে দিচ্ছি। খেয়ে রেস্ট নাও সারাদিন তো কম্পিউটারের সামনে বসে থাকো। যাও গো।

একপ্রকার খেলে সাইমাকে ওপরে পাঠিয়ে দিল ভাবি। ভাবি কেমন জড়তার মধ্যে আমতা আমতা করে বললেন,

— কিছু মনে করো না প্রীতি। ও একটু ওরকমই। আসলে ফরেন কান্ট্রিতে থাকে তো। আমাদের লাইফ স্টাইল ওঠাবসা কথাবাত্রা সাথে ওর বিস্তার ফারাক আছে।

কথাগুলো বলে এক প্রকার আমার সামনে থেকে কেটে পড়লেন ভাবি।

ড্রয়িং রুমের পরিবেশটা কেমন থমথমে হয়ে গেছে। সাইমার বলা প্রত্যেকটা কথা আমার কানে বাজছে। মেয়েটার প্রতিটা কথা রহস্য পরিপূর্ণ। ভাবি ও কেমন ব্যাপারটা যেন ধামাচাপা দিতে ব্যস্ত। তাহলে কি সাইমা এবং সাফনের মধ্যে কোন অন্য রকম সম্পর্ক ছিল। যেটা তারা আমাকে জানাতে চাইছে না। সেটা কি কোন গভীর সম্পর্ক। না না এমন কিছু থাকলে তো আমাদের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল না।

বিয়ের আগে মানুষের পছন্দ থাকতেই পারে। সাফওয়ানের থাকলেও সেটা তো এখন অতীত। ওর বর্তমান তো শুধু আমি। সাফওয়ান বলেছিল আমাকে ।

আর সাফওয়ান ও তো ওকে ধমকে বলল ভাইয়া ডাকার জন্য। তারমানে সাফওয়ানের মনে সায়মার জন্য কিছুই নেই। হ্যাঁ নেই ।কিছু নেই ওর মনে।

অনেক কষ্টে নিজেকে অনেক কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছি কিন্তু তারপরও বারবার মনের ভিতরে একটা ভয় মাথা ছাড়া দিয়ে উঠছে। কলিজাটা খামছে ধরছে একটা বিষয়। সাফওয়ানকে আমার থেকে কেড়ে নেবে না তো। না না সম্পর্কেও আমার স্বামী হয়। ওর সাথে বৈবাহিক সম্পর্কে আছি আমি। স্ত্রীর কাছ থেকে তার স্বামীকে কেড়ে নেওয়া এত সহজ ব্যাপার নয় । সাফওয়ান শুধু আমার। কাউকে দেবো না আমি ওকে।

অস্থিরতায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল আমার। পাশে তাকিয়ে দেখি। সাফওয়ান এখনো ভাইয়ের সাথে কথা বলছে। হাতটা সুপার হ্যান্ডেলের উপরে রাখা। ইচ্ছা করছিল খুব জোরে করে আঁকড়ে ধরি তাই হাতটা। কিন্তু পরিবেশ পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে নিজেকে সংবরণ করলাম।

উঠে দাঁড়ালাম। এখানে বসে থাকতে যেন আরও অস্বস্তি লাগছে।

এরমধ্যে ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করলো একটি ছেলে। উচ্চতায় সাফওয়ান এর মত হবে। গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণ। ফরমাল ড্রেস আপ। এক হাতে এপ্রোন ঝুলছে। ভারী কণ্ঠস্বরে আমি তার দিকে তাকিয়ে পরলাম।

— হেই ব্রো হোয়াটস আপ?

সাফওয়ানকে দেখলাম উঠে গিয়ে তৎক্ষণাৎ জড়িয়ে ধরল। ছেলেটির পিঠ চাপড়ে বললো,

— গ্রেট তোর কি খবর বল।

আমার আর কি খবর সকালে উঠে রোগীর মুখ দেখে আমার দিন শুরু হয় রাতটাও রোগীর মুখ দেখে এসে শেষ হয়। জীবনটা পুরো রোগী ময় হয়ে গেছে আমার।

কেন জানিনা এত অস্থিরতার মধ্যেও তার কথা শুনে আমার হাসি পেল। ছেলেটার দিকে এবার ভালো করে দেখালাম আমি। মুখটা একটু লম্বাটে কিন্তু অবয়বটা অসম্ভব সুন্দর। যা তার গায়ের রং কে হার মানিয়েছে। হাসতে হাসতে হঠাৎ তার নজর আমার দিকে পরল। সে এক নজরে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। তা দেখে আমি তাড়াতাড়ি নজর সরিয়ে নিলাম।

সাফওয়ানকে ছেড়ে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,

— কেমন আছেন আপনি?

আমি তার দিকে নজর তুলে তাকালাম। হালকা হেসে বললাম,

— জি আলহামদুলিল্লাহ ভালো।

আবারো মুচকি হেসে বললেন,

আমি আপনার দেওর হই। আপনার বর আমার ভাই প্লাস বেস্ট ফ্রেন্ড হয়। আপনিও কিন্তু আমার ফ্রেন্ড হতে পারেন। কি হবে নাকি ফ্রেন্ড।

আমি অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম। প্রথম দেখায় এমন আবদার কেউ করে নাকি। আমি কোন রকমে তার দিকে তাকিয়ে হেসে বললাম,

—- আচ্ছা ঠিক আছে। আপনারা বসে গল্প করুন আমি একটু পুতুলকে দেখে আসি।

আমার থেকে পেছনের সরে গিয়ে হাত দিয়ে ইশারা করে বলল,

ইহাহ সিওর ।

আমি তাড়াতাড়ি চলে আসলাম সেখান থেকে। পেছনে তাকালে হয়তো কারোর গাড়দৃষ্টির সাক্ষী হতাম।

__________🌺🌺_________

হাঁটতে শুরু করলাম। এসে ধরে পুতুলটা সেই উপরে চলে গেছে তার আর কোন পাত্তাই নেই। তাই পুতুলকে খুঁজতে খুঁজতে দোতলায় উঠে চলে আসলাম। দোতালার দরজা দিয়ে ঢুকতেই দেখলাম একটি করিডোর। বাহ বেশ লম্বা করিডোর একটা। যা প্রত্যেকটা রুমের সামনের বারান্দা কে একসাথে যুক্ত করে তৈরি করা হয়েছে।

গ্রিল ধরে আস্তে আস্তে হাঁটতে লাগলাম। বাইরে তাকিয়ে দেখলাম পরিবেশটাও অত্যন্ত মনোরম। যান্ত্রিক শহরের মধ্যেও যে এমন একটা জায়গা আছে সত্যি আমার কল্পনায় ছিল না।

করিডোরটা বাড়ির পেছনের সাইডে হওয়া দরুন গ্রিল দিয়ে একটা মাঠ দেখা যাচ্ছে। সম্ভবত এটা স্কুল মাঠ। কারণ রাতের বেলায় দুপাশে দুটো বাল্ব জ্বালিয়ে লম্বা করে জাল টানিয়ে নিয়ে রেকেট খেলার প্রস্তুতি নিচ্ছে একগুচ্ছ ছেলে।

আমারও ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে গেল। ছোটবেলায় আমরাও এমন হালকা হালকা শীতের আমি যে রেকেট নিয়ে দৌড়াতাম মাঠে। সন্ধ্যার পরে যেহেতু বাইরে থাকা সম্পূর্ণ নিষেধ ছিল তাই বিকেল বেলায় পুরো মাঠ দাপিয়ে বাড়ানো হতো এর রেকেট নিয়ে। তা নিয়েও মায়ের সে কত বকাবকি। আমি আপন মনে হেসে উঠলাম।

সে দিক থেকে নজর ঘুরিয়ে সামনে এগোতেই দেখলাম একজন ভদ্রমহিলা আমার থেকে কিছুটা দূরত্বে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।

আমি কিছুটা ভরকে গেলাম। এতক্ষণ মনোযোগ সহকারে বাইরে তাকিয়ে ছিলাম বলে উনার উপস্থিতি আমি টের পাইনি। আমি প্রথম এসেছি এই বাড়িতে। কাউকে চিনি না। আমাকে কি বলে সম্বোধন করব বুঝতে পারছি না।

আমি তাকাতে তিনি আমার দিকে তাকিয়ে তিনি মুচকি একটি হাসি দিলেন। তার বিনিময় আমিও হাসলাম। আমার কাছে এগিয়ে এসে আমার মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন। তারপর একটা মিষ্টি কণ্ঠস্বর বললেন,

— আমার সাফু বাবুর বউ তুমি তাই।

আহা কেমন আদুরে সম্মোধন। আমি মুচকি হেসে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালাম। তারপর তিনি আমাকে কাছে টেনে কপালে চুম্বন দিয়ে বললেন,

— আমি সাফওয়ানের ছোট খালামণি হই। সাথে তোমারও। আমার সাথে এসো।

বলে আমার হাত ধরে করিডোরের মাথায় একটা রুমে নিয়ে গেলেন। রুমে ঢুকেই কেমন একটা শান্তি অনুভব করলাম। ছিমছম সুন্দর বড় একটি শয়ন কক্ষ। আসবাবপত্র দেখে মনে হচ্ছে তিনি যথেষ্ট সৌখিন রুচিসম্পন্ন মানুষ। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের বাইরে একটি অপ্রয়োজনীয় জিনিস দেখলাম না তার ঘরে।

আমাকে তার বিছানায় বসিয়ে বললেন,

— একটু অপেক্ষা করো মামনি আমি আসছি।

আমিও সম্মতি জানালাম। তিনি উঠে গেলেন ডবল পার্টের আলমারির কাছে। কিছুক্ষণ পরে আলমারি থেকে একটি কাঠের বাক্স বের করলেন। আলমারিটা ভালো করে লক করে কাঠের বাক্সটা নিয়ে এসে আমার সামনে বিছানায় বসলেন।

আমি খালামণিকে উদ্দেশ্যে বললাম,

— কি আছে এতে খালামণী‌?
খালামণি বেশ রহস্য করে বললেন,

— তোমার বরের গুপ্তধন।

চলবে….!