প্রীতিলতা পর্ব-১৬

0
448

#প্রীতিলতা ❤️

#লেখিকা:- Nowshin Nishi Chowdhury

#১৬_তম_পর্ব🍂

সূর্যের অকৃত্রিম মিষ্টি রোদের ছটা মুখের উপর লাগতেই ঘুম ভেঙ্গে গেল আমার। চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে মুখে হাত দিয়ে একটা লম্বা হাই তুললাম। অভ্যাসবশত ঘাড় ঘুরিয়ে সাফওয়ানের দিকে তাকালাম। কিন্তু না আজ আর সাফওয়ানের বুকের মধ্যেখানে শুয়ে নেই আমি।

পাশে পুতুল চাদর জড়িয়ে শুয়ে আছে। কপালের ওপরে ছড়িয়ে আছে একগুচ্ছ বেবি হেয়ার। কি নিষ্পাপ লাগছে পুতুলকে। পুতুলের দিকে কিছুটা এগিয়ে এগিয়ে চুলগুলো কপালের উপর থেকে সরিয়ে একটা চুমু এঁকে দিলাম।

হঠাৎ মনের মধ্যে একটা ব্যাপার চারা দিয়ে উঠলো। আমার আর সাফওয়ানের এর মধ্যকার সবকিছু ঠিক থাকলে হয়তো আজকের সকালটা অন্যরকম হতো। ভেতর থেকে আপনি ইচ্ছে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।

না আমি আর ওসব নিয়ে ভাববো না। সবার ভাগ্য সমান হয় না। এই পৃথিবীতে খুব কম ভাগ্যবান মানুষ আছে যে তার ভালোবাসার মানুষকে আপন করে পেয়েছে। তাই বলে তারা মরে যায়নি বরং নতুন ভাবে বাঁচার অনুপ্রেরণা পেয়েছে। আমিও বাঁচবো এবার নতুন করে নিজের জন্য বাঁচবো।

বিছানায় বসে চুলগুলো হাত খোঁপা করে নিলাম। জোরে একটা শ্বাস নিয়ে দু হাতে তালুই মুখ ঘষে। চাদর সরিয়ে বিছানা থেকে উঠতে গিয়ে খেয়াল আসলো। আমার গায়ে আলাদা একটা চাদর জড়ানো। কিন্তু আমার যতদূর মনে আছে রাত্রে আমি তো সোজা এসে পুতুলকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়েছিলাম চাদর কে দিল। সাফওয়ান…!

নিজেকে নিজে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি উপহার দিলাম।

— হাহ্। তোর এখনো মনে হয় সাফওয়ান তোর গায়ে চাদর টেনে দেবে। পায়ের কাছে ছিল হয়তো ঠান্ডা লেগেছে নিজ হাতেই টেনে নিয়েছি।

বিছানা থেকে নেমে চাদরটা ভাজ করে রেখে ওয়াশরুমে চলে গেলাম ফ্রেশ হতে। কিছুক্ষণ পর ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসে ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে চিরুনি নিয়ে চুলগুলো আঁচলে একটা পাঞ্চ ক্লিপ লাগিয়ে নিচে চলে আসলাম।

নিচে নেমে এসে দেখি খালা ঝাড়ু দিচ্ছেন। আমাকে দেখে গাল ভরা একটা হাসি দিলেন।

আমি কিছুটা এগিয়ে গিয়ে ডাইনিং এর চেয়ারে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে তাকে বললাম,

— আজ ঘুম থেকে উঠতে অনেক দেরি হয়ে গেল খালা।

— কাল অনেক রাইতে বাসায় আইসো তাই না। তোমরা আইসিলা আমি টেরডাও পাই নাই। কি মরনের ঘুম দিছিলাম।

আমি মুচকি হেসে বললাম,

— তাতে কি হইছে। এই দেখো সকালে তো সবার আগে তুমি ওঠো সবকিছু গুছিয়ে রাখো। তোমার উচিত সবার আগে ঘুমাতে যাওয়া।

ঝাড়ু দেওয়া শেষ হয়ে গেছে খালার। হাত ধুয়ে আমার কাছে এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

— তোর মন খুব ভালা। আল্লাহর কাছে দোয়া করি তোর খুব ভালো হোক।

আমি নিঃশব্দে হাসলাম।

একি তোর মুখ এমন শুকনো দেখাচ্ছে কেন? জ্বর-টর বাধালি নাকি আবার।

— আরে না খালা এমনি।

— এমনি মানে? মুখটা শুকায়ে একেবারে ধুলো হয়ে গেছে। কিরে জামাই এর সাথে ঝগড়া লাগাইছস।

আমি চমকে উঠলাম। খালা কিছু শুনে ফেলিনি তো। ভয়ে আমতা আমতা করে কিছু বলতে যাব তার মধ্যেই খালা বলে উঠলেন আমি মজা করছিলাম।।

আমি সব গুছাইয়া রাখছি নতুন বউ। তুমি খালি আইসা রান্নাবাড়া শুরু কইরা দাও।

কথাটা বলে খালা রান্নাঘরের দিকে চলে যাচ্ছিল। আমি তাকে থামিয়ে বললাম,

— খালা। বলছি কী। আজ আমি একটু আমার বাসায় যাব।

খালা ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকালেন। তারপরে সন্দেহের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,

— আমি কি তাইলে আন্দাজে ঠিক জায়গায় ঢিল টা মারলাম।

আমি হালকা হেসে বললাম,

— না খালা। আজ আমার ছোট ভাইয়ের জন্মদিন। প্রতিবছর তো বাড়িতেই থাকি। এবারই শুধু বাড়ির বাইরে। জানি ভাইটা মন খারাপ করে বসে আছে। তাই ভাবছিলাম সকালেই চলে যাব ওই বাড়িতে।

খালা দ্রুত পায়ে আমার দিকে এগিয়ে এসে বললেন,

— তুমি এটা আমারে আগে বলবা না। তাহলে আমি আগে আগে রান্নাটা বসাই দিতাম। সকাল সকাল বেরোবে এখনই তো সাড়ে সাতটা বেজে গেছে।

এত ব্যস্ত হওয়ার দরকার নেই। দশটা সাড়ে দশটার দিকে যাব। ততক্ষণ এদিকে রান্নাবান্না সব হয়ে যাবে।

আচ্ছা ঠিক আছে তোমাকে আর বেশি কিছু করা লাগবে না তুমি বরং তোমার ভাইয়ের জন্য পায়েসটা তৈরি করো। আর আমাকে বলে বলে দিও আমি সেই ভাবে রান্নাবান্না করে নেব।

এছাড়া দুপুরে আর খাবা না বাসায় তোমরা সকালের নাস্তাটাই বানাই তোমাদের জন্য।

আমি খালাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম আমি আর পুতুল যাব। তোমার ছোট বাবা বাড়িতেই থাকবে। আর কাল শুনলাম ভাবি আর ভাইয়াও চলে আসবে আজকে।

এজন্য সবার জন্যই রান্না করব। তাড়াতাড়ি চলো। না হলে আমার দেরী হয়ে যাবে।

______🌺🌺________

রান্নাবান্না শেষ করতে করতে প্রায় সাড়ে নয়টা বেজে গেল। এই হালকা শীতের মধ্যেও ঘেমে শরীর ভিজে গেছে আমার। আমি দ্রুত পুতুলের রুমে গেলাম। গিয়ে দেখে মেয়েটা ফ্রেশ হয়ে টেবিলে বসে কি যেন করছে। আমি গিয়ে দেখলাম কোচিংয়ের পড়াগুলো লিখছে।

আমি ওকে টেনে তুলে বললাম,

— আজ আপনাকে আর কোচিংয়ে যেতে হবে না ম্যাডাম। সাথে আমি কথা বলে নিয়েছি, আজকে তুমি আমার সাথে বাইরে যাচ্ছ।

— কোথায় প্রীতিলতা?

— আমার বাড়িতে। কেশবপুর। আজ তোমার প্রীতম ভাইয়ের জন্মদিন। সে স্পেশালি তোমাকে যেতে বলেছে।

— ইয়েহ…! আমি যাব। কিন্তু আমি তো কোন গিফট কিনিনি ভাই এর জন্য।

— তুমি নিজেই তো একটা গিফট।চল চল তাড়াতাড়ি গোসল করে নাও। আমিও গোসল করে আসছি। তারপর পরে নাস্তা করে বেরিয়ে পড়বো আমরা। ঠিক আছে…!

— ওক্কে।

বলেও ওয়াশরুমে চলে গেল গোসল করার জন্য। আর আর আমি এদিকে ওর জন্য পোশাক বিছানার উপরে বের করে রেখে রুমে চলে আসলাম।

রুমে এসে দেখি বিছানায় উবু হয় শুয়ে আছে সাফওয়ান। তাকে দেখার সাথে সাথে কাল রাতের ঘটনাগুলো মনে পড়ে গেল। নজর অন্যদিকে ঘুরিয়ে আলমারি থেকে নিজের জামা কাপড় গুলো বের করে বাথরুমে চলে গেলাম।

১৫ মিনিট পরে গোসল করে বের হয়ে আসলাম আমি। পরনে লং হাই নেকের ফুল হাতার সুতির ফ্রক। ভালোভাবে চুল মুছে তোয়ালেটা বারান্দায় শুকিয়ে দিয়ে এসে পুতুলের রুমের চলে আসলাম।

— পুতুল তোর হলো….! আরে বাহ এ আমি কাকে দেখছি তো পুরোপুরি পরী লাগছে।

— তোমাকেও তো পুরোপুরি পরী লাগে। দেখে মনেই হয় না যে তোমার বিয়ে হয়েছে।

আমি বারান্দায় ওর রেখে দেওয়ার তোয়ালে টা মেরে দিচ্ছিলাম। ওর কথা শুনে অবাক হয়ে পেছনে তাকিয়ে পুতুলকে বললাম,

— এই বুড়ি এত পাকা পাকা কথা কোথা থেকে শিখলি রে তুই?

পুতুল খাটের উপর আরাম করে বসে বলল,

— কেন স্কুলের ওই আন্টিগুলো তো সেদিন বলল।

— কি বলল?

—আমার কাছে জিজ্ঞাসা করছিল তোমার সাথে যে মেয়েটি আসে সে তোমার কেমন বোন হয়?

আমি বলেছি আমার ভাবি হয়। ওকে আমি আদর করে প্রীতিলতা বলে ডাকি। প্রথমে বিশ্বাস করিনি জানো পরে আমাকে বলল দেখে তো মনেই হয় না যে ওই মেয়ের বিয়ে হয়েছে।

আমি হেসে ওর মাথার ক্লিপটা করে লাগিয়ে দিয়ে বললাম ,

— ভালো কাজ করেছিস আমার পরিচয়টা দিয়ে দিয়েছিস। নে এখন তাড়াতাড়ি চল আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে।

ওয়েট ওয়েট বলে দৌড়ে ওর পড়ার টেবিলের কাছে চলে গেল। হাতে করে দুটো ডেইরি মিল্ক সিল্ক আর একটা কালার বক্স নিয়ে এসে বলল,

— এগুলো আমি প্রীতম ভাইয়াকে গিফট করবো।

আমি হেসে বললাম

— তুই পারিসও।এত বুদ্ধি নিয়ে রাতে ঘুমাস কি করে রে তুই।

হেসে উত্তর দিল,

— বালিশের নিচে রেখে।

_________🌺🌺__________

পুতুল আর আমি তাড়াতাড়ি নাস্তা শেষ করে নিলাম। ব্যাগে করে দুটো জামা ও নিয়েছি। পারলে একটা দিন থেকে আসব। ব্যাগটা নিতে আবার রুমে চলে আসলাম। ব্যাগটা ঠিকঠাক মতো গুছিয়ে ফোনটা চার্জের থেকে ছাড়িয়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে আয়নার দিকে তাকালাম।

হঠাৎ সাফওয়ানের একটা কথা মনের মধ্যে ভেসে উঠলো। এরপর যখন বাইরে যাবেন বোরকা পরে বের হবেন।

ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে পাঁচকলিপ টা দিয়ে ভালো করে চুলটা আটকে নিলাম। তারপরে আলমারি থেকে হিজাব বের করে এনে সেট করে নিলাম। নিচে আমার ফুল হাতার লং ফ্রক পরা আছে।

আয়না দিয়ে একবার ঘুমন্ত সাফওয়ানের দিকে তাকালাম। মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে ঘুম ভেঙ্গে গেছে তার এখনই চোখ মেলে তাকাবেন তিনি। আমি তাড়াতাড়ি রুম থেকে বেরিয়ে আসলাম।

নিচে এসে দেখি পুতুল সোফায় বসে জুতোর ফিতে আটকাচ্ছে। আমি খালার কাছে এগিয়ে গিয়ে বললাম,

— খালার সময় মত কফিটা দিয়ে এসো। এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি তাই বলে যেতে পারছি না। তুমি বলে দিও আমরা ওই বাড়িতে গিয়েছি।

— আচ্ছা। হ্যাঁ রাতে হয়তো ঘুম হয়নি ছোট বাবার। ভোরবেলায় দেখলাম পুতুলের রুম থেকে বের হতে।

আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম পুতুলের রুমে ভোর বেলায় কি করছিলেন উনি। তারমধ্যে পুতুল বলে উঠলো

— প্রীতিলতা আমি তৈরি এবার চলো।

আমিও সমস্ত চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে পুতুলের হাত ধরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসলাম।

_______🌺🌺_______

কতক্ষণ ধরে কলিং বেল দিচ্ছে দরজা খোলার কোন নাম গন্ধ নেই। এবার দরজায় জোরে জোরে দুটো চাপড় মারলাম। এবার ভাই দরজা খুলে আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলল,

— আপু তুই আসছিস…!

পুতুল আমার পেছন থেকে সামনে এসে বলল,

— সাথে আমিও এসেছি প্রীতম ভাইয়া। হ্যাপি বার্থডে। এই নাও এগুলো তোমার গিফট।

— আরে বাবা আমার ছোট বোনু ওটা আমার জন্য গিফট এনেছে নাকি। থাঙ্কস বনু।

তুই দাঁড়িয়ে আছিস কেন আপু ভেতরে আয়। ভেতরে আসতে আসতে প্রীতম আবার প্রশ্ন করল,

— ভাইয়া কোথায় ভাইয়া আসেনি?

আমি কিছুটা ভেবে উত্তর দিলাম। আসবে ওর একটা কাজ বেঁধে গেছে তো। কাজ শেষ হয়ে গেলে চলে আসবে বলেছে।

— ও আচ্ছা। আম্মু দেখো আপু এসেছে।

আম্মু রান্নাঘর থেকে হাত মুছে বেরিয়ে এসো আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আম্মুর চোখে পানি চিক চিক করছে।

আমাকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,

— জামাই আসেনি?

— পরে আসবে বলেছে।

— ও। আরে এটা কে? যে আমাদের ছোট কুটুম।

পুতুল হেসে আম্মুকে জড়িয়ে ধরে বলল

— কেমন আছো আন্টি।

— খুব ভালো। তুমি কেমন আছো মা?

— ভালো।

আমি ব্যাগ থেকে পায়েসের বাটিটা বের করে আম্মুর হাতে দিয়ে বললাম,

— আম্মু আমি পায়েস বানিয়ে এনেছি।

আম্মু আমার হাত থেকে পায়েসের বাটিটা নিয়ে বললে,

— তোরা গিয়ে ভেতরে বোস আমি বাটিতে করে আনছি তোদের জন্য।

______🌺🌺______

এদিকে সাফওয়ান ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এসে বিছানায় বসলো। গায়ে গেঞ্জি আর ট্রাউজার পরা। ফোনে কি যেন দেখছে। এর মধ্যে খালা এসে সাফওয়ান এর সামনে কফির মগটা রাখলেন। সাফওয়ান কিছুটা অবাক দৃষ্টিতে খালার দিকে তাকিয়ে বলল,

— কফিটা আজ তুমি আনলে যে…

— হয় নতুন বউ তো চলে গেছে।

সাফওয়ান চমকে উঠলো। এতটাই চমকেছে যে তড়িৎ গতিতে দাঁড়িয়ে পড়ল। উচ্চস্বরে চেচিয়ে উঠে বলল,

কীহ…!

নিজের আচরণে নিজেই বিব্রত বোধ করল। আমতা আমতা করে বলল,

— চলে গেছে মানে…!

— নতুন বউয়ের ভাইয়ের আজ জন্মদিন। তাই পুতুল রে নিয়ে ওই বাসায় গেছে।

— ওহ।

খালা চলে গেলেন। সাফওয়ান বিছানায় বসে পড়ল। বিড়বিড় করে নিজেই নিজেকে বলল,

— আমাকে না বলেই চলে গেল…..!

চলবে….🌺