প্রেম প্রতীক্ষার রঙ পর্ব-০১

0
4

#প্রেম_প্রতীক্ষার_রঙ
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব- ১

হবু বর আহিলের পাশে নিজের বেস্টফ্রেন্ড রাইমাকে বউ সাজে হাত ধরাধরি করে একসাথে কফি খেতে দেখে চমকে গেল মুনা। দূর থেকে ও কিছুক্ষণ থমকানো ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল। বোঝার চেষ্টা করল আহিলের সাথে রাইমা এখানে কী করছে, তাও আবার এই সাজে। মুনা নিজেকে ধাতস্থ করে এবং প্রচন্ড বিস্ময় নিয়ে দু’জনের দিকে এগিয়ে গেল। গিয়ে
দাঁড়াল ওদের টেবিলের সামনে। আহিল আর রাইমা তখনো ওকে দেখতে পায়নি। তারা দু’জনে নিজেদের মধ্যে সময় কাটাতে ব্যস্ত।। ধীরপায়ে হেঁটে গিয়ে পেছন থেকে গলা খাকারি দিতেই আহিল আর রাইমা পেছনে ফিরে ওকে দেখে নাটকীয় ভঙ্গিতে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। কফির মগ থেকে অনেকটা কফি ছলকে পড়ল টেবিলে। মুনা অবশ্য সেদিকে দৃষ্টিপাত করল না।
আহিলকে সরাসরি প্রশ্ন করল,
— এসব কী?
এদিকে আহিল বুঝতে পারছে না কী বলবে। ও পুরোপুরি বোকা বনে গেছে। এভাবে হাতেনাতে ধরা পড়ে যাবে ঘূর্ণাক্ষরেও কল্পনা করেনি। ওর মাথা নিচু হয়ে গেল। মুনা জোরালো গলায় বলল,
— চুপ করে আছেন কেন? আমি আপনাকে কিছু জিজ্ঞাসা করছি মিস্টার আহিল। আপনি এখানে আমার বেস্টফ্রেন্ডের সাথে কী করছেন? কী সম্পর্ক আপনাদের?
আহিল ভড়কে গেল। মুনার গলার উঁচানো আওয়াজ শুনে৷ আশেপাশের টেবিলের সবাই তাকিয়ে তাকিয়ে ওদের নাটক দেখছে। মানসম্মান বলতে কিছু রইল না বোধহয়! আহিল আমতাআমতা করে বলল,
— প্লিজ মুনা, আস্তে কথা বলো। সিনক্রিয়েট করো না…
মুনা আশ্চার্যান্বিত হয়ে গেল,
— আমি সিনক্রিয়েট করছি না মিস্টার আহিল। আমি শুধু ছোট্ট একটা প্রশ্ন করেছি, যে আপনি রাইমার সাথে এখানে কী করছেন?
আহিল উত্তর দিলো না। উত্তর দেওয়ার মতো কিছু অবশিষ্ট নেই ওর কাছে। মুনা কোনো জবাব না পেয়ে এবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এবার রাইমার দিকে তাকাল,
— বিয়ে করেছিস দু’জনে?
রাইমা এতক্ষণ চুপ করে থাকলেও এবারে মাথা নাড়িয়ে সায় জানিয়ে বলল,
— হু, বিয়ে করেছি আমরা।
সরাসরি স্বীকারোক্তি রাইমার। একদম স্বচ্ছ। কোনো ভনিতা নেই। এটুকুই শোনার ছিল মুনার। ও দু’হাতে তালি দিয়ে বলল,
— কংগ্রাচুলেশনস তোদের নতুন জীবনের জন্য। আর হ্যাঁ, ধন্যবাদও প্রাপ্য! আমাকে মানুষ চিনিয়ে দেওয়ার জন্য!
আহিল ওকে এভাবে কাটকাট স্বরে কথা বলতে
দেখে ভাষা হারিয়ে ফেলল। অপ্রস্তুত বোধ করল। কোনোমতে বলল,
— আসলে মুনা হয়েছে কী ….
মুনা প্রচন্ড বিরক্ত হলো যেন। ঘৃণায় ওর শরীর গুলাচ্ছিল। ও থামিয়ে দিলো আহিলকে।
— আসলে নকলে রাখুন মিস্টার আহিল। আপনার মতো প্রতারকের মুখে আমি আমার নাম শুনতে চাই না। আর না চাই আপনার থেকে কোনো এক্সপ্লেনেশন শুনতে।
এ পর্যায়ে এসে রাইমা চেঁচিয়ে উঠল,
— আমরা দু’জন স্বেচ্ছায় বিয়েটা করেছি মুনা। তুই
কিন্তু এভাবে অপমান করতে পারিস না ওনাকে।
রাইমার কথা শুনে চুপ করে গেল মুনা।
পরপরই সঙ্কুচিত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে
স্মিত হেসে বলল,
— যে মেয়েটা গত রাতেও বিয়ে, সংসার নিয়ে এতগুলো কথা বলল, জ্ঞান দিল, আমার বিয়ে নিয়ে এত এত প্ল্যান করল সে মেয়েটা আমার সাথে এতবড় একটা বিশ্বাসঘাতকতা করার পর, এখানে দাঁড়িয়ে আমি তাঁর স্বামীকেই অপমান করছি? সরি রে। ভুল করে ফেলেছি।

বলে টেবিলের উপর আধখাওয়া কফির মগটা উঁচিয়ে বাকি কফিটুকু আহিল আর মুনার উপর ছুঁড়ে মেরে বেরিয়ে এলো রেস্টুরেন্টে থেকে। পেছনে তাকিয়ে দেখারও ইচ্ছে হলো না দু’জনকে। বড় রাস্তা পেরিয়ে এসে খানিকটা দূরে রাস্তার পাশে বসে রইল
অনেকটা সময়। কাঠফাটা রোদের ঝলকানিতে এমনিতেই অতিষ্ঠ জনজীবন।
এরমধ্যে নিজের প্রিয় বান্ধবী আর হবু বরের বিশ্বাসঘাতকতা! নিতে পারল না মুনা। ঘৃণায়, রাগে-দুঃখে নিজের মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে হলো
ওর।
কীভাবে আহিল আর রাইমার ভেতরে এত গভীর সংযোগ ঘটল সেসবও জানতে ইচ্ছে করল না ওর। শুধু দু’জনের কান্ডে প্রখর রোদের উগ্রতার মতোই মেজাজ টগবগ করে ফুটতে লাগল ওর।
অনেকক্ষণ পর ব্যাগ থেকে ফোন বের করে কল
করল আফ্রাকে।
— রাইমা আর মিস্টার আহিল আজ বিয়ে করেছে।
ফোনের ওপাশ থেকে আফ্রা চমকিত গলায় বলল,
— হোয়াট!!
— চমকাস না, চমকানোর কিছু নেই।
— তুই কীভাবে জানলি?
— হাসপাতালে গিয়েছিলাম একজনকে দেখতে। সেজন্য খাবার অর্ডার দিতে গিয়েছিলাম পাশের এক রেস্টুরেন্টে। এরপর হাতেনাতে ধরলাম। বিয়ে পরবর্তী সেলিব্রেশন করছিল!
আফ্রা আহত স্বরে বলল,
— এতবড় বিট্রে? রাইমা? ও কী পাগল? কেমনে পারল?
— জানি না। খবরটা দিতেই তোকে কল করলাম।
ফোন রাখ।
মুনা ফোন কেটে দিয়ে ব্যাগে ভরে উঠে দাঁড়াল।
কামিজ ঝেড়ে ধুলো ফেলে হাঁটা ধরল স্টুডেন্টের বাসায়। জীবন যে গতিতেই চলুক না কেন, টাকাপয়সা তো রোজগার করতে হবে! এ সমস্ত ছোট ছোট কারণের জন্য মন খারাপ করে থাকলে দিনশেষে লস নিজেরই। কিছু বিশ্বাসঘাতকের জন্য অহেতুক নিজের ক্ষতি করা ঠিক না।

_____

বেইলি রোডের সাদা ঝকঝকে বাড়িটা দেখতে যতটা সুন্দর ঠিক ততোটাই সুন্দর বাড়ির মানুষগুলোর মন।
কিন্তু কথিত আছে, সমস্ত সুন্দরের মধ্যে কিছু না কিছু খুঁত, ঝামেলা থাকবেই। এমনটাই হয়েছে এখানে। এবাড়ির সবগুলো মানুষ অতি ভালো হলেও বিরিয়ানির মধ্যে এলাচের মতো অতি খারাপ একটা লোকের বাস আছে এ বাড়িতে। নাম মিদহাদ কবির রোদ্দুর । মুনাকে দেখলেই যার দিন-দুনিয়া উল্টে যায়, হৃদযন্ত্রের সমস্যা দেখা দেয়! পারতপক্ষে এ লোকের মুখদর্শন করতে চায় না বলে নানানভাবে লোকটা মুনাকে নাজেহালও করে তুলেছে বিভিন্ন সময়।
এ বাড়ির ছোট মেয়ে রাহা। সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলে ক্লাস নাইনে পড়ে। মুনা তাকেই পড়ায়। ভালো স্টুডেন্ট বলে রাহাকে পড়িয়ে আরামও পায়। একারণেই হোক বা এ বাড়ির লোকেদের প্রতি অদৃশ্য এক টানের কারণেই হোক মুনা টিউশনিটা ছাড়াতে পারেনি।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কলিংবেল চাপলো মুনা।
মনে মনে দোয়া করল দরজাটা যাতে বুয়া বা অন্য
কেউ খুলে। রোদ্দুর নামক লোকটা না। মুনার আজ মেজাজ ভালো না। ও কোনোভাবেই চায় না এ
লোকের সামনে পড়তে আর গা জ্বালানো কথা শুনতে।
কিন্তু মুনার প্রার্থনা সফল হলো না। খালি গায়ে, হাফ প্যান্ট পড়ে, হাই তুলতে তুলতে দরজা খুলল রোদ্দুরই।
এরপর ভালো করে তাকিয়ে দেখল কে এসেছে আদতে। মুনাকে দেখে চোখ বড়বড় করে দরজার দু’পাশে হাত রেখে দাঁড়াল এমনভাবে যে রোদ্দুরের অবস্থা দেখে লজ্জায় মাথা কাটা গেল মুনার।
ও কোনদিকে দিয়ে ভেতরে ঢুকবে সেটাই বুঝল না।
মাথা নামিয়ে বলল,
— সরে দাঁড়ান, যাব!
রোদ্দুর কিছু শুনতেই পায়নি এমন একটা ভঙ্গিমা
করে বলল,
— আপনি কী কিছু বললেন? শুনতে পাইনি।
যত্তসব নাটক! মুনা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
— ভেতরে ঢুকব, সরুন।
রোদ্দুর চোখ বুজে পরায় সঙ্গে সঙ্গেই বলল,
— আমার মনে ঢুকো।
মুনা কড়া স্বরে বলল,
— কী বললেন?
— আমার মনের দরজা খোলা। দেখতে পাও না?..
মুনা খিটমিট করে বলল,
— দরজা কেন? নিজের মানইজ্জত সব খুলে যে
দাঁড়িয়ে আছেন তা সব দেখতেই পাচ্ছি। কষ্ট করে একটু রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ান, কিছু আয়-রোজগার হলেও হতে পারে!
মুনার কথা শুনে এ পর্যায়ে রোদ্দুর রেগে গেল।
— ম্যাডামের মুখে আজ খই ফুটেছে দেখছি!
মুনাও তিরস্কারের সুরে বলল,
— আপনার মনেও লাড্ডু ফুটছে দেখছি!
রোদ্দুরের রাগ প্রশমিত হলো। কিন্তু হাসলো না সে। ঠিকঠাক হয়ে দাঁড়ালো কেবল। একদম ভদ্র ছেলেদের মতো। কিন্তু গায়ে পোশাক না থাকায় তাকে দেখতে অদ্ভুত লাগছিল। মুনার হাসি পেল আচমকা, কিন্তু চেপে গেল। রোদ্দুর হাত দিয়ে চুলগুলো পেছনে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে গম্ভীর গলায় বলল,
— উহু! ভালোবাসার জোয়ার বইছে। কারো ধুলোমাখা জামা আর বাঁকানো টিপ দেখে!

রোদ্দুরের মুখ থেকে সোজাসাপটা এমন কথা শুনে মুনা থতমত খেল। ও আর এক মুহূর্ত দাঁড়াতে চাইল না ওখানে। দ্রুত ভেতরে ঢুকে পড়বে ঠিক তখনি রোদ্দুর ওকে আটকাল। মুনা বিস্মিত হলো। অপ্রস্তুত হলো। দৃষ্টিতে সেটা ফুটে উঠল। রোদ্দুর কপালে ভাঁজ ফেলে জলদগম্ভীর স্বরে আওড়াল,
— স্বার্থপর মেয়ে। কয়টা জামাই লাগবে তোমার? আমাকে ছাড়ানোর জন্য এতটাই উতলা হয়ে গেছ যে বিবেকবুদ্ধি সব বুড়িগঙ্গায় বিসর্জন দিয়ে এসেছ তাই না?
বলে তির্যক দৃষ্টি মেলে চায় মুনার দিকে। মুনা অবাক গলায় বলে,
— আপনি জানলেন কী করে?
— মনের টানে।
কটমট করে কথাটা বলে রোদ্দুর বেরিয়ে পড়ল সেভাবেই। মুনা সেখানেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।
কিন্তু রাহা এসে পড়ায় আরকিছু ভাবতে পারল না। ম্লানমুখে গিয়ে টেবিলে বসল পড়াতে। তবে মানসিকভাবে কিছুটা বিধস্ত থাকায় ঠিকঠাক পড়াতে পারল না। ছুটি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। ক্লান্ত, অবসন্ন দেহটা নিয়ে রাস্তার পাশের একটা টং দোকানের বেঞ্চিতে গিয়ে বসে পড়ল। এরপর আচমকাই রোদ্দুরকে সেখানে দেখতে পেল। আয়েশ করে চা-বিস্কুট খাচ্ছে। গায়ে টি-শার্ট আর কালো রঙের ট্রাউজার। মুনা কপাল চাপড়াল। কার মুখ দেখে ঘুম থেকে উঠেছিল যে আজ এত খারাপ দিন যাচ্ছে ওর?
মুনা কেটে পড়তে যাবে তার আগেই রোদ্দুর দোকানির উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
— আমার বউকে আপনার হাতের স্পেশাল এক কাপ
চা দিন চাচা। দুধ- চিনি ছাড়া, কড়া লিকার চা। খুব প্রেশারে আছে!

মুনার মাথা ঘুরে উঠল। চোখে সব অন্ধকার দেখতে পেল। কটমট করে চাইল রোদ্দুরের দিকে। এই লোক কী জীবনেও শুধরাবে না?

_____

চলবে…