#প্রেম_প্রতীক্ষার_রঙ
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৪
আকাশের আজ মন ভালো নেই। ক্ষণে ক্ষণে সে শুধু তার রুপ বদল করছে। কখনো সাদা কখনো কালো মেঘের চাদরে নিজকে ঢেকে নিচ্ছে। দমকা হাওয়ার সাথে ছুটাচ্ছে বৃষ্টিবাণ। টিপটিপ করে ঝরে পরা বৃষ্টি জলে প্রকৃতি নিজেদের ধুয়েমুছে নিয়ে সতেজ হচ্ছে।
তবে রাস্তায় জমছে কাদা পানি।
ক্লাস সিক্সের স্টুডেন্টকে পড়ানো শেষ করে মুনা মাত্র বেরিয়েছে। বৃষ্টি তখন নেই। ফুটপাত ধরে হাঁটতে গিয়ে কাদা জলে বারবার পা পড়ছে মুনার। যার কারণে জামাকাপড়েরও বেহাল দশা। আকাশি রঙের প্রিয় সালোয়ার-কামিজটা আজকেই মাত্র পরেছে ও। এরমধ্যে কাদা লেগে বিদঘুটে অবস্থা হয়ে যাওয়ায় মুনার বড্ড মন খারাপ হয়ে গেল। এই অবস্থায় হেঁটে হেঁটে বাড়ি যেতে ইচ্ছে করল না ওর। সেজন্য রিকশার খোঁজ করল। কিন্তু বৃষ্টি দিনে রিকশা পাওয়াটা মুশকিল হয়ে গেল ওর জন্য। শেষ পর্যন্ত যা-ও একটা পেল, রিকশাওয়ালা ভাড়া চাইল দ্বিগুণেরও বেশি।
তর্ক করেও লাভ হলো না। বিশ টাকার ভাড়া পঞ্চাশ টাকাতেই রাজি হতে হলো মুনাকে।
সিগন্যালে এসে থেমেছে রিকশাটা। ছোটখাটো যানজট সৃষ্টি হয়েছে। হঠাৎ করে মুনা বাঁ দিক তাকাতেই রোদ্দুরকে দেখল বাইকে বসে আছে। একা নেই। পেছনের সিটে একটা মেয়ে আছে। শাড়ি পরা, দারুণ সুন্দরী। নায়িকাদের মতো দেখতে। রোদ্দুরের কাঁধে রাখা মেয়েটার ফর্সা হাতখানা চকচক করছে দূর থেকেই। মেয়েটা হয়তো কিছু একটা বলছে, রোদ্দুর সুন্দর করে হেসে কথার উত্তর দিল মেয়েটাকে।
রোদ্দুরের কথা শুনে মেয়েটা লাজুকতায় মিলিয়ে গেল৷ চুলগুলো ঠেলে কানের পিছনে গুঁজে শক্ত করে ধরে বসল রোদ্দুরকে।
মুনা একদৃষ্টিতে ওদের দু’জনকে দেখে যাচ্ছিল। এমনভাবে আচরণ করছে যেন দু’জনের মধ্যে ভালোবাসার অভাব নেই। অথচ এতদিন কতকিছু করেই না মুনাকে বাগে আনানোর চেষ্টা করেছে,
কত ধর্ণা দিয়েছে রোদ্দুর!
আর এখন, ক’দিনেই ভালোবাসা শেষ!
নতুন গার্লফ্রেন্ড নিয়ে বাইকে করে ঘোরাঘুরি চলছে।
চলুক, তাতে মুনার কী? ও তো আর ভালোবাসে না রোদ্দুরকে। কিন্তু মনটা হঠাৎ এমন ভার লাগছে কেন?
মুনা বুঝতে পারল না। আচমকাই চোখাচোখি হয়ে গেল রোদ্দুরের সঙ্গে। সাথে সাথেই মুনা নিজের
চোখ সরিয়ে সামনে তাকিয়ে মুখ শক্ত করে রিকশাওয়ালাকে বলল,
— মামা, একটু দ্রুত চলেন। আমার তাড়া আছে।
যানজট তখনো সরেনি। একটু একটু করে গাড়ি এগুচ্ছে। রিকশাওয়ালা বিরক্ত হলো মুনার উপর,
— এই জ্যামর মইধ্যে আমি পঙ্খীরাজের মতো উইড়া উইড়া যামু নাকি? জ্যাম সরুক, সরলে যামু।
— আপনি গাড়িটা অন্তত আগান। এক জায়গায়
দাঁড়িয়ে থাকলে জ্যাম ছুটবে কী করে?
— আফনে আমার থেইকা বেশি বুঝুইন? অহন সামনে আগাইলেই খামু ঝাড়ি। এইজন্যিই কয়, মেয়েমানুষের আক্কেল কম!
মুনা রেগে গেল,
— ভদ্রভাবে কথা বলেন। তাড়া আছে বলেই বলছি।
— আপনিও আক্কেলওয়ালা কথা কইন।অত তাড়া থাকলে নিজের প্রাইভেট কার নিয়া বাইর হইবেন এরপর থেইক্কা।
রিকশাওয়ালার গলা চড়ে গেল। উচ্চস্বর শুনে আশেপাশেই অনেকেই তাকাচ্ছে। অদ্ভুতভাবে দেখছে!
রোদ্দুর যদিও তাকাচ্ছে না কিন্তু ওর পেছনে বসা মেয়েটা তাকিয়ে দেখছে। অস্বস্তিতে মুনার চোখমুখ দেখার মতো হলো! ও আর একটা কথাও বাড়াল না।
.
মুনা গোসল সেরে চুলে তোয়ালে প্যাঁচিয়ে বিছানায় গিয়ে বসল। মাথাটা প্রচন্ড ধরেছিল, পানি ঢালায় এখন ফ্রেশ লাগছে। ঠান্ডা হাওয়ায় গা এলিয়ে বসে ফোনটা হাতে নিলো। এরপর কী মনে করে গ্যালারিতে ঢুকল। ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে পেল রোদ্দুরের একটা ছবি। অবশ্য ছবিতে রোদ্দুর একা নয়। রাহাও আছে। দু’বছর আগে রাহারা ফ্যামিলি সহ কক্সবাজার ঘুরতে গিয়েছিল, তখন ছবিগুলো ও পাঠিয়েছিল মুনাকে।
মুনা রোদ্দুরের হাসিমাখা ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইল। নিঃসন্দেহে এই পুরুষ ভারী সুদর্শন। তার হাসি চোখে লেগে থাকার মতো। ওর স্ট্যাটাসের সাথে যায় কোনো বড়লোক ঘরের মেয়ে। ওর পাশে মানায় পরীর মতো দেখতে কোনো সুন্দরীকে। মুনার মতো ছোটখাটো, শ্যামলা গড়ন, যার পারিবারিক-আর্থিক অবস্থা নড়বড়ে, সে রকম কেউ কোনোভাবেই যায় না রোদ্দুরের সাথে। মুনা যখন এসব ভাবনায় মগ্ন তখন ওর পেছনে এসে দাঁড়াল নিপা। মুনার ভেজা চুল থেকে তোয়ালে সরিয়ে নিয়ে বলল,
— ভেজা চুলে বেশিক্ষণ থাকতে নেই, কতবার বলব তোকে?
মুনা চমকে গিয়ে ফোনটা ফোন অফ করে রেখে দিল। অপ্রস্তুত গলায় বলল,
— বেশিক্ষণ থাকিনি তো।
— জানি আমি তোর স্বভাব। সাফাই গাস না।
মুনা হেসে বলল,
— ওকে। আর সাফাই গাইব না আমার সুন্দরী ভাবি।
নিপা ওর গাল টেনে দিয়ে বলল,
— চা খাবি?
— তুমি বানালে অবশ্যই খাব।
— বস, নিয়ে আসছি।
নিপা দু-কাপ চা নিয়ে এলো পাঁচমিনিটের মধ্যে।
এরপর এসে বসল মুনার পাশে। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে নিপাকে লক্ষ্য করল মুনা। কেমন
যেন বিভ্রান্ত দেখাল নিপাকে। মুনা গলা খাকারি দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
— কিছু বলবে নাকি?
নিপা হাত কচলাতে কচলাতে ইতস্তত করে বলল,
— বলতে তো চাই, কিন্তু তুই কীভাবে নিবি…
মুনা চায়ের কাপটা বেড সাইড টেবিলের উপর রেখে আলতো করে ভাবির হাতদুটো নিজের মুঠোয় নিল।।নম্র সুরে শুধাল,
— বাবা-মা চলে যাওয়ার পর তুমি আর ভাইয়াই তো আমার সব। তোমরা আমার অভিভাবক। তাই এত হ্যাজিটেট করো না ভাবি। আর কখনো কী এমন কিছু হয়েছে যে তোমরা কিছু বলেছ, আর আমি অন্যভাবে নিয়েছি?
নিপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওর গালে হাত রাখল,
— না, কখনোই না।
— তাহলে কোনোকিছু নিয়ে ভনিতা করো না।
সরাসরিই বলে ফেল। ওয়েট, ওয়েট ভাইয়া কিছু বলেছে?
একটু সময় নীরবতা পালন করে নিপা বলল,
— আসলে তোর ভাইয়া তোর জন্য একটা প্রস্তাব এনেছে। ছেলে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। মা-বাবা নেই। দুটো বোন, ওদেরও বিয়ে হয়ে গেছে। ধানমন্ডিতে বাড়ি আছে। ওরা তোর ছবি দেখেই পছন্দ করেছে। তোর ভাইয়া বলায় আসতে রাজি হয়েছে।
মুনা অনেক অবাক হয়ে গেল,
— আমি কিছুই বুঝলাম না ভাবি। তোমরা আবার আমার বিয়ে নিয়ে পড়েছ?
নিপা বলল,
— বোন বিয়ের উপযুক্ত হলে বড় ভাইদের চিন্তা দিনদিন বাড়তেই থাকে। যতদিন না ভালো ছেলের হাতে তুলে দিতে পারছে ততদিন তোর ভাইয়ের মাথাও ঠান্ডা হবে না।
মুনা ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
— আহিল সাহেবের কান্ডের পর আবার…
— আরে ছেলেটা তোর ভাইয়ের পরিচিত। অনেক
দিনের জানাশোনা।
— তাই বলে এভাবে!
মুনার মুখ ছোট হয়ে গেল। নিপা বুঝল ওর মনের অবস্থা। মেয়েদের জীবনটাই এরকম। জীবনভর অন্যের মর্জি মতো চলতে হয়। পরিবার খুশি দেখতে হয়। তাতে জীবন জাহান্নাম হয়ে গেলে যাক, কারো কিছু যায় আসে না। শুধু অন্যের জন্য জীবন
স্যাক্রিফাইস করলেই পৃথিবী খুশি। নিপা মুনাকে সবসময় ননদ কম নিজের ছোটবোনের মতো দেখে। তাই ওর যাতে একটা ভালো পরিবারে, ভালো ছেলের সাথে বিয়ে হয় তা নিয়ে নিপারও ভাবনার অন্ত নেই।
ও বলল,
— আহিলের ওরকম কান্ডের পর তোর ভাই দুশ্চিন্তায় আছে তোকে নিয়ে। না করিস না বোন, তুই রাজি না হলে তোকে জোর করে বিয়ে দেব না। কিন্তু তোর ভাই যেহেতু ওদের আসতে বলেছে অন্তত দেখাসাক্ষাৎ হোক। তাছাড়া আগে হোক, পরে হোক বিয়ে তো করতেই হবে!
মুনার মন কিছুতেই সায় দিতে চাইল না বিষয়টাতে। কিন্তু ভাই-ভাবির কথা ভেবেই মনের বিরুদ্ধে গিয়ে রাজি হলো দেখাসাক্ষাৎ করতে। রাতে ওর ঘুম এলো না। মনে হলো কোনোকিছু যেন থমকে গেছে,
মুনা নিজেও থেমে গেছে। অজানা, অচেনা জ্বালাপোড়া এক ধরণের অনুভূতি তোলপাড় চালাতে লাগল ওর হৃদযন্ত্রে!
.
রোদ্দুর চোখ বন্ধ করে বারান্দায় বসে গান শুনছে। বৃষ্টিময় প্রেমের গান। গানটি ভেসে আসছে মৃদু বাতাসের সঙ্গে সঙ্গে, প্রতিটি সুরেই যেন মুনার হাসির রেশ মিশে আছে। মুনা ওর কল্পনায় উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। রোদ্দুরের চোখের সামনে ভেসে উঠছে ওর নানান
ছবি—সেই প্রথম প্রেমে পড়ার মুহূর্ত, বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়া! ওর মনে প্রশ্ন জাগে, মুনা কি সত্যিই ওর কল্পনায় আছে, নাকি এই সুরের সাথে মিশে গেছে? আচ্ছা এমনও কোনোদিন কী আসবে, যখন ওরা দু’জন একসাথে বৃষ্টিতে ভিজবে, প্রেমের গান গাইবে?
রোদ্দুর ভাবে, মুনার সাথে কাটানো প্রতিটি মূহূর্ত টক-ঝাল-মিষ্টির মতোন। মুনা কিছু না করেই ওর মনে কেমন এক অন্য জগৎ সৃষ্টি দিয়েছে, যার থেকে
ও কিছুতেই বেরুতে পারছে না। কতদিন মুনাকে সে এড়িয়ে চলছে? দেড়মাস! দেড়মাস যাবৎ মেয়েটাকে
সে জ্বালায় না, বিরক্ত করে না। ফোন দেয় না, কথা হয় না। এরপরেও মেয়েটা এক সেকেন্ডের জন্যও ওর মাথা থেকে বেরুয়নি। অথচ মুনা, আগের মতোই চলছে।কোনো হেলদোল নেই রোদ্দুর আছে নাকি গেছে!
হঠাৎ একটা বজ্রধ্বনি ওকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনে। জানালার দিকে তাকিয়ে দেখে, বৃষ্টি আসার প্রস্তুতি নিচ্ছে। রোদ্দুর আকস্মিক উঠে দাঁড়ায়। ফোন খুঁজতে থাকে। বালিশের নিচে ফোনটা সে খুঁজে পায়। ফোনটা হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ বসে থেকে রোদ্দুর ভাবে, মুনাকে একবার ফোন করে কথাটা জিজ্ঞেস করলে
ও কী খুব বেশি ছোট হয়ে যাবে?
.
____________
চলবে…