প্রেম প্রতীক্ষার রঙ পর্ব-০৭

0
5

#প্রেম_প্রতীক্ষার_রঙ
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৭

বাড়ি চলে যাওয়ার কথাটা মুনা রিমু বেগমকে জানাতেই তিনি বাধ সাধলেন। খানিকটা আপত্তি করলেন। তিনি চেয়েছিলেন মুনা আরেকটু থেকে একেবারে খেয়েদেয়ে তারপর যাক। মুনা বুঝল, কিন্তু ভাইয়ের দুশ্চিন্তার কথাটা বুঝিয়ে বলতেই
তিনি বুঝলেন এবং রাজি হলেন মুনাকে যেতে দিতে। তবে বললেন এত রাতে, অসুস্থ শরীর নিয়ে মঈন যাতে না আসে। মুনা যেন ওকে বারণ করে দেয় আসার জন্য। বাড়িতে গাড়ি আছে। ড্রাইভার নয়তো রোদ্দুর গিয়ে ওকে পৌঁছে দিয়ে আসবে। শুনে মুনার চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম হয়ে গেল। রোদ্দুর দিয়ে আসবে মানে?
এই লোকের সাথে তো ওর কোন মিলমিশ নেই,
কথাবার্তা নেই। রোদ্দুর তো ওকে এখন এড়িয়ে চলে।
সামনে পড়লেও এমন একটা ভান করে যাতে মুনাকে সে চেনেই না, কোনদিন দেখেনি। যেন মুনা পৃথিবীর সব দোষে দোষী। ওর মত অপরাধী নিষ্ঠুর আর কেউ নেই। তাহলে ও কেন রোদ্দুরের সাথে যাবে?
মুনা আপত্তি করতে লাগল। কিন্তু রিমু বেগম কিছুতেই ওর কথা শুনলেন না। উল্টো কারণ জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন। এ পর্যায়ে এসে মুনা একটু স্থিমিত হয়ে পড়ল। ও কীভাবে বলবে যে আপনার ছেলে আমাকে পছন্দ করতো এবং পুরো তিনটি বছর সে আমার পাণিপ্রার্থী হবার আশায় আমাকে জ্বালাতন করে গেছে এবং শেষমেষ আমার সায় না পেয়ে, আমার আচরণে দুঃখ পেয়ে সে এখন আমার সাথে কথা বলে না, চোখ তুলে তাকায় না, আমাকে ইগনোর করে চলে। আর আমারও এখন আপনার ছেলের দিকে তাকাতে কেমন লাগে, অনেকটা অপরাধবোধের মতো! কিন্তু এই অপরাধবোধের সাথে যে আমার অন্যরকম অনুভূতির বেদনার সৃষ্টি হয় সেটা আসলে কি আমি জানি না। বোধহয় আমি আপনার ছেলেকে এখন মিস করতে শুরু করেছি। যেটা আসলে ঠিক হচ্ছে না। মুনা কথাগুলো মনে মনে আওড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল! এতসব কথা রিমু বেগমকে বলতে পারবে না বলেই অগত্যা মুনা মাথা নামিয়ে চুপচাপ তার কথা মেনে নিল।
রিমু বেগমের হাতে কিছু কাজ ছিল। তিনি হাতের কাজ টুকু শেষ করে ছুটলেন ড্রাইভার আছে কিনা জিজ্ঞেস করতে। দারোয়ান জানালো সে নেই। একটু আগেই ইনামুল সাহেব আর এক বন্ধুকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়িসহ ড্রাইভারকে পাঠিয়েছেন।
রিমু বেগম হতাশ হয়ে ছুটে এলেন মোনার কাছে। এসে তড়িঘড়ি কন্ঠে বললেন,
— ড্রাইভার তো নেই। তোমার আঙ্কেল ড্রাইভারকে একজনকে পৌঁছে দিতে পাঠিয়েছে। রোদ্দুরকেই বলতে হবে। তুমি একটু অপেক্ষা করো, আমি বলে আসছি।
সুযোগ পেয়ে মুনা একটু আপত্তি জানিয়ে বলল,
— থাকুক না আন্টি। উনি অনেক কাজ করেছেন আজ। অনেক ধকল গিয়েছে। এখনো নিশ্চয়ই ব্যস্ত?
উনাকে বিব্রত না করলেও চলবে।
— যত ব্যস্তই হোক তোমাকে পৌঁছে দিতে বললে ও ঠিকই পৌঁছে দিবে। আফটার অল তুমি একটা মেয়ে। তুমি এখন আমাদের অতিথি আর আমাদের রেসপন্সিবিলিটি। তাই আমরা যা বলব সেটাই শুনতে হবে। কোনো কথা শুনছি না।
মুনা বুঝল আর আপত্তি জানিয়ে লাভ হবে না। রিমু বেগম ওর কোনো কথাই শুনবে না। অগত্যা মুনা ফোন করে মঈনকে বারণ করে দিল আসতে। প্রথমে মঈন যদিও আপত্তি করছিল তবে রিমু বেগম নিজে কথা বলে আশ্বস্ত করায় পরে রাজি হল। মঈনের সাথে কথা বলে রিমু বেগম গেলেন রোদ্দুরকে খুঁজতে। মুনা সোফার একপাশে চুপচাপ গিয়ে বসল। ড্রয়িংরুমে এখনো অনেক মেহমান। কাছের আত্মীয়দের মধ্যে কেউ কেউ থেকে যাবে আবার অনেকে চলে যাওয়ার প্রস্তুতিও নিচ্ছে। ইনামুল সাহেব তার একপাশে তার ক্লাসের সাথে যায় এমন লোকজনের সাথে গল্পগুজব করছেন।
এর মধ্যে রাহাকে দেখা গেল সে তার বন্ধু-বান্ধব, কাজিনদের নিয়ে খুবই ব্যস্ত। মুনাকে দেখতে পেয়েই কাছে ছুটে এলো। উৎসুক গলায় বলতে লাগলো কি কি উপহার পেয়েছে সবার থেকে। সব শুনে মনা মিষ্টি করে হাসলো। এরপর জানালো ও চলে যাচ্ছে। রাহায অবাক হয়ে বলল,
— এত তাড়াতাড়ি চলে যাবে? আরো কিছুক্ষণ থাকো।
— ওয়েদার ভালো না তো ভাইয়া-ভাবি চিন্তা করছে। আর দেরি করা যাবে না। পরশুতো পড়াতে আসবোই।
— ঠিক আছে। কিন্তু আমার মন খারাপ করে দিয়ে গেলে।
— ধুর পাগল।
বলে মুনা হেসে ফেলল। এরপর রাহার গাল টেনে দিল। এতে করে রাহাও হাসল। মিষ্টি করে বলল,
— তুমি যদি আমার বোন হতে তাহলে খুব ভালো হতো।
— তাই?
— হুম তাই।
মুনা আফসোসের সুরে বলল,
— তোমার মত মিষ্টি একটা ছোট্ট বোন থাকলে আমার ও খুব ভালো হতো।

রিমু বেগম এদিক-ওদিক খুঁজে এসে রোদ্দুরকে পেলেন ওর ঘরে। এসি ছেড়ে ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে ভীষণ ক্লান্ত। ওর পরনের হাত ঘড়ি, রুমাল,পাঞ্জাবিটা অবহেলিতভাবে বিছানায় পড়ে আছে।
জুতো পড়ে আছে দরজার একপাশে। রিমু বেগম ভেজানো দরজাটা ধীরে ধীরে খুলে ভেতরে ঢুকলেন। রোদ্দুর এর কাছে এগিয়ে দেখলেন ওর চোখ বন্ধ। তিনি ছেলের চুলে হাত বুলিয়ে ধীর গলায় ডাকলেন,
— খুব ক্লান্ত?
মায়ের কণ্ঠস্বর শুনে ফট করে চোখ খুলে রোদ্দুর বলল,
— কই! না তো।
— তাহলে এভাবে বসে আছিস যে? বাইরে গিয়ে সবার সাথে একটু কথা টথা বল।
— ওসব ফর্মালিটি করা শেষ আমার।
— আচ্ছা যাই হোক, তোকে একটা কাজ দিতে এলাম।
— কী কাজ?
— মুনাকে একটু ওর বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে।
চট করে রোদ্দুর রেগে গেল,
— কেন? একাই যেতে পারে আমাকে আবার কি প্রয়োজন।
রিমু বেগম ছেলের আক্কেল জ্ঞান দেখে কঠিন গলায় বললেন,
— মারব এক চড়। এত রাতে একা একটা মেয়েকে আমি যেতে দিব? তাছাড়া বাইরে বৃষ্টি।
— রোদ-বৃষ্টি যাই হোক না কেন উনি একাই একাই যেতে পারে। মুনা বেগমকে তুমি চেন না।
রিমু বেগম জোরাল গলায় বললেন,
— যেতে পারলে যাক। কিন্তু আমি যখন বলেছি তখন তুই গিয়ে দিয়ে আসবি। আজ তো ও আর রাহার ম্যাম হিসেবে আসেনি, এসেছে আমাদের অতিথি হিসেবে। তাই আমাদের তো কিছু রেস্পন্সিবিলিটি আছে। তাই না?
রোদ্দুর বিরক্তিকর গলায় বলল,
— তো আমার সাথে যেতে রাজি হবে নাকি মহারানী ভিক্টোরিয়া?
রিমু বেগম মুনা-রোদ্দুরের প্রেম বিষয়ক কিছু জানেন না। কিন্তু জানেন, ছেলে সবসময় মুনার পেছনে লেগে থাকেন। চোখ পাকিয়ে বললেন,
— হবে না কেন! তুই কি বাঘ না ভাল্লুক? ওকে রাজি করেই তোকে বলতে এসেছি।
রোদ্দুর বিস্ময়সূচক গলায় বলল,
— আপত্তি করল না?
— ওর ভাই নিতে আসবে বলে আপত্তি করছিল আমি না করে দিতে বললাম।
রোদ্দুর ফুঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
— আমাকেই যেতে হবে? ড্রাইভারকে বললে পৌঁছে দিয়ে আসতো৷
— তোর বাবা সালাম সাহেবকে পৌঁছে দিতে বলেছেন। ড্রাইভার তাকে নিয়ে গেছে।
রোদ্দুরের মেজাজ খারাপ হল। ওই অহংকারী মেয়ের মুখ দেখতে চায় না সে। আশেপাশেও ঘেঁষতে চায় না। তবুও মায়ের কথা রক্ষার্থে এসে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল,
— ওকে।
রিমু বেগম ছেলের কথায় আশ্বস্ত হয়ে আলতো করে হেসে চলে গেলেন। এদিকে রোদ্দুর জামা কাপড় পরে তৈরি হতে হতে মনে বলল,
— কী দিনকাল এলো, আমাকেই নাকি যেতে হবে মহারাণীকে পৌঁছে দিতে। আমি কি তার বডিগার্ড নাকি?

ঝিম ধরা বৃষ্টি। টুপটাপ ঝরছে। রোদ্দুর আগে থেকে গেইটের কাছে রিকশা ঠিকঠাক করে দাঁড়িয়ে ছিল। রিমু বেগম, রাহা, মুনা এল মিনিটখানেক পর। রিমু বেগম অনেক খাবারদাবার প্যাকিং করে মুনার সঙ্গে দিয়ে দিয়েছেন, ওর বারণ স্বত্তেও। মুনা রাহা আর রিমু বেগমকে বিদায় জানিয়ে রিকশায় ওঠার পর রোদ্দুর উঠল। মুনার জন্য প্যাকিং করে দেওয়া খাবারের ব্যাগ হাতে নিয়ে যথাসম্ভব দূরত্ব
রেখে বসল। তেজালো গলায় বলল,
— মামা চলুন।
রিকশা কিছুদূর এগিয়ে যেতেই বৃষ্টিটা বাড়ল। রোদ্দুর হাঁক ছেড়ে বলল,
— মামা, পলিথিন নেই? অবস্থা খারাপ, ভিজে যাচ্ছি।
— আছে মামা।
বলে রিকশাওয়ালা কাগজ বের করে দিলো। রোদ্দুর সেটা খুলে মুনার দিকে বাড়িয়ে ধরল,
— নিন, ঢেকেঢুকে বসুন।
মুনা বৃষ্টি থেকে বাঁচতে পলিথিন দিয়ে ঢেকে নিলো নিজেকে। কিন্তু খেয়াল করল রোদ্দুর ভিজে যাচ্ছে। তাই উচাটন কন্ঠে বলে ওঠল,
— একী! আপনি ভিজে যাচ্ছেন তো!
এরপর কাগজের বাড়তি অংশটা ওর দিকে দিয়ে বলল,
— এদিকে চেপে বসুন। তাহলে দু’জনের হয়ে যাবে।
রোদ্দুর সেটা ফিরিয়ে দিয়ে শক্ত গলায় বলল,
— অন্যের বউয়ের সাথে গা ঘেঁষে বসার অভ্যাস নেই আমার। নিজেকে নিয়ে ভাবুন।

মুনা হা হয়ে গেল ওর কথা শুনে। বিয়ে না করা
স্বত্তেও এখন ও অন্যকারো বউ হয়ে গেল?

_________

চলবে…